মামুন রশীদ ।। অঙ্গারের মতো সংযমে হীরকের জন্ম হয়
বাংলা কবিতা থেকে নিজস্বতা হারিয়ে যাওয়ার একটা আশংকার কথা একসময় বেশ জোরে সোরেই উচ্চারিত হয়েছিল। বাংলা কবিতাকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড় করানোর অজুহাত তুলে স্বেচ্ছাকৃত জটিলতা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন কেউ কেউ। বিভিন্ন ইজমের ধুয়া তুলে পরীা-নিরীার নামে বাংলা কবিতাকে পাঠক বিমুখ করে তুলতেই যেন সচেষ্ট ছিলেন সেইসব কবিরা। তারা সৃষ্টির পরিবর্তে নির্মাণের খেলায় মেতেছিলেন। যাতে করে বাংলা কবিতা থেকে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, শেকড়, রূপ, রস, গন্ধ হারিয়ে যেতে বসেছিল। সেই স্রোতে হারিয়ে যাওয়া বা গা ভাসিয়ে দেওয়ার বিপীরতে কেউ কেউ, শেকড় সন্ধানীরা উদ্দেশ্যহীনতার পথে বাংলা কবিতাকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে, লাগাম টেনে ধরেছিলেন। তারা আমাদের ইতিহাস, ঐহিত্যের ভেতর দিয়েই বাংলা কবিতাকে বৈশ্বিক করে তোলার জন্য সচেষ্ট থেকেছেন। বাংলা কবিতার যে উজ্জ্বল ঐতিহ্য, তাকেই সযতেœ লালন করেছেন। এই ধারার, এই বিবেচনার কবিতা চর্চা প্রতিটি যুগেই হয়েছে।
সাম্প্রতিককালেও তার ব্যতিক্রম নয়। সব কবিরই চেষ্টা থাকে কবিতায় নিজের স্বাতন্ত্র্য ফুটিয়ে তোলার। কবিতায় নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চান সব কবিই। আর এটা করতে গিয়ে কেউ কেউ নিজের ভেতরের জটিলতা, বৈপরীত্য, বোধকে প্রাধান্য দেন। আবার কেউ অন্তর্গত বেদনার সঙ্গে চেনা দৃশ্য, চেনা পরিবেশকে মিলিয়ে পাঠকের সামনে সহজ, সুন্দর একটি দৃশ্য নির্মাণ করেন। যাতে করে সেই পরিচিত দৃশ্যাবলী অদ্ভুত স্বপ্নময় হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। পাঠক নিজেকে নতুন করে দেখতে পায় কবির দেখানো আয়নায়। কাজী নাসির মামুন সাম্প্রতিক সময়ের সেই শ্রেণীর প্রতিনিধি। যে নিজেকে নিজের বোধকে বহুমাত্রিকতায় পাঠকের সামনে মেলে দিতে পারে। কাজী নাসির মামুনের সচেতন মন, তার নির্মিত দৃশ্যাবলী পাঠকের মনকে স্বস্তি দেয়। চেনা জগতের জটিলতা নানান সংকেত, চিহ্ন এবং শব্দের সাঁকোতে মামুনের কবিতায় নতুন জগৎ তৈরি করে। আর কাজী নাসির মামুনের দেখা বস্তুও নিরপে নয়। তাই পাঠককে নেশার ঘোরের মতো কবিতার ভেতের ঢুকে পড়তে সহায়তা করে। পাঠককে কবিতার ভেতর ডেকে আনতে মামুন কখনো আশ্রয় নেন ছন্দের, আবার কখনোবা ছন্দহীন গতিময় গদ্যের। মামুনের সংবেদনশীলতা, অনুসন্ধিৎসা বাংলা কবিতার ধারাবাহিক উত্তরাধিকারকে চিহ্নিত করে। কাজী নাসির মামুন তার ‘লবণপ্রার্থনার দিনলিপি’ কবিতায় যখন লেখেÑ
বাগান সংগুপ্ত রেখে
তুমি কেন পাথর ভালোবাসো?
দেয়ালে শ্যাওলা জমে
কাঠামো গুঁড়িয়ে দিলে ধুলো জমে
প্রতœ-প্রবেশিকায়
অতীত মোহিত করে তুমি কেন
পিছনে হাঁটো?
তাল গাছ নীরবে বাড়ে। ঝড়েও লুটিয়ে পড়ে না।
তোমাকে পাহাড় দিলাম। মৌনতায় উঠে আসো।
পুলক ছড়িয়ে দিলে
সঙ্গে কিছু বিষাদের দায় থেকে যায়
ঢেউয়ে ঢেউয়ে জীবন মিলিয়ে দেখো
সমুদ্র কখনো লিখবে না লবণ প্রার্থনার দিনলিপি।
বিষাদ তাড়িত হলে তুমি কেন আকাক্সা মাড়াও?
অপূরণের দাবানলে
মানুষ কেবলি ছাই হতে চায়, সোনা নয়।
হৃদয়ে আকাশ গুঁজে রাখো
মেঘে মেঘে স্বপ্ন খুঁজে পাবে।
মৃত্যুকে প্রেমের জন্য উপাত্ত ভেবো না
তোমাকে শোনাবো লুপ্ত পাথরের গান।
(লবণ প্রার্থনার দিনলিপি: কাজী নাসির মামুন)
কাজী নাসির মামুন হতাশাবাদীদের দলে নয়। তার কবিতায় প্রাণের আবেগের ফল্গুধারা শোনা যায়। সেখানে শরীর খুঁজে পেতেও পাঠককে কষ্ট করতে হয় না। শরীরকে ধারণ করেই কবিতায় কাজী নাসির মামুন জীবনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। যা কাব্যপিপাসু মনকে সুস্থির করে আশ্বাসের বাণী শোনায়।
সাম্প্রতিক সময়ের আর এক প্রতিনিধি চন্দন চৌধুরী। নতুন শতাব্দীর সূচনাপর্বেও প্রতিনিধিদের মাঝে চন্দন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত। সাহিত্যের সব শাখাতেই তার বিচরণ। চন্দনের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যাও একের অধিক। চন্দন যেমন শিশুদের জন্য লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তেমনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্যেও তার বিচরণ অবাধ। কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি তাই প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং শিশুতোষ গ্রন্থও রয়েছে তার নামের পাশে। তবু সব মিলিয়ে চন্দনের পরিচিতি কবিতা লেখার জন্যই। চন্দনের কবিতায় ল্যণীয় বিষয় হলো আবেগের প্রাধান্য। তবে আবেগের প্রাবল্যে চন্দন কবিত্বকে বিসর্জন দেয় না। নিজের ব্যক্তিসত্ত্বা, বোধ, বিবেচনা এবং সর্বোপরি নিজের দেখা প্রাত্যহিক জীবন চন্দন চৌধুরীর কবিতার বিষয়বস্তু। আর একে কাব্যবিন্যাসে ফুটিয়ে তোলার জন্য চন্দন জীবনকে নানাভাবে নেড়ে চেড়ে দেখেন। এই নেড়ে চেড়ে দেখা থেকেই চন্দনের কবিতায় ফুটে ওঠে বাংলাদেশের ছবি। সেখানে বাংলার প্রকৃতি, মাটি, জল, হাওয়া তার ব্যক্তিত্বে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। জীবনযাপনের প্রাত্যহিকতায় চন্দন নিজেকে তুলে ধরেন পাঠকের সামনে। আর এই তুলে ধরা থেকে পাঠকের পে চন্দনের ব্যক্তিত্ব বুঝে নেয়া সম্ভব হয়। ব্যক্তিসচেতন চন্দন তার কবিতার ভেতর দিয়ে নিজেকে উন্মোচন করে দেয় পাঠকের সামনে। সেখানে, চন্দনের কবিত্বের এই গুণের জন্য তার কবিতা তখন শুধু শিল্পের জন্য শিল্প হয়ে থাকে না। তখন তা হয়ে ওঠে ব্যক্তি চন্দনের অনুভূতি, যা ব্যক্তি চন্দনকে ছাপিয়ে পাঠকের হৃদয়ের দরজাও খুলতে বাধ্য করে। নাড়া দেয় ব্যক্তিহৃদয়ের নিভৃতে লুকিয়ে থাকা একান্ত আমিকে। এেেত্র চন্দন চৌধুরী’র ‘চৈতি ও চন্দ্রবিষয়ক’ কবিতাটি পাঠকের সামনে উপস্থিত করা যেতে পারেÑ
এই পড়ন্ত বইমেলায় তোমার টিপের চাঁদে
বসন্ত সাজানো দেখে আমি হই চন্দ্রচিকিৎসক
আর তখন তোমার স্পষ্টতম জোনাকিরা অদৃশ্য শাসায়Ñ
বাইরে মাড়িয়ো না পা, পরাজিত হবে।
চৈতি, আমি শতবার পরাজয়ের লোভে সে-ই বাইরে বাড়ালাম পা।
(চৈতি ও চন্দ্র বিষয়ক : চন্দন চৌধুরী)
এ সময়ে ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধানী, কবিতা চর্চাকারী মোহাম্মদ নূরুল হক। মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতা চিত্রকল্পময়। সেইসঙ্গে সবসময়ই তার কবিতায় একটি মেসেজ থাকে। কবিতার পংক্তিগুলোর সমন্বিত বাঁধনের ভেতর দিয়ে পুরো একটি দৃশ্য রচিত হয়। যাতে করে বাংলা কবিতার সম্পূর্ণ নিজস্ব ঢঙ অনুভূত হয়। এেেত্র মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘স্রোতের নামতা’ কবিতাটি পাঠ করে দেখতে পারিÑ
ডালিম দানার মতো লাল লাল কামুক সূর্যাস্তে
লাফিয়ে উঠুক মুঠোবন্দি রাধিকার স্তন। আর
সমস্ত আকাশ সেই শিতি মন্থন দৃশ্য দেখে
নাত্রিক বেদনায় কেঁদে কেঁদে উঠুক এবার।
জ্বলন্ত সূর্যের ঠোঁটে চুম্বন এঁকেছি চণ্ডীদাস।
আয় রজকিনী ঘাটেÑ রসের দিঘিতে আমি ঢেউ।
নদী নদী জল এনেÑ আয় তৃষ্ণা মেটাবি দিঘির।
জানি তোর কোমরের কলসে প্রেমের বিষ নাচে
তোর চুলের বেণীতে ফনা তোলা সাপের নিশ্বাস
তোর চোখের তৃষ্ণায় পুড়ে খাক সহস্র সমুদ্র
চান্দের আন্ধারে নামে গেলাশ গেলাশ প্রিয়ঘুম
আমি ঘুম পান করিÑ রাত খাই কালান্ধ-সন্ধ্যায়
বয়স্ক রাতের দিঘি ঢেউ তোলে শরীরে আমার।
তোর গতরের নদী স্রোতের নামতা শেখে নাই?
(স্রোতের নামতা: মোহাম্মদ নূরুল হক)
এ সময়ে ঠিক ভিন্ন ধরণের কবিতা লিখেছেন জাকির জাফরান। তার কবিতা আমিত্বময়, আকৃতিতে ছোট। কাব্যের পঙ্ক্তি বিন্যাসও স্বল্পদৈর্ঘ্যরে। ছোট ছোট চেনা শব্দে জাকির জাফরান নিজের জগৎ, নিজেকে পাঠকের সামনের উন্মোচন করেন অকৃত্রিমভাবে। যেখানে পাঠকের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না, জাকির জাফরানের জগৎ-এর সঙ্গে তার জগৎ-এর পার্থক্য। চেনা শব্দে, চেনা দৃশ্যে জাকির জাফরান যে পঙ্ক্তি নির্মান করেন তা থেকে কবিতা পাঠকের অনুভূতি খুব দূরের নয়। তাই তার কবিতার সঙ্গে, তার জগৎ-এর সঙ্গে, তার চিন্তার সঙ্গে পাঠক একাত্মতা অনুভব করেন। যার কারণে জাকির জাফরানের কবিতা উদ্ধৃতিযোগ্য। তার কবিতা পাঠকের হৃদয়ে প্রভাব সঞ্চার করতেও সম হয়। সহজবোধ্য পংক্তিবিন্যাস হলেও জাকির জাফরানের কবিতা দূর-সঞ্চারী। দূর সময়ের ইঙ্গিত দেয়। পাঠককে ভাবনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে সম হয়। বাংলা কবিতার মৌল উপাদান সমৃদ্ধ হয়ে তাই জাকির জাফরানের কবিতা ইতিহাস ঐতিহ্য চেতনার রাস্তায় হেঁটে চলে। আর এই হেঁটে চলার ভেতর দিয়ে নিজের অনুভূতিকে পাঠকের সামনে ছড়িয়ে দিতে পারে জাকির জাফরান। যেমনÑ
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন
বললেন: ধরো, ডালে-বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেল
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি?
অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে-পাখিটির দিকে
আর মনে এলো তুমি আজ স্কুলেই আসোনি।
(চিঠি: জাকির জাফরান)
একটি কবিতা লেখার জন্য কবিকে অনেক অকবিতা লিখতে হয়। অন্যের প্রভাব কাটিয়ে নিজের স্বতন্ত্রতা নির্মাণের জন্য পুন পুন নিজেকে নিয়োজিত করতে হয় শিল্পের ভুবনে। শিল্পের ভুবনে নিজেকে স্থাপিত করার প্রয়োজনে কেউ কেউ এেেত্র নিজের মনোজগৎকেই প্রাধান্য দেন, আবার কেউ কেউ নিজেকে নয় বরং বহির্জগতের দিকে মেলে দেন তার দৃষ্টি। কেউ হয়ে ওঠেন অন্তুমর্ুুখী, নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধি সজ্ঞাত অভিজ্ঞতাকেই কাব্যের বিষয় করে তোলেন। ফুটিয়ে তোলেন অন্তর্গত বেদনার দিক সকল। নিজের ব্যক্তিসচেতন মনকেই পাঠকের সামনে মেলে দেন, পাঠকের সামনে নিজের জগৎ মেলে দেন। সেরকম একজন কবি নিতুপূর্ণা।
যদি আরো বিকেল বরাবর হাঁটতে বের হইÑ সন্ধ্যা হবে, ঘেঁটুর গন্ধ মনে প্রতœ চেহারা নিয়ে ফিরবেÑ কাঁঠালপাতার কষ বাড়লে দুপুরের কান্তি লাগবে পায়েÑ চোখে! রাতে দিদিমার বাতাস গল্প ফেলবে হোগলার গিঁটে গিঁটে। চিনুয়া আচেবে আপনাকে মনে রেখে বলছিÑ তখন আমি গল্পের কুমারী হবো, গল্প পাকলে জিওনকাঠি খুঁজবো কুমারের জন্যেÑ
না না আপাতত রাজ্য ভাববো নাÑ
রাজ্যে প্রতিদিন বাস করি কি-না!
(জাদুর এই বাস্তবতায় গল্প বলা: নিতুপূর্ণা)
শব্দের জটিলতা ছাড়াও যে কবিতা রচনা সম্ভব। সহজ-সরল ভাষ্যের ভেতর দিয়ে নিজের অনুভূতিকে যে প্রকাশ সম্ভব। উত্তর-আধুনিকতার আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ভেতর দিয়েও শব্দের বিচিত্র বর্ণবিভায় নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলা সম্ভব। এ সময়ের কবি মিজান মল্লিকের কবিতা সেই বেলাভূমি নির্মাণ করে। শব্দের দ্যোতনায়, কোন উদ্দেশ্যহীন স্বপ্ন নির্মান নয় বরং সযতেœ নিজেকে নির্মাণের প্রচেষ্টা মিজান মল্লিকের কবিতা ধারণ করে। তার কবিতা শ্রমসাধ্য কোন কৌশলীর নির্মাণ নয়। হৃদয় খুঁড়ে শব্দের বেলাভূমি সেঁচে, খুঁজে খুঁজে হীরা-মনি- মুক্তা দিয়ে অভিনব করে নিজেকে উপস্থাপনের প্রয়াস। মিজানের একটি কবিতা উদ্ধৃত করিÑ
দূর গ্রাম থেকে খাদ্য বয়ে আনো
বৃদ্ধ কঙ্কালসার ঘোড়া।
কতকাল পিঠে চড়েছি পুরো পরিবার
ছিঁড়ে নিয়েছি তোমার মাংস,
উৎসবের দিন রন্ধনশালা থেকে
বাতাসে ছিটিয়ে নিয়েছি মশলার ঘ্রাণ।
তোমার পাহাড়ি ধসনামা চোয়াল থেকে
নামিয়ে রেখেছি
ছুটির আবেদননামা।
জুতা পায়ে ঘোড়ায় চড়তে অভ্যস্ত
আমরা মাংসাশী।
আমার মেয়ে পিটে সওয়ার হলে
মনে হয়, আমিও পিতা হয়েছি।
(পিতা: মিজান মল্লিক)
সব কবিতাই প্রভাব সঞ্চারী হয় না। সব কবিই পারে না প্রভাব বিস্তার করতে বা তাদের চিন্তার উৎসারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। তারপরও কবি পাঠকের সঙ্গে নিজের হৃদয়ের, চিন্তার দূরত্ব ঘোচাতে ক্রমাগত শব্দের পর শব্দ দিয়ে সেতু তৈরির চেষ্টা করেন। কুয়াশার চাদর দূরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। ব্যাপারটি শ্রমসাধ্য। কারো কারো কবিতায় এই শ্রমের চিহ্ন স্পষ্ট, কারো অস্পষ্ট। কারো কবিতা পড়ার পর পাঠকের মনে হয় নির্মাণ। যেন কবি সেতু নয়, শব্দের ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা করেছেন। আবার কেউ স্পষ্টই সফলতার দিকে এগিয়ে যান আপন বর্ণবিভায়। নিজের স্বতন্ত্র স্বর ও সুর নির্মাণের প্রয়াসী হন। ইমতিয়াজ মাহমুদ বাংলা কবিতার প্রবাহকে সচল রাখতে নিরন্তর প্রয়াসী। ইমতিয়াজ মাহমুদ কবিতার সঙ্গে, কবিতার আবেগের সঙ্গে নিজের মস্তিষ্ককে জুড়ে দিতে চান প্রায়ই। নিজের স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে কখনোবা শব্দের বানানেও চমক তৈরির প্রয়াসী। যা অনেক সময় বাধাগ্রস্ত করে সহজ স্বাভাবিক পাঠ। তারপরও কাব্যগুণ বিচারে ইমতিয়াজ তার বিশাল কল্পনাশক্তির সঙ্গে মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে উৎরে যায়, ভাবিত করে পাঠক হৃদয়, দ্বিধাহীনভাবে তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করে। ইতিহাস ঐহিত্যের সঙ্গে বৈশ্বিক প্রোপট মেলানোর প্রচেষ্টা ইমতিয়াজের স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করে। যেমনÑ
সোমালিয়ার শিশুর যে ভাষায় কাঁদছে, বাংলাদেশ বা স্পেনের শিশুরাও
সে ভাষায় কাঁদে। তাদের বর্ণমালা সহজ। উচ্চারণও এক। যেমন খরগোশ
বা শেয়ালের ডাক অনুবাদ করার জন্য কোন ভাষা বিজ্ঞানীর প্রয়োজন পড়ে
না। বিশ্বব্যাপী পশুদের ভাষা এক। পশু ও শিশুরা একই স্বভাবের।
মানুষ আলাদা রকম।
(বৈসাদৃশ্য: ইমতিয়াজ মাহমুদ)
সম্প্রতি লিখেছেন অনেকেই। তাদের কারো সম্পর্কেই শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। কেউই সম্পূর্ণভাবে নিজেকে মেলে ধরার মতো করে, সবার চোখে পড়ার মতো, ঘোর লাগানো, চোখ ধাঁধানো, চমকে দেয়ার মতো এখনো কিছু করে উঠতে পারেন নি। তবে কবিতার ভুবনে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে, স্বতন্ত্রতা চিহ্নিত করতে সবাই সচেষ্ট। কে সফল হবেন, আর কারা সফল হবেন না, ঝড়ে পড়বেন দশক পেরুনোর আগেই তা নির্ণয় করার সময় এখন সুদূর পরাহত। তবু বাংলা কবিতার নিজস্বতার ভেতরেই চেষ্টা করছেন সবাই। এ দলে রবু শেঠকেও রাখা চলে। রবু’র লেখা থেকে একটি কবিতা উদ্ধৃতি করিÑ
গাঁয়ের ভিতর জন্মে যারা শহরে ওঠে
তারা ভুল করে:
ফুলের পিছনে ছোটে,
তোমার নিকটে আমার তেমন ভুল আছে
গাঁও খুব সরল শিক
ভুলেরা তার বিনম্র ছেলে
(গাঁও: রবু শেঠ)
ঐতিহ্য থেকে সরে আসা মানে নিজেকে অসহায় করে রাখা। এ সময়ের কবিরা যেন পূর্বপাঠ থেকে এই শিা খুব ভালো করে আত্মস্থ করেছে। তাই বারবার তাদের চেতনায় ঢেউয়ের মতো আচড়ে পরে আমাদের সময়, স্বকাল। সময়ের অস্থিরতা, সাম্প্রতিকতা কিছুই উপয়ে নয় আর কবিতায়। তবে একে বিজারিত করে, নিজের মনকে আত্মস্থ করে উপস্থাপনেই আগ্রহী এ সময়ের কবিকুল। এেেত্র কাব্যসত্ত্বায় পূর্ববর্তী অগ্রজরাও হানা দেয় চুপিসারে। তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে চেতনে, অবচতেনে। পূর্বজের সর্বগ্রাসী প্রভাব সন্তর্পণে কাটিয়ে তারা জ্বলে উঠতে চান নিজস্বতায়। নিজেদের গল্প, নিজেদের ভাষা নির্মাণ, প্রতিভার চর্চা, সময়ের অস্থিরতার ভেতর থেকেই ফুটিয়ে তুলতে প্রয়াসী। আজকের কবিমন। এসময়ের প্রতিনিধি জাহানারা পারভীনও নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেÑ সাধনায়, গোপন সংকেত পাবার আশায়Ñ
মানুষের শরীরেও নাকি ঘ্রাণ থাকে!
অথচ আমি ঘামের গন্ধ ছাড়া কিছুই পাইনি।
পরিপাটি শরীরের কাছাকাছি হেঁটে যেতে যেতে বহুবার
নাকে এসে বিঁধেছে পরিচিত পারফিউম,
মানুষ নয় শিশুদেরই ঘ্রাণ আছে শুধু;
প্রতিটি মানুষ ঘুমের মধ্যে কী চমৎকার শিশু হয়ে যায়!
(ঘ্রাণ: জাহানারা পারভীন)
দেখা অদেখা জগৎ-এর রহস্য উন্মোচনে আমরা বিভাজিত হয়ে যাই দু‘দলে। আস্তিক এবং নাস্তিক এই দুই বিশ্বাসের ভেতর থেকে একদিকে যেমন চরম হতাশার সুর অন্যদিকে তেমনি জীবনের মৌল উপাদানগুলো খুঁজে ফেরার তত্ত্ব-তালাশও চলে। তার ভেতর দিয়েই ফুটে ওঠে জীবনের বহুমাত্রিক ছবি। কেননা জীবনকে বাদ দিয়ে নয় কোন কিছুই। জীবনকে খোঁজার, বোঝার ভেতার দিয়েই মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির পথে এগিয়ে যান কবি। যুক্তির, অতীতের, বিশ্বাসের, আস্তিকতার মধ্য দিয়ে দূর সময়ের, নিজের মনোজগৎ চেনানোর প্রয়োজনেই নিজেকে উন্মোচন করেন কেউ কেউ। ফেরদৌস মাহমুদ কবিতার প্রোপট বিবেচনায় রেখেই নিজেকে মেলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছে কবিতায়। অদৃশ্য শক্তির প্রতি আস্থা রেখেই ফেরদৌস মাহমুদ কবিতার অনন্ত যাত্রায় সামিল করেন নিজেকেÑ
বাতাসে সবকিছু নিশ্চয় থেকে যায়, তা-না হলে
আমাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের নিয়ে
কথা হয় কীভাবে?
মৃত্যুর পর
নিশ্চয় জেনে ফেলে মানুষ
জীবতদের গোপনীয়।
গত জন্মে আমি কোকিলের ডিম হয়ে কাকের ঘরে জন্মেছিলাম
আগে মানুস হয়ে কাক শিকারের বিরুদ্ধে বলেছি কথা, আমাকে সবাই জানে
কোকিলের মতো কবি বলেই।
(টমাস মানের একটি গল্প পড়ে: ফেরদৌস মাহমুদ)
বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ এরকম কবি দশকে দশকে আসে না। এমন সর্বগ্রাসী প্রতিভার মর্মভেদী উচ্চারণ যদি প্রতি দশকে শোনা যেত? এমন নামের জন্য পাঠক আতীব্র অপোয় সময় কাটান। তারপরও এরকম নামের দ্যুতিতে আমরা রৌদ্রের ঝলক দেখতে পাই। সংক্রামিত শব্দের মিছিলে যারা এগিয়ে আসে তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি। যদিও মতার অভাবে দশকে দশকে টবে লাগানো স্বপ্নের চারাগাছ রৌদ্রের মুখ দেখে না প্রায়ই। তবু আমরা প্রতি দশকেই স্বপ্নবিদ্ধ হয়ে উঠি, শব্দের আগ্রাসনে, যেন মতার অভাবে কেউ হারিয়ে না যায়। বরং শব্দে শব্দে অসাধারণ সংহতিতে, বাঁধনে, বুননে চমৎকার করে ফুটে উঠুক এক একটি লাল গোলাপ। শব্দের শূন্যতা, নিরবতা ভেঙ্গে জেগে উঠুক আরক্ত গোলাপ। ফাঁকা স্থানগুলো ভরে যাক চমকে, শব্দে থেকে শব্দে। কারণ আমরা জানিÑ ‘নিষ্পেষণে ক্রমে ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে/ হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত।’ (বিনয় মজুমদার)।
তাই আজকের কবির কবিতা কঠোর অগ্নিপরীার ভেতর দিয়ে, রূপান্তরে, ক্রমশ দ্যুতিময় হীরক খণ্ডে প্রকাশিত হবে। কেউ হয়তো তীব্র চাপে, আগুনের হলকা এখনও ঠিক বেরিয়ে আসে নি যদিও, তবুও, যাকে দেখে মনে হবে, আলাদা, স্বচ্ছ, স্ফটিক অথবা অঙ্গারের মতো তীব্র। আমরা সেই জাদুকরী প্রতিভার জন্য তৈরী। হয়তো অত্যুক্তি শোনাবে, তবু আমরা প্রতীা করবো, অমোঘ অব্যর্থভাবে সাম্প্রতিক সময়ের বৃত্ত ভেঙে কেউ যদি বেরিয়ে আসে? মহাকালজয়ী প্রতিভার মতো না হোক, সাম্প্রতিকতা পেরিয়ে যদি কেউ সময়ের ক্ষুদ্রসীমার বাইরে নিজেকে প্রকাশিত করতে পারে অঙ্গারের মতো সংযমে। এজন্য আমরা তৈরি।
আমিনুল ইসলাম ।। নজরুলের গানে শব্দের ব্যবহার
কবিতার ক্ষেত্রে শব্দই ব্রহ্ম বলে একটা কথা
চালু আছে। সুনির্বাচিত শব্দের সুবিন্যস্ত প্রকাশই কবিতা। আর গানের ভিত্তি
হচ্ছে কবিতা বা গীতিকবিতা। কবিতাকে সুর দিয়ে গান বানানো হয়। সেজন্য গানের
ক্ষেত্রেও শব্দের সুষম ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গানের বাণী খুব দুর্বল
হলে সুর ভালো হওয়া সত্ত্বেও তা পাঠকের মনে স্থায়ী আসন পেতে ব্যর্থ হয়।
অবশ্য যন্ত্রসংগীতের ব্যাপারটি ভিন্ন। বাংলা ভাষায় লালনশাহের পর যারা
সমৃদ্ধ বাণীর ওপর ভিত্তি করে গান রচনা করেছেন__ তারা হলেন রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন এবং কাজী নজরুল
ইসলাম। তাদের মধ্যে নজরুলের গানের সংখ্যা সর্বাধিক এবং তিনি সবচেয়ে বিচিত্র
ধরনের গান রচনা করেছেন। তাঁর গানে সুরবৈচিত্র্য অতুলনীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি।
তিনি রাগপ্রধান গান, শ্যামা সংগীত, ইসলামি গান, গজল, লোকসংগীত, ঝুমুর,
ঝাপান, ভাটিয়ালি, প্রেমগীতি, দেশাত্মবোধক গান, জাগরণী গান এবং বিভিন্ন
দেশের গানের সুরে গান রচনা করেছেন। এ কারণে নজরুলের গানে নানা ধরনের
লোকজ-তৎসম-সংস্কৃত-গুরুগম্ভীর-হালকা এবং দেশি-বিদেশি শব্দের ব্যবহার ঘটেছে।
সেসব শব্দ ব্যবহারও নানা ব্যঞ্জনায় ব্যঞ্জিত হয়েছে।
সংগীতের ক্ষেত্রে নজরুলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব
এই যে, তিনি বাংলাগানকে সবার গানে রূপান্তরিত করেছেন। কিছু রাগপ্রধান গান
ছাড়া নজরুল তাঁর গানে এমন শব্দ, উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন যা সব
বাঙালির ব্যবহৃত ভাষা। তিনি উপন্যাস-কবিতা-গান-নাটকে উপেক্ষিত-প্রায়
কৃষাণ-জেলে-কুলি-মজুর-শ্রমিক-বেদে-বাউল-সাঁওতাল-পতিতা-হরিজন প্রভৃতি
শ্রেণীর অখ্যাত মানুষের জন্য বহুবিধ গান রচনা করেছেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই
তাঁর হাতে সোনার ফসল ফলেছে। নবাব-জমিদারের বিলাসী জলসাঘর আর প-িতদের
ড্রয়িংরুম থেকে বের হয়ে বাংলাগান পৌঁছে গেছে ফসলের মাঠে, নদীর জলে,
শ্রমিকের কারখানায়-কয়লাখনিতে, সাঁওতালনির তালপুকুরে, বেদেনির শালপাহাড়ে,
বাউলের বটতলায়। এসব গানের প্রভাবে লোকায়ত জীবনে সৃষ্টি হয়েছে উচ্ছ্বল
প্রাণরস আর ভাবরসের জোয়ার। অবশ্য সেসব গান শিক্ষিত-ভদ্রলোকদের নাগরিক মনেও
আনন্দের ঝড় তুলেছে একইভাবে। তিনি গানে লোকজ শব্দের চমৎকার ব্যবহার করে
সংগীতবোদ্ধাদের মুগ্ধ করে দিয়েছেন। বাউরী কেশ, সন্ধ্যাতারা জা, শুকতারার
সতিনী, বৈঁচী ফলের পৈঁচী, সোনাল ফুলের বাজু, কলমীলতার বালা, টাটকা তোলা
ভাঁটফুলের মালা, বুকের খাপরা, কলমি শাক ঢোলা ঢোলা, ঝিয়ারী, গোঠের রাখাল,
কালো ছুঁড়ির কাঁকাল, মাতাল ছোঁড়া, ভিনগেরাম, ময়নামতির শাড়ি, সখি লো,
কালিয়া বনমালী, ও লো ললিতে, কুচবরণ কন্যা, বউয়ে-ঝিয়ে, লাল নটের ক্ষেতে,
আঙিনা, গাঙ, খিড়কি দুয়ার, মাঝিভাই, হাড়ের নূপুর, তুষের আগুন, মিঠা নদীর
পানি, বান্দা, মিঠা পানির নহর, গরীবের মোনাজাত, ঝোরা, ক্ষ্যাপা, বাউল, গেহ,
দেহ, ডানাকাটা পরী, পান্সে জোসনা, ডুরিছেঁড়া ঘুড়ি, পাথার, নাইয়া, ঘাগরা,
পাটের জোড়, বগলদাবা, অকূল ভব পারাবার, চিকন কালো, কাল নাগিনী ননদিনী,
টুলটুলে চোখ, নাকছাবি, শিকলকাটা পাখি, কাঁচের চুড়ি, পানের খিলি, ভায়রাভাই,
হুঁকোহাতে, বটের ঝুরি, অচিন দেশের বন্ধু, ভিন্ গেরামের নাইয়া, গোয়ালের গাই,
আ-াবাচ্চা, আলুচেরা চোখ, বেয়ান, মামদোভূত, কাছা, কয়লাবরণ গয়লা ছোঁড়া,
দিন-কানা, হিমশিম, পাত ভরে ভাত, দজ্জাল বজ্জাত, মান্ধাতার বুড়ি, আড়বাঁশি,
নায়ের ছই, রূপার বাজু, ডাগরচোখা ছুঁড়ি, লাল লঙ্কার ঝাল, ঘরের বেটি, লবণভাত,
ধুতুরাফুল, বাবলাফুল প্রভৃতি শব্দ গানে ব্যবহার করে লোকায়ত সমাজের
পাশাপাশি ভদ্রসমাজে তা উপস্থাপন করেছেন এবং তা সাদরে গৃহীত হয়েছে। নজরুল
গানের বাণীকে সহজতর করার পাশাপাশি সেসব গানে সাধারণ সংসারী মানুষের
প্রাত্যহিক জীবনের নানা চিত্র এবং তার ইহকাল-পরকাল-ভাবনাকে বিষয়ও করেছেন।
তাঁর গানে স্থান পেয়েছে রূপকথা ও কিংবদন্তিও। ফলে নজরুলের গান অবসরে
আনন্দদানের পাশাপাশি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীসহ গ্রামকেন্দ্রিক বিভিন্ন পেশার
মানুষের ভাবনা-চিন্তাকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে গেছে।
কিছু চরণ উদ্ধার করা যাক :
১। আমি ময়নামতির শাড়ি দিব চলো আমার বাড়ী ও গো ভিনগেরামের নারী;
২। তুই শুকতারারি সতিনী সই সন্ধ্যাতারার জা,
৩। সেদিন তুলতে গেলাম দুপুরবেলা কলমির শাক ঢোলা ঢোলা সই;
৪। কালো ছোড়ার কাঁকাল ধরে নাচে মাতাল ছুঁড়ি লো/খোঁপায় দোলে বুনোফুলের কুঁড়ি;
৫। সখি নির্মল কুলে মোর কৃষ্ণ-কালি কেন লাগালো কালিয়া বনমালি/আমার বুকে দিল তুষের আগুন জ্বালি;
৬। কোকিল ডাকে আমের ডালে/যে মালঞ্চে সাঁঝ-সকালে রে/আমার বন্ধু কাঁদে সেথায় গাঙের কিনারে;
৭। ওই জলকে চলে লো কার ঝিয়ারী/রূপ চাপে না তার নীল শাড়ি;
৮। কোন বিদেশের নাইয়া তুমি আইলা আমার গাঁও/ কুলÑবধূর সিনান-ঘাটে বাঁধলে তোমার নাও;
৯। কত নিদ্রা যাও রে কন্যা জাগো একটুখানি/যাবার বেলায় শুনিয়া যাই তোমার মুখের বাণী;
১০। নিশি-পবন নিশি-পবন ফুলের দেশে যাও/ফুলের বনে ঘুমায় কন্যা তাহারে জাগাও;
এই চরণগুলোর ভিন্ গেরাম, তুই, সতিনী, জা,
সই, চিকন কালা, ও লো ললিতে, ঢোলা ঢোলা, মাতাল ছুঁড়ি, বিদেশের নাইয়া, থুইতে__
প্রভৃতি শব্দ নিতান্তই লোকায়ত। শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবীসমাজ এসব শব্দ ব্যবহার
করে না। কিন্তু নজরুল এসব শব্দ ব্যবহার করেছেন এত চমৎকারভাবে যে, গানগুলো
শুনে শিক্ষিত সমাজও তৃপ্তি পায়। আবার যখন সাধুভাষার শব্দ ব্যবহার করে বলেন,
‘নিশি-পবন নিশি-পবন ফুলের দেশে যাও/ফুলের দেশে ঘুমায় কন্যা তাহারে জাগাও’,
তখন ওই শব্দগুলোর সহজ ব্যবহার এবং তার মাধ্যমে প্রচলিত রূপকথাকে স্পর্শ
করে যাওয়া__ প্রভৃতি কারণে বিষয়টি শিক্ষিত সমাজের পাশাপাশি
অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষেরও বোধগম্যতায় এসে যায়। আনন্দ পায় তারাও। কোনো
ভাষার গান সমাজের মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অবসর উপভোগের সীমানায় আবদ্ধ
তাকতে পারে না। একইসঙ্গে তাকে জনরুচির ও জনচিত্তেরও খোরাক জোগাতে হয়।
নজরুল গভীর দরদ, দক্ষতা ও সাহসের সঙ্গে সেই কাজটিই করেছেন। তাঁর এই
কর্মতৎপরতায় সুফল দিয়েছে লোকজীবন-রূপকথা-কিংবদন্তি জড়িয়ে থাকা শব্দগুলোর
ব্যবহার।
নজরুল ইসলামের আরেকটি মস্তবড় কৃতিত্ব__ তিনি
প্রথম বাংলাগানে আধুনিকতার সূচনা করেন। বাংলা গানকে সবার গানে রূপান্তরিত
করলেন। গানের বাণী সহজ হলো, জীবনকেন্দ্রিক হলো। নজরুলের আগের বিখ্যাত
কবি-গীতিকারদের গানে বিশেষত প্রেমের গানে শরীর ছিল অলিখিতভাবে
নিষিদ্ধপ্রায়। হৃদয় আর মন__ এর বাইরে কোনো শারীরিক ব্যঞ্জনা থাকত না গানের
বাণীতে। অথচ শরীরবিহীন মন বা হৃদয় একটা অলীক কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। নজরুল
ছিলেন আধুনিক মানুষ। কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা স্থাপন করতে পেরেছিলেন।
তিনি জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, শরীর বাদ দিয়ে প্রেমের ভাবনা অসার পূজা
ছাড়া আর কিছুই নয়। নারী-পুরুষের দৈহিক মিলন, চুম্বন, স্পর্শসুখ__ এসবই
প্রেমের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। রোমান্টিকতার ভরা মৌসুমে নজরুল ভাবনায় আধুনিক
হতে পেরেছিলেন বিদ্রোহী সত্তার অধিকারী হওয়ায়। তাই কবিতা ও গানে নর-নারীর
সংরক্ত শারীরিক চাহিদা, কামনা-বাসনা, ক্ষুধা-পিপাসা এবং এসবের অভিব্যক্তিকে
প্রতিবিম্বিত করেছেন। বাংলা গান হয়ে উঠেছে জীবন্ত; হয়ে উঠেছে রক্ত-মাংসের
মানুষের গান। অরুচি ও স্থূলতাকে এড়িয়েই তার ভেতরে যৌবনের উন্মাদনা এসেছে,
দেহ এসেছে, যৌনতা এসেছে। অভিমান, ক্ষোভ, হতাশা বেদনা__সবই এসেছে। ‘তোমার
দেবালয়ে কি সুখে কি জানি/দুলে দুলে ওঠে আমার দেহখানি’, ‘মোর বিকশিল আবেশে
তনু নীপসম, নীরুপম, মনোরম,’, ‘উদাসী বিবাগী মন যাচে আজ বাহুর বাঁধন’, ‘মম
তনুর ময়ূর সিংহাসনে এসো রূপ-কুমার ফরহাদ’, ‘চপল পুরুষ সে তাই কুরুশ কাঁটায়
রাখবো খোঁপার সাথে বাঁধিয়া লো তায়’, ‘এ দেহ-ভৃঙ্গারে থাকে যদি মদ ও গো
প্রেমাস্পদ পিও হে প্রিয়’, ‘কাড়িয়া নিলে না কেন তেমনি করিয়া মোর
ফুল-অঞ্জলি’, ‘স্বপ্নে দেখি একটি নতুন ঘর/তুমি আমি দুজন প্রিয় তুমি আমি
দুজন’, ‘মালিকাসম বঁধুরে জড়ায় বালিকা-বধূ সুখ-স্বপনে’___ দেহমনের স্বাভাবিক
কামনা-বাসনাঘন এমন অজস্র কথা স্থান পেয়ে গেছে তাঁর গানে। নর-নারীর
প্রতিদিনের প্রেম-ভালোবাসা, হাসি-কান্না, সংসারের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান,
মিলন-বিচ্ছেদ, প্রার্থনা-ভয়Ñ সবই গানে ঠাঁই পেয়েছে এবং সব গানের শরীর থেকে
দূর হয়েছে মিস্টিসিজম বা অলৌকিক রহস্যময়তা। এসব করতে গানে ব্যবহৃত হয়েছে
দৈনন্দিন জীবনকেন্দ্রিক চিত্রকল্প এবং মানুষের মুখের ভাষা তথা জিহ্বায়
উচ্চারিত শব্দাবলী। দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘তুমি আরেকটি দিন থাকো/হে চঞ্চল যাবার
আগে মোর মিনতি রাখো’; ‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই/মালাচন্দন দিয়ে মোর
থালা সাজাই’; ‘তুমি যখন এসেছিলে তখন আমার ঘুম ভাঙেনি’; ‘ঘুমাই যদি কাছে
ডেকো হাতখানা মোর হাতে রেখো’; ‘বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে আমার তনুর তীরে’;
‘সই ভালো করে বিনোদ বেণী বাঁধিয়া দে’; ‘সাঁঝের পাখিরা ফিরিলো কুলায় তুমি
ফিরিলে না ঘরে’; বঁধু মিটিল না সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়/তাই আবার বাসিতে ভালো
আসিবো ধরায়’; ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি
ঝরে’__ প্রভৃতি গানের কথা বলা যায়।
প্রচলিত বিভাজন অনুসারে তাঁর আধুনিক গান,
লোকসংগীত, ইসলামি গান এবং শ্যামাসংগীত রয়েছে। কিন্তু সব গানই আধুনিকতার
রঙ-রস-রূপ-প্রাণ সমন্বয়ে রচিত। গানগুলোর বাণী পর্যালোচনা করলে সহজে বোঝা
যায়___ এসব গান সংসারী মানুষের ইহজীবনের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, মিলন-বিরহের
ছবি। গানের বাণী চটুল নয়; কিন্তু সহজে বোধগম্য। এসব গানের মধ্যে কোনো
আধ্যাত্মিকতা নেই, বুদ্ধিজীবী-মনের খোরাক কিংবা কৃত্রিম ঘোরপ্যাঁচ নেই।
গানগুলো গভীর কাব্যময়তায় সমৃদ্ধ ; কিন্তু রহস্যের জটিলতায় দুর্বোধ্য নয়।
ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ প্রায় সবারই জানাশোনা। আপাত সহজ শব্দগুলোই অতিরিক্ত
ব্যঞ্জনা বহন করেছে। ‘সেই পুরাতন চাঁদ আমার চোখে আজ নতুন লাগে’ চরণে ‘সেই
পুরাতন চাঁদ’ শব্দগুলো কত সহজ অথচ কত গভীর ব্যঞ্জনা ধারণ করেছে। পুরাতন
প্রেমিক একসময় নতুন মানুষ ছিল, তখন আনন্দ-জোছনার মাখামাখি ছিল; কিন্তু সে
আজ চাঁদের মতো অনেক দূরে বা অধরায়। অথচ তাকেই নতুন করে ভালো লাগছে। সে আগের
মতোই আকর্ষণ সৃষ্টি করছে। আবার রয়ে যাচ্ছে নাগালের বাইরেও। এ কারণে হয়তো
দুজনের পুনর্মিলন ঘটে না। চাঁদও তো তেমনি। কৃষ্ণাতিথির পর আবার যখন তাকে
দেখা যায়, তাকে আগের মতোই সুন্দর, আকর্ষণীয় লাগে। তার জোছনা মাখতে ইচ্ছে
করে। সুতরাং ‘সেই পুরাতন চাঁদ’ মানে হচ্ছে সেই পুরনো প্রেমিক। পুরাতন চাঁদ
এই সহজতম শব্দটি প্রতীকী।
যে-কোনো ভাষার মূলসম্পদ তার শব্দসম্ভার। যে
ভাষার শব্দ সংখ্যা যত বেশি, সে ভাষা তত সমৃদ্ধ। কোনো ভাষাকে সমৃদ্ধ হতে হলে
তার নতুন ও অন্য ভাষার শব্দ গ্রহণের ক্ষমতা থাকতে হয়। আজ ইংরেজি ভাষা এতটা
সমৃদ্ধ হয়ে ওঠারও মূল কারণ এটি। আর নতুন শব্দ সৃষ্টি বা আমদানি করার কাজটি
মূলতঃ কবি-সাহিত্যিকদের। কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমে কবিতায়, পরে গানে অজস্র
আরবি-ফার্সি-উর্দু-হিন্দি শব্দের ব্যবহার করেছেন। এসব শব্দের ব্যবহার তার
গানের বাণীকে অনেক বেশি ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে। বাংলা ভাষা ও বাংলা গান
কিছুসংখ্যক সংস্কৃত ও তদ্ভব-তৎসম শব্দের ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছিল। নজরুল
ইসলাম বাংলা গানকে বাণীর দিক থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তাঁর গজলগুলোও গান
হিসেবে যেমন, তেমনি কবিতা হিসেবেও উৎকৃষ্ট। ‘নজরুলের গানে সুর ও বাণীর
পারস্পরিক সম্পর্কটি একই জাতের শব্দ ব্যবহারেই নয়, ভিন্নজাতীয় শব্দের
ব্যবহারেও চমৎকার ফুটে ওঠে।
আল্গা কর গো খোঁপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফ্যঁস গয়ি;
বিনোদ-বেণীর জরিন্ ফিতায়
আন্ধা এশ্ক্ মেরা ফ্যঁস গয়ি।
এই গানে বাংলা শব্দের পাশেই উর্দু শব্দ আবার
তারপরেই বাংলা শব্দের সহাবস্থান___ গজলের পরিবেশটিকে অনেকখানি তুলে ধরেছে।
ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রেও যেন মনে হয়Ñ ‘আল্গা কর গো খোঁপার বাঁধন’-এর পর
‘চিত্ত যেথায় হারিয়ে গেছে’___ এই ধরনের জোলো বাণীর পরিবর্তে ‘দিল ওহি মেরা
ফ্যঁস গয়ি’ সুপ্রযুক্ত। এছাড়া শব্দ ব্যবহারে কোনো ছুঁৎমার্গ ছিল না
নজরুলের। নিজের আবেগকে প্রকাশ করতে গিয়ে যখন যে শব্দের প্রয়োজন হয়েছে তাকেই
এনে বসিয়েছেন গানের পঙ্ক্তিতে।’ (সুর ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি/যূথিকা বসু)।
নজরুল তাঁর কবিতায় যেমন, গানেও তেমনি অজস্র
আরবি-ফার্সি-উর্দু-হিন্দি শব্দ ব্যবহার করেছেন। এতে গানের বাণী আরও সমৃদ্ধ ও
ব্যঞ্জনানিবিড় হয়ে উঠেছে। গজল ও ইসলামি গানগুলো দেশি-বিদেশি শব্দের যুঁৎসই
ব্যবহারে হয়ে উঠেছে অনন্য। বাংলা ভাষার শব্দভা-ার সমৃদ্ধকরণে নজরুলের এই
ভূমিকা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। এখানে আরেকটি কথা প্রণিধানযোগ্য__ বাংলা
ভাষাভাষী মানুষের অর্ধেকেরও বেশি ইসলাম ধর্মানুসারী। তাদের প্রতিদিনের
জীবনযাপনে ও কথোপকথনে স্বাভাবিকভাবেই ও অপরিহার্যভাবেই অনেক আরবি-ফার্সি
শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এছাড়া এদেশে বহুদিন ফার্সি রাজভাষা থাকার কারণে এবং
মুসলমানদের ধর্মীয় পুস্তকগুলো আরবি ভাষায় লিখিত হওয়ায় অফিস-আদালত,
ভূমিব্যবস্থাপনা, বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে শত-শত বছর আগে থেকেই প্রচুর
আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নজরুল ইসলাম এসব শব্দ ব্যবহার করে
গানগুলোকেও সেসময়ে সংগীতবিমুখ বাঙালি মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্য করে
তুলেছেন। এটা দূরদর্শিতার পরিচয়বাহী।
তাঁর ব্যবহৃত আরবি-ফার্সি শব্দগুলোর
ব্যবহারও চমৎকার। জোছনার কুমকুম, রহমতের ঢল, পুণ্যের গুলিস্তান, রংমহলার
তিমির দুয়ার, শিশমহল, নীল পিয়ালায় লালসিরাজী, লালগেলাসের কাচমহলা, দিলদরদীর
দিললাগি, বাদশাজাদীর রঙমহল, বিজলী জরিন ফিতা, লু হাওয়ার ওড়না, মিঠাপানির
নহর, ফুটন্ত গুলবাগিচা, বিরহের গুলবাগ, শরাবরঙের শাড়ি, বাণ-বেঁধা বুলবুল,
তনুর তলোয়ার, গোলাপগালের লালি, চাউনিবাঁ সুর্মাআঁকা ডাগর আঁখি, গাফেলতির
ঘুম, সোনাল ফুলের বাজু, অনুরাগের লাল শরাব, অস্তাচলের প্রাসাদ মিনার, শরাবী
জামশেদী গজল, গুলবাহারের উত্তরীয়, ঈদের চাঁদের তশতরী, মদির আঁখির নীল
পেয়ালায়, বেদন বেহাগ, সুরের সাকি, নও-বেলালের শিরিন সুর, আল আরাবী সাকি,
হৃদয়-জায়নামাজ, তৃষ্ণা-দরিয়া, মুসাফির, জরিন হরফ, রাঙা-গুলের বাজার, খুশির
জলসা, নূরের দরিয়া প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার অভূতপূর্ব এবং অপূর্বসুন্দর।
যদি বলা হয় গানের মধ্যে সেরা গান কোনগুলো?
তবে এক কথায় জবাব হবে প্রেমের গানগুলো। মাটির মানুষের মিলন-বিরহ,
হাসি-কান্না, কামনা-বাসনা তাঁর গানে স্থান পেয়েছে সাবলীলভাবে। নজরুল
প্রেমের গানে ব্যবহার করেছেন রোমান্টিক, কোমল-পেলব হৃদয়-ছোঁয়া শব্দ। আবার
ঋতুভেদে প্রেমের গানে ব্যবহৃত ভাষা ও তার মেজাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।
প্রেমের গান বসন্তকালের অনুষঙ্গে হলে ভাষা ও শব্দের ব্যবহার একরকম, বর্ষার
অনুষঙ্গ থাকলে শব্দ ও ভাষার ব্যবহার ভিন্নরকম। এভাবে নজরুল সব ধরনের গানেই
সুনির্বাচিত শব্দসমষ্টি, উপমা, চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। এতে গানের বাণী
শ্রোতার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। ‘তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল’,
‘নয়নে ভীরু মাধুরীর মায়া’, ‘বিরহ-মলিন বন-তুলসীর শুকানো মালিকাখানি’,
‘মাধবীচাঁদের মধুর মিনতি, মদির আঁখির নীল পিয়ালায়’, ‘প্রেমের অলকানন্দা,
ভীরু-মনের কলি’___ এমন শব্দসমষ্টি তাঁর গানকে করে তুলেছে একাধারে মানবিকতায়
এবং আধুনিকতায় সমৃদ্ধ ও উপভোগ্য। বর্ষার অনুষঙ্গে রচিত প্রেমের গান
সম্পর্কে যূথিকা বসুর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য___ ‘প্রেমের এইসব গানে কবির
শব্দব্যবহার লক্ষণীয়Ñ ধানীরঙ ঘাঘরী, মেঘরঙ ওড়না, হৃদয়-যমুনা, মরম,
মেঘ-বরণা, প্রিয়-দরশা, বন্ধু-মিলন-হরষা, মেঘলামতী, মেঘ-নটী, মেঘমালতী,
বন-পাপিয়া, শ্যাম-পরশা, মধু-তিথি, বাদরিয়া, শামলিয়া, কাজরিয়া, ঝুলনিয়া,
মেঘ-নীল, নীপ-মালিকা, জল-নূপুর, বিষাদ-মগন, বন-কুন্তলা, মেঘ-চন্দন, বরিষণসহ
এমন আরো বহু শব্দ চয়ন করা যায় যেখানে আ-কারান্ত, ই-কারান্ত বা
ইয়া-প্রত্যয়ান্ত শব্দের প্রাধান্য আছে। যুক্ত ব্যঞ্জনগুলোকে ভেঙে ভেঙে শব্দ
তৈরি করায় শব্দে আশ্চর্য শ্রুতি-মধুরতা, পেলবতা, স্নিগ্ধতা এসেছে__ যা
প্রেমের কোমল মধুর অনুভবের জন্য নিতান্ত জরুরি। যেমন__ হরষা, বরষা, দরশা,
পরশ, মরমী, বরণা ইত্যাদি। আ-কারান্ত শব্দে ধ্বনির বিস্তার চিত্তকে অনেক
বেশি অধিকার করে রাখে এবং বর্ষার অনন্ত ধারা প্রবাহের সঙ্গে বড় মানানসই।
গাগরিয়া, শ্যামলিয়া, কাজরিয়া, ঝুলনিয়া শব্দগুলো প্রেমিকের প্রতি স্নেহসূচক
বলে মনে হয়। প্রেমের আকুলতায় হৃদয়ের যে উথাল-পাথাল অবস্থা, হƒদয়-যুমনার
চেয়ে সুপ্রযুক্ত উপমা সেখানে যেন আর হয় না। প্রেমিকার ঘাঘরার রঙ ধানী এবং
ওড়নার রঙ মেঘ__ রঙের এমন অসামান্য কবি-কল্পনা নজরুলের কাছে আমাদের চিরদিনের
জন্য ঋণী করে রাখে। কবির সমস্ত মন-প্রাণ-আত্মা যেন বর্ষাকে সজীব-প্রাণবন্ত
এক সত্তারূপে গ্রহণ করেছে। বর্ষা সেখানে কখনও প্রেমিকাকে বিরহাতুর করে
তোলে, কখনও করে তোলে চঞ্চল, কখনও ভীত-সন্ত্রস্ত, কখনওবা অভিমানী। কবি তাঁর
সমস্ত অন্তর দিয়ে বর্ষার সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে পড়েছেন। ঋতু আর কেবল
বহিঃপ্রকৃতির বিশিষ্ট অবস্থা নয়, কবির অন্তরের বিশেষ অবস্থার
নামান্তরমাত্র।’ (এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া/বাংলা গানের আঙিনায়)।
কবি-শিল্পীর প্রধান ক্ষেত্র ও অবলম্বন
প্রকৃতি। মূলতঃ
আকাশ-বাতাস-নদী-ঝর্ণা-পাহাড়-পর্বত-সাগর-মরু-বৃক্ষ-তরুলতা-বৃষ্টি-খরা-ঝড়-ষড়ঋতু
কবি-শিল্পীর রঙতুলির রঙ ও কল্পনা-ভাবনার উপকরণ-উপমা-চিত্রকল্প-কল্পচিত্র
যোগায়। নজরুল ইসলাম তাঁর গানে প্রকৃতির উপকরণ ও উপাদান ব্যবহার করেছেন
দক্ষতার সঙ্গে। আমার শুধু তাঁর গানে ফুলে ব্যবহারের বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে ফুলকে উপমা, উপকরণ, প্রতীক ও বিষয় হিসেবে
ব্যবহার করেছেন। গানে ফুলকে উপমা, প্রতীক, উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে
অজস্র সমাসবদ্ধ শব্দ, শব্দগুচ্ছ সৃষ্টি করেছেন যা তাঁর গানকে করেছে উপভোগ্য
ও কাব্যরসঘন এবং বাংলা ভাষার শব্দভা-ারকে করেছে সমৃদ্ধ। এ শব্দগুচ্ছ
সৃষ্টিতে তিনি আরবি-ফার্সি শব্দের সঙ্গে বাংলা শব্দের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন এত
যুৎসইভাবে যে তারা সোনায় সোহাগার মতো হয়ে তৈরি করেছে শব্দসৌন্দর্য,
অর্থ-মাধুর্য, শব্দালঙ্কার ও বাক্যালঙ্কার। গুলবাহারের উত্তরীয়,
কানন-সুন্দরী, মউ বিলাসী প্রজাপতি, ফুল-মাধবী, কৃষ্ণচূড়ার মুকুট, শিউলি
ছোপানো শাড়ী, গোলাপের নজরানা, চাঁপার গেলাস ভরিয়া, কুসুম দীপালি, সুখের
রাঙা কমল, বনফুল আভরণ, পুষ্পচোর, গুল-ডাকাত, শাপলা-বন, ফুল-ধনু,
চম্পককুঞ্জ, পথ-মঞ্জরী, সাঁঝের শাপলা, আলোকমঞ্জরী, পুষ্পধনু, নব
মালতির-কলি, মুকুল-নয়ন, মুকুল-বয়সী, মাধবী-কঙ্কণ, ফুলের শপথ, তারার ফুল,
চৈতালী চাঁপা, ফুল-ঝামেলা, নীল শালুকের ভেলা, কেয়া-ফুলের বেণী, ব্যাথার
শতদল, নিবেদনের কুসুম, কুসমী রঙ শাড়ি, বিফল-দিনের কমল, গুল্মবনের দুল,
গন্ধ-ফুলের জলসা, দুলাল-চাঁপার কুঁড়ি, কনক-গাঁদার চুড়ি, চাঁপারঙের শাড়ি,
পলাশফুলের গেলাস, কথার কলি, মহুয়া-মদের নেশা, রসুল নামের ফুল, শিমুল-ফুলের
মতো হিয়া, ডালিম ফুলের ডালি, গোলাপ ফুলের লালি, গোলাবীগুলের নেশা,
ফুল-সমাধি, বিরহের গুলবাগ, বিফল বনের কুসুম, শিউলি-বোঁটার-রঙের উত্তরীয়,
প্রণামী-কমল, কথার-মুকুল, ভীরু মনের কলি প্রভৃতি।
ফুল ও ফলসজ্জিত প্রতিবেশকে প্রতীক, উপমা
হিসেবে ব্যবহার করায় নজরুলের অনেক গান অপূর্ব মাধুর্যম-িত, অভূতপূর্ব
চিত্রকল্পময় হয়ে উঠেছে। ‘শাপলা-বনে চাঁদ ডুবে যায় ম্লান চোখে চায় চকোর’,
‘আজো তার ফুলকলিদের ঘুম টুটেনি তন্দ্রাতে বিহ্বল’, ‘ভোরের কমল ভেবে সাঁঝের
শাপলা ফুলে গুঞ্জরে ভ্রমর ঘুরে ঘুরে’, ‘কমল ফুল যেন তোলে কমল ফুল/ভাসায়ে
আকাশ-গাঙে অরুণ-গাগরি’, ‘মধুকর যবে ফুলে মধু খায় রহে না চঞ্চলতা’, ‘ও রে
শুভ্রবসনা রজনীগন্ধা বনের বিধাব মেয়ে’, ‘চৈতালী চাঁপা কয় মালতী শোন,
শুনেছিস বুঝি মধুকর গুঞ্জন’, ‘ম্লান-আলোকে ফুটলি কেন গোলক-চাঁপার ফুল’,
‘ফুটে ওঠে আনারকলি নাচে ভ্রমর রঙ-পাগল’, ‘দিনগুলি মোর পদ্মেরি দল যায় ভেসে
যায় কালের স্রোতে’, ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’, ‘পুষ্পবনে দুল হয়ে তুই
দুলিস একা ফুলগাছে’, ‘বন অতসীর কাঁকন পরো কনক-গাঁদার চুড়ি’, ‘মহুয়া বনে ফুল
ফোটাতো বাজিয়ে বাঁশী কে’, ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’,
‘বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে/ঝরা বন-গোলাপের বিলাপ শোনে’, ‘বিরহের গুলবাগে
মোর ভুল করে আজ ফুটলো কি বকুল’, ‘ঘুমিয়ে ছিলাম কুমুদকুঁড়ি বিজন ঝিলের নীল
জলে’, ‘বাদল সাঁঝের জুঁইফুল হয়ে আসিয়াছি ধরাতলে’, ‘ঝরাফুল দলে কে অতিথি’,
‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেবো খোঁপায় তারার ফুল’, ‘সাহারাতে ফুটলো রে
রঙ্গিন গুলে লালা/সেই ফুলেরই খৌশবুতে দুনিয়া মাতোয়ালা’, ‘যে কথার কলি সখি
আজো ফুটিলো না/শরম মরম পাতে দোলে আনমনা’, ‘নয়নভরা জল গো তোমার আঁচলভরা
ফুল’__ প্রভৃতি চরণে ফুলখচিত চিত্রকল্প আর অনুপ্রাসের ব্যবহার যথার্থ।
নজরুলের আগেও অরো অনেকেই বাংলাভাষায়
উদ্দীপনামূলক গান রচনরা করেছেন। তবে তাঁদের সেসব গানের ভাষা ছিল অপেক্ষাকৃত
কোমল এবং উদ্দীপনা জাগানোর ক্ষেত্রে অনেকখানি অক্ষমও বটে। ফলে সেসব ছিল
প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দুর্বল অস্ত্র। সেসব গানের মর্মবাণী জাগরণের হলেও
ভাষা ও সুর ছিল অনেকটা মোলায়েম। ব্যবহৃত শব্দাবলী ছিল ঝুঁকিহীন স্বস্তিতে
থাকতে অভ্যস্ত সমাজের ওপরতলার ভদ্রলোক শ্রেণীর। তাদের হাতে রচিত জাগরণমূলক
গানে পরিশীলিত ভদ্রগোছের অনাক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সেসব শব্দ
আক্রমণাত্মক গতি, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিকারী উপমা, প্রতিরোধের চিত্রকল্প, ভেঙে
ফেলার উস্কানি, রক্তে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী তাল ও ছন্দ সৃষ্টির পক্ষে মোটেই
যথেষ্ট ছিল না। নজরুল প্রথম বাংলা ভাষায় রক্তে আগুন লাগানো গান রচনা করেন।
তিনি তাঁর জাগরণমূলক গান__ ‘কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট
রক্তজমাট শিকল-পূজার পাষাণবেদী’, ‘ ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত/আমরা আনিবো রাঙা
প্রভাত’, ‘নব নবীনের গাহিয়া গান/ সজীব করিবো মহাশ্মশান’, ‘বাজলো কি রে
ভোরের সানাই নিদ-মহলার আঁধার-পুরে’, ‘জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা
নাগিনী/বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা’, ‘ধূ ধূ জ্বলে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি/জাগো
মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার
হে/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রী-নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’, ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল
যারা জীবনের জয়গান/আসি অলক্ষে দাঁড়ায়েছে তারা দেবে কোন্ বলিদান’, ‘বাজিছে
দামামা বাঁধ রে আমামা শির উঁচু করে মুসলমান’, ‘যত অত্যাচারে আজি বজ্র
হানি/হাঁকে নিপীড়িত জন-মন-মথিত বাণী’, ‘শোন অত্যাচারী শোন রে সঞ্চয়ী/ছিনু
সর্বহারা হব সর্বজয়ী’ প্রভৃতি চরণগুলোয় অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে
বারুদগর্ভ প্রণোদনা প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছে। এসব গানে ন্যায়, সত্য, জনতা ও
স্রষ্টা, মিত্রশক্তি এবং মিথ্যা, অন্যায়, অত্যাচারী শাসকরূপী অসুরশক্তি__
অক্ষশক্তিতে মেরুকরণকৃত হয়েছে। এসব গানে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ__ শব্দ তো নয়,
যেন বুলেট, বারুদগর্ভ বোমা, ছোড়ামাত্র প্রচ- বিস্ফোরণে কাঁপিয়ে দেবে
চারপাশ। তা শুনে জেগে উঠবে অর্ধমৃত প্রাণ, ভয়ে ছুটে পালাবে অন্যায়
প্রতিপক্ষ! এসব গানে নজরুল বাংলা ভাষার সুপ্তশক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছেন।
নজরুলের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব হচ্ছে বাংলা
ভাষায় গজল-গানের প্রবর্তন এবং তা সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছানো। গজল মূলত
প্রেমের গান এবং ফার্সি ও উর্দু ভাষার গান। নজরুল বাংলা ভাষায় গজল-গান রচনা
করেন, তাতে সুর দেন এবং তা বাংলার আপামর জনগণের মধ্যে সংগীতের ব্যাপক
আবেদন সৃষ্টি করে। তিনি গজল-গানে বহু ফার্সি ও উর্দু শব্দের ব্যবহার করে
গানের মধ্যে গজলের আদি আবহ তৈরি করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। আবার বাংলার লোকায়ত
বিষয়, শব্দ, চিত্রকল্প সহযোগে গজল-গান লিখে তাকে বঙ্গদেশীয় রূপ দিয়েছেন__
বকুলচাঁপার বনে কে মোর চাঁদের স্বপন জাগালে
অনুরাগের সোনার রঙে হৃদয়-গগন রাঙালে।।
ঘুমিয়ে ছিলাম কুমুদকুঁড়ি বিজন ঝিলের নীলজলে
পূর্ণ শশী তুমি আসি আমার সে ঘুম ভাঙালে।।
হে মায়াবী তোমার ছোঁয়ায় সুন্দর আজ আমার তনু
তোমার মায়া রচিল মোর বাদল মেঘে ইন্দ্র-ধনু।
তোমার টানে হে দরদী দোল খেয়ে যায় কাঁদন-নদী
কূলহারা মোর ভালোবাসা আজকে কূলে লাগালে।।
উদ্ধৃত গজলটির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ, উপমা ও চিত্রকল্প বঙ্গদেশীয়।
নজরুল-পূর্ববর্তী চার কবি-গীতিকারের গানের
একটা বড় দুর্বলতা ছিল তাঁদের অধিকাংশ গানে একই ধরনের ভাষা অর্থাৎ শব্দ
উপমা-চত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। হালকা বিষয় নিয়ে গান রচনা করতে গিয়েও
স্বভাবসুলভভাবে ভারী-ভারী শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু নজরুল তা করেননি।
নজরুল জটাধারী শিবকে নায়ক করে গান রচনার সময় যেসব গুরু গম্ভীর ও ওজনদার
শব্দ ও চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন, লোকসুরের গান রচনার ক্ষেত্রে তেমনটি
করেননি। সেক্ষেত্রে তিনি প্রান্তরের ভাষা, নদীর ভাষা, ঘাটের ভাষা ব্যবহার
করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনটি গানে ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা
যায়।
১. সৃজনছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ/হে মহাকাল প্রলয়-তাল ভোলো ভালো ।
২. তোর রূপ সই গাহন করে জুড়িয়ে গেল গা/তোর ঘাটের নদীর ঘাটে বাঁধলাম এ মোর না।
৩. বাজলো কিরে ভোরের সানাই নিদ-মহলার আঁধার-পুরে/শুনছি আজান গগন-তলে আঁধার-রাতের মিনার-চূড়ে।
প্রথম গানটি রাগপ্রধান এবং গানের বিষয়
জটাধারী শিবকে সৃজনশীলতায় আসতে আহ্বান জানানো। একেই তো শিব দেবতা, তদুপরি
যখন ধ্বংসের নাচ নাচেÑ তখন তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তখন তার মাথায় থাকে
জটা, পরণে উন্মদের পোশাক, মাথায় ধুতরা ফুল, কোমে বিষধর সাপের মেখলা আর গায়ে
বাঘছাল। তাকে প্রলয়-নৃত্য বাদ দিয়ে সৃষ্টির নাচ নাচতে বলা হলে এবং সে তাতে
সম্মত হলে তার পোশাক ও চেহারা দুটোই বদলে মনোরম হয়ে যাবে। গানে তাই তার
রুদ্ররূপ ফুটিয়ে তুলতে যুক্তাক্ষরবিশিষ্ট গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যবহার করা
হয়েছে। আবার যখন সৃজনশীলতায় ফিরে আসবে তখন তার শির হতে যে আলো ছড়িয়ে পড়বে,
তা হবে কোমল। সেজন্যই তাকে ‘শিশু-শশীর কিরণ-ছটা’ বলা হয়েছে। শিশু-শশী
নবজাতক এবং তার আলো কোমল। দুটো মিলে নতুন সৃষ্টি। আবার সমগ্র গানটির সঙ্গে
নৃত্য ও গান জড়িত বলে অনুপ্রাসবিশিষ্ট শব্দ ও শব্দসমষ্টি ব্যবহার করা
হয়েছে। এতে গানের শরীরে ছন্দ ও তাল এবং তার প্রাণে অনুপ্রাসের অনুরণনজনিত
স্পন্দিত মাধুর্য যুক্ত হয়ে তাকে পূর্ণ করে তুলেছে। যুক্তাক্ষরবিশিষ্ট তৎসম
শব্দাবলী এবং মহাকাল শব্দের পূর্বে ‘হে’ সম্বোধন গানটিকে প্রয়োজনীয়
গাম্ভীর্য দান করেছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় গানটি লোকাঙ্গিকের গান বিধায় এবং
তার সঙ্গে নদীর অনুষঙ্গ জড়িত থাকায় সে গানে সহজসরল এবং নদীর স্রোতের মতো
গতিময় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নদীর ঘাটে গ্রামীণ যুবতীর উড়তে থাকা চুলের
কথা বলতে গিয়ে ‘বাউরী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, জটা নয়। সমগ্র গানটিতেই
গ্রামীণ নদীন পটভূমি ফুটিয়ে তুলতে লোকজ উপমা (শুকতারার সতিনী, সন্ধ্যাতারা
জা, ডানাকাটা পরী), চিত্রকল্প ও শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। তৃতীয় গানটি
মুসলমান জাতিকে জাগিয়ে তোলার একটি গান। অর্থাৎ জাগরণমূলক গান। এই গানে ওই
সময় ঝিমিয়ে পড়া পরাধীন মুসলমান জাতিকে জাগিয়ে তুলতে তার গৌরবময় অতীতের
প্রত্যাবর্তনের কল্পিত ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে। তার বর্তমান ঘুমন্ত
অবস্থাকে বোঝাতে ‘নিদ-মহলা’, তার অধঃপতিত পরাধীন অবস্থাকে চিহ্নিত করতে
‘আঁধার-পুর’ শব্দসমষ্টি ব্যবহার করা হয়েছে। তার জাগরণের আহ্বানকে ‘গগন-তলের
আজান’ তাদের পারস্পারিক একতাকে ব্যঞ্জিত করতে ‘বন্ধু’, তার আন্দোলনের
বেগবানতাকে তুলে ধরতে ‘বান হাজার স্রোতে’, তার সম্ভাব্য মুক্তিকে
‘হাসীন-উষা’ এবং নবমুক্তির আগমন-ঘোষণাকে ‘নও-বেলালের শিঁরিন সুর’ বলে
বর্ণনা করা হয়েছে। মুসলমানদের জাগরণের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য এবং আরবি ভাষার
অতীত সিলসিলা রয়েছে বলে গানে আরবি-ফার্সি শব্দ এবং ওই সময়ের আরব-বীরদের নাম
ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবেই তিনি জাগরণমূলক গানে উদ্দীপনাময় শব্দ ও
শব্দসমষ্টি ব্যবহার করেছেন সুচিন্তিতভাবে।
তবে নজরুলের সব গানে শব্দের ত্রুটিমুক্ত
ব্যবহার ঘটেছে__ এমনটি দাবি করার সুযোগ নেই। নানা শ্রেণীর অখ্যাতজনদের জন্য
রচিত গানের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং সেসবের একটা বড় অংশ গ্রামোফোন
কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক-অনুরোধে তাড়াহুড়া করে রচিত হওয়ায় অনেক গানে শব্দের
ব্যবহার, ভাষার ভারসাম্য এবং নন্দনতাত্ত্বিক মাধুর্য ক্ষুণœ হয়েছে। আবার
কিছু কিছু গানের বাণী চমৎকার হওয়া সত্ত্বেও দুই-একটি ভুল বা স্থূল শব্দের
ব্যবহার গানের বাণীর কাব্যিক মাধুর্য ও নান্দনিক ব্যঞ্জনাকে ক্ষতিগ্রস্ত
করেছে। একাধিক নিম্নমানের বা ভুল শব্দের ব্যবহারের কারণে তো বটেই এমনকি
কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটিমাত্র ভুল শব্দের প্রয়োগ পুরো গানের কাব্যিক উৎকর্ষ
ভীষণভাবে ক্ষুণœ করেছে। এমনও হয়েছে যে, শব্দের ব্যবহারে একটা ভুলের কারণে
গানটি উন্নত রুচির ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও
শ্রবণযোগ্যতা হারিয়েছে। এটাকে কেউ কেউ নজরুলের রুচির দোষ বলে আখ্যায়িত
করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় ও সময় নজরুলের গানের ব্যাপক চাহিদা, গ্রামোফোন
কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান মুনাফার লোভ-উৎসারিত নতুন গানের চাহিদাজনিত
পীড়াপীড়ি, নজরুলে নিজের অর্থকষ্ট এবং ‘পরওয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি
যুগের হুজুগ কেটে গেলে’Ñ জাতীয় বেপরোয়া মনোভাবÑ তাঁর দুর্বল বাণীতে অজস্র
গান রচনার কারণ। এছাড়া কবিতা-গান-উপন্যাস-নাটক-চিত্রকর্ম-ভাস্কর্য-সুর
তাড়াহুড়া করে অধিক সংখ্যায় সৃষ্টি করা হলে সেসব সৃষ্টির অনেকাংশই দুর্বল বা
ত্রুটিপূর্ণ হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কারণ যাই হোক এটাই সত্য যে, নজরুলের
মানোত্তীর্ণ গান যেমন অনেক, শব্দের অসতর্ক ব্যবহারে দুর্বল বাণীতে রচিত
গানের সংখ্যাও কম নয়। উদাহরণস্বরূপ অমন একটি গান পাঠ করা যায়Ñ
কী হবে জানিয়া কে তুমি বঁধু, কি তব পরিচয়?
আমি জানি, তুমি মোর প্রিয়তম, সুন্দর প্রেমময়।।
জগৎ তোমার পায়ে পড়ে আছে
তুমি এসে কাঁদ এ দাসীর কাছে
হে বিজয়ী, আমার বিজয়ী আমি শুধু জানি
তুমি হার মানি আমারে করেছ জয়।।
কত যে বিপুল মহিমা তোমার জানতে দিয়ো না প্রিয়
জনমে জনমে প্রিয়া বলে মোরে বক্ষে টানিয়া নিয়ো।
প্রভাত-সূর্যে ভাবি নারায়ণ
বিশ্ব প্রণাম করে গো যখন
একমুঠো কমলিনী হেসে বলেÑ আমি চিনি
ও যে মোর প্রিয়, ও-তোর নারায়ণ নয়।।
গানটির শুরুর বা স্থায়ী অংশের চরণ দুটি
অপূর্বসুন্দর। শব্দ নির্বাচন ও বাক্যের গাঁথুনি চমৎকার। সঞ্চারীটিও খুব
সুন্দর এবং আভোগ অংশটি মোটামুটি ভালো বলা যায়। কিন্তু প্রথম অন্তরার ‘দাসী’
শব্দটির ব্যবহার গানটির কাব্যিক মর্যাদা ক্ষুণœ করছে। সম্পর্কের
দুইপ্রান্তে একজন দাসী হলেÑ আরেকজন হবে প্রভু। প্রেমে এমনটি সম্ভব নয়। এই
গানটিতেও দুজনার সম্পর্ক প্রভু-দাসীর নয়। যদি তাই হতো, তবে বিজয়ী বীরপুরুষ
নারীর পায়ের কাছে এসে নিজেকে সমর্পণ করতেন না। অনুনয়-বিনয়-কান্নকাটিও করতেন
না। গানের নায়িকা উচ্চগুণসম্পন্না ব্যক্তিত্বসম্পন্না। সে তো দাসী-প্রভুর
সম্পর্কে নিজেকে জড়াতে চাইবে না। নজরুল ছিলেন নারী স্বাধীনতার প্রবল
প্রবক্তা, বলা চলে অগ্রদূত। তিনি তাঁর সুবিখ্যাত ‘নারী’ কবিতায় বলেছেনÑ সে
যুগ হয়েছে বাসি/যে যুগে পুরুষ আছিল না দাস, নারীরা আছিল দাসী।’ অধিকন্তু
তাঁর একটি গানে তিনি নারীর জবানবন্দিতে যা বলেছেন, তাও এখানে প্রাসঙ্গিকÑ
দাসী হতে চাই না আমি হে শ্যাম কিশোর বল্লভ
আমি তোমার প্রিয়া হওয়ার দুঃখ লব।।
জানি জানি হে উদাসীন
দুঃখ পাব অন্তবিহীন
বধুর আঘাত মধুর হে নাথ সে গরবে সকল সব।।
তোমার যারা সেবিকা নাথ, আমি নহি তাদের দলে
সর্বনাশের আশায় আমি ভেসেছি প্রেম-পাথার জলে।
দয়া যে চায় যাচুক চরণ
আমার আশা করব বরণ
বিরহে হোক মধুর মরণ, আজীবন সুদূরে রব।।
অর্থাৎ প্রেমের সম্পর্ক কখনোই প্রভু-দাসী কিংবা প্রভু-দাস রূপে হবে না। এমনকি অসম প্রেমেও এমনটি ঘটে না।
আমাদের আলোচনাধীন মূলগানে নায়ক বিজয়ী এবং নায়িকাও বিজয়িনী। সমানে সমান। বিষয়টি যেন নজরুলের আরেকটি কবিতার মতোÑ
‘হে মোর রানী তোমার কাছে হার মানি আজ
শেষে/আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।’ অথচ নজরুল এই গানে ‘দাসী’
শব্দটি ব্যবহার করে গানটির মর্যাদা এতটা কমিয়ে দিয়েছেন যে, এটাকে প্রেমের
গান বলে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। হয়তো ‘দাসী’ বলতে প্রেমের দাসী বা শতভাগ
অনুগতা বোঝানো হয়েছে। যেমন ‘দাঁড়ালে দুয়ারে মোর কে তুমি ভিখারিনী’। নজরুলের
‘আমি তব দ্বারে প্রেমভিখারী’ গানের অনুকরণে রচিত একটি আধুনিক গানের প্রথম
চরণও এমনÑ ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে তোমারে করেছে রানী’। এরপরও ভিখারী
বা ভিখারিনী শব্দগুলো অপেক্ষাকৃত উন্নত ব্যঞ্জনা ধারণ করে। ভিখারী বা
ভিখারিনী মুক্ত মানুষ। তারা কারো পায়ের কাছে স্থান গ্রহণ করে না।
পৃথিবীতে কোনো কিছুই সবার কাছে শতভাগ ভালো
বা মন্দ নয়। প্রকৃতির সবকিছুই নির্ভেজাল সুন্দর কিংবা অসুন্দর নয়।
মানবসৃষ্ট সৃষ্টির মধ্যেও খুঁত রয়ে যায়। নিখুঁত বলে কোনোকিছু নেই।
বৈচিত্র্যের মধ্যেও ঐক্য হলো সৃষ্টির প্রধান বৈশিষ্ট্য, সামগ্রিক সৌন্দর্য।
মানুষের জন্যই নজরুলের গান। তাই তাঁর গানে শব্দের ব্যবহার বহু ক্ষেত্রেই
যুৎসই ও সর্বাঙ্গসুন্দর। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে আংশিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ।
প্রসঙ্গত, নজরুলের ত্রুটিপূর্ণ বাণীযুক্ত
গানগুলো তাঁর অন্যান্য গানের মতোই মোহনীয় সুরের মাধুর্য যোগ হওয়ায় বাণীর
দুর্বলতা কেটে যায় অনেকাংশে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন