কতগুলো বৈশাখ পালিয়ে থেকেছি ।। ভৌমিক সুমন
পহেলা বৈশাখ আসবে। ভীষণ আনন্দ আর উদ্বেগে কাটত শিশু বেলা। হৈ-চৈ করে কাটাতাম। গ্রামে গ্রামে তখন মেলা বসত। আজ বৈশাখী মেলা বলি। তখন গড়িয়া (মেলা) বলতাম। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতাম। সোধা-মেথি গায়ে মেখে মা ¯èান করাতেন। এখন দুর্ঘন্ধ মনে হয়। তখন ভাল লাগত। ¯èান শেষে ঘরে ফিরতাম আমরা। সব সময়- প্রথম বৈশাখে নতুন জামা পাইনি। তবে যতটুকু সাধ্য ছিল বাবার- অন্তত একটি চিকন হাতার শাদা গেঞ্জি হলেও কিনে দিতে চেষ্টা করতেন। নতুন জামা না ফেলে হয়তো একটু ব্যাথা পেতাম মনে। তবে আজ যখন সমাজকে কিছুটা হলেও বুঝতে শিখলাম, তখন নিশ্চিত হই- আমাদের বাবা খাঁটি বাঙালি। আমরা জন্ম নিয়েছি সেই বাঙালির রক্তে। আজ গর্ববোধ করি একজন আদর্শিক-নৈতিক পিতার ঘরে জন্ম নিলাম বলে।
শিশু বা কৈশোরে ভাবতাম পহেলা বৈশাখ মানে হিন্দুদের একটি পুঁজা। আসলে তা নয়। আজ বুঝি এটি বাঙালীর সংস্কৃতি সত্ত্বা। মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক সংস্কৃতি। এটি বাঙালির বাঙালিয়ানা। এটি বাঙালির আবেগ-অনুভূতি।
আজ খুব মনে পড়েÑ নতুন বছর মানে পহেলা বৈশাখ। তখন এসব থার্টি ফাস্ট-টাস্ট বুঝতাম না। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম। আমি, আমার ভাই সুজিত, অজিত বাড়ির বন্ধু স্বপন, রিপন, শিপন, অভিলাশ, মনিকা, মনা কাকা এবং বাড়ির সকল শিশু-কিশোর মিলে ফুল কুড়ানোর জন্য ছুটা-ছুটি করতাম। এ ফুল ঘাস ফুল। কোন ফুল বাগানোর ফুল নয়। ফুল কুড়িয়ে এনে ¯èান সেরে নতুন যা পাই তা গায়ে দিয়ে উঠানে হাজির হতাম বাড়ির সব মেয়ে-ছেলে। আম গাছ থেকে সবাই দু-একটা আম পেড়ে নিতাম। তারপর শত্র“ আঁকতাম উঠানের মাটিতে। মানে একটা মানুষ আঁকতাম। তারপর ঐ মানুষের অবয়ব’র ওপর খই-মুড়ির গুড়ো ছিটে দিতাম। তার ওপর একটি আম। হাতে দা নিয়ে স্লোগান দিতাম শত্র“র বংশ ধংস হোক এ বলেই জোরসে একটা কোপ দিতাম। চেষ্টা করতাম যাতে করে এক কোপেই ছোট আম আর আমের বীজসহ কেটে যায়। যদি এক কোপে কাটতে পারতাম, তখন ভাবতাম আগামী বছরটি আমার শত্র“মুক্ত যাবে। এ সকল উদ্ভট অনেক কিছুতেও আনন্দ পেতাম তখন। সারা গ্রামের বৌ-ঝিদের চলাচল বেড়ে যেত প্রথম বৈশাখে। গ্রামে হেঁটে হেঁটে খুঁজতো দুনিয়ার সব লতা-পাতা। এসব লতা-পাতা- কুড়িয়ে এনে বাড়ির বৌ-ঝিরা বসে পড়ত উঠোনে এগুলো কাটা-কুটি করতে। কাটা-কুটি শেষে শুরু হতো রান্নার ধুম। সেদিন সকালে ভাত খাওয়া হতো না। সকালে নারিকেল, চিড়া, মুড়ি। তারপর রান্না শেষে খাওয়া হতো পাঁচন। এই ছিল তখনকার বৈশাখ উদ্যাপন।
বৈশাখের খুরধারা রোদে ঘামে ¯èান করতাম। তবুও গ্রামে গ্রামে হেঁটে বেড়াতাম, কোন্ গাছের আম একটু বড় হয়েছে। ঢিল ছুড়তাম আর বকুনি শুনতাম বাড়িওয়ালাদের। চুরি করতাম আম আর ভিটির কাঁচা মরিচ। মোটামুটি কয়েকটা হলেই রোদকে ফাঁকি দিয়ে বসে পড়তাম গাছের ছায়ায়। দু-একটি কলা পাতা নিয়ে মেলা থেকে কিনে আনা ছোরা দিয়ে কুচি-কুচি করে আম কাটতাম আর কাঁচা মরিচ সাথে ঘর থেকে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আনা একটু লবন ও চিনি মিশাতাম। আহ্-কি, মজা। লিখতে লিখতে জিবে জল এসে গেল। আজ জীবন থেকে কতগুলো বৈশাখ গেল। ফিরে যেতে ভীষণ ইচ্ছে হয় সে দিন গুলোতে।
এবার চৈত্রে পেশাগত কাজে গেলাম দণিাঞ্চলে। কয়েকটি বাড়িতে যেতে হলো। মানুষের সাথে কথার ফাঁকে ফাঁকে তাকিয়ে বেড়িয়েছি আমগাছ। খুঁজে পেয়েছি; যতটা আশা করেছি ততটা নেই। যা কয়েকটা আম গাছ আছে, তাও আমের সংখ্যা খুবই কম। চরাঞ্চলেও এখন ভবন আর ভবন হচ্ছে। কেটে শূন্য করে ফেলা হচ্ছে বৈশাখী আমেজ।
আজ শহরবাসী হয়েছি। বৈশাখ উদ্যাপন করিনা যে তা না। অন্য সবার মত গলিত পিছে মাথায় ছাতা নিয়ে শোভা যাত্রার মধ্যদিয়ে করা হয় বৈশাখ উদ্যাপন। আবার দেখি অনেকে পান্তা-ইলিশ দিয়ে বৈশাখ উদ্যাপন করে। বিষয়টি কার কাছে কেমন লাগে তা আমি জানিনা, আমার মনে হয়না বাঙালীরা কোনদিন পান্তা-ইলিশ খেয়ে তাদের ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করেছে। যারা পান্তা-ইলিশ পালন করেন তাদের প্রতি আমার নিন্দা বা ঈর্ষা নেই। তাহলে কী? হয়তো কেউ ঘৃণা ভাবতে পারেন।
আজ বৈশাখ আসে গানে গানে। আমেজ আসেনা আমার মনে। যখনই চিঠি পাই চারণ বৈশাখ উদ্যাপন করবে, সেখানে যেতে হবে আমাকেও। তখনই বুঝি বৈশাখ এসেছে, আমাদের নিমন্ত্রণ ছাড়াই। আজ আর কুড়ানো ঘাস ফুল দিয়ে বরণ করা হয়না বৈশাখ। একসাথ হতে পারিনা সব ভাই। জীবিকার তাগিদে জীবন তাড়িয়ে বেড়ায় সকলকে। আজ আর ছোট বেলার বন্ধুদের কাছে পাই না। এভাবে কতগুলো বৈশাখ থেকে পালিয়ে থেকেছি।
রফিকুর রশীদ ।। পরিত্যক্ত আলখাল্লা
সেদিন সকালে তেমাথা বাজারের ঝাঁকড়া পাকুড়তলায় একেবারে অভিনব এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সত্যিই সে দেখার মতো দৃশ্য বটে। এসব আচানক খবরের ডালপালা মেলতে তো সময় লাগে না, হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতে ছড়িয়ে পড়ে এ-পাড়া ও-পাড়া। চোখেমুখে টানটান কৌতূহল নিয়ে নানান বয়সের লোকজন ছুটে আসে, কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যায়, কেউ পিছিয়ে পড়তে রাজি নয়, সবার আগে জানতে হবে__ তছির পাগলের হঠাৎ এটা হলোটা কী?
কে একজন বিরক্ত দর্শক ভিড়ের উল্টোদিকে পিছিয়ে আসতে আসতে বলে, সঙ হয়িচে।
সঙ হয়েছে তছির পাগলের? মানুষজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। দুই-একজন ছেলেমানুষে ফিক করে হেসেও ফ্যালে। তাই বলে ভিড় ছেড়ে পিছিয়ে আসতে কেউ রাজি নয়। সঙ-ফঙ্ যা-ই হোক, সেটা তারা দেখতেই চায়। তছির পাগল তো তাদের কাছে অচেনা কেউ নয়। খুব চেনা, খুব জানা অতি সাধারণ মানুষ। না না, সাধারণ সে নয়; বরং পাগল বলেই খানিকটা অসাধারণ বটে। তবে হ্যাঁ, এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়___ তার পাগলামির ধরন এবং পরিধি এ তল্লাটের মানুষের কাছে এতটাই নৈমিত্তিক এবং পরিচিত হয়ে গেছে যে, তার মধ্যে অসাধারণত্বের বা অভিনবত্বের কিছুই আর খুঁজে পায় না কেউ। পাওয়ার কথাও নয়। অথচ এই তছির পাগলই সহসা সেদিন সমস্ত কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। কেন, কেমন করে সম্ভব হয় এটা? হঠাৎ কি তার মাথায় জট্ গজায়? নাকি পায়ের পাতা থেকে শেকড় নামে?
যেভাবে হোক, এই অতি চেনা, অতিসাধারণ তছির পাগলই সেদিন সকালে তেমাথা-বাজারের আলোচ্য ঘটনার নায়ক হয়ে ওঠে। কৌতূহলী মানুষজনের আর দোষ কোথায়। সবার দৃষ্টি তো নায়কের দিকে পড়বেই। তছির পাগল হয়তো খুব সামান্য মানুষ, তুচ্ছ মানুষ; কিন্তু তার পক্ষে নায়ক হয়ে ওঠা তো মোটেই সামান্য ঘটনা নয়! নিতান্ত সামান্য এক পাগলের এমন নায়ক হয়ে ওঠার কেচ্ছা কেই বা সহজে বিশ্বাস করবে! চাল নেই চুলো নেই, ঘরসংসারের নেই ঠিকঠিকানা, পথে-পথে ঘুরছে তো ঘুরছেই, মাসের দশদিন যদি গ্রামে থাকে তো বাকি কুড়িদিন কাটায় ভিন গ্রামে, কী খায় কোথায় ঘুমায় তার সঠিক হদিস কেউ রাখে না। এই হলো তছির পাগল। না, পাগল হয়ে জš§ায়নি। পিতৃহীন অনাথ তছির শৈশবে এ বাড়ি ও বাড়ি গরু চরিয়েছে, ম-ল-মেম্বারের বাড়িতে নির্বিবাদে হুকুম শুনেছে, রাত হলেই ছুটে এসেছে মায়ের কাছে। বয়স বাড়লেও মায়ের কোলছাড়া ঘুমোতে শেখেনি; সমাজ-সামাজিকতার আরও অনেক কিছুই তার শেখা হয়নি। তবু সবার অলক্ষে গ্রামজুড়ে অত্যন্ত সহজসরল এবং বিশ্বস্ত এক ভাবমূর্তি যে তার কখন কীভাবে গড়ে ওঠে, সে কথাও কেউ বলতে পারবে না ঠিকঠাক। এই গ্রামে বলতে গেলে সবার চোখের সামনে অতি সাধারণভাবে তার বেড়ে ওঠা, আশৈশব স্রেফ আলাভোলা স্বভাবের কারণে প্রায় সবারই সে প্রিয় পাত্র; তবু কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না__ তার এই পাগল হওয়ার প্রক্রিয়াটি কখন কীভাবে কোন প্রেক্ষাপটে শুরু হয়।
হ্যাঁ, নায়ক হওয়ার একটা সুযোগ তছির পাগলের জীবনে আগেও একবার এসেছিল বই কি! সেই নায়ক হওয়ার অসাধারণ ঘটনাটির গায়েও কাদা ছিটাতে চায় কেউ-কেউ। এমনই ঈর্ষাপরায়ণ সেইসব মানুষজন, তারা নায়ক হওয়া বলে না, বলে নায়ক সাজানো। সেদিন তছিরকে নাকি নায়ক সাজানো হয়েছিল বিশেষ কৌশলে। এ কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা! বর বেশে বিয়ে করার একটা রঙিন দিন তো প্রায় সবার জীবনেই আসে। ধনী-দরিদ্র, ন্যাংড়া-কানা, কালো-ফর্সা, লম্বা-বেঁটে যা-ই হোক, বর হওয়ার ওই একটি দিনে তো সে-ই নায়ক! কেবল তছিরের বেকলা যতো সব আতালি-পাতালি কথার বাহারÑ সাজানো নায়ক! তছিরকে কে সাজিয়েছে নায়ক? কেন সাজিয়েছে? কানে কানে গুনগুনিয়ে সে প্রশ্নেরও জবাব ভেসে বেড়ায় হাওয়ায় হাওয়ায়। ধরতে গেলে এসব কথার মূল খুঁজে পাওয়া মুশকিল; কিন্তু জানতে বাকি থাকে না কারোথ__ আলাভোলা তছিরকে নায়ক সাজিয়েছে আলেফ মেম্বর এবং আপন গরজেই তছিরের বিবাহবিষয়ক মজাদার এই নাটক তাকে বানাতে হয়েছে। ভারি এক নায়িকাও সে ফিট করেছে নিজের বাড়ির মধ্য থেকে, তিনজšে§র বাঁধা ঝি বিউটি খাতুনকে। বিউটি একা নয়, তার মা এবং নানিও জš§ পরম্পরায় ওই বাড়ির হেঁসেল-গোয়াল সামলে আসছেন; আলেফ মেম্বরের কথার বাইরে তারা যাবে কেমন করে! কাজেই আড়ালে-আবডালে আলেফ মেম্বরের কলেজপড়–য়া ছেলে রিন্টুর সঙ্গে যতই আশনাই জমে উঠুক, নায়িকা বিউটি খাতুনকে এ নাটকের নায়ক হিসেবে তছির পাগলকেই বরণ করে নিতে হয়। না, তছির তখনো পাগল হয়নি। তার সীমাহীন সরলতা এবং উদাসীনতাকে চারপাশের মানুষেরা চিরকালই মূর্খতা ও বোকামি বলে চিহ্নিত করেছে; কিন্তু তখনো কেউ পাগলামি বলে ঘোষণা করেনি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তছিরের বিবাহবিষয়ক নাটকের বিয়োগান্তক যবনিকাপাত ঘটলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। সহসা বিউটি খাতুনের রহস্যময় অন্তর্ধান নিয়ে যার মুখে যা আসে তাই মন্তব্য করে, এ নিয়ে আলাভোলা তছিরকেও উচ্চারণ-অযোগ্য নানাবিধ প্রশ্নবানে উত্ত্যক্ত করে। নির্বিকারত্বের দৃশ্যাতীত বর্ম দিয়ে তছির দিব্যি নিজেকে রক্ষা করে। তবু এ তল্লাটের অনেকে এরকম ধারণা করতে ভালোবাসে__ বাঁকবদলের এই প্রান্ত থেকেই তার পাগলামির সূত্রপাত এবং অতিদ্রুত তার বিস্তারও ঘটে। মায়ের আঁচল ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে অনন্য এক তছির পাগল। তারপর থেকে এই পথে পথে ঠিকানাবিহীন। তখন থেকেই তার মুখে শোনা যাচ্ছে কান্তিহীন এক গানের কলি ‘ওরে পাগল মন, মনরে আমার, আগে তোর মনটাকে তুই ঠিক কর...।’
তছির পাগলের পাগল হয়ে ওঠা-সংক্রান্ত এই রসঘন বিবরণ যে সারা গ্রামের সবাই একইভাবে বিশ্বাস করে, তাও নয়। যারা অবিশ্বাস করে তারা প্রবলভাবেই অবিশ্বাস করে এবং সেই অবিশ্বাস সুচারুভাবে ছড়িয়ে দেয়__ আরে ভাই, এসব হচ্ছে ইলেকশন ক্যারিক্যাচার। সামনে আবার ভোট না?
তা বটে, ইউপি ইলেকশন মোটেই দূরে নয়, এই নভেম্বর কি ডিসেম্বরে; গ্রাম্য রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ভোটের তোড়জোড় অলরেডি শুরু হয়ে গেছে, তা এর মধ্যে ঢুকতেও পারে ক্যারিক্যাচার; কিন্তু সেটা কী রকম? আলেফ মেম্বরের চির প্রতিদ্বন্দ্বী বরকুল মেম্বর। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা এই গ্রামের দুই প্রান্তে দুজনের বাস। গ্রামের মানুষের কী রকম বিচার-বিবেচনা দ্যাখো__ ভোটের আগে সাতকাহনের প্যাঁচাল যতোই পাড়–ক, ঝগড়া-বিবাদ যা-ই করুক, ভোটের বাক্সে ব্যালটপেপার জমা দেওয়ার বেলায় যেন তাদের যুক্তিবুদ্ধি করাই থাকে। একবার বরকুল মেম্বর তো পরের বার আলেফ মেম্বর। এমনই উল্টাপাল্টা রায় হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। এবারের ভোটে জেতার পালা আলেফ মেম্বরের। অনেকেই বলে___ ভোট সমীকরণের সেই সরল হিসাব-নিকাশ উল্টে দেওয়ার জন্য বরকুল মেম্বরের লোকজন তছিরকে জড়িয়ে ডাহা মিথ্যা এই কেচ্ছা ফেঁদেছে। আলেফ মেম্বরকে ভোটের গাঙে ডোবানোর জন্যে বিউটি খাতুনের গায়ের কাদা তছিরের মতো ষোল আনা সাদা মনের মানুষের গায়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-মাখিয়ে কার কতটুকু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে সমাজের মানুষ সে হিসাব নানাভাবে কষলেও ভোটের ফলাফলে তার কোনো প্রভাবই পড়েনি। কী এক অদৃশ্য কেরামতির জোরে কল্পিত বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে আলেফ মেম্বর ঠিকই সেবার নির্বাচনী বৈতরণী পেরিয়ে যায়। কিন্তু সেই নির্বাচনের পরপরই, বড়জোর সপ্তাহখানেকের মাথায় তছিরের বউ বিউটি খাতুনের নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারটা এলাকায় নতুন আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। সদ্যসমাপ্ত ইউপি নির্বাচনের সঙ্গে সামান্য এক গৃহবধূর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার আদৌ কী সম্পর্ক থাকতে পারে, তা নিয়েও বিস্তর গবেষণা হয়। কৌতূহল মেটাতে কেউ-কেউ অতি উৎসাহী হয়ে তছিরকেও চেপে ধরে, দাম্পত্যজীবনের খুঁটিনাটি নানা দিক নিয়ে ভব্য-অভব্য নানান প্রশ্নে জেরবার করে।
তছির নির্বিকার।
মুখে তার কথা নেই। কারো প্রশ্নেরই বিশেষ কোনো জবাব দেওয়ার গরজও সে অনুভব করে বলে মনে হয় না। কেবল ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকায় সবার মুখের দিকে। নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে সবার চোখের তারায় সে কী যেন ইঙ্গিত খুঁজে ফেরে; কিন্তু নিজে থেকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। তছিরের এ আচরণের কোনো ব্যাখ্যা মেলাতে পারে না কৌতূহলী মানুষজন। কেউ-কেউ জিভে চুকচুক ধ্বনি তুলে আহা আহা সমবেদনা জানায়, কেউ বা কাঁধে হাত রেখে বলে, বউ হারিয়ে তছির খুব কষ্ট পেয়েছে।
কষ্ট! বউ হারালে কে না কষ্ট পায়! সহজ-সরল তছির যেনবা অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। মুখে কথা ফোটে না। এই নীরবতা নাকি বেশ ভয়ঙ্কর। কেউ কেউ বলে ফ্যালে___তছির এবার নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাবে।
পাগল হওয়ার কি সঠিক কোনো দিন-তারিখ থাকে? এমন কথা কেউ কোনোকালে শুনেছে? তছিরের পাগল হওয়ার সূত্র খুঁজতে খুঁজতে অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করে বটে, তাই বলে কাঁটা কাঁটায় মিলিয়ে সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখের কথা কে বলবে? তবে সেই বউ হারানোরকালে তছিরের মনোভূমিতে অতি নিঃশব্দে ঘটে যায় শেকড়-উপড়ানো ভূমিকম্প। অথচ তছির নিস্তব্ধ। তবে হ্যাঁ, এরই মাঝে সবার অলক্ষে আরো একটি ঘটনা ঘটে যায়। খুব বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, যে তছির বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমোতে ভলোবাসতো, বউ হারানোর পর সেই তছির আর কিছুতেই মায়ের কোলে ফিরে যায়নি। রাত নামলেই সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। কে জানে হয়তো বিছানার দিকে দৃষ্টি পড়লেই তার শয্যাকণ্টকি শুরু হয়। হয়তো তখন ঘরে থাকাই দায় হয়ে ওঠে। তখন তার সারারাত কাটে পথে পথে, হয়তো কখনো এই তেমাথা বাজারের ঝাঁকড়া পাকুড়তলায় এসে বওয়ার সঙ্গে হেলান দিয়ে একটুখানি ঝিমিয়ে পড়ে। পাখি ডাকে। সকাল হয়। ঘরে ফেরার ইচ্ছে হয় না তছিরের। তার মা এসে আকুল হয়ে কাঁদতে-কাঁদতে জাপটে ধরে তাকে। মাথায় হাত বুলায়, গালে চুমু খায়। পুনর্বার বিয়ের প্রলোভন দেখায়; কিন্তু এসব তছিরের কিছুই যায় আসে না। সহসা হাত উঁচিয়ে সে গান ধরে__ ‘ওরে মন, আগে তোর মনটাকে তুই ঠিক কর...।’
তারপর এই দীর্ঘদিনে তছিরের মনের খবর সত্যি কেউ জানতে পেরেছে কি-না কে বলবে সেই কথা। নিজে উদ্যোগী হয়ে কারো সঙ্গে কথা বলে না তছির। পথে পথে ঘোরে। দিনরাত মুখে বিড়বিড় করে। একা একা কী যে বলে তা মোটেই স্ফুট হয় না। অল্পদিনের মধ্যেই ছেলে-ছোকরার দল তাকে নির্দয়ভাবে উত্ত্যক্ত করে___অতছির, তুমার বউ কনে? কথায় কথায় কারো কারো মন্তব্য শ্রবণ অযোগ্য তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তছির তবু নির্বিকার। কারো কথাই যেন তার কানে ঢোকে না। কেবল কেউ গান গাইতে বললে তার প্রতিক্রিয়া টের পাওয়া যায়। কোনো আপত্তি নেই। সামনে হাতবাড়িয়ে বেসুরো গলায় সেই একই গান ধরে, নিজের মনটাকে ঠিক করার আহ্বান জানায়। মাঝেমধ্যে শোনা যায় মনটাকে জয় করার কথা বলে। কীভাবে সেটা করা যাবে তার কোনো বিবরণ নেই, ওই আহ্বান পর্যন্তই। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে-ঘুরে তেমাথা বাজারে এসে তার প্রিয় পাকুড়তলায় বসে মন-বিচারী গান ধরে।
এভাবেই দিনে-দিনে তছির পাগলের জীবনযাপনের মধ্যে বিশেষ এক দার্শনিকতার আভাস ফুটে ওঠে। ধুলিমলিন বেশবাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গোঁফ-দাড়ির জঙ্গল। মাথার চুলেও অর্ধজটা পাখির বাসা। রোদ-বৃষ্টির পরোয়া করে না। রাস্তার দুপাড়ে এবং ঘরবাড়ির আশপাশে পলিথিন-কাগজ, টিনের কৌটা, কাচের বোতল ইত্যাদি পরিত্যক্ত সামগ্রী কুড়িয়ে বিক্রি করে যে যৎসামান্য আয়-রোজগার হয়, তা দিয়েই দিব্যি চলে যায় তার। কোনো কোনোদিন হুট করে বাড়ি এসে মায়ের হাতে দুই-একটা টাকা গুঁজে দিয়ে বলে__ নে মা। মা তো কেঁদেই আকুল। চোখের জলে বাঁধতে চায় ছেলেকে। তখন সে আবার মাকেই ঘুরিয়ে বলেÑ তুই কি পাগল হয়িচিস মা?
ছেলের কথা শুনে মায়ের চোখে বাঁধভাঙা বন্যা নামে। ‘বাপ্ গো’ বলে বিলাপ করে ওঠে; কিন্তু এসবের কিছুই মনে ধরে না তছির পাগলের। লোকটা এই রকমই। কারো কথার তোয়াক্কা করে না। কোনো অনুরোধও রাখে না। কেউ কোনো কিছু স্বেচ্ছায় দিতে চাইলেও সে নেবে না। সহসা কারো কাছে হাত পাততেও সে রাজি নয়। প্রবল ক্ষুধার মুখে নিতান্ত অনিচ্ছায় ও সসংকোচে কদাচিৎ তাকে হাত-ইশারায় খাবার চাইতেও দেখা গেছে বটে; কিন্তু সেখানেও ফুটে উঠেছে তার নিজস্ব দর্শন। নিজে খাবার চেয়েও যদি সে খাবার না পায়, তাহলেই সে হয়ে যায় অতি উদার দার্শনিক। ম্রিয়মাণ ভঙ্গিতে সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে আপন মনে বলে__ থাক, দরকার নি। নেই যে, দেবে কন্ থিকি! ঘরে থাকলি আবার দেয় না কিডা, এ্যাঁ! খাবার নি যে! থাকলি পারে ঠিকই দিতো! থাক, আমি খাবো না।
তছির পাগলকে ঘিরে এই রকম দার্শনিকতা ছড়ানো আরো অনেক কেচ্ছা এ অঞ্চলের মানুষের মুখে-মুখে প্রচলিত আছে। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কোনো কিছুই সে নিজের বলে গ্রহণ করতে পারে না। তবে যথার্থ মালিক এসে সেই অর্থ বা বস্তু গ্রহণ না করা পর্যন্ত তছির আপন দায়িত্বে পাহারা দিতে থাকে। সেই বস্তুকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে সে বিড়বিড় করে বলেথ__ কার যে বুকের পাঁজর ভাঙলো, কার কপালে গেরো ছেলো আল্লাই জানে! এ বিপদ আমি ফেলবু কুথায়, হায় আল্লা। এই রকম নানান কথার বিলাপ তার চলতেই থাকে চলতেই থাকে, সঠিক মালিক না আসা পর্যন্ত চলতেই থাকে। ভুল মালিক এসে হাত বাড়ালেই তছিরের গায়ে জ্বালা ধরে যায়, এ অন্যায়ের প্রতিরোধ সে একা করতে পারে না, হাত উঁচিয়ে গান ধরেথ__ ‘যার দ্যাখা সে দ্যাখে সবই, মনরে তুই দেখলি না/ও মন, কিছুই তো তুই শিখলি না...।’ এমন অন্যায্য ঘটনার পর তছির পাগল অনেকদিন আর সেই রাস্তায় হাঁটে না, এমনকি সেই এলাকায়ও থাকে না, দূরে কোথাও গিয়ে ঘৃণ্য এই ঘটনা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। সবাই জানে তছির পাগল এই রকম।
বহুদিন পর তছির পাগল গ্রামে ফিরেছে, তেমাথা বাজারে এসে অখিলের দোকান থেকে জর্দামাখা পান খেয়েছে, আপন মনেই গান ধরেছে....। এসব ঘটনার মধ্যে নতুনত্ব কোথায়! এই তছির পাগলকে এ অঞ্চলের কেনা চেনে! তা সেই তছির পাগল রাত পোহাতে না পোহাতেই প্রাচীন ওই পাকুড়তলায় এসে হঠাৎ কীভাবে যে নায়কোচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেটা এক রকম ভাবনার কথাই বটে। রাতারাতি কী এমন অভিনব প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে যে, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পিঁপড়ের সারির মতো লেকজন এসে হাজির হয় তেমাথা বাজারের পাকুড়তলায়! গ্রামের মানুষের এমনই বাঁধভাঙা কৌতূহল, একটা কিছু ছলছুতো পেলেই হলো, ঝাঁপিয়ে পড়ে কাতারে কাতারে। কেউ পিছিয়ে পড়তে রাজি নয়। তাই ঠেলাঠেলি।
কিন্তু তছির পাগল মধ্যজীবন পেরিয়ে এসে হঠাৎ সেদিন নায়ক হলো কমন করে? হ্যাঁ, ঘটনা একটা ঘটেছিল বছর দুই-তিন আগে। আলেফ মেম্বরের বড় ছেলে আরিফুল একদিন শহর থেকে একগাদা সাংবাদিক নিয়ে এসে ঘিরে ধরে তছির পাগলকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্যামেরার ফ্যাশ-লাইট জ্বলে ওঠে মুহুর্মুহু। একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আরিফুল ঘোষণা দেয়__ আমাদের এই তছির ভাই হচ্ছে এতদঞ্চলের সাদা মনের মানুষ। শুধু ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হয় না সে, দুহাত তুলে উপস্থিত জনতার মতামত জানতে চায়__আপত্তি আছে আপনাদের? মাথা খারাপ! কে জানাবে আপত্তি! তছির পাগল যে সাদা মনের মানুষ, সে বিষয়ে কারো কোনো ভিন্নমত নেই, সবাই সেটা ভালোমতো জানে; তাই বলে সে কথা এতদিন খবরের কাগজে তো প্রকাশ পায়নি! স্থানীয় দুই-তিনটি কাগজে তছিরের ছবিসহ ছাপা হয় তার প্রিয়গানের প্রথম কলি__আগে তোর মনটাকে তুই ঠিক কর...।
বেলা বাড়তে বাড়তে তেমাথা বাজারের পাকুড়তলা কৌতূহলী মানুষে কানায়-কানায় পূর্ণ হয়ে উঠলে অল্পক্ষণের মধ্যে জানা যায় এবারের আয়োজন আরিফুলের নয়, তার বাবা আলেফ মেম্বরের। বেশ কিছুদিন থেকে হাওযায় ভাসছে কথা__ আলেফ মেম্বর এবার চেয়ারম্যান পদে ইলেকশন করবে। মেম্বরগিরি হলো অনেকদিন, এবার সে বরকুলকেই ছেড়ে দেবে। এ আর হাওয়ায় ভাসা কথার কথা নয়, উপস্থিত জনতার সামনে দাঁড়িয়ে একেবারে খোলা-মেলাভাবে জানিয়ে দেয় আলেফ মেম্বর__ এ শুধু তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার মোটেই নয়, এটা হচ্ছে তার পীরবাবার আদেশ। প্রথমে স্বপ্নে আদেশ, পরে সশরীরে উপস্থিত হয়ে নির্দেশ দিয়েছেন; ফলে আলেফ মেম্বরের কাছে এ আদেশ এখন অলঙ্ঘনীয় এবং বাধ্যতামূলক।
এরপর আলেফ মেম্বর তার পীরবাবার সঙ্গে জনতার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সেই চিরচেনা তছির পাগলের ডানহাত তুলে ধরে ঘোষণা করেÑ ইনিই আমার পীরবাবা, পীরে কামেল হজরত তছির শাহ্। মানুষজন খ্যাক-খ্যাক করে হেসে ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করতে উদ্যত হয়; কিন্তু আলেফ মেম্বর দুহাত জোড় করে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ জানায়__আপনারা পীরের অসম্মান করবেন না। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, এতবড় পুণ্যবান ব্যক্তি আমাদেরই মাঝে এসেছেন পাগলের বেশে। এই পাকুড়তলায় আমি পীরবাবার দরবার শরিফ তৈরি করে দেব ইনশা আল্লাহ।
উপস্থিত পাবলিক কী যে বোঝে কে জানে, আলেফ মেম্বরের বক্তৃতা বেশ মনোযোগ দিয়ে শোনে। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ লক্ষ করে, এত চেনা লোকটার বক্তৃতার ভাষাও যেন বেশ খানিক বদলে গেছে। গ্রাম্য শব্দ, আঞ্চলিক উচ্চারণ এড়িয়ে দিব্যি শহুরে নেতাদের ভাষায় কথা বলছে, কথায় কথায় তার পীরবাবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এত কিছুর মাঝে সেই পীরবাবার কোনো প্রতিক্রিয়া বোঝার উপায় নেই। তার মুখে কথা নেই। পরণে নতুন পোশাক। সাদা ধবধবে ফতুয়া। সঙ্গে সাদা লুঙ্গি। মনে হয় যেন বা মৃত মানুষের শ্বেতশুভ্র পোশাক পরেছে তছির পাগল। পরেছে মানে সে কি স্বেচ্ছায় তার জীর্ণ মলিন কাপড়-চোপড় ত্যাগ করে এই পোশাক রিধান করেছে, নাকি কেউ জোর করে পরিয়ে দিয়েছে তাই বা কে জানে! শীতকাল ছাড়া তার গায়ে বিশেষ জামাকাপড় কেউ কখনো দেখেছে বলে মনেই পড়ে না। সেই মানুষ নতুন পোশাকের ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকতে পারে কতক্ষণ! হাতের কব্জি ভাঁজ করে পিঠের দূরধিগম্য এক জায়গা চুলকাতে গিয়ে হঠাৎ টান লেগে গলায় জুলানো রুদ্রাক্ষের মালাটি ছিঁড়ে যায়। আলেফ মেম্বর ভক্তিভরে ছেঁড়া মালাটি উবু হয়ে কুড়াতে উদ্যত হয়। এ দৃশ্য দেখে জনগণ উথলে ওঠা হাসির গমন রোধ করতে পারে না। অনেকে ভিড় ভেঙে বেরিয়ে আসে। তবু সারাদিনে নিত্যনতুন মানুষের আসা-যাওয়া একেবারে থেমে যায় না, চলতেই থাকে। রাত নিঝুম হলে তারপর পাকুড়তলা জনশূন্য হয়। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিযে পীরবাবা তছির শাহ্ নির্বিকার বসে থাকেন চুপচাপ। তার খেদমতের জন্য আলেফ মেম্বর দুই বিশ্বস্ত লোক নিযুক্ত করে। তাদের সঙ্গেও পীরবাবার কথা বলতে ইচ্ছে করে না, কেবল চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে তাদের মতিগতি বুঝতে চেষ্টা করে। একজন এরই মধ্যে হাঁ করে হাই তুলতে-তুলতে জিজ্ঞেস করে, পীরবাবা কি ঘুমাবেন না?
পীরবাবা নিরুত্তর।
রাত্রি নিস্তব্ধ হয়। প্রগাঢ় অন্ধকার ঘিরে ধরে চারিদিক। তেমাথা বাজারের সবগুলো বাতি নিভে আসে ধীরে ধীরে। পাকুড়গাছের পাতার আড়ালে পাখা ঝাপটায় রাতজাগা কোনো পাখি। একসময় আলেফ মেম্বরের পাঠানো খেদমত গারেরাও ঢলে পড়ে ঘুমের কোলে। তখন একঝাঁক জোনাকি মিটিমিটি আলো জ্বেলে এগিয়ে আসে, যেনবা ইশারায় ডাকে তারাÑ আয় তছির, মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমাবি যদি আয়...।
সকালে মানুষজন এসে দেখতে পায় পাকুড়গাছের ডালে ঝুলছে পীরবাবার ধবধবে নতুন পোশাক, গাছতলার প্রস্তাবিত দরবার শরিফে পীরবাবা নেই।
মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ ।। অলৌকিক টেলিভিশন
চারদিকে গুমোট অন্ধকার। চোখ দুটো ভারি বাটখারার
মত সেঁটে আছে ধড়ের সঙ্গে - নড়ে না, চড়ে না। আজ তাঁর মনের দরজাজানালার
সব কপাট খুলে গেছে অকষ্মাৎ- তিনি সকালেও এমনটি
ভাবতে পারেননি। এক আলৌকিক টিভি
বাক্সের ভেতরে লুকিয়ে আছেন যেন - এখন কেউ তাঁকে আর দেখছে না। অথচ তিনি সবাইকে
দেখছেন এক অশরীরী শক্তির অপার মহিমায়।
বার বার স্কুলের
কথা মনে পড়ছে। ক্লাসরুমগুলো, লম্বা লম্বা বারান্দাগুলো, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে
থাকা দেবদারু মেহগনির সারি সারি গাছ - এখনো যেন প্রতিদিনের মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। কমনরুমের সামনে
নারকেল গাছ দুটোর বাড়তি বুড়োমরা পাতা, থোরের শুকনো বাকল-সাকল
;
যা আগামীকাল পরিস্কার করার কথা কালুকে বলেছিলেন তিনি। তা কালুমিয়ার আর এতক্ষণ মনে থাকবে কিনা - এ নিয়ে জেগে থাকা
সন্দেহটুকু ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে তাঁর।
সমস্ত শরীরের সাদা উর্দিটি সঙ্গে সঙ্গে
মনটা ফুরফুরে করে দিচ্ছে আবার।
এক অদ্ভুত শক্তির
ছোঁয়া সারা গায়ে লেগে আছে - ইচ্ছে করার সঙ্গে সঙ্গে যেন তিনি এখন সবকিছু দেখছেন। সব কিছু পেয়ে যাচ্ছেন। বার বার কমনরুমের
কোণার টেবিলটির তৃতীয় চেয়ারের কথা মনে পড়ছে। চেয়ারটির উপর কোন তোয়োলে নেই-ছিলনা। কাঁঠাল গাছের পুরনো
চেয়ার - হাতল দুটো ও পেছনের কাঁধাটা ঘামে ময়লায় চিটচিটে থাকতো সারা বছর। ওটি তাঁর চেয়ার। এই চেয়ারের এক সময়
পণ্ডিত হরলাল রায় স্যার বসতেন। তিনি প্রমোশন নিয়ে চলে যাবার সময় চেয়ারটি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। এই চেয়ারের সম্মানটা
বেশ আলাদা। এটি স্কুলের পুরাতর
মাস্টারগণ ভালভাবে জানেন। হরলাল স্যারের চেয়ারেই বসেন সাদিক সৈয়দ। প্রাক্তন ছাত্ররা
যাঁরা আজ অনেকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উকিল ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছেন- তারা তা মনে রেখেছেন। প্রতি বছর এখনও
অনেকে আসেন - তাঁরা যখন স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে স্মৃতি চারণ করেন পরীক্ষার রেজাল্টের
কথা বলেন, গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টের কথা বলেন। তখন হরলাল স্যারকে
স্মরণ করেন - তাঁর কাঁঠাল গাছের চেয়ারের কথা বলেন। বলতে থাকেন। স্যার এই স্কুলে
শুধু তাঁকেই পছন্দ করতেন ,ভালোবাসতেন। তিনি তাঁকে সঙ্গীতশিক্ষক
হিসেবে এখানে নিয়োগ দিয়েছিলেন। স্যার শিল্পের ভক্ত-সমঝদার ছিলেন; ডি এল রায় আর অতুল প্রসাদের গানগুলো শুনলে তাঁর চোখ জোড়া
ভিজে যেতো। তাঁরা এক সঙ্গে
স্কুল-লাইব্রেরির পাশে এক চিলে কোটায় ছিলেন - তিন বছর। পরের উনিশ বছর তিনি
একা একা ও ঘরেই ছিলেন। সব স্মৃতি- সব কথা
তাঁর বার বার মনে পড়ছে। কেন পড়ছে তিনি কোনক্রমেই বুঝতে পারছেন না। কখনো কখনো মনে হয়-
এই জীবনটা বুঝি এ রকমই শুধু স্মৃতি তর্পন-অনন্ত সময় ধরে অপেক্ষা। কিন্তু কার জন্যে
এই অপেক্ষা, কেন এই অপেক্ষা কিছুই তিনি জানেন না-বোঝেন
না। তিনি দেখতে পাচ্ছেন-এখনো
চেয়ারটি খালি পড়ে আছে। এই চেয়ারে প্রতিদিন তিনি বসতেন -ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কাছে
আসতো। তাঁর কেন যেন মনে
হচ্ছে-ওই চেয়ারে আর কেউ বসবে না। এটি তাঁর চেয়ার-তিনি নেই তো কে বসবে। কেউ বসবে না। আজ বাইশ বছর তিন
মাস তের দিন ধরে একমাত্র তিনিই এই চেয়ারে বসেছেন। তিনি না থাকলে এটি
খালি থেকেছে। ক্লাসে গেলে খালি
থেকেছে। ছুটিতে থাকলে খালি
পড়ে থেকেছে। এখন ভাবছেন এই কাঠের
চেয়ারটা কাকে দেয়া যায় অথবা কীভাবে এখানে নিয়ে আসা যায়। তিনি হেডমাষ্টারের
সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন- পারছেন না। হয়তো আর কখনো পারবেন না। মাঝে মাঝে মনটা
বিষিয়ে ওঠে। হেডমাস্টারের কথা
মনে পড়লে তীব্র চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলতে ইচ্ছে হয় কিন্তু পারে না। সাদিক সৈয়দ হেড
মাস্টারকে বিশ্বাস করে না। আর শুয়ে শুয়ে ভাবছেন একটু পরের সাক্ষাৎকারটুকু তিনি কীভাবে
শুরু হবে। ভয় হচ্ছে- বার বার সুরা ইখলাস পড়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। এখানে কোন দোয়া
দরুদ পড়ার নিয়ম নাই। কোন ভাবে বুঝতে পারছেন না- ইন্টারভিউতে তিনি কী বলবেন ;কী বলবেন না।
আসসালামু আলাইকুম
ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ- জানাজার শেষে ইমামহুজুর
প্রথমে ডানে পরে বামে মুখ ঘোরালেন। দুইবার দুইদিকে সালাম জানালেন। মুসল্লিরাও হুজুরের
মত ডানে বামে ঘাড় ফিরিয়ে সালাম দিলেন। কাকে দিলেন কেন দিলেন কেউ তা ভাবে না। হয়তো ফেরেশতাদের
দিলেন। এখন এখানে কয়জন
ফেরেশতা থাকতে পারে তা কেউ জানে না। এদের দেখা যায় না, উপস্থিতি টের পাওয়া
যায় না- কীভাবে জানবে। কিন্তু তিনি জানেন- তিনি মানুষ দেখছেন ; ফেরেশতাদেরও দেখছেন। তারপর হুজুর যথারীতি জিজ্ঞেস করেন- লোকটি কেমন ছিলেন? ভালো ছিলেন, খুব ভালো ছিলেন-তখন সকলে সমস্বরে উত্তর দেন। আবার পেছনে কেউ
কেউ হাউমাউ করে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। আজও মাস্টারসাহেব চুপ থাকতেন। তাঁর মন কখনো সায়
দিতো না- তাঁর বুঝতে কষ্ট হতো এভাবে জানাজার মাঠে কারো চরিত্রের সনদ দিলে কারো পাপ
কীভাবে মাফ হয়ে যায় । আজাব কীভাবে হালকা হয়। এখন তিনি নিরুত্তর-
গভীর ঘুমের কোলে যেন অচেতন। বিশাল অডিটরিয়াম-
পুরোপুরি ফাঁকা। কোন ছাত্রছাত্রী
নেই। কয়েক বছর ধরে এ
রকম চলতে চলতে এটিই এখন চল হয়ে গেছে। এখন কোন জাতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সংযোগ সংস্রব নেই। মঞ্চে সভাপতি মহোদয়
তাঁর অতিথিদের নিয়ে বসে আছেন। সভাপতির চেয়ারটি বেশ উঁচ, বড়োসড়ো- দামি তোয়ালেঢাকা। সরকারি অফিসে যিনি
প্রধান তিনিই সকল সভা সমিতির সভাপতি- এটি নিয়ম। পেছনে ঝুলছে জাতীয়
শোক দিবসের নানারঙের ডিজিটাল ব্যানার। সামনে বিশ-বাইশজন অনিচ্ছুক শ্রোতা বসে আছে। তাঁরা একটু পর পর
কথা বলছেন। কেউ কেউ খবরের কাগজ
পড়ছেন। কেউ কেউ মুঠোফোনে
ফেসবুকে ঘুরছেন। কেউ কেউ আবার হাই
তুলছেন। কারো তেমন আকর্ষণ
অনুরাগ নেই। একজন ছাড়া সবাই
যেন সব কিছু ভুলে গেছেন। তিনি তেমন কোন কেউ নয়- তাঁর মনে রাখা না রাখায় কিছু যায় আসে
না। বেচারা একেবারে
একা- বেশ পেছনে বসে আছেন। তাঁর কাছে এটি একটি মঞ্চ নাটকের মতো মনে হচ্ছে।
অতিথিদের মুখোমুখি
ক্যামেরাম্যান দাঁড়িয়ে- ক্লিক ক্লিক ক্লিক শব্দ হচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। তিনি সবার সামনে-পেছনে
বানে বামে হাঁটছেন। বোঝা যায় সভার ছবিগুলোই খুব দরকার- অন্যকিছু নয়। আলোচনা নয়, আদর্শ নয়, কারো জীবন ও কর্মের
মূল্যায়ন তো নয়ই। আর একটি কাগজ আগে
হতে তৈরি আছেÑ যা
কিছুক্ষণ পরেই বিভিন্ন মিডিয়ায় চলে যাবে। প্রেসবিজ্ঞপ্তি। ক্যাম্পাসে শতশত
ছাত্রছাত্রী নিজেরা নিজেদের মত ব্যস্ত। কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গালগল্প করছে- কেউ বা নানা
জাতের গাছের ঘন ছায়ার নিচে। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ক্লাস রুমে। কয়েকজন ছাত্রী শিউলি
তলায় ঝরা ফুলগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে খবরের কাগজের উপর রাখছে; আজকে রঙ্গনফুলের গাছগুলো ফুল ফুলে ভরে আছে- ডালে-পাতায় যেন
ছোপ ছোপ রক্তের দলা। ওদিকে চোখ পড়লেই মনটা বিষাদে ভরে উঠে।
বিসমিল্লাহ হির
রাহমানির রাহিম- বলে সঞ্চালক সভার শুরুতে উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানালেন। সভাপতি, প্রধান অতিথি ও অন্যান্য অতিথিদের পরিচয় জানিয়ে দিলেন। এখন জনকের শোক সভায়
উপস্থিত সকল শ্রোতার সামনে একে একে পবিত্র গ্রন্থ আল-কোরআন, গীতা ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ শেষে বক্তরা এক একজন করে আলোচনা
করে যাচ্ছেন।
সবাই বিসমিল্লাহ হির রাহমানির রাহিম -বলে আলোচনা শুরু করছেন
। তিনি ভাবছেন আর
ঘামচেন। আর মনে করতে চেষ্টা
করছেন আয়োজিত শোক সভার উদ্দিষ্ঠ নায়ক কখনো বিসমিল্লাহ বলে ভাষণ শুরু করেছিলেন কিনা। না, তাঁর তা মনে পড়ে না। মঞ্চে উপবিষ্ট অমুসলিম
অতিথি ক’জন বেশ নীরব -তাঁরা এই আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন
না। আবার অনেকে আসেননিও। কয়েকজন মুখ গোমড়া
করে বসে আছেন। সবার পেছনে বসে
কী যেন ভাবছিলেন তিনি। শোকসভা প্রায় শেষের দিকে। অফিস পিয়ন আমজাদ, মফিজ, জামসেদ নাস্তার
প্যাকেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেন জানি মন ভরছে না তাঁর-দিলের ভেতর দুঃখের ঘণ্টা বাজছে। তাঁর বক্তব্য দেয়ারও
সুযোগ নেই। থাকবে কি করে তিনি
তো সিনিয়র কেউ নয়। সৈয়দ বংশের কলঙ্ক-শুধুই
গান গায়, দেশের কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে বলে মানি লোকদের অপমানিত করে। পঞ্চাশের উর্ধে
বয়স-নামাজ দোয়া নেই, মসজিদ-মাদ্রাসায়
কখনো পা দেয় না। মিলাদের কথা বললে
আনমনা হয়ে যায়। শোনা যায়-তিনি নাকি
আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা করার সময় হামদ-নাত গাইতে গাইতে সঙ্গীতের ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন। আরো অভিযোগ আছে-
সাদিক মিয়া ঠোঁট কাটা; হাটে হাড়ি ভেঙ্গে
দেয়। বুদ্ধি কম- মেপে কথা বলতে জানে না, সুবিধা-অসুবিধা
বোঝে না। খামোখা হক কথা কয়, বিপদ ডেকে আনে।
ভালোবাসার স্পর্শহীন ফাঁকাবুলি- দায়সারা কথার ফুলঝুরি তাঁর ভালো লাগে
না।
একে একে চার পাঁচ
জন বক্তা আলোচনা করলেন-তাঁরা বিভিন্ন বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক। তাঁরা বারবার শহিদদের
বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছেন। কিন্তু কাদের হাতে কীভাবে কে কে শহিদ হলেন কেউ বলেন না। বিসমিল্লাহ হির রাহমানির রাহিম নাহমদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা
........ .... .. বলে লম্বা একটি দোয়াপাঠ করে ফিনফিনে সুতোর পাঞ্জাবি পরা পরবর্তী বক্তা আলোচনা শুরু করলেন। আবেগ ভরা কণ্ঠে
জানালেন, তিনি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করেন। কারণ তাঁর নেতাকে
এক পলক দেখার সুযোগ হয়েছিল। সভার সামনে তিনি নেতার কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন ধবধবে সাদা
পাঞ্জাবির উপরে পরা কালোকোটটি ছুঁয়ে দেখেতে চেয়েছিলেন তিনি।
এবার প্রধান অতিথির
পালা। বিসমিল্লাহ হির
রাহমানির রাহিম। একটু নরম সুরে আলোচনা
শুরু করলেন তিনি।
‘ইতিহাস খুবই নির্মম। প্রতিটি ব্যক্তি
যাঁর জায়গা তিনিই পেয়ে যাবেন- একটু আগে বা পরে। অন্য কেউ তা ধরে
রাখতে পারে না। অস্বীকার করার কোন
কারণ নেই রাষ্ট্রপতি জিয়াঊর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি
কখনো বলেন নাই তিনি স্বাধীনতার ঘোষক। ’ এইটুকু বলে একবার সভাপতির দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ জোড়া বন্ধ-অতি
উঁচু চেয়ারে বসে বসে তিনি ঝিমুচ্ছেন-ঘুমুচ্ছেন। এটি তার খুব শখের
চেয়ার- তাঁর অফিসরুমে এ চেয়ারেই তিনি বসেন। কোন অনুষ্ঠান হলে অডিটরিয়ামে বা খেলার মাঠে পিয়নরা এটি নিয়ে
যায়- নিয়ে যেতে হয়। অন্য চেয়ারে তিনি
বসেন না।
তারপর একটু ঢোক গিলে তিনি আবার বললেন- ‘নিয়তির নির্মম পরিহাস পঁচাত্তুরের এই দিনে বঙ্গবন্ধু অপঘাতে
(!) মৃত্যু বরণ করেন।’
পেছনের কোণার শেষ শেয়ার থেকে গর্জে উঠলেন সাদিক সৈয়দ -‘এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড- কোন অপঘাত বা দুর্ঘটনা নয়। না, না, এই বক্তব্য আমি
মানি না। এটি নির্জলা মিথ্যাচার। মিথ্যাবাদী - মিছাখোর
কোথাকার।’ -কথাটুকু বলতে বলতে
তিনি বুকে হাত রাখেন। কাঁপতে থাকেন। ঘৃণায়-ক্ষোভে ফেটে
পড়েন । তারপর পেছনের চেয়ারের
উপর ঢলে পড়েন।
ইমার্জেন্সির কর্তব্যরত
ডাক্তারগণ তাঁর নাড়ি দেখছেন। বুকের উপর দুই হাত রেখে কয়েক বার জোরে জোরে চাপ দিচ্ছেন আর
ধীরে ধীরে বিমর্ষ হয়ে পড়ছেন।
তাঁদের একজন জানতে চাইলেন - কী ব্যাপার স্যারের কী হয়েছিল? তখন কী বলবেন- এই প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে এর কোন কূল কিনারা খুঁজে পায় না মাস্টার তাহের। নীরবে আনমনে ট্রলির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাত্র। তাঁরা দুজনে আজ গত বাইশ বছর ধরে শৈলসাগর উচ্চবিদ্যালয়ে এক সঙ্গে শিক্ষকতা করছেন। পদ্মপুকুর পাড়া কবরস্থান - শাকের, শহিদ, রবিউল, আনিস ও মাস্টার তাহের তখনো কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। শাকের কোন ভাবে মানতে পারে না সাদিক মাস্টার আর বেঁচে নেই। প্রতিদিন সকালে তাঁরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মাছ- তরকারি কিনতে যেতো পাশের বাজারে। তাঁর বিশ্বাস হয় না- এ রকম মৃত্যু মানুষের কীভাবে হতে পারে। তিনি যেন দেখতে পাচ্ছেন - সাদিক সৈয়দ এখনো ট্রলির উপর শুয়ে আছেন।
তাঁদের একজন জানতে চাইলেন - কী ব্যাপার স্যারের কী হয়েছিল? তখন কী বলবেন- এই প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে এর কোন কূল কিনারা খুঁজে পায় না মাস্টার তাহের। নীরবে আনমনে ট্রলির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাত্র। তাঁরা দুজনে আজ গত বাইশ বছর ধরে শৈলসাগর উচ্চবিদ্যালয়ে এক সঙ্গে শিক্ষকতা করছেন। পদ্মপুকুর পাড়া কবরস্থান - শাকের, শহিদ, রবিউল, আনিস ও মাস্টার তাহের তখনো কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। শাকের কোন ভাবে মানতে পারে না সাদিক মাস্টার আর বেঁচে নেই। প্রতিদিন সকালে তাঁরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মাছ- তরকারি কিনতে যেতো পাশের বাজারে। তাঁর বিশ্বাস হয় না- এ রকম মৃত্যু মানুষের কীভাবে হতে পারে। তিনি যেন দেখতে পাচ্ছেন - সাদিক সৈয়দ এখনো ট্রলির উপর শুয়ে আছেন।
কিছুক্ষণ পর তাঁর
ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি আবার আড়মোড়া
ভেঙ্গে হাই তোলেন । নিজেকে এভাবে দেখে একটু ভ্যাবাচেকা খেলেন যেন। এই অন্ধকার প্রকোষ্টের
ভেতর আলো -জোছনার এক মায়াবি খেলায় নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। দূর থেকে এক অপূর্ব
সুর যেন ভেসে আসছে তাঁর কানে। এটি কি কোন নদীর কুলকুল ধ্বনি না কোন বিশেষ সঙ্গীতের কোমলধারা-
তিনি তা বুঝতে পারছেন না। অথচ এক অচেনা আনন্দে মনটা বার বার নেচে উঠছে। তিনি নিজেকে তাঁর প্রিয় সেই কাঁঠালগাছের চেয়ারে বসা দেখে
অভিভূত হয়ে গেলেন। এখন চেয়ারটি বেশ ঝকঝকে আয়নার মতো - যাতে তাঁর নিজের প্রতিবিম্ব
ফুটে উঠছে। তারপর তিনি আস্তে
আস্তে বুঝতে পারলেন- এটি তাঁর অন্য জীবন। এবার তিনি মুনকির
নকিরের প্রশ্নোত্তরের জন্য তৈরি হতে চেষ্টা করছেন। তিনি মনে মনে মুখস্ত
করতে লাগলেন- আমি সাদিক সৈয়দ, আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ। হঠাৎ কয়েকটি আওয়াজ
তিনি শুনতে পেলেন; পরিচিত কেউ যেন
তাঁর কাছে জানতে চাইলেন- স্যার, আপনি কেমন আছেন? আপনার এই মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? আমি ভালো আছি- বলে অপর প্রশ্নের উত্তর বলার পূর্বে অন্য আরেকজন
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন- না, আপনার আর বলার প্রয়োজন
নেই। আপনি রেস্ট নিন। বিষয়টি কিরামান
কাতিবিনের ডেইলি রিপোর্টে আমরা জানতে পেরেছি। আপনি তো জানেন, ওরা ফেরেশতা- তারা প্রতি মুসলমানের কাঁধে থেকে তাঁর দৈনিক
কার্যবিবরণী তৈরি করেন।
কথা শেষ হওয়ার পরপর
তিনি কয়েকজন মানুষের কাতর আর্তনাদ শুনতে পান। এই কণ্ঠগুলো তাঁর
বেশ পরিচিত মনে হলো। আস্তে আস্তে ঘরের আলো যেন আরো বাড়তে থাকে।
এবার তিনি
দেখতে পেলেন-একটু দূরে তাঁর সমানে কয়েকজন বন্দি পড়ে আছে। তিনি তাঁদের পেছনে-চোহারাগুলো
দেখা যাচ্ছে না। এই দৃশ্যটি দেখে তাঁর শরীর শির শির করে কেঁপে ওঠে। তাঁর চোখ জোড়া আটকে যায়। তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। বন্দিগুলো শক্ত দড়ি দিয়ে পিঠমোড়া বাঁধা। হাতগুলো পেছনে-কব্জি বরাবর অন্য একটি রশির গিটে। তাদের মাথামুণ্ডু থেতলানো – শরীর থেকে বেয়ে আসছে লাল রক্তের ধারা।
ঘরের মেঝে কয়েকটি
ভাঙ্গাচেয়ার- ক্ষত বিক্ষত লাশের সামনে যেন লণ্ডভণ্ড
হয়ে পড়ে আছে। চেয়ারগুলো অতি উঁচু, উঁচু আর মাঝারি গোছের। সুখদর্শন । । অজিত দাশ
সে বসেছিলো পুরানো ঘাটলায়। দিঘির পূর্ব দিকে। রাস্তার পার ঘেষে কোনো গাছপালা নেই। সন্ধ্যার আলোয় বাতি জ্বলে ওঠছে একেকটি ছোট ছোট সংসারে। এখানকার রাস্তাঘাট এমনকি ঘাটলার কোনায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো তার। জলের উদ্দেশ্যে কতদিন কত কথা বলেছে সে। দুই পা ডুবিয়ে কী রকম অদ্ভুদ সুখে আওড়ালো, ‘এই যে স্বচ্ছ তুমি প্রাণহীন, আড়াল করে রেখেছো কিছু জীবনের ছবি, তোমাকে মানিয়েছে। জীবনের ক্লান্ত মায়া ছেড়ে একদিন পালাতে হয়। এই অপূর্ব দৃশ্যে মুগ্ধ আমি।’ তারপর অনেক কিছু ভাবার চেষ্টা করে অত সব জটিলতার মধ্যে যেতে চায় না সুবিমল। অনেক নিরবতা শেষে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করে আবারও হুঁচোট খায়। আজ একেবারে ফাঁকা, শূন্য মাথায় কিছুতেই পার পেয়ে উঠতে না পেরে মাথায় ঝিম ধরে আসে। ঘুরে ফিরে পরমার কথা মনে পড়ে। শৈশবের এক চিলতে উঠোনে পরমার গা ছুঁতে না পেরে সে কি ক্রোধ জন্মেছিলো। এলোপাথাড়ি ভাবনায় বাড়ির কথা ভুলে যায় সে।
মণীষা চলে যাবে। এক ঝাপটায় চার বছরের সংসার যাত্রার সব টুকি টাকি সুবিমলের চোখ এলোমেলো করে দেয়। মানুষের অন্তরঙ্গ বিষাদ থেকে যে অভিমান উঠে আসে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে দিনরাত। ভিতরে ভিতরে মণীষার কাছ থেকে বিদায়ের পাকা পোক্ত ব্যবস্থা করে নিচ্ছিলো সে। যে শিকড় উপড়ে ফেললে পুরুষের শুদ্ধতা ম্লান হয়ে আসে তার জমকালো আয়োজনে ক্লান্ত হয়ে উঠে। অথচ শারীরিক ও মানুষিক এই দুই দিক থেকে এত পরিচ্ছন্ন বিদায় নেবে তা আগে ভেবে উঠতে পারেনি।
২
মাঝের ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুবিমল । মণীষা বিছানায়। কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে না পেরে একটু একটু করে বিছানার দিকে পা বাড়ায় সে। পুজোর ঘর থেকে ভেসে আসা ধূপ চন্দনের চেয়ে মণীষার গায়ের গন্ধ তার কাছে অনেক পবিত্র মনে হয়। বিছানায় বসে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মত মণীষার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আলগোছে পায়ের পাতায় চুমো খেয়ে বলে, ‘তুমি চলে গেলে বাড়িটা বেঁচে দিবো। অত বড় বাড়ি দিয়ে কি হবে আমার, আমি একলা মানুষ।’ মণীষা চুপ করে থাকে। কোনো উত্তর না পেয়ে নিজেকে পাথরের চেয়ে ভারী মনে করে সুবিমল। মাঝের ঘর ছেড়ে বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরের গুমোট অভিমান থেকে গান ভেসে আসে- ‘ওগো ভোলা ভাল তবে কাঁদিয়া কী হবে মিছে আর। যদি যেতে হল হায় প্রাণ কেন চায় পিছে আর।’
৩
বিকেলে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে মণীষা। পরিপাটি সাজগোছে ঠোটের এক কোনে অভিমানের স্পষ্ট চিহ্ন বুঝা যায়। বাড়ির চারপাশে লাগানো গাছাগাছালির দিকে দ্রুত গতিতে এমনভাবে তাকিয়ে নিচ্ছিলো যেন আজন্মের ছবি তুলে রাখবে তার স্মৃতির ভিতরে। হঠাৎ বাগানের শ্যাওলা মাখানো ইটের পাশে লাগানো গাছটির দিকে নজর পড়ে তার। কতগুলো কলির মাঝখানে ধবধবে একটি সাদাফুল ফোটেছে। অনেক চেষ্টা করে ফুলের নাম মনে করে, ‘সুখদর্শন।’ তারপর বিরিবিরিয়ে নিজের ভিতরে বলতে থাকে, ‘মানুষের টিকে থাকাটাই সব। টিকে থাকতে পারলেই হলো। ভালবাসা আর ঘৃণার দিব্যি অভিনয় করে বাঁচা যায়।।’ একটা নিস্তেজ হয়ে যাওয়া মায়ার কথা ভেবে নিজেকে কেমন একা ভাবে সে। ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের দরজায় তালা দিয়ে মণীষার পিছনে এসে দাঁড়ায় সুবিমল। নিস্তব্দ দাঁড়িয়ে থাকে। অপ্রতিম মুগ্ধতার নেশা ধরে যায় তার চোখে। হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে পেছনের দিকে তাকালে সুবিমল আতকে উঠে। কী রকম একটা বজ্রপাতের শব্দ শুনে ভিতরে ভিতরে। নিজেকে নিছক দর্শক মনে হয় তার। হাঁটতে হাঁটতে মৃদু স্বরে সুবিমল বলে- ‘তোমার লাল কালো শাড়িটা রেখে দিয়েছি। একেবারে ঘর খালি হলে লক্ষী নারাজ হবেন।’ মণীষা মাথা নাড়িয়ে সন্মতি জানায়। দরজা খুলে রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়ায় দুজন। রিক্সা ঠিক করে ওঠে পড়ে। প্রচন্ড গরমে বিরক্তির ভাব ভুলে যায় সুবিমল। ঝাপসা অন্ধকারে সমগ্র চৌধুরি পাড়া ফাঁকা লাগে তার কাছে। এক মুহূর্তে দূরত্বের একটা গোপন মূল্য গেথে যায় তার মনে, ভিতরে ভিতরে বার বার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, ‘মাত্র আধঘন্টা লাগবে ঠাকুড়পাড়া যেতে; কী আশ্চর্য লাগে মানুষকে দুই ভাবে বিদায় দিতে হয় জীবিত অথবা মৃত।’ সে নিশ্চিত হতে পারেনা কোনটা বেশি দুঃখের। মুখফোটে মণীষাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে আবার থেমে যায়। আচমকা মণীষার হাত চেপে ধরে সুবিমল, ভাঙ্গা গলায় মিনিমিনিয়ে বলে-‘মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে আসবো। ইচ্ছে না হলেও একটু দেখা দিও।’
৪
জলপাই রঙ্গের গেট পার হয়ে হাঁটতে শুরু করে সুবিমল। চারপাশে করতালের আওয়াজ হতে থাকে। বটতলার পাশ দিয়ে যেতে মন্দিরের কীর্তন সুর বিচ্ছিরি লাগে তার কাছে। দ্রুত গতিতে অন্ধকার ঠেলে রাস্তার আলোর দিকে ছুটে আসে । চারপাশে তাকায়। আজ তার কোনো তাড়া নেই বাড়ি ফেরবার। মানুষের ভীড়ে মিশে গিয়ে মনে মনে বলে, ‘হে অনন্ত আমি তোমার গোপন ফাঁদে পা দিয়েছি। আমাকে দীক্ষা দাও। আমাকে শুদ্ধ কর তোমার সমস্ত বেদনার রঙ দিয়ে।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন