জোছনা ।। শিমন শারমিন
মূল : গ্যি দ্য মোপাসা
জুলি রুবের উৎসুক হয়ে বড় বোনের জন্য অপেক্ষা করছেন। সুইজারল্যান্ডে ভ্রমণ শেষ করে তার বোন, হেনরিয়েটা লেটোর আজকেই ফিরছেন। সরাসরি তিনি ছোট বোনের বাসায় এসে উঠবেন।
প্রায় পাঁচ সপ্তাহ আগে লেটোর দম্পতি তাদের বাড়ি ছেড়েছিলেন। তবে হেনরিয়েটার স্বামীকে আগেই ব্যবসার প্রয়োজনে ক্যালভাডোসে চলে যেতে হয়েছে, সুইজারল্যান্ড থেকেই। আর হেনরিয়েটা চলে আসবেন প্যারিসে, তার বোনের সঙ্গে কিছুদিন কাটাতে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায়। অন্যমনস্ক জুলি বসার ঘরের নির্জনতায় চুপ করে বসে বই পড়ছিলেন। যে কোনো শব্দেই চকিতে একবার তাকাচ্ছিলেন দরজাটার দিকে।
শেষ পর্যন্ত যখন দরজার কড়া নাড়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শব্দটা এল, জুলি ছুটে গেলেন। গায়ে একটা শাল জড়িয়ে তার বড় বোন দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজার বাইরেই। একজন আরেকজনকে দেখার পর কোনোরকম ভদ্রতা হলো না, কথাবার্তা হলো না। উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলো এক বোন আরেক বোনকে। এক মুহূর্তের জন্য বাঁধনটা একটু আলগা হলো হয়তো, কিন্তু সেটা শুধু পরম আদরে আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরার জন্যই। তারপর শুরু হলো তাদের গল্প। কে কেমন আছে, তাদের পরিবার আর হাজারটা দরকারি-অদরকারি জিনিস নিয়ে গল্প চললো। চললো পরচর্চা আর রসিকতা। হাসির দমকে কিংবা তাড়াহুড়ায় কোনো কোনো বাক্যের অর্ধেকটা হারিয়ে যাচ্ছিলো, তারপরেও অন্যজন বুঝে ফেলছিলো খুব সহজেই। হেনরিয়েটাকে তার টুপি আর শালটা উঠিয়ে রাখতে সাহায্য করলো জুলি এরমধ্যেই।
বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে ততক্ষণে। কাজের মেয়েটা এসে বাতি জ্বালিয়ে দেওয়ার পর জুলি তার বোনের মুখটা দুচোখভরে দেখলেন। আরেকবার তাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। তার চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়! তার বড়বোনের মাথাভর্তি ঝকঝকে রেশমি, কাজল-কালো চুলের ভিড়ে দুগাছি সাদা চুলও দেখা যাচ্ছে। মাথার দুই পাশ দিয়ে রুপালি নদীর মতো সেই দুগাছি পাকা চুল নেমে গিয়ে হারিয়ে গেছে কালো চুলের সমুদ্রে। বোনটি তার বড় হলেও বয়স মাত্র চব্বিশ! আর সুইজারল্যান্ড যাওয়ার আগে তো তার মাথায় কোনো সাদা চুলের চিহ্নমাত্রও ছিলো না! হতবাক হয়ে জুলি তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। জলে টলমল করছে চোখ। এমন কী রহস্যজনক আর ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এলো তার বোনের জীবনে যে মাত্র কয়েক সপ্তাহেই চুল পেকে সাদা হয়ে গেলো!
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘দিদি, কী হয়েছে তোমার বল তো?’
একটা করুণ হাসি দিলেন হেনরিয়েটা, সেই হাসিতে যেন কত-শত বেদনার গান মিশে আছে। উত্তর দিলেন, ‘কিছু হয়নি রে আমার, সত্যি। আমার সাদা চুল দেখছিলি বুঝি?’
কিন্তু জুলি মানলেন না। বোনের দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে তার দুচোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন। আবারও বলে উঠলেন, ‘কী হয়েছে তোমার, দিদি? বলো আমাকে তোমার কী হয়েছে। আর মিথ্যে কথা বলবে না একদম। আমার কাছে মিথ্যে বললে তুমি সবসময় ধরা পড়ে যাও।’
মুখোমুখি বসে ছিলেন দুই বোন। হেনরিয়েটার মুখটা বিবর্ণ লাগছিল। মুক্তার মতো দুই ফোঁটা অশ্রু জমে ছিল তার দুই চোখের কিনারে। জুলি অধৈর্য হয়ে উঠলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? কী হয়েছে, বলো এক্ষুণি! কথা বলো!’ সেই মুহূর্তেই প্রায় ফিসফিস করে অন্যজন বলে উঠলেন, ‘আমার --- আমার একজন প্রেমিক হয়েছে।’ কথাটা বলেই ছোট বোনের কাঁধে মাথাটা রেখে ফুঁপাতে শুরু করলেন হেনরিয়েটা।
অনেকটা সময় কান্নার পর তিনি আস্তে আস্তে একটু শান্ত হলেন। এই গোপন কষ্টের ভার সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। সহানুভূতিশীল বোনের কাছে একটু একটু করে তার চেপে রাখা বেদনার কথাগুলো বলতে শুরু করলেন তিনি। গেস্টরুমের এক কোণায় ছোট একটা সোফা। সেখানেই গিয়ে বসলেন দুজন। জুলি এক হাতে তার বড় বোনটিকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলেন। শুনতে লাগলেন বোনের গোপন কথাগুলো।
‘উফ! জুলি, আমি জানি আমি যা করেছি তার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। দেওয়ার মতো আমার কোনো কৈফিয়তও থাকা উচিত না। আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না এমন একটা কাজ আমি কীভাবে করে ফেললাম! ওইদিনের পর থেকে আমার মাথা সারাক্ষণ পাগল পাগল লাগে। কীভাবে হলো? তোমাকেও বলে রাখি, সবসময় নিজেকে সাবধানে রাখবে। সামলে চলার চেষ্টা করবে। কেন বলছি? তুমি যদি জানতে যে আমরা মনের দিক থেকে কতো দুর্বল! আমরা, মেয়েরা কতো তাড়াতাড়িই যে বশ মেনে ফেলি ছোট ছোট দুর্বলতার কাছে। আর তারপর আমরা ভুল করে ফেলি। কতো ছোট, কত্তো ছোট সেসব এক মুহূর্তের দুর্বলতা! কিছু কিছু বিষাদমাখা সময় আছে যেগুলো এক পলকের জন্য এসে তোমাকে ছেয়ে ফেলে। কারো দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার, ভালোবাসার তীব্র একটা আকাক্সক্ষা যেন অধিকার করে ফেলে তোমাকে। কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। সবার জীবনেই এমন মুহূর্তগুলো বারবার আসে। তুমি তো আমার স্বামীকে জানো। তুমি জানো আমি ওকে কতোটা পছন্দ করি। আসলে ও অনেক, তোমরা যাকে বলো প্র্যাকটিক্যাল। কোনো মেয়ের হƒদয়ের কোমল আকুতিগুলো বুঝতে পারা ওর পক্ষে সম্ভব হয় না। ও সবসময় একইরকম। সবসময় খুব ভালো, সবসময় হাসিমুখ, সবসময় দয়ালু আর সবসময় একদম নিখুঁত! উফ! মাঝে মধ্যে আমার মনে হতো সবসময় এতো নিখুঁত সৌজন্যতা বাদ দিয়ে একবার যদি ও একটু উত্তাল সমুদ্রের মতো দুর্বিনীত হতো! ওর ভালোবাসায় ভদ্রতাটুকু না দেখিয়ে ও যদি কখনো আমাকে ওর ভালোবাসার জোর দেখাতো! কখনো কখনো আমি চাইতাম ও যদি একটু বোকা হতে পারতো কিংবা একটু দুর্বলও হতো, তাহলে আমাকে ওর প্রয়োজন পড়তো। আমার স্পর্শের অথবা আমার চোখের জলের মূল্য ওর কাছে থাকতো।
শুনতে কেমন অর্থহীন মনে হয় এসব, না? কিন্তু আমরা মেয়েরা তো এমনই। নিজের মনকে কী করে থামিয়ে রাখি, বলো? তারপরেও কিন্তু আমার স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করার কোনো চিন্তাই আমার মাথায় কখনো আসেনি। তবু কী করে যে হয়ে গেলো! এতে কোনো ভালোবাসা নেই, যুক্তি নেই, কিচ্ছু নেই! কোনো এক হ্রদের তীর কোনো এক রাতে জোছনার আলোয় ভেসে যাচ্ছিলো, এছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা নেই এর।
আমরা দুজন যে ঘুরতে গিয়েছিলাম তুমি তো জানো। সেই সময় সব ব্যাপারেই আমার রবার্টের ঠা-া নির্বিকার ভাব আমার উৎসাহ-উদ্দীপনাগুলোর গলা টিপে মেরে ফেলছিলো। একদিন সূর্যোদয়ের সময়টায় আমরা পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে আসছিলাম ঘোড়ার গাড়িতে চেপে। হঠাৎ একটা মোড় ঘুরতেই বিস্ময়ে আমার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো প্রায়। ভোরের স্বচ্ছ আলোয় সামনে ভেসে উঠেছিলো হাজার মাইল নিচে ছড়ানো উপত্যকা, বন, পাহাড়ি ঝর্ণা আর ছোট ছোট গ্রাম। আমি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলাম। ওকে বললাম, ‘দেখো কী অদ্ভুত সুন্দর! এদিকে সরে আসো! তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আসো!’ রবার্ট একটা ঠা-া দয়ার্দ্র হাসি দিয়ে আমাকে উত্তর দিলো, ‘তোমার কাছে এই বন, পাহাড় দেখতে ভালো লাগছে বলেই যে আমাকে রাস্তায় এভাবে জড়িয়ে ধরতে হবে তার কোনো কারণ আমি দেখছি না।’ ওর কথাগুলো আমার হƒদয়টাকে যেন জমিয়ে বরফ করে দিলো। আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে খুব সুন্দর কোনো দৃশ্যের সামনে দাঁড়ালে একে অপরের প্রতি ভালোবাসার অনুভবটা সবচেয়ে বেশি সত্যি মনে হয়। কিন্তু আমার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার কোনো পথ আমি পাচ্ছিলাম না। একটা গ্যাস বেলুনের মতো নিজের ভেতর সমস্ত আবেগ, অনুভূতি বন্ধ করে রেখেছিলাম যেন। ছটফট করছিলাম আমি। একদিন সন্ধ্যায় রবার্ট রাতের খাবারের পরপরই ঘুমাতে চলে গেলো। খুব মাথাব্যথা করছিলো ওর। আর আমি হ্রদের ধারে গেলাম হাঁটতে। ওইদিনের মতো এতো সুন্দর একটা রাত শুধু রূপকথায় পাওয়া যায়। আকাশের মাঝ বরাবর রুপার বিরাট থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়াগুলোয় রুপালি মুকুটের মতো তুষার জমে আছে। মৃদু বাতাসে হ্রদের পানিতে ছোট ছোট ঢেউ উঠছিলো আর চাঁদের আলোয় চিকচিক করছিলো। হালকা ঠা-া বাতাসে কেমন একটা উষ্ণতা জড়ানো যে, কারণ ছাড়াই একদম হƒদয় ছুঁয়ে যায়। এমন অসামান্য সুন্দরের সামনে এমন মুহূর্তগুলোয় আমাদের হƒদয় খুব স্পর্শকাতর হয়ে যায়। আমি তীরে ঘাসের ওপর বসে আমার সামনে বিস্তৃত অসাধারণ সুন্দর কিন্তু বিষন্ন হ্রদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর একটা অদ্ভুত অনুভূতি ধীরে ধীরে জেগে উঠলো আমার ভেতরে। ভালোবাসার আর ভালোবাসা পাওয়ার অতৃপ্ত একটা চাহিদা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। আমার জীবনের এই ভয়াবহ একঘেঁয়েমির বিরুদ্ধে আমার মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠছিলো। এটা কেমন কথা! এমন কোনো জোছনা রাতে কোনো একটা হ্রদের ধার দিয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার ভাগ্য কি আমার কখনো হবে না? অসামান্য কোনো সুন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর সত্য সেই অনুভূতির শক্তিটাকে অনুভব করতে পারবো না আমি? কোনো গ্রীষ্মের রাতে চাঁদের আলো-ছায়ার খেলায় বসে অশান্ত আকুল ভালোবাসার জোয়ারে আমি কখনো ভেসে যেতে পারবো না?
এসব ভেবে আমি পাগলের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম একা একা। এমন সময় পেছনে একটা শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি এক লোক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকেই নিবদ্ধ তার দৃষ্টি। পেছন ফিরে তাকানোর পর আমাকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন আর এগিয়ে এলেন, ‘আপনি কাঁদছেন?’ সে এক তরুণ উকিল, মাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে এদিকে। হোটেলে আসা-যাওয়ার পথে কয়েকবার দেখা হয়েছে তাদের সঙ্গে। তার চোখ যে প্রায়ই আমার আশপাশে ঘুরে বেড়াতো তা-ও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। যা-ই হোক, আমি তাকে কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছিলাম না। বললাম, আমার কিছুটা অসুস্থ লাগছিলো। উঠে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম হ্রদের ধার ধরে। সে আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো, সম্মানজনক দূরত্ব রেখেই। ঘুরতে ঘুরতে সে কোথায় গেছে আর কি কি দেখেছে সেগুলোর বর্ণনা করছিলো। আর ওর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিলো যা যা আমি অনুভব করে গেছি সেগুলোই যেন সে শব্দে, বাক্যে সাজিয়ে আমাকে শোনাচ্ছে। আমার প্রতিটা অনুভূতি, প্রতিটা শিহরণের অনুবাদ করে দিচ্ছিলো সে, নিখুঁতভাবে। তারপর হঠাৎ সে কয়েক লাইন কবিতা আবৃত্তি করে উঠলো, যে লাইনগুলো আমি রবার্টকে শোনাতে চেয়েও পারিনি। আমার যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিলো। প্রচ- আবেগে আমার কণ্ঠরোধ হয়ে গেলো। আমার আশপাশে সবকয়টা পাহাড়চূড়া, হ্রদ, চাঁদের আলো, সমস্ত প্রকৃতি যেন আমার কানে অনির্বচনীয় মিষ্টি কোন গানের সুর গেয়ে উঠলো। আর তারপরই ঘটে গেলো ঘটনাটা। কীভাবে হলো, কেন হলো আমি কিছুই জানি না। যেন ঘোরের মধ্যে ঘটে গেলো। সেই লোকটার সঙ্গে পরে আবার দেখা হয়েছে ওদের চলে যাওয়ার দিন সকালে। আমাকে তার কার্ড আর ফোন নাম্বার দিয়ে গেছে সে!
শেষ কথাটা বলেই বোনকে জড়িয়ে ধরে গুঙিয়ে উঠলেন হেনরিয়েটা।
জুলি এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি। এবার তার বড় বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খুব শান্ত গলায় বললেন, ‘দিদি রে, বেশিরভাগ সময়েই আসলে আমরা কোনো মানুষের প্রেমে পড়ি না, বরং ভালোবাসার প্রেমে পড়ি। আর তোমার ক্ষেত্রে সেই রাতে তোমার আসল প্রেমিক ছিলো জোছনার আলো, কোনো মানুষ না!’
মূল : গ্যি দ্য মোপাসা
জুলি রুবের উৎসুক হয়ে বড় বোনের জন্য অপেক্ষা করছেন। সুইজারল্যান্ডে ভ্রমণ শেষ করে তার বোন, হেনরিয়েটা লেটোর আজকেই ফিরছেন। সরাসরি তিনি ছোট বোনের বাসায় এসে উঠবেন।
প্রায় পাঁচ সপ্তাহ আগে লেটোর দম্পতি তাদের বাড়ি ছেড়েছিলেন। তবে হেনরিয়েটার স্বামীকে আগেই ব্যবসার প্রয়োজনে ক্যালভাডোসে চলে যেতে হয়েছে, সুইজারল্যান্ড থেকেই। আর হেনরিয়েটা চলে আসবেন প্যারিসে, তার বোনের সঙ্গে কিছুদিন কাটাতে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায়। অন্যমনস্ক জুলি বসার ঘরের নির্জনতায় চুপ করে বসে বই পড়ছিলেন। যে কোনো শব্দেই চকিতে একবার তাকাচ্ছিলেন দরজাটার দিকে।
শেষ পর্যন্ত যখন দরজার কড়া নাড়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শব্দটা এল, জুলি ছুটে গেলেন। গায়ে একটা শাল জড়িয়ে তার বড় বোন দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজার বাইরেই। একজন আরেকজনকে দেখার পর কোনোরকম ভদ্রতা হলো না, কথাবার্তা হলো না। উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলো এক বোন আরেক বোনকে। এক মুহূর্তের জন্য বাঁধনটা একটু আলগা হলো হয়তো, কিন্তু সেটা শুধু পরম আদরে আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরার জন্যই। তারপর শুরু হলো তাদের গল্প। কে কেমন আছে, তাদের পরিবার আর হাজারটা দরকারি-অদরকারি জিনিস নিয়ে গল্প চললো। চললো পরচর্চা আর রসিকতা। হাসির দমকে কিংবা তাড়াহুড়ায় কোনো কোনো বাক্যের অর্ধেকটা হারিয়ে যাচ্ছিলো, তারপরেও অন্যজন বুঝে ফেলছিলো খুব সহজেই। হেনরিয়েটাকে তার টুপি আর শালটা উঠিয়ে রাখতে সাহায্য করলো জুলি এরমধ্যেই।
বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে ততক্ষণে। কাজের মেয়েটা এসে বাতি জ্বালিয়ে দেওয়ার পর জুলি তার বোনের মুখটা দুচোখভরে দেখলেন। আরেকবার তাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। তার চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়! তার বড়বোনের মাথাভর্তি ঝকঝকে রেশমি, কাজল-কালো চুলের ভিড়ে দুগাছি সাদা চুলও দেখা যাচ্ছে। মাথার দুই পাশ দিয়ে রুপালি নদীর মতো সেই দুগাছি পাকা চুল নেমে গিয়ে হারিয়ে গেছে কালো চুলের সমুদ্রে। বোনটি তার বড় হলেও বয়স মাত্র চব্বিশ! আর সুইজারল্যান্ড যাওয়ার আগে তো তার মাথায় কোনো সাদা চুলের চিহ্নমাত্রও ছিলো না! হতবাক হয়ে জুলি তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। জলে টলমল করছে চোখ। এমন কী রহস্যজনক আর ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এলো তার বোনের জীবনে যে মাত্র কয়েক সপ্তাহেই চুল পেকে সাদা হয়ে গেলো!
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘দিদি, কী হয়েছে তোমার বল তো?’
একটা করুণ হাসি দিলেন হেনরিয়েটা, সেই হাসিতে যেন কত-শত বেদনার গান মিশে আছে। উত্তর দিলেন, ‘কিছু হয়নি রে আমার, সত্যি। আমার সাদা চুল দেখছিলি বুঝি?’
কিন্তু জুলি মানলেন না। বোনের দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে তার দুচোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন। আবারও বলে উঠলেন, ‘কী হয়েছে তোমার, দিদি? বলো আমাকে তোমার কী হয়েছে। আর মিথ্যে কথা বলবে না একদম। আমার কাছে মিথ্যে বললে তুমি সবসময় ধরা পড়ে যাও।’
মুখোমুখি বসে ছিলেন দুই বোন। হেনরিয়েটার মুখটা বিবর্ণ লাগছিল। মুক্তার মতো দুই ফোঁটা অশ্রু জমে ছিল তার দুই চোখের কিনারে। জুলি অধৈর্য হয়ে উঠলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? কী হয়েছে, বলো এক্ষুণি! কথা বলো!’ সেই মুহূর্তেই প্রায় ফিসফিস করে অন্যজন বলে উঠলেন, ‘আমার --- আমার একজন প্রেমিক হয়েছে।’ কথাটা বলেই ছোট বোনের কাঁধে মাথাটা রেখে ফুঁপাতে শুরু করলেন হেনরিয়েটা।
অনেকটা সময় কান্নার পর তিনি আস্তে আস্তে একটু শান্ত হলেন। এই গোপন কষ্টের ভার সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। সহানুভূতিশীল বোনের কাছে একটু একটু করে তার চেপে রাখা বেদনার কথাগুলো বলতে শুরু করলেন তিনি। গেস্টরুমের এক কোণায় ছোট একটা সোফা। সেখানেই গিয়ে বসলেন দুজন। জুলি এক হাতে তার বড় বোনটিকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলেন। শুনতে লাগলেন বোনের গোপন কথাগুলো।
‘উফ! জুলি, আমি জানি আমি যা করেছি তার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। দেওয়ার মতো আমার কোনো কৈফিয়তও থাকা উচিত না। আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না এমন একটা কাজ আমি কীভাবে করে ফেললাম! ওইদিনের পর থেকে আমার মাথা সারাক্ষণ পাগল পাগল লাগে। কীভাবে হলো? তোমাকেও বলে রাখি, সবসময় নিজেকে সাবধানে রাখবে। সামলে চলার চেষ্টা করবে। কেন বলছি? তুমি যদি জানতে যে আমরা মনের দিক থেকে কতো দুর্বল! আমরা, মেয়েরা কতো তাড়াতাড়িই যে বশ মেনে ফেলি ছোট ছোট দুর্বলতার কাছে। আর তারপর আমরা ভুল করে ফেলি। কতো ছোট, কত্তো ছোট সেসব এক মুহূর্তের দুর্বলতা! কিছু কিছু বিষাদমাখা সময় আছে যেগুলো এক পলকের জন্য এসে তোমাকে ছেয়ে ফেলে। কারো দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার, ভালোবাসার তীব্র একটা আকাক্সক্ষা যেন অধিকার করে ফেলে তোমাকে। কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। সবার জীবনেই এমন মুহূর্তগুলো বারবার আসে। তুমি তো আমার স্বামীকে জানো। তুমি জানো আমি ওকে কতোটা পছন্দ করি। আসলে ও অনেক, তোমরা যাকে বলো প্র্যাকটিক্যাল। কোনো মেয়ের হƒদয়ের কোমল আকুতিগুলো বুঝতে পারা ওর পক্ষে সম্ভব হয় না। ও সবসময় একইরকম। সবসময় খুব ভালো, সবসময় হাসিমুখ, সবসময় দয়ালু আর সবসময় একদম নিখুঁত! উফ! মাঝে মধ্যে আমার মনে হতো সবসময় এতো নিখুঁত সৌজন্যতা বাদ দিয়ে একবার যদি ও একটু উত্তাল সমুদ্রের মতো দুর্বিনীত হতো! ওর ভালোবাসায় ভদ্রতাটুকু না দেখিয়ে ও যদি কখনো আমাকে ওর ভালোবাসার জোর দেখাতো! কখনো কখনো আমি চাইতাম ও যদি একটু বোকা হতে পারতো কিংবা একটু দুর্বলও হতো, তাহলে আমাকে ওর প্রয়োজন পড়তো। আমার স্পর্শের অথবা আমার চোখের জলের মূল্য ওর কাছে থাকতো।
শুনতে কেমন অর্থহীন মনে হয় এসব, না? কিন্তু আমরা মেয়েরা তো এমনই। নিজের মনকে কী করে থামিয়ে রাখি, বলো? তারপরেও কিন্তু আমার স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করার কোনো চিন্তাই আমার মাথায় কখনো আসেনি। তবু কী করে যে হয়ে গেলো! এতে কোনো ভালোবাসা নেই, যুক্তি নেই, কিচ্ছু নেই! কোনো এক হ্রদের তীর কোনো এক রাতে জোছনার আলোয় ভেসে যাচ্ছিলো, এছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা নেই এর।
আমরা দুজন যে ঘুরতে গিয়েছিলাম তুমি তো জানো। সেই সময় সব ব্যাপারেই আমার রবার্টের ঠা-া নির্বিকার ভাব আমার উৎসাহ-উদ্দীপনাগুলোর গলা টিপে মেরে ফেলছিলো। একদিন সূর্যোদয়ের সময়টায় আমরা পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে আসছিলাম ঘোড়ার গাড়িতে চেপে। হঠাৎ একটা মোড় ঘুরতেই বিস্ময়ে আমার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো প্রায়। ভোরের স্বচ্ছ আলোয় সামনে ভেসে উঠেছিলো হাজার মাইল নিচে ছড়ানো উপত্যকা, বন, পাহাড়ি ঝর্ণা আর ছোট ছোট গ্রাম। আমি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলাম। ওকে বললাম, ‘দেখো কী অদ্ভুত সুন্দর! এদিকে সরে আসো! তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আসো!’ রবার্ট একটা ঠা-া দয়ার্দ্র হাসি দিয়ে আমাকে উত্তর দিলো, ‘তোমার কাছে এই বন, পাহাড় দেখতে ভালো লাগছে বলেই যে আমাকে রাস্তায় এভাবে জড়িয়ে ধরতে হবে তার কোনো কারণ আমি দেখছি না।’ ওর কথাগুলো আমার হƒদয়টাকে যেন জমিয়ে বরফ করে দিলো। আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে খুব সুন্দর কোনো দৃশ্যের সামনে দাঁড়ালে একে অপরের প্রতি ভালোবাসার অনুভবটা সবচেয়ে বেশি সত্যি মনে হয়। কিন্তু আমার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার কোনো পথ আমি পাচ্ছিলাম না। একটা গ্যাস বেলুনের মতো নিজের ভেতর সমস্ত আবেগ, অনুভূতি বন্ধ করে রেখেছিলাম যেন। ছটফট করছিলাম আমি। একদিন সন্ধ্যায় রবার্ট রাতের খাবারের পরপরই ঘুমাতে চলে গেলো। খুব মাথাব্যথা করছিলো ওর। আর আমি হ্রদের ধারে গেলাম হাঁটতে। ওইদিনের মতো এতো সুন্দর একটা রাত শুধু রূপকথায় পাওয়া যায়। আকাশের মাঝ বরাবর রুপার বিরাট থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়াগুলোয় রুপালি মুকুটের মতো তুষার জমে আছে। মৃদু বাতাসে হ্রদের পানিতে ছোট ছোট ঢেউ উঠছিলো আর চাঁদের আলোয় চিকচিক করছিলো। হালকা ঠা-া বাতাসে কেমন একটা উষ্ণতা জড়ানো যে, কারণ ছাড়াই একদম হƒদয় ছুঁয়ে যায়। এমন অসামান্য সুন্দরের সামনে এমন মুহূর্তগুলোয় আমাদের হƒদয় খুব স্পর্শকাতর হয়ে যায়। আমি তীরে ঘাসের ওপর বসে আমার সামনে বিস্তৃত অসাধারণ সুন্দর কিন্তু বিষন্ন হ্রদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর একটা অদ্ভুত অনুভূতি ধীরে ধীরে জেগে উঠলো আমার ভেতরে। ভালোবাসার আর ভালোবাসা পাওয়ার অতৃপ্ত একটা চাহিদা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। আমার জীবনের এই ভয়াবহ একঘেঁয়েমির বিরুদ্ধে আমার মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠছিলো। এটা কেমন কথা! এমন কোনো জোছনা রাতে কোনো একটা হ্রদের ধার দিয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার ভাগ্য কি আমার কখনো হবে না? অসামান্য কোনো সুন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর সত্য সেই অনুভূতির শক্তিটাকে অনুভব করতে পারবো না আমি? কোনো গ্রীষ্মের রাতে চাঁদের আলো-ছায়ার খেলায় বসে অশান্ত আকুল ভালোবাসার জোয়ারে আমি কখনো ভেসে যেতে পারবো না?
এসব ভেবে আমি পাগলের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম একা একা। এমন সময় পেছনে একটা শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি এক লোক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকেই নিবদ্ধ তার দৃষ্টি। পেছন ফিরে তাকানোর পর আমাকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন আর এগিয়ে এলেন, ‘আপনি কাঁদছেন?’ সে এক তরুণ উকিল, মাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে এদিকে। হোটেলে আসা-যাওয়ার পথে কয়েকবার দেখা হয়েছে তাদের সঙ্গে। তার চোখ যে প্রায়ই আমার আশপাশে ঘুরে বেড়াতো তা-ও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। যা-ই হোক, আমি তাকে কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছিলাম না। বললাম, আমার কিছুটা অসুস্থ লাগছিলো। উঠে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম হ্রদের ধার ধরে। সে আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো, সম্মানজনক দূরত্ব রেখেই। ঘুরতে ঘুরতে সে কোথায় গেছে আর কি কি দেখেছে সেগুলোর বর্ণনা করছিলো। আর ওর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিলো যা যা আমি অনুভব করে গেছি সেগুলোই যেন সে শব্দে, বাক্যে সাজিয়ে আমাকে শোনাচ্ছে। আমার প্রতিটা অনুভূতি, প্রতিটা শিহরণের অনুবাদ করে দিচ্ছিলো সে, নিখুঁতভাবে। তারপর হঠাৎ সে কয়েক লাইন কবিতা আবৃত্তি করে উঠলো, যে লাইনগুলো আমি রবার্টকে শোনাতে চেয়েও পারিনি। আমার যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিলো। প্রচ- আবেগে আমার কণ্ঠরোধ হয়ে গেলো। আমার আশপাশে সবকয়টা পাহাড়চূড়া, হ্রদ, চাঁদের আলো, সমস্ত প্রকৃতি যেন আমার কানে অনির্বচনীয় মিষ্টি কোন গানের সুর গেয়ে উঠলো। আর তারপরই ঘটে গেলো ঘটনাটা। কীভাবে হলো, কেন হলো আমি কিছুই জানি না। যেন ঘোরের মধ্যে ঘটে গেলো। সেই লোকটার সঙ্গে পরে আবার দেখা হয়েছে ওদের চলে যাওয়ার দিন সকালে। আমাকে তার কার্ড আর ফোন নাম্বার দিয়ে গেছে সে!
শেষ কথাটা বলেই বোনকে জড়িয়ে ধরে গুঙিয়ে উঠলেন হেনরিয়েটা।
জুলি এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি। এবার তার বড় বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খুব শান্ত গলায় বললেন, ‘দিদি রে, বেশিরভাগ সময়েই আসলে আমরা কোনো মানুষের প্রেমে পড়ি না, বরং ভালোবাসার প্রেমে পড়ি। আর তোমার ক্ষেত্রে সেই রাতে তোমার আসল প্রেমিক ছিলো জোছনার আলো, কোনো মানুষ না!’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন