সাহিত্যের রাজনীতি
মোহাম্মদ নূরুল হক
সূচি
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতা : ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার ১১
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা ছোটগল্প : সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ২১
বাংলায় রহস্য সাহিত্য ৩০
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তি ৩৮
নজরুলের কবিতায় পঙ্ক্তি বিন্যাস ও মাত্রাচেতনা ৪৭
হেলাল হাফিজ : দ্রোহী প্রেমিক, বিনীত বিদ্রোহী ৫১
আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা: একটি সরল পাঠ ৫৮
সাহিত্যের রাজনীতি ৬৩
বাংলা কবিতায় দশকের রাজনীতি ৬৬
ফেসবুক-ব্লগকেন্দ্রিক বাংলা কবিতা ৭০
সাহিত্যের ছোটকাগজ : কত দূর সুসম্পাদিত ৭৩
ভূমিকা
সভ্যতা
মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছে। মত প্রকাশের; সীমিত পরিসরে। সভ্য দুনিয়ার মানুষ
নিয়ম তৈরি করেছে। ওই নিয়ম মানতে অন্যকে বাধ্য করে, নিজে মানতে চায় না।
সাহিত্য মানুষকে স্বপ্নবান হতে প্রণোদিত করে। তবে তা বাস্তবতার সম্পর্ক
ছিন্ন করে নয়; অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু নিয়েই। সাহিত্য কেবল স্বপ্নবান হওয়ার
পথ দেখায় না, শৃঙ্খলমুক্তির কথা বলে, বুদ্ধির মুক্তিরও। তবে সব সময় নয়।
কবিতায় বুদ্ধির মুক্তি ঘটে কালেভদ্রে। প্রায় ভাবাবেগে ভেসে যাওয়াই
তারুণ্যের ধর্ম। কবিতা এই ভাবাবেগকে সম্মান দেখায়, কিন্তু
উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ সংহতিকে শ্রদ্ধাপূর্ণ করে তোলে। মানুষ যখন যুক্তিবাদী
হতে শেখে, হয়ে ওঠে বিজ্ঞানমনস্ক, তখন সমাজের দিকে সে নতুন চোখে তাকায়। এ
দৃষ্টি বাড়ির জানালার কার্নিশে আটকে যায় না। চলে যায় দিগন্তরেখায়; যেখানে
আকাশ ও পৃথিবীকে মনে হয় সঙ্গমরত। ব্যক্তির দাঁড়িয়ে থাকা ভূমি থেকে
দিগন্তরেখা পর্যন্ত যা কিছু তার চোখে পড়ে, সবই সে নিরীক্ষণ করে। এ-ই আধুনিক
সম্পন্ন মানুষের ধর্ম। এসব হঠাৎ করে হয় না। এর থাকে সুবিন্যাসিত পরম্পরা ও
ঐতিহ্য। বলেছিলামÑ সাহিত্য মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। কেবল স্বপ্ন দেখানোই
সাহিত্যের একমাত্র কাজ নয়। এর কাজ আরও অনেকে, দায়ও। ‘সাহিত্য ও শিল্পের কাজ
হলো মানুষের হƒদয়ে প্রবেশ করাÑমনকে শুধু মুগ্ধ করা নয়, হƒদয়কে জাগিয়ে
তোলাও।’ (সাহিত্য ও শিল্পের উপেক্ষিত উপকরণ : আবুল ফজল)। সব সাহিত্যিক
হƒদয়কে জাগিয়ে তোলে না, তুলতে পারে না; মনকেও মুগ্ধ করে না। কখনো-কখনো
সংক্ষুব্ধও করে তোলে। স্বপ্নের পথে কোনো প্রতিবন্ধক এসে দাঁড়ালে মানব
ক্ষেপে ওঠে, প্রতিবাদীও। সাহিত্যিক সব সময় নয়, মাঝেমধ্যে জনতার দাবিকে
সম্মান জানানÑ যখন গণদাবি কোনো জাতির শৃঙ্খল মুক্তির প্রশ্নে ওঠে,
যুক্তিবোধের নিরিখে ওঠে তখন। এর বাইরে সাহিত্যিকেরা জনতার একটি বিশেষ অংশকে
নিজের কথাটুকু বোঝানোর চেষ্টা করেন। গণরুচিকে এড়িয়ে যান, নতুন রুচি সৃষ্টি
করেন। জনতা সাহিত্যিকসৃষ্ট নতুন মূল্যবোধ, রুচি ও মেজাজ সব সময় সাদরে
গ্রহণ করে না। তখন করে, যখন পুরোনোর রীতি বহুল ব্যবহারে ম্লান হয়ে পড়ে।
সাহিত্যিক বোধটা আসলে কী? সত্যিকার সাহিত্য বোধ কিংবা রুচির রূপই বা কী?
মানবসমাজে সংঘটিত সব ঘটনাই সংবাদমূল্য পায় না। নির্বাচিত কিছু ঘটনা ছাপার অক্ষরে মানুষ জানতে পারে, এর মধ্যে কিছু ঘটনা মানুষকে ব্যথিত করে, কিছু ঘটনা করে গর্বিত। নানা রকম ঘটনার ভেতর দিয়েই কাটে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন। এর ভেতর থেকে কিছু বিষয় সে গ্রহণ করে দায়ে পড়েÑ সংসারের প্রয়োজনেও; কিছু আনন্দলাভের জন্য। আবার ঘটনা ইতিহাসেরও সাক্ষী হিসেবে মানুষকে সাহায্য করে। সাহিত্যিকেরা সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো থেকে কিছু ঘটনা নির্বাচন করেনÑ যেমন শস্যের বীজ সম্পাদনা করেন একজন প্রাজ্ঞ কৃষক। কৃষক ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণের সময় উৎকৃষ্ট বীজগুলো আলাদা করেন, ভুষি-চিটা থেকে। বীজ সম্পাদনার সময় কৃষককে হতে হয় একই সঙ্গে নির্মোহ, নিষ্ঠুর, নির্দয়; হƒদয়বানও। দুর্বল বীজগুলোর প্রতি দয়া দেখালে ভবিষ্যতে ফসল ভালো হবে না, তাই তাঁকে উৎকৃষ্ট বীজগুলোই বাছাই করে নিতে হয়। নির্বাচিত বীজগুলোর প্রতি হƒদয়ের দরদ ষোলো আনাই ঢেলে দেন কৃষক। দুর্বল, নিকৃষ্ট বীজগুলোর প্রতি তাঁকে নিষ্ঠুর আচরণ করতে হয়। শুধু বীজ নির্বাচনের সময় যে কৃষক নির্মোহ-নিষ্ঠুর হন তা নয়। ফসলের ক্ষেতের আগাছা পরিস্কারের সময়ও তাঁকে হতে হয় বিচক্ষণ, নিষ্ঠুর ও সিদ্ধান্তে অনড়। এক গোছা ধান কিংবা গমের চারা কিংবা অন্য কোনো রবিশস্যের চারার চেয়ে নিঃসন্দেহে একটি চন্দনের চারা মূল্যবান। কিন্তু কৃষককে মনে রাখতে হয়Ñ ফসলের ক্ষেতে চন্দনের চারাও আগাছা। ভালো ফলন পেতে চাইলে ফসলের ক্ষেত থেকে চন্দনগাছও উপড়ে ফেলতে হয়। ফসলের চারাকে উপেক্ষা করে চন্দনের প্রেমে পড়লে দেশে দুর্ভিক্ষ আসে। সাহিত্যিককে বুঝতে হয়, কোনটা চন্দন আর কোনটা শস্যের চারা। চন্দন-শস্যের প্রভেদ না চিনলে বিষয় নির্বাচনে ভুল হবে। সাহিত্যিক জীবনকে চিত্রায়িত করেন। কিন্তু কোন জীবন? যে জীবনে মানুষ প্রতিদিন যাপন করে, সে জীবন? ‘আমরা সকলেই জীবনের অভিজ্ঞতায় জানি, কতকগুলি ক্ষুৎপিপাসা আছে যাহা অন্ন পানের মত পূর্ণতৃপ্তিতেই মিটিয়া যায়। তাহাদের সঙ্গে আমাদের নগদ কারবার। উভয় পক্ষেই কোনো দেনা থাকে না। জীবনে ইহাদের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকিলেও, কাব্যেও সাহিত্যে ইহাদের স্থান খুঁজিয়া পাই না। আমাদের সকলের ভিতরই সৌন্দর্যবোধ বলিয়া যে জিনিষটি আছে তাহা আমাদের প্রত্যেকের অন্তপ্রকৃতির অনুপাতে। এই লইয়া আমাদের পরস্পরের মধ্যে বিভিন্নতা ও বিরোধ থাকিলেও একটি বোধ করি সাদৃস্য আছে। যাহা সুন্দর তাহার মুখে এমন কিছু আছে যাহার জোরে সে অবলীলাক্রমে প্রাণের শীর্ষস্থানটি অধিকার করিয়া বসে, আর সবাইকে পশ্চাতে ঠেলিয়া ফেলিয়া। জনতার ভিতর একখানি সুন্দর মুখ অন্য মুখগুলিকে নিমেষে নিভাইয়া দেয়। যে মুখখানি আমার ভাল লাগিল সেটা আপনার ভাল না লাগিতে পারে, কিন্তিু আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অন্তরের উচ্চাসন খানি সেই প্রিয়দর্শনের জন্য পাতিয়া দেই।’ (সাহিত্যের শুচিতা : সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র)। সাহিত্যিককে তার বলার বিষয়-ৈশৈলী ও সময়Ñ সবই নির্বাচন করতে হয়। এই নির্বাচনে বিফল হলে সবই তাঁর অনর্থ। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑ কোনটা তিনিসে নেবেন, কোনটা তিনিসে বাদ দেবেন। তবে এই গ্রহণ-বর্জনের সময় তার তার খেয়াল রাখতে হবে যে বিষয়টি গ্রহণ করবেন, তা যেন খ-িত না হয়। বিষয় যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তা যেন হয় সামগ্রিক।
সব যুগেই বিষয় নির্বাচন-প্রকরণে বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে নানা মুনিণর নানা মত বিদ্যমান ছিল। এর ফলে এক দল যখন দেশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেছেন, অন্য দল তখন আরোপিত বিষয়-আশয়ে স্বস্তি খুঁজেছেন। এই শেষোক্তরা কোনো বিষয়কে সামগ্রিকভাবে উপলব্ধির চেষ্টা করেননি। সবকিছুরই খ-িত রূপকে তাঁরা মূল্য দিয়েছেন। সাহিত্যিকদের এই প্রবণতা সংক্রমিত হয়েছে পাঠকসমাজেও। ফলে বাঙালি পাঠকদেরও সত্যিকার -অর্থে উৎকৃষ্ট কোনো সাহিত্যরুচি গড়ে ওঠেনি। আর ‘সত্যকার সাহিত্যিক বোধ ও রুচি বাংলার পাঠকসমাজের খুব কমই প্রসার লাভ করতে পেরেছে। এ ব্যাপারে আশ্চর্যভাবে সফলকাম হয়েছেন আমাদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরা ননÑআমাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর সাহিত্যিকরা।
তাঁদের পরিচয়স্বরূপ বলা যেতে পারে, মধুসূদন বলতে তাঁরা বুঝেছেনÑ পরধএমট্টাপএদশ ভয়াবহ, বঙ্কিমচন্দ্র বলতে বুঝেছেনÑ হিন্দুত্বের পুনরুত্থান, আর রবীন্দ্রনাথ বলতে বুঝেছেন ওফবধষরংস, গুংঃরপরংসÑঅর্থাৎ কিছু কবি-কবি ভাব।’ (বাংলা সাহিত্যের চর্চা : কাজী আবদুল ওদুদ)। মানুষকে স্বপ্নবান করে তুলতে হলে সংস্কৃতিমবান করেও তুলতে হবে। সংস্কৃতিমবান না হলে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত হবে এবং জনগণ কোনো ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠ গুণটুকু চিনতে শিখতে পারবে না। সংকীর্ণ দৃষ্টিতে তুচ্ছ কোনো বিষয়কে বড় করে দেখতে চাইবে এবং দেখবেও। সাহিত্য বোধ হলো মনুষ্যত্বের রূপ আবিষ্কার এবং অন্যকেও আবিষ্কারের দিকে প্রণোদিত করা। তাহলেই মানুষ সমাজ থেকে কুসংস্কার, অশিক্ষা, গোঁড়ামি, বর্বরতাকে বিদায় করবে। ‘কিং ইদিপাস’-এ সফোকিস দেখিয়ে সমাজ থেকে বিপর্যয় দূর করতে গিয়ে ইদিপাস সত্যের অন্বেষণ করেছেন। সমাজের অশান্তির মূল কারণ কী?Ñ এর উত্তর জানার চেষ্টা করেছেন। এবং এই চেষ্টায় ঝুঁকি আছে, সামনে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছেÑ এমন সতর্কবার্তাকেও উপেক্ষা করতে হয়েছে তাঁর। তবে দুঃখের কারণ আবিষ্কার করতে পেরেছেন ইদিপাস। জেনেছেন রাজ্যে যে দুর্যোগ নেমে এসেছে, এর জন্য দায়ী ইদিপাস নিজেই। পিতৃহত্যা, নিজের মাকে বিয়ে করা, মায়ের গর্ভে সন্তান জš§দানÑ এত সব পাপের শাস্তি হিসেবে আÍহত্যাও করতে পারতেন ইদিপাস। কিন্তু আÍহত্যাকে লঘুদ- মেনেছেন। তাই নিজের হাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিজের চোখ রক্তাক্ত করে অন্ধ হয়ে গেছেন। ন্যায়বিচারের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সমাজে-রাষ্ট্রে। এখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। আবার শেক্সক্স পিয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিসে বিচারের নামে প্রহসনে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, স্বাগত জানানো হয়েছে ন্যায়বিচারকে। সাহিত্যে যখন ন্যায় বিচার সংবর্ধিত হয়, তখন হয়ে ওঠে গণমানুষের সম্মানের জিনিস। এ দিক থেকে বিচার করলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানোও সাহিত্যের উদ্দেশ্য। সমাজে কী ধরনের কর্মকা- ঘটে,Ñ তার জরিপ উপস্থিত করা সাহিত্যিকের কাজ নয়। আবার সব সময় ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য কিংবা সত্য-মিথ্যার সম্পর্ক দেখানোও নয়। আসলে উপস্থিতকালের সাহিত্যিক তাঁর সমাজকে কীভাবে দেখছেন, আর তিনি নিজেই কী ধরনের সমাজব্যবস্থা আশা করেন, এই দুয়ের সমন্বয় ঘটানোর স্বপ্ন রচনা করাই তাঁর কাজ। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার রূপ নির্ভর করে একেক কালে, একেক সমাজে একেক রকম। এসবের কোনো চিরায়ত রূপ নেই। থাকতে পারে না। সমাজের প্রতিটি প্রপঞ্চ বিবর্তনশীল, পরিবর্তন ঘটে সামাজিক সম্পর্কে, চিন্তায় ও স্বপ্নে। শিল্পকলায়-বিজ্ঞানে-দর্শনে প্রতিদিনই বিবর্তন ঘটে, গতকালের সত্য আজ হুবহু নেই, আজকেরও সত্যও ভবিষ্যতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কিন্তু ধর্মের সত্য অনড়, অপরিবর্তনীয় ও স্থিতিশীল। ধর্মে নীতি ও নিয়মের স্থান সবার ওউপরে; মানবিকতা, প্রেম, কল্পনার স্থান সেখানে নেই। যেটুকু আছে তা-ও ধর্মনির্দেশিত। সবচেয়ে বড় কথাÑ সন্দেহ-প্রশ্ন-তর্কের স্থান কোনো স্থান নেই ধর্মে। ধর্মের সত্যে মানুষ আস্থাশীল হওয়ার ভান করে, সমাজের ভয়ে, পরকালের ভয়ে; ভেতরে ভেতরে সন্দেহ আর নানা রকমের জিজ্ঞাসা তাঁকে উত্তেজিত করে, কান্তও। কিন্তু ধার্মিকে হওয়ার লোভে, পরকালের অনন্ত সুখভোগের লোভে তিনিসে নিজের ভেতরে জেগে ওঠা প্রশ্ন-সন্দেহকে অবদমিত রাখেন। কিন্তু সাহিত্য-শিল্পে-বিজ্ঞানে-দর্শনে এই প্রশ্ন-সন্দেহই মূল। এসবের জোরেই সাহিত্যিক-শিল্পী-বিজ্ঞানী-দার্শনিক সমাজে নতুন নতুন রস, আবিষ্কার, প্রশ্নের জš§ দেন।
সাহিত্যের ধর্মÑ মানুষের ভেতরের মানুষকে জাগিয়ে তোলা, মনুষ্যত্ব ও পাশবিকতার পার্থক্য স্পষ্ট করা; এবং সমাজে যা ঘটে, যা ঘটা উচিত এই দুইয়ের সমন্বয় সাধনের স্বপ্ন দেখানো। এই সাধনায় সাহিত্যিক সফল হলেই সে সাহিত্য মানুষকে আলোড়িত করে, সমাজেও এর প্রভাব পড়ে। বাংলা সাহিত্যের আজকের যে রূপ, এর রূপ এক দিনে দাঁড়ায়ইনি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য; উত্তরাধিকারও। সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। সেখানে দেখেছি, যেমন রয়েছে নানা রকমের মতবাদ-মতবিরোধ, তেমনি রয়েছে নানা ধরনের উদ্দেশ্য-রাজনীতিও। এসবই এই বইয়ের প্রতিপাদ্য। আমার বিচারের দায় ছিল সাহিত্যের রস বিচার করা। কিন্তু শেষ এই বইয়ের গদ্যগুলো হয়ে উঠেছে নিরস।
প্রকৃত প্রস্তাবেই গদ্যগুলো নিরস। কোনো -কোনো পাঠকের মতে,Ñ আমার গদ্যভাষা জঘন্য; পাঠের অযোগ্য। পড়তে পড়তে বিতৃষ্ণা জাগে; ঘৃণা-বিরক্তিও। পাঠকের অভিযোগ অগ্রাহ্য করার শক্তি আমার নেই। যেমন থাকে না সিনেমার ভিলেনদের। নায়ক-নায়িকার মিলনে দর্শকমন হয় প্রফুল্ল, বিরহে ব্যথিত। কিন্তু ভিলেনের সাফল্যে দর্শক হয় সংক্ষুব্ধ, পরাজয়ে উৎফুল্ল। অর্থাৎ জয়-পরাজয়Ñ উভয় েেক্ষত্রেই ভিলেনভাগ্যে ঘৃণাই জোটে। ভিলেনের অভিনয় দেখে কিশোর-কিশোরী, সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ-তরুণী প্রায় অস্ফুট স্বরে বলে, ‘জঘন্য’। আমার গদ্যও তেমন। এ গদ্যগুলোয় বিরামহীন কোটেশন নেই, পা-িত্যের প্রমাণও না। নেই সুড়সুড়িসর্বস্ব উপন্যাসের মতো পাঠকের মন ভোলানো যৌনতার স্পর্শও।
আমার গদ্য জঘন্যÑ এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমার কোনো জবাব থাকে না। যেমন থাকে না দর্শকের তীব্র ঘৃণা হজম করেও নির্বিকার সিনেমার ভিলেনদেরও। দর্শকদের ঘৃণা যত বাড়ে, পরিচালক-প্রযেয়াজক-সমঝদারদের কাছে তত কদর বাড়ে ভিলেনদের। কিন্তু বৃহত্তর দর্শকগোষ্ঠীর তুলনায় পরিচালক-প্রযেয়াজক-সমঝদাররা সংখ্যায় অত্যল্প। জঘন্য গদ্যলেখকের অবস্থাও বোধ করি তেমন। আমার গদ্যভাষা জঘন্য জেনেও সমাজের সংখ্যালঘু প্রকাশক বই করার আগ্রহ দেখান। আগ্রহ দেখানোর সময় বৃহত্তর পাঠকশ্রেণীর রুচির কথা ভাবেন না। তাই লোকসান গুনণতে হয়; হাড়ে হাড়ে টের পান জঘন্য ভাষায় রচিত নিরস গদ্যের বই প্রকাশের ঝুঁকি কতখানি। সাকি পাবলিশিং কাবের মোজাম্মেল হক নিয়োগী বইটি প্রকাশের ঝুঁকি নিয়েছেন। লোকসানের মানসিক প্রস্তুতিও নিশ্চয় তাঁর রয়েছে।
মানবসমাজে সংঘটিত সব ঘটনাই সংবাদমূল্য পায় না। নির্বাচিত কিছু ঘটনা ছাপার অক্ষরে মানুষ জানতে পারে, এর মধ্যে কিছু ঘটনা মানুষকে ব্যথিত করে, কিছু ঘটনা করে গর্বিত। নানা রকম ঘটনার ভেতর দিয়েই কাটে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন। এর ভেতর থেকে কিছু বিষয় সে গ্রহণ করে দায়ে পড়েÑ সংসারের প্রয়োজনেও; কিছু আনন্দলাভের জন্য। আবার ঘটনা ইতিহাসেরও সাক্ষী হিসেবে মানুষকে সাহায্য করে। সাহিত্যিকেরা সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো থেকে কিছু ঘটনা নির্বাচন করেনÑ যেমন শস্যের বীজ সম্পাদনা করেন একজন প্রাজ্ঞ কৃষক। কৃষক ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণের সময় উৎকৃষ্ট বীজগুলো আলাদা করেন, ভুষি-চিটা থেকে। বীজ সম্পাদনার সময় কৃষককে হতে হয় একই সঙ্গে নির্মোহ, নিষ্ঠুর, নির্দয়; হƒদয়বানও। দুর্বল বীজগুলোর প্রতি দয়া দেখালে ভবিষ্যতে ফসল ভালো হবে না, তাই তাঁকে উৎকৃষ্ট বীজগুলোই বাছাই করে নিতে হয়। নির্বাচিত বীজগুলোর প্রতি হƒদয়ের দরদ ষোলো আনাই ঢেলে দেন কৃষক। দুর্বল, নিকৃষ্ট বীজগুলোর প্রতি তাঁকে নিষ্ঠুর আচরণ করতে হয়। শুধু বীজ নির্বাচনের সময় যে কৃষক নির্মোহ-নিষ্ঠুর হন তা নয়। ফসলের ক্ষেতের আগাছা পরিস্কারের সময়ও তাঁকে হতে হয় বিচক্ষণ, নিষ্ঠুর ও সিদ্ধান্তে অনড়। এক গোছা ধান কিংবা গমের চারা কিংবা অন্য কোনো রবিশস্যের চারার চেয়ে নিঃসন্দেহে একটি চন্দনের চারা মূল্যবান। কিন্তু কৃষককে মনে রাখতে হয়Ñ ফসলের ক্ষেতে চন্দনের চারাও আগাছা। ভালো ফলন পেতে চাইলে ফসলের ক্ষেত থেকে চন্দনগাছও উপড়ে ফেলতে হয়। ফসলের চারাকে উপেক্ষা করে চন্দনের প্রেমে পড়লে দেশে দুর্ভিক্ষ আসে। সাহিত্যিককে বুঝতে হয়, কোনটা চন্দন আর কোনটা শস্যের চারা। চন্দন-শস্যের প্রভেদ না চিনলে বিষয় নির্বাচনে ভুল হবে। সাহিত্যিক জীবনকে চিত্রায়িত করেন। কিন্তু কোন জীবন? যে জীবনে মানুষ প্রতিদিন যাপন করে, সে জীবন? ‘আমরা সকলেই জীবনের অভিজ্ঞতায় জানি, কতকগুলি ক্ষুৎপিপাসা আছে যাহা অন্ন পানের মত পূর্ণতৃপ্তিতেই মিটিয়া যায়। তাহাদের সঙ্গে আমাদের নগদ কারবার। উভয় পক্ষেই কোনো দেনা থাকে না। জীবনে ইহাদের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকিলেও, কাব্যেও সাহিত্যে ইহাদের স্থান খুঁজিয়া পাই না। আমাদের সকলের ভিতরই সৌন্দর্যবোধ বলিয়া যে জিনিষটি আছে তাহা আমাদের প্রত্যেকের অন্তপ্রকৃতির অনুপাতে। এই লইয়া আমাদের পরস্পরের মধ্যে বিভিন্নতা ও বিরোধ থাকিলেও একটি বোধ করি সাদৃস্য আছে। যাহা সুন্দর তাহার মুখে এমন কিছু আছে যাহার জোরে সে অবলীলাক্রমে প্রাণের শীর্ষস্থানটি অধিকার করিয়া বসে, আর সবাইকে পশ্চাতে ঠেলিয়া ফেলিয়া। জনতার ভিতর একখানি সুন্দর মুখ অন্য মুখগুলিকে নিমেষে নিভাইয়া দেয়। যে মুখখানি আমার ভাল লাগিল সেটা আপনার ভাল না লাগিতে পারে, কিন্তিু আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অন্তরের উচ্চাসন খানি সেই প্রিয়দর্শনের জন্য পাতিয়া দেই।’ (সাহিত্যের শুচিতা : সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র)। সাহিত্যিককে তার বলার বিষয়-ৈশৈলী ও সময়Ñ সবই নির্বাচন করতে হয়। এই নির্বাচনে বিফল হলে সবই তাঁর অনর্থ। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑ কোনটা তিনিসে নেবেন, কোনটা তিনিসে বাদ দেবেন। তবে এই গ্রহণ-বর্জনের সময় তার তার খেয়াল রাখতে হবে যে বিষয়টি গ্রহণ করবেন, তা যেন খ-িত না হয়। বিষয় যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তা যেন হয় সামগ্রিক।
সব যুগেই বিষয় নির্বাচন-প্রকরণে বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে নানা মুনিণর নানা মত বিদ্যমান ছিল। এর ফলে এক দল যখন দেশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেছেন, অন্য দল তখন আরোপিত বিষয়-আশয়ে স্বস্তি খুঁজেছেন। এই শেষোক্তরা কোনো বিষয়কে সামগ্রিকভাবে উপলব্ধির চেষ্টা করেননি। সবকিছুরই খ-িত রূপকে তাঁরা মূল্য দিয়েছেন। সাহিত্যিকদের এই প্রবণতা সংক্রমিত হয়েছে পাঠকসমাজেও। ফলে বাঙালি পাঠকদেরও সত্যিকার -অর্থে উৎকৃষ্ট কোনো সাহিত্যরুচি গড়ে ওঠেনি। আর ‘সত্যকার সাহিত্যিক বোধ ও রুচি বাংলার পাঠকসমাজের খুব কমই প্রসার লাভ করতে পেরেছে। এ ব্যাপারে আশ্চর্যভাবে সফলকাম হয়েছেন আমাদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরা ননÑআমাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর সাহিত্যিকরা।
তাঁদের পরিচয়স্বরূপ বলা যেতে পারে, মধুসূদন বলতে তাঁরা বুঝেছেনÑ পরধএমট্টাপএদশ ভয়াবহ, বঙ্কিমচন্দ্র বলতে বুঝেছেনÑ হিন্দুত্বের পুনরুত্থান, আর রবীন্দ্রনাথ বলতে বুঝেছেন ওফবধষরংস, গুংঃরপরংসÑঅর্থাৎ কিছু কবি-কবি ভাব।’ (বাংলা সাহিত্যের চর্চা : কাজী আবদুল ওদুদ)। মানুষকে স্বপ্নবান করে তুলতে হলে সংস্কৃতিমবান করেও তুলতে হবে। সংস্কৃতিমবান না হলে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত হবে এবং জনগণ কোনো ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠ গুণটুকু চিনতে শিখতে পারবে না। সংকীর্ণ দৃষ্টিতে তুচ্ছ কোনো বিষয়কে বড় করে দেখতে চাইবে এবং দেখবেও। সাহিত্য বোধ হলো মনুষ্যত্বের রূপ আবিষ্কার এবং অন্যকেও আবিষ্কারের দিকে প্রণোদিত করা। তাহলেই মানুষ সমাজ থেকে কুসংস্কার, অশিক্ষা, গোঁড়ামি, বর্বরতাকে বিদায় করবে। ‘কিং ইদিপাস’-এ সফোকিস দেখিয়ে সমাজ থেকে বিপর্যয় দূর করতে গিয়ে ইদিপাস সত্যের অন্বেষণ করেছেন। সমাজের অশান্তির মূল কারণ কী?Ñ এর উত্তর জানার চেষ্টা করেছেন। এবং এই চেষ্টায় ঝুঁকি আছে, সামনে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছেÑ এমন সতর্কবার্তাকেও উপেক্ষা করতে হয়েছে তাঁর। তবে দুঃখের কারণ আবিষ্কার করতে পেরেছেন ইদিপাস। জেনেছেন রাজ্যে যে দুর্যোগ নেমে এসেছে, এর জন্য দায়ী ইদিপাস নিজেই। পিতৃহত্যা, নিজের মাকে বিয়ে করা, মায়ের গর্ভে সন্তান জš§দানÑ এত সব পাপের শাস্তি হিসেবে আÍহত্যাও করতে পারতেন ইদিপাস। কিন্তু আÍহত্যাকে লঘুদ- মেনেছেন। তাই নিজের হাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিজের চোখ রক্তাক্ত করে অন্ধ হয়ে গেছেন। ন্যায়বিচারের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সমাজে-রাষ্ট্রে। এখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। আবার শেক্সক্স পিয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিসে বিচারের নামে প্রহসনে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, স্বাগত জানানো হয়েছে ন্যায়বিচারকে। সাহিত্যে যখন ন্যায় বিচার সংবর্ধিত হয়, তখন হয়ে ওঠে গণমানুষের সম্মানের জিনিস। এ দিক থেকে বিচার করলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানোও সাহিত্যের উদ্দেশ্য। সমাজে কী ধরনের কর্মকা- ঘটে,Ñ তার জরিপ উপস্থিত করা সাহিত্যিকের কাজ নয়। আবার সব সময় ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য কিংবা সত্য-মিথ্যার সম্পর্ক দেখানোও নয়। আসলে উপস্থিতকালের সাহিত্যিক তাঁর সমাজকে কীভাবে দেখছেন, আর তিনি নিজেই কী ধরনের সমাজব্যবস্থা আশা করেন, এই দুয়ের সমন্বয় ঘটানোর স্বপ্ন রচনা করাই তাঁর কাজ। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার রূপ নির্ভর করে একেক কালে, একেক সমাজে একেক রকম। এসবের কোনো চিরায়ত রূপ নেই। থাকতে পারে না। সমাজের প্রতিটি প্রপঞ্চ বিবর্তনশীল, পরিবর্তন ঘটে সামাজিক সম্পর্কে, চিন্তায় ও স্বপ্নে। শিল্পকলায়-বিজ্ঞানে-দর্শনে প্রতিদিনই বিবর্তন ঘটে, গতকালের সত্য আজ হুবহু নেই, আজকেরও সত্যও ভবিষ্যতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কিন্তু ধর্মের সত্য অনড়, অপরিবর্তনীয় ও স্থিতিশীল। ধর্মে নীতি ও নিয়মের স্থান সবার ওউপরে; মানবিকতা, প্রেম, কল্পনার স্থান সেখানে নেই। যেটুকু আছে তা-ও ধর্মনির্দেশিত। সবচেয়ে বড় কথাÑ সন্দেহ-প্রশ্ন-তর্কের স্থান কোনো স্থান নেই ধর্মে। ধর্মের সত্যে মানুষ আস্থাশীল হওয়ার ভান করে, সমাজের ভয়ে, পরকালের ভয়ে; ভেতরে ভেতরে সন্দেহ আর নানা রকমের জিজ্ঞাসা তাঁকে উত্তেজিত করে, কান্তও। কিন্তু ধার্মিকে হওয়ার লোভে, পরকালের অনন্ত সুখভোগের লোভে তিনিসে নিজের ভেতরে জেগে ওঠা প্রশ্ন-সন্দেহকে অবদমিত রাখেন। কিন্তু সাহিত্য-শিল্পে-বিজ্ঞানে-দর্শনে এই প্রশ্ন-সন্দেহই মূল। এসবের জোরেই সাহিত্যিক-শিল্পী-বিজ্ঞানী-দার্শনিক সমাজে নতুন নতুন রস, আবিষ্কার, প্রশ্নের জš§ দেন।
সাহিত্যের ধর্মÑ মানুষের ভেতরের মানুষকে জাগিয়ে তোলা, মনুষ্যত্ব ও পাশবিকতার পার্থক্য স্পষ্ট করা; এবং সমাজে যা ঘটে, যা ঘটা উচিত এই দুইয়ের সমন্বয় সাধনের স্বপ্ন দেখানো। এই সাধনায় সাহিত্যিক সফল হলেই সে সাহিত্য মানুষকে আলোড়িত করে, সমাজেও এর প্রভাব পড়ে। বাংলা সাহিত্যের আজকের যে রূপ, এর রূপ এক দিনে দাঁড়ায়ইনি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য; উত্তরাধিকারও। সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। সেখানে দেখেছি, যেমন রয়েছে নানা রকমের মতবাদ-মতবিরোধ, তেমনি রয়েছে নানা ধরনের উদ্দেশ্য-রাজনীতিও। এসবই এই বইয়ের প্রতিপাদ্য। আমার বিচারের দায় ছিল সাহিত্যের রস বিচার করা। কিন্তু শেষ এই বইয়ের গদ্যগুলো হয়ে উঠেছে নিরস।
প্রকৃত প্রস্তাবেই গদ্যগুলো নিরস। কোনো -কোনো পাঠকের মতে,Ñ আমার গদ্যভাষা জঘন্য; পাঠের অযোগ্য। পড়তে পড়তে বিতৃষ্ণা জাগে; ঘৃণা-বিরক্তিও। পাঠকের অভিযোগ অগ্রাহ্য করার শক্তি আমার নেই। যেমন থাকে না সিনেমার ভিলেনদের। নায়ক-নায়িকার মিলনে দর্শকমন হয় প্রফুল্ল, বিরহে ব্যথিত। কিন্তু ভিলেনের সাফল্যে দর্শক হয় সংক্ষুব্ধ, পরাজয়ে উৎফুল্ল। অর্থাৎ জয়-পরাজয়Ñ উভয় েেক্ষত্রেই ভিলেনভাগ্যে ঘৃণাই জোটে। ভিলেনের অভিনয় দেখে কিশোর-কিশোরী, সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ-তরুণী প্রায় অস্ফুট স্বরে বলে, ‘জঘন্য’। আমার গদ্যও তেমন। এ গদ্যগুলোয় বিরামহীন কোটেশন নেই, পা-িত্যের প্রমাণও না। নেই সুড়সুড়িসর্বস্ব উপন্যাসের মতো পাঠকের মন ভোলানো যৌনতার স্পর্শও।
আমার গদ্য জঘন্যÑ এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমার কোনো জবাব থাকে না। যেমন থাকে না দর্শকের তীব্র ঘৃণা হজম করেও নির্বিকার সিনেমার ভিলেনদেরও। দর্শকদের ঘৃণা যত বাড়ে, পরিচালক-প্রযেয়াজক-সমঝদারদের কাছে তত কদর বাড়ে ভিলেনদের। কিন্তু বৃহত্তর দর্শকগোষ্ঠীর তুলনায় পরিচালক-প্রযেয়াজক-সমঝদাররা সংখ্যায় অত্যল্প। জঘন্য গদ্যলেখকের অবস্থাও বোধ করি তেমন। আমার গদ্যভাষা জঘন্য জেনেও সমাজের সংখ্যালঘু প্রকাশক বই করার আগ্রহ দেখান। আগ্রহ দেখানোর সময় বৃহত্তর পাঠকশ্রেণীর রুচির কথা ভাবেন না। তাই লোকসান গুনণতে হয়; হাড়ে হাড়ে টের পান জঘন্য ভাষায় রচিত নিরস গদ্যের বই প্রকাশের ঝুঁকি কতখানি। সাকি পাবলিশিং কাবের মোজাম্মেল হক নিয়োগী বইটি প্রকাশের ঝুঁকি নিয়েছেন। লোকসানের মানসিক প্রস্তুতিও নিশ্চয় তাঁর রয়েছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতা : ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার
কবিতা এক ধারাবাহিক প্রপঞ্চ।
ঐতিহ্যহীন শিল্পের ভিত কখনো মজবুত হয় না। িেশকড়হীন বৃক্ষের মতো ওই শিল্পের গন্তব্যও উদ্দেশ্যহীন, Ñস্বীকৃতিহীন। কোনো এককালে যে শিল্পের সূচনা, কালক্রমে বহু শিল্পীর অংশগ্রহণে সে শিল্প ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে পল্লবিত; ক্রমপ্রসারমাণ। বাংলাদেশের কবিতা পাঠের সময় এই ঐতিহ্যিক পরম্পরা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। পদাবলির যুগ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কবিতা বিশ্লেষণে নানা বিষয়-আশয়ের সন্ধান মিললেও এক বা একাধিক সাধারণ ঐক্য সেখানে দুর্লক্ষ্য নয়।
বাংলাদেশের কবিতা মূলত হাজার বছরের বাংলা কবিতার উত্তরাধিকার। এ সময়ের কবিতায় কোনো না -কোনোভাবে অগ্রজ কবির ছায়া রয়েছে। কারণ, ‘মানুষকে যেমন িেশকড়ের কাছে যেতে হয় অস্তিত্ব বিস্তারের প্রয়োজনে, কবিতাকেও তেমনি মিথ-উৎস কিংবা ঐতিহ্য মন্থনের মতো অগ্রজের অভিজ্ঞতালোকেও কখনো কখনো পরিভ্রমণ করতে হয়। শতকসন্ধির সময়গ্রন্থি অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যবিন্দুতে যে জটিল অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, এ-সময়ের মৌলিক কণ্ঠস্বর সন্ধানী কবিদের জন্য তা নিঃসন্দেহে এক পরম প্রাপ্তি।’ (বাংলাদেশের তিন দশকের কবিতা : রফিক উল্লা খান)। কবিতাকে প্রাত্যহিকতার ভেতর রেখেও স্বপ্নজগতের আরাধ্য বিষয়েও পরিণত করেছেন কেউ -কেউ। এ ধারার কবিতায় জীবনের কথা, সংগ্রামের কথা, স্বপ্নের কথা একই সূত্রে গ্রথিত। মানুষের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের হতাশাÑদারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম, বিপ্লব এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে রূপক-প্রতীকের সাহায্যে কবিতায় প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে।
নারী, ধর্ম, নদী, প্রেম, দেহজ কামনা, দেশপ্রেম, নিসর্গ, রাষ্ট্রচিন্তাÑএসব প্রশ্নে প্রত্যেক যুগের কবির উপলব্ধি প্রায় অভিন্ন। ফলে পদকর্তার কোনো -কোনো পঙ্ক্তি হুবহু পরবর্তীকালের কারও -কারও কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এভাবে প্রাচীন-মধ্যযুগ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রকাব্যও আধুনিক কবিতায় প্রভাব ফেলে। বিষয়টা আসলে প্রভাবের নয়, ঋণ গ্রহণ ও ঐতিহ্যের। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য আঙ্গিকের বিবর্তনÑএ কথায় যতটা সত্য আছে, তারও বেশি আছে সংশয়। কোন আঙ্গিক থেকে আধুনিক বাংলা কবিতা নতুন আঙ্গিকে রূপান্তরিত হলোÑএ প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। তখন আঙ্গিকের বিবর্তন প্রসঙ্গ-ই হয়ে ওঠে প্রশ্নবিদ্ধ। তবে একথা সত্য যে, রবীন্দ্রকাব্যের আঙ্গিকের সঙ্গে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে প্রমুখের কবিতার আঙ্গিক ভিন্ন। এভাবে বিচার করলে আধুনিক বাংলা কবিতার আঙ্গিকের বিবর্তনের বিষয়টি একটি বিশেষ তাৎপর্যে বিবেচিত হয়। রবীন্দ্রকাব্যের সঙ্গে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দের কবিতার আঙ্গিকের যে পার্থক্য, সে সমানুপাতিক বিবর্তন বাংলাদেশের কবিতায় ঘটেছে কি নাÑএ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কবিতায় ভাষা, শব্দব্যবহার, অলঙ্কার, ছন্দ, বিষয়েরও রয়েছে ঐতিহ্যিক সম্পর্ক; রয়েছে নিরীক্ষারও। বাংলাদেশের কবিতায় এসবের সমন্বয় ঘটেছে নানাভাবে। এর কারণ স্বাধীনতা-উত্তরকালে যাঁদের আবিভর্ভাব, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী কবিরাও একই বিষয়-আশয় নিয়ে কাব্যচর্চায় ক্রিয়াশীল ছিলেন, কেউ কেউ এখনো সৃষ্টিশীল। ফলে অগ্রজ কবিদের কাব্যকৌশলের প্রভাব অনুজদের ওপর পড়েছে স্বাভাবিকভাবে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলা কবিতায় প্রধানত বিষয়ের পরিবর্তন আসে। রোমান্টিকতা, নিসর্গ ও দেহজ প্রেমের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও দেশপ্রেম প্রাধান্য পেয়েছে এ সময়ের কবিতায়।
বাংলা কবিতার রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য; বাঁক-উপবাঁকের ইতিহাসও। কবিতা কখনো হয়ে উঠেছে স্ববিরোধী চিন্তার অন্তঃসার, কখনো জাতিসত্তার স্বাক্ষর। শিল্পীমাত্রই আÍ-উšে§াচনে কাক্সক্ষাপোষণকারী। আÍ-উšে§াচনের জন্য আÍপরিচয় অনুসন্ধান জরুরি। পরিচয়সংকট ঘটলে সেখানে আÍ-উšে§াচন সম্ভব হয় না। শিল্পকর্মে শিল্পীর আÍপরিচয়ের ছাপ থাকাই স্বাভাবিক। বিপরীত দৃশ্য কদাচিৎ দেখা যায়। সে দৃশ্য ব্যতিক্রম মাত্রÑকোনোভাবেই বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ওঠে না। িেশকড়বিহীন গাছ যেমন বৃক্ষ নয়, পরগাছা; তেমনি আÍপরিচয়হীনও শিল্পী নন, অনুকারকমাত্র। কবিতা সবচেয়ে স্পর্শকাতর শিল্প, তাই কবিকে সবকিছুর আগে আÍপরিচয়ে সংবর্ধিত হতে হয়। বাংলাদেশের কবিদের একটি নির্দিষ্ট-স্বাধীন ভূ-খ- রয়েছে। এর পেছনের ইতিহাস রক্ত ঝরার। সে ইতিহাসে রিরংসা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বীরত্বের গাথাও। মহাকাব্য সৃষ্টির বিপুল উপকরণ ও উৎস হওয়ার মতো একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু বিশ্ব-অর্থনীতি, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ মহাকাব্যের যুগের অনেক পরের ঘটনা। মহাকাব্যের রুচি, মেজাজ ও স্বাদ গ্রহণের মানসিক যোগ্যতা তত দিনে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। গীতিকবিতার দুকূকুল প্লাবীযুগে মহাকাব্যের দীর্ঘযাত্রা অচল। তাই খ-কবিতা-ই মহাকাব্যের সারাৎসার হয়ে উঠেছে। পঞ্চাশ হাজার শব্দের মহাকাব্যে যে রুচি-মেজাজ-বোধের সন্ধান মিলত, সে একই যোগ্যতা নিয়ে উপস্থিত আজকের পঞ্চাশ থেকে পাঁচ শত শব্দের একটি গীতিকবিতা। বর্তমানকালের কবিতায় ঘটনার চেয়ে ঘটনার পরিপার্শ্ব, মানুষের চেয়ে মানুষের মনস্তত্ত্বই মুখ্য। পূর্ববর্তী কবিদের সৃষ্ট পথকে পাথেয় জেনেও সে পথকেই বাংলাদেশের কবিরা একমাত্র জ্ঞান করেননি। নতুন পথ নির্মাণের পরিচর্যায়ও কোনো -কোনো কবিকে আÍমগ্ন হতে দেখা যায়। আÍমগ্ন হওয়ার লক্ষ্য যতক্ষণ আÍ-উšে§াচন, ততক্ষণ কবি মানবতাবতাবাদী। সমাজবিমুখ হওয়ার পথে অগ্রসর হতে গেলেই সর্বনাশ। সর্বনাশ মানবিকতার প্রশ্নে, শিল্পের প্রশ্নেও।
বাংলাদেশের কবিতার বিষয়-আশয়, প্রবণতা, লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে কিছু সাধারণ ঐক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমনÑ
১. মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও দেশ পুনর্গঠনের উদ্যোগ
২. পরাজিত শক্তির প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা
৩. ঐতিহ্য ও আধুনিকতার প্রশ্নে স্ববিরোধিতা।
৪. বিষয় নির্বাচনে নতুনত্বের অন্বেষা।
৫. লোকজ অনুষঙ্গের প্রাধান্য।
৬. কেন্দ্রবিমুখ ও প্রান্তমুখী চেতনা।
৭. ছন্দ বিষয়ে মতানৈক্য।
৮. মন ও মননের অন্বয়সাধন।
৯. ধর্মীয় বিষয়ে নিস্পৃহ মনোভাব।
১০. উপমাসহযোগে চিত্রকল্পের প্রয়োগ।
১১. ভাবালুতার বিপরীতে চিন্তার প্রাখর্য।
১২. সমকালীন ঘটনার ভিতের ওপর চিরকালীন চেতনার উদ্ভাস।
উল্লিখিত প্রবণতা, লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো কখনো একই কবির একাধিক কবিতায়, কখনো বহু কবির কবিতায় দেখা গে গিয়েছে। এবং তা কখনো প্রচ্ছন্ন, কখনো প্রকটরূপে। বিষয়গুলো কোনো এক কবির কবিতায় এককভাবে ছায়াপাত করেনি। অর্থাৎ কখনো অনেক কবির একই ধরনের ভাবনা দেখা গেছে, কখনো এক কবিরই অনেক কবিতায় একই বিষয় চিত্রিত হয়েছে।
বাংলাদেশের কবিতার বিপুল অংশজুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। ওই সময়ের কবিতায় দেশপ্রেম যেমন প্রবল হয়ে উঠেছিল, তেমনি প্রতিশোধপরায়ণতাও। আবার ক্রোধ ও স্বদেশ-স্বজাতিপ্রীতিও বড় রকমের ভূমিকা পালন করেছিল। ফলে কাব্যক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো। স্বাধিকার ও মুক্তির আকাক্সক্ষার স্থলে প্রতিশোধ স্পৃহা ও প্রতিহিংসা এবং দ্রোহ ও অসহযোগের স্থলে দেশ পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি বড় হয়ে উঠল। এখানে বিস্ময়ের বিষয়Ñএই দ্রোহ, প্রেম, প্রতিশোধ স্পৃহা, কামনা, যুদ্ধÑএসবের কোনো কিছুই বাঙালিজীবনের আকস্মিক ঘটনা নয়। বহু যুগের বহু ঘটনার ভেতর দিয়ে বাঙালির অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। ফলে এককালের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্যকালের অভিজ্ঞতাও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘বাংলা কবিতার ঐতিহ্য বিচারে জীবনচেতনা ও সমাজচেতনা ঘিরে দুই বিপরীতের চিত্রণ শুরু থেতকে দুই ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করেছে, কখনো তত্ত্বের টানে কখনো মতাদর্শের প্রভাবে। অধ্যাÍবাদিতা বা মানবিকতা বা সমাজচেতনা কবিতাকে ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যে কারণে কখনো ঐশীচেতনা ও ভাববাদিতা প্রাধান্য পেয়েছে, কখনো পেয়েছে সচেতন জীবনবোধ, আবার কখনো সমাজ পরিবর্তনের সম্ভাবনায় বর্ণময় ভবিষ্যতের আকাক্সক্ষা। কবিতার এ দ্বৈত চরিত্র যতটা বিশ্বজনীন তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাচ্যচেতনা, বিশেষ করে বাঙালি চেতনার অঙ্গীভূত।’ (আহমদ রফিক, বাংলা কবিতার ঐতিহ্য-চরিত্র : দ্বৈত রূপের দ্বন্দ্ব)। ঐতিহ্যের প্রশ্নে বাংলাে দেশের কবিতার বিশেষত্ব রয়েছে। সে বিশেষত্ব এর মৌলিকত্বের ও নিজস্বতার। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যাঁরা কবিতাচর্চা শুরু করেছেন, তাঁদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গÑএ কথা অনস্বীকার্য। ‘মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে যে-সকল নতুন কবি আবির্ভূত হলেন দ্বিধাহীন আÍপ্রকাশ-আকাক্সক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বস্তুগত পটপরিবর্তনের সুখবোধ ও আনন্দানুভূতি অনেকের স্বপ্নলোককেই করে তুললো বস্তুসম্পর্করহিত। প্রেম ও সংগ্রামের দ্বৈরথ অগ্রজদের কারো কারো মতো এঁদের আলোড়িত করেনি। বরং যুদ্ধোত্তর কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় জীবনের বিপর্যয়, মুক্তিযুদ্ধ-অর্জিত চেতনার ক্রমবিলীয়মান রূপ, পাকিস্তানি আমলের পরাজিত দৃষ্টিভঙ্গির পুনরুত্থান, সেনাতন্ত্রের বিকৃত মুখচ্ছবি, গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, পরাজিত সাম্প্রদায়িকতার পুনরুজ্জীবনচেষ্টা এবং সংবিধানের মূলস্তম্ভগুলোর অপসারণ জাতীয় চৈতন্যকে নিক্ষেপ করে গভীর অন্ধকার ও অনিশ্চয়তাগহ্বরে। এই পরিস্থিতিতে সংবেদনশীল কবিচৈতন্যের যে -প্রতিক্রিয়া, সমাজ ও সময়ের অন্তঃস্বর অনুধাবনে তার তাৎপর্য অপরিসীম। (সাম্প্রতিক কবিতা : ভাবরূপের অস্থির জঙ্গম, রফিকউল্ললাহ খান)। সঙ্গত কারণে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিরা শুরুতে রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। সব তরুণই যে জনপ্রিয়তার জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন, তাও নয়। যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও সব সময় জনপ্রিয়তার বিষফল পান করতে সমর্থ হননি। ফলে অচিরেই কবিতার জগৎ থেকে ছিটকে পড়েছেন। কারও- কারও নাম এখন ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে উচ্চারিত হয় মাত্র। কোনো -কোনো কবি জীবন ও শিল্পের জটিলতাকে মন্থন শেষে নতুন অভিজ্ঞতায় রূপান্তরের কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন। তবে প্রত্যেকে সমান দক্ষতায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এমনটা বলা যায় না।
স্বাধীনতা-উত্তর কালখ-ে দেশ পুনর্গঠনের ভার কবিদের ওপর ছিল না। কিন্তু কবিরাই স্বপ্নবান ছিলেন দেশগঠনে। তাই শুরুর দিকে কিছুটা স্লোগানসর্বস্ব কবিতাও লিখেছেন কেউ -কেউ। অগ্রজদের মধ্যেও তখন নতুন করে দেশপ্রেম জেগে উঠেছিল। বিশেষত যারা পাকিস্তানের পক্ষে, কায়েদে আযজমের পক্ষে স্লোগান লিখে খ্যাতি অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরাও তখন মাতৃভূমির জয়গাথা রচনা শুরু করেছিলেন। স্লোগানকে কবিতায় উন্নীত করার প্রশ্নে কবিরা তখন দ্বিধাজড়িত ছিলেন না;। বরং জীবন ও শিল্পের মিথস্ক্রিয়ায় নতুন অভিজ্ঞান রচনায় ব্রত হয়েছিলেন। সময়ের দাবিকে তাঁরা অস্বীকার করেননি। শিল্পের সমান গুরুত্বপূর্ণ করেছিলেন জীবনের কাক্সক্ষাকেও। আÍপরিচয়ের সন্ধানে নিজেরা হয়ে উঠেছিলেন ডুবুরির মতো।
কোনো একটি বিশেষ কালখ-ে একাধিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চিন্তকেরও আবির্ভাব হতে পারে। মতাদর্শের প্রশ্নে পরস্পরের মতৈক্য থাকা সত্ত্বেও প্রকাশের পথ অভিন্ন হয় না। গুরু-শিষ্যেও দেখা দেয় মতবিরোধ। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যই ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে আলাদা করে তোলে ব্যক্তির গ্রহণ-বর্জন ক্ষমতার ভিত্তিতে। এককালের ভালো লাগার বিষয়ও উত্তরকালে অপছন্দের তালিকায় ঠাঁই নেয়। নন্দনতাত্ত্বিক ঐকমত্য সব সময় সম্ভব হয় না। চিন্তার স্রোতও চলে না সমান্তরাল গতিতে। জীবনাভিজ্ঞতা, রুচিবোধ ও পাঠাভিজ্ঞতার মিথস্ক্রিয়ায় ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন গ্রহণ-বর্জন ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা দেয়। মৌলিক চিন্তা ও প্রজ্ঞার ঐশ্বর্য অগ্রজ ও সমকালীন অন্য চিন্তকের চিন্তাবিশ্ব থেকে চিন্তককে স্বতন্ত্র করে তোলে। সক্রেটিসের চিন্তার ভরকেন্দ্রে ছিল আÍ-জিজ্ঞাসা, সত্যের সন্ধান। প্লেটো সে ঐশ্বর্য ও মৌলিকত্বে বিস্মিত হয়েছিলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েননি। ঈশচিন্তা ও মানবকল্যাণেনর প্রশ্নে উভয়ের সাধনা অভিন্ন। গুরু প্লেটো ছিলেন কবির প্রতি বিতৃষ্ণ; শিষ্য অ্যাএরিস্টেটল কবিতার গুণগ্রাহী। জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় গুরু-শিষ্যের ভাবনার মিল থাকলেও কবিতার প্রশ্নে উভয়ের মানসগঠন সম্পূর্ণ বিপরীত। যে-েেকানো প্রতিক্রিয়াশীলতামুক্ত চিন্তারাজ্যেই চিন্তার স্ববিরোধের সম্ভাবনা থেকে যায়। চিন্তকে -চিন্তকে ব্যক্তিত্বের সংঘাতও অনিবার্য হয়ে ওঠে কখনো -কখনো। শেষ পর্যন্ত পক্ষপাতহীন চিন্তাস্রোতের অস্তিত্ব অলিীক ধারণায় পর্যবসিত হয়। সমাজ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে ব্যক্তিকে কোনো না কোনো পক্ষাবলম্বন করতে হয়। পক্ষপাতশ্লিষ্ট বিশ্বাস ও আচরণের মূলে ব্যক্তির অভিরুচি এবং ব্যক্তিস্বার্থও জড়িত। সে অর্থে চিন্তার দীর্ঘায়তনে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির অভিন্ন রুচি গঠন জরুরি। অভিন্ন রুচিবোধ গড়ে না উঠলে অভিন্ন চিন্তার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তাই দেখা যায়, পুরুষ নিজের জন্য সতী স্ত্রী নির্বাচন করে, কিন্তু অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে মনোদৈহিক সম্পর্ক গড়ে তুলতেও পাপবোধ জাগে না তার। নারীও কি সে রকম নেই? নারীও নিজের স্বামীকে নিষ্কাম দেবতার মতো পেতে চায়, অথচ কামুক কোনো পুরুষকে দেহদানের জন্য ভেতরে ভেতরে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ফুকো-দেরিদা, ভলটেয়ার-রুশো প্রত্যেকের চিন্তার ভরকেন্দ্রে মানবকল্যাণের সদিচ্ছাই ক্রিয়াশীল ছিল। তবু সে মাঙ্গলিক চিন্তার বাস্তবায়ন প্রশ্নে, প্রত্যেকের পথ ছিল স্বতন্ত্র ও স্বরচিত। কেউ কারও পথ মাড়াতে চাননি। শিষ্যের ব্যক্তিত্ব যখন গুরুর ব্যক্তিত্বকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, তখন গুরু শিষ্যকে বিভিন্নভাবে ভর্ৎসনা করেছেন। গুরুশিষ্যের øায়ুযুদ্ধে অনুরাগীরাও ব্যথিত হয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিত্বের প্রশ্নে প্রত্যেকে ছিলেন আপসহীন। গুরু-শিষ্য তাত্ত্বিক আলোচনায় সব সময় একমত হতে পারেন না। জ্যাঁ পফল সাঁত্রের চিন্তারস্ববিরোধ ভুবনবিখ্যাত। এই ফরাসি চিন্তানায়ক, অস্তিত্ববাদী দার্শনিক মনে করতেন, ‘অস্তিত্ব সারসত্তার পূর্বগামী’। মানুষ নিজেই নিজের স্রষ্টা। অস্তিত্ববাদী দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি পূর্ববর্তী অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কে গার্ডের চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। কিন্তু কিয়ের্কে গার্ড যেখানে কেবল নিখিল নাস্তির জয়গান গেয়ে দর্শনকে নৈরাশ্যময় করে তুলেছিলেন, সেখানে নাস্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেও সাঁত্র মানবতাকে মহীয়ান করে তুলেছিলেন। অথচ এই সাঁত্রে ঐতিহ্য প্রশ্নে ছিলেন স্ববিরোধী। ঐতিহ্যকে স্বীকার করেও ঐতিহ্যবিরোধী দর্শনকে ঔজ্জ্বল্য দিয়েছেন।
একই ব্যক্তি চিন্তার স্ববিরোধে আক্রান্ত হন কখন? কবিতায় চিন্তার স্ববিরোধ কিংবা ব্যক্তিত্বের সংঘাত কেন ঘটে? এবং কী ভাবে? ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধই ব্যক্তিত্বের সংঘাত সৃষ্টির মৌল নিয়ামক। চিন্তার স্ববিরোধ প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রগতিশীলতার ক্ষেত্রে ঘটে। বিরোধ সৃষ্টি হয় রোমান্টিকতা এবং আধুনিকতায়। আস্তিক্য ও নাস্তিক্যেও। এসব বিষয় কবিকে ভাবিত ও প্রভাবিত করে প্রবলভাবে। তাড়িতও কি করে/////। ফলে কবি প্রকাশভঙ্গিতে যতটা রোম্যান্টিক, কবিতার আঙ্গিকে ততটাই আধুনিক। সামাজিক বিশৃঙ্খলায় সমাজচিন্তক ভাবিত হলে, কবিও চিন্তিত হন। সামাজিক আচরণে তাৎক্ষণিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা কবির পক্ষে সম্ভব নয়; দৃশ্যত। আবার সমাজচিন্তকের দৃষ্টিতে যা বিশৃঙ্খল, তাই কবির বোধে শৃঙ্খলা। সে ক্ষেত্রে সমাজচিন্তকের চিন্তার সঙ্গে কবির চিন্তার সংঘর্ষ অনিবার্য। সমাজচিন্তক বিবাহবহির্ভূত নারী-পুরুষের মনোদৈহিক সম্পর্কে বিধিনিষেধের দেয়াল তোলেন। কবি তৈরি করেন সে সম্পর্কের ভিতের ওপর নান্দনিক সৌধ। সঙ্গত কারণে এ সামাজিক মূল্যবোধের প্রশ্নে কবির ভাগ্যে তিরস্কার জোটে।
কবিতায় বৈশ্বিক চেতনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উগ্র জাতীয়তাবোধ কবিকে সংকীর্ণ ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ রাখে। আবার দেশপ্রেমহীন বিশ্বনাগরিকবোধও কবিকে উন্মূš§ুলজীবন যাপনকারীতে পরিণত করে। করে তোলে উদ্বাস্তুও। েিশকড়বিহীন বৃক্ষ যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি নির্দিষ্ট ভূখ- ছাড়াও কবির অস্তিত্বত্ত্ব বিপন্ন। ভূখ- ছাড়া স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। সার্বভৌম কবির অস্তিত্বত্ত্বও অনেকটা স্বাধীন-সার্বভৌম কবির মতো। জীবনের আলোকচিত্র নয়, প্রতিচ্ছবি, সমাজের নানা বিষয়ের সাংবাদিক প্রতিবেদন নয়, ঘটনার বস্তুনিষ্ঠষ্ট বিবরণ-Ñঅনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে কারও কারও কবিতায়। ফলে এ ধারার কবিতা এক ধরনের সাংবাদিক মূল্যও প্রতিষ্ঠা পায়। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের অন্নবস্ত্রের নিশ্চয়তা দিতে পারে না, তার বিরুদ্ধে কবিরা দ্রোহ করেন। সরাসরি রাজনৈতিক সুর ও স্বরে নয়, কিছুটা ব্যঙ্গ, কিছু শ্লেষে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতায় এই প্রবণতাগুলো কেবল প্রচ্ছন্ন থাকেনি, হয়ে উঠেছে সচেতন পাঠকের মনের কথাও। ফলে তাঁদের কোনো -কোনো কবিতা রস গ্রহণের অনুষঙ্গের সীমা ছাড়িয়ে রুচিশীল নাগরিকের রাজনৈতিক চিন্তার সম্পূরকও হয়েছে। এ সময়ের কবিরা উপলব্ধি করেছেন, অস্থির পরিস্থিতির ভেতর পাখির গান গাওয়ার মতো কবিতাচর্চা বিলাসিতা মাত্র, এখন প্রয়োজন শিল্পকে বক্তব্য উপস্থাপনের উপায় করে তোলা। ফলে তাঁদের কবিতায় মানবজীবনের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে, বাদ যায়নি স্বপ্ন-চিন্তা ও মনস্বিতাও। শিল্পসচেতন মানুষের মনে শিল্প প্রসঙ্গ বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে চরাচরের অন্যান্য বিষয় গুরুত্বহীন না হলেও, কিছুক্ষণের জন্য বিশেষ করে শিল্পভাবনার বিশেষ মুহূর্তে জগতের যাবতীয় বিষয়ের গুরুত্ব কিছুটা ম্লান হয়ে পড়ে। তখন শিল্পের যে অঞ্চলে তাঁর সিদ্ধি, সে অঞ্চলের বিশেষ ব্যঞ্জনায় নিজেকে বারবার রাঙিয়ে নিতে চান শিল্পী। কোনো -কোনো শিল্পের কাছে সমর্পিত সত্তা; তাঁদের কবিতায় মানুষের ক্ষুধা-দারিদ্র্য, দুঃখ-যন্ত্রণা, হতাশার চেয়ে স্বপ্ন-প্রেম, কাতরতা-পিপাসা ও কামের প্রসঙ্গ প্রচ্ছন্ন। কোনো -কোনো ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন ভাব ছাপিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিল্পের প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ পক্ষপাত। কারও -কারও কবিতায় চরাচরের যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলে একজন স্বপ্নবান মানুষের দেখা মেলে। যেখানে জগতের কোনো কিছুর প্রতি তাঁদের মোহ নেই, মোহ কেবল কবিতার কাছে। কবিতার কাছে-ই তাঁদের নিবেদন। কিন্তু তিনি মাঝে -মাঝে যেন ভুলে-ই যেতে চানÑ ‘সংকেতে প্রতীকে রূপকল্পে কবিতা আসলে তুলে ধরে আমাদেরই আশা হতাশা, বোধ ও বিবেচনা, আনন্দ, দুঃখ, আমাদেরই অস্তিত্বের সংকোচন ও সম্প্রসারণের সংবাদ।’ (কবিতা কেন লেখা : সৈয়দ শামসুল হক)। এ শ্রেণীর কবিকে পৃথিবীর কোনো বস্তুই আপ্লুত করে না, কোনো স্বার্থের প্রতি তাঁর মোহ নেই। কেবল কবিতার প্রতি-ই তাঁর যত আকর্ষণ, মুগ্ধতা। ফলে সমাজে-রাষ্ট্রে কোথায় কী ঘটছে, তারও বেশি আচ্ছন্ন কবি শিল্পের শুদ্ধতার প্রতি। আÍমগ্নতা-ই তাঁর স্বভাব। এ ধারার কবিরা মূলত আÍমগ্ন, সমাজবিমুখ না হলেও শতভাগ সমাজসচেতনও নন। এদিক থেকে পদকর্তাদের আÍমগ্নতা ও তন্মম্ময়তার সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
কারও কারও কবিতায় কেবল ব্যক্তিগত দুঃখবোধ কিংবা সুখ কিংবা বিষয়-আশয় প্রাধান্য পায় না, এর গভীরে যে বিষয়গুলো সমাজস্থ মানুষকে ভাবিয়ে তোলে, তারও কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা থাকে। কবিতা কখন কবির ‘সমাÍজীবনী’ হয়ে ওঠে? কখন কবিতাকে মনে হয় কবির গোপন রক্তক্ষরণের ভাষিক অনুবাদ? কবিতা কখনো -কখনো দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে, মানব বসতির বৃত্ত পার হয়ে আÍ-উদ্বোধনে সহায়ক হয়। চরাচরে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার প্রতিঘাত কবির সৃজনকৌশলে কবিতায় রূপান্তরিত হতে পারে। ব্যক্তি মানুষের নৈর্ব্যক্তিক আচরণ, লৌকিকতার বিপরীতে স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণও মুহূর্তে কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। নিরন্তর পরিচর্যায় একজন শক্তিমান কবি সহযাত্রীদের অতিক্রম করে হয়ে ওঠেন বাঁক বদলের রূপকার। এর জন্য চাই কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য অর্জন। এ অর্জন কষ্টসাধ্য হলেও প্রকৃত কবির পক্ষে অসম্ভব নয়; কিন্তু অর্জন করার মতো যোগ্যতা একই সঙ্গে সবার হয় না। এক-একটি কালখ-ে একজন কি দুজনের কণ্ঠই আলাদা করে শোনা যায় মাত্র। একই সঙ্গে দশজন-বিশজনের কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। কারণ, হাজার বছরে একজন মধুসূদন, একজন রবীন্দ্রনাথ, একজন কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা একজন জীবনানন্দ দাশের আভির্ভাব ঘটে; চেষ্টা করে কেউ রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ দাশ হতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো,Ñ কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য অর্জনের সহজ সূত্র কী? শব্দ নির্বাচন, গঠন ও প্রায়োগিক কৌশলই কেবল কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য নির্ণায়ক হতে পারে না। কেবল অলঙ্কার প্রয়োগের স্বকীয়তাও নয়। তবে বিষয়, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার ও শব্দ প্রয়োগে বিশেষ কৌশলপূর্ণ শৈলীর উপস্থাপন একজন কবিকে সমকালীন ও অগ্রজ কবির কণ্ঠস্বর থেকে স্বতন্ত্র কণ্ঠ অর্জনে সমর্থ করে তোলে। এ জন্য থাকতে হয় জীবন সম্পর্কে প্রগাঢ় প্রশ্ন। আবার মানবিক আচরণের স্ববিরোধ ও সুকুমারবৃত্তির সংরাগেও কবি মনে এক ধরনের বিকলন দেখা দেয়। সে বিকলন কবিচিত্তে যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে, তার-ই বিপুল আলোড়নে তৈরি হয় শিল্পের বিভিন্ন অঞ্চলব্যাপী চিৎপ্রকর্ষের ফল্গুধারা। এভাবে কবি ডুব দেন কর্মচাঞ্চল্যের আয়োজনের ভেতর।
পদাবলীর চ-ীদাস, বিদ্যাপতি, মঙ্গলকাব্যের চাঁদ সওদাগর, বেহুলা কিংবা লখিন্দর মিথের পোশষাক পরে যেমন নতুনরূপে উপস্থিত হয়, তেমনি গ্রিক মিথও জীবন্ত হয়ে ওঠে। আবার লোকপুরাণের পাশাপাশি কোরআন-পুরাণের////////// বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রও কবিতার বিষয় হয়েছে। তবে লোকপুরান, গ্রিক মিথ কিংবা ভারতীয় পুরাণের পুনরুজ্জীবন যতটা স্বতঃস্ফূর্ত ও অক্ষয়, ইসলামি অনুষঙ্গ ততটা নয়। রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্র যতটা আত্তীাÍীয়করণে সম্পৃক্ত, ততটা কোরআন নয়। ইসলাম ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহারে কবিদের কিছুটা কৌশলী হতে দেখা যায়। রাধা-কৃষ্ণ, রাম-সীতা, একলব্য, অর্জুন, দ্রোণাচার্য, সরস্বতী যতটা বাঙালি কবির চিত্তহরণে সক্ষম, ততটা কেরামান-কাতেবিন, ঈষা-মুসা-ইব্রাহিম-মুহম্মদ নয়। কারণও স্পষ্ট। ইসলামি মিথ ও চরিত্র যতটা ধর্মীয় অনুষঙ্গ, ততটা সাংস্কৃতিক নয়। আর সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয় প্রাণে আলোড়ন তুলতে পারে না কখনোই। তাই ইসলাম ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষঙ্গে নিয়মের নিগড় বেশি। চিত্তের চাঞ্চল্য প্রকাশে এসব অনুষঙ্গ অনুকূল নয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালের কবিরা উপলব্ধি করতে প্রাণিত হয়েছেনÑ ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মীয় প্রপঞ্চ বাঙালির ওপর আরোপিত বিষয়; কিন্তু গীতা, রামায়ণ কিংবা মঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন অনুষঙ্গ বাঙালির ঘরের জিনিস, প্রাণের বস্তু। ধর্মানুষঙ্গ যেখানে কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে, সেখানে ঐতিহ্যের প্রশ্নে সংশয়ী তাঁরা। তেমনি ধর্মীয় বিষয়ে নিস্পৃহ মনোভাবও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লব্ধ ধারণার সঙ্গে জীবনের কোনো বিশেষ ঘাত-প্রতিঘাতের প্রত্যক্ষ কোনো সম্বন্ধ না থাকলে তা শিল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর জন্য দায়ী জনপ্রিয়তার মোহে আচ্ছন্ন কবিদের অনুকরণপ্রিয় মানসিকতা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে চরম রোমান্টিকতা ও কাসিজমের বিপরীতে বিপুল হতাশা ও গ্লগানির ওপর আধুনিকতার জš§। সে আধুনিকতা পুঁজিবাদ-ধনতন্ত্রকে পরিহাস করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রতিও সন্দেহের কাঁটা এগিয়ে ধরেছে। এ রকম আচরণের কার্যকারণ সম্পর্কের উৎস অনুসন্ধান করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আধুনিকতাবাদীদের যাপিত জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা ও হতাশার প্রকৃত রূপ। শক্তিমান কবির কবিতায় ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিছক প্রথাগত ধর্মীয় বৃত্তের ভেতর থাকে না। আবার প্রথাগত ধর্মের প্রতি নিস্পৃহ মনোভাব মানুষকে কখনো -কখনো নিখিলনাস্তির দিকেও প্ররোচিত করে। নিখিলনাস্তিপন্থীদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। অনেকের মতে, তিনিই এ ধারণা ইউরোপ থেকে আমদানি করতে চেয়েছিলেন। দীপ্তি ত্রিপাঠী আধুনিক বাংলা কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ভেতর অনিকেত শৈলীকে একটি বিশেষ গুণ বলে দাবি করেছিলেন। এবং তাঁর ওই প্রস্তাবনা বহুদিন পর্যন্ত গৃহীত হয়েছিল। আধুনিকতাবাদীদের অন্তঃসারশূন্য জীবনাচরণ ও কাব্যাদর্শের ফাঁকিকে পুঁজি করে নব্যপুঁজিবাদ ‘উত্তরাধুনিকতা’র ছদ্মবেশে মানবচিন্তার শৈল্পিক অঞ্চলকে প্রায় গ্রাস করে ফেলে। আধুনিকতা যেখানে ঐশ্বরিক প্রপঞ্চকে অস্বীকার করে, সেখানে উত্তরাধুনিকতা আস্তিক্যবাদকে দেয় পুনরুজ্জীবন। কিন্তু দুটি মতবাদের কোনোটিই প্রশ্নসীমার বাইরে নয়। তবু এ দুটি মতবাদের জন্য প্রত্যক্ষ জীবনাভিজ্ঞতা ও সমাজের অভিঘাত ক্রিয়াশীল। ফলে কবিতায় সন্দেহ, সংশয় স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। যুগে -যুগে কবিতা প্রকাশ করেছে মানবজীবনের যত সব ঘটনা ও দুর্ঘটনার চিত্ররূপময় প্রতিবেদনও। সেখানে আনন্দের হিল্লোল যেমন আছে; তেমনি আছে বিষাদের ছোঁয়াও।
বাংলাদেশের কবিতায় নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর থেকে কবিরা দলীয় রাজনীতিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন বেশি। এই আক্রান্তদের কারও -কারও কবিতা পড়ে মনে হয়, Ñতারা যতটা না রাজনীতি সচেতন, তারও বেশি দলীয় কর্মী। এই দলীয় কর্মী-শ্রেণীর কবিরা মতবাদীও। এই মতবাদ কবিতার, আধুনিকতাবাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদ, পারাবাস্তববাদ, ডাডাবাদ//// নয়; রাজনীতির মার্কসবাদ, পুঁপূঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী চেতনার। তাঁদের কবিতার বিষয়বস্তু পূর্ব নির্ধারিতÑ স্বোপার্জিত নয়; আরোপিত। অথচ কবির অভিজ্ঞতা হওয়া উচিত একান্ত এবং নিজস্ব। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কবিগোষ্ঠী চিন্তাচেতনায়, প্রকরণে ওএবং প্রকাশে সমান মানের নন। ব্যাপক হতাশা ও নৈরাশ্য কবিকে অনেক সময় পলায়নপর মনোবৃত্তির করে তোলে। মতবাদ কবিতাকে ফেনায়িত করে; আর উদ্দেশ্য কবিতার মৃত্যু ডেকে আনে। এই দুইয়ের ফলে কবিতা হয়ে পড়ে মননশূন্য, Ñঅসংবেদনশীল। তবু কোনো -কোনো কবি দলীয় রাজনীতির বৃত্ত ছাড়িয়ে মানবতার জয়গান গেয়ে ওঠেন। তখন রাজনীতিও কবিতার একটি সুষমাম-িত অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ফলে রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতি একাকার হয়ে যায়। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ভেতরই আবিষ্কার করি রাজনীতির অন্তঃসারশূন্য দিকও।
রাজনীতির প্রতি প্রকৃত কবির বিবমিষা জšে§। এর কারণও অনেক। রাজনীতিঅলারা রাজনীতি করেন মূলত ক্ষমতা দখল ও মসনদের জন্য; জনকল্যাণের জন্য নয়। এ জন্য দেখা যায়, Ñযতই রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়, জনসাধারণের ভাগ্যের উন্নতি কিংবা পরিবর্তন হয় না। জনগণের কদর বাড়ে কেবল একটা বিশেষ সময়ে। অর্র্থাৎ সাধারণ নির্বাচন এলে জনগণ হয়ে ওঠেন দেবতা, সকল ক্ষমতার উৎস এবং নির্বাচক। ‘ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়’Ñ এই প্রবাদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে জনগণ প্রতি পাঁচ বছর পর পরই ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। এবং ওই প্রতিনিধিরাই জনগণের সঙ্গে প্রতিত্যেকবার প্রতারণা করেন। তাই ভোট শেষে জনগণ বেওয়ারিশ লাশ হয়ে বাঁঁশ ঝাড়ে, ডাস্টবিনে, ম্যানহোলে এবং রাস্তার পাশে পড়ে থাকেন। এই লাশগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল, মিছিল এবং আন্দোলনের ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় মাত্র। এইসব মানুষ রাজনৈতিক হত্যাকা-ের শিকার বলে কোনো সুষ্ঠু তদন্ত কিংবা বিচার পর্যন্ত হয় না। জনসাধারণ শুধু প্রতিশ্রুতিই শোনে; তার বাস্তবায়ন চাক্ষুষ করতে পারে না। রাজনীতিঅলারা প্রকাশ্যে জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে আশ্বাস দিলেও গোপনে জনগণের সর্বনাশ করার জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে রাখেন। রাজনীতিঅলাদের এই দ্বৈত চরিত্রের কারণে বলা যায়, Ñবর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে চরিত্রহীন সম্প্রদায়ের নাম রাজনীতিবিদ। তাহলে কবি কি রাজনীতি বিমুখ হবেন?
কবি রাজনীতি সচেতন না হলে রাষ্ট্রস্ট্রযন্ত্র বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকেÑএ-ও সত্য। ততধিক সত্য, Ñকবি রাজনৈতিক -কর্মী হলে মানবতার বিরুদ্ধে চলে যায় তাঁর সকল চিন্তা ও চেতনার সারাংশ। এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উক্তি স্মরণ করা যাকÑ ডযবহ ঢ়ড়বিৎ ষবধফং সধহ ঃড়ধিৎফ ধৎৎড়মধহপব, ঢ়ড়বঃৎু ৎবসরহফং যরস ড়ভ যরং ষরসরঃধঃরড়হং. ডযবহ ঢ়ড়বিৎ হধৎৎড়ংি ঃযব ধৎবধং ড়ভ সধহ'ং পড়হপবৎহ, ঢ়ড়বঃৎু ৎবসরহং যরস ড়ভ ঃযব ৎবধপযহবংং ধহফ ফরাবৎংরঃু ড়ভ যরং বীরংঃবহপব. ডযবহ ঢ়ড়বিৎ পড়ৎৎঁঢ়ঃং, ঢ়ড়বঃৎু পষবধহংবং. সুতরাং কবিকে রাজনীতি সচেতন হতে হয় জাতির স্বার্থে এবং বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মীর তালিকা থেকে নিজের নাম মুছে দিতে হয় সংবেদনশীল ও মানবিক গুণসম্পন্নরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কারণ, এ ছাড়া জাতি ও কবিতার মঙ্গল তাঁর জন্য কঠিন হয়ে যায়। সংবেদনশীল কবি সমাজ ও রাজনীতি সচেতন হবেন, এতে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলা কবিতার আধুনিকতার সূচনালগ্নে কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লিখে জনগণকে অধিকার বিষয়ে সচেতন করার পাশাপাশি নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দ্রোহী করে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতা পড়ে তৎকালীন শিক্ষিত দেশপ্রেমিক যুবসমাজ নিজেদের নতুনভাবে আবিষ্কার করতে শেখে। তৎকালীন রাজনীতিকরা, Ñবিশেষত সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন রায় প্রমুখ দেশ বরেণ্য রাজনীতিবিদ জনগণকে উদ্বুদ্বকরণের জন্য যথোপয্ক্তু ভাষার সন্ধান পেলেন। ফলে তাঁরা বিভিন্ন জনসভায়, বক্তৃতার মঞ্চে তাঁর প্রয়োগও ঘটিয়েছেন সফলভাবে। কবিতা ও রাজনীতির ইতিহাসের এ ঐকান্তিক ঘটনার রেশ ধরে আজকের কোনো -কোনো কবিও স্বরাটকণ্ঠে কবিতার পঙ্ক্তি উচ্চারণের পক্ষে য্ুিক্তর অবতারণা করেন। তবে সে যৌক্তিক প্রস্তাবনা নেহায়েত তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আজকের কবিতায় ভাবালুতা পরিত্যাজ্য। বুদ্ধির দীপ্তিদিপ্তী ও চিন্তার প্রাখর্যই কবিতায় অভিবাদনযোগ্য। ছন্দ বিষয়ে এই কবিরা দ্বিধাবিভক্ত। অলঙ্কার প্রয়োগে উপমাসহযোগে চিত্রকল্পের প্রয়োগ বেশি। কবিতাচর্চার বয়স এক দশক হলেই তার স্বকীয়তা অর্জন সম্ভব হয় না, সহজ নয় তার কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য শনাক্ত করাও। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে একটি বিশেষ স্বর ও সুর কোনো -কোনো কবির লেখায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধরা দেয়। তবে কোনো -কোনো কবি শুরুতেই আপন কণ্ঠস্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হন। সে রকম কবিও দুর্লক্ষ্য নয়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা ছোটগল্প : সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত
ছোটগল্পের বিষয় কী হবেÑ এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে, সে তর্ক মীমাংসাহীনও হতে পারে। তবে তর্ক তোলার আগে লেখক-মানস ও তার সামাজিক পটভূমিও মনে রাখতে হবে। না হলে গল্পের রস উপলব্ধির ক্ষেত্রে বিঘœ সৃষ্টি হবে; ভুল ধারণা জš§াবে লেখকের প্রতিও। গল্পের বিষয়-আশয় থেকে শুরু করে আঙ্গিকÑ প্রতিটা বিষয়ে গল্পকারকে থাকতে হয় সচেতন। বাংলাদেশের ছোটগল্প প্রসঙ্গে বলতে গেলে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো আগে বিবেচনায় নিতে হয়। সে সঙ্গে এও মনে রাখতে হয়, গল্পের সঙ্গে সামাজিক বাস্তবতার সম্পর্ক কতটা নিবিড়।
গল্পের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নির্ভর করে লেখকের অভিজ্ঞতা এবং মানসপ্রকৃতির ওপর। লেখক কেবল কল্পনার ওপর নির্ভর করে গল্প বলেন না, সমাজ থেকে আহরিত অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিন্তা ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে গল্পের কাঠামো ও বিষয় ঠিক করেন। নিজের সমাজ ও যাপিত জীবনকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে কাল্পনিক গাথা রচনা করা সৎ লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়; উচিতও নয়। কারণ,Ñ ‘ছোটগল্প ও উপন্যাস অর্থাৎ কথাশিল্প সব সময় প্রত্যক্ষভাবে জীবন-নির্ভর, তা কোনো আকাশকুসুম বা অবৃন্তক ফুল নয়, বিশেষ দেশ-কালের সঙ্গে তার সম্বন্ধ থাকেই, এমনকি প্রতীক-প্রতিমা-প্রধান গল্প-উপন্যাসেও যাকে এড়ানো অসম্ভব।’ (আবদুল মান্নান সৈয়দ : ভূমিকা, বাংলাদেশের নির্বাচিত ছোটগল্প, তৃতীয় খ-, বিশ্বাসাহিত্য কেন্দ্র, জুলাই ১৯৮৯)। যেকোনো শিল্পীর নিজের অঞ্চলেই সিদ্ধি। অন্যত্র কেবল কল্পনা ও অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয় তাঁকে। ফলে লেখককে সৎ থাকতে গেলে, যথাযথ জীবনচিত্র আঁকতে গেলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার অধিকারী হতে হয়। লেখকের সামাজিক দায় রয়েছে। সে দায় থেকে যাঁরা লেখেন তাঁদের গল্পে সমাজের ছাপ থাকে নিশ্চিত। মনে রাখা ভালো,Ñ ছোটগল্প কেবল লেখকের কল্পনা-প্রসূত কাহিনিীর ঘনঘটা নয়।
ভিন্ন ধরনের গল্পও রয়েছে। সেসব গল্পে মনভোলানো কথার ফুলঝুরি ছাড়াও নতুন চিন্তার বীজও লুকিয়ে থাকে। ফলে এ ধরনের গল্প পাঠ শেষে পাঠকের চিন্তার ভরকেন্দ্রে আমূল পরিবর্তনের ঢেউ জাগে। কোনো কোনো ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কের জটখোলার চেষ্টা পাঠকের থাকে। সময়ের ব্যবধানে একই গল্পের তখন ভিন্ন ভিন্ন পাঠ ও ব্যাখ্যাও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ফলে এসব গল্পে কাহিনিীর চেয়ে, কাহিনিীর সূত্র, চরিত্রের আচরণের চেয়ে অবদমন প্রধান ভূমিকা পালন করে। গল্পকার যখন কোনো গল্পের বিষয়কে চরিত্রের আচরণ ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলেন, তখন পাঠক স্বাধীনভাবে চরিত্র নির্বাচনের সুযোগ পান। ব্যাপারটা অনেকটা চিত্রকলার মতোই। ছবি যেমন নিজে কথা বলে না, দর্শককে দিয়ে বলিয়ে নেয়, তেমনি এসব গল্পের চরিত্রগুলো নিজে কথা না বললেও পাঠক সে সব চরিত্রের ভেতর নিজেকে খুঁজে পায়। এ ধরনের গল্পে পাঠকের অনুধ্যান আর চরিত্রের নৈপুণ্য ঐকান্তিক হয়ে ওঠে। গল্পের ভেতর বুদ্ধির মুক্তি ঘটে। লেখকের স্বভাবই তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের আচরণে প্রকাশ পায়। সঙ্গত কারণে লেখক চরিত্র সৃষ্টির সময় কোনো একটি বিশেষ চরিত্রের প্রতি পক্ষপাত দেখান না।
বাংলাদেশের কৃষি-ব্যবস্থা অনেকটাই প্রকৃতির খামখেয়ালিীপনার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির লীলার কাছে আত্ম-সমর্পিত জনপদে বিশ্বাসের খুঁটিটা খুবই ভঙ্গুর ও ক্রমবিবর্তনশীল। যে মানুষ নিজের হঠাৎ সাফল্যে বৈজ্ঞানিক যুক্তিকে বড় করে দেখানোর সুযোগ হাত ছাড়া করতে চান না; সে মানুষই প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে গোপনে ও প্রকাশ্যে অলৌকিকতায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং সর্বশক্তিমানের কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ফলে এখানকার মানুষের বিশ্বাসের ভূ-ম-লকে আচ্ছন্ন করে রাখে অনেকটা দ্বান্দ্বিক পরিবেশ ও প্রকৃতির নানা রঙ্গলীলা। আমাদের প্রগতিশীল সাহিত্যিক মাত্রই বিজ্ঞানমনস্ক বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন, কিন্তু গোপনে লালন করেন অসংখ্য কুসংস্কার ও অপবিশ্বাসের নানা রূপ। সে বিষয়টি গল্পে অনুল্লিখিত থাকে বলেই গল্প বিশ্বস্ততার পথে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের গল্পের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়Ñ মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের গল্পপাঠের সময় কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। বৈশিষ্ট্যগুলো হলোÑ
১. মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা এবং যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ
২. বিভিন্ন স্তরের জনগোষ্ঠীর জীবন-যাপনের চিত্র আঁকার চেষ্টা
৩. বিদেশি গল্পের অনুকরণ
৪. নিছক কাহিনিী বর্ণনার মাধ্যমে একরৈখিক গল্প বলার চেষ্টা
৫. জটিল ডিটেইলের বর্ণনায় আচ্ছন্ন থাকা
৬. ব্যক্তির বহিরাঙ্গের চেয়ে অন্তর্জগৎত চিত্রায়ণেনর চেষ্টা
৭. সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন
৮. ধর্মীয় বিষয়ে উদাসীনতা এবং যৌনতার প্রশ্নে দ্বিধাহীন
৯. দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতাবোধ
১০. বিজ্ঞানমনস্কতা
১১. জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রীতি
১২. বিষয় নির্বাচনে মধ্যবিত্ত ও নিুবিত্তের প্রাধান্য
১৩. সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের জীবন-যাপন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর যাঁদের গল্পে কমবেশি রয়েছে, তাঁরা হলেন:, আতা সরকার, আবু সাইদ জুবেরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, আহমদ বশীর, ইমদাদুল হক মিলন, ইসহাক খান, জাফর তালুকদার, তাপস মজুমদার, বারেক আবদুল্লাহ, বুলবুল চৌধুরী, ভাস্কর চৌধুরী, মঈনুল আহসান সাবের, মঞ্জু সরকার, মনিরা কায়েস, মুস্তাফা পান্না, রেজোয়ান সিদ্দিকিী, সৈয়দ ইকবাল, শাহরিয়ার কবিীর, শেখর ইমতিয়াজ, সুশান্ত মজুমদার, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, হরিপদ দত্ত, হুহুমায়ূন আহমেদ, আশোক কর, ইমতিয়ার শামিম/////, ওয়াসী আহমেদ, ওয়াহিদ রেজা, কাজল শাহনেওয়াজ, জাহিদুর রহিম, ঝর্ণা রহমান, তপন বড়ুয়যা, তারেক শাহরিয়যার, দেবাশিষ ভট্টাচার্য, নাসরিন জাহান, পারভেজ হোসেন, প্রলয় দেব, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, মহীবুল আজিজ, মাখরাজ খান, মামুন হুসাইন, মুসা কামাল মিহির, শহীদুল আলম, শহীদুল জহির, সামসুল কবির, সঞ্জীব চৌধুরী, সুব্রব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সেলিম মোরশেদ, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, হামিদ কায়সার, হুমায়ুন মালিক, ইমতিয়ার শামীম, হামিদ কায়সার, হুমায়ুন মালিক,। আন্দালিব রাশদী, আবদুল আউয়াল চৌধুরী, আহমাদ কামরুল মীজান, ইশতিয়াক আলম, জাহিদ নেওয়াজ, মনীষ রায়, মনি হায়দার, মাহবুব রেজা, মোস্তফা হোসেইন, মুজতাহিদ ফারুকী, রাশেদ উন নবী, শরীফ খান, শহীদ খান, শাহ নিসতার জাহান, স্বপ্না রেজা, সারওয়ার-উল-ইসলাম, সিরাজুল ইমলাম মুনির, হাসান জাহিদ, নাজিব ওয়াদুদ, নাসিমা সুলতানা, রফিকুর রশিদ, অদিতি ফাল্গুনী, আকমল হোসেন নিপু, আকিমুন রহমান, আদিত্য কবির, আনোয়ার শাহাদাত, আবু জাফর রাজীব, আহমাদ মোস্তফা কামাল, আহসান ইকবাল, কামরুল হুদা পথিক, খোকন কায়সার, চঞ্চল আশরাফ, জহির হাসান, জাকির তালুকদার, জামশেদ বাবু, জিয়া হাশান, জিয়াউদ্দিন শিহাব, নজরুল কবীর, নাসিমা সেলিম, নাফিজ আশরাফ, পাপড়ি রহমান, প্রশান্ত মৃমৃধা, ফয়জুল ইসলাম, ব্রাত্য রাইসু, মশিউল আলম, মামুন সিদ্দিকিী, মাসুদুল হক, মাসুমুল আলম, মাহবুব মোর্শেদ, মোহাম্মদ হোসেন, মির্জা তাহের জামিল, শামীম কবীর, শাহাদুজ্জামান, শাহীন আখতার, শাহনাজ মুন্নী, শহিদুল ইসলাম, শিবব্রত বর্মনণ, শিমুল মাহমুদ, সরকার আশরাফ, সরকার মাসুদ, সাদ কামালী, সালাম সালেহউদ্দিন, সুমন লাহিড়ী, সেলিম মোজাহার, ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, রনি আহম্মেদ, রবিউল করিম, রাজা সহিদুল আসলাম, রোকন রহমান, রাজীব নূর, রাখাল রাহা, রায়হান রাইন প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যাঁরা গল্প লেখা শুরু করেছেন, তাঁদের লেখার এক বিপুল অংশÑ মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের পরে এ ধরনের গল্পের প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল জাতিকে, পাঠককে জাগিয়ে তোলার, ভবিষ্যৎ প্রজš§কে যুদ্ধের ভয়াবহতা ওএবং দাসত্ব থেকে মুক্তির চেতনায় উজ্জীবিত করার ইতিহাস জানানোর। সে দায় থেকে লেখকেরা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছোটগল্প লিখেছেন। কিন্তু তারও একটা সীমা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জন্য বিপুল গৌরবের বিষয়। সে গৌরবজনক অধ্যায়কে সারাক্ষণ মস্তিষ্কের কোষে কোষে সঞ্চরণশীল রাখলে মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা বা মাহাত্ম্য বিন্দু মাত্র বাড়ে না;। বরং দুর্বল গাঁথুনির গল্প কিংবা রগড় কাহিনি সর্বস্ব গল্পে পর্যবসিত হলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনাকে অসম্মান করা হয়। এর কারণÑ‘একাত্তরের কথা লিখতেই হবে, নইলে আমার মান থাকবে না লেখক হিসেবেÑএরচেয়ে আত্মঘাতী কথা আর কিছু হতে পারে একজন সৃষ্টিশীল লেখকের পক্ষে।’ (গল্পের বিষয় হিসেবে একাত্তর : সৈয়দ শামসুল হক)। একাত্তর বা একাত্তর- পরবর্তীকালের বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকা-ে একাত্তর বিষয়ক লিখিত গল্পের সংখ্যা কম নয়। অগ্রজ লেখকদের পাশাপাশি ওই সময়ে আবির্ভূত লেখকেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন। এর মধ্যে হুহূমায়ূন আহমেদের ‘উনিশ শ একাত্তর’, মঞ্জু সরকারের ‘শরণার্থী ও বেহাল নৌকা’, ‘অপারেশন জয় বাংলা’, ‘রাজাকারের ভূত’, ‘মশিউল আলমের ‘অযোদ্ধা’, ‘শিহাব সরকারের ‘কুয়াশার কাল’, মঈনুল আহসান সাবেরের ‘কবেজ লেঠেল’ ও ‘রেলে স্টেশনে শোনা গল্প’, নাজিব ওয়াদুদের ‘ মেঘভাঙা রোদ’, মনিরা কায়েসের ‘জলডুবি গাঁও’ উল্লেখযোগ্য।
গ্রামীণ জীবন চিত্রায়ণেনর ক্ষেত্রে আতা সরকার, আবু সাইদ জুবেরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, সুশান্ত মজুমদার, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, হরিপদ দত্ত, হুহুমায়ূন আহমেদ, আশোক কর, ইমতিয়ার শামিম, মহীবুল আজিজ, হুমায়ুন মালিক, ইমতিয়ার শামীম, হামিদ কায়সার, আন্দালিব রাশদী, নাজিব ওয়াদুদ, নাসিমা সুলতানা, রফিকুর রশিদ, নাসরিন জাহান, আকমল হোসেন নিপু, আকিমুন রহমান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, আহসান ইকবাল, খোকন কায়সার, পাপড়ি রহমান, প্রশান্ত মৃধা, মশিউল আলম, শাহনাজ মুন্নী, শহিদুল ইসলাম, শিমুল মাহমুদ, সাদ কামালী, সালাম সালেহউদ্দিন প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তাঁদের গল্পে গ্রামীণ জীবন অবিকৃত ও অবিকলভাবে চিত্রায়িত। সেখানে বাহুল্য নেই। গ্রামীণন জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতসহ নিম্নবর্গের মানুষের আনন্দবেদনার দিনলিপি তাঁদের গল্প। এই লেখকেরা বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার প্রতি অনীহ। কেউ কেউ গল্প বলার প্রথাসিদ্ধ রীতি এড়িয়ে চলারও চেষ্টা করেছেন। প্রথাগত রীতিকে মান্য করে ব্যক্তিবিশেষের মনোবিকার ও বিকৃত যৌনবিকারের চিত্র এঁকে গল্পকে সীমিত পাঠকের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন দু-একজন। নাসরিন জাহানের গল্পে অস্তিত্ববাদী চেতনা, মনোবিকলন, ভয় ও উৎকণ্ঠা প্রকাশিত। ‘দাহ’, ‘নিশাচর’, ‘কুকুর’, ল্যাম্পপোস্টের নিচে’ প্রভৃতি গল্পে এসব প্রবণতা লক্ষণীয়। গ্রামীণ জনপদের আর্থিক নিরালম্ব শিক্ষিত যুবকের জৈবিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণের কৌশলের চিত্র আঁকেন মহীবুল আজিজ ‘মাছের মা’ গল্পে। এ গল্পে লেখক দরিদ্র বেকার যুবকের যৌন ক্ষুধা মেটানোর কৌশলকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণের জন্য মানসিকভাবে বিভ্রান্ত করে সাঁতার শেখার জন্য প্রস্তুত করে গৃহশিক্ষক। সাঁতার শিখতে গেলে মাছের ঘাত-প্রতিঘাত পাওয়ার মতো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছেÑ এই বিশ্বাস চারিয়ে দেয় ছাত্রীর মনে। ফলে জলের নিচে শিক্ষকের কলাকৌশলকে শিশুছাত্রীর মনে মাছের কর্মকা- হিসেবে ছায়াপাত করে।
নাজিব ওয়াদুদের গল্পের নাম ‘কাক ও কারফিউ’, ‘নষ্টকাল অথবা হƒদয়ের অসুখ’। নামকরণেই স্পষ্ট তিনি সমকালীন সমাজব্যবস্থা দেখে শংকিত ও সমাজ পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তার গল্পে সংলাপ যেমন বিশ্বস্ততার বহন করে, তেমনি পটভূমিও বাস্তবতাকে প্রমাণ করে। তাঁর চরিত্র নির্র্মাণে কোনো কৃত্রিমতা নেই। সাধারণ চিরাচরিত চরিত্রগুলোই তাঁর গল্পে কথা বলে। তাঁর ‘আবাদ’ গল্পটি বাংলাসাহিত্যের জীবনঘনিষ্ঠষ্ট যেে কোনো শ্রেষ্ঠ গল্পের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। এ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, কী করে নানা মতের মানুষের মধ্যেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয়। আবার অজান্তেই সে সম্পর্কের সূত্র ধরে সমকালের বিবদমান পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। এখানে ফসলিী জমি ও নারীকে একই অর্থে বিবেচনা করা হয়েছে। নারী ও জমি প্রকৃতির নিয়মেই সৃজনশীল অনুষঙ্গÑ এ সত্য নাজিব ওয়াদুদ প্রতীকী অর্থেই পাঠককে বোঝাতে চেয়েছেন। রফিকুর রশিদও গ্রামীণন জীবনের বিবদমান পরিস্থিতিকে গল্পের বিষয় করে তুলতে জানেন। তাঁর গল্পে কিছু অসঙ্গতি বাদ দিলে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কথা বলে কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে চাকরিীজীবী পর্যন্ত তাঁর গল্পে কথা বলে। মনিরা কায়েসের মতো তিনিও সাধারণ পাঠকের গল্পকার নন। অথচ এ সময়ের গল্পকার জীবন পাঠ না করে গ্রামীণ কি শহুরে জীবনের যে বানানো গল্প পাঠককে শোনাতে চান, তাতে পাঠক তাতে রূপকথার কল্প শোনার মতোই মুগ্ধ হয় সত্য, মোহ কেটে গেলে নিজেরাই চমকে ওঠে, গল্পের আজগুবি বয়ান পুনঃস্মরণ করে।
আধুনিক যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ধর্মÑ গতি। গতির ছায়া চিত্রকলা, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের অঙ্গনেও লেগেছে। গল্পের সঙ্গে চিত্রকলার সম্পর্ক অনেকটাই দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব-মধুর সম্পর্ক। চিত্রকলার রেখা ও রঙের প্রয়োগের মতোই ছোটগল্পে জীবনের নানা দিক লেখক অংকন করেন। কবি ও চিত্রকরকে ভোগবাদী সমাজে সমাজ-বিচ্ছিন্ন-উন্নাসিক, বাউল ভাবলেও গল্পকারের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটে না। কবি ও চিত্রকর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। সাধারণ মানুষ কবি ও চিত্রকরের সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন, সেখানে তাঁরা যতটা সংবেদনশীল, ঠিক ততটা বৈদগ্ধ্যের অধিকারী নন। কিন্তু গল্পকারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা পোষণ করেন। কারণ, গল্পকার সমাজ ও সমাজের রুচি পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে তাঁর গল্প রচনায় ব্যাপ্ত হন। গল্পকার মানব জাতির প্রাত্যহিক জীবনের নানা তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা পরম্পরাকে অস্বীকার না করে, মানবেতর জীবন-যাপন থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার মিথস্ক্রিয়ায় সমাজ পরিবর্তনের জন্য ইঈঙ্গিতপূর্ণ সাহিত্য রচনা করেন। সে সৃষ্টিকর্ম আপামর জনতাকে আলোড়িত করে না; দু’একজনকে আন্দোলিত করে মাত্র। সে দু’একজনই সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে ব্রতী হনÑ শিল্পের অন্তঃশীল প্রেরণায়। গল্পের মৌল ধর্ম হলোÑ সংবেদনশীল মানুষের মনে সংরাগ সৃষ্টি করে সংবেদনশীলতাকে প্রণোদিত করা। প্রথাগত ধারণার বিপরীতে নতুন উপলব্ধি কিংবা চিন্তার কিংবা বৈচিত্র্যপূর্ণ সৌন্দর্যে চেতনার শিল্পিত প্রকাশ সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রায় কোনো নির্দিষ্ট কালখ-ের একাধিক গল্পকারের গল্পের স্বর, কাহিনিী এবং শৈলী অভিন্ন হয়ে যেতে পারে। তবুও সে অভিন্ন স্বরের সম্মিলিত উচ্চারণ কোরাসে পর্যবসিশত হয়ে যায়। কোন ব্যতিক্রম সুর স্বতন্ত্র হয়ে বেজে ওউঠে না। বেজে না ওউঠার জন্য দায়ী ওইঐ বিশেষ কালখ-ের লেখকগোষ্ঠীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধহীন- নির্বিশেষ ভাষাভঙ্গি ও অভিন্ন চেতনার উপলব্ধিজাত বিশ্বাস ও ধারণার অভিন্নকরণ প্রক্রিয়া। অগ্রজ ও সমকালীন অপরাপর গল্পকারের ভাষাশৈলী ও লব্ধ ধারণা থেকে ভিন্নতর শৈলী ও ধারণায় উপনীত হতে না পারলে কেবল গল্প বলার কান্তিহীন অভ্যাস মানব মনের অদম্য আকাক্সক্ষাকে পরিতৃপ্ত করা যায় না। তার জন্য চাইÑযৌক্তিক ঘটনা পরম্পরার বিশ্বাসযোগ্য পটভূমি নির্র্মাণে। যে চরিত্র বাস্তব জগতের কোনো অঞ্চল কিংবা পরিবেশে নেই, কেবল নিজের অজ্ঞতাকে ঢেকে রাখার জন্য বিমূর্ততার অজুহাতে প্রগলভতার চর্চাকে প্রশ্রয় দিলে গল্পকার তাঁর অনভিজ্ঞতার কালো দাগ গল্পের শরীরে আঁকার ব্যর্থ আস্ফালনই প্রমাণ করতে পারবেন মাত্র; তাতে গল্প পাঠকের মনে স্থায়ী কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। আলাদা স্বর নির্র্মাণের নামে গল্পের রীতিসিদ্ধ শৈলীকে অস্বীকার করে গল্পহীন গল্প বলার ব্যর্থ কসরতৎ করেন, নয় রূপকথার যুগের যুক্তিহীন ভাবালুতাসর্বস্ব কাহিনিী বয়ানের চেষ্টা করেন মাত্র।
যে সমাজ ব্যবস্থা ও জনপদ এবং শ্রেণীর মানুষের সম্পর্কে বিন্দু-বিসর্গ ধারণা লেখকের নেই, সে সমাজ ও মানবগোষ্ঠীর জীবনাচার নিয়ে গল্প বলার ব্যর্থ চেষ্টা না করাই উচিত। ছোটগল্প লেখকেরা গ্রামীণ জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে অনেকটা শেসৗখিন পর্যটকের কৌতূহলী চোখে দূরবীনেণর অস্পষ্ট আলোয় দেখা তাকেই///////// গল্পে রূপান্তরের চেষ্টা করেন। আবার নাগরিক জীবনকে দেখেন কল্পিত যান্ত্রিক ও দ্রুতগতি সম্পন্ন হƒদয়হীন অসভ্য শিক্ষিতÑ মেকি আভিজাত্যের আভরণের ভেতর। কিন্তু সুলুকসন্ধানী চোখের বিপরীতে কেবল কৌতূহলী চোখের চাপল্যে শুধু জলের উপরিভাগের তাৎক্ষণিক সৃষ্ট ফেনা আর হালকা বুদ্বুদই দৃশ্যমান হয়; তাতে জলের নিচের চোরা ঘূর্ণি আর অন্তঃশীল স্রোতের বেগ বোঝা সম্ভব হয় না। তার জন্য চাই নিশ্চিতভাবে জলের গভীরে ডুব দিয়ে অবগাহন আর ডুবুরির অন্তর্দৃষ্টি। এর ব্যতিক্রমে একজন গল্পকার ক্রমাগতভাবে কেবল আত্মপ্রতারিতই হবেন। যাপিত জীবন সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গল্পকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে বিশিষ্ট করে তুলতে পারে। তার জন্য চাইÑ লেখকের প্রগাঢ় শিল্পপবোধসম্পন্ন মন ও গভীর জীবনবোধ। সঙ্গে প্রচুচূর অভিজ্ঞতাও। এ সবের সুষম সমন্বয় এ সময়ের গল্প লেখকেরা কতটা নৈপুণ্যের সঙ্গে সাধন করতে পেরেছেন, সে প্রশ্নটাই এ মুহূর্তে সবার আগে জরুরি। এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমাদেরকে আমাদের আর্থÑ সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক পটভূমির নির্মাণ কৌশলটি নিরূপণ করা প্রয়োজন। প্রত্যেক্যে লেখক সৃষ্ট চরিত্রগুলোর ভেতর নিজের ছায়াটিই সন্তর্পণেন আঁকবেন, Ñএটাই স্বাভাবিক। আগে নারী ছিল সহিংসতার শিকার; এখন পুরুষ নারীদের বলির পাঁঁঠা। কিন্তু বিষয়টি এ সময়ের লেখকেরা এড়িয়ে যান। এর কারণ সম্ভবত দুটো। প্রথমত, প্রতিক্রিয়াশীলতার তালিকাভুক্ত হওয়ার ভয়। দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদী ও নারীবাদীদের সঙ্গে আদর্শিক সংঘর্ষ ও মতোবিরোধ এড়িয়ে চলার জন্য। ফলে এ বাস্তব ও যুক্তিনিষ্ঠ আর্থ-সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চিত্রটি এ সময়ের ছোটগল্পে অনালোকিতই থেকে গেল। বাংলা ছোটগল্পের প্রাথমিক রূপকারদের মতো এ সময়ের ছোটগল্প লেখকেরাও নারীকে করুণাপ্রার্থী করে রূপায়ণন করেছেন। নারীকে নারী আর পুরুষ পুরুষরূপের//////// ভেতরে বরাবর রূপায়ণেনর শিকার হতে হচ্ছে। এর বিপরীতে নারী-পুরুষ মানুষ পরিচয়ে গর্বিত হতে পারছে না। এ দায়ভার কার? গল্পে লেখকদের? না সমাজচিন্তকদের?
বাংলাদেশের লেখকদের কোনো কোনো গল্প পাঠে মনে হয়Ñ গল্পের উদ্দেশ্য নিছক কোনো কাহিনি বর্ণনা মাত্র। যে কাহিনি গ্রামের কোনো প্রখর স্মৃতিধর প্রবীণের মুখেও শোনা যায়। এর জন্য দীক্ষিত মানুষের সযতœ প্রয়াসের প্রয়োজন হয় না। এসব গল্পের বিষয় মানুষের দৃষ্টিগ্রাহ্য আচরণের পরম্পরা। কখনো কখনো আকস্মিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে নির্বাচিত ঘটনাও এসব গল্পের কাঠামো তৈরিতে ভূমিকা রাখে। যেমন হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মনি হায়দার, সিরাজুল ইসলাম মুনির প্রমুখ। তবে হুমায়ূন আহমেদ নিছক গল্প বললেও সেখানে কাহিনির সঙ্গে একটি মানবিক সূত্রও থাকে। বিষয় আহরিত হয় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা থেকেই। কোনো কাল্পনিক জগতের রূপকথা নয় তাঁর গল্প। হুমায়ূন আহমেদ গল্পে জীবনকে চিত্রায়িত করেন। ফুটিয়ে তোলেন সমাজ-রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বহিরাঙ্গ ও অন্তর্লোকের বিষয়-আশয়। তবে সমাজের বহিরাঙ্গ চিত্রায়ণেনর চেয়ে ব্যক্তির মনোবিকলন অংকনে তাঁর আগ্রহ বেশি। (হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প : জটিল জীবনের সহজ গাথা : মোহাম্মদ নূরুল হক)। এবং তাঁর গল্পে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবন ও ভাষা অবিকৃতভাবেই গৃহীত।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিত হতে হয়েছে। তাদের জীবন-যাপন, সংস্কৃতি-নির্ভর গল্প যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে মনিরা কায়েস, প্রশান্ত মৃধা ও রাজীব নূরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাজীব নূরের ‘বাংলার মুখ’ গল্পে সংখ্যালঘুদের জীবনচিত্র এবং তাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র রয়েছে। এই লেখকদের গল্পে সংখ্যালঘুদের সামাজিক চিত্রই যে কেবল রয়েছে, তা নয়। তাদেরে প্রতি আন্তরিকতাও প্রকাশ পেয়েছে। সমকালীন প্রেক্ষাপট যাঁরা তুলে এনেছেন, তাঁদের অগ্রগণ্য হলেন, নাজিব ওয়াদুদ, আতা সরকার, আকমল হোসেন নিপু, আহমাদ মোস্তফা কামাল প্রমুখ। আহমাদ মোস্তফা কামালের ‘বিজ্ঞান ও মানুষে///// গল্প’ আকমল হোসেন নিপুর ‘আমরা খুব খারাপ সময়ে বেঁছে আছি’ গল্পে সমকালীন সমাজচিত্র ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে।
এ সময়ের গল্পে নারী-পুপূরুষের প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-বেদনা, সুখ-দুঃখের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নৈরাশ্যবোধকে অনিবার্য করে তোলার পাশাপাশি নিরালম্ব শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীর জন্য ছিনতাই, সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে পেশা হিসেশবে অনিবার্য করে তোলা হয়েছে। এদের গল্পে পাঠক কেবল সমাজের কদর্য রূপটিই প্রত্যক্ষ করবেন; আদর্শগত কল্যাণময় দিকটি পাঠকের মনে অনালোকিতই থেকে যাবে। অনেকাংশে, বস্তুতপক্ষে সকল ছোটগল্পকারের ক্ষেত্রে সত্য যে, এঁদের অভিজ্ঞতা যতটা না অর্জিত, তারও বেশি আরোপিত আর ধার করা। তাঁরা যখন গ্রামের গল্প রচনা করেন, তখন কেবল গ্রামের কদর্য রূপ আর গ্রাম্যতাই দেখেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মানুষের জীবন যাত্রায় সে পরিবর্তনের হাওয়া গ্রামের মাঠে মাঠে নুয়ে পড়া অশীতিপর বৃদ্ধ কৃষক থেকে শুরু করে স্কুলগামী শিশু- কিশোরদের মনেও যে লাগতে পারে, সে খবর বোধ হয় আমাদের লেখকেরা রাখেন না। যে টুকু সংবাদ তাঁরা জানেন তার প্রায় ষোলোআনাই খবরের কাগজের মফঃস্বল পাতা ও গ্রামগঞ্জের খুন, ধর্ষণ, ভূমিগ্রাসের সাংবাদিক প্রতিবেদন মাত্র। ফলে তাঁরা জানতেই পারেন না, গ্রামের মানুষ শহরের তথাকথিত শিক্ষিত-Ñঅভিজাত শ্রেণীর চেয়েও অনেক সভ্য; প্রজ্ঞা ও মনণীষা নিয়েও যে গ্রামীণ শিক্ষিত যুবক গ্রামের আলোÑ হাওয়ায় জীবন যাপন করেই বিশুদ্ধ বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। গ্রামীণ মানুষের জীবনের এই বাস্তবতা, তাঁদের রাজনীতি শ্লিষ্ট জীবনযাপন, নাগরিক জীবনের আদর্শহীন সমাজকাঠামোর বিপরীতে স্বচ্ছন্দ্য, সে বিষয়টি এ সময়ের গল্পে প্রায় অনুপস্থিত। এ ছাড়া এ সময়ের গল্পে প্রায় সস্তা প্রেমের খিস্তিখেউর আর অনৈতিক সম্পর্কের সুড়সুড়ি সর্বস্ব কাহিনিীর সমাবেশ দেখা যায়। তাদের গল্পপাঠে আমাদের বাংলাদেশকে পাওয়া যায় না। এদের গল্পে আলু পটোল চাষের যে বানানো পটভূমি নির্মিত হয়, সে পটভূমি ল্যাটিন আমেরিকার কোনো অচেনা গ্রাম; যা আমাদের গল্পকারেরা বিশ্বসাহিত্য পাঠে জানতে পেরেছেন। আর শহরের যে চিত্র তা তাঁরা অঙ্কন করেন তাঁদের গল্পে, সে সব শহরের সমকামিতা ও অবাধ যৌনাচারের যে বর্ণনা থাকে, তাতে মনে হয় ফ্রান্স কিংবা আমেরিকার কোনো খোলা উদ্যান আর নাইট কাব- অধুধ্যূষিত কোনো মহানগরের ভেতর দিয়ে পাঠক হেঁটে যাচ্ছে। তাঁদের গল্পের সৃষ্ট চরিত্রগুলো প্রায় কথা বলেÑ অশুদ্ধ বাংলা আর অশুদ্ধ ইংরেজির মিশেলে।
শুভবাদী দর্শনের স্থানে ব্যাপক নৈরাশ্য আর সহিংসতার ছড়াছড়ি দেখে মনে হতে পারে, বাংলাদেশে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক, মঙ্গালাকাক্সক্ষী মানুষ নেই। এ সব গল্পের নায়কদের প্রায় অতিমানবিক গুণ সম্পন্ন আর খল নায়কদের প্রায় অ-মানবিক বৈশিষ্ট্য ছাড়া কোনো ব্যতিক্রম খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রায় গল্পে দেখা যায়, গ্রামীণ জনপদের ভূস্বামীরা ভূমিগ্রাসী আর নারীে লোলুপ। তাদের আকাক্সক্ষা আর লালসা চরিতার্থ করার জন্য দারিদ্র্য পীড়িত নায়ককে হামলা-মামলায় জড়িয়ে কিংবা বিভিন্ন রকম সালিসশ দরবারের প্রহসন সৃষ্টি করে ভিটেমাটি ছাড়া করার বানোয়াট কাহিনিই বার বার ঘুরেফিরে আসে। নায়করা প্রায় উদ্বাস্তু আর উš§ূš§ুল জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। তারা কেবল স্বপ্ন দেখে; মজুরি খাটে, ন্যায্য অধিকার পায় না। তারা কঙ্কালসার আর অস্থিমজ্জাহীন। দেখে শুনে মনে হয় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার আলো আদৌ পৌঁছোয়নি। এ বৃত্ত ভেঙে নতুন চিন্তা ও চেতনার আলোয় গল্পকে প্রায় পণের্না কাহিনির জগদ্দল পাথর থেকে মুক্ত করা জরুরি।
যাঁরা পরাধীন দেশে ঔপনিবেশিক মানসিকতা নিয়ে গল্প লিখতে এসে, নায়ককে মহৎ আর আত্মদানকারী বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অশিক্ষিত, গ্রাম্য আর দুর্বল ক্ষীণ স্বাস্থ্যের করে সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের দেখানো পথ ধরে স্বাধীন ভূ-খ-ে যাঁরা গল্প লিখতে শুরু করেছেন, তাঁদের মধ্যেও জীবন সংগ্রামের গল্প লেখার ছলে এসব উদ্বাস্তু জীবনের উš§ূল মানুষের প্রতি করুণা মিশ্রিত বানানো কাহিনি বলার প্রবণতা শোচনীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছে। তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় নাÑ ‘আমাদের অর্জন খুব সামান্য নয়। জীবন ও পৃথিবীর চেনা-অচেনা কোণে আমাদের লেখকরা ক্রমাগত আলো ফেলেছেন এবং ফেলছেনÑ এ কাজটি কেন গুরুত্বপূর্ণ হবে না? আমার মনে হয় আমাদের পুরো গল্প নিয়ে গর্ব করতে পারি আমরা।’ (বাংলাদেশের ছোটগল্প : উত্তরাধিকারে////// পরিপ্রেক্ষিত: আহমাদ মোস্তফা কামাল)। সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের আলোকে অনেকের গল্পই পাঠযোগ্য। কিন্তু শিল্প ও সমাজ এবং সাধনার সমন্বয়ে যাঁরা সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও চিত্রকে শিল্প করে তুলেছেন, তাঁরা হলেন:, আতা সরকার, মঈনুল আহসান সাবের, মঞ্জু সরকার, নাজিব ওয়াদুদ, মনিরা কায়েস, রফিকুর রশিদ, নাসরিন জাহান, আকমল হোসেন নিপু, আহমাদ মোস্তফা কামাল, শাহনাজ মুন্নী, রাজীব নূর, রাখাল রাহা, প্রশান্ত মৃধা প্রমুখ। তবে এই লেখকদের সবাই শিল্পমানে সমানÑ এমন দাবি করা যাবে না। তবে এখানে কিছু নাম একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ কোনো কোনো লেখকের ব্যাপ্তি এত বেশি যে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায়, একাধিকবারই তাঁদের নাম উল্লেখ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
বাংলায় রহস্য সাহিত্য
রহস্য সাহিত্যের প্রতি তথা দীক্ষিত পাঠক-সমালোচকের উন্নাসিকতা থাকলেও নিবিড় পাঠকের রয়েছে তুমুল আগ্রহ। নিবিড় পাঠক যেকোনো বিষয় পাঠ করেন নীরবে, প্রতিক্রিয়া ব্যক্তও করেন নিজের কাছে। লেখকের দোষগুণ নিয়ে নিজের মনেই সমাধান খোঁজেন, পেয়েও যান। তাঁর মহত্তম সমাধান নিজ গুণে লেখকের ত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া এবং নীরবেই। আর গুণ নিয়ে প্রসঙ্গক্রমে অন্যের বোধের সঙ্গে নিজের বোধের সম্পর্ক রক্ষা করাও তাঁর স্বভাব। এই নিবিড় পাঠকই মূলত সাহিত্যের নির্বিচারী পাঠক। তাঁর লক্ষ্য নির্বাচন করে পাঠ নয়; আনন্দ লাভ। তাই দরকারিী রচনার চেয়ে রসসমৃদ্ধ সাহিত্যই তাঁর আরাধ্য। সঙ্গত কারণে এ ধরনের পাঠকের কাছে রহস্য সাহিত্য গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। ওয়েস্টার্ন, ভৌতিক ও থ্রিলারও রহস্য সাহিত্যের বিষয়। বিশ্বসাহিত্যে বোধ করি স্যার আর্থার কোনাল ডয়েলের শার্লক হোমসই আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা কাহিনি বলে স্বীকৃত ও পঠিত। রহস্য সাহিত্যের মধ্যে শুরুতেই গোয়েন্দা কাহিনির প্রসঙ্গ আসে। রহস্য কাহিনির ক্ষেত্রে কোনো গোয়েন্দার উপস্থিতি না -থাকলেও চলে। কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনির জন্য দরকার একজন গোয়েন্দা; যার কাজ, সংঘটিত ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনসহ চোর বা খুনি শনাক্তকরণ। রহস্যের্য জট যত কঠিন, গোয়েন্দার বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ও তত তীক্ষœ। রহস্য কাহিনির জট যে খোলে, সে-ই মুখ্য; কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনিতে মুখ্য অপরাধী। তাকে কেন্দ্র করেই কাহিনি আবর্তিত হয়। ফলে তার গতিবিধি ও কর্মকা-ের ওপর নজরদারি করাই গোয়েন্দার মুখ্য কাজ।
বাংলায় গোয়েন্দা কাহিনির শুরু উঊনিশ শতকের শেষ দিকে। সেই ১৮৯২ সালে। লেখক প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। ছিলেন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্য। অপরাধী, পুলিশ ও গোয়েন্দার কাজের ধরন সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। তবে প্রিয়নাথের গোয়েন্দা কাহিনিগুলো যতটা পুলিশি অনুসন্ধানের বিবরণ, ততটা সাহিত্যগুণসম্পন্ন নয়। প্রিয়নাথের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘অদ্ভুূত হত্যা’। শুরুর দিকে গোয়েন্দা সাহিত্যের এ উপন্যাসে একজন নর্তকীর খুন হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করাই কথক গোয়েন্দার মুখ্য কাজ। কিন্তু কথক যে প্রক্রিয়ায় রহস্য উদ্ঘাটন করে, সে প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই গোয়েন্দা-প্রক্রিয়া বলা যায় না। সত্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দার কাজ গোপনে ও প্রকাশ্যে তদন্ত; উকিলের কাজ আদালতে উপস্থিত সাক্ষিীকে জেরা করা। উভয়ের কাজের ধরন ভিন্ন। তবে গোয়েন্দা মাঝেমধ্যে আসামি ও সাক্ষিীকে জেরার সুবিধা নেন; উকিলের পক্ষে অপরাধীকে জেরার সুযোগ নেই। সেদিক থেকে গোয়েন্দার অনুসন্ধানী ক্ষেত্র বিস্তৃত। প্রকারান্তরে উকিলের ক্ষেত্র সীমিত। এ পর্যবেক্ষণের আলোকে বলা যায়, প্রিয়নাথের ‘অদ্ভুূত হত্যা’ উপন্যাসটি সর্বাঙ্গিীণন গোয়েন্দা সাহিত্য নয়। খুনের ঘটনাশ্লিষ্ট একটি পুলিশি মামলার স্বাভাবিক পরিণতির ধারাবিবরণী মাত্র।
গোয়েন্দা তার বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল অবলম্বন করে হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করে না,। বরং ঘটনা স্বাভাবিক গতিতেই চলে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই বের হয়ে আসে প্রকৃত হত্যাকারীর পরিচয়। সেখানে গোয়েন্দার বিশেষ কোনো ভূমিকা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না। তবে প্রথম দিকের গোয়েন্দা কাহিনি হিসেবে এ দুর্বলতা ধর্তব্য নয়। কোর্টে উকিলের তীক্ষক্ষ্ম েেজরায় যে বিষয়টি ধীরে ধীরে প্রমাণিত হয় সে বিষয়টিই প্রিয়নাথের কাহিনিতে গোয়েন্দার জেরায় প্রমাণিত। প্রকৃত গোয়েন্দার কাজ এ নয়।
প্রথম মৌলিক গোয়েন্দা সাহিত্যের স্রষ্টা সম্ভবত পাঁচকড়ি দে। পাঁচকড়ি দের ‘নীলবসনা সুন্দরী’, ‘মনোরমা’, ‘মায়াবী’, ‘হত্যাকারী কে?’ গোয়েন্দা কাহিনিগুলো সুখপাঠ্য। এই লেখক শুরুর দিকে ছিলেন উইল্কি কলিন্স ও এমিল গাবোরিয়লের অনুসারী। পরে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল থেকেও উপাদান গ্রহণ করছেন। তবে উপাদানটুকু নিয়েছেন কেবল ধারণার প্রয়োজনে। লিখেছেন বঙ্গীয় পটভূমির উপযোগী ভাষায়। পাঁচকড়ি দের সমসাময়িক লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায়। তাঁর ‘রহস্য লহরী’ও বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে রচিত। তাঁর গোয়েন্দা কাহিনিজুড়ে ছিল বিদেশের ভূগোল। চরিত্রও অনেকটা বিদেশি ধাঁচের।
পাঁচকড়ি দের গল্প ‘চিঠিচুরি’। ছোট ভাই অক্ষয়ের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করার স্বপ্ন দেখাটা মেনে নিতে পারে না দাদা বিনয় কুমার। ইতোমধ্যে বিনয় কুমারের ড্রাফট করা চিঠিটি হারিয়ে যায়। চিঠিটি উদ্ধারের দায়িত্ব পড়ে অক্ষয় কুমারের ওপর। অক্ষয় একপ্রকার বিনা তদন্তেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, চিঠিটি নিজের অজান্তেই দাদা বিনয় কুমারই হারিয়ে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত ওই চিঠির সন্ধান মেলে বিনয়ের ছেলে সুশীলের সখের ঘুড়ির লেজুড়ে। এখানে নিছক বুদ্ধির জোরেই অক্ষয় চিঠিটি উদ্ধার করে তার দাদাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করে। আধুনিক গোয়েন্দা সাহিত্যের মান বিচারে এ কাহিনিকেও সর্বার্থে সফল গোয়েন্দা কাহিনি বলা চলে না। তবে প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক গোয়েন্দা গল্পের রচয়িতা হেমেন্দ্রকুমার রায়। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দার নাম জয়ন্ত, হেমন্ত ও রবিন। বিজ্ঞানভিত্তিক হলেও গোয়েন্দা কাহিনি হিসেবে গল্পগুলো উতৎরে যেতে পারেনি।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সত্যান্বেষী’ উপন্যাসে ব্যোমকেশ প্রথম গোয়েন্দা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ব্যোমকেশ নিজের পরিচয় গোপন করে, কলকাতার চীনাবাজার///// পাড়ার মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব নেয় পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে। আর থানা পুলিশ ঘটনাচক্রে তাকেই গ্রেপ্তার করে ঠিকই, পরিচয় পেয়ে ছেড়ে দেয়। এতেই অপরাধী ডাক্তার অনুকূকুল বাবুর চোখে সে ধরা পড়ে। গোয়েন্দা হিসেবে অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয় মেসমেট অশ্বিনী বাবুর খুনের ঘটনায় জানালা///// রহস্যের বিষয় নিয়ে কথা বলে। একজন গোয়েন্দা তার আবিষ্কৃত সূত্র জনসম্মুখে এভাবে প্রকাশ করবে কেন? তবু শেষ পর্যন্ত তার বুদ্ধিমত্তার জোরেই অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয় পুলিশ।
শরদিন্দুর একটি বিখ্যাত গল্প ‘রক্তমুখী নীলা’। এ নীলা চুরির রহস্য উদ্ঘাটনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খুন ও ডাকাতির ঘটনাও। কিন্তু নীলাচুরির রহস্য উদ্ঘাটন গোয়েন্দাপদ্ধতির পরিবর্তে উকিলের জেরার ধাঁচে উদ্ঘাটিত হয়,। যা গোয়েন্দা গল্পের রস কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। এদিক বিবেচনায় এ গল্পটিও ষোলো আনা গোয়েন্দা গল্পের অভিধা পেতে পারে না।
এভাবে ব্যোমকেশ ‘পথের কাঁটা’, ‘সীমান্ত হীরা’, ‘মাকড়সার রস’, ‘চোরাবালি’, ‘অগ্নিবাণ’, ‘ব্যোমকেশ ও বরদা’, ‘আদিম রিপু’, ‘রক্তের দাগ’, ‘লোহার বিস্কুট’ গল্পে একজন শৌখিন গোয়েন্দার কর্মযজ্ঞ চিত্রায়িত করেছেন। এ গল্পে দেখানো হয়েছে, বাইরে যেসব চোরাই সোনা ভারতবর্ষে আসে, তা সংগ্রহ করা। কম মূল্যে কিনে বেশি মূল্যে বিক্রিই তার পেশা। সংগৃহিীত সোনা অক্ষয় ঘরে রাখে না, রাখে ছাদের পানির ট্যাঙ্কে। তার সহকর্মী হরিহর তাকে ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি ধরতে পারায় অক্ষয় তাকে খুন করে। বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় সে। কিন্তু যাওয়ার সময় নিজের সংগৃহিীত সব সোনা নিয়ে যেতে পারে না। তাই রাতের অন্ধকারে সোনাগুলো সরাতে চায়। কিন্তু তার এ কাজে আপাতত বাধা হয়ে দাঁড়ায় কমল। এ কমল বাবুকে বাড়ি পাহারায় দায়িত্বে বসিয়ে যায় অক্ষয়ই। কিন্তু কমল যখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন সে কমলকে বাড়ি ছাড়া করার জন্য বিভিন্ন ছলচাতুরিীর আশ্রয় নেয়। ছলচাতুরিীর বিষয়টি সন্দেহের কারণ হয় ব্যোমকেশের। তাই ব্যোমকেশ রাতের অন্ধকারে বাড়ি পাহারা দিতে গিয়েই ধরে ফেলে অক্ষয়কে। অক্ষয় ম-ল সোনার বিস্কুট বাড়ির ছাদে পানির ট্যাঙ্কে সোনার বিস্কুট রাখত। রাতের অন্ধকারে সে যখন বিস্কুট তুলতে যায় পানির ট্যাঙ্কি থেকে, তখনই ধরা পড়ে ব্যোমকেশের হাতে। এভাবে ব্যোমকেশ একটি হত্যাকা-ের সঙ্গে সঙ্গে চোরাচালানের রহস্যও উদ্ঘাটন করে। প্রকৃত গোয়েন্দার কর্মপরিধির মধ্যে পড়ে এ ধরনের কাজ। এ অর্থে সার্থক গোয়েন্দা কাহিনি ‘লোহার বিস্কুট’।
সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা গোয়েন্দা সাহিত্যের আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত চরিত্র। প্রতিটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দার পেশাদারিত্বের প্রমাণ রাখে ফেলুদা। ফলে ফেলুদা হয়ে ওঠে আধুনিক যুগের রহস্য উšে§াচনকারী একজন দক্ষ পেশাদার গোয়েন্দা। ‘গোলক ধাম রহস্য’ গল্পে ফেলুদা একজন গবেষকের গবেষণাকর্মসংক্রান্ত একটি চুরির ঘটনা তদন্ত করে। চুরির রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে উদ্ঘাটন করে রনজিতের চোরে পরিণত হওয়ার কারণ। আরও মর্মান্তিক সত্যÑ স্বয়ং অমোঘ নিয়তির শিকার বৈজ্ঞানিক নীহাররঞ্জনের জিঘাংসার কারণও। এখানে ফেলুদা কেবল প্রথাগত গোয়েন্দা নয়, তার কার্যকারণ সম্পর্কের বিশ্লেষক।
‘লন্ডনে ফেলুদা’ উপন্যাসেও দেখা যায় একটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে অন্য ঘটনারও রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। ফলে দেখা যায় মানবজীবনের ঘটনাবলিী বিচিত্র স্বভাব ও অমোঘ নিয়তি নির্ভর। অপরাধী একটি অপরাধের চিহ্ন মুছে দিতে গিয়ে অন্য একটি অপরাধের জš§ দেয়। অপরাধজগতে একটি অপরাধের সঙ্গে অন্য একটি অপরাধের সম্পর্ক অনিবার্য ও অবশ্যাম্ভাবী। শিীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রজাপতির মৃত্যু ও পুনর্জš§’ একই সঙ্গে রোম্যান্টিক ও গোয়েন্দা গল্প। দাম্পত্য কলহের জের ধরে বিচ্ছিন্ন থাকা ভজন বাবু আর বিভাবরি সম্পর্কের পুনর্জš§ই এ গল্পের প্রতিপাদ্য। একটি খুনের মামলার সূত্র ধরেই পরস্পরের মধ্যকার দূরত্ব ঘুছে যায়। শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা শবরের চেষ্টায় দাম্পত্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়, আর আরোপিত খুনের দায় থেকে মুক্তি পায় ভজন।
ঘনাদা প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাড়া জাগানো গোয়েন্দা চরিত্র হলেও পরাশর বর্মাও নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। ‘গোয়েন্দা হল পরাশর বর্মা’ গল্পে দেখানো হয়েছে নিছক সম্পত্তির লোভেও মানুষ মানবিক সম্পর্ককেও অস্বীকার করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই সব চেষ্টা চাতুর্য হিসেবেই পরিগণিত হয় এবং প্রকাশ পেয়ে যায় সব ছল। এ ছাড়া গোয়েন্দাবৃত্তির সঙ্গে মানবিক সম্পর্কও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সে বিষয়টিও এখানে স্পষ্ট। কেবল পেশাদারিত্ব আর সামাজিক শিষ্টাচারই জীবন নয়, সেখানে মানুষের বিচিত্র চাওয়া-পাওয়াও রয়েছে। রয়েছে এসব চাওয়া-পাওয়ার যৌক্তিক ব্যাখ্যাও।
আরও উল্লেলখযোগ্য গোয়েন্দা কাহিনি হলো, অখিল নিয়োগীর ‘তিব্বত ফেরত তান্ত্রিক’, অজিতকুমার পুততু-র- ‘গোয়েন্দা কৌস্তভ’, অদ্রীশ বর্ধনের ‘গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ’, অনীশ দেবের ‘তীর বিদ্ধ’, অভ্র রায়ের ‘গোয়েন্দা বৈজ্ঞানিক ’ অরুণকুমার দত্তের ‘সেরা রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা কাহিনী’, অশোককুমার মিত্রের ‘সবাই যখন অন্ধকারে’, অসীম চট্টোপাধ্যায়ের ‘গোয়েন্দা গোরাদা’, আবীর গুপ্তের ‘রাজুর গোয়েন্দাগিরি’, কালকেতুর ‘শ্রেশ্রষ্ঠ গোয়েন্দা গল্প’, খগেন্দ্রন্দ্রনাথ মিত্রের ‘পূজনীয় দস্যু’ গজেন্দ্রন্দ্রকুমার মিত্রের ‘রেশমী ফাঁঁস’, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গোয়েন্দা গার্গী’, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘রবার্ট বেক রহস্য অমনিবাস’, নারায়ণ সান্যালের ‘কাঁটায় কাঁটায়’, নীহাররঞ্জন, গুপ্তের ‘ইস্কাবনের টেক্কা’, ‘কিরীটিী অমনিবাস’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘পরাশর সমগ্র’, ‘গোয়েন্দা পরাশর বর্মা’, বুদ্ধদেব বসুর ‘ছায়া কালো কালো’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘নীলু হাজরার হত্যা রহস্য’, শেখর বসুর ‘রহস্যের জাল’, সমরেশ মজুমদারের ‘অর্জুন সমগ্র’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবুর অভিযান’, ‘কাকাবাবু সমগ্র’, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘গোয়েন্দা আর গোয়েন্দা’, রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা সমগ্র উল্লেলখযোগ্য গোয়েন্দা কাহিনি।
আর বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের উল্লেলখযোগ্য চরিত্রগুলো হলোÑ অজিতকুমার পুততু-র কৌস্তভ, অদ্রীশ বর্ধনের ইন্দ্রনাথ রুদ্র, অনীশ দেবের এ.সি.জি, অসীম চট্টোপাধ্যায়ের গোরাদা, কৃষাণু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসব, গৌতম রায়ের নীল ব্যানার্জী, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গার্গী, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রবার্ট বেক, ধীরেন্দ্রলাল ধরের গোবিন্দ, নলিনী দাসের গো-ালু, নারায়ণ সান্যালের পি.কে.বাসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাদুড়ীমশাই, নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটিী রায়, প্রণব রায়, প্রভাবতী দেবীর কৃষ্ণা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরাশর বর্মা, পাঁঁচকড়ি দের দেবেন্দ্রবিজয় ও অরিন্দম, বিমল করের কিকিরা, বুদ্ধদেব বসুর চঞ্চল, মানবেন্দ্র পালের বাপ্পা, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের হুকাকাশি, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী, শিবরাম চক্রবর্তীর কল্কেকাশি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বরদাচরণ, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পা-ব গোয়েন্দা, বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু ও বিচ্ছু, সত্যজিৎ রায়ের ফেলু দা, সমরেশ বসুর গোগোল, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, সুজন দাশগুপ্তের একেনবাবু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল নিীলাদ্রিী সরকার, স্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জি, হিমানীশ গোস্বামীর গর্জন, হেমেন্দ্র কুমার রায়ের জয়ন্ত, মানিক ও ইনস্পেক্টর সুন্দরবাবু এবং হেমন্ত, রবিন ও ইন্সপেক্টর সতীশবাবু। রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দার কিশোরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গোয়েন্দা কাহিনির প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলেন। ফলে লিখেছিলেন একটি পারিবারিক প্রেমের গল্প ‘ডিটেকটিভ’। ডিটেকটিভ নামটাই সার; ভেতরে ভিন্ন প্রসঙ্গÑ গল্পটি দাম্পত্যকলহ জড়িয়ে পারিবারিক ঘটনাবৃত্তান্ত মাত্র। এ গল্পকে কোনোনওভাবে ডিটেকটিভ গল্প বলা সঙ্গত নয়।
একেবারে তরুণ গোয়েন্দা কাহিনিকারদের মধ্যে মোস্তফা মামুন এবং দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের নাম উল্লেলখ করা যায়। মোস্তফা মামুনের তনু কাকা সিরিজ এবং দেবব্রতের দি হরিপদ টিম সমকালীন সমাজবাস্তবতার সঙ্গে প্রযুক্তির প্রয়োগ ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে লিখিত। কেবল বুদ্ধির ব্যায়াম নয়, মানবিক গুণ ও ব্যক্তির লোভ-লালসাও চিত্রায়িত হয়েছে এ দুটি সিরিজে। তনু কাকায় দেখা যায় কোনোনও একটি বিশেষ অঞ্চলে অনুসন্ধান চলাকালে সে অঞ্চলের ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ও বর্ণনা করা হয়। দ্য হরিপদ টিম গল্পগুলোয়ও প্রায় একই রকম চিত্রের দেখা মেলে। এ দুজন গোয়েন্দা ও অপরাধীর মনস্তত্ত্ব সম্পূর্ণ আত্মস্থ করতে পেরেছেন এমন দাবি অসঙ্গত। তবুও গল্প বুননে যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, তাতে তাদের মনস্তত্ত্ব উপলব্ধির নবিশি দৌর্বল্যটুকু সহজেই এড়িয়ে চলা যায়।
এসব গোয়েন্দা কাহিনির পাশাপাশি বাংলায় শিকার কাহিনি, রহস্য কাহিনি, থ্রিলার, ওঅয়েস্টার্ন কাহিনিরও সুপ্রচুর প্রমাণ মেলে। বাংলা ভাষায় রহস্য সাহিত্য সৃষ্টিতে কাজী আনোয়ার হোসেনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফলে এ চরিত্রে ফুটে উঠেছে বহুমাত্রিক পরিচয়,। যা একই সঙ্গে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সত্তারও পরিচায়ক। বাংলায় প্রথমেই স্পাই থ্রিলারের সূচনা করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তাঁর বিখ্যাত চরিত্র মাসুদ রানা। এ মাসুদ রানাকে কোনোনওভাবেই গোয়েন্দা বলা যায় না; বলা যায় না সম্পূর্ণ রোম্যান্টিক কোনোনও চরিত্রও। দস্যুও নয়। তবে এসবের এক সম্মিলিত রূপ ও তার চরিত্র এঁঁেকছেন এর স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। মাসুদ রানা সিরিজের মাসুদ রানা চরিত্রটি একাধারে গোয়েন্দা, দস্যুতা ও রোম্যান্টিকতারও প্রতীক।
দস্যুবৃত্তি নিয়ে একটি অমর চরিত্র বনহুর। সিরিজটির নাম দস্যু বনহুর। কেবল বাংলাদেশ নেয়, পৃথিবীর সর্বত্রই তার কর্মক্ষেত্র। এর স্রষ্টা রোমেনা আফাজ। বনহুর মূলত দসুস্যূ; কিন্তু তার কর্মকা- একজন নিখাদ প্রেমিকের। সঙ্গত কারণে বনহুর সিরিজ প্রকৃত পক্ষে রোম্যান্টিকতায় আকীর্ণ দস্যুতার কাহিনি। ‘ডাকাত নোটন সর্দার’ নীহার রঞ্জন গুপ্তের লেখা দস্যুবৃত্তির গল্প। এ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, ডাকাত জমিদার বাড়ির লাঠিয়াল নোটনের ছোট ভাই ঝোটন দস্যুদের হাতে মারা যায়। নোটন সেই থেকে নিখোঁজ। কেউ তার সন্ধান দিতে পারত না। অনেক বছর পর কাজলার বিলে গভীর রাতে এক ভয়ানক দুস্যুর আগমন ঘটে। এত নির্দয় আর ক্ষিপ্র তার হাত থেকে কেউই রক্ষা পায় না। সে নিষ্ঠুর নোটন সর্দারও অবুঝ শিশুর দাদা ডাক শুনে গলে যায় মোমের মতো। মনে পড়ে তার মৃত ভাই ঝোটনের কথা। ছেড়ে দেয় দস্যুতা। রহস্য গল্পের ধারায় দস্যুবৃত্তির কাহিনিও একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। পশ্চিমে যেমন ওয়েস্টার্ন কাহিনিতে ওয়াগন, ট্রেইল আর পিস্তল-রাইফেলের ছড়াছাড়ি, তেমনি বাংলায় দস্যুতার গল্পে মাঝি, নৌকা আর কোচ- বল্ললেমের সাক্ষাৎ মেলে প্রায়।
পচাব্দী গাজি শিকারিী হিসেবে খ্যাতিমান। তার বাঘ শিকারের কাহিনি নিয়ে লেখা ‘সুন্দরবনের মানুষে খেকো’। অবাক হওয়ার বিষয়,Ñ এ বইটি পচাব্দী গাজি নিজে লেখেননি। তাঁর কাছে শুনে শুনে অনুলিখন করেছেন সাহিত্যিক হুমায়ুন খান। আরেক জন শিকার কাহিনিকার আবদুর রহমান চৌধুরী। শিকার করেছেন ডজন খানেক বাঘ। আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন, তিনটি বই। ‘জানোয়ারের খাস মহল’, ‘শিমুলতলার নরখাদক’ও ‘মানিগার নরখাদক’। ‘শিমুলতলার নরখাদক’ বইয়ে একটি মানুষখেকো বাঘের কথা রয়েছে। বাঘটির কিছু অলৌকিক গুণের কথা রয়েছে সে বইয়ে। বিবরণ দেওয়া হয়েছে যে বাঘটি অলৌকিক শক্তির অধিকারিী ও অবধ্য বলে পরিচিত হয়েছিল।
ভাষার দিক থেকে পাঁচ কড়ি দে, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ভাষা পুলিশি প্রতিবেদন থেকে সাহিত্যিক গদ্যে উত্তরণ ঘটেনি। শুরুর দিকের কাহিনি হওয়ায় এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়াই সঙ্গত। আবার শরদিন্দুর ব্যোমকেশের ভাষা পুলিশি প্রতিবেদন, জজের রায়ের ভাষা ও সাহিত্যিক গদ্যের সংরাগে সৃষ্ট নতুন ভাষা। পুরোপুরি সাহিত্যিক গদ্য নয়; কিন্তু পুলিশি প্রতিবেদন ও আদালতের রায়ের ভাষা থেকে ভিন্নতর। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভাষা সাহিত্যিক গদ্যের; কিছুটা কাব্যিক গন্ধও লেগে আছে তাঁর গোয়েন্দা গল্পের ভাষায়। অন্যদিকে সত্যজিৎ রায়ের ভাষায় পরিপূর্ণ সাহিত্যিক গদ্যের ভাষা। এদিক থেকে সত্যজিৎ রায় যথার্থ সাহিত্যিক গোয়েন্দা গল্পের স্রষ্টা। তেমনি শিকার কাহিনির ক্ষেত্রে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের শিকার গল্পের ভাষাও ষোলোকলা পূর্ণ সাহিত্যিক গদ্য। পরবর্তীকালের কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজে যে ভাষা সৃষ্টি করেছেন, সে ভাষা যেমনি চিত্তাকর্ষক তেমনি স্নায়ু উত্তেজকও। তাঁর গল্পপাঠে পাঠক সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠিত, উদ্বেলিত আর আতঙ্কিত থাকেন। কাহিনির বর্ণনা অনেকটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রায় সিনেম্যাটিক ভাষা তাঁর মজ্জাগত। সঙ্গত কারণে কাজী আনোয়ার হোসেন পাঠকের সঙ্গে নিজের ভাবনার যোগাযোগ ঘটান অতি দ্রুত। রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুরের ভাষা গতানুগিতিক হলেও মাঝে মধ্যে ভাষার ব্যবহার এমনই আকস্মিস্কক গুণ ঋদ্ধ যে, পাঠক হঠাৎ চমকে ওঠেন। আবার হুমায়ূন আহমেদের হিমু, মিসির আলী কিংবা শুভচরিত্রকেন্দ্রিক গল্পগুলোও রহস্য সাহিত্যের অন্তর্ভুর্ভুক্ত। এসব গল্পের ভাষাও ঝরঝরে। পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে ভাষার সম্মোহক শক্তি।
ভাষা-চরিত্র সৃষ্টি ও গল্পের বুনন বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা চরিত্রগুলোর মধ্যে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ এবং সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাই মুখ্য। বাকি চরিত্রগুলো লেখকের কল্পনা ও চরিত্র সৃষ্টির কৌশলের কারণে যথার্থ গোয়েন্দা হয়ে উঠতে পারেনি। ব্যোমকেশ চরিত্র খুব সাদামাটা চরিত্র। ব্যোমকেশের বিশেষ কোনোনও বেশভূষা নেই; চালচলনও সহজ-সরল। তার চেহারায় এমন কোনোনও বৈশিষ্ট্য ফুটে ওউঠে না, যা দেখে তাকে সমাজের দশজন থেকে আলাদা করা যায়। সহজে সে উত্তেজিত হয় না। তীক্ষœবুদ্ধি ও ধীশক্তির জোরে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম ব্যোমকেশ। তাকে কেউ খোঁচা না -দিলে, কেউ জাগিয়ে না -তুললে খুব সহজে তার ভেতরে বিশেষ সত্তার পরিচয় সহজে পাওয়া যায় না। ব্যোমকেশ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আপন বুদ্ধি মত্তার চেয়ে পুলিশিস জেরার আশ্রয় গ্রহণ করতে অভ্যস্ত। অপরাধীকে সরাসরি জেরা করে মানসিকভাবে দুর্বল করে তার কাছ থেকে তথ্য আদায় করাই তার মৌল প্রবণতা। ব্যাপক অনুসন্ধান শেষে নিজের বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমের জোরে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা ব্যোমকেশে বিরল। সঙ্গত কারণে ব্যোমকেশকে স্বভাবগোয়েন্দা বলেও মনে হয়। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা এদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার গোয়েন্দা। জীবন ও জগৎত সম্পর্কে তার ধারণা সুপ্রচুর। বিপুল পাঠ তার ভূগোল-ইতিহাস ও নৃতত্ত্বেত্বও। ফলে তার পক্ষে সম্ভব ব্যাপক অনুসন্ধান শেষেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো। ফেলুদার কাজও তাই প্রমাণ করে। একেকটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করার ক্ষেত্রে ফেলুদা প্রচুর অনুসন্ধান করে, অনুসন্ধানলব্ধ ধারণার ওপর ভিত্তি করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া তার স্বভাব। এদিক থেকে ফেলুদাকে শার্লক হোমসের বঙ্গীয় সংস্করণ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
কোনোনও গোয়েন্দাই গল্প বলে না। গল্প বলে সঙ্গীয় চরিত্র; দুই গোয়েন্দার সহকারী। সহ-চরিত্র অজিত বর্ণনা করে ব্যোমকেশের গোয়েন্দাবৃত্তান্ত, তাপস বর্ণনা করে ফেলুদার। ফলে গোয়েন্দার সব গতিবিধি কথকের জানা থাকে না। কিছু প্রত্যক্ষণ, কিছু অনুমানের ওপর নির্ভর করে গল্প এগিয়ে চলে। অথচ এ কথকের আড়ালে রয়েছেন স্বয়ং কাহিনিকার। এই কাহিনিকারই প্রকারান্তরে গোয়েন্দা, অপরাধী, পুলিশ ও পার্শ্বচরিত্র। শেষ পর্যন্ত লেখকই একাধিক চরিত্রের ভেতর নিজেকে তুলে ধরেন। বাংলায় অধিকাংশ গল্প উপন্যাসই সহজ ও সরল। জট পাকানো গল্প বাঙালি পাঠকের পক্ষে বোঝা কি খুব কঠিন? বাঙালিপাঠক মাত্রই কি হালকা ও সহজ গল্প পছন্দ করেন? শরদিন্দু শুরু করেছেন অজিতের মুখে গল্প বলে, কিন্তু শেষের দিকে নিজেই কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। গোয়েন্দা কাহিনি লিখেছেন নীহাররঞ্জন গুপ্তও। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটিী। এই কিরীটিীও বিচিত্র ঘটনার রহস্য উšে§াচন করে।
ইংরেজি সাহিত্যে গোয়েন্দা গল্প আর বাংলায় গোয়েন্দা গল্পের পার্থক্য অনেক। পশ্চিমাদের সঙ্গে বাঙালির জীবনযাত্রা সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই প্রকট। সঙ্গত কারণে কোনাল ডয়েল যে প্রক্রিয়ায় শার্লক হোমস সৃষ্টি করেছেন, সে প্রক্রিয়ায় বাংলায় কোনও কানো গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। এর কারণও স্পষ্ট। পশ্চিমের জীবনযাত্রার সঙ্গে বাঙালির জীবনযাত্রা এবং রুচিবোধ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাঙালির জীবনযাত্রা অনেকটা সহজ- সরল। এখানে সংশয় কম; বিশ্বাস বেশি। সামান্য সকাতর মিনতিতে বাঙালির মন গলে। রূঢ় রূপ সে দেখায় কালেভদ্রে। চাতুর্য তার মজ্জাগত নয়; কূটচালেও সে অদক্ষ। বাঙালি খুন করলে কথাবার্তা ও আচার-আচরণেই সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রায় প্রকাশ করে। ফলে খুনি বাঙালির কৃতকর্ম উদ্ঘাটন করতে সাধারণ পুলিশ থেকে শুরু করে কোর্টের উকিল, কাউকেই গলদঘর্ম হতে হয় না। আসামি গ্রেপ্তারের পরই পুলিশি জেরার মুখেই বাঙালি খুনি দোষ স্বীকার করে বসে। তাকে কঠিন রিমান্ডের মুখোমুখি হতে হয় কখনোনও কখনোনও। রাজনৈতিক ঘটনার সূত্র ধরে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির প্রসঙ্গ ভিন্ন। সে সব স্বীকারোক্তি পরবর্তী সময় সংশ্লিশষ্টজনেরা অস্বীকারও করেন। তাই রাজনৈতিক বিবেচনায় আটক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি সন্দেহমুক্ত নয়। সাধারণের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পেশাদার খুনিও পুলিশি জেরার মুখে অপরাধ স্বীকার করে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে খুনের পাশাপাশি জাল টাকা তৈরি, প্রতারণা, গুম, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁসসহ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলেরও চেষ্টা হয় মাঝেমধ্যে। এসব ঘটনা জাতীয় জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। কিন্তু এসব ঘটনা চিত্রায়িত করতে শক্তিমান কথাশিল্পীর আবির্ভাব জরুরি। কেবল শক্তিমান কথাশিল্পী হলেই সার্থক গোয়েন্দা কাহিনি লেখা সম্ভব নয়। শিল্পশর্ত পূরণে সক্ষম কথাসাহিত্যিক মাত্রই গোয়েন্দা গল্প না-ও লিখতে পারেন। গোয়েন্দা গল্প লিখতে হলে, কেবল জীবনবোধ, শিল্পবোধ থাকলেই চলে না, সেই সঙ্গে আইনি জটিলতা, পুলিশি েেকৗশল, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, অপরাধের ধরন, অপরাধীর মনস্তত্ত্বসহ গোয়েন্দার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ ধারণা ও অভিজ্ঞতা থাকা চাই। গোয়েন্দা গল্পের লেখককে হতে হয় একাধারে মনস্তত্ত্ববিদ, আইনজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানী। না হলে গোয়েন্দা কাহিনি কেবল খুন ও চুরি-ডাকাতির সংবাদভাষ্যে পর্যবসিত হবে। সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠবে না। এর পর আসে, রহস্য গল্পের কথা। রহস্য গল্প লেখার জন্যও কেবল সাহিত্যবোধ আর জীবনবোধই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে থাকতে হয়, রসবোধ ও রসসৃষ্টির অনন্য স্বভাবও। কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা এবং রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর পাঠে সে ব্যঞ্জনাঋদ্ধ রসের সন্ধান মেলে।
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তি
অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, মনীষা, অধ্যয়ন ও কল্পনার মিথস্ক্রিয়ায় সৃজিত হয় শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। মনের বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃজনের শ্রেষ্ঠ সুযোগ কিন্তু শ্রেষ্ঠষ্ট সৃষ্টির পূর্বশর্ত শৃঙ্খলা। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসারে, মহাবিশ্বে গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টির পেছনে নক্ষত্রের বিশৃঙ্খলাই দায়ী। কোনো সুচিন্তিত প্রপক্রিয়ার ফলে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ও সংকোচন ঘটে না। সৃষ্টিশীলতার যেকোনো প্রপঞ্চের ক্ষেত্রেও ওই সূত্র আংশিক সত্য। কবি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-ভিন্ন স্বকপোলকল্পিত বিষয়কে সব সময় কবিতা করে তুলতে পারেন না। যিনি পারেন তিনি হƒদয়বৃত্তির কাছে যেমন সৎ নন, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। যে কবির অভিজ্ঞার ভা-ার বিচিত্রমুখী, অনেকান্ত ঘটনার যিনি গভীর পর্যবেক্ষক, তাঁর পক্ষে কেবল স্বকপোলকল্পিত সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব নয়। পাঠ ও যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতা যাঁকে প্রাজ্ঞ করে তুলেছে, কল্পনা যাঁকে করেছে কবি, তাঁর কবিতায় বুদ্ধির দীপ্তি এবং মনীষার ছাপ থাকবেই। ব্যক্তি তাঁর অভিজ্ঞার বাইরের গিয়ে কেবল কল্পনায় ভর করে প্রকাশ করতে পারে না। অত্যল্প পাঠের ওপর নির্ভর করে কবি কল্পনা-প্রবণ হয়ে উঠতে পারেন কিন্তু বিপুল পঠন-পাঠনে যিনি নিজেকে ঋদ্ধ করে তুলেছেন, তাঁর পক্ষে যুক্তিহীন কল্পনার স্রোতে ভেসে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁকে হতে হয় বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ক। একই সঙ্গে ইতিহাস-ভূগোল-রাজনীতি-অর্থনীতি-ধর্ম ও সমাজ সচেতনও। আধুনিক যুগের জটিল পরিস্থিতির ভেতর বসবাস করে সময়ের জটিল আবর্তন শনাক্ত করাও তাঁর দায়।
আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিকদের একজন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর কবিতায় আবেগের চেয়ে প্রজ্ঞা, কল্পনার চেয়ে অভিজ্ঞতা এবং ভাবালুতার চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় বহুল পরিমাণে বিধৃত। ফলে তাঁর কবিতা সহজবোধ্য হয়ে ওঠেনি। এর কারণ কবিতা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যানস্থ হওয়া এবং কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও ভাবনা প্রকাশের বাহন করে তোলা। এ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘কাব্য সংগ্রহ’র ভূমিকায় লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু, ‘সুধীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, তাঁর স্বভাবেরই প্রণোদনায়, কিন্তু তাঁর সামনে একটি প্রাথমিক বিঘœ ছিলো বলে, এবং অন্য অনেক কবির তুলনায় যৌবনেই তাঁর আত্মচেতনা অধিক জাগ্রত ছিলো বলে, তিনি প্রথম থেকেই বুঝেছিলেনÑ যা আমার উপলব্ধি করতে অন্তত কুড়ি বছরের সাহিত্যচর্চার প্রয়োজন হয়েছিলোÑ যে কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার, ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ। তাঁর প্রবৃত্তি তাঁকে চালিত করলে কবিতার পথেÑ সে-পর্যন্ত নিজের উপর তাঁর হাত ছিলো না, কিন্তু তারপরেই বুদ্ধি বললে, ‘‘পরিশ্রমী হও।’’ এবং বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য করে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে তিনি অগ্রসর হলেন, অতি সুচিন্তিতভাবে, গভীরতম শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে।’ শিক্ষা /////// ও রুচিবোধ যাঁকে মার্জিত ও আবেগের সংহতি দিয়েছে, তাঁর পক্ষে প্রগলভতায় ভেসে যাওয়া দুরূহ। সুধীন দত্তের কবিতায় এমন এক মার্জিত রুচির প্রলেপ ছড়ানো যাকে দুর্বোধ্য বলে দূরে ঠেলে দেওয়া যায় না, সসম্ভ্রমে প্রণতি জানাতে হয়। এ কথা সত্যÑ তাঁর কবিতার সঙ্গে সাধারণ পাঠকের প্রীতিপূর্ণ কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না; যা গড়ে ওঠে দীক্ষিত পাঠকের ক্ষেত্রে।
প্রবুদ্ধি ও হƒদয়াকুতিÑ এ দুয়ের মিথস্ক্রিয়ায় যে কবিতার সৃষ্টি, সে কবিতা পাঠকের মনকে সহজে আকৃষ্ট করে না কিন্তু চিন্তা জগতে সসুক্ষ্ম অভিঘাত সৃষ্টি করে। তাঁর কবিতা বিশেষভাবে পূর্বকল্পিত সৃষ্টি; কোনোভাবেই আকস্মিক ঘটনা কিংবা তাৎক্ষণিক অনুভূতির তরল প্রকাশ নয়। ‘কবিতার নির্মাণ : সুধীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে অশ্রুকুমার শিকদার উল্লেখ করেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের কবিতার গঠন উদ্ভিদের অচিন্তিতপূর্ব নিয়মে সম্পাদিত হয় না। তার বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধি স্থাপত্যের মতো পূর্বপরিকল্পিত। বাস্তুশিল্পী যেমন ব্লুপ্রিন্ট বা নকশা তৈরি করে তারপর সৌধনির্মাণে হাত দেন, তেমনি এই কবির প্রতিটি কবিতার পিছনে আমরা এক পূর্বকল্পনা বা নকশার অস্তিত্ব অনুভব করি। ইটের মতো শব্দ সাজিয়ে সাজিয়ে গড়ে ওঠে তাঁর কবিতার এক একটি স্তবক। ন্যায়ের পরম্পরায় সেই স্তবকগুলি সাজিয়ে নির্মিত হয় তাঁর এক একটি কবিতা। কবিতাগুলি যেন সঙ্গীত বেদনায় মুখর এক একটি কক্ষ। অনেকগুলি কবিতা নিয়ে এক-একটি কাব্যসংকলনÑযেন এক-একটি মহাল। সেই সব মহাল নিয়ে এই মহিমাময় কাব্যের সৌধ।’ অশ্রুকুমার সিকদারের এই মূল্যায়ন যথার্থ; কিন্তু ইটের মতো শব্দ সাজিয়ে নির্মাণের যে অভিমত, তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ এ কথা মেনে নিলে সুধীন্দ্রনাথকে কবিতা বিনির্মাণকলার একজন কৌশলী বলেই মনে হয় এবং প্রকৃত কবির যে বৈশিষ্ট্য ও অভিধা, তা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
সুধীন দত্ত কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ে প্রজ্ঞার স্মারক করে তুলেছেন। চিন্তাশূন্য কল্পনাবিলাসিতার বিপরীতে অবস্থা নিয়েছে তাঁর কবিতা। সঙ্গত কারণে অপ্রস্তুত পাঠকের পক্ষে তাঁর কবিতার রস আস্বাদন অনায়াস-সাধ্য নয়। একথা অস্বীকার যায় নাÑ তাঁর কবিতায় তৎসম শব্দের বাহুল্য রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে মিথ ও পা-িত্যের সংশ্লেষ। এর অন্য কারণও রয়েছে। সুধীন দত্ত যুক্তিনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞান-মনস্ক। প্রমাণ ছাড়া অন্তঃসারশূন্য বিষয়ের প্রতি কোনো মোহ ছিল না। বস্তুসত্যের ওপর কল্পনার প্রলেপে কবিতা সৃষ্টিই একমাত্র লক্ষ্য ছিল। কেবল ভাবের জগতে বিচরণ করে, যুক্তিহীন স্বপ্নচারিতায় প্রতিভার অপচয় সময়ের অপব্যবহারে ছিলেন অনীহ। যা কিছু দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন তাকেই কবিতায় রূপান্তর করেছেন। তাঁর কবিতার বিষয়-আশয় হয়ে উঠেছে খুব তুচ্ছ বিষয়ও, কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গির আভিজাত্যে বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগেনি। ‘উটপাখি’, ‘কুক্কুট’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন তেমনি লিখেছেন দর্শন, সমাজ, রাষ্ট্র, অধ্যাত্ম-সংকট নিয়েও। কিন্তু এসব কবিতাকে কোনোভাবেই বিষয়ের অনুগত করে তোলেননি। তাঁর কবিতা যেমন দর্শনে আক্রান্ত নয়, তেমনি ধর্মীয় বাণী প্রচারের অনুষঙ্গও নয়। বরং কোনো কোনো সমালোচক তাঁর কবিতায় নিখিল নাস্তির সন্ধানও পেয়েছেন। এ সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসানের অভিমতÑ ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : শব্দের অনুষঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের জড়বাদী দুটি জিনিস তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। একটি হচ্ছে তিনি যে নাস্তিক একথা বারবার বলতে চান। এই বলাটা তো কবিতা হয় না। কিন্তু এই বলাটাকেই তিনি রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন কবিতায়। ‘‘হয়তো ইশ্বর////// নেই : স্বৈর সৃষ্টি আজš§ অনাথ’’Ñবলে তিনি একটা পরিতোষ লাভের চেষ্টা করেছেন। সৃষ্টি সত্যিই অনাথ কি না এগুলো নিয়ে দার্শনিকরা চিন্তাভাবনা করুন, কিন্তু কবি এগুলো নিয়ে কথা বলবেনÑ এটা ভাবতে আমাদের অসুবিধা লাগে এবং এটা একটা বক্তব্য মাত্র। এ বক্তব্যের নানা রকম প্রসার ঘটিয়েছেন তিনি কবিতায়।’ সুধীন্দ্রনাথের ঈশচিন্তা///// নিয়ে সৈয়দ আলী আহসান অস্বস্তি বোধ করেছেন। কারণ সুধীন দত্ত যেমন নিখিল নাস্তির জয়গান গেয়েছেন, তেমনি সৈয়দ আলী আহসান আস্তিক্যকে করেছেন শিরোধার্য। ফলে বিশ্বাসের দিক থেকে পরস্পর বিপরীত মেরুর ছিলেন বলেই সুধীনদত্তের দার্শনিক অভিজ্ঞা সৈয়দ আলী আহসান নির্মোহ দৃষ্টিতে গ্রহণ করতে অনীহ ছিলেন। সুধীনদত্তের শিল্প -বা কাব্য সিদ্ধি নিয়ে সৈয়দ আলী আহসান নিঃসংশয়; কিন্তু আদর্শিক বৈপরীত্যের কারণে তাঁর প্রতি তিনি সুপ্রসন্ন হতে পারেননি। একই রকম অপ্রসন্ন ছিলেন দীপ্তি ত্রিপাঠীও। ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’ শীর্ষক গবেষণা-প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের কাব্য যেন ভ্রষ্ট আদমের আর্তনাদ। তিনি স্বর্গচ্যুত কিন্তু মর্ত্যে অবিশ্বাসী। তাঁর মধ্যে বিজ্ঞতা আছে কিন্তু শান্তি নেই, যুক্তি আছে কিন্তু মুক্তি নেই। তাঁর কাব্য কোনো আশ্বাসের আশ্রয়ে আমাদের পৌঁছে দেয় না। সুধীন্দ্রনাথের নঞর্থক ও পরে ক্ষণবাদী জীবনদর্শন আমাদের ধর্মপুষ্ট বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব সংযোজন। এমনকী আধুনিক কাব্যের অনেকগুলি লক্ষণ যদিচ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান তথাপি এই দর্শন-বৈশিষ্ট্যে তিনি আধুনিক কবিদের মধ্যেও স্বতন্ত্র।
সুধীন্দ্রনাথের কাব্যপাঠকালে মনে হয় কবি যেন এক নিঃসঙ্গ চূড়ায় দাঁড়িয়ে আধুনিক জীবনের নিঃসীম শূন্যতা নৈরাশ্যভারাতুর নয়নে অবলোকন করছেন।’ আধুনিক যুগে মানুষের প্রতি মানুষ প্রশ্নহীন আস্থা স্থাপন করতে পারে না বিচিত্র কারণে। জীবন-যাপনে যেখানে অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ বিগ্রহে যেখানে মুহূর্তে লাখ -লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, সামান্য কারণে যেখানে মানুষ খুন হয়, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রের নাগরিকদের পেছনে গুপ্তচর লেলিয়ে দিয়ে রাখে, আণনবিক বোমার আঘাতে এক-একটি ভূ-খ- মুহূর্তে ধধুলিস্যাৎ হয়ে যায়, যেখানে ঐশীশক্তির কোনো নিদর্শন দেখা যায় না, সেখানে যুক্তিনিষ্ঠ, বিজ্ঞান-মনস্ক কবি সংশয়ী হবেন; এটাই স্বাভাবিক। সুধীন দত্ত এই স্বভাবের জাতক। ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যের ‘মৈমন্তী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়’। এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে হতাশা আর ভালোবাসার জন্য কাকুতি এবং সবশেষে না-পাওয়া বেদনা। তাঁর মনে হয়েছে, চরাচরে চিরায়ত বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই, নেই কোনো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কোনো শক্তিও। ফলে তিনি আর ‘শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে’ সময় ব্যয় করবেন না। এই উপলব্ধি নিছক ধর্মবিদ্বেষ বা আস্থাহীনতা থেকে উদ্ভূত নয়, নয় নাস্তিক্যের চেতনা থেকেও। তাহলে অন্যত্র (চপলা কবিতায়) উচ্চারণ করতেন না, ‘জনমে জনমে, মরণে মরণে, / মনে হয় যেন তোমারে চিনি।’ নিখিল নাস্তিক বহুজনম বা পুনর্জšে§ বিশ্বাস করবেন কোন ভিতের ওপর নির্ভর করে?
সমাজ-জীবনে সত্য-মিথ্যার অস্তিত্ব আছে; কিন্তু এই সত্য-মিথ্যা আপেক্ষিক, না শাশ্বত? যদি যুক্তিবোধ এবং বাস্তবতার নিরিখে সত্য-মিথ্যা নিয়ে ভাবা যায়, তাহলে সত্য এবং মিথ্যা দুটি আপেক্ষিক পদ মাত্র; দুটিই সাপেক্ষ পদ। একটির অভাবে অন্যটির অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। মানবজীবনে এ ধরনের তর্কের সামাজিক কি আর্থিক, কোনো মূল্য নেই। কিন্তু শিল্পের প্রশ্নেÑ বিশেষত কবিতায় সত্য-মিথ্যার সম্পস্পর্ক সুনিবিড়। এ সম্পর্কে বিনয় ঘোষ ‘সত্য ও বাস্তব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সত্য পরিবর্তনশীল ক্রমবির্ধমান ও সমাজাশ্রয়ী।’ অর্থাৎ সত্যের কোনো চিরন্তন রূপ নেই। কবিতায় এ সত্য বা বাস্তবতার প্রসঙ্গ আরও সূসুক্ষ্মভাবে এসেছে। বাস্তবতা হলো একটি বস্তুকে মানুষস কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে? মানুষের উপলব্ধি এবং বোধের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে কোনো একটি বস্তুর গুণাগুণ বিচারের দৃষ্টিভঙ্গিও। কবিতা মানুষের উপলব্ধিজাত বিষয়গুলোর একটি। তাই কবিতার সত্য এবং বস্তুসত্য কোনোকালেই এক ছিল না, এখনো নয়।
সময়, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির আন্তঃসম্পর্কের ধরন সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথের ছিল গভীর পর্যবেক্ষণ। জীবন ও সংসার সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি স্পষ্ট, কিন্তু ওই অভিজ্ঞান প্রকাশে সংশয়ী। ফলে তাঁর চেতনার উপরিতল সম্পর্কে ‘নাস্তিপ্রবণ’ বলে শনাক্ত করা হয়। মহাশূন্যের দিকে তাকালে তাঁর মনে হয় ‘নির্বাক নীল, নির্মম মহাকাশ’। কল্পনাপ্রবণ কবির কাছে নীল যেখানে রোম্যান্টিকতার প্রতীক, বুদ্ধিবাদী কবির কাছে সেখানে কেবল নির্মম। অথচ ‘নাম’ কবিতায় শুরুতে তাঁকে অস্থির ও অধীর মনে হয়। কাক্সিক্ষতকে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার জন্য কালক্ষেপণ করার ৈ ধর্য নেই তাঁর। কাক্সিক্ষতের অভাবে ‘অসহ্য অধুনা’ এবং ‘ভবিষ্যৎত বন্ধ অন্ধকার’, ফলে তার ‘কাম্য শুধু স্থবির মরণ’। চাওয়ার সঙ্গে সব সময় পাওয়ার সমন্বয় ঘটে না। হয়তো তাই, এই অস্থিরতা। হয়তো এ কারণেই এই উচ্চারণÑ‘বজ্রাহত অশোকেরে অলজ্জায় করেছি বিনত / ক্ষণিক পুষ্পের লোভে।’ কিন্তু এ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির নিকট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।
বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞার অনুশাসনও যে কবিতা হয়ে উঠতে পারে, এর প্রমাণ সুধীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন অনেক কবিতায়। এর মধ্যে ‘শাশ্বতী’ও একটি। কবিতাটি তিন পর্বের ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্তে রচিত। প্রথম দুই পর্ব পূর্ণমাত্রার শেষ পর্বের মাত্রা সংখ্যা দুই। মাত্রাবৃত্তের যে সাংগীতিক লয়, সে লয় এখানে পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি। আবার অক্ষরবৃত্তের ধীর, গম্ভীর লয়ও অনুপস্থিত। অর্থাৎ সংগীতময়তার ভেতর, ধ্বনি-সংহতি, গাম্ভীর্যের ভেতর সুললিত সুরÑ এ সবের সম্মিলনে সৃষ্ট এ কবিতা। ভাব ও বিষয়ের যুগলচিত্র প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে এভাবেÑ
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণীজুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;
আগেই বলেছিÑ সুধীন্দ্রনাথকে কোনো কোনো সমালোচক নৈরাশ্যবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এই নৈরাশ্যবাদী পরিচয় ছাপিয়ে ভিন্ন পরিচয় আবিষ্কারের চেষ্টা তেমন কারও ভেতর নেই। অথচ তাঁর কবিতাগুলোয় বেশির ভাগই প্রত্যাশা ও সামান্য সংশয়বাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এই পঙ্ক্তিগুলো আশাবাদের সাক্ষ্য দেবেÑ ‘বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা / রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে।’ একটি বিশেষ কালসীমার পর অন্য ধরনের অভিজ্ঞতা মানুষের জন্য অপেক্ষা করে। এরপরেই সংকটকাল শেষও হতে পারে। ফলে জীবনের কোনো কোনো স্মৃতি মানুষ আজীবন ধরে রাখে। কখনোই সে স্মৃতি ভুলতে পারে না।
তাঁর চিত্রকল্প ও উপমা ভাবাবেগ//// নয় বুদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে। ফলে কেবল অনুভবগ্রাহ্য অলঙ্কারেই তিনি তৃপ্ত নন, দৃশ্যগ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রকল্প-উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রমাণ রেখেছেন কবিতায়। ভাবাবেগের চেয়ে বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞা মানবজীবনে ভূমিকা রাখে বেশি। কেবল তীব্র ভাবাবেগ ও হƒদয়াকুতির কাছে সমর্পিত কবির পক্ষে তারল্যপূর্ণ কবিতা চর্চা সম্ভব, মনীষার প্রতি আস্থা রাখা অসম্ভব।
সুধীন্দ্রনাথের মানসপ্রকৃতি শেষ পর্যন্ত সংশয়বাদী। সংশয়-ই তাঁর মনীষার ভূষণ। যেন কোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে আস্থা রাখতে পারেন না কবি, যেন কোনো উপমা-ই তাঁর মনোঃপূতঃ হয় না, কেবলই বারবার রুচির পরিবর্তন ঘটান, রূপান্তর চান চিন্তারও। ‘মহাসত্য’, ‘মার্জনা’, ‘সংশয়’, ‘প্রশ্ন’, ‘দ্বন্দ্ব’, ‘যযাতি’, ‘উপস্থাপন’, ‘মৃত্যু’, ‘সৃষ্টিরহস্য’ কবিতাগুলো মূলত প্রশ্ন, বিস্ময়, সন্দেহ ও সংশয়কে আশ্রয় করে রচিত। মানবমনের স্বতঃসিদ্ধ স্বভাব বস্তু বিশেষকে পরীক্ষা করে নেওয়া, এক বস্তুকে অন্য বস্তুর সঙ্গে তুলনা-প্রতিতুলনা করে বিচার করা। এমন বিচার-প্রক্রিয়ায় সাফল্যও আসে। কিন্তু কেউ কেউ আবেগ ও চিন্তার বিশেষ মুহূর্তে এত বেশি উদ্বেল কিংবা অস্থির কিংবা নিরপেক্ষ হয়ে ওঠেন, যে বিশেষ কোনো বস্তুকে একাধিক বস্তুর সঙ্গে তুলনা করেও সন্তুষ্ট হতে পারেন না। কোনো ব্যাখ্যা-ই তার মনের মতো হয় না, তবু অব্যক্ত কোনো এক ভালো লাগা তাকে বস্তু বা ব্যক্তি বিশেষের প্রতি সম্মোহিত করে রাখে।
রূপসী বলে যায় না তারে ডাকা;
কুরূপা তবু নয় সে, তাও জানি;
কী মধু যেন আছে সে-মুখে মাখা;
কী বরাভয়ে উদ্ধৃত সে-পাণি।
(সংশয় : উত্তর ফাল্গুনী)
যার রূপ-গুণ সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে ব্যক্তি পৌঁছাতে পারে না, তার সম্পর্কে শেষ প্রশ্ন তার মনে-ই বেজে ওঠেÑ ‘ভালো কি তবে বেসেছি তারে আমি?/ বিজ্ঞ হিয়া শিহরে তাই ভয়ে?’ প্রশ্নশীল ও সংশয়বাদীরা কোনো একটি বিশেষ বিষয়কে বিনা তর্কে মেনে নিতে পারে না। তাদের হƒদয় যতটা আবেগে ভরা, ততধিক প্রজ্ঞাপূর্ণ। ফলে নিজের স্বভাব সম্পর্কেও ‘বিজ্ঞ হিয়া শিহরে’ ওঠে ভয়ে। আদৌ শিহরে ওঠে কি না, সে বিষয়েও কবি নিশ্চিত নন, ফলে নিজেকেই প্রশ্ন করেনÑ ‘বিজ্ঞ হিয়া শিহরে তাই ভয়ে?’ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় হƒদয়বৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক চিন্তাও সমানভাবে উপস্থিত। মৌলিক চিন্তক মাত্রই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধে বিশ্বাসী। পূর্ববর্তী কোনোনও চিন্তকই তার পূর্বসূরি নন; কারও চিন্তার রেশ তার প্রেরণার উৎস নয়। প্রকৃত চিন্তক মূলত একমেবাঅদ্বিতীয়ম্। চরাচরের ঘটনা ও দুর্ঘটনার ফলাফল এবং প্রপঞ্চগুলোর কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ ও প্রতিষ্ঠা করাই তার মূল কাজ। কোনোনও মৌলিক চিন্তা-ই একই সঙ্গে দুই চিন্তকের হতে পারে না। কারণ মৌলিক চিন্তকের চিন্তা অনেক সময় অনির্দেশ্য ও অনির্দিষ্ট থাকে। বিক্ষিপ্ত চিন্তাকণিকার মিথস্ক্রিয়ায় একটি মৌলিক চিন্তার বীজ প্রথমে অঙ্কুরোদগম হয়। এরপরই সে অঙ্কুর ক্রমাগত পরিচর্যায় হয়ে ওঠে একটি বিশেষ প্রপঞ্চের ভাষ্য।
সে চিন্তার সঙ্গে কল্পনার অন্বয় ঘটিয়ে সৃষ্ট কবিতাও চিন্তাশীলদের আরাধ্য। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটে চিন্তাসূত্র বৈচিত্র্যপূর্ণ। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ক্ষেত্রে কথাগুলো ষোলোআনা-ই সত্য। ‘মহাসত্য’র মূল ভাব চিরায়তকে অস্বীকার; আপেক্ষিকতার জয়গান। চিরকালীন সত্য বা শাশ্বত রূপকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে এ কবিতায়। কিন্তু তার এ ব্যঙ্গপ্রবণতা দার্শনিকতা নয়, বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে হƒদয়বৃত্তি অনেকাংশে উপেক্ষিত হয়েছে। কবিতায় অতিমাত্রায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হƒদয়বানকে পীড়া দেয়, এ কথা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : শব্দের অনুষঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, কবিতায় ‘যে মেধা ও মননের পরিচয়টা তিনি দিয়েছেন, ইতিহাসটা দিয়েছেন, সেই মেধা এবং মনন শব্দের ক্ষেত্রে শব্দতেই পর্যবসিত এবং শব্দ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর মেধাকে পূর্ণ ব্যবহার করেন। অন্য কোনো ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসর হতে আর পারলেন না।’ অধ্যাÍ চেতনা মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা। সংকটে, সংশয়ে মানুষ মাত্রই অলৌকিক শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। চায় পরিত্রাণ, নির্ভয় ও আশ্রয়। কেউ গোপনে, কেউ প্রকাশ্যে। যে সব অঞ্চলে বা সাংস্কৃতিক বলয়ে ধর্মীয় েেচতনার সঙ্গে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলীতার সম্পর্ক সৌহার্র্দ্যপূর্ণ ওই সব অঞ্চলের শিল্পকর্মেও অধ্যাÍচেতনা শিল্পিত মহিমায় উজ্জ্বল।
যে সব অঞ্চলে ধর্মানুষঙ্গের সঙ্গে আধুনিকতা, প্রগতিবাদিতার সম্পর্ক সাংঘর্ষিক, সে সব অঞ্চলে অধ্যাÍচেতনা গোপনে চর্চিত হয়। প্রকাশ্যে অলৌকিকতার বিরুদ্ধে সরব শিল্পিীর শিল্পকর্মেও গোপনে চর্চিত হয় অধ্যাÍপ্রেম। অধ্যাÍসংকট একটি জটিল সংকট। বিজ্ঞানে প্রমাণিত নয়, এমন বিষয়ও স্বয়ং বিজ্ঞানিীরাও লালন করেন। সঙ্গত কারণে কেবল বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবোধ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর গূঢ়ার্থ অন্বেষণ করা জরুরি। মানুষের ভয়, হতাশা, নিরাপত্তাহীনতাই তাকে অধ্যাÍসংকটের দিকে প্রণোদিত করে। ফলে মানুষ অবদমনকেও অনিবার্য নিয়তি ভাবতে শুরু করে এবং মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই সংশয়চিত্ত মানবজাতির একদিকে রয়েছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার, বস্তুনিষ্ঠা এবং যুক্তিবোধ; অন্যদিকে রয়েছে অলৌকিকতার মোহ, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা এবং অস্তিত্বের সংকট। সঙ্গত কারণে সংশয়ী চিত্ত একসময় নির্ভরতার আশ্রয় খোঁজে।
বস্তুসত্য বাঙালি সহজে মেনে নেয় না; মেনে নেওয়ার ভান করে মাত্র। বাঙালি জাতি হিসেবে মূলত ভাবুক। তাই ভাবনার জগতে যত পারে ঐশী শক্তিকে স্বাগত জানায়, কিন্তু বস্তুসত্যের নগদ ফলকেও বিচার করে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। কবিরা এই ভাবুকগোষ্ঠীর মন্ত্রণাদাতা। তাঁদের চিন্তারাজ্যে বস্তুসত্য ও কাব্যসত্য প্রায় সমান্তরাল পথ সৃষ্টি করে। সুধীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে ভাববাদী ও সংশয়বাদী। কবিতার শরীর ও আÍাজুড়ে সংশয় ও ভাবেরই প্রচ্ছন্ন ছাপ রেখেছেন তিনি। বস্তুসত্যকে অগ্রাহ্য করেও ভাববাদে আস্থা রেখেছেন। অলীক বিষয়কে দিয়েছেন মর্যাদা; কবিতা হয়ে উঠেছে ভাবুকের প্রাণের উৎসারণ, কল্পনার দৃশ্যগ্রাহ্য ভুবন। যুক্তি ও বাস্তবতা সেখানে হয়ে উঠেছে প্রায় অপাঙ্েেক্তয়। প্রবল নিষ্ঠা, যুক্তিবোধ ও কল্পনায় সৃষ্টি হয়েছে সংশয়ের ভুবন; নিখিল নাস্তি কিংবা অকাট্য বিশ্বাস সেখানে মান্যতা পায়নি। যেখানে বিজ্ঞানমনস্ক হতে চেয়েছেন, সেখানে হয়েছেন বড়ে জোর সংশয়ী। ভাবুকের পক্ষে নিখিলনাস্তির জয়গান গাওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব নয়; মাঝেমধ্যে বিশ্বাসের জগতে আলোড়ন তুলতে পারে মাত্র। এ কারণে প্রবল ধার্মিকের সঙ্গে কবির চিন্তার তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। তাঁর কবিতায় চিন্তার স্ববিরোধ ও অধ্যাÍবোধ গোপন সুতোর মতো ইন্দ্রজাল সৃিেষ্ট করে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় বস্তুবাদী দর্শন স্পষ্ট। আধুনিকতাবাদীদের বিবেচনায় বস্তুবাদের প্রতি সমর্পিত সত্তাই আধুনিক সত্তা। কিন্তু নিটশের সে বিপুল নৈরাশ্যচেতনাও সুধীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করতে পারেনি। বাঙালি কবি যতই পশ্চিমের আধুনিকতার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করার মনোভাব দেখান, ততটা দৃঢ় হতে পারেন না। বাইরে যতই যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় তাঁর, ভেতরে ততই অধ্যাত্মচেতনা। সুধীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। ফলে তাঁর কবিতায় বিজ্ঞান-যুক্তির পাশাপাশি অধ্যাÍচেতনার সমন্বয় ঘটে সহজে। ‘মৃত্যু’, ‘প্রার্থনা’, ‘মরণতরী’, ‘দ্বন্দ্ব’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘অসময়ে আহ্বান’, ‘সান্ত¡না’, ‘প্রতিহিংসা’সহ আরও বেশ কিছু কবিতায় উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিচর্যার সাক্ষাৎ মেলে।
অধ্যাÍসংকট বাঙালির মৌলসংকট। এ সংকট বাঙালির উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। ইচ্ছা করলেই যুক্তিবোধ, গবেষণা এবং বিজ্ঞান দিয়ে এ সংকট থেকে তার উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। অন্তত যত দিন, বাঙালিজীবনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কার্যকারণ জলবায়ু পরিবর্তনও আবহাওয়ার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যৌক্তিক কার্যকারণ সম্পর্কের ফল বলে স্বীকৃত না হয়, তত দিন তার মনে হবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ মানবজাতির পাপাচারের ফলÑ শাস্তি। এ কেবল ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়, জাগতিক স্বার্থশ্লিষ্ট বিষয়েও প্রাসঙ্গিক। এ সম্পর্কে ‘উটপাখি’ উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। প্রথম চার পঙ্ক্তি স্মরণ করা যাকÑ
আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?
কেন মুখ গুঁজে আছ তবে মিছে ছলে?
কোথায় লুকাবে? ধূ ধূ করে মরু ভূমি;
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।
শূন্য মরুর বুকে হতাশাগ্রস্ত জীবন স্বাভাবিক। সেখানে যেকোনো ধরনের আহ্বান তৃষ্ণার্তের জন্য মহার্ঘ্যতুল্য। কিন্তু যখন একজন তৃষ্ণার্ত আশ্রয়-ভালোবাসার আহ্বানও নীরবে উপেক্ষা করে তখন আহ্বানকারীরও আÍমর্যাদাবোধে আঘাত লাগে। তখন তারও মনে হতে পারে ‘ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে’। যে উটপাখিকে কবির মনে হয়, মরুদ্বীপের সমস্ত খবর জানা প্রাণী, তাকেই আবার স্মরণ করিয়ে দেন কবিÑ ‘তুমি তো কখনও বিপদপ্রাজ্ঞ নও’। অর্থাৎ মানুষ বা প্রাণীÑ সবাই অতীতের ঘটনা পর্যালোচনা করে অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, ক্ষেত্র বিশেষ যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার কার্যকারণ সম্পর্কও আবিষ্কার করতে পারে। কিন্তু অতীত-বর্তমানের ঘটনা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চিত বার্তা কেউ দিতে পারে না; কেবল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেওয়া সম্ভব হয় তাদের পক্ষে। ফলে অতীতের সাক্ষী হয়েও কেউ কখনো সর্বজ্ঞ হতে পারে না। সঙ্গত কারণে চরাচরের নানা সম্পর্কের ধরন ও বিভেদের দায় একা কারও নয়।
আমরা জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দু জনে সমান অংশীদার;
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে
আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার
তাই অসহ্য লাগে ও-আÍরতি।
অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।
ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।
অতএব এসো আমরা সন্ধি করে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি:
তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে
তোমাকে, বন্ধু, আমি লোকায়তে বাঁধি।
জাতির উদ্ধারকারী হিসেবে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যক্তির প্রতিশ্রুতি হিসেবে শেষের চার পঙ্ক্তি অনন্যসাধারণ। আর ‘অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে’ একই সঙ্গে প্রশ্নশীল উপলব্ধি ও প্রবচন। পুরো কবিতায় পরার্থপরতাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। উটপাখি একটি প্রতীক মাত্র, আড়ালে সমাজ ও রাজনৈতিক বিমুখ, উদাসীন মানুষের প্রমূর্তি। তাই সতর্ক উচ্চারণÑ ‘ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে’।
মানুষ নিজের নিরাপত্তার জন্য নিয়ম তৈরি করে; নিজেই সে নিয়ম লঙ্ঘংঘন করে অন্যতর প্রয়োজনে। অন্যে যখন নিয়ম লঙ্ঘন করে তখন তার জন্য শাস্তি কামনা করে, কিন্তু নিজের নিয়ম লঙ্ঘনকে দেয় বৈধতা। মানবচরিত্রের এই এক ভয়াবহ দ্বৈরথ। দ্বিমুখী স্বভাব তার। অন্যকে শাস্তি দিতে সে কুণ্ঠাহীন, নিজের দোষের ক্ষেত্রে তৈরি করে অন্য বিধি। যে কাজ অন্যের বেলা গর্হিত বলে প্রচার করে, সে কাজ নিজের জন্য করে তোলে গর্বের। অন্তত এমনটাই প্রচার করে সে। সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় এ বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত।
নজরুলের কবিতায় পঙ্ক্তি বিন্যাস ও মাত্রাচেতনা
দীক্ষিত কবিমাত্রই পঙ্ক্তিবিন্যাসে যেমন সিদ্ধহস্ত, তেমনি মাত্রাচেতনায়ও। পঙ্ক্তিবিন্যাসের বৈচিত্র্যের জন্য ছন্দজ্ঞান থাকা জরুরি। ব্যত্যয়ে পঙ্ক্তিবিন্যাস হয়ে উঠবে আঙ্গিক সর্বস্বতার একটি অংশমাত্র। ছন্দজ্ঞানের সঙ্গে মাত্রাচেতনা ও পঙ্ক্তিবিন্যাসের সম্পর্ক গভীর। দীক্ষিত কবি বক্তব্য স্পষ্ট করার লক্ষ্যে যেমন পঙ্ক্তি বিন্যাস করেন, তেমনি বক্তব্যের আড়াল সৃষ্টির জন্যও। অপ্রস্তুত কবিযশপ্রার্থী ছন্দ উচ্ছেদ করার জন্য যত উদ্গ্রীব, ছন্দসিদ্ধির জন্য তিলার্ধ চেষ্টাও তার থাকে না; ছন্দ না জেনেই ভাঙার স্বপ্ন দেখেন। ফলে কবিতার সর্বনাশ শুরুতেই ডেকে আনেন।
নজরুল পঙ্ক্তিবিন্যাসে ও মাত্রাচেতনায় সচেতন ছিলেন; ছিলেন নিরীক্ষাপ্রবণও। একটি কবিতায় কোন ছন্দের প্রয়োগে কী ধরনের পঙ্ক্তিবিন্যাস সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, সে সম্পর্কে তার সচেতন প্রয়াস লক্ষণীয়। পঙ্ক্তিবিন্যাসের প্রথম ও সার্থক উদাহরণ ‘বিদ্রোহী’। অতি পর্ব, মধ্যখ-ন, ছন্দসন্ধির সমন্বয়ে এ কবিতার পঙ্ক্তিগুলো বহুবর্ণিল রেখার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারাছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্রভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
এখানে শুরুর পঙ্ক্তির শুরুতে বল শব্দের পর একটি স্পেস, তার পর ছয় মাত্রার দুটি পর্ব। অতি পর্বসহ তিন পর্বে এ পঙ্ক্তির সমাপ্ত। তার আরও তিনটি পঙ্ক্তি রয়েছে, প্রতিটির নিয়মিত পর্ব সংখ্যা দুই। পঙ্ক্তিগুলোর পর্বসংখ্যা ও মাত্রা সংখ্যা সমান ও স্বাভাবিক। কিন্তু ‘উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর’ পঙ্ক্তির শুরুতে ‘উঠিয়াছি’ চার মাত্রার একটি অপূর্ণ পর্ব সম্পন্ন হয়ে উঠেছে পরবর্তী শব্দযুগল ‘চির-বিস্ময়’ থেকে প্রথম অংশের ‘চির’সহযোগে। এর পরের পঙ্ক্তি ‘মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!’ থেকেও অতিপর্ব ‘মম’ শেষে একটি স্পেস। এরপর ‘ললাটে’ শব্দের পর বাকি তিন মাত্রার জন্য পরবর্তী শব্দ ‘রুদ্র ভগবান’ থেকে ‘রুদ্র’ নিয়ে ‘ললাটে রুদ্র’ পর্ব গঠন করে ছন্দসন্ধির নিয়মকে মান্য করেছেন। আবার ‘দীপ্ত জয়শ্রীর’ শব্দবন্ধেও পর্বসন্ধি ঘটিয়ে কবিতার পঙ্ক্তি পরিপূর্ণ করে তুলেছেন। ‘দীপ্ত জয়শ্রীর’ শব্দযুগলে ছয় মাত্রার পর্ব বিন্যাসের ক্ষেত্রে ‘দীপ্ত জয়শ’ পর্যন্ত গ্রহণ শেষে বাকি থাকে, ‘শ্রীর’। টের পাওয়া যায়, কেবল শব্দযুগল ‘দীপ্ত জয়শ্রী’ হলেও এখানে ছয় মাত্রা মেলে, তখন পরবর্তী ধ্বনির ওপর পূর্ববর্তী ধ্বনিপুঞ্জকে নির্ভর করতে হয় না।
আর যখন উচ্চারণ করেন, ‘আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/ আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!’ তখন ‘ধৃষ্ট’ শব্দ মাত্রাবৃত্তের সাধারণ নিয়ম ভেঙে তিন মাত্রার স্থলে দুই মাত্রার মর্যাদা পায়। পাঠকের সতর্ক কান দুই মাত্রার সাক্ষ্য দেয়। পঙ্ক্তিবিন্যাসের ক্ষেত্রে পঙ্ক্তির শুরুতে অতিপর্বের প্রয়োগ থাকলেও এ পঙ্ক্তিতে মূল পঙ্ক্তি থেকে স্পেসসহ ‘আমি’ শব্দ অতিপর্ব নয়, বরং পঙ্ক্তিস্থ পর্বগুলো যদি এভাবে বিন্যাস করি, ‘আমি ধৃষ্ট, আমি/ দাঁত দিয়া ছিঁড়ি/ বিশ্ব মায়ের/ অঞ্চল’ তখন স্পষ্ট হয়, ‘ধৃষ্ট’ শব্দটি দুই মাত্রার। পূর্ববর্তী পঙ্ক্তির ‘চঞ্চল’ শব্দের সঙ্গে পরবর্তী পঙ্ক্তির ‘অঞ্চল’ শব্দের ধ্বনি ও মাত্রাসাম্য বজায় থাকে। ‘বিদ্রোহী’ মাত্রাবৃত্তের ষাণ¥মাত্রিকপর্বের/////// অসম পঙ্ক্তিযোগে রচিত হলেও প্রবহমানতার কারণে চরণান্তের মিলও ¤ম্লান হয়ে পড়ে। অন্ত্যমিল এ কবিতায় অবান্তর কি না, সে প্রশ্নও এখানে প্রাসঙ্গিক। মাত্রাবৃত্তের স্বাভাবিক তান এখানে মান্যতা পায়নি। অসম পঙ্ক্তির উপস্থিতি কবিতাটিকে করে তুলেছে একঘেয়েমি মুক্ত। প্রথাগত চরণান্তিক মিল কবিতা সাধারণত সমপার্বিক হয়ে থাকে। নজরুল সে প্রথা ভেঙে নতুন সুর সৃষ্টি করেছেন; তথা গদ্যছন্দের সূচনা এখান থেকেও হতে পারত। কিন্তু চরণান্তিক মিল থাকায় তথা গদ্যছন্দের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই ছন্দকে গদ্যছন্দের সমাত্মীয়ও বলা যায় না।
পঙ্ক্তিবিন্যাসের ক্ষেত্রে সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়, ‘সিন্ধু’ কবিতায়। অক্ষরবৃত্তের অসম পঙ্ক্তিযোগে সৃজিত এ কবিতায় পর্বান্তের মিল থাকা সত্ত্বেও অসম পর্ব ও পঙ্ক্তির মিথস্ক্রিষ্ক্রয়ায় সে অন্ত্যমিল ঊউহ্য হয়ে পড়ে। সর্বোচ্চ মাত্রা সংখ্যা ২২ এবং সর্বনিম্ন ৪। বক্তব্যের প্রয়োজনে পঙ্ক্তিকে বড় থেকে ছোট করেছেন, বড়ও করেছেন।
অশান্ত! প্রশান্ত ছিলে
এ-নিখিলে
জানিতে না আপনারে ছাড়া।
তরঙ্গ ছিল না বুকে, তখনো দোলানী এসে দেয়নি ক’ নাড়া।
প্রথম পঙ্ক্তিতে আট মাত্রা, দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে মাত্রা সংখ্যা চার। উভয় পঙ্ক্তির অন্ত্যমিল রক্ষিত। তৃতীয় পঙ্ক্তিতে দশ মাত্রা এবং চতুর্থ পঙ্ক্তিতে বাইশ মাত্রা। তৃতীয় ও চতুর্থ চরণান্তেও মিল রক্ষা করা হয়েছে।
অক্ষরবৃত্তের আরও একটি কবিতা ‘দারিদ্র্য’। প্রতিচরণে চৌদ্দ মাত্রা এবং চরণান্তে মিল সত্ত্বেও চরণান্তে ভাবের সমাপ্তি টানা হয়নি। ভাবকে প্রবহমানতা দেওয়া হয়েছে।
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা। Ñদিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধৃতাংশের প্রথম দুই পঙ্ক্তির অন্ত্যমিল সত্ত্বেও ভাবের সমাপ্তি ঘটেছে তৃতীয় পঙ্ক্তির আট মাত্রার প্রথম পর্বে। আবার তৃতীয় পর্বের ছয় মাত্রিক শেষ পর্বের ভাব সম্পন্ন হয়ে উঠেছে চতুর্থ পঙ্ক্তিতে। প্রকৃতপক্ষে সেখানেও ভাবের পরিপূর্ণ উদ্বোধন সম্ভব হয়নি, কবিচিত্তের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে, ‘উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার/ বীণা মোর শাপে তব হল তরবার’ উচ্চারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। চার মাত্রাকে তিন মাত্রায় পরিণত করার নৈপুণ্য এ কবিতায় দেখিয়েছেন, ‘দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগ বালা!’ পঙ্ক্তির শুরুর ‘দংশিল’ শব্দে। ‘দংশিল’ শব্দে সাধারণত চার মাত্রা হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে পঙ্ক্তির শুরুতে, প্রথম শব্দের শুরুতে থাকা ‘দং’ রুদ্ধদল হওয়ার কারণে পরবর্তী শব্দ ‘সর্বাঙ্গে’র ভারিী উচ্চারণের সঙ্গে একাÍ হয়ে যাওয়ায় চার মাত্রার পরিবর্তে তিন মাত্রাই গ্রাহ্যতা পায়।
‘চাঁদনীরাতে’ কবিতার একটি চিত্রকল্পঋদ্ধ পঙ্ক্তি, ‘সপ্তর্ষি’র তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রাণী’। ছয় মাত্রিক মাত্রাবৃত্তে রচিত। কিন্তু ‘সপ্তর্ষি’ শব্দটিতে যদিও ছয় মাত্রা রয়েছে, তবু সংশয় জাগে পাঁচ মাত্রার! দ্রুদ্রতলয়ে পাঠকালে পাঁচ মাত্রা মান্য হলেও ধীরলয়ে পঠনকালে ছয় মাত্রাই গ্রাহ্যতা পায়। ‘বাতায়ন পাশে গুবাকতরুর সারি’ কবিতার পঙ্ক্তি বিন্যাস ও মাত্রাচেতনার বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। একটি উদাহরণে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। ‘তোমার পাখার হাওয়া/ তারই অঙ্গুলি পরশের মতো নিবিড় আদর ছাওয়া’ পঙ্ক্তি দুটির গঠন ও মাত্রা বিন্যাসের দিকে লক্ষ্য করলে টের পাওয়া যায়, প্রথম পঙ্ক্তিটি আট মাত্রার। একটি ছয় মাত্রার পূর্ণ পর্ব। অন্যটি অপূর্ণ। দ্বিতীয় পঙ্ক্তির শুরুর পব'//// ‘তারই অঙ্গুলি’ স্বাভাবিক নিয়মে সাত মাত্রার। কিন্তু এখানে ‘তারই’ শব্দের ‘ই’ প্রত্যয়কে পূর্ববর্তী বণ'/// ‘র’-এর সঙ্গে সমন্বিত করে নিলে তখন শব্দটিতে মাত্র দুই মাত্রাই শোনা যায়। মাত্রা গণনার সময় যদি ধরা হয়, তার+ই তাহলে তিন মাত্রা, কিন্তু শ্রুতিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে, ‘তারি’। সে হিসেবে দুই মাত্রাই শ্রেয়।
নজরুলের পঙ্ক্তি বিন্যাসের আরেকটি বিশেষত্ব, একটি অপূর্ণ পঙ্ক্তিতে যে ভাবের শুরু, পূর্ণ পঙ্ক্তিতে সে ভাবের পরিপূর্ণতা।
ক.
পরশুরামের কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! (বিদ্রোহী)
খ.
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান (সাম্যবাদী)
গ.
হায়রে ভজনালয়
তোমার মিনারে চড়িয়া ভ- গাহে স্বার্থের জয়! (মানুষ)
ঘ.
এই দুনিয়া পাপশালা
ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূন্য পুণ্য-ছালা! (পাপ)
ঙ.
শোনো মানুষের বাণী
জšে§র পর মানব জাতির থাকে না ক কোনো গানি! (বারাঙ্গনা)
চ.
হে চঞ্চল
বারে বারে টানিতেছে দিগন্তিকা-বন্ধুর অঞ্চল! (সিন্ধু)
পাঠোদ্ধারগুলো বিশ্লেশষণ শেষে প্রতীয়মান হয়, নজরুল পর্ববিন্যাস ও পঙ্ক্তিসজ্জায় সচেতন ছিলেন। তাই একই কবিতায় অসম দৈর্ঘ্যরে প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর পঙ্ক্তিসজ্জার আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য পঙ্ক্তির শুরুতে অতিপর্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তাতে কবিতা যেমন হয়েছে বহুরৈখিক, তেমনি প্রাকরণিক দিক থেকেও কবিতার একটি গ্রহণযোগ্য ভিত তিনি তৈরি করেছেন, যে ভিতের ওপর তাঁর একটি শৈলীও সৃষ্টি হয়েছে।
নজরুল তাঁর কবিতায় পঙ্ক্তি বিন্যাস ও মাত্রাচেতনায় একটি বিশেষ ধারা তৈরি করেছেন। যে ধারা নজরুলের সাহিত্যিক স্বকীয়তাকে প্রোজ্জ্বল করেছে। ছন্দ বিষয়ে গভীরতর অভিনিবেশ না থাকলে মাত্রাচেতনায় সাফল্য অর্জন অসম্ভব। নজরুল বাংলা ছন্দের প্রতিটি প্রকরণ সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ সচেতন। ফলে ছন্দের ভাঙাগড়ায় তাঁর নিরীক্ষাও ছিল, প্রতিকৃতের। এদিক থেকে কাজী নজরুল ইসলাম নিরীক্ষাপ্রবণ কবিদের জন্য নমস্য।
হেলাল হাফিজ : দ্রোহী প্রেমিক, বিনীত বিদ্রোহী
শিল্পের প্রধান উপকরণ মানবসমাজ। ভাবনাবিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে শিল্পের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কবিতা শিল্পের সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রপঞ্চÑ এ ধারণা সুবিধিত। কবিতা আধুনিককালকে স্পর্শ করেছে সংবেদনশীলতায়, আবেগে এবং বুদ্ধির সংশ্লেষে। বুদ্ধির দীপ্তি, যুক্তির পরম্পরা ও বস্তুসত্যের সঙ্গে চিন্তা ও কল্পনার সমন্বয়ে আধুনিক কবিতা হয়ে উঠেছে সময়ের স্মারক। সমকালীন বিষয়ের প্রতিচিত্র অঙ্কনের কারণে আধুনিক কবিতা আধুনিক মানুষের রুচি গঠনেও সহায়ক ওঠে। আধুনিকতার যুগচিহ্ন মূলত বিবর্তনে। এ বিবর্তন ঘটে প্রধানত আঙ্গিকে। বিষয়-ভাব এবং চেতনায় ঘটে ধীরে ধীরে। আঙ্গিকের বিবর্তনের ক্ষেত্রে কবির কাব্যচর্চার ধারাবাহিকতা এবং স্বাতন্ত্র্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেে কোনো বড় কবিই শুরুতে প্রথাসম্মত পথেই চলেন। প্রথাগত শৈলী আত্মস্থ হওয়ার পর স্বাতন্ত্র্যবোধ কবিকে আত্মমর্যাদা সচেতন করে তোলে। আত্মমর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যবোধই প্রকাশভঙ্গি এবং কবিতার আঙ্গিক পরিবর্তনে কবিকে প্রণোদিত করে। তবে এই পরিবর্তন আকস্মিক ঘটেনি। ঘটেছে ধীরে ধীরে। সামান্য কিছু ক্ষেত্র বাদ দিলে এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা আধুনিক বাংলা কবিতাকে দিয়েছে ঐতিহ্যিক পরম্পরা।
বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের পরম্পরায় যুক্ত হয়েছে বাঙালির সংগ্রাম, দ্রোহ ও বিপ্লবও। বাংলা কবিতার যে ধারা গেছে সংগ্রামের দিকে, বিপ্লবের দিকে, সে ধারার প্রথম সার্থক কবি কাজী নজরুল ইসলামÑ সন্দেহ নেই। এরপর বিপ্লব, সংগ্রাম ও দ্রোহের কবিতা অনেক রচিত হয়েছে। সেই প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান পর্যন্ত অনেকের কবিতায় এ ধারা ঋদ্ধ হয়েছে। তবে বিস্ময়ের বিষয় এইÑ দ্রোহ-বিপ্লব ও সংগ্রাম যেখানে অনিবার্য সেখানে প্রেমও উপস্থিত। এই দুই ভিন্ন মেরুর আশ্চর্য সঙ্গংগম ঘটেছে বাংলা কবিতায়; তবে এ ধারার রূপকার খুব নন। এই অত্যল্প কুশীলবদের একজন হেলাল হাফিজ। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে এই কলমযোদ্ধার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। উত্তাল সময়ে শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি লিখেছেন অবিনাশী সব পঙ্ক্তি। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ যুগপৎ সংগ্রাম, প্রেম, জীবন ও শিল্পের উচ্চারণ হয়ে উঠেছে। ‘শিল্পীর সার্বক্ষণিক চেষ্টা হচ্ছে তাঁর কমিউনিকেশনের দক্ষতা বাড়ানো। তিনি যতটা জ্ঞাপন করতে পারেন, তার চেয়ে অধিকতর কিছু জ্ঞাপন করতে চান।’ (আধুনিক শিল্পকলা : ভাষার ব্যবহার / সৈয়দ আলী আহসান)। হেলাল হাফিজ অল্পকথায় পাঠকের সঙ্গে তাঁর মনঃসংযোগ করতে চান। এ কারণে তাঁর কবিতা স্বল্পদৈর্ঘ্যরে, কিন্তু বর্ণনায়, শব্দে যা বলেন, চিত্রকল্পে-উপমায় তারও বেশি উপলব্ধি করানোর চেষ্টা তাঁর থাকে।
তাঁর কবিতায় বিবরণ আছে, আছে চিত্রও। বিষয় বর্ণনায় তিনি স্বল্পভাষী। মিতকথনে অন্বিষ্ট বিষয় স্পষ্ট করে তোলেন তিনি। বিষয়োপযোগী তাঁর ভাষা, শব্দ চয়ন, অলঙ্কার সৃষ্টি ও ছন্দ নির্বাচন। আঙ্গিক নির্মাণেও বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার স্বাক্ষর স্পষ্ট। বিষয় -প্রকরণের দিক থেকে তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলোÑ
১. মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধিকার আন্দোলন ও রাজনীতি সচেতনতা
২. নারী ও প্রকৃতি প্রেম
৩. কল্পনার প্রাচুর্য ও আবেগের তীব্রতা
৪. ছন্দের বৈচিত্র্য ও অলঙ্কারের সহজ প্রকাশ
৫. বহুরৈখিক একাকিীত্ব
৬. সমর্পণ ও স্মৃতিচারণা
৭. অহঙ্কার ও চিত্তের দার্ঢ্য
হেলাল হাফিজ কবিÑ বাইরে দ্রোহের, অন্তরে প্রেমের। তাঁর কবিতায় বিষয়-বৈচিত্র্যের চেয়ে নির্বাচিত অনুষঙ্গের প্রাধান্যই লক্ষণীয়। কিছু নির্দিষ্ট অনুষঙ্গে বারবার কবি নিজেকে প্রকাশ করেন। এই বিষয়ের পৌ পুনঃপুপৌনিক ব্যবহারে তিনি সিদ্ধহস্ত। এ ক্ষেত্রে প্রেম, দ্রোহ, বিরহ, কষ্ট নারী, যুদ্ধ ও অস্ত্রের প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য। তাঁর বহুল পঠিত কবিতাটি হলোÑ ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। এ কবিতা জাতীয় মুক্তির কাক্সক্ষায় সহযোদ্ধা ও স্বজাতিকে প্রেরণাদানকারী। কবি যেমন তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন, তেমনি যৌবনে ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টিও প্রস্তাবও করেছেন। দেশপ্রেমের কাছে অনেক সময় নারীপ্রেম ম্লান মনে হয়েছে তাঁর। ব্যক্তিগত সুখভোগের চেয়ে সামষ্টিক মুক্তিকামিতাই তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে। ফলে সংকটকালে নারীপ্রেমকে তুচ্ছ মেনেছে। কবির মতে, বীরের প্রেম অস্ত্রের সঙ্গে, যুদ্ধকালীন পরিবেশে প্রেয়সী নয়, অস্ত্রই আরাধ্য। এমনই চিত্র মেলে ‘দুঃসময়ে আমার যৌবন’ ও ‘অস্ত্র সমর্পণ’ কবিতায়। ঠিক বিপরীত চিত্রের কবিতা ‘অগ্ন্যুৎসব’। শেষোক্ত কবিতায় জš§ভূমি ও নারীর মধ্যে সতিনের সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন কবি। ‘অন্য রকম সংসার’, ‘বাম হাত তোমাকে দিলাম’, ‘একটি পতাকা পেলে’, ‘যেভাবে সে এলো’ প্রভৃতি কবিতায় দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ বারবার উচ্চারিত।
ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালির স্বাধিীকার আন্দোলন মুখ্য হয়ে ওঠে। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার বিপরীতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার প্রশ্নে জাতি সংগঠিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্ববর্তী কয়েক বছরÑ বিশেষত ঊন সত্তরের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সমগ্র জাতি মুক্তির কাক্সক্ষা প্রকাশ করে। সমগ্র জাতির আশা-আকাক্সক্ষার যে বেগ সৃষ্টি হয়েছিল ওই সময়ে, এর সঙ্গে কবি ও কথা-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা একাÍতা েেপাষণ করেছিলেন। ওই সময়ে যার দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার অংশীদার ছিলেন, পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে ওই স্মৃতি ও রেশ রয়ে গেছে। ওই রেশ যেমন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছে, তেমনি পরবর্তীকালে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিতদেরও দৃৃঢ়প্রত্যয়ী করেছে। এ ধরনের মাঙ্গলিক কাজে কবিদের ভূমিকা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তারা অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও প্রত্যয়কে শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কারের মাধ্যমে স্পষ্ট করে তুলেছেন। হেলাল হাফিজ এই ধারার কবিদের প্রতিভূ। তাঁর কবিতায় যুদ্ধ-অস্ত্র-সংগ্রাম একই সঙ্গে চিত্রিত। নানা ধরনের বিষয় বর্ণনা করলেও মূলত প্রেম ও দ্রোহই তাঁর কবিতার মুখ্য অনুষঙ্গ। এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজের কথাগুলো প্রকাশ করতে চান। ‘পাখির একটা সুবিধা আছে, যেখানেই থাক, একই গান গাইবে সে, যদি গান গাইতে চায়। মানুষ তা পারে না। তাঁর গান বলে যায় স্থানে ও কালে। মানুষ ইতিহাস দ্বারা বন্দী, যে-ইতিহাস সে নিজেই তৈরি করেছে, নিজের হাতে। যদিও একা নয়, মিলিত হস্তক্ষেপে।’ (মনীষার সময় ও সুযোগ : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)। বাঙালির যে ইতিহাস এই ইতিহাস ইংরেজ-পাকিস্তানি ও বাঙালির যৌথ কর্মে রচিত। এই ইতিহাস ইংরেজ ও পাকিস্তানিদের জন্য পরাজয়ের, গ্লানির; বাঙালির আÍত্যাগ ও অহঙ্কারের। সে অহঙ্কারকে কবি মূর্ত করে তুলেছেন।
হেলাল হাফিজ মননের চেয়ে হƒদয়ের দাবিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে তাঁর আবেগ ও কল্পনা বাস্তবকে ছুঁয়ে গেছে কি না, সে খবর তিনি রাখেননি। যখন যা মানসপটে ভেসে উঠেছে, তা-ই অকপটে বর্ণনা করেছেন। এ েেক্ষত্রে খুব বেশি ভাবিত হননি। তীব্র ভাবাবেগে ভেসে যান বলে লিখতে পারেন দ্বিধাহীন থরোথরো সব প্রেমের কবিতা। কারও আহ্বানের অপেক্ষা না করেই নিজেকে উপস্থাপন করেন অকপটে। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলোয় প্রেমিক হƒদয়ের দার্ঢ্য স্পষ্ট, কোনো কুণ্ঠা নেই তাঁর কণ্ঠে। ফলে তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো পাঠকালে পাঠকহƒদয় আন্দোলিত হয়, আলোড়ন তোলে মস্তিষ্কের কোষে-কোষেও। ‘কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি’ প্রবন্ধে শুচি সৈয়দ যথার্থই লিখেছেন, ‘বাংলা কবিতার মূলধারায় যে স্বল্প ক’জন কবি কবিতাকে তাঁর পাঠকের কাছে অনিবার্য প্রতিপন্ন করেছেন, হেলাল হাফিজ তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতা দাগ কেটে বসে গেছে পাঠকের হƒৎপি-ে। তাঁর কবিতা অনুভূতি উপলব্ধির অর্ঘ্যরূপে নিবেদিত হয়েছে তাঁর পাঠক তথা তাঁর দেশের মানুষের হƒদপদ্মে। মানুষের উদ্দেশে, মানবের উদ্দেশে এ এক অনন্য অন্তরাঞ্জলি।’ এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘যাতায়াত’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন দৃঢচেতা, বোহেমিয়ান, আজš§ দুঃখলালনকারীর দিন যাপনের গল্পÑ এ কবিতা। তাঁর প্রিয় প্রসঙ্গ একাকিত্ব। নৈঃসঙ্গপ্রিয় কবি পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘপথ। নিশ্চিত জানেন তাঁর জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই। কেউ তাঁকে আপন করে পেতে চাই না। অথচ প্রবল আÍবিশ্বাসের জোরে কবি ভালোবাসার দাবি নিয়ে মানুষের দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছেনÑ ‘কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে ভালোবাসি।’ কবি যতটা আÍপ্রত্যয়ী ততটাই সমর্পিত। আÍ নিবেদনের আভাস ‘যাতায়াত’ কবিতায় কিছুটা মেলে। কিন্তু পরিপূর্ণ সমর্পণের স্বভাব ও অভিপ্রায় স্পষ্ট ‘বাম হাত তোমাকে দিলাম’, ‘কষ্ট’, পরানের পাখি, ‘কবিতার কসম খেলাম, প্রত্যাবর্তন, দুঃখের আরেক নাম’, হিরণবালা’, আমার সকল আয়োজন, প্রতিমা’, ‘অন্যরকম সংসার’ প্রভৃতি কবিতায়। এসব কবিতায় স্মৃতি রোমন্থন ও আÍসমর্পণ প্রায় সমানভাবে উপস্থিত।
অহঙ্কার ও চিত্তের দার্ঢ্য প্রকাশে কবি স্পষ্টবাদী। সমাজ ও রাষ্ট্রের অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবিরা স্বভাবগুণেই সোচ্চার। রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়ন, রাজনীতিবিদদের অলজ্জ আচরণ, আইন-শৃঙ্খলার অবনতির মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো কবিকে তাড়িত করে। ‘যার যেখানে জায়গা’য় সংক্ষুব্ধ কবি ওই ভাবনারই প্রতিফলন এঁকেছেন। সরাসরিই ঘোষণা করেছেন, শাসকগোষ্ঠী যতই মানুষ ঠকানোর ষড়যন্ত্রে মেতে উওঠুক, মানুষ জেগে উঠলে ষড়যন্ত্রীরা ব্যর্থ হতে বাধ্য। মানুষের সহ্যক্ষমতারও সীমা আছে। এই সীমা পার হয়ে গেলে তারাও ‘চুতমারানি’ গাল দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে। সাধারণ মানুষের অসাধারণ রকমের অহঙ্কার রয়েছে। সে অহঙ্কারকে সম্মান দিতে জানে না সমাজের সুবিধালোভীরা। তাতে কী? সাধারণ মানুষের প্রতিভূ যে কবি, যিনি সমাজের সমস্ত অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার তাঁর অহঙ্কার ও দৃঢ়ঢচিত্তের উৎকৃষ্ট উদাহরণÑ ‘রাখালের বাঁশি’। পুরো কবিতাটি এখানে উদ্ধৃতিযোগ্য।
কে আছেন?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেনÑ
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না।
সৃষ্টিশীল মানুষ দৃঢ়প্রত্যয়ী না হলে উপস্থিতকালের সবাইকে ছাড়িয়ে মহাশূন্যে মাথা তুলে দাঁড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব। আÍবিশ্বাস মানুষকে কখনো কখনো নিজের স্বরূপ চিনতে সাহায্য করে। ব্যক্তি তার উচ্চতা মাপতে পারলে আরোপিত মানদ- ও উচ্চতার সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। কবি মাত্রই বৃত্তছিন্নকারী। তাঁকে কোনো সংঘ, সময় কিং বা গোষ্ঠীর ক্ষুদ্রবৃত্তবন্দি করে রাখা যায় না। এ কারণে হেলাল হাফিজকে নির্দিষ্ট কোনো তত্ত্বের, সময়ের গ-িতে বিচার করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে বেরিয়েছিল বলে কেউ কেউ হেলাল হাফিজকে বলেন আশির দশকের কবি। তাঁদের এ বলার মধ্যে হেলাল হাফিজের আকাশ ছোঁয়া পাঠকপ্রিয়তার প্রতি আছে ঈর্ষাকাতরতা। আছে এক ধরনের অজ্ঞতা। আবার হেলাল হাফিজদের দশকের বিভাজনে আটকাতে না পারলে ‘কবিপাড়ায়’ তাদের ‘‘সিনিয়রিটি’’ বা ‘‘অভিভাবকত্বও’’ থাকে না। কবিতার আলোচনার সুবিধা বিবেচনায় এনে দশকওয়ারি বিভাজন মানলে বলতে হবে, হেলাল হাফিজ মধ্য ষাটের কবি। মধ্য আশির দশকে বই প্রকাশের হিসাবে তাঁকে ওই দশকে আটকে দেয়ার সঙ্কীর্ণতা লজ্জার! পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের অনেকের বই হেলাল হাফিজের মতো বেরিয়েছে তাদের দশক কেটে যাওয়ার পর।’ (কবিতার জলে হেলাল হাফিজের নতুন আগুন : হাসান শান্তনু)। তবে হেলাল হাফিজ যে সময়ে কবিতাচর্চা শুরু করেছেন, সে সময়ের নিরিখে তাঁকে বিচার করলে তাঁর প্রজ্ঞা-কল্পনা-আবেগের চূড়ান্ত রূপ স্পষ্ট হবে; তাতে সন্দেহ নেই। কারণ,Ñ ‘৭১ পূর্ববর্তী কবিতা উপনিবেশ বৃত্ত ভেঙে আÍস্বরূপকে দিতে চেয়েছে আমাদের জীবনরূপের প্যাটার্ন; মানবিক দ্রোহ-দুঃখ-গ্রামস্পৃহার চিরায়ত বিভা। (বাংলাদেশের পঁচিশ বছরের কবিতা : পরিপ্রেক্ষিত ও প্রান্তÑ বেগম আকতার কামাল)। কাব্যচর্চার পটভূমির বিবেচনায়ও এই কবি সম্পূর্ণরূপে বৃত্তভাঙা, বোহেমিয়ান ও কল্পনার স্বেচ্চারী। তাঁর সময়, বেড়ে ওঠা, জীবন-যাপন, রাজনৈতিক পরিস্থিতিÑ এসবই তাঁকে এমন দ্রোহী করে তুলেছে। তাঁর কবিতা জীবনোপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের উপায় মাত্র নয়, আÍ আবিষ্কার, চিত্ত-উদ্বোধনেরও মাধ্যম। হেলাল হাফিজ এই উভয়বিধ স্বভাব ও চারিত্র্যের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করেছেন। সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি, ব্যক্তির মনোবিকারকে কবিতায় চিত্রায়িত করতে গিয়ে তাঁর ভাষা কখনো জটিল হয়ে পড়েনি। তাঁর কবিতায় প্রবল দ্রোহ এবং তীব্র আবেগ প্রকাশের সময়ও এক শান্ত, সৌম্য চিত্র ফুটে ওঠে। যে স্বভাব একজন মানুষের ভেতর যুগপৎ দ্রোহী ও প্রেমিক সত্তার উদ্বোধন ঘটায়। ‘হেলাল হাফিজ অতি সরল ভাষায় তাঁর অসাধারণ কবিতাগুলো রচনা করেছেন। এ কবিতাগুলো বুঝতে বা অনুধাবন করতে কুষ্ঠকাঠিন্য আক্রান্ত কবিদের কবিতা পড়ে বোঝার মতো প্রয়োজন হয় না। হেলাল হাফিজের কবিতাগুলো নিজগুণেই পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।’ (কবিতা একাত্তর েেহলাল হাফিজকে নিয়ে বিভ্রম : কবির হুমায়ূন)। আমাদের মনে রাখতে হবেÑ প্রকৃত কবি সময় ও স্থানের সীমানা ছাড়ানো অসীম সত্তা। এ কারণেই কবি হেলাল হাফিজ বয়স-নির্বিশেষে প্রেমিক-সংগ্রামী সবার প্রিয় কবি।
ছন্দনির্বাচনে কবি মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তে স্বস্তিবোধ করেছেন, স্বরবৃত্তেও লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। তবে অক্ষরবৃত্তে তাঁর দক্ষতা বিস্ময়কর। বিশেষত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’-এর মতো কবিতায় তিনি অক্ষরবৃত্তের নিয়ম ভেঙে যে পঙ্ক্তি রচনা করেছেন, তাতে তাঁর নিয়ম মানা ও না-মানার শক্তির প্রমাণ মেলে। স্বাক্ষর মেলে অলঙ্কার সৃষ্টির ক্ষেত্রেও। ‘প্রাণধর্মের অনুশাসন থেকে আমরা দুটি দিকে মুক্তির পথ পেয়েছি; দর্শনে আর শিল্পকলায়। দর্শন বিশুদ্ধ পড়হংবঢ়ঃ সমূহের বিন্যাসের মধ্যে অন্তঃসঙ্গতি আনতে চায়; শিল্পীর কারবার রসধমব নিয়ে। এই মানসপুতুলগুলিকে সে খুশীমতো ভাঙে আর গড়ে, সাজায় আর গুছায়।’ (আধুনিক বাংলা কবিতা : ভূমিকা/ আবু সয়ীদ আইয়ুব)। হেলাল হাফিজ এই খুশমতো ভাঙাগড়ার কাজে স্বতঃস্ফূর্ত। নিয়ম মেনে যেমন তাঁর কবিতা রচিত হয়েছে, তেমনি নিয়মের ব্যত্যয় করেও। তাঁর কবিতায় প্রাণধর্মের উপস্থিতি সর্বাধিক, চিন্তনের রেশও কম নয়। প্রাণধর্ম ও চিন্তনের মিথস্ক্রিয়ায় তাঁর কবিতার সৃষ্টি। এ কারণে পড়হংবঢ়ঃ-এর বিন্যাসে সঙ্গতি যেমন রয়েছে, তেমনি রসধমব ও স্পষ্ট করে তুলেছেন। কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।
১. এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ( নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়)
২. আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর উঠেছে
নারী-খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে? (হিরণবালা)
৩. মৌলিক প্রেমিক আর কবি হলে অধিক হারায় (প্রত্যাবর্তন)
৪. নিউট্রন বোমা বোঝো
মানুষ বোঝো না! ( অশ্লীল সভ্যতা)
৫. গাভিন ক্ষেতের ঘ্রাণ জলের কলস, কাক
পলি মাটি চেনা মানে আমাকেই চেনা।
আমাকে চেনো না?
আমি তোমাদের ডাক নাম উজাড় যমুনা। (নাম ভূমিকায়)
৬. মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস (মানবানল)
৭. ভালোবাসাবাসিহীন এই দিন সব নয়Ñ শেষ নয়
আরো দিন আছে
ততো বেশি দূরে নয়
বারান্দার মতো ঠিক দরোজার কাছে। (লাবণ্যের লতা)
৮. পরিপাটি নির্দোষ সন্ত্রাস নিয়ে
আমি কতো বিনীত বিদ্রোহী
পাখিকে জিজ্ঞেস করো সব জেনে যাবে
অবিকল আমার মতন করে কবুতর নির্ভুল জানাবে। (কবুতর)
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবেÑ কবি বিভিন্ন বিষয়ের আশ্রয়ে মূলত নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এই চেষ্টায় কখনো চিত্রকল্প, কখনো উৎপ্রেক্ষা, কখনো উপমা সৃষ্টি করেছেন। বিষয় হিসেবে কখনো যুদ্ধ, কখনো প্রেম, কখনো প্রকৃতি এসেছে। আপাতত মনে হতে পারে, তাঁর বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ের সামঞ্জস্য প্রচ্ছন্ন, বিরোধী প্রকট। কিন্তু আধুনিক কালের কবিস্বভাবকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে উপলব্ধি উচিতÑ ‘আধুনিক বাংলা কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা যে সবিস্ময়ে এই কথাটা উপলব্ধি করি যে ঐক্যের মধ্যেও বিপরীতের স্থান আছে, বিরোধের মধ্যেও সংহতির সম্ভাবনা।
আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকলভাবে শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, কান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি।’ (আধুনিক বাংলা কবিতা : ভূমিকা / বুদ্ধদেব বসু)। বুদ্ধদেব বসুর যুক্তি ও ব্যাখ্যার ষোলোআনাই হেলাল হাফিজের ক্ষেত্রে খাটে। তাঁর কবিতায় প্রেম-বিরহ, যুদ্ধ-শান্তি, অস্ত্র, চুম্বন, নারী, প্রকৃতি সমানভাবে উপস্থিত। এ সবের মধ্যে বিরোধের চেয়ে সংহতি বেশি, বিপরীতের চেয়ে ঐক্য। শেষ পর্যন্ত হেলাল হাফিজ মূলত বিনীত বিদ্রোহী।
আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রসঙ্গ
আধুনিক বাংলা কবিতা যতটা না বিষয়গত, তারও বেশি আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার। ফলে রোম্যান্টিকদের সঙ্গে আধুনিকদের প্রাকরণিক পার্থক্যও স্পষ্ট। যেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দ-সুধীন দত্তদের। এই ধারাবাহিকতা বর্তমান কালের বাংলা কবিতায়ও সমুপস্থিত। এই সময়ের প্রধান কবিদের অনেকেরই উšে§ষকাল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেবর্তী সময়। ওই সময়ের কবিতার বিষয়-আশয়ের বিপুল অংশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, ক্ষোভ, দেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক অনুষঙ্গই বেশি। তবে কেউ কেউ সমকালের স্রোতের ভেতর থেকে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছেন, নিস্পৃহতা ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির জোরে। ফলে এ ধারার কবিরা সমকাল থেকে রস গ্রহণ করেও সমকালের প্রভাবে প্রভাবিত হন না, স্বকালকে প্রভাবিত করেন। স্বকালের ওপর তাঁদের প্রভাব এমন সর্ববিস্তারিী হয় যে, কালের উত্তাপ তাঁদের পোড়াতে পারে না, স্পর্শ করে মাত্র। আবু হাসান শাহরিয়ার এই ধারারই একজন।
আধুনিক কালের কবি তাঁর উপস্থিতকালের প্রধান অসুখ শনাক্ত করেন এবং এ থেকে নিরাময়ের স্বপ্ন দেখান স্বজাতিকে। এ কারণে তাঁদের কাজে নিজের কাল তেমন গুরুত্ব পায় না। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের বিষয়-আশয় থেকে তাঁদের কবিতার রস ও রসদ সংগৃহিীত হয়। অর্থাৎ অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের রুচি এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নচারণÑ এই তিনের মিথস্ক্রিয়ায় সৃজিত হয় কবিতার অন্তরাÍা ও অবয়ব। এ সঙ্গে শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় কবি নিজেই বলেছেন, ‘বহুকালের বহু কবির ঋণভূমে নতুন শব্দের বীজ হাতে দাঁড়ায় কবিতার নতুন সমকাল। সেই সমকালকে নিয়ে কোনোনও দূরল///// ভবিষ্যতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন কবি। অস্থির সমকালে বাস করেও কবি এক ধ্যানী মহাকালের বাসিন্দা।’ পাশাপাশি ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার প্রসঙ্গও স্বীকার করেছেন।
চিন্তা ও কল্পনার সমন্বয়ে কবিতায় বুদ্ধি ও আবেগের সুষম সম্পর্ক রক্ষা করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আধুনিক কবি অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটান। নারী-পুরুষের প্রেম, প্রকৃতি, নদী, দেশপ্রেম, যুদ্ধ, ধর্ম, দর্শন ও রাজনীতি ছাড়াও মনোবিকার, ক্ষোভ, হতাশা, যৌনতা, বিশ্বায়ন, সর্বপ্রাণে প্রেম, যুদ্ধবিরোধী মনোভাব, সমকালের বিশেষ ঘটনার রেশ ইত্যাদি আধুনিক কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে। তাঁর কবিতায় বিষয় বিচিত্র, কোনো নির্দিষ্ট ছকে সীমাবদ্ধ নয়। এ প্রসঙ্গে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় উল্লেখ করেছেনÑ ‘জীবনের ছবি থেকেই আমি তুলে আনি কবিতার চিত্রকল্প। জীবনের হাসি-কান্না হাহাকার থেকেই উঠে আসে আমার কবিতার ধ্বনিময়তা।’ কোনো বিশেষ নারী যেমন তাঁর আরাধ্য, তেমনি নির্বিশেষ নারীও। আবার কেবল নারীপ্রেমেই সীমাবদ্ধ নন কবি, চরাচরের অশরীরীরি প্রাণের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার স্বপ্ন দেখেন। এ কারণে কাব্য চর্চার শুরুর দিকের কবিতা ‘তুমি’েেত যেমন ‘তুমি’র পরিচয় স্পষ্ট করেন না, তেমনি পরিণতকালের কবিতা ‘বালিকাআশ্রম’-এ-ও। প্রথম দিকের কাব্যগুলোয় কবি মূলত প্রেমিক, যে প্রেম নারীর প্রতি, কিছুটা নিসর্গের প্রতিও। কিন্তু মধ্যপর্যায় থেকে শুরু করে সর্বশেষ কাব্যে তাঁর প্রেম বিবর্তিত হয়েছে নারী থেকে নিসর্গে, দেহ থেকে দেহাতীতে। কবি যেন বস্তুবাদী ধারণা থেকে ভাববাদী চৈতন্যে পরিভ্রমণ করেছেন। কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারেননি। মূলত কবি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর বিষয়ে কবিতা রচনা করেননি। তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে বহু বিষয়ের বহুরৈখিক প্রকাশের। শাহরিয়ার যেকোনো বিষয়কে কবিতা করে তুলতে জানেন। এ প্রসঙ্গে সমালোচক পবিত্র মুখোপাধ্যায় ‘চিরচলমান কবিতার এক কবি’ প্রবন্ধে লিখেছেনÑ ‘স্বাভাবিক কবিত্বশক্তি নিয়ে জšে§ছেন শাহরিয়ার। যে কোনো অনুভবকে সংযমশাসিত কবিতা তুলতে পারেন, তার অনুভব এত সৎ ও গভীর যে, তার প্রকাশও স্বচ্ছ-সাবলীল এবং ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে ওঠে।’ পবিত্র মুখোপাধ্যায় শাহরিয়ারের কবিত্বশক্তির মৌলিক ও সাবলীল দিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘স্বাভাবিক কবিত্ব শক্তি’ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এই স্বাভাবিক কবিত্ব শক্তি স্বভাবকবির নয়, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ, বহুলপাঠে আত্মপ্রস্তুতিসম্পন্ন প্রাজ্ঞের। ফলে নিজের অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন, কল্পনা ও মনীষাযোগে যেকোনো বিষয়ে কবিতাসৃষ্টি তাঁর জন্য সহজ। এ প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্যÑ ‘শাহরিয়ার প্রেরণনার জন্য শুধু মেঘ কিংবা নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টি রাখেন না, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থমালার প্রতিও গভীর মনোনিবেশ করেন। নিজের অন্তর্দৃষ্টি, প্রচুর পাঠ, সর্বোপরি জীবন-নিঙড়ানো অভিজ্ঞতা শাহরিয়ারের কবিতাকে সমৃদ্ধ এবং অগ্রসর করে তুলেছে।’ সমকাল ও সমাজকে অনুভবে ধরাই কবির মৌল কাজ। বস্তুসত্য সেখানে অর্থহীন। অনর্থক তার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা। মরীরিচিীকার নাগাল পাওয়া মানবজীবনের স্বপ্নের অসাধ্যও। বাস্তবের সঙ্গে তার সম্পর্ক মনোভূমিকেন্দ্রিক। বস্তুগত সত্যের সঙ্গে সম্পর্ক অসম্ভবের। জাতীয়তাবোধের প্রশ্নে, স্বজাতির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবি আঁকা দেশপ্রেমিক কবির দায়। সে দায় পালনে তার কাব্যিক সততা তাৎপর্যময়।
কেবল স্বজাতি-স্বদেশ নয়, বৈশ্বিক চেতনাও তাঁর কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবি জানেন এবং মানেনÑ উগ্র জাতীয়তাবোধ কবিকে সংকীর্ণ ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ রাখে। আবার দেশপ্রেমহীন বিশ্বনাগরিকবোধও কবিকে উš§ূš§ুল ও উদ্বাস্তু করে তোলে। শেকড়বিহীন বৃক্ষ যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, তেমনি নির্দিষ্ট ভূখ- ব্যতিীত কবিরও অস্তিত্বত্ত্ব বিপন্ন। কারণ, ভূখ- ব্যতিীত যেমন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না, তেমনি সার্বভৌম কবির অস্তিত্বও। প্রত্যেক সার্বভৌম কবিরই একটি নির্দিষ্ট ভূখ- থাকে। সেটিই তাঁর শেকড়। শেকড় যে প্রাণসঞ্জিীবীনী গ্রহণ করে, তা তাঁর নিজের ভূখ- থেকেই।
তবে এ কথা অস্বীকার করা যায়ই নাÑ বুদ্ধির চেয়ে হƒদয়বৃত্তির প্রাখর্যেই তাঁর সৃষ্টি উজ্জ্বল। কবিমনের অহংপ্রবণতা, কবিতাকে মানবজাতির চিৎপ্রকর্ষ ও চরিত্রের দার্র্ঢ্য প্রকাশের অনুষঙ্গে পরিণত করে। কলাকৈবল্যবাদীদের ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্ব বর্তমান মানবসমাজে অন্তঃসার শূন্য প্রপঞ্চে পর্যবসিত। পাখি আপন মনে গান করে। এতে মানবজাতির কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই পাখির গান প্রকৃত গান নয়। মানব রচিত ও গাওয়া গানই গান। কারণ এতে মানুষের অংশগ্রহণকে মানুষ স্বাগত জানায়। শিল্পের যে প্রকরণ মানবতাকে শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করে, সে প্রকরণের মৃত্যু জšে§র লগ্নেই নির্ধারিত হয়।
সাম্যের গান- মানবমন্ত্রে পরিণত হয়েছে অনেক আগে। তবু পরাধীন জাতিগুলো স্বাধীনতার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্বাধীনতাকামী জাতিকে পদানত করে রাখার জন্য দ্বিধাবিভক্ত করে। সবকালেই এর প্রমাণ রয়েছে। স্বাধীনতাকামী জাতিগুলোও বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে স্বাধীনতার দাবি ফিকে হয়ে আসে। আবার স্বাধীন জাতিগুলোর ভেতর বিভিন্ন রকম উপসর্গ ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন গৌণ বিষয়ে বিবদমান রাখে। তখন স্বাধীন জাতিগুলোও নিজেদের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও সংঘঙ্ঘ তৈরির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। যে সে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। মোদ্দা কথা, ছলে-বলে- কৌশলে এসব জাতির ঐক্য বিনষ্ট করে, জাতিগুলোর মতানৈক্যের সুযোগে পদানত করে রাখে। আবু হাসান শাহরিয়ার কবি হিসেবে অহিংসবাদী এবং প্রতিশোধবিমুখ। ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন, ‘হত্যার বদলে যারা হত্যা চায় তারা/ সভ্যতার গ্লানি’। পাশাপাশি দোষীর মৃত্যুদ-ের পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন, অন্তত নির্বাসনে পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। ঠিক এ কবিতাটির বিপরীতধর্মী কবিতা ‘একলব্যের পুনরুত্থান’। এই কবিতায় ব্যক্তির ‘সম্পন্ন মানুষ’ হয়ে ওঠার পেছনে বাধাগুলো শনাক্ত করে কবির দৃঢ়চিত্তের ঘোষণা সহসা সচকিত করে ‘সভ্যতার প্রতি’র পাঠককে। ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতার সমস্ত প্রস্তাবনাকে চূর্ণবিচূর্ণ করেই যেন শেষ দুই পঙ্ক্তি রচিতÑ ‘যদিও একলব্য তবু ভুলিনি অপমান/ পুনর্বার হব না তাই ক্ষমাঅন্তঃপ্রাণ’। স্বাভাবিকভাবে দুটি কবিতার মধ্যে বিরোধ লক্ষণীয় হলেও প্রকৃতপক্ষে আন্ত্যঃমিলই বেশি। দুটোতে অহিংস এবং আত্মমর্যাদাকে গুরুত্ববহ করে তোলা হয়েছে। পরন্তু ‘একলব্যের পুনরুত্থান’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে সমস্ত মেকি ও ন্যাকামিীর বিরুদ্ধে দ্রোহ। কারণ একপক্ষ কেবল ক্ষমাঅন্তঃপ্রাণ হলে অন্য পক্ষের স্বৈরাচারী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে সমাজের নানা স্তরের মানুষের স্বরূপ উšে§াচনও কবি করে দেন সহজে। ‘জš§ যার নিসর্গতায় পদ্য তার পায়ে গড়ায়’ শীর্ষক এক বিশ্লেষণাত্মক গদ্যে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘হƒৎপি- ছিঁড়ে মনের অথই বোধের অতল যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি মেধাবী ভাষায় সমকালের সমস্ত দীর্ণতাকেও ব্যঙ্গবিদ্রƒপে শ্লেষে তীর্যকে//// অনেক রঙিন মুখোশধারীর আসল চেহারাও শনাক্ত করেছেন।’ প্রথম দিকে রচিত কবিতাগুলোয় কবি যতটা ভাববাদী, শেষদিকে ততটা নন। শেষ দিকের বিশেষত ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’, ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’ ও ‘বালিকাআশ্রম’ কাব্যে সমাজের প্রতি কবির দায় পালনের উজ্জ্বল প্রমাণ রয়েছে।
বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কষ্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার, চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রভাব, যান্ত্রিক সভ্যতার বিবমিষা, নগর জীবনের নৈঃসঙ্গতা, নৈরাশ্য আর অবসাদগ্রস্ত এক ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আধুনিক কাল মানুষকে। যার মুখোমুখি দাঁঁড়িয়ে নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত জন অলৌকিকতা এবং ঐশ্বরিক কার্যকারণ সম্পর্কের মধ্যে আপাতত অন্তঃসার শূন্যতা দেখেন। ফলে ক্রমাগত জগৎসংসার, যূথবদ্ধ জীবনপ্রণালিী আর যৌথ পরিবার প্রথার বন্ধন নিয়ে সন্দেহ ও নৈরাশ্যবোধের উšে§ষ ঘটে। যা থেকে কেউ কেউ তাদের প্রাত্যহিক জীবন-যাপন থেকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও অনুশাসনগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে স্বতঃপ্রণোদিত ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। যান্ত্রিক জীবনের প্রতি স্বপ্নবান মানুষের বিবমিষা জšে§ সহজে। যে যন্ত্র মানুষের আবেগ ও নিত্যপ্রয়োজনেরর দাবিকে অস্বীকার করে, তার প্রতি কবি বিতৃষ্ণ। ‘আড়াইঅক্ষর’ কাব্যে দার্ঢ্যরে সঙ্গে উচ্চারণ করেনÑ ‘জীবনই না থাকে যদি কেন হাঁটি জীবিকার গলি?’ নাগরিক প্রতিবেশে বসে কবি নিসর্গকে স্মরণ করেন প্রেয়সীর মতো। এ কারণেই তাঁর সহজ উচ্চারণ ‘মাটির আমি পেটের ছেলে; আকাশ আমায় ডেকেছে ‘‘ভাই’’Ñ/ একসঙ্গে বসে সবাই এক থালাতে নিসর্গ খাই।’ তবে শাহরিয়ার নিসর্গকে কাব্যের অনুষঙ্গ করে তুলতে গিয়ে গ্রাম্য করে তোলেন না, নিসর্গপ্রেমের সঙ্গে নগর চেতনার অন্বয় সাধনও করেন। নিজে হয়ে ওঠেন বিদগ্ধ এবং কবিতা তাঁর মন ও মননের স্মারক। তাই যৌনগন্ধী শব্দ এবং শারীরবৃত্তীয় শব্দের সমন্বিত পাঠ তাঁর কবিতায় অপেক্ষাকৃত বেশি। শেষ পর্যন্ত যৌনতাও শিল্প হয়ে উঠেছে।
তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের বিবেচনা করলে দেখা যায়Ñ ‘অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ’ কাব্যে পূর্বসূসুরিদের ঋণ লক্ষণীয় হলেও তাঁরও প্রস্তুতির স্বাক্ষর রয়েছে। এ কাব্যের ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় কবি দেশকে দেখেছেন কন্যারূপে। বলেছেন বাংলাদেশ লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে, হাজারও সংকট ও সংগ্রামের পথ মাড়িয়ে সিজিল-মিছিল করে উঠেছে মাত্র এই কন্যা। তাকে যেন কেউ ভূত সেজে ভয় না দেখায়। ‘অব্যর্থ আঙুল’ মূলত আÍজিজ্ঞাসা তাড়িতের দার্শনিক প্রজ্ঞাপূর্ণ। এ কাব্যের গুরুত্বপূর্ণ কবিতাগুলোর একটি ইতোপূর্বে উল্লিখিত ‘সভ্যতার পতি’। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘মোহরপ্রার্থী।’ এই কবিতায় স্বরবৃত্তের দ্রুতলয়ের শব্দ সমবায়ের সমন্বয়ে সংবেদনশীল হƒদয়ের স্পষ্ট ও দৃঢ়মনোবাসনা প্রকাশিত হয়েছে। স্বরবৃত্তের পর্ববিন্যাস ও পঙ্ক্তিবিন্যাসে ভাঙচুর ও নিরীক্ষার প্রমাণ রয়েছে।
‘তোমার কাছে যাই না তবে যাব’ প্রস্তুতিকাল ছাড়িয়ে পরিণতকালের কাব্য। এ কাব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘যে -গোলাপ অনন্ত সুন্দর’। এ কবিতায় ব্যক্তির আত্মউদ্বোধন এবং উšে§াচনকে বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ করে তুলেছেন। গোলাপপ্রীতি সবার স্বতঃস্ফূর্ত নয়। অনেকটা লৌকিক আচরণ মাত্র। স্বার্থসিদ্ধির উপচারের পরিণত গোলাপ অনেক অসত্যেরও সহায়। তাই গোলাপপ্রীতি ফ্যাশন হয়ে ওঠে। যান্ত্রিক সভ্যতায় সবকিছুই যেখানে উপযোগ দাবি করে করে, আর্থিক লাভালাভের ভিত্তিতে সেখানে প্রেমিকের দাবি কী? নৈরাশ্য তাকে আচ্ছন্ন করে কখনো কখনো। এই সত্য উপলব্ধিজাত নয় কেবল, অভিজ্ঞতারও অংশ। যে অভিজ্ঞানে কবি সাধারণ মানুষ থেকে কবি হয়ে ওঠেন, কবি থেকে হয়ে ওঠেন সম্পন্ন মানুষও। এ গোলাপ কার্যসিদ্ধিরও উপায়। যা বহু আগে ইয়েটÑ 'ঞঙ ঞঐঊ জঙঝঊ টচঙঘ ঞঐঊ জঙঙউ ঙঋ ঞওগঊ' কবিতায় বলেছিলেন, 'ঈড়সব হবধৎ; ও ড়িঁষফ, নবভড়ৎব সু ঃরসব ঃড় মড়,/ ংরহম ড়ভ ড়ষফ ঊরৎব ধহফ ঃযব ধহপরবহঃ ধিুং: জবফ জড়ংব, ঢ়ৎড়ঁফ জড়ংব, ংধফ জড়ংব ড়ভ ধষষ সু ফধুং'. গোলাপ বিদায়ক্ষণকে মিলনবেলার//// মতো স্মরণীয় করে রাখার আদর্শ অনুষঙ্গ হতে পারে। ইয়েটস সে কথাই ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। শাহরিয়ার ঠিক সেভাবে বলেন না, তাঁর বলার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্প্রীতি স্থাপনে গোলাপ যেমন সেতু বন্ধন হতে পারে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদিী কোনোনও কর্মযজ্ঞেরও স্মারক গোলাপ হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই গোলাপের গুরুত্ব অপরিমেয়। ইয়েটস গোলাপকে নিয়ে অহংকার করেছেন, শাহরিয়ার করে তুলেছেন আত্মউদ্বোধনের চিহ্ন।
ঐতিহ্য ও লোকপুরাণের নবায়নে সৃষ্ট ‘একলব্যের পুনরুত্থান’। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’ প্রকৃতপক্ষে নিসর্গ প্রশস্তি ও সর্বপ্রাণের প্রতি প্রেমের বর্ণনা। আরোপিত সভ্যতার যন্ত্রণাকিীষ্ট জীবনের প্রতি তীব্র কটাক্ষের কাব্য, ‘এ বছর পাখিবন্যা হবে’। ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’, ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’, কাব্যত্রয়ী উত্তরাধুনিক চেতনায় ঋদ্ধ। এ উত্তরাধুনিকতা পশ্চিমের আরোপিত নয়, বাংলার ঐতিহহত্য, পুরাণকে চিন্তার ভরকেন্দ্রে রেখে কল্পনার সংহত ভাবের সমন্বয়ে সৃষ্ট। সমকাল ও স্বসমাজের নানা দিক কেন্দ্রে রেখে আপনসৃষ্টির মিথস্ক্রিয়ায় লিখিত কাব্য ‘তোমাদের কাচের শহর’। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’, ‘আড়াইঅক্ষর’ ও ‘বালিকাআশ্রম’ মূলত আখ্যানকাব্য। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’ ও ‘আড়াইঅক্ষর’এর কবিতাগুলো লিরিকধর্মী, বিষয় নির্বাচনে প্রেম, শরীর, প্রযুক্তির নানা দিক প্রাধান্য পেয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ-বিষয়, যুদ্ধ, প্রেম, সংবিধান প্রভৃতি বিষয়ের বহুরৈখিক প্রকাশ ঘটেছে ‘বালিকাআশ্রম’ কাব্যে।
কবিমানস কাল সচেতন বলেই সমকালকে শব্দে-বাক্যে-পঙ্ক্তিতে ধারণ করেন সচেতনভাবেই। তাতে কবিতা সমকালের ফসল হয়েও চিরকালীন হয়ে ওঠে। সমকালীন রাজনীতি, রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা ভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊউর্ধ্বগতি, কুসংস্কার, সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব কবির মনোবিশ্বকে আলোড়িত করে, ব্যথিত করে; করে ক্ষত-বিক্ষতও। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ধর্মীয় উš§াদনার অপ-সংক্রমণে কবি ব্যথিত। ছন্দ মানা ও ছন্দভাঙার প্রতি তাঁর সমান আগ্রহ, চিত্রকল্পে রয়েছে নিজস্ব রুচির পরিচয়। সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার শিক্ষাকে কবিতার অনুষঙ্গে পরিণত করতে গিয়ে শিক্ষিত মানুষের ভদ্রোজনোচিত ভাষাকে কবিতার ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি। কবিতার স্বর ও সুর এবং চিত্রকল্পে তাঁর স্বাতন্ত্র্য উজ্জ্বল।
সাহিত্যের রাজনীতি
মানুষের চিন্তার স্রোত সব সময় একমুখী হয় না, থাকে না বাঁকহীনও। নানা চড়াই-উতরাইৎরায় পার হতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। এই অভিজ্ঞতা মানুষকে ধীরে ধীরে বদলে দেয়। পরিবর্তন ঘটে তার আচরণে, মনোজগতে। আর এই পরিবর্তন ঘটে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সাহিত্যিকদের। সাহিত্যিক ও সাহিত্যশ্লিশষ্টদের ভেতর চিন্তার পরিবর্তন ও বিবর্তন কখনো কখনো ঘটে আকস্মিক; কখনো কখনো সুপরিকল্পিতভাবে। পরিবর্তন ঘটে দুভাবে। প্রথমত, লব্ধ ধারণা ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজ-পরিবর্তনে লেখক অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পড়েন। ফলে মাঙ্গলিক চিন্তায় পূর্ণ হয়ে ওঠে সৃষ্টির ভুবন। দ্বিতীয় পরিবর্তন ঘটে আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছায়। এ পরিবর্তন যাদের মধ্যে প্রবল তারা লেখালেখির চেয়ে লেখালেখিকেন্দ্রিক কৌশলে আগ্রহী বেশি। লেখালেখিকে অবলম্বন করে জাগতিক স্বার্থসিদ্ধি-ই এই শ্রেণীর মূল্য উদ্দেশ্য। এই স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা গঠন করে বিভিন্ন সংঘ, গোষ্ঠী। দখন করে নেয় দৈনিকলগ্ন সাহিত্য পাতা, সাময়িকী এবং প্রকাশ করে নানা রকম গৌণ ইস্যুভিত্তিক সংকলন। ওই সংকলনগুলোর ভিত্তি সাধারণত কোনো দশক, কিংবা তুচ্ছ কোনো মতবাদ। ওই সংকলনগুলোর মূল উদ্দেশ্যÑ একজন বা একাধিক কথাশিল্পীর সঙ্গে নিজেকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা। এই প্রবণতার সরল নামকরণ হতে পারে সাহিত্যের রাজনীতি।
পৃথিবীতে যত ধরনের রাজনীতি রয়েছে, এর মধ্যে সাহিত্যের রাজনীতি সবচেয়ে ভয়ানক। অন্য যেে কোনো পেশার লোকের চেয়ে সাহিত্যশ্লিশষ্ট লোকের আত্মম্ভরিতা বেশি। গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, স্টান্টবাজি ও øবরি/////Ñ এ অঞ্চলের মতো অন্য কোথাও নেই। ইংরেজি পলিটিক্স শব্দের যথাযথ প্রতিশব্দ বাংলায় নেই। তাই রাজনীতি শব্দটা কাছাকাছি হওয়ায় গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু কী সেই রাজনীতি? প্রতিভাবানকে উপেক্ষা করে মেধাহীনদের দৌরাত্ম্যের ইতিহাস অনেকের-ই জানা। অনুরাগী পাঠক ও খ্যাতিপ্রত্যাশীদের প্রচার-প্রচারণায় সমকালে যিনি খ্যাতির শিখরে উঠতে পেরেছেন, তিনি কখনো নিজের আশে-পাশে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীদের প্রশ্রয় দেন না। নিজেও কোনো জ্ঞানী কিংবা নিজের চেয়ে প্রতিভাবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন না এবং নিজের চেয়ে বেশি প্রতিভাবানকে সহ্য করতে পারেন না। সাহিত্যের রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা অনুসারী সৃষ্টি ও লালনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন। আর অনুসারী লালনে তাঁদের কিছু নগদ অর্থও ব্যয়িত হয়। এই নগদ অর্থের উৎসÑ লেখক-কবিযশপ্রার্থী-আমলা-ব্যবসায়ীদের লেখক বানানোর প্রকল্প। এই প্রকল্প থেকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দুই ধরনের অর্থ উপার্জন সম্ভব। পাঠবিমুখ-অপ্রস্তুত সাহিত্য সম্পাদকেরা বিত্তশালীদের রচনা ছাপিয়ে সময়ে-অসময়ে কিছু আর্থিক সুবিধা আদায় করেন। সে অর্থেই চলে তাঁদের অনুসারীগোষ্ঠী লালন। তাঁরা ভুলে যায়Ñপ্রজ্ঞাবানেরা আইডিয়া নিয়ে নিজে নিজে ভাবেন, পর্যালোচনা করেন নিজের সঙ্গে নিজে। নির্বোধেরা নিজের মনে কোনো চিন্তার উদয় হওয়া মাত্র-ই দশজনকে জানায়; চালাকেরা ওই আইডিয়া ধার করে নিজের বলে চালিয়ে দেয়। এই নিয়ম যুগ -যুগ ধরে চলে আসছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে নাÑ ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না, মাঝেমাঝে কেউ কেউ কিছুদিনের জন্য বিকৃত করে মাত্র। ইতিহাস আপনি গতিতে চলে এবং স্বমহিমায় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। এ-ও সত্যÑ সূর্য থেকে আলো আর উত্তাপ নিতে হয় প্রাণীজগৎ আর উদ্ভিদ জগতের। সূর্যের বুকে কেউ পৌঁছতে পারে না, বিপরীত চেষ্টা করলে ভস্ম হতে হয়। কিছু মানুষ সব সময়-ই ক্ষমতাবানদের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য লালায়িত থাকেন। তাঁরা ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সময় সুবিধাবাদী অবস্থানে থাকেন এবং ডিগবাজি খান।
তোষামোদকারী যতই ক্ষমতাবানদের কাছে ঘেঁষতে থাকে, প্রাজ্ঞজনেরা ততই উপেক্ষিত হতে থাকেন। এর কারণ ক্ষমতাবানেরা অনেক সময় তোষামোদকারীদের স্তুতির বন্যায় এমন-ই ভেসে যেতে থাকেন যে প্রায় অন্ধ হয়ে যান। যৌক্তিক-অযৌক্তিক বিষয়কে আলাদা করার পর্যবেক্ষণ শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তখন মোসাহেব বেষ্টিত থাকার কারণে প্রকৃত সত্য জানার সুযোগ পান না। বিস্ময়ের বিষয় হলো,Ñ এই চরম সত্য থেকে তোষামোদকারী কিংবা ক্ষমতার মোহে অন্ধরা কোনো দিন শিক্ষা নেন না। পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাস এই সাক্ষ্য-ই বহন করে।
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য এ শ্রেণীর সাহিত্যশ্লিশষ্টরা দায়ী। তাঁদের মূল্য লক্ষ্যÑ সমাজকে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেওয়া, সৃষ্টি করা নৈরাশ্যজনক সাহিত্য সমাজ। যেখানে ক্রমাগত শিষ্টাচার- বহির্ভূত আচরণ করতে থাকবে, কবি-কথাশিল্পী-যশপ্রার্থীরা। নিজেদের ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণকে চিত্তের দার্ঢ্য আর গোঁয়ার্তুমিকে দ্রোহ বলে-ই দাবি করে। তাঁদের স্বভাবজাত প্রবণতা হলোÑ সমাজের সম্মানিত কাউকে অসম্মান করা। ছোটকে বড় আর বড়কে ছোট বলে প্রচার করা মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ধরনের অপরাধ যাঁরা করেন তাঁরা মূলত অসাহিত্যিক সাহিত্য-সম্পাদক। অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা সাহিত্য পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পেলে পুরো পাতাটিকে পারিবারিক সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের দেয়ালিকায় পরিণত করেন। এই অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখকদের প্রতি তাকান ভীত সন্ত্রস্ত চোখে, আর আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চানাচুর মার্কা পত্রস্থ করেন যত্মসহকারে। সাহিত্যসমাজে যখন øবরি//// বা স্টান্টবাজ লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন নির্মোহ, নিরাসক্ত ও নির্লোভ প্রাজ্ঞ ও হƒদয়বান সাহিত্যিকেরা উপেক্ষিত হতে থাকেন। প্রচল সমাজ ব্যবস্থার নিরিখে নির্মোহ, নিরাসক্ত সাহিত্যিককে কারও কারও কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। মনে হতে পারে অপ্রকৃতিস্থও। প্রচল স্রোতের সঙ্গে গা ভাসাতে না পারা প্রতিভাবানদের এই এক সমস্যা। লোভের পৃথিবীতে নিস্পৃহ-নির্লোভীরা কোনো দিন যথাযথ সম্মান পায় না। এই লোভ ও হুজুদের///// পৃথিবীতে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থান চাটুকারদের জন্য বরাদ্দ। চাটুকারদের দৌরাত্ম্যে প্রতিভাবান-সত্যবাদীরা উপেক্ষিত হতে থাকেন নানাভাবে। কিন্তু সত্যবাদীরা ব্যক্তিগত জীবনে যতই সত্যের চর্চার করুক কিন্তু সমাজের ওপর তেমন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না উপস্থিতকালে। বিপরীতে চাটুকারেরা নিজেদের সুবিধা আদায় করে নেয় প্রায় তাৎক্ষণিক। সত্যবাদীদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজপতিরা, শাসকবর্গ। ফলে সত্যবাদীদের জন্য প্রতিমুহূর্তে উপেক্ষার যন্ত্রণা নির্ধারিত থাকে। চাটুকারদের সঙ্গে আপাতত তাদের পরাজয়ই বড় হয়ে ওঠে। এর কারণÑ চাটুকারের পেছনে থাকে ক্ষমতার শক্তি, সত্যবাদীর জন্য ক্ষমতার খক্ষ।
কিন্তু এই সত্যবাদীদেরও শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। এক শ্রেণীর সত্যবাদী রয়েছে, যারা আসন্ন বিপদের সংকেত না বুঝেই, সময় না বুঝেই, নিজের উপলব্ধি যেখানে-সেখানেই প্রকাশ করে। অন্য েেশ্রণীর সত্যবাদীরা পরিস্থিতি বুঝে, সময়মতো সত্য প্রকাশ করে। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর সত্যবাদীরা অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সত্য প্রকাশেও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়ন। এই শ্রেণীর সত্যবাদীরা-ই প্রকৃতপক্ষে প্রজ্ঞাবান। বিষয়টা অনেকটা ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর মতো। বোকারা ঝড়ের সময় আম কুড়ায়, বুদ্ধিমানেরা ঝড় শেষে; আর প্রজ্ঞাবানেরা পর্যবেক্ষণ করে। ফলে ঝড়ের কবলে ফলে বোকারা মাঝেমাঝে প্রাণ হারায়, বুদ্ধিমানেরা তাদের ঠকিয়ে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে আর প্রজ্ঞাবানেরা কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়েই ফসল তোলে ঘরে। প্রসঙ্গটা আপাতত, অসংলগ্ন মনে হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের রাজনীতির আলোচনায় এ প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। ফলে যারা সাহিত্যের রাজনীতি করে, অন্যকে খাটো করে নিজের সুবিধা আদায়ের হীন েেচষ্টায় লিপ্ত থাকে, তাদের মানসিকতা বোঝার জন্য উপর্যুক্ত বিষয়ের ধারণা রাখারও প্রয়োজন রয়েছে। সে সঙ্গে এ-ও পরিষ্কার হয়ে যাবেÑ সমকালে সাহিত্যের রাজনীতির শিকার-উপেক্ষিত মাত্র-ই দুর্বল নন, নন উত্তরকালে হারিয়ে যাওয়ার কোনো মামুলি সত্তা। বরং উপেক্ষিতদেরই ভেতর থেকেই কেউ কেউ হয়ে ওঠে মহীরুহ।
বাংলা কবিতায় দশকের রাজনীতি
দশককেন্দ্রিক কবিতার রাজনীতি কবিদের জন্য বিরক্তি; অকবিদের জন্য সৌভাগ্যের। কবি কখনো দশকের বৃত্তে নিজেকে বন্দি করতে চান না, অকবিদের একমাত্র লক্ষ্য ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বৃত্ত তৈরি করে তাতেই বন্দি থাকা। স্বসৃষ্ট ক্ষুদ্রবৃত্তের বনসাঁই হওয়ার জন্যই চলে তাঁদের যত নর্দন-কুর্দন। দশক ছাপিয়ে মহাকালের নিক্তিতে কাব্যবিচারের প্রসঙ্গ উঠলেই দশকবাজদের পিলে চমকে ওঠে। তাঁদের মূল কাজ কবিতা নয়, দশককেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চা। ‘পৃথিবীতে যত ধরনের রাজনীতি রয়েছে, এর মধ্যে সাহিত্যের রাজনীতি সবচেয়ে ভয়ানক। অন্য যেকোনো পেশার লোকের চেয়ে সাহিত্যশ্লিষ্ট লোকের আত্মম্ভরিতা বেশি। গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, স্টান্টবাজি ও øবরিÑ এ অঞ্চলের মতো অন্য কোথাও নেই। ইংরেজি পলিটিক্স শব্দের যথাযথ প্রতিশব্দ বাংলায় নেই। তাই রাজনীতি শব্দটা কাছাকাছি হওয়ায় গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু কী সেই রাজনীতি? প্রতিভাবানকে উপেক্ষা করে মেধাহীনদের দৌরাত্ম্যের ইতিহাস অনেকের-ই জানা। অনুরাগী পাঠক ও খ্যাতিপ্রত্যাশীদের প্রচার-প্রচারণায় সমকালে যিনি খ্যাতির শিখরে উঠতে পেরেছেন, তিনি কখনোই নিজের আশে-পাশে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীদের প্রশ্রয় দেন না। নিজেও কোনো জ্ঞানী কিংবা নিজের চেয়ে প্রতিভাবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন না এবং নিজের চেয়ে বেশি প্রতিভাবানকে সহ্য করতে পারেন না।’ (সাহিত্যের রাজনীতি : মোহাম্মদ নূরুল হক)।
স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে রীতিসিদ্ধপথে সিদ্ধি অর্জনে ব্যর্থরা সব সময়ই শর্টকাট পথ খোঁজে। কোনো পথের সন্ধান না পেলে অদ্ভুত কিছু উপায় বের করে তারা। যদিও ওই পথে চলার মতো কোনো বিশেষ নিয়ম-রীতি তারা প্রবর্তন করে না এবং নিজেরাও জানে না কোনো রীতি। শিল্পের প্রতি, জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায় পালন করতে হয় না। তারা একদিকে হয় নিয়ম বিচ্যুত, অন্যদিকে তেমনি সমাজ-শিল্পচ্যুতও। ভাবতে অবাক লাগে, এই ব্যর্থরা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য কখনো অনুতপ্ত হয় না। বরং নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য আÍম্ভরিতায় ভোগে। নিয়ম না-জানা ও না-মানার সুবিধা এইÑ তারা ইতিহাস-ঐতিহ্য-নিয়মের প্রতি কোনো দায় বোধ করে না। ফলে হাজার বছরের কবিতার প্রেক্ষাপট নয়, নিজেদের চর্চার ক্ষুদ্রকালকেই কবিতাচর্চার মাহেন্দ্রক্ষণ বলে দাবি করে তারা। যদিও সে চেষ্টা নিজেদের বাগ্্কবিত-া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।
এখন প্রশ্ন হলোÑ কারা এই দশকগ্রস্ত?Ñ ‘যারা সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি শনাক্ত করতে ব্যর্থ, তারাই দশকভিত্তিক আলোচনায় আহাদি হয়ে ওঠেন। দশকভিত্তিক আলোচনায় সাহিত্যের পাঠোদ্ধার ও বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকে কম। কেবল অন্তঃসারশূন্য মন্তব্যপ্রধান আলোচনা করে যেমন আলোচক সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন, তেমনি সে আলোচনার সূত্র ধরে দশকিয়া সাহিত্যিকও বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। সাহিত্যের যুগবিভাগ ও প্রবণতা উপলব্ধি করা ধ্যানসাধ্য গবেষণার বিষয়। সে ধ্যানসাধ্য গবেষণায় অসমর্থরাও দশকবিভাজনে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সাহিত্যের যুগবিভাগ ও প্রবণতা উপলব্ধি করার জন্য সাহিত্যের ভিত্তিভূম আত্মস্থ করা জরুরি।’ (সাহিত্যে দশক বিভাজ : মোহাম্মদ নূরুল হক)। কিন্তু দশকবাজদের মূল সমস্যা কোনো কিছুর অতীত-বর্তমান না জেনেই কবিতাবিষয়ে নিরর্থক মন্তব্য করা। তারা দশকবাজি করতে গিয়ে এই দশকবিভাজনকেও বিতর্কিত করে তোলে। একদশকের ধ্বজাধারীরা অন্য দশককে দেখে তাচ্ছিল্যের চোখে। নিজের দশকের তুচ্ছকে মহীরুহ দাবি করলেও অন্য দশকের সবাইকে করে অবজ্ঞা। নিজের কাজ দিয়ে তারা বড় হতে চায় না, অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার জন্য নিজের নাক কাটতেই ব্যস্ত থাকে। দশকবাজি সম্পর্কে কার্তিক মোদক সম্পাদিত ‘সীমান্ত সাহিত্য’-এর মে-ডিসেম্বর ২০০০ সংখ্যায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে কবি অরুণ মিত্র বলেছেন, ‘আমি দশকবিভাজনে একবারেই বিশ্বাসী নই। সাহিত্যের গতি দশ বছর অন্তর পাল্টায় না। এমন কোনো নিয়ম নেই। কোনো বিশেষ সাহিত্যের ধারা হয়তো দশ বছর বা পঞ্চাশ বছর থাকতে পারে। তার পরে হয়তো পাল্টায়। দশক বিভাজন করলে একটা সুবিধা হয় এই যে, অনেক কবির নাম ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।’ অরুণ মিত্রের এই বক্তব্য যথার্থ। দশকবাজির প্রধান সুবিধা এইÑ যার মহাকালের কবিসভায় পেছনের আসনটিতেও বসার যোগ্যতা নেই, সেও একটি দশকিয়া সংকলনের সম্পাদক হওয়ার সুবাদে নিজের রচনাটি ঢুকিয়ে দিতে পারে। এর ফলে স্টান্টবাজদের নগদপ্রাপ্তি জোটে সত্য কিন্তু অনেক সময়ই প্রকৃত কবিরা উপেক্ষিত হতে থাকেন। কারণ বিভিন্ন দশক ধরে ধরে সংকলন তৈরির সময় কবিদের সংখ্যাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। যেমন কোনো একটি সংকলনে পাঁচ দশকের কবিতা নেওয়া হবে। শর্ত প্রত্যেক দশক থেকে দশজন অন্তর্ভুক্ত হবেন। তর্কের খাতিরে দশকবিভাজন মেনে নিলেও একথা তো সত্যÑ সব দশকে সমান মেধাবী কবি জš§ান না। কোনো একটি বিশেষ দশকে একই সঙ্গে পনেরো জন একই মানের মেধাবী কবি জš§াতে পারেন, আবার এর পরবর্তী দশকে মোট কবিই হতে পারেন দশ জন। যাঁরা পূর্ববর্তী দশকের মেধাহীনদের চেয়েও দুর্বল। দশকিয়া সংকলনের কারণে পূর্ববর্তী দশকের মেধাবীদের পনেরো জনেকের পাঁচজনকে বাদ দিতে হয়, আর পরবর্তী দশকের অথর্বরাও তাদের সঙ্গে একই আসনে বসার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে।
দশকবিভাজনের ফলে কবিতার কোনো আঙ্গিকগত কি মানগত কোনো পরিবর্তন সূচিত হয় না। কারণ, দশক ধরে ধরে কবিতার চারিত্র্য বদলায় না। চারিত্র্যে পরিবর্তন আসে বিভিন্ন জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। আর এসব ঘটনা নিশ্চয় দশকের গজফিতা মেপে-মেপে ঘটে না। এ সম্পর্কে মোক্ষম-শ্লেষাÍ মন্তব্য করেছেন কবি পূর্ণেন্দু পত্রী। তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘দশ বছর পরে পরে সত্যিই কি ন্যাড়া হয়ে যায় সাহিত্যের মাথা আর তাতে গজায় নতুন রঙের চুল?’ না, নতুন রঙের চুল তো গজায়-ই না, উল্টো বাসি চুলে বব কার্ট দিয়ে নারীপুরুষের লিঙ্গ েেভদ করার কসরতই চলে কেবল। এ কারণে হয়তো কবি মৃণাল বসু চৌধুরী দশকবাজদের ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘দশক ফুরানোর আগেই, সেই দশকের কবিতা বলে কোনো সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করতে চান যাঁরা, তাঁরা শুধু বাচালই নন, উš§াদও।’ বাচাল ও উš§াদ বলার মধ্যে কেউ কেউ অতিশয়োক্তির প্রমাণ খুঁজতে পারেন, কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলেই দশকবাজদের আচরণে ও কর্মে এই দুটি গুণের প্রমাণ মেলে। একথা ভুলে গেলে চলবে নাÑ একদুপুরের তীব্র আলো ও দাবদাহ যেমন সারা বছরের গ্রীষ্মকাল নয়, তেমনি কল্পনার হঠাৎ ঝলকানিতেও সাহিত্যের বাঁকবদল হয় না। এ জন্য দরকার বিশেষ বিশেষ প্রবণতার ক্রমাগত পরিমার্জন- পক্রিয়া। প্রতিটি বাঁক বদলের পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে অধ্যাবসায়ী নির্মাণ-কৌশল এবং নিরন্তর পরিচর্যা। যাঁরা নিরন্তর পরিচর্যা এবং অনুশীলনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে চান, তাঁরা জানেন দশক তো তুচ্ছ বিষয়, শতকও কবিতার কাল বিভাজনে গৌণ হয়ে ওঠে। একই প্রসঙ্গে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বলেছেন, ‘দশক গৌণ কবিদের আশ্রয়।’ আর নতুন শতকের শুরুতে কবি আবিদ আজাদ লিখেছিলেন একটি শ্লেষাত্মক কবিতাÑ ‘২০০০’। ওই কবিতার শেষ পঙ্ক্তি এ রকমÑ ‘এই যে ভাই নামুন, নামুন, দেখুন আপনার দশক যায়।’ দশকবাজদের মূল উদ্দেশ্য একটাইÑ দশক শেষ হওয়ার আগেই দশকিয়া সংকলন বের করে নিজেকে বিভিন্ন দশকীয় লোকাল বাসের যাত্রীতে পর্যবসিত করা।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, কেন এই দশকবাজি কিংবা দশককেন্দ্রিক রাজনীতি? উত্তরও অজানা নয়। দশকবাজেরা প্রকৃতপক্ষে কবিতাপ্রেমী নয়, খ্যাতি ও অর্থলোভী। কবিতা তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছনোর সিঁড়ি মাত্র। দশকিয়া কবিতা সংকলন, বিভিন্ন সাহিত্যপত্র, ছোটকাগজ, দৈনিকলগ্ন সাহিত্যপাতাকে পুঁজি করে তারা মূলত অর্থবিত্তের ধান্ধায়ই থাকে। আর এ কাজে তাদের কিছু অনুসারী সৃষ্টি করতে হয়। অনুসারী লালনে ব্যয়িত হয় নগদ কিছু অর্থও। এই নগদ অর্থের উৎসÑ লেখক-কবিযশপ্রার্থী-আমলা-ব্যবসায়ীদের দশকওয়ারি কবি বানানোর প্রকল্প। এই প্রকল্প থেকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দুই ধরনের অর্থোপার্জন করেন তারা। দুর্বল ও মেধাহীনদের দশকওয়ারি কবিতা সংকলনগুলোর দিকে তাকালেই এই উক্তির সত্যতা মিলবে। এটা একধরনের অপরাধ। আর এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত মূলত অসাহিত্যিক সাহিত্য-সম্পাদক, দশকবাজ সংকলক ও গৃহপালিত সমালোচক। তারা রুচি নিয়ন্ত্রণ দূরের থাক, রুচি গঠনেও কোনোনও ভূমিকা রাখতে পারে না। কুয়োর ব্যাঙ কুয়োকেই বিশ্ব মনে করে, সেখানেই তার স্বর্গসুখ খোঁজে। দশকের কুয়োয় লাফানোর মধ্যে আনন্দ থাকতে পারে। কিন্তু এই লাফানো দিয়ে দিঘি-বিল-সমুদ্রে সাঁতার কাটার মতো দুঃসাহসকে ব্যঙ্গ করার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই নিশ্চয়। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উক্তি প্রণিধানযোগ্যÑ ‘মজাখালে ডিঙ্গি ঠেলে খুব আনন্দ পাচ্ছি এমন কথা বলি আপত্তি নেই, কিন্তু তাই বলে বড় নদী বলে কিছু নেই দুনিয়াতে, বা ডিঙ্গির চেয়ে দ্রুত কোনো যান নেই কোথাও, বা বড় নদীর ও বড় যানের যাত্রীরা কোনো আনন্দ পায় না সমুদ্র-যাত্রায়, এই সব কথা বলতে যাওয়া আত্মপ্রবঞ্চনামূলক হবে।’ যাঁরা এই আত্মপ্রবঞ্চনাকে কবিতায় সিদ্ধিলাভের মোক্ষম ভাবেন তাঁরা মূলত বৃত্তাবদ্ধ। তাঁরা কুয়োকে সমুদ্র আর ক্ষুদ্র গ্রামকে বিশ্বসংসার ভেবে আত্মতৃপ্তি পান। তাঁদের এই স্বভাবকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন ‘গ্রাম্যতা’। তাঁর মতে, এই ‘গ্রাম্যতার কারণেই আমাদের দেশে বিজ্ঞানী এসেছে যদিও কিন্তু বিজ্ঞান প্রায় আসতেই পারল না, এ কারণেই আমাদের প্রকৌশলীরা হন তবলিীগিী, পদার্থ-বিজ্ঞানীরা হন জামাতিী।’ দশকবাজেরা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কথিত তবলিগি ও জামাতিই। তাদের মগজে গ্রাম্যতা, নীচতা এবং চিন্তায় হীনম্মমন্যতা। ফলে নিজেরা সংকলনের কুয়োর মধ্যে আনন্দ পায় বলে অন্যকেও সেখানে প্ররোচিত করে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এক বা একাধিক কবি ও কথাশিল্পীর অভিন্ন রুচি, অভ্যাস, আচরণ ও শিক্ষা-দীক্ষার ঐকান্তিক চেষ্টায় গড়ে ওঠে একেকটি সাহিত্যিক প্রবাহ। একেকটি সাহিত্যিক ধারার উšে§ষ ও বিকাশের জন্য পঞ্চাশ বছর থেকে এক শতাব্দিী পর্যন্ত সময় প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে একাধিক সাহিত্যিক প্রবণতাও সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। ইংরেজি সাহিত্যে যেমন ‘অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগ’, ‘এলিজাবেথীয় যুগ’, ‘নিউ ক্যাসিক যুগ’, ‘রোম্যান্টিক যুগ’, ‘ভিক্টোরীয় যুগ’, ‘অএ্যাডওয়ার্ডীয় যুগ’, ‘আধুনিক যুগ’, ‘জর্জীয় যুগ’, বাংলায় তেমনি ‘বৈষ্ণব যুগ’, ‘চৈতন্য যুগ’, ‘মঙ্গলকাব্যের যুগ’, ‘নাথ যুগ’, ‘রবীন্দ্র যুগ’, ‘আধুনিক যুগ’, ‘কল্লোল যুগ’ সুপ্রতিষ্ঠিত। এসব বলয়ের সাহিত্যিক একই সঙ্গে একাধিক যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাতে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি কিংবা প্রবণতা শনািেক্তর ক্ষেত্রে কোনোনও অসুবিধা হয়নি। কারণ কবিতার যুগবিভাজন প্রবণতা ও চারিত্র্যনির্ভর। পাঁজি মিলিয়ে মিলিয়ে এ যুগ বিভাজন সম্ভব নয়। পাঁজি মিলিয়ে মিলিয়ে কবির বয়স ও কবিতাচর্চার সময়-ক্ষণ চিহ্নিত করা যায়। তাতে কবিতার ধারা সৃষ্টির কোনো লক্ষক্ষ্মণ ফুটে ওঠে না। আমাদের মনে রাখতে হবে,Ñ আম-জাম-নারিকেল-সুপারি-তুলসিী গাছ প্রতিত্যেক বাড়িতে বাড়িতে জšে§। কিন্তু কয়েক ক্রোশ পথ পাড়ি দিলেই তবে দেখা মেলে বটবৃক্ষের। বটবৃক্ষের জন্য প্রয়োজনও হয় উš§ুক্ত প্রান্তরের। হেঁসেলের চালার নিচে বট হয় না। অর্থাৎ এক দশকের ক্ষুদ্রবৃত্তে বড় কবির জš§ অসম্ভব। দশকে দশকে কবিয়ালের জš§ হয়, চ-ীদাশ-মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-শামসুর-আল মাহমুদের জন্য কয়েক যুগ থেকে শুরু করে শতকের ব্যবধানও প্রয়োজন।
ফেসবুক-ব্লগকেন্দ্রিক বাংলা কবিতা
বাংলা কবিতার ইতিহাস ঐতিহ্যের, নিরীক্ষার; বুদ্ধি ও কল্পনারও। পদাবলিী থেকে শুরু করে মাইকেলের যুগ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমানের কবিতাÑ সব যুগেই এই ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা প্রবহমান। ফলে উপস্থিতকালের কবিদের রচনায় অতীতের মহৎ ও প্রধান কবিদের ছায়া পড়ে। কখনো প্রচ্ছন্ন, কখনো প্রকটভাবে। তবে বিভিন্ন যুগের কবিতায় ঐকতান রক্ষা আকস্মিকভাবে ঘটে না, এ জন্য কবিদের বিপুল প্রস্তুতি ও অতীতের কবিতা আত্মস্থ করতে হয় উপস্থিতকালের কবিকে। ব্যত্যয়ে কেবল অনুকরণের ঘটনা-ই ঘটে, ঐতিহ্য রক্ষা হয় না। কিন্তু সাম্প্রতিক কবিতার দিকে তাকালে বিপুল প্রস্তুতি, পঠনপাঠন ও আত্মমগ্ন হওয়ার চেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজাত শব্দসমবায় সৃষ্টির প্রমাণ মেলে বেশি।
তাৎক্ষণিকতায় আক্রান্ত কবিযশপ্রার্থীদের সহজে বিজ্ঞপিত//// হওয়ার কাক্সক্ষা থাকে। এ কারণে তারা সাধনার অরণ্যে হাঁটে না, খোঁজে সংক্ষিপ্ত এবং তাৎক্ষণিকতার সংকীর্ণ পথ। এবং এই সংকীর্ণ পথ বেয়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য তারা নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেয়। এগুলো হলোÑ
১. ছন্দ উচ্ছেদের সচেতন প্রয়াস
২. গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব
৩. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজাত শব্দসমবায় সৃষ্টি
৪. যৌনতার প্রাধান্য
৫. বিষয়হীনতা
এই প্রবণতাগুলো এ সময়ের প্রায় কবিযশপ্রার্থীর রচনায় উপস্থিত। এর পেছনে মূল কারণ হলোÑ কবিতা লিখিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠপ্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ; নগদ হাততালি। এ সুযোগগুলো ঘটে দুইভাবে। প্রথমত ফেসবুক নির্ভর, দ্বিতীয়ত ব্লগ ও অনলাইনভিত্তিক কবিতাচর্চা। যাঁরা ন্যূনতম সাধনা ছাড়াই পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার স্বাদ পেতে চান, তাঁরা যে-েকোনো মুহূর্তের রচনাকেই ফেসবুকের নোটে কিংবা ব্লগে পোস্ট করতে পারেন। তাতে ফেসবুক বন্ধু এবং ব্লগারদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এসব প্রতিক্রিয়া সাধারণ ‘অসাধারণ’, ‘চমৎকার’, ‘বেশ হয়েছে’ ধরনের প্রশংসাসর্বস্ব হয়ে থাকে। আর এই নগদ হাততালিকে ফেসবুক-ব্লগার লেখকেরা শিল্পসিদ্ধির স্বীকৃতি ভেবে বছর না ঘুরতেই বই আকারে প্রকাশ করছেন। এসব বই আবার ফেসবুক বন্ধু-ব্লগাররা কিনছেন। তাতে হয়তো বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ উঠে আসছে, কিন্তু কবি, কবিতা ও পাঠকের তাতেই ক্ষতির মাত্রা বাড়ছে দিন দিন। ফেসবুক-ব্লগ কবিতাবিলাসীদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠীপ্রীতি অন্য যে-কোনো মাধ্যমের চেয়ে বেশি; এবং ভয়াবহ। ফেসবুকে ও ব্লগকেন্দ্রিক একেক জন দাদা বা বড় ভাই বা গুরু থাকেন। তিনি যখন কোনো একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিধত স্ট্যাটাস পোস্ট করেন তাঁর ওয়ালে, তখন অনুসারীরা তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করে কমেন্ট করতে থাকেন। কেউ যদি ওই দাদা বা গুরুর কমেন্টের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেন, তাহলে তাঁর অনুসারীরা তাঁকে তুলোধোধূনো করে ছাড়েন। এভাবে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করেন ফেসবুক-ব্লগকেন্দ্রিক কবিরা। এসব কবির রচনার আদৌ কোনো শিল্পগুণ আছে কি না, তা পরিষ্কস্কার বোঝা যায় না। উদ্দেশ্যহীন ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাকচাতুর্যের সমবায়ে তাঁদের রচনার শারীরিক আকার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফেসবুক বা ব্লগে কোনো সেন্সরশিপ না থাকায় ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগাররা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেন। ফলে কোনো রকম নিয়ম-নীতি না মেনেই যা ইচ্ছা লিখে পোস্ট করেন। আর ওই পোস্টে একের পর লাইক-কমেন্ট পড়তে থাকে সমমনা ও অনুসারীদের। ওই লাইক-কমেন্টের সংখ্যাকে এসব কবি তাঁদের কবিতার জনপ্রিয়তার মাপকাঠি ভেবে বসে তৃপ্তি পান। এই তৃপ্তি কারও কারও জন্য আত্মশ্লাঘার কারণ হয়ে উঠলেও অধিকাংশই নিজের ভুল সহজে উপলব্ধি করতে পারে না।
ছন্দ কবিতা নয়, ছন্দহীন রচনাও কবিতা নয়। ছন্দ কবিতার একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ, যেমন মানবদেহে রক্তের চলাচল। কিন্তু ব্লগার বা ফেসবুক আসক্তরা দ্রুত বাহ্বা পান বলে ছন্দহীন রচনাকে যেমন কবিতা হিসেবে গ্রহণ করছেন, তেমনি ছন্দহীন প্রগলভতার চর্চায়ও উৎসাহী হয়ে উঠছেন। এভাবে তাঁরা নিজেদের রচনার পাঠক, প্রকাশক নিজেরা হয়ে ওঠার ফলে কাব্যবোদ্ধাদের স্বীকৃতির বিষয়কে গৌণ করে দেখছেন তারা। তোয়াক্কা করছেন না সাহিত্যবোদ্ধা পাঠক-সমালোচকের মতামতের। নিজেদের রচনাকে নিজেরা স্বীকৃতি দিচ্ছেন, নিয়ম-কানুন কিছুই না জেনে। ছন্দ এবং কবিতার প্রকরণ সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ ধারণা ছাড়াই ঘোষণা করছেন ছন্দ না মানার এবং প্রকরণ ভাঙার। এ শ্রেণীর কবিরা øবরি ও স্টান্টবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন সহজে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। একগোষ্ঠীর রচনাকে অন্য গোষ্ঠী করছেন অস্বীকার। আবার নিজেদের যেনতেন প্রকারেণ রচনা মাত্রকেই কবিতা-কবিতা বলে ঢেঁকুর তুলছেন হামেশাই। এই ভার্চুয়াল জগৎ সম্পূর্ণ অ্যাক্টিভিস্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় পৃথিবীর যে-কোনো ঘটনা তাঁরা তাৎক্ষণিক জানার সুযোগ পানয়।
কোনো একজন প্রথম কোনো একটি বিশেষ ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে ব্লগ কিংবা ফেসবুকে পোস্ট করেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্য ব্লগাররা কিংবা ফেসবুক বন্ধুরা ওই ঘটনা জানতে পারেন। এ ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজাত রচনার সাড়া মেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভার্চুয়াল জগতের কবিযশপ্রার্থীরা লিখে ফেলেন তাৎক্ষণিক কবিতা। ওই কবিতাগুলো সমকালীন বিষয়কেন্দ্রিক বলে এগুলোর এক ধরনের সংবাদ মূল্যও রয়েছে। ফলে যতটা না সাহিত্যমূল্য, তারও বেশি সংবাদমূল্য পায় অ্যাক্টিভিস্টদের কাছে। এই অ্যাক্টিভিস্টরা নিজেরা নিজেদের যেনতেন প্রকারেণ রচনা নিয়ে তর্ক-কূটতর্কের অবতারণা করেন ভার্চুয়ালি, সে তর্ক-কূটতর্ককে তাঁরা ধরে নেন তাঁদের রচনার গ্রহণযোগ্যতা হিসেবে। ফলে মূলধারার সাহিত্যবোদ্ধাদের মতকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতেই দেখেন তাঁরা। ভার্চুয়াল জগতের অনেকের রচনা নির্দিষ্ট বিষয়হীন হলেও যৌনতার প্রাধান্য স্পষ্ট। মানুষকে আকৃষ্ট করার সহজতম পথ যৌনতা।
ব্লগার ও ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট কবিযশপ্রার্থীদের অনেকেই এই যৌনতাকেই কবিতাচর্চার মূল নিয়ামক ভেবে বসে আছেনÑ যৌক্তিক কারণও আছে। কারণÑ মানুষের চিন্তার এক বিপুল অংশজুড়ে রয়েছে যৌনচিন্তা। কবিতা কিংবা কোনো সৃজনশীল রচনায় যৌনতার প্রয়োগ থাকলে পাঠক তা সহজে গ্রহণ করে। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ওই ধরনের রচনা তাঁদের ভালো লেগে যায়। এই শ্রেণীর কবিযশপ্রার্থীদের কর্মের চেয়ে আত্মম্ভরিতা বেশি। তাঁরা মূল ধারার সাহিত্য সম্পর্কে প্রায় নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। এ কারণে প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত কবিতা কিংবা প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতার প্রতি তাঁদের কোনো আগ্রহ নেই। ভাবতে অবাক লাগে ভার্চুয়াল জগতের কবিদের অনেকেই হাজার বছরের বাংলা কবিতার উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো কবির মাত্র দুটো কি তিনটি কবিতাও পড়ে দেখে না। চ-ীদাস, বিদ্যাপতি, মাইকেল, রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান-আল মাহমুদের দুই- চারটা কবিতার নামও অনেকে জানেন না। বিষয়টা বিস্ময়ের যে তাঁরা কবিতা চর্চা করতে এসেও অগ্রজদের কবিতা পড়ে দেখেন না। তবে নিজেদের রচনার মান সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেন তাঁরা। অথচ এ কথাও মানতে নারাজ তাঁরাÑ তাঁদের রচনার মান এখনো হাঁটুর ওপরে উঠতে পারেনি, প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত কবিতাগুলোর মান নামতে নামতেও হাঁটুর ওপরেই আছে।
ব্লগে-ফেসবুকে যাঁরা লেখেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের মনে করেন কর্তৃত্বকারী, তাঁরা অনুসারীদের নানা ধরনের রচনাকে জড়ো করে সংকলন প্রকাশ করেন। এসব সংকলন যেমন অজস্র বানান ভুলে ভরা থাকে, তেমনি থাকে ভুল বাক্য ও ভুল তথ্যের পাহাড়ও। এই প্রজাতির সংকলকেরা যেমন কবিতায় ছন্দকে স্বীকার করেন না, তেমনি ভাষার ব্যবহারেও ব্যাকরণ মান্য করেন না। যা লেখেন তা প্রকাশ করাকেই জীবনের সিদ্ধি জানেন। এসব লেখা পড়লে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়, এই প্রজাতির লেখক-সংকলকেরা যেন মাতৃভাষাকে ধর্ষণ করার ব্রত নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে এসেছেন। ফলে যেমন খুশি লিখছেন। যেহেতু সংকলক এবং ব্লগের অ্যাএডমিনরা কোনো পঠনপাঠন কিংবা নিয়ম কানুনের ধার ধারেন না, সেহেতু নিজেদের অনুসারী কিংবা পছন্দের লোকদের যা পান তাই পত্রস্থ কিংবা পোস্ট করেন। সম্পাদনার নিয়ম-কানুনও তাঁদের মাননেত হয় না। অবশ্যই বর্তমানে অনেক দৈনিকলগ্ন সাহিত্যপাতার দায়িত্বপ্রাপ্তরাও সম্পাদনার ধার ধারেন না। তাঁরা খ্যাতিমান লেখক, প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা, সচিব, ব্যবসায়ী, ঠিকাদারদের অখাদ্য-কুখাদ্য পেলেই শুধু যে েেকানো দিক থেকে শব্দ সংখ্যা কমিয়ে পত্রস্থ করতে পারলেই চাকরিজীবন সার্থক মানেন। আর এসব ব্লগে যাঁদের লেখা পোস্ট হয়, তাঁরা এত বেশি আবেগে উদ্বেল থাকেন যে, একই রচনা একই সঙ্গে একাধিক ব্লগে পাঠানোর ভেতর আত্মতৃপ্তি খোঁজেন। কবিতার অনেক শত্রুর মধ্যে এই ব্লগ-ফেসবুক প্রভাবশালী মাধ্যম। দুর্বল লেখকের হাতে পড়লে যৌনতা যেমন পর্নোগ্রাফিতে পর্যবসিত হয়, তেমনি অপ্রস্তুত ব্লগারদের হাতে পড়ে বাংলা কবিতাও আজ খিস্তি-েখেউড়ে পরিণত হয়েছে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী?
সাহিত্যের ছোট কাগজ : কত দূর সুসম্পাদিত
মানবসভ্যতার সামগ্রিক অগ্রগতির নিয়ামক মানুষের চিন্তাশক্তি। এ শক্তির কল্যাণেই মানুষ অরাজক পরিস্থিতি ও চরাচরের সমস্ত অসুর শক্তিকে পরাজিত করে, জ্ঞানে-বুদ্ধিতে, প্রজ্ঞায়-মনীষায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে দৈবশক্তির ওপরও। যুক্তিহীন পেশিীশক্তির লড়াইয়ে যুগে-যুগে নগদ বিজয়ীর মুকুট পরেছে ক্ষমতাবানেরাই। যুক্তি সেখানে স্পর্ধার অভিযোগে পরাভূত হতে বাধ্য হয়েছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানবজীবনের নানা কুসংস্কারকে দূর করার ব্রত নিলেও বিজ্ঞানের সুবিধাভোগীরাও নিজেদের স্বার্থে মুক্তচিন্তার ধারকদের পদানত করার হীন েেচষ্টা করেছে। সে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সবাই মাথা তুলে দাঁঁড়াতে পারেনি, পেরেছিলেন দু-ই একজন। তাঁরা সে সব অবিচার ও কুসংস্কারকে ভেঙেচুরে নতুন বিশ্বাসের জš§ দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। জিয়োদার্নর্ো ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলি, সক্রেটিস, যিশু খ্রিস্ট থেকে শুরু করে সত্যসন্ধানী প্রত্যেক মহৎ প্রাণের লক্ষ্যই ছিল পরম সত্য প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিরন্তর নিয়োজিত রাখা।
আধুনিক সভ্যতার অন্যতম অবদান ছাপাখানা। সে ছাপাখানাও প্রথম দিকে সমাজপতি, পুরোহিত কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের আজ্ঞাবহ যন্ত্র ছিল কেবল। সময়ের বিবর্তনে সে ছাপাখানার কল্যাণে সংবাদপত্র ও সাহিত্য সাময়িকীর উšে§ষ ও বিকাশ লাভ করে। কিন্তু সেখানে দেখা গেল আরেক সমস্যা। সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলো কেবল প্রথা ও শক্তির পূজারিীতে পরিণত হতে লাগলো। তখন সৃষ্টিশীল মানুষের সামনে যে বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিল, তা হলো, ব্যক্তির কল্পনা ও চিন্তার সারাংশকে দার্ঢ্যরে সঙ্গে প্রকাশ করা কী করে সম্ভব? কেউ কেউ তখন উপলব্ধি করলেন যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতামুক্ত মতপ্রকাশের মাধ্যম আবিষ্কারের। হয়তো ওই চিন্তা থেকেই ছোট কাগজের সূচনা।
বড় কাগজ যা ধারণ করতে অক্ষম, ছোট কাগজ তারই প্রযতœ। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক কারণে বড় কাগজ সব সময় মুক্তচিন্তার পরিচর্যায় আন্তরিকতা ও সততা দেখাতে পারে না। সামাজিক মূল্যবোধের প্রশ্নে বড় কাগজ যে বিষয়কে আপত্তিকর বিবেচনা করে, ছোট কাগজ সে বিষয় প্রকাশে স্বতঃস্ফূর্ত। কোনো -কোনো রচনা দৈর্ঘ্যরে কারণে বড় কাগজের সৌন্দর্য হানি করে, ছোট কাগজের বাড়ায় শিল্পমান। ছোট কাগজ-বড় কাগজের সম্পর্ক বিরোধের নয়, ধারণক্ষমতার। বড় কাগজের মুখ্য উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। তাই যে বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে ভালো কাটতির সম্ভাবনা, বড় কাগজ সে দিকেই ঝোঁকে। গণরুচির প্রতি বড় কাগজের সমর্থন ও প্ররোচনা তাই প্রতিযোগিতামূলক। সমকালীন ঘটনাপুঞ্জকে পুঁজি করে জনমনে প্রভাব বিস্তার করার মতো উত্তাপ ধারণ করার সামর্র্থ্য বড় কাগজের রয়েছে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বড় কাগজ সাহিত্যচর্চারও উত্তম মাধ্যম। তবে বড় কাগজলগ্ন সাহিত্য পাতাটি যদি সুসম্পাদিত হয়। প্রচারসংখ্যা বেশি হওয়ায় বড় কাগজ মৌলিক চিন্তাধারার সংক্রমণে দ্রুত কার্যকর।
ছোট কাগজ ও বড় কাগজ-বিতর্কে ছোট কাগজকর্মীরা ছোট কাগজকে সাহিত্যের সূতিকাগার বলে দাবি করেন সব সময়। দাবিটা অযৌক্তিক নয়; অবাস্তব। অবাস্তব, কারণ, ছোট কাগজ নতুন কোনো লেখক প্রতিষ্ঠা না করে, মৌলিক চিন্তার প্রবর্তন ও পরিচর্যা না করে। সম্পাদনার চেয়ে সংকলনের দিকেই বেশি মনোযোগ অনেক ছোট কাগজকর্মীর। প্রায় দেখা যায়,Ñ ছোট কাগজগুলো বাজারি সাহিত্যসংকলনের প্রতিযোগী হয়ে উঠতে চায়। অথচ প্রকৃত ছোট কাগজের কিছু দায় পালন করা উচিত।
ছোট কাগজের মৌলিক দায় মোটামুটি এ রকম:
১. প্রথাগত রীতির বিপরীতে মৌলিক, যৌক্তিক ও নতুন চেতনার উদ্বোধন করা।
২. শিল্পমান অক্ষুণœ রেখে সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণের নিরীক্ষাকে প্রণোদিত করা।
৩. সত্য, সুন্দর ও শিল্পের প্রশ্নে আপসহীন থাকা।
৪. চাতুর্য ও ভাবালুতার বিপরীতে প্রজ্ঞা ও মনীষার পথে পরিভ্রমণ করা।
৫. হঠাৎ চিন্তার ঝলকানি নয়; ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা ও মননের পরিচর্যা।
৬. যেকোনো রকমের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করা।
৭. গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিপরীতে ঔদার্যের স্বাক্ষর থাকা।
৮. অপরিচিতকে পরিচিত এবং নতুনের আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেওয়া।
৯. লেখকের চেয়ে লেখার পরিচর্যা করা।
অনেক সময় ছোট কাগজ-সম্পাদক বড় কাগজের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বৃত্তাবদ্ধ অন্যান্য ছোট কাগজের সম্পাদককে প্ররোচিত করেন। পরস্পরের মধ্যে চলে এ নিয়ে গোপন আঁতাত। এরা প্রশংসা ভুলে স্তুতি, সমালোচনার পরিবর্তে নিন্দাবাক্যের প্লাবনে ভেসে যায়।
ছোট কাগজ কী? কী তার কর্মপরিধি? Ñপ্রশ্ন যত সহজ, উত্তর ততধিক কঠিন। কঠিন এ জন্য, ছোট কাগজ বলে প্রচলিত কাগজগুলোয় যে ধরনের কবিতা-গল্প-গদ্য-উপন্যাস পাওয়া যায়, সে ধরনের রচনার সাক্ষাৎ দৈনিকলগ্ন সাহিত্য পাতায়ও মেলে। স্বল্পদৈর্ঘ্য রচনাগুলো সাহিত্য পত্রিকাগুলোয়ও পাওয়া যায়। তাহলে ছোট কাগজের কাজ কী? যদি নতুন কোনো লেখককে উপস্থাপন করা না যায়, তাহলে ছোট কাগজের মূল্য কী? সুসম্পাদিত ছোট কাগজ কেবল লেখা পত্রস্থ করেই দায় সারে না, সঙ্গে পরিচর্যাও করে। যে কাগজ লেখা পাওয়ামাত্রই পত্রস্থ করে, সেটি ছোট কাগজ নয়; সংকলন। কর্ণধারও ছোট কাগজ সম্পাদক নন, সংকলক। সংকলক চলেন প্রথাগত পথে, ছোট কাগজ স্বসৃষ্ট পথে। এ দুয়ের পার্থক্য সুস্পষ্ট। তীক্ষè বোধসম্পন্ন না হলে ছোট কাগজ সম্পাদকের চলে না। কেবল প্রতিষ্ঠিত লেখকের তল্পিবাহক হলে ছোট কাগজের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
ছোট কাগজ সাহিত্যের সূতিকাগার, সাহিত্যিকের নয়। এখানে দ্যুতিময় রচনাটি প্রকাশিত হয়, খ্যাতিমান লেখক নন। যে কাগজে দ্যুতিময় লেখকের পূজা চলে, সে কাগজ ছোট কাগজ নয়। সে কাগজ ব্যক্তিবিশেষের পূজারি, ইশতেহার মাত্র। লেখক তৈরির পাশাপাশি সৎ-সমালোচনার ধারা সৃষ্টিতে সহযোগিতা করাও ছোট কাগজের কাজ। যুগের দায় মেটানোর বিপরীতে নতুন যুগ সৃষ্টিই এর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। প্রমথ চৌধুরী চারদিকের অস্বাস্থ্যকর সাহিত্যিক পরিবেশ থেকে ব্যথিত হয়েছিলেন বলেই ১৯১৪ সালে প্রকাশ করেন ‘সবুজপত্র’। এ কাগজটি প্রকৃতপক্ষে সবুজেরই অভিযাত্রার অধিক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। এ কাগজেই রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকর্ম প্রকাশিত। প্রথমজনের আশ্রয় নবায়ন-নিরীক্ষার; দ্বিতীয়জনের পরিচর্যার। সবুজপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল মননশীল গদ্য। প্রথাভাঙার জোয়ার দেখা দিয়েছিল। প্রমথ চৌধুরী সে জোয়ারের উদ্বোধক, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সহযাত্রী। ফলে প্রমথ চৌধুরীর গদ্যভাষায় রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে নবায়ন শুরু করেছিলেন, সময়ের স্রোত শনাক্ত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। সবুজপত্র একটি যুগের স্রষ্টা। কাগজটি থেকেই উঠে এসেছেন, একজন সম্পন্ন প্রমথ চৌধুরী, আরেক নতুন ও পরিবর্তিত রবীন্দ্রনাথ। ‘সবুজপত্র’ বাংলা ভাষার চেহারা পরিবর্তনের শ্রেষ্ঠতম কুশীলবও। সে হিসেবে সবুজপত্রও ছোট কাগজ; ‘বঙ্গদর্শন’ আর ‘সাধনা’ও।
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ (১৯২৬) ছোট কাগজ নয়? এ কাগজেই নজরুলের কালজয়ী সাহিত্য প্রকাশিত হয়। ‘শিখা’ (১৯২৭) পত্রিকায় মুক্তবুদ্ধি চর্চার আশ্রয় যতটা, ততটা সাহিত্যের প্রযতœ হয়ে ওঠেনি। বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘প্রগতি’ (১৯২৭) শিল্প-সাহিত্যে প্রথম বৃত্তাবদ্ধ চেতনার মূলে আঘাত করে সাফল্য অর্জন করে। যে সংগ্রাম শিখা শুরু করে, সে সংগ্রাম সাফল্য অর্জন করে প্রগতি প্রকাশের মাধ্যমে। শিখা মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানচর্চার কাগজ; প্রগতি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আশ্রয়। সঙ্গত কারণে শিখার চেয়ে প্রগতি দ্রুত প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়। অজয় ভট্টাচার্য ও অজিতকুমার গুহ সম্পাদিত ‘পূর্বাশা’? এ কাগজটি কি ভালো লেখার পরিচর্যা করেনি? কাগজটি ক্ষীণজীবী হওয়ায় কোনো সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ও ছোট কাগজ। কিন্তু যতটা বুদ্ধির আকর, ততটা প্রাণচাঞ্চল্য না থাকায় সংবেদ সৃষ্টি হয়নি।
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকাই প্রথম সার্থক ছোট কাগজ। যে কাগজটির জš§ই একটি দ্রোহ ও জিজ্ঞাসা থেকে। সে সঙ্গে ‘পরিচয়’ পত্রিকার নামও স্মর্তব্য। ‘পরিচয়’ অনেকটা গুণবিচারিী ছিল। বিশুদ্ধ সাহিত্যের সেবা করাই সে পত্রিকার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু নতুনকে আহ্বান করা, পরিচর্যা করার প্রথম দায়ভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। তাই ‘কবিতা’ পত্রিকাই প্রথম এবং সংজ্ঞাপূর্ণ ছোট কাগজ। বুদ্ধদেব বসুর পরিচর্যায়ই মূলত বাঙালির আধুনিকতারই বিকাশ সাধিত হয়েছিল। বিশেষত কবিতাকে দীক্ষিত পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য তাঁর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অনুসরণযোগ্য; অনুকরণীয়ও। বুদ্ধদেবে বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একঝাঁক কবির অভিষেক, উšে§ষ ও বিকাশের একক কৃতিত্বের দাবিদার ওই কাগজটি। যার তুল্য ছোট কাগজ পরবর্তীকালে আর প্রকাশিত হয়নি। ব্যতিক্রম পশ্চিম বঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’। ফজল শাহাবুদ্দিন সম্পাদিত ‘কবিকণ্ঠ’ প্রতিষ্ঠিতদের লেখায় পরিপূর্ণ। এদিক থেকে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ ব্যতিক্রম। এ কাগজে নতুনদের অবাধ বিচরণ লক্ষণীয়। ‘সমকাল’ বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার অভাব কিছুটা পূরণ করলেও ‘স্বাক্ষর’, ‘স্যাড জেনারেশন’, ‘কণ্ঠস্বর’ চমক দেখানোয়তেই ব্যস্ত ছিল। তবে ‘কণ্ঠস্বর’ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। কাগজটির সঙ্গে জড়িতরাই পরবর্তীকালে স্বমহিমায় ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন। কামাল বিন মাহতাব, একজন সাহিত্য অন্তঃপ্রাণ। তাঁর সম্পাদিত গল্পের ছোট কাগজ ‘ছোটগল্প’। ছোটগল্প চর্চার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল একটি ছোট কাগজ। সাহিত্যের পরিচর্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আনওয়ার আহমদ সম্পাদিত ‘কিছুধ্বনি’, ‘রূপম’, খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত ‘একবিংশ’, হেনরী স্বপন সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ’, আমিনুর রহমান সুলতান সম্পাদিত ‘অমিত্রাক্ষর’, এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত ‘লিরিক’, আক্তার হোসাইন সম্পাদিত ‘পঙ্ক্তিমালা’।
কিছু কিছু ছোট কাগজ যতটা সাহিত্যপ্রেমী, তারও বেশি বাণিজ্যিক। স্তাবকগোষ্ঠী লালনের প্রবণতাও লক্ষণীয়। এসব কাগজের গোষ্ঠীবদ্ধতা ভয়াবহ। বৃত্তের ক্ষুদ্রকে বৃহৎ, আর বৃত্তের বাইরের বৃহৎকে ক্ষুদ্রজ্ঞানে তাচ্ছিল্য করার স্বভাব এসব ছোট কাগজের মজ্জাগত। ফলে এ কাগজগুলো গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে প্রায়ই। এ কারণে অক্ষম লেখকদের মধ্যে পরশ্রীকাতরতার জš§ হয়। অন্যের সাফল্য দেখে তারা আঁতকে ওঠে। নিজেদের লেখার প্রভাব পাঠক-সমাজে পড়ে না বলে, তারা হয়ে ওঠে ক্রোধোš§ত্ত। শুরু করে বিভিন্ন ধরনের চাতুর্য। তারই অংশ হিসেবে প্রবর্তন করে পুরস্কার। পুরস্কার প্রদানের নিয়মটিও বেশ কৌতুকসর্বস্ব। আপনবৃত্তের নিকৃষ্টকে সমকালীন সাহিত্যের উদ্ধারকর্তা বলে প্রচারসহ পদক বিতরণেনর ব্যবস্থা থাকে সেখানে। সে পদক বিতরণের কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্তাবকদল লালন করে এসব ছোট কাগজ। স্তাবকদের কাজই হলোÑ সম্ভাব্যপদকযোগ্য অপচিন্তার স্তুতি করা। তারা ভুলে যায়, ‘লাগে না পদক খ্যাতি যদি থাকে লেখার শ্রাবণ’। এ পদক নিয়ে আরও পরিহাসপূর্ণ কাজ রয়েছে তাদেরÑ পদকবিনিময়। তাদের দুই দলের নাম হতে পারে, প্রলুব্ধক ও স্তাবক। প্রলুব্ধক স্তাবক দলের কাউকে পুরস্কৃত করলে, স্তাবক দল দ্বিগুণ সুদাসলে তা প্রত্যার্পণ করে।
আরেক ধরনের প্রবণতাও আছে। কিছু ছোট কাগজকর্মীর কাজ হলোÑ গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের মতো ঢাউস আকৃতির কাগজ করা। এ মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের সূত্র ধরে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের হিড়িক পড়ে। কত তুচ্ছ স্বার্থ চরিতার্থ করার হীন মানসিকতা যে থাকতে পারে, এসব কাগজ পাঠ করলেই Í তা টের পাওয়া যায়। বিশেষ সংখ্যায় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রচারের মোহটিও বেশ ফলাও করে প্রকাশ করে। ফলে বুঝতে বাকি থাকে না, বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্দেশ্য কী! মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের লেখকেরাও নির্বাচিত। সম্পাদকীয়তে রাজা-উজির মারার বুলি কপচাতে-কপচাতে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কাসুন্দি লিখে রীতিমতো অভিসন্দন্ধর্ভও প্রণয়ন করেন। আবার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে গিয়ে দৈনিকের শ্রাদ্ধ করতেও ছাড়েন না এসব কাগজের সম্পাদকেরা। অথচ বিশ হাজার টাকার কাগজ করতে গিয়ে বিজ্ঞাপন বাবদতই সংগ্রহ করেন, লাখ টাকার ওপরে। এ বিজ্ঞাপনগুলোও বহুজাতিক কোম্পানির করুণাভিক্ষা ছাড়া মেলে না। তাহলে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ কী? এ ধরনের প্রবণতা রাজধানীকেন্দ্রিক ছোট কাগজগুলোর ক্ষেত্রে ঘটে বেশি। এখন প্রশ্ন হলোÑ ছোট কাগজ যদি নতুন সাহিত্যের সূতিকাগারই হবে, তাহলে বিশেষ সংখ্যায় গবেষণাসর্বস্ব রচনা প্রকাশের উদ্দেশ্য কী?
অধিকাংশ ছোট কাগজ সম্পাদকই নিজে ছন্দ না জেনেই স্লোগান তোলেন ছন্দউচ্ছেদের। আঙ্গিক-প্রকরণে অনভিজ্ঞ, আহাদ দেখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার। এখন যত কবি, তত কাগজ, তত সম্পাদকও। পাঠকের দেখা মেলা ভার! এখন প্রশ্নÑ কারা লেখেন ছোট কাগজে? সরাসরি উত্তর হতে পারে, যাঁরা সম্পাদক, তাঁরা একের কাগজে অন্যে লেখেন। এ প্রকারে সম্পাদকে-সম্পাদকে আঁতাত চলে। এক সম্পাদক অন্য একটি কাগজকে বিশেষ মূল্যায়নের দৃষ্টিতে দেখলে, সে সম্মানিত সম্পাদকও পাল্টা তোষামোদি করেন। আবার পরস্পর দ্বন্দ্বেও লিপ্ত থাকতে দেখা যায় বিভিন্ন ছোট কাগজকে। একটি ছোট কাগজকে ঘিরে একটি গোষ্ঠী যখন কোনো বিশেষ মতবাদ বা চিন্তার পরিচর্যা করে, অন্য একটি ছোট কাগজ তাকে অস্বীকার করে ভিন্ন কোনো ধারাকে পরিচর্যা করে এবং অন্যদেরও পরিচর্যার প্ররোচনা দেয়।
শেষ পর্যন্ত ছোট কাগজ-বড় কাগজ বিতর্ক অনর্থক। প্রত্যেক মাধ্যমই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ও সার্থক। অংশত বৃত্তাবদ্ধও। সুসম্পাদিত হওয়ার পরও। সুসম্পাদনার জন্য হƒদয়ের ঔদার্য, সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণ ও বাঁক বদলের ইতিহাস সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা থাকা জরুরি। এর ব্যতিক্রমে কাদা ছোড়াছুড়ি, আত্মকলহ, আত্মপ্রেমই বড় হয়ে ওঠে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস : জীবন ও শিল্পের যৌথ পাঠ
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উপন্যাসে ব্যক্তির অন্তর্লোক-বহির্লোক পর্যবেক্ষণ ও চিত্রায়ণ করেন। কেবল আখ্যান বর্ণনায় যেমন তিনি অনীহ, তেমনি কাহিনির তারল্যেও। আখ্যান বর্ণনার সময় চরিত্র কিংবা গল্পের শরীরে কোনও অলঙ্কার চাপিয়ে দেন না তিনি। একেবারে নিরলঙ্কৃত তাঁর ভাষা। অথচ সামগ্রিকভাবে অলঙ্কৃত ভাষার চেয়ে আকর্ষণীয়। ঘটনার বর্ণনায় তাঁর রচনা সাংবাদিক প্রতিবেদন হয়ে ওঠে না। আবার পুঁথিকারের বয়ানও তাঁর লক্ষ্য নয়। সব মিলিয়ে সামাজিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তির অন্তর্জগতে কী অভিঘাত সৃষ্টি করে__তারই শৈল্পিক চিত্র ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’। প্রথম উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন। শহুরের রাজনীতির সঙ্গে গ্রামীণ পটভূমির সমান্তরাল চিত্র আঁকার প্রতি ইলিয়াস বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। চিলেকোঠার সেপাইয়ের মূল চরিত্র ওসমান এবং আনোয়ার। যদিও উপন্যাসের শুরু এবং শেষ রহমতউল্লাহর বাড়ির চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানের বিভিন্ন আচরণ ঘিরে, তবু তাকেই মূল চরিত্র বিবেচনা করা যায় না। ওসমান একটি অবদমিত চরিত্র, সে কেবল ঘটনার নীরব দর্শক এবং পর্যবেক্ষক মাত্র; ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কি সংঘটনে কোনও ভূমিকা রাখতে তাকে দেখা যায় না।
উপন্যাসের শুরু চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানের স্বপ্ন দেখার বর্ণনা দিয়ে। সে ওসমান দীর্ঘ দিন ধরেই অদমিত, যাপন করে অচরিতার্থ জীবন। একদিন দরজায় করাঘাত শুনে তার ঘুম ভেঙে গেলে উঠে বসে। দরজা খুলতেই সে যা শোনে, সে সংবাদ শোনার জন্য ওসমান প্রস্তুত ছিল না। তবু শুনতে হল, পুলিশের গুলিতে মারা গেছে একই বাড়ির ভাড়াটিয়া মকবুল হোসেনের ছেলে তালেব। তালেবের মৃত্যুই ওসমানকে টেনে নেয় গণ-আন্দোলনে। ওসমানের সঙ্গে যোগ দেয় ধীরে ধীরে আনোয়ার, শওকত, হাড্ডি খিজির ও জুম্মন। গণ-আন্দোলনে মহল্লাবাসীদের নেতৃত্ব দেয় যে, সে আলাউদ্দিন পাকিস্তানপন্থী বাড়িঅলা রহমত উল্লাহর ভাগ্নে। সুখে-দুঃখে একে অন্যের শুভাকাঙ্ক্ষী। রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে দুজন দুই মেরুর হলেও, পুঁজি আর শোষণের প্রশ্নে দুজন একই পন্থী। ছয় দফা আন্দোলনে যখন বাঙালি জেগে ওঠে, তখন আইয়ুব খানের ুদ্র সংস্করণ রহমতউল্লাহ ধরে উল্টো স্লোগান। আইয়ুবপন্থী রহমত উল্লাহ মরতে মরতেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায়, গণ-আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, মিছিলের জোরালো স্লোগানদাতা হাড্ডি খিজির পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়। গণ-আন্দোলনে ওসমানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে না পারা, রানুর প্রতি আকর্ষণের বাস্তব রূপ দিতে ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে যোগ হয় তার আন্দোলনের সহকর্মী নিম্নবর্গের হাড্ডি খিজিরের অপঘাতে মৃত্যুর অভিঘাত। সব মিলিয়ে ওসমানের শুরু হয় মনোবিকলন। হয়ে ওঠে অপ্রকৃতিস্থ।
আনোয়ার প্রাণের ডাকে ফিরে যায় গ্রামে। সেখানে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব হারানো প্রতিবাদের ভাষা তাকেও নাড়া দেয়। সে দেখে গ্রামেও শহরের রহমত উল্লাহর মতো, খয়বার গাজী হয়ে ওঠে আইয়ুব খানের গ্রামীণ সংস্করণ। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির ছয় দফা আন্দোলনে দেশবাসী জেগে উঠেছে। সে আন্দোলনে শহরে বাধা হয়ে দাঁড়ায় রহমত উল্লাহ। তাই তার গ্যারেজ লুট করতে উদগ্র হাড্ডি খিজিরের নেতৃত্বে রিকশাচালকের দল। গ্রামেও সমান দৃশ্যের অবতারণা__ খয়বার গাজীর লোক হোসেন আলী ফকির গ্রামের মানুষের গৃহপালিত পশু নিয়ে নদীর বুকে ধারাবর্ষা চরে বেঁধে রাখে। গ্রামের গরিব মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সে পশু ফেরত দেয়। এনিয়ে কেউ প্রতিবাদের সাহসও পায় না। আনোয়ারের উপস্থিতিতেই হোসেন আলী ফকিরকেও আগুনে পুড়ে মরতে হয়। তারপর গ্রামের করমালি, আলীবক্স, চেংটু মিলে তৈরি করে গণ-আদালত। সেই গণ-আদালতে মানুষ হত্যা ও অন্যের জমি জবরদখলের অভিযোগ খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। কিন্তু ধর্মের অজুহাতে চিরকাল ভণ্ডরা যেমন মানুষকে বোকা বানিয়ে ন্যায়বিচারকে করেছে কলঙ্কিত, এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটে না। খয়বার গাজী মৃত্যুদণ্ড থেকে মার্জনা চায় না, তবে জুমার নামাজ পড়ার আগ্রহ দেখায়। ঘটনাক্রমে গ্রামেও গণ-আন্দোলনের হাওয়া লাগে। সেখানেও পৌঁছে যায় ছাত্রদের মিছিল। সঙ্গে জনসভায় যোগ দেওয়ার আহ্বানও। একদিকে জাতীয় স্বার্থে ছাত্রদের ডাকা জনসভা, অন্যদিকে গ্রামীণ জনপদে জোতদার উচ্ছেদের বিচারব্যবস্থা। শেষ পর্যন্ত বিচার বিলম্বিত হয়। সুযোগ পেয়ে খয়বার গাজী পালিয়ে যায়। এর জন্য বিচারপ্রার্থীরা আনোয়ারকে দায়ী করে। আনোয়ার কোনও উত্তর দিতে পারে না। খয়বার গাজীর আশীর্বাদপুষ্ট আনোয়ারের ফুফা জালাল মাস্টার খয়বার গাজীর বেঁচে যাওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব দিতে চায় আনোয়ারকেই। জালাল মাস্টার উভয়কূলই রক্ষা করতে চায়। বিব্রত হয় আনোয়ার।
////ওসমান যেখানে নিষ্ক্রিয়, আনোয়ার সেখানে সক্রিয়। আনোয়ারের ভূমিকা ঢাকা থেকে সে গ্রাম পর্যন্ত তার যাতায়াত। তার কাজের পরিধিও শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে শহরের চলমান গণ-আন্দোলনে তার তেমন ভূমিকা না থাকলেও তার উপস্থিতিতে গ্রামের চেংটু, আলীবক্সরা মনে সাহস পায়। তারা জোতদার উচ্ছেদে অগ্রসর হয়। ওসমান রহমত উল্লাহ, আলাউদ্দিন মিয়ার স্বার্থের মারপ্যাঁচের ভেতর একজন হাড্ডি খিজিরকে অপঘাতে মারা যেতে দেখে, দেখে জুম্মনের মাকে স্বামীর জন্য ব্যথিত না হয়ে বাড়িঅলা মহাজন রহমতউল্লাহহর দাসত্ব করে তৃপ্তি পেতে। জুম্মনের মা কেবল শক্তি ও টাকার খেলা দেখে। তার কাছে বর্তমান স্বামী হাড্ডি খিজির যেমন, তালাক দেওয়া কামরুদ্দিন তেমন। কারও জন্য তার আলাদা কোনও প্রেম নেই।
শহরের হাড্ডি খিজিরের সমান্তরাল চরিত্র গ্রামের চেংটু। দুই জনেরই অপঘাতে মৃত্যু ঘটে, দুই জনই সংগ্রামে সক্রিয় এবং উচ্চকণ্ঠের কর্মী। এরা কোনও ক্রমেই লাভতির প্রশ্নে হিসেবিী নয়। মানবমঙ্গল এবং দেশের স্বাধীনতা ও গ্রামের শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই তাদের ল্য। হাড্ডি খিজির যেমন আইয়ুব খান উৎখাতের আন্দোলনে নেমে, তারই এদেশীয় দালাল রহমত উল্লার ধ্বংস কামনা করে, তেমনি চেংটুও খয়বার গাজীর মৃত্যু কামনা করে। শেষ পর্যন্ত তারা দুজনেই মতার কাছে পরাজিত হয়, প্রাণ হারায় অপঘাতে। এ চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে চিরকালীন বৈষম্য ফুটে ওঠে। মানবসমাজের স্তর বিন্যাসে দুর্বল চিরকালই সবলের কাছে মার খেয়েছে। এই নিুবর্গের মানুষদের শক্তিকে পুঁজি করে, অপোকৃত ধনীরা, পুঁজিপতিরা এবং জোতদাররা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে। প্রয়োজনের সময় নিুবর্গের মানুষের সঙ্গে বর্ণচোরা মধ্যবিত্ত সমাজ প্রতারণা করে এসেছে।
‘খোয়াবনামা’ ইলিয়াসের দ্বিতীয় উপন্যাস। সম্পত্তির রায় কৌশল হিসেবে গ্রামের জোতদারদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার মানুষ লালন করে বাধ্য হয়ে। জোতদার আর জমিদারদের তৈরি মিথকেই সাধারণ মানুষের মানতে হয় স্রষ্টার দেওয়া শাস্তি বলে। তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, অশরীরিী কোনও জীব এসে তাদের বিভিন্ন কাজে বাধা দেয়। তারা বঞ্চিত থাকে নিজেদের প্রাপ্য থেকে। তার চিত্র খোয়াবনামায় বর্ণিত কাৎলাহার বিল, বহুকাল আগের কোনও এক ফকিরের কাৎলাহার বিল রার জন্য তার ভৌতিক উপস্থিতি। তমিজের বাপের কাৎলাহার বিলে মাছ ধরতে যাওয়া এবং সেখানে ফকিরের আবিভর্ভাব এসবই জমিদার জোতদারদের সম্পত্তি গ্রাসের মোম উপায় মাত্র। সাধারণ মানুষ যুক্তি মানে কম, মানে বেশি কুসংস্কার। তাদের বিশ্বাসের খুঁটি খুব শক্ত। বাস্তবের গুলির চেয়ে তাদের বেশি ভয় ভূভুতের ঘাড় মটকে দেওয়ায়। তাই তারা বল্লম কি লাঠির সামনে বুকে চেতিয়ে দাঁড়ালেও, অন্ধকার নির্জন পথে পা বাড়াতে সাহস দেখায় না। এ উপন্যাসের কুলসুম এবং ফুলজান দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। প্রথম চরিত্র, তমিজের সৎ মা। যে বৃদ্ধ স্বামীর সঙ্গে অচরিতার্থ জীবনযাপন করে আর অবচেতন মনে কামনা করে সৎ ছেলের স্পর্শ। দ্বিতীয়জন প্রকাশ্যে তমিজকে মাঝির বেটা বলে তিরস্কার করলেও দেহমনে কামনা করে তাকেই। একসময় তমিজ ফুলজানকে বিয়ে করে সত্য, কিন্তু তার সংসার বেশিদিন করা হয় না, জমিদার শরাফত মণ্ডলের কৌশলের কাছে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। খাটতে হয় জেল। শেষ দৃশ্যে সর্বস্বান্ত হতে হয় ফুলজানকেও। আল্লাউদ্দিন দেশপ্রেমিক, পুঁজিবাদী এবং শোষক। তার শোষণের চিত্র সাধারণ্যে অস্পষ্ট, দেশপ্রেমের চিত্র প্রকাশ্য। গণ-আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পৃক্তিই প্রমাণ করে, দেশমুক্তির আন্দোলনে তার ভূমিকা গুরুত্ববহ।
চিলেকোঠার সেপাইয়ের লেখক কেবল আখ্যান বর্ণনা করেন, কোনও ঘটনায় তার ভূমিকা সেখানে গৌণ। প্রতিটি চরিত্রই সমান গুরুত্বে নিজ গন্তব্যে পৌঁছে যায়, অনিবার্য পরিণতির মতোই। ফলে লেখক গণ-আন্দোলনে প্রত্য ভূমিকা রাখতে না পারা ওসমানকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখতে পারে না। সে চেষ্টাও করে না। আনোয়ারকে নিষ্ক্রিস্ক্রয় করতে করতেও করে না। যদিও উপন্যাসের মূল স্রোত ও ঘটনার ঘূর্ণাবর্ত ওসমানকে ঘিরে, তবু কর্মচাঞ্চল্য এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রত্য অংশগ্রহণে আনোয়ারই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের নাম চিলেকোঠার সেপাই হওয়ায় চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানকেই দিতে হয় মূল নায়কের ভূমিকা। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার ভূমিকা স্বপ্নচারীর। যে স্বপ্ন তার অচরিতার্থ জীবনে, অবদমিত ইচ্ছার ভেতর দেয় কিঞ্চিৎ সুখ, সে স্বপ্নপ্রবণতাই তাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নেয় সংগ্রামের পথে। নিজেকে যথাসময়ে প্রকাশ করতে না পারার বেদনাবোধ তাকে এক সময় অপ্রকৃতিস্থ করে তোলে। ফলে অবচেতনে সে দেখে বুড়িগঙ্গার পানি আগুনে পরিণত হতে এবং সে আগুনে আইয়ুব খানের মতা ভিত নড়ে উঠতে।
খোয়াবনামার তমিজ পরিশ্রমী, সংগ্রামী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জোতদারের সঙ্গে টিকতে পারে না। চিলেকোঠার সেপাই এ প্রতিটি চরিত্র নিজের যোগ্যতায় চলাফেরা করে, চিন্তা করে আপনাপন বিচারবুদ্ধিতে। খোয়াবনামার চরিত্ররা চলাফেরা করেন লেখকের ইচ্ছায়। মাঝে-মধ্যে লেখক চরিত্রের সঙ্গে লীন হয়ে যাওয়ায় তাকেও উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মনে হয়। খোয়াবানামার চরিত্রগুলোর মূলত লেখকের ইচ্ছারই বাস্তবায়ন করে, নিজেরা স্বাধীনভাবে স্বপ্ন পর্যন্ত দেখে না। সাধারণ মানুষগুলো স্বপ্ন দেখে__ লাঙল যার জমি তার। তাদের সে স্বপ্ন উদ্বুদ্ধ করে মতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর কিছু মানুষকে। যারা মতায় যাওয়ার তারা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রাণ হারায় খেটে খাওয়া মানুষগুলো। এ দৃশ্য চিলেকোঠার সেপাইতেও বর্তমান।
দুটি উপন্যাসে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র এঁকেছেন ইলিয়াস, সঙ্গে শ্রেণীবৈষম্যও। নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও সম্পর্কের ধরন আঁকতে গিয়ে কোনও কল্পনার আশ্রয় নেননি। ফলে চরিত্রের সামাজিক মর্যাদা অনুসারেই তৈরি করেছেন সংলাপ। এসবের পাশাপাশি বর্ণিত আখ্যানের ধারাবাহিকতা এবং প্রবহমানতা রার প্রতিও লেখক যতœশীল। চিলেকোঠার সেপাই অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে একটি বিশেষ সময়ের দলিল। একটি দেশের গ্রামে ও নগরে যে ধরনের আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে তার চিত্র। অন্যদিকে খোয়াবনামা স্থান-কাল নির্বিশেষে মানবজাতির বিশ্বাস ও আচরণের যৌক্তিক, কল্পিত জীবনযাপনের আখ্যান।
ইলিয়াস জীবনকে দেখেছেন রূঢ় বাস্তবতার ভেতর। রূঢ় জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে উপন্যাসের ভাষাকে করে তুলেছেন ঝরঝরে। রূঢ় জীবনে যে মাঝে-মধ্যে রোমান্টিকতার আগমন ঘটে, সে রোমান্সের ভাষাও খুব পরিশীলিত। ফলে প্রেমের দৃশ্যেও খুব ভাবালুতা সর্বস্ব কোনও সংলাপ শোনা যায় না। সেখানে মনের সঙ্গে দৈহিক চাহিদারও গুরুত্ব সমান। চিলেকোঠার সেপাইয়ের মানুষগুলো নিজেদের প্রয়োজনে সংগ্রামে নামে, সাড়া দেয় গণ-আন্দোলনের ডাকে। গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া হাড্ডি খিজিরকে লেখক পুলিশের গুলিতে মারতে গেলেন কেন? তবে কি শেষ পর্যন্ত হাড্ডি খিজির বেঁচে থাকলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত? তার ভাবমূর্তি কি ওসমানকেও ছাড়িয়ে যেত? চিলেকোঠার বাসিন্দার মাহাÍ্য ম্লান হতে পারে সে শঙ্কায় কি লেখক সবচেয়ে প্রাণবন্ত চরিত্র হাড্ডি খিজিরের মৃত্যু নিশ্চিত করলেন অপঘাতে? আবার গ্রামের চেংটু প্রসঙ্গেও একই প্রশ্ন তোলা যায়। তার মৃত্যুও কি লেখকের ইচ্ছাধীন? এসবই একজন মনোযোগী পাঠকের নিছক প্রশ্ন মাত্র। গভীরভাবে ভেবে দেখলে উপলব্ধ হয়__ বিপ্লবে-সংগ্রামে এই হাড্ডি খিজির আর চেংটুরাই চিরকাল ঝাঁপিয়ে লাভ-লোকসার বিবেচনা না করেই। আলাউদ্দিন মিয়া এবং জালালউদ্দিন মাস্টাররা সব সময় রহমত উল্লাহ আর খয়বর গাজীদের মানসম্মানে কথা ভাবেন। তারও আগে ভেবে নেন, নিজেদের লাভ-তিও। ব্যর্থ বিপ্লবের ফলে আন্দোলনের বেঁচে যাওয়া করমালিরা বিচারের মুখোমুখি হয়, সফল বিপ্লবের ফল ভোগ করে আলাউদ্দিন মিয়া আর জালালউদ্দিন মাস্টাররাই।
খোয়াব নামার আখ্যানের সঙ্গে চরিত্রচিত্রায়ণন সুসামঞ্জস__ একথা অনস্বীকার্য। এ উপন্যাসের তমিজের বাপ এবং তমিজের পরিণতিও চিলেকোঠার সেপাইয়ের চেংটু, হাড্ডি খিজিরের মতোই। চিলেকোঠার সেপাইয়ের ওসমান অবদমিত, নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে না সে। কিন্তু খোয়াবনামার তমিজ নিজের ভালো লাগার কথা অকপটেই জানায় ফুলজানকে। ফলে ফুলজান এবং তমিজের প্রণয় পরিণয়ে রূপ পায়। ওসমান অদমিত এবং ভীরু হওয়ায় তার সঙ্গে রানুর কোনও সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় না। বরং রানুর ছোট ভাই রঞ্জুকে আহত করার দায়ে রানুর পুরো পরিবারই তাকে ঘৃণা করে একসময়। ওসমান বন্ধু আনোয়ার ছাড়া আর কারও সহানুভূতি পায় না। এমনকিী, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আলাউদ্দিন মিয়াও ওসমানের প্রতি কোনও ভালোবাসা দেখায় না। ইলিয়াস মানবজীবনের কঠিন ও বাস্তব চিত্র আঁকতে গিয়ে দেখিয়েছেন, সমাজের উঁচুতলার মানুষের সম্পর্ক নির্ণিীত হয়, সম্পদের মাপকাঠিতে। সম্পদই উঁচুতলার বাসিন্দাদের আÍীয়তা এবং মর্যাদারার সূত্র। তাই, যখন উত্তেজিত রিকশাচালকরা রহমত উল্লাহর গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে মিছিল করতে চায়, তখন আলাউদ্দিন রিকশাঅলাদের সে উদ্যোগকে স্বাগত জানায় না। ; বরং রিকশাঅলাদের উদ্যোমকে হঠকারী বলেই তার মনে হয়। আবার যখন গণ-আন্দোলনকারীদের জনসভায় হাড্ডি খিজির রহমতউল্লাহহহ দেশদ্রোহিতার বিবরণ দিতে চায়, তখন আলাউদ্দিন তাকে বাধা দেয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে গ্রামের খয়বার গাজীর বিচারেও। সবাই যখন খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার জন্য গণ-আদালতে রায় ঘোষণা করে, তখন জালাল উদ্দিন মাস্টার দেখেন সেখানে একজন মানিী লোককে অসম্মানের দৃশ্য।
উভয় উপন্যাসেই দেখা যায়, মানুষের সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং সে স্তরবিন্যাসে ধনীদরিদ্রের নানামুখী বৈষম্য। তবে ইলিয়াসের কৃতিত্ব এখানে যে কেবল আখ্যান বর্ণনার মধ্য দিয়ে একটি বিশাল পটভূমি তুলে ধরেন খোয়বনামায়। ব্যর্থ খোয়াব বা স্বপ্ন দেখে কেবল গরিব মানুষেরা, তাদের খোয়াবের ব্যাখ্যা তাদের জীবনে কখনও সফল হয় না। কিন্তু ধনীদের সব ধরনের স্বপ্নই পূরণ হয়। শরাফত মণ্ডল কেবল কাৎলাহার বিলের মালিকানার মিথ্যে স্বপ্নই দেখেন না, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য থানা পুলিশ থেকে শুরু করে ভৌতিক বিষয়-আশয় এবং ফকিরের আশ্রয়ও নেয়। ফলে গ্রামের গরিব মানুষেরা এক অশরীরিীর ভয়ে কাৎলাহার বিলে নিজেদের দাবি কখনও প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত শরাফত মণ্ডলই সেখানে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের কুসংস্কারকে ভিত্তি করে, ইলিয়াস চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে যেমন বটগাছের আদি বাসিন্দা জ্বিনের ভয় দেখা, তেমনি খোয়াব নামায় দেখায় মৃত ফকিরের বিল পাহারা দেওয়ার ভয়। আবার ধনীদরিদ্রের বৈষম্য, কংগ্রেস-মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব, দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সাধারণ মানুষ জোতদার উচ্ছেদ করে সম্পত্তির সুষম বণ্টনের শুধু স্বপ্নই দেখে না; প্রত্যয়ও ব্যক্ত করে। তাত্ত্বিকরা সম্পদের সুষম বণ্টনকে মার্কসবাদী চেতনা বলতে পারেন, বটগাছের জ্বিন, নদীর ভেতর ঘোড়ার ডাক কিংবা তমিজের বাপের ঘুমের ভেতর হাঁটা কিংবা কাৎলাহার বিলে ফকিরের আত্মার পাহারাকে জাদুবাস্তবতা বলতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যায্য পাওনার দাবি কিংবা ভূতপ্রেতের বিষয়-আশয়ও যদি বাঙালিকে পশ্চিম থেকে আমদানি করতে হয়, তাহলে তার নিজস্ব বলতে থাকল কী?
ইলিয়াসের সমস্ত সাহিত্যকর্ম বিবেচনা করলে দেখা যায়, চিলেকোঠার সেপাই প্রচল ধারার উপন্যাসের উন্নত সংস্করণ। খোয়াবনামা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার সৃষ্টি। চিলেকোঠার সেপাইয়ে লেখক পর্যবেক এবং কথক মাত্র; খোয়াবনামায় সর্বজ্ঞ। প্রকরণ বিবেচনায় বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তুলনা-প্রতিতুলনায় মার্কেজের ওয়ান হানড্রের্ন্ডেড ইয়ারস সলিচিউডের সঙ্গেই খোয়াবনামার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব। কিন্তু বিষয়বস্তু এবং পটভূমি বিবেচনায় এ উপন্যাসটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ‘চিলেকোঠা সেপাই’ লেখকের অধ্যয়ন, অনুশীলন এবং পরিশ্রমের ফল হলে ‘খোয়াব নামা’ কল্পনা ও প্রজ্ঞার স্বার। ইলিয়াস কেবল গল্প বো বুনেননি, গল্পকে করে তুলেছেন কালের দলিল। মানবজীবনকে চিত্রায়ণন করেছেন শিল্পের মোড়কে। তাঁর উপন্যাস মূলত জীবন ও শিল্পের যৌথপাঠ।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উপন্যাসে ব্যক্তির অন্তর্লোক-বহির্লোক পর্যবেক্ষণ ও চিত্রায়ণ করেন। কেবল আখ্যান বর্ণনায় যেমন তিনি অনীহ, তেমনি কাহিনির তারল্যেও। আখ্যান বর্ণনার সময় চরিত্র কিংবা গল্পের শরীরে কোনও অলঙ্কার চাপিয়ে দেন না তিনি। একেবারে নিরলঙ্কৃত তাঁর ভাষা। অথচ সামগ্রিকভাবে অলঙ্কৃত ভাষার চেয়ে আকর্ষণীয়। ঘটনার বর্ণনায় তাঁর রচনা সাংবাদিক প্রতিবেদন হয়ে ওঠে না। আবার পুঁথিকারের বয়ানও তাঁর লক্ষ্য নয়। সব মিলিয়ে সামাজিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তির অন্তর্জগতে কী অভিঘাত সৃষ্টি করে__তারই শৈল্পিক চিত্র ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’। প্রথম উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন। শহুরের রাজনীতির সঙ্গে গ্রামীণ পটভূমির সমান্তরাল চিত্র আঁকার প্রতি ইলিয়াস বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। চিলেকোঠার সেপাইয়ের মূল চরিত্র ওসমান এবং আনোয়ার। যদিও উপন্যাসের শুরু এবং শেষ রহমতউল্লাহর বাড়ির চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানের বিভিন্ন আচরণ ঘিরে, তবু তাকেই মূল চরিত্র বিবেচনা করা যায় না। ওসমান একটি অবদমিত চরিত্র, সে কেবল ঘটনার নীরব দর্শক এবং পর্যবেক্ষক মাত্র; ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কি সংঘটনে কোনও ভূমিকা রাখতে তাকে দেখা যায় না।
উপন্যাসের শুরু চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানের স্বপ্ন দেখার বর্ণনা দিয়ে। সে ওসমান দীর্ঘ দিন ধরেই অদমিত, যাপন করে অচরিতার্থ জীবন। একদিন দরজায় করাঘাত শুনে তার ঘুম ভেঙে গেলে উঠে বসে। দরজা খুলতেই সে যা শোনে, সে সংবাদ শোনার জন্য ওসমান প্রস্তুত ছিল না। তবু শুনতে হল, পুলিশের গুলিতে মারা গেছে একই বাড়ির ভাড়াটিয়া মকবুল হোসেনের ছেলে তালেব। তালেবের মৃত্যুই ওসমানকে টেনে নেয় গণ-আন্দোলনে। ওসমানের সঙ্গে যোগ দেয় ধীরে ধীরে আনোয়ার, শওকত, হাড্ডি খিজির ও জুম্মন। গণ-আন্দোলনে মহল্লাবাসীদের নেতৃত্ব দেয় যে, সে আলাউদ্দিন পাকিস্তানপন্থী বাড়িঅলা রহমত উল্লাহর ভাগ্নে। সুখে-দুঃখে একে অন্যের শুভাকাঙ্ক্ষী। রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে দুজন দুই মেরুর হলেও, পুঁজি আর শোষণের প্রশ্নে দুজন একই পন্থী। ছয় দফা আন্দোলনে যখন বাঙালি জেগে ওঠে, তখন আইয়ুব খানের ুদ্র সংস্করণ রহমতউল্লাহ ধরে উল্টো স্লোগান। আইয়ুবপন্থী রহমত উল্লাহ মরতে মরতেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায়, গণ-আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, মিছিলের জোরালো স্লোগানদাতা হাড্ডি খিজির পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়। গণ-আন্দোলনে ওসমানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে না পারা, রানুর প্রতি আকর্ষণের বাস্তব রূপ দিতে ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে যোগ হয় তার আন্দোলনের সহকর্মী নিম্নবর্গের হাড্ডি খিজিরের অপঘাতে মৃত্যুর অভিঘাত। সব মিলিয়ে ওসমানের শুরু হয় মনোবিকলন। হয়ে ওঠে অপ্রকৃতিস্থ।
আনোয়ার প্রাণের ডাকে ফিরে যায় গ্রামে। সেখানে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব হারানো প্রতিবাদের ভাষা তাকেও নাড়া দেয়। সে দেখে গ্রামেও শহরের রহমত উল্লাহর মতো, খয়বার গাজী হয়ে ওঠে আইয়ুব খানের গ্রামীণ সংস্করণ। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির ছয় দফা আন্দোলনে দেশবাসী জেগে উঠেছে। সে আন্দোলনে শহরে বাধা হয়ে দাঁড়ায় রহমত উল্লাহ। তাই তার গ্যারেজ লুট করতে উদগ্র হাড্ডি খিজিরের নেতৃত্বে রিকশাচালকের দল। গ্রামেও সমান দৃশ্যের অবতারণা__ খয়বার গাজীর লোক হোসেন আলী ফকির গ্রামের মানুষের গৃহপালিত পশু নিয়ে নদীর বুকে ধারাবর্ষা চরে বেঁধে রাখে। গ্রামের গরিব মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সে পশু ফেরত দেয়। এনিয়ে কেউ প্রতিবাদের সাহসও পায় না। আনোয়ারের উপস্থিতিতেই হোসেন আলী ফকিরকেও আগুনে পুড়ে মরতে হয়। তারপর গ্রামের করমালি, আলীবক্স, চেংটু মিলে তৈরি করে গণ-আদালত। সেই গণ-আদালতে মানুষ হত্যা ও অন্যের জমি জবরদখলের অভিযোগ খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। কিন্তু ধর্মের অজুহাতে চিরকাল ভণ্ডরা যেমন মানুষকে বোকা বানিয়ে ন্যায়বিচারকে করেছে কলঙ্কিত, এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটে না। খয়বার গাজী মৃত্যুদণ্ড থেকে মার্জনা চায় না, তবে জুমার নামাজ পড়ার আগ্রহ দেখায়। ঘটনাক্রমে গ্রামেও গণ-আন্দোলনের হাওয়া লাগে। সেখানেও পৌঁছে যায় ছাত্রদের মিছিল। সঙ্গে জনসভায় যোগ দেওয়ার আহ্বানও। একদিকে জাতীয় স্বার্থে ছাত্রদের ডাকা জনসভা, অন্যদিকে গ্রামীণ জনপদে জোতদার উচ্ছেদের বিচারব্যবস্থা। শেষ পর্যন্ত বিচার বিলম্বিত হয়। সুযোগ পেয়ে খয়বার গাজী পালিয়ে যায়। এর জন্য বিচারপ্রার্থীরা আনোয়ারকে দায়ী করে। আনোয়ার কোনও উত্তর দিতে পারে না। খয়বার গাজীর আশীর্বাদপুষ্ট আনোয়ারের ফুফা জালাল মাস্টার খয়বার গাজীর বেঁচে যাওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব দিতে চায় আনোয়ারকেই। জালাল মাস্টার উভয়কূলই রক্ষা করতে চায়। বিব্রত হয় আনোয়ার।
////ওসমান যেখানে নিষ্ক্রিয়, আনোয়ার সেখানে সক্রিয়। আনোয়ারের ভূমিকা ঢাকা থেকে সে গ্রাম পর্যন্ত তার যাতায়াত। তার কাজের পরিধিও শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে শহরের চলমান গণ-আন্দোলনে তার তেমন ভূমিকা না থাকলেও তার উপস্থিতিতে গ্রামের চেংটু, আলীবক্সরা মনে সাহস পায়। তারা জোতদার উচ্ছেদে অগ্রসর হয়। ওসমান রহমত উল্লাহ, আলাউদ্দিন মিয়ার স্বার্থের মারপ্যাঁচের ভেতর একজন হাড্ডি খিজিরকে অপঘাতে মারা যেতে দেখে, দেখে জুম্মনের মাকে স্বামীর জন্য ব্যথিত না হয়ে বাড়িঅলা মহাজন রহমতউল্লাহহর দাসত্ব করে তৃপ্তি পেতে। জুম্মনের মা কেবল শক্তি ও টাকার খেলা দেখে। তার কাছে বর্তমান স্বামী হাড্ডি খিজির যেমন, তালাক দেওয়া কামরুদ্দিন তেমন। কারও জন্য তার আলাদা কোনও প্রেম নেই।
শহরের হাড্ডি খিজিরের সমান্তরাল চরিত্র গ্রামের চেংটু। দুই জনেরই অপঘাতে মৃত্যু ঘটে, দুই জনই সংগ্রামে সক্রিয় এবং উচ্চকণ্ঠের কর্মী। এরা কোনও ক্রমেই লাভতির প্রশ্নে হিসেবিী নয়। মানবমঙ্গল এবং দেশের স্বাধীনতা ও গ্রামের শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই তাদের ল্য। হাড্ডি খিজির যেমন আইয়ুব খান উৎখাতের আন্দোলনে নেমে, তারই এদেশীয় দালাল রহমত উল্লার ধ্বংস কামনা করে, তেমনি চেংটুও খয়বার গাজীর মৃত্যু কামনা করে। শেষ পর্যন্ত তারা দুজনেই মতার কাছে পরাজিত হয়, প্রাণ হারায় অপঘাতে। এ চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে চিরকালীন বৈষম্য ফুটে ওঠে। মানবসমাজের স্তর বিন্যাসে দুর্বল চিরকালই সবলের কাছে মার খেয়েছে। এই নিুবর্গের মানুষদের শক্তিকে পুঁজি করে, অপোকৃত ধনীরা, পুঁজিপতিরা এবং জোতদাররা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে। প্রয়োজনের সময় নিুবর্গের মানুষের সঙ্গে বর্ণচোরা মধ্যবিত্ত সমাজ প্রতারণা করে এসেছে।
‘খোয়াবনামা’ ইলিয়াসের দ্বিতীয় উপন্যাস। সম্পত্তির রায় কৌশল হিসেবে গ্রামের জোতদারদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার মানুষ লালন করে বাধ্য হয়ে। জোতদার আর জমিদারদের তৈরি মিথকেই সাধারণ মানুষের মানতে হয় স্রষ্টার দেওয়া শাস্তি বলে। তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, অশরীরিী কোনও জীব এসে তাদের বিভিন্ন কাজে বাধা দেয়। তারা বঞ্চিত থাকে নিজেদের প্রাপ্য থেকে। তার চিত্র খোয়াবনামায় বর্ণিত কাৎলাহার বিল, বহুকাল আগের কোনও এক ফকিরের কাৎলাহার বিল রার জন্য তার ভৌতিক উপস্থিতি। তমিজের বাপের কাৎলাহার বিলে মাছ ধরতে যাওয়া এবং সেখানে ফকিরের আবিভর্ভাব এসবই জমিদার জোতদারদের সম্পত্তি গ্রাসের মোম উপায় মাত্র। সাধারণ মানুষ যুক্তি মানে কম, মানে বেশি কুসংস্কার। তাদের বিশ্বাসের খুঁটি খুব শক্ত। বাস্তবের গুলির চেয়ে তাদের বেশি ভয় ভূভুতের ঘাড় মটকে দেওয়ায়। তাই তারা বল্লম কি লাঠির সামনে বুকে চেতিয়ে দাঁড়ালেও, অন্ধকার নির্জন পথে পা বাড়াতে সাহস দেখায় না। এ উপন্যাসের কুলসুম এবং ফুলজান দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। প্রথম চরিত্র, তমিজের সৎ মা। যে বৃদ্ধ স্বামীর সঙ্গে অচরিতার্থ জীবনযাপন করে আর অবচেতন মনে কামনা করে সৎ ছেলের স্পর্শ। দ্বিতীয়জন প্রকাশ্যে তমিজকে মাঝির বেটা বলে তিরস্কার করলেও দেহমনে কামনা করে তাকেই। একসময় তমিজ ফুলজানকে বিয়ে করে সত্য, কিন্তু তার সংসার বেশিদিন করা হয় না, জমিদার শরাফত মণ্ডলের কৌশলের কাছে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। খাটতে হয় জেল। শেষ দৃশ্যে সর্বস্বান্ত হতে হয় ফুলজানকেও। আল্লাউদ্দিন দেশপ্রেমিক, পুঁজিবাদী এবং শোষক। তার শোষণের চিত্র সাধারণ্যে অস্পষ্ট, দেশপ্রেমের চিত্র প্রকাশ্য। গণ-আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পৃক্তিই প্রমাণ করে, দেশমুক্তির আন্দোলনে তার ভূমিকা গুরুত্ববহ।
চিলেকোঠার সেপাইয়ের লেখক কেবল আখ্যান বর্ণনা করেন, কোনও ঘটনায় তার ভূমিকা সেখানে গৌণ। প্রতিটি চরিত্রই সমান গুরুত্বে নিজ গন্তব্যে পৌঁছে যায়, অনিবার্য পরিণতির মতোই। ফলে লেখক গণ-আন্দোলনে প্রত্য ভূমিকা রাখতে না পারা ওসমানকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখতে পারে না। সে চেষ্টাও করে না। আনোয়ারকে নিষ্ক্রিস্ক্রয় করতে করতেও করে না। যদিও উপন্যাসের মূল স্রোত ও ঘটনার ঘূর্ণাবর্ত ওসমানকে ঘিরে, তবু কর্মচাঞ্চল্য এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রত্য অংশগ্রহণে আনোয়ারই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের নাম চিলেকোঠার সেপাই হওয়ায় চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানকেই দিতে হয় মূল নায়কের ভূমিকা। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার ভূমিকা স্বপ্নচারীর। যে স্বপ্ন তার অচরিতার্থ জীবনে, অবদমিত ইচ্ছার ভেতর দেয় কিঞ্চিৎ সুখ, সে স্বপ্নপ্রবণতাই তাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নেয় সংগ্রামের পথে। নিজেকে যথাসময়ে প্রকাশ করতে না পারার বেদনাবোধ তাকে এক সময় অপ্রকৃতিস্থ করে তোলে। ফলে অবচেতনে সে দেখে বুড়িগঙ্গার পানি আগুনে পরিণত হতে এবং সে আগুনে আইয়ুব খানের মতা ভিত নড়ে উঠতে।
খোয়াবনামার তমিজ পরিশ্রমী, সংগ্রামী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জোতদারের সঙ্গে টিকতে পারে না। চিলেকোঠার সেপাই এ প্রতিটি চরিত্র নিজের যোগ্যতায় চলাফেরা করে, চিন্তা করে আপনাপন বিচারবুদ্ধিতে। খোয়াবনামার চরিত্ররা চলাফেরা করেন লেখকের ইচ্ছায়। মাঝে-মধ্যে লেখক চরিত্রের সঙ্গে লীন হয়ে যাওয়ায় তাকেও উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মনে হয়। খোয়াবানামার চরিত্রগুলোর মূলত লেখকের ইচ্ছারই বাস্তবায়ন করে, নিজেরা স্বাধীনভাবে স্বপ্ন পর্যন্ত দেখে না। সাধারণ মানুষগুলো স্বপ্ন দেখে__ লাঙল যার জমি তার। তাদের সে স্বপ্ন উদ্বুদ্ধ করে মতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর কিছু মানুষকে। যারা মতায় যাওয়ার তারা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রাণ হারায় খেটে খাওয়া মানুষগুলো। এ দৃশ্য চিলেকোঠার সেপাইতেও বর্তমান।
দুটি উপন্যাসে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র এঁকেছেন ইলিয়াস, সঙ্গে শ্রেণীবৈষম্যও। নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও সম্পর্কের ধরন আঁকতে গিয়ে কোনও কল্পনার আশ্রয় নেননি। ফলে চরিত্রের সামাজিক মর্যাদা অনুসারেই তৈরি করেছেন সংলাপ। এসবের পাশাপাশি বর্ণিত আখ্যানের ধারাবাহিকতা এবং প্রবহমানতা রার প্রতিও লেখক যতœশীল। চিলেকোঠার সেপাই অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে একটি বিশেষ সময়ের দলিল। একটি দেশের গ্রামে ও নগরে যে ধরনের আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে তার চিত্র। অন্যদিকে খোয়াবনামা স্থান-কাল নির্বিশেষে মানবজাতির বিশ্বাস ও আচরণের যৌক্তিক, কল্পিত জীবনযাপনের আখ্যান।
ইলিয়াস জীবনকে দেখেছেন রূঢ় বাস্তবতার ভেতর। রূঢ় জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে উপন্যাসের ভাষাকে করে তুলেছেন ঝরঝরে। রূঢ় জীবনে যে মাঝে-মধ্যে রোমান্টিকতার আগমন ঘটে, সে রোমান্সের ভাষাও খুব পরিশীলিত। ফলে প্রেমের দৃশ্যেও খুব ভাবালুতা সর্বস্ব কোনও সংলাপ শোনা যায় না। সেখানে মনের সঙ্গে দৈহিক চাহিদারও গুরুত্ব সমান। চিলেকোঠার সেপাইয়ের মানুষগুলো নিজেদের প্রয়োজনে সংগ্রামে নামে, সাড়া দেয় গণ-আন্দোলনের ডাকে। গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া হাড্ডি খিজিরকে লেখক পুলিশের গুলিতে মারতে গেলেন কেন? তবে কি শেষ পর্যন্ত হাড্ডি খিজির বেঁচে থাকলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত? তার ভাবমূর্তি কি ওসমানকেও ছাড়িয়ে যেত? চিলেকোঠার বাসিন্দার মাহাÍ্য ম্লান হতে পারে সে শঙ্কায় কি লেখক সবচেয়ে প্রাণবন্ত চরিত্র হাড্ডি খিজিরের মৃত্যু নিশ্চিত করলেন অপঘাতে? আবার গ্রামের চেংটু প্রসঙ্গেও একই প্রশ্ন তোলা যায়। তার মৃত্যুও কি লেখকের ইচ্ছাধীন? এসবই একজন মনোযোগী পাঠকের নিছক প্রশ্ন মাত্র। গভীরভাবে ভেবে দেখলে উপলব্ধ হয়__ বিপ্লবে-সংগ্রামে এই হাড্ডি খিজির আর চেংটুরাই চিরকাল ঝাঁপিয়ে লাভ-লোকসার বিবেচনা না করেই। আলাউদ্দিন মিয়া এবং জালালউদ্দিন মাস্টাররা সব সময় রহমত উল্লাহ আর খয়বর গাজীদের মানসম্মানে কথা ভাবেন। তারও আগে ভেবে নেন, নিজেদের লাভ-তিও। ব্যর্থ বিপ্লবের ফলে আন্দোলনের বেঁচে যাওয়া করমালিরা বিচারের মুখোমুখি হয়, সফল বিপ্লবের ফল ভোগ করে আলাউদ্দিন মিয়া আর জালালউদ্দিন মাস্টাররাই।
খোয়াব নামার আখ্যানের সঙ্গে চরিত্রচিত্রায়ণন সুসামঞ্জস__ একথা অনস্বীকার্য। এ উপন্যাসের তমিজের বাপ এবং তমিজের পরিণতিও চিলেকোঠার সেপাইয়ের চেংটু, হাড্ডি খিজিরের মতোই। চিলেকোঠার সেপাইয়ের ওসমান অবদমিত, নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে না সে। কিন্তু খোয়াবনামার তমিজ নিজের ভালো লাগার কথা অকপটেই জানায় ফুলজানকে। ফলে ফুলজান এবং তমিজের প্রণয় পরিণয়ে রূপ পায়। ওসমান অদমিত এবং ভীরু হওয়ায় তার সঙ্গে রানুর কোনও সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় না। বরং রানুর ছোট ভাই রঞ্জুকে আহত করার দায়ে রানুর পুরো পরিবারই তাকে ঘৃণা করে একসময়। ওসমান বন্ধু আনোয়ার ছাড়া আর কারও সহানুভূতি পায় না। এমনকিী, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আলাউদ্দিন মিয়াও ওসমানের প্রতি কোনও ভালোবাসা দেখায় না। ইলিয়াস মানবজীবনের কঠিন ও বাস্তব চিত্র আঁকতে গিয়ে দেখিয়েছেন, সমাজের উঁচুতলার মানুষের সম্পর্ক নির্ণিীত হয়, সম্পদের মাপকাঠিতে। সম্পদই উঁচুতলার বাসিন্দাদের আÍীয়তা এবং মর্যাদারার সূত্র। তাই, যখন উত্তেজিত রিকশাচালকরা রহমত উল্লাহর গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে মিছিল করতে চায়, তখন আলাউদ্দিন রিকশাঅলাদের সে উদ্যোগকে স্বাগত জানায় না। ; বরং রিকশাঅলাদের উদ্যোমকে হঠকারী বলেই তার মনে হয়। আবার যখন গণ-আন্দোলনকারীদের জনসভায় হাড্ডি খিজির রহমতউল্লাহহহ দেশদ্রোহিতার বিবরণ দিতে চায়, তখন আলাউদ্দিন তাকে বাধা দেয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে গ্রামের খয়বার গাজীর বিচারেও। সবাই যখন খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার জন্য গণ-আদালতে রায় ঘোষণা করে, তখন জালাল উদ্দিন মাস্টার দেখেন সেখানে একজন মানিী লোককে অসম্মানের দৃশ্য।
উভয় উপন্যাসেই দেখা যায়, মানুষের সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং সে স্তরবিন্যাসে ধনীদরিদ্রের নানামুখী বৈষম্য। তবে ইলিয়াসের কৃতিত্ব এখানে যে কেবল আখ্যান বর্ণনার মধ্য দিয়ে একটি বিশাল পটভূমি তুলে ধরেন খোয়বনামায়। ব্যর্থ খোয়াব বা স্বপ্ন দেখে কেবল গরিব মানুষেরা, তাদের খোয়াবের ব্যাখ্যা তাদের জীবনে কখনও সফল হয় না। কিন্তু ধনীদের সব ধরনের স্বপ্নই পূরণ হয়। শরাফত মণ্ডল কেবল কাৎলাহার বিলের মালিকানার মিথ্যে স্বপ্নই দেখেন না, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য থানা পুলিশ থেকে শুরু করে ভৌতিক বিষয়-আশয় এবং ফকিরের আশ্রয়ও নেয়। ফলে গ্রামের গরিব মানুষেরা এক অশরীরিীর ভয়ে কাৎলাহার বিলে নিজেদের দাবি কখনও প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত শরাফত মণ্ডলই সেখানে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের কুসংস্কারকে ভিত্তি করে, ইলিয়াস চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে যেমন বটগাছের আদি বাসিন্দা জ্বিনের ভয় দেখা, তেমনি খোয়াব নামায় দেখায় মৃত ফকিরের বিল পাহারা দেওয়ার ভয়। আবার ধনীদরিদ্রের বৈষম্য, কংগ্রেস-মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব, দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সাধারণ মানুষ জোতদার উচ্ছেদ করে সম্পত্তির সুষম বণ্টনের শুধু স্বপ্নই দেখে না; প্রত্যয়ও ব্যক্ত করে। তাত্ত্বিকরা সম্পদের সুষম বণ্টনকে মার্কসবাদী চেতনা বলতে পারেন, বটগাছের জ্বিন, নদীর ভেতর ঘোড়ার ডাক কিংবা তমিজের বাপের ঘুমের ভেতর হাঁটা কিংবা কাৎলাহার বিলে ফকিরের আত্মার পাহারাকে জাদুবাস্তবতা বলতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যায্য পাওনার দাবি কিংবা ভূতপ্রেতের বিষয়-আশয়ও যদি বাঙালিকে পশ্চিম থেকে আমদানি করতে হয়, তাহলে তার নিজস্ব বলতে থাকল কী?
ইলিয়াসের সমস্ত সাহিত্যকর্ম বিবেচনা করলে দেখা যায়, চিলেকোঠার সেপাই প্রচল ধারার উপন্যাসের উন্নত সংস্করণ। খোয়াবনামা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার সৃষ্টি। চিলেকোঠার সেপাইয়ে লেখক পর্যবেক এবং কথক মাত্র; খোয়াবনামায় সর্বজ্ঞ। প্রকরণ বিবেচনায় বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তুলনা-প্রতিতুলনায় মার্কেজের ওয়ান হানড্রের্ন্ডেড ইয়ারস সলিচিউডের সঙ্গেই খোয়াবনামার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব। কিন্তু বিষয়বস্তু এবং পটভূমি বিবেচনায় এ উপন্যাসটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ‘চিলেকোঠা সেপাই’ লেখকের অধ্যয়ন, অনুশীলন এবং পরিশ্রমের ফল হলে ‘খোয়াব নামা’ কল্পনা ও প্রজ্ঞার স্বার। ইলিয়াস কেবল গল্প বো বুনেননি, গল্পকে করে তুলেছেন কালের দলিল। মানবজীবনকে চিত্রায়ণন করেছেন শিল্পের মোড়কে। তাঁর উপন্যাস মূলত জীবন ও শিল্পের যৌথপাঠ।
বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব
বাংলা সাহিত্যে মতাদর্শবাদীরা কালক্রমে ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রোপটে মতান্ধে পরিণত হয়ে যায়। মতবাদীরা মূলত পশ্চিমের কিশে হয়ে আসা বিভিন্ন তত্ত্বকেই জ্ঞানচর্চার অনুষঙ্গ ভেবে সে পথেই নিজেদের মেধা ও প্রতিভার বিপুল অপচয় ঘটান। সে সঙ্গে তাদের অন্ধঅনুসারীগোষ্ঠীর স্তুতিকেই নিজেদের জীবনের চরম সার্থকতা মনে করে আত্মরতিতে ভোগে। এরা প্রকৃতপে চরম প্রতিক্রিয়াশীল। পোশাক পরে প্রগতিবাদের। এদের অন্তরে প্রতিক্রিয়াশীলতা, মুখে প্রগতিবাদের বুলি। কার্যত এরা ‘প্রতিক্রিয়াশীল প্রগতিবাদী’। এ ‘প্রতিক্রিয়াশীল প্রগতিবাদী’রা মূলত প্রগতিবাদী তত্ত্বের দোহায় দিয়ে বিকৃত ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার সারাংশ দিয়েই বাংলার মানবতাবাদী ও সর্বপ্রাণবাদী চিন্তার ভরকেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এ মতবাদীদের ভাষ্যমতে সর্বপ্রাণবাদ কথাটিও নাকি পশ্চিমের আবিষ্কার। গৌতম বুদ্ধ’র ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এবং স্বামী বিবেকানন্দ’র ‘জীবে দয়া করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’ এর মতো সর্বপ্রাণবাদী অমোঘ উচ্চারণও নাকি তারা কোনওকালেও শোনেনি। এরা লালনের আরশি নগর না চিনলেও দেরিদার ‘বিনির্মাণবাদ’ ঠিকই চেনে। এ ধরণের মতাদর্শবাদীরা মূলতঃ সাহিত্যের গুণবিচারবিরোধী।
সাহিত্যের নির্দিষ্ট শ্রেণীবিভাজনের েেত্র বিভিন্ন মতবাদের প্রবর্তক ও চর্চাকারীর জন্য কষ্টসহিষ্ণু চিত্তের অধিকারী ও জীবনের বিশেষ অংশে বিশেষ ঘাত-প্রতিঘাতের প্রয়োজন। সে অর্জন ‘প্রতিক্রিয়াশীলপ্রগতিবাদী’দের নেই। মতান্ধদের দলীয় মনোবৃত্তিও বাংলা সমালোচনাসাহিত্যকে কলুষিত করে। কে কোন দলের সঙ্গে জড়িত, কে কোন দলের সমর্থক এ নিয়ে বিপুল বিতর্ক! কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। এ দল যদি প্রতিক্রিয়াশীল, ও দল তাহলে প্রগতিবাদী। এ দল যদি ধর্মনিরপেতার ধ্বজাধারী, ও দল তাহলে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিক। এ দলাদলির রেষারেষিতে পড়ে প্রকৃত সাহিত্যের অবমূল্যায়ণ হয়। সাহিত্যিক পরিচয়ের চেয়ে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত পরিচয়ই তখন বড় হয়ে ওঠে। তার জন্য কবি ও সাহিত্যিকদের ভূমিকাও কম দায়ী নয়। সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মকর্মের প্রসঙ্গ গুলিয়ে ফেলে যারা ধর্মীয় পরিচয়কে ছাড়িয়ে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না, তারাই নিছক ধর্মকর্মের বিষয়টি ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে। ফলে কবি কিংবা কথাশিল্পী নয়, একজন সম্পন্ন মানুষ নয়, বিশেষ ধর্ম ও মতান্ধ হিসেবেই আত্মপ্রসাদ লাভ করে এবং ব্যক্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। আমাদের রাজনীতিক ও ধর্মবিশেষজ্ঞদের মনে রাখা উচিৎ, ধর্মনিরপেতার মানে যেমন ধর্মহীনতা নয়, তেমনি সকল ধর্মের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানও নয়। বরং সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু মনোভাবসমেত নিস্পৃহ মনোভাবপোষণ করা। অথচ এখানে সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণের কথা প্রচার করা হয়। একই ব্যক্তির পে কী করে সম্ভব পরস্পর বিপরীত মতাদর্শের প্রতি সমান বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন? ধর্ম প্রাইভেট বিষয়, তাকে পাবলিক বিষয়ে পরিণত করার অর্থই হলো মানবতার প্রতি অপমানের বৃদ্ধাঙ্গুলি উত্তোলন করা। যে ভুল সমকালীন বাংলাসাহিত্যে কেউ কেউ অহরহই করে। এভাবেই কবি-সাহিত্যিকের ভুলের কারণে এবং মতান্ধের মনোবৃত্তির কারণে, শুধু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক পরিচয়ের অজুহাতে অনেক বড় শিল্পীও একশ্রেণীর সমালোচকের কাছে অস্পৃশ্য। এসব মতান্ধের কি একবারও মনে হয় না, শিল্পের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক, তাদের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক মানবতাবিরোধিতার সামিল? ন্যায়বোধ ও রুচিবোধের প্রশ্নে বাঙালি জাতির সঙ্গে তারা লুকোচুরি খেলছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রগতিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দলে বিভক্ত সাহিত্যসমাজ। যুদ্ধোপরাধী-প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলটি আজও মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য প্রকাশ্যে মা প্রার্থনা করেনি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শকেন্দ্রিক সাহিত্য-সমালোচনার ধারা থেকে গুণবিচারী সমালোচককুলকে বের হয়ে আসতে হবে। মুক্তচিন্তার ধারাকে বিকশিত করার ল্েয সবধরনের সংকীর্ণতা ত্যাগ করতে না পারলে, প্রথাগত ধর্মের ওপরে মানবধর্মকে স্থান দিতে না পারলে মানুষে মানুষে বিভাজন বিলোপ হবে না। মতান্ধের বৃত্ত থেকে সাহিত্যকে মুক্তি দিতে না পারলে যে বঙ্কিম সম্মিলনের সম্ভাবনা, সে সম্মিলনের পেছনের দরোজায় অশুভ মতাদর্শ বড় হয়ে ওঠে। তখন সাহিত্যের প্রকৃত রূপ ও রীতি সাময়িক উপেতি থাকে। ঔচিত্যবোধের প্রশ্নে মতান্ধের সঙ্গে ত্যাগও প্রকৃত শব্দ-শিল্পীর জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। আবার নিছক ধর্মবিশ্বাসের কারণে যারা ধার্মিক কবিকে আধুনিক কবি বলতে অস্বীকার করেন তারাও আংশিক ভুল করেন। কারণ ধার্মিক মাত্রই মৌলবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল নন। আস্তিক্যবাদী দর্শনের সঙ্গে আধুনিকতাবাদের সম্পর্ক কি সাংঘর্ষিক? তাহলে খ্রিস্টিয় ধর্মাবলম্বি ও ঐতিহ্যের অনুসারী টি এস এলিয়ট কী করে আধুনিক কবি হন? কিংবা লিউ টলস্টয়?
মতান্ধদের আরও একটি গুরুতর প্রবণতা দশককেন্দ্রিক চিন্তা। দশকিয়া সংকলনে একদশকের ধারণাসম্মত প্রবণতা শনাক্তির মধ্য দিয়ে একেকটি দশকের অর্জন নিয়ে বেদবাক্য রচনা করে প্রকৃত কবিদের বাদ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়াও তাদের একটি অন্যতম কাজ। এ দশকিয়াগোষ্ঠী মূলত উৎসবকেন্দ্রিক কবি। বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক উৎসব পালন করে উৎসবের রেজিস্ট্রার খাতায় যত বেশী কবির নাম নিবন্ধন করতে পারেন তত বেশী কবি উৎপাদন করতে সম হয়েছেন বলে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। চিৎপ্রকর্ষের কোনও চেষ্টা তাদের কবিতা কিংবা দশকিয়া নিবন্ধে থাকে না। তার জন্য কোনও চেষ্টাও তারা করে না। দশকবাদীদের প্রকোপ মূলত স্বাধীনতা-উত্তর কালখণ্ডে বেড়েছে বহুগুণ। এসময় হাজার বছরের বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় তৃতীয় শ্রেণীর উপকবিদের অর্জন ও কৃত্যের মান এতই অনুল্লেখ্য যে, তারা বিশেষ ধারার কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাদের অনেকের নামও উলেখ করার মতো কোনও কারণ নেই। ফলে শুরু হয় বিশেষণহীন অন্তসারশূন্য দশকিয়া সংকলণের প্রকোপ। এ দশকবাদীদের প্রাদুর্ভাবে অসংখ্য গুরুত্বহীন দশকিয়া সংকলন বের হতে থাকে।
মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্রাবাদ, পুজিবাদ,নারীবাদ, গণতন্ত্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পরাবাস্তবাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদের মতান্ধরা ভুলেও চিন্তা করে না যে, একদশকে যেমন সাহিত্যের কোনও যুগরুচি গড়ে উঠতে পারে না, তেমনি কোনও তত্ত্ব দিয়েও সাহিত্যের প্রবণতা বোঝা যায় না। সাহিত্যের কোনও প্রবণতা উপলব্ধি করতে হলে দশক কিংবা মতবাদ নয়, নয় কোনও তত্ত্বকেন্দ্রিক চিন্তাও; তার জন্য চাই নির্দিষ্ট প্রকরণের সামগ্রিক রূপ। একটি কবিতা, গল্প কিংবা উপন্যাসের ভেতর একই সঙ্গে বিভিন্ন তত্ত্ব ও প্রকরণ যেমন থাকতে পারে, তেমনি একটি কবিতা গল্প কিংবা উপন্যাস একটি বিশেষ দশকে রচিত হয়েও রসগুণে তা চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে।
যৌন বিষয়ে বাংলাদেশে কড়াকড়ি বাড়বাড়ি রকমের। এখানে প্রায় কবিই যৌন বিষয় প্রকাশের েেত্র অবদমিত। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজকর্মী ও সমাজচিন্তকের বিনিময় প্রত্যাশা থাকে। তারা অবদমিত হতে শেখেনি; প্রয়োজনের মর্মজ্বালা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। কিন্তু যিনি চরাচরের বিভিন্ন ঘটনা ও আচরণের সংঘর্ষে আপন হৃদয়কে রক্তাক্ত করার মতো ইচ্ছার অবদমনের শিকার, তার অম আক্রোশে দুরারোগ্য ব্যাধির মত মস্তিষ্কের কোষে কোষে অনুরণন তোলে অতৃপ্ত কামনা। সেখানে নীতিবোধ নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়। প্রেমে কামের আবেদন চিরন্তন; কিন্তু সংকীর্ণমনাদের বিধিনিষেধ পবিত্র কামকে করেছে কলুষিত। স্বভাবতই কবি মন হয়ে উঠেছে সংশয়বাদী। একদিকে মনোদৈহিক আকাক্সা; অন্যদিকে বৃত্তাবদ্ধ চেতনার ধারক সামাজিক প্রথার নিষেধের তর্জনী। এ দু‘য়ের দ্বন্দ্বে কবিমনে যে প্রতিক্রিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে তাতে আত্মগানিতে নীল হতে হয় কবিকে। বাঙালি মাত্রই অবদমনের শিকার। নৈতিকতার প্রশ্নে ছদ্মবেশী। মনোদৈহিক নিবেদনে দৃঢ়কণ্ঠী সে নয়; কিছুটা জাড্য তার কণ্ঠে চাঁদের কলংকের মত অনিবার্য।
বাঙালি প্রাতিষ্ঠানিক শিালাভের সময় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় তার মৌলিক চাহিদা পাঁচটি। (অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা)। তাবৎ জ্ঞানী-গুণি সে মিথ্যাচারকেই সত্য গণ্যে অনুমোদন দিয়েছেন কোনও রকম প্রশ্ন না তুলেই। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে যে সত্য রৌদ্্রকরোজ্জ্বল দুপুরের সূর্যের মত অস্তিত্বময় তা হলো মানুষের পেটের ুধা নিবারণের পরপরই যৌনুধা জাগে। সঙ্গত কারণে মৌলিক চাহিদা হওয়া উচিৎ ছিল___ অন্ন-যৌনতা-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিা। অবদমিত মন সবসময় নৈতিকতা-অনৈতিকতার প্রশ্নে দ্বান্দ্বিক। তার কাছে যে কোনও সত্য আপেকি। সে যা বলে তা বিশ্বাস করে না, যা বিশ্বাস করে, তা করার সাহস তার থাকে না। বাঙালির এ মানবিক সংকটের কারণে র্যাঁবো, বোদলেয়ার, বায়রন, এলিয়ট, ইয়েটস, টলস্টয়ের সাহিত্যের মতো কালোত্তীর্ণ সাহিত্য রচনা সম্ভব হয়না। দ্বিধাজড়িত চিত্তের পে স্বরাট উচ্চারণ অসম্ভব। যে যৌনতার প্রশ্নে বাঙালির নৈতিকতার মানদণ্ড নির্ধারিত সেখানে হৃদয় ও মননের সংঘাত ও সংঘর্ষের সম্ভাবনা সার্বণিক। সুতরাং শংকাহীন আপন স্বভাবের উদ্বোধন ব্যতীত শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনা প্রশ্নসাপে। যে উদ্দাম যৌনাচারের ফলে ‘নরকে এক রাত্রি’ কিংবা ‘ল্যাডিচ্যাটার্লিজ লাভার’ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল, স্বাভাবিক প্রবৃত্তির অবদমনে ন্যাকামিপূর্ণ কামহীন ক্লেদাক্ত প্রেম অসম্ভব হলেও যেখানে প্রেমের ফসল আনন্দের না হয়ে বিষাদের ও কলংকের হতে বাধ্য।
কবিতা ও ঐশী
বাণীর অন্তর্গত সুর এক না হলেও পরস্পর বিরোধী এমত অপবাদ নিরাসক্ত___
নৈরাশ্যবাদীও দেবেন বলে মনে হয় না। তাই অনেক সময় কবিতার স্বর ও সুর
ঐশীমন্ত্রের মতো শোনায়। বিষয়টা শ্র“তিকটু না ঠেকে মর্মে দোলা দেয়। কবিতা ও
ঐশীবাণীর ঐকান্তিক সুরে অনেক সময় মানব মনে করুণ রসের উদ্বোধন ঘটে। সে করুণ
রসও শ্রোতার গ্রহণ মতার তারতম্যের ভেতর দিয়ে কখনও কখনও শান্তরসে রূপান্তরিত
হয়। তখন মনে হয় কবিতা ও ঐশীবাণীর উৎসবিন্দু এক ও অভিন্ন। সঙ্গতকারণে কবিতা
সংস্কৃতিবান মানুষের পাশাপাশি ধার্মিকেরও চিৎপ্রকর্ষের প্রেরণা হয়ে ওঠে।
যুদ্ধ-বিগ্রহ, ুধা-দারিদ্র, হত্যা-লুণ্ঠন, সন্ত্রাস-কালোবাজারী, রাজনীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট সচেতন কবিকে ভাবিত না করে পারে না। সৎ কবি কখনও নিজেকে এসব আর্থসামাজিক পটভূমি থেকে সরিয়ে রাখেন না। ফলে সৎকবিকেও এসব সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে হয়। এককালের প্রশংসিত কাজও উত্তরকালে ঘৃণার বিষয়ে পর্যবসিত হতে পারে। তার জন্য সে কাজের পরিকল্পনাকারী, বাস্তবায়নকারী কিংবা সমর্থনকারীকে দোষ দেয়া যায় না। সময়ের বির্বতনে মানুষের বিশ্বাস ও আচরণে পরিবর্তন আসে। তখন স্থান-কাল ভেদে মানুষের ভাললাগার-শ্রদ্ধার-ভক্তির বিষয়ও পরিবর্তিত হতে পারে। সেসব তুচ্ছ বিষয় মনে রেখে প্রকৃত কবিকে অবজ্ঞা করা আত্মঘাতি আচরণের নামান্তর মাত্র।
বিশ্ববাসী মা করে দিয়েছেন হিটলারের নাৎসীবাহিনীর সক্রিয় সদস্য গুন্টারগ্রাসকে। নাৎসীবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বাচবিচারহীনভাবে সমর্থন করার দায়ে অভিযুক্ত এজরাপাউন্ডকেও এখন তেমন দোষারোপ করা হয় না। সমগ্রবিশ্বকে ঔপনিবেশ বানিয়ে রাখা বৃটিশদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে আইরিশরা আজও মুক্তি পায়নি। অথচ ভাষাগত আচরণে বিনয়ী, শাসন-শোষণে চতুর বৃটিশদের দোষের চেয়ে গুণাবলী নিয়ে বিশ্ববাসী প্রশংসা করে। কিন্তু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া জাতিগুলো কেবল রিরংসা জিইয়ে সগোত্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী দ্বন্দ্ব লালন করতে চায়। ফলে কে প্রগতিবাদী, কে মৌলবাদী এ প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। এদের ল্য মূলত বিন্দুকেন্দ্রিক। অর্থাৎ বিন্দুর শাসনে এরা স্বেচ্ছায় শোষিত হতে চায়। নিজের শাসনভার নিজের হাতে নেওয়ার মতো মনোদৈহিক সামর্থ্য এদের নেই। ফলে পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষাপরায়ণতা এদের ভেতর ব্যাধির মতো বাসা বাঁধে। নিজের দেশের কমলালেবু-আম লিচু না খেয়ে বাইরের কেমিক্যাল মিশ্রিত জুস খাওয়ার মধ্যে আভিজাত্য খুঁজে বেড়ায়। জা পল সাঁত্রে মানবতাবিরোধী সাম্্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার নোবেল পর্যন্ত প্রত্যাখান করেছিলেন। সেটি তুচ্ছ কোনও চমক সৃষ্টির অসৎ উদ্দেশ্যে নয়। মানুষের রক্তে রঞ্জিত হাত থেকে নোবেল গ্রহণ করতে মানবতাবাদী শিল্পী কুণ্ঠিত ছিলেন। বিপরীতে আমাদের দেশের প্রধান কবি-কথাসাহিত্যিকরা তুচ্ছ স্বার্থের জন্য প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের ছায়ায় নিজেদের আবাস কামনা করেন। কিন্তু কেন ? তারা কি জানেন না কলকারখানার বর্জ্যপ্রবাহিত ড্রেন প্রবাহমান নদীকে কিছু দিতে পারে না। যা দেয় তাতে প্রবহমান নদীর বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। ড্রেন নদীতে গিয়ে পড়লে ড্রেনের মর্যাদা বাড়ে সহস্রগুণ, কিন্তু নদীর তাতেই তি। প্রবহমান হলেও ড্রেন থেকে পতিত আবর্জনা নদীর বিশুদ্ধতাকে কলুষিত করে।
মানবিকগুণরহিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যখন কবিতাবিমুখ হয়ে ওঠেন, তখন আদর্শ রাষ্ট্রে কুকুর দার্শনিকের মর্যাদা পায়। অথচ কবির ভাগ্যে জোটে নির্বাসন। প্লেটোর প্রবল বিতৃষ্ণা সত্ত্বেও কবিতা মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। যাবেও না। উল্টো পেটোর দর্শন ভুল প্রমাণ করে পাবলো নেরুদার মতো শ্রেষ্ঠকবিরা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে সহযোগিতা করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। বিপরীত দৃশ্যও কি নেই? রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কবির বন্ধুত্বকে আমাদের এখানে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। পরশ্রীকাতর সমালোচকরা হয়তো জানেন না রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সমরনায়ক কারও সঙ্গে আমাদের কবি সাহিত্যিকদের প্রত্য কোনও যোগাযোগ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনানীতি ও সমরনীতি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা না থাকায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো এতো বড় ঘটনা নিয়েও বিশ্বস্ত কোনও মহৎ কাব্য কিংবা উপন্যাস রচনা সম্ভব হয়নি। কোনও মতান্ধের মতাদর্শ কিংবা বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা নয়; নয় কোনও তুচ্ছ তত্ত্বের প্রতি মোহগ্রস্ত পপাত। বিশুদ্ধচিত্তে সাহিত্যকে সাহিত্যের ভেতর অন্বেষণই প্রকৃত কবি-সাহিত্যি-সমালোচক-পাঠকের ল্য হওয়া উচিৎ। উৎকৃষ্ট সাহিত্যের প্রযত্ন যদি রাষ্ট্রনায়কও হয়ে ওঠেন, তার সে ঔদার্যকে স্বাগত জানাতে দোষ কী?
যুদ্ধ-বিগ্রহ, ুধা-দারিদ্র, হত্যা-লুণ্ঠন, সন্ত্রাস-কালোবাজারী, রাজনীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট সচেতন কবিকে ভাবিত না করে পারে না। সৎ কবি কখনও নিজেকে এসব আর্থসামাজিক পটভূমি থেকে সরিয়ে রাখেন না। ফলে সৎকবিকেও এসব সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে হয়। এককালের প্রশংসিত কাজও উত্তরকালে ঘৃণার বিষয়ে পর্যবসিত হতে পারে। তার জন্য সে কাজের পরিকল্পনাকারী, বাস্তবায়নকারী কিংবা সমর্থনকারীকে দোষ দেয়া যায় না। সময়ের বির্বতনে মানুষের বিশ্বাস ও আচরণে পরিবর্তন আসে। তখন স্থান-কাল ভেদে মানুষের ভাললাগার-শ্রদ্ধার-ভক্তির বিষয়ও পরিবর্তিত হতে পারে। সেসব তুচ্ছ বিষয় মনে রেখে প্রকৃত কবিকে অবজ্ঞা করা আত্মঘাতি আচরণের নামান্তর মাত্র।
বিশ্ববাসী মা করে দিয়েছেন হিটলারের নাৎসীবাহিনীর সক্রিয় সদস্য গুন্টারগ্রাসকে। নাৎসীবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বাচবিচারহীনভাবে সমর্থন করার দায়ে অভিযুক্ত এজরাপাউন্ডকেও এখন তেমন দোষারোপ করা হয় না। সমগ্রবিশ্বকে ঔপনিবেশ বানিয়ে রাখা বৃটিশদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে আইরিশরা আজও মুক্তি পায়নি। অথচ ভাষাগত আচরণে বিনয়ী, শাসন-শোষণে চতুর বৃটিশদের দোষের চেয়ে গুণাবলী নিয়ে বিশ্ববাসী প্রশংসা করে। কিন্তু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া জাতিগুলো কেবল রিরংসা জিইয়ে সগোত্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী দ্বন্দ্ব লালন করতে চায়। ফলে কে প্রগতিবাদী, কে মৌলবাদী এ প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। এদের ল্য মূলত বিন্দুকেন্দ্রিক। অর্থাৎ বিন্দুর শাসনে এরা স্বেচ্ছায় শোষিত হতে চায়। নিজের শাসনভার নিজের হাতে নেওয়ার মতো মনোদৈহিক সামর্থ্য এদের নেই। ফলে পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষাপরায়ণতা এদের ভেতর ব্যাধির মতো বাসা বাঁধে। নিজের দেশের কমলালেবু-আম লিচু না খেয়ে বাইরের কেমিক্যাল মিশ্রিত জুস খাওয়ার মধ্যে আভিজাত্য খুঁজে বেড়ায়। জা পল সাঁত্রে মানবতাবিরোধী সাম্্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার নোবেল পর্যন্ত প্রত্যাখান করেছিলেন। সেটি তুচ্ছ কোনও চমক সৃষ্টির অসৎ উদ্দেশ্যে নয়। মানুষের রক্তে রঞ্জিত হাত থেকে নোবেল গ্রহণ করতে মানবতাবাদী শিল্পী কুণ্ঠিত ছিলেন। বিপরীতে আমাদের দেশের প্রধান কবি-কথাসাহিত্যিকরা তুচ্ছ স্বার্থের জন্য প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের ছায়ায় নিজেদের আবাস কামনা করেন। কিন্তু কেন ? তারা কি জানেন না কলকারখানার বর্জ্যপ্রবাহিত ড্রেন প্রবাহমান নদীকে কিছু দিতে পারে না। যা দেয় তাতে প্রবহমান নদীর বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। ড্রেন নদীতে গিয়ে পড়লে ড্রেনের মর্যাদা বাড়ে সহস্রগুণ, কিন্তু নদীর তাতেই তি। প্রবহমান হলেও ড্রেন থেকে পতিত আবর্জনা নদীর বিশুদ্ধতাকে কলুষিত করে।
মানবিকগুণরহিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যখন কবিতাবিমুখ হয়ে ওঠেন, তখন আদর্শ রাষ্ট্রে কুকুর দার্শনিকের মর্যাদা পায়। অথচ কবির ভাগ্যে জোটে নির্বাসন। প্লেটোর প্রবল বিতৃষ্ণা সত্ত্বেও কবিতা মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। যাবেও না। উল্টো পেটোর দর্শন ভুল প্রমাণ করে পাবলো নেরুদার মতো শ্রেষ্ঠকবিরা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে সহযোগিতা করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। বিপরীত দৃশ্যও কি নেই? রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কবির বন্ধুত্বকে আমাদের এখানে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। পরশ্রীকাতর সমালোচকরা হয়তো জানেন না রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সমরনায়ক কারও সঙ্গে আমাদের কবি সাহিত্যিকদের প্রত্য কোনও যোগাযোগ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনানীতি ও সমরনীতি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা না থাকায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো এতো বড় ঘটনা নিয়েও বিশ্বস্ত কোনও মহৎ কাব্য কিংবা উপন্যাস রচনা সম্ভব হয়নি। কোনও মতান্ধের মতাদর্শ কিংবা বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা নয়; নয় কোনও তুচ্ছ তত্ত্বের প্রতি মোহগ্রস্ত পপাত। বিশুদ্ধচিত্তে সাহিত্যকে সাহিত্যের ভেতর অন্বেষণই প্রকৃত কবি-সাহিত্যি-সমালোচক-পাঠকের ল্য হওয়া উচিৎ। উৎকৃষ্ট সাহিত্যের প্রযত্ন যদি রাষ্ট্রনায়কও হয়ে ওঠেন, তার সে ঔদার্যকে স্বাগত জানাতে দোষ কী?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন