বুধবার, ২৮ মে, ২০১৪

পাহাড় ও খননকারীর উপাখ্যান : আবুল কালাম আযাদ ।। অনুবাদ ও ভূমিকা : হাসসান আতিক


আহমদনগর কেল্লা, ১০ আগস্ট, ১৯৪২

পাথেয়-জিজ্ঞাসা নেই আত্মভোলা যাত্রীদলের
দোল দেওয়া ছাড়াই মুসাফিরি ঘণ্টা বেজে চলে

প্রিয় বন্ধু,
কাল সকাল পর্যন্ত মুম্বাইয়ে অবকাশের ঘরে এতটাই অনটন লেগে ছিল যে, ৩ আগস্টের ভ্রমণ-চিঠি আপনাকে পাঠানোর জন্য আজমল খান সাহেবের হাতে দিতে পারিনি। কিন্তু আজ আহমদনগর কেল্লার এই সংকীর্ণ দেয়ালে তার দিগন্তপ্রসারী পরিতৃপ্তি দেখুন____ মন চায়, কাহিনির পর কাহিনি লিখে যাই___ ‘মরু! প্রসারিত হও আরও/তার স্মৃতির হাওয়ায় এলোমেলো কাঁপে গভীর ক্যাম্প/দুয়ারে দাঁড়িয়ে আর্তনাদী সৈনিকদল।’ ৯ মাস হয়ে গেল। ১৯৪১ সালের ৪ ডিসেম্বর নিনির কেন্দ্রীয় কারাগার আমার জন্য উদাম হয়েছিল। আর গতকাল ১৯৪২-এর ৯ আগস্ট দুপুর সোয়া ২টায় আহমদনগর কেল্লার সংকীর্ণ দেয়ালের নতুন ফটক পেছনে বন্ধ হয়ে গেল___ ‘হাজার কারিশমা আর রঙের এ কারখানায় কেবলই দরোজা আর দরোজা/খুলে যায় বন্ধ হতে/বন্ধ হয় খুলে যেতে।’ ৯ মাসকে বড় কোনও সময় বলে মনে হয় না___ ‘স্বপ্নের দুই প্রান্তর উদাসীন পৃথিবীতে।’ এরকম কিছু।___‘পৃষ্ঠা পূর্ণ হলে পাতা উল্টাতেই হয়।’ নতুন গল্প শুরু হতে যাচ্ছে। জানি না, ভবিষ্যৎ তাকে কবে এবং কীভাবে শেষ করবে___ ‘পৃথিবীর প্রবঞ্চনা আলোময়/রাত তো অন্তঃসত্ত্বা, দেখা যাক কী জন্ম দেয়।’
জ্বর আর প্রচ- মাথাব্যথা নিয়ে ৪ আগস্ট মুম্বাই এলাম। এসেই কাজে ঢুকতে হয়েছে। মনের যতো দুর্গতিই হোক না কেন___ নির্দিষ্ট কর্মসূচিতে ছেদ পড়লে একদম সহ্য হয় না। ৪ থেকে ৭ আগস্ট ওয়ার্র্কিং কমিটির বৈঠক চলল। ৭ তারিখ দুপুর থেকে শুরু হল অল-ইন্ডিয়া কমিটির বৈঠক। স্বাভাবিকভাবে তা শেষ হতে ৩ দিন লাগত এবং কেন্দ্রীয় কমিটিও এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; কিন্তু আমি চেষ্টা করলাম দুদিনে নামিয়ে ফেলতে। সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বৈঠক চলেছে এবং কাজের শেষ ট্রেনেই ওঠেছি___ ‘অজস্র কাজ ছিল মীরের; অন্য এক ভালবাসার ঘোরে/সমাপ্তি টেনেছি তাই দ্রুত।’ কান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরেছি। দেখি, বাড়ির মালিক খুবই উদ্বিগ্ন। কিছুদিন হয় এই ভদ্রলোক মানসিক রোগে ভুগছেন। সারাক্ষণ কী এক ভাবনায় ডুবে থাকেন। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বর্তমান প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতাম, যেন তার মানসিক সমস্যা আর না বাড়ে। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য পদ থেকে ইস্তফা নিয়েছেন। অবশ্য এখনও আমি তা গ্রহণ করিনি। আবার কমিটির বৈঠকে অংশগ্রহণ করতেও বলিনি। তিনি জানালেন, সন্ধ্যায় কেউ একজন এসেছিলেন। আমার অপেক্ষা করে এইমাত্র চলে গেছে। আগন্তুক বলে গেছেন___ ‘গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ভুল ছিল না। আজ রাতেই কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে।’ দুসপ্তাহ ধরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে। দিল্লি থেকে কলকাতা___ সবার মুখে এ পরোয়ানার কথা শুনে-শুনে কান্ত হয়ে পড়েছিলাম___ ‘শোনাতে আমার সফলতা তোমাকে কিংবা তোমাকে আমার সফলতা অথবা সহযাত্রীর মৃত্যুকথা___ এই তিনটির একটি নিয়েই আসমান বাজি ধরে আছে।’ এ ভদ্রলোককে আর অস্থিরতায় ফেলতে চাইলাম না। তাই একটু বিরক্তি নিয়েই বললাম, যেসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি, এসব নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার খবর বাতাসে ওড়াউড়ি করবেই। এগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্যতা আছে নাকি? খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে যাব। কিছুটা রাত এখনো বাকি; হাত থেকে ফসকে যাবে। একটু বিশ্রাম চাই___ অস্থিরতার চেয়ে চলো আজ মদিরায় ডুবি। অভ্যাস অনুযায়ী ভোর ৪টায় ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু ভেতরটা ছিল কান্ত-অবসন্ন, প্রচ- মাথাব্যথাও। দুটি মবহ ধংঢ়রৎরহ মুখে দিয়ে চা পান করলাম এবং হাতে কলম নিলাম। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠির খসড়া লিখব। যেগুলো রাত পেরুলেই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও অন্যদের পাঠাতে হবে।
সামনে সমুদ্র। ভাটা শেষ। রাতের ভ্যাপসা গরমও কেটে গেছে অনেকটা। এখন জোয়ারের ঢেউ এসে পাড়ে বারি খাচ্ছে। পানি ছুঁয়ে ঠাণ্ডা-ভেজা হাওয়া বইছে। কিছুটা ছিল মবহ ধংঢ়রৎরহ-এর কারিশমা আর কিছুটা ভোরের হাওয়ার। এ দুইয়ের হালকা ঝিমুনি মুক্তি দিল আমাকে। মাথাব্যথা উড়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, উড়ে যাচ্ছে___ এ রকম ভাবতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম___ ‘আহা! ভোরের বিমল হাওয়া, তোমার একান্ত অনুগ্রহ!’ অনিচ্ছায় কলম রেখে দিলাম এবং বিছানায় এলিয়ে পড়লাম। শোয়া মাত্রই চোখ বুজে এল। হঠাৎ অনুভব হল, রাস্তা দিয়ে যেন অনেকগুলো গাড়ি চলছে। এরপর দেখলাম, কয়েকটি গাড়ি বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করেছে এবং পেছন বাড়ির বাংলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে বাড়ির মালিকের ছেলে দাহির থাকে। স্বপ্ন দেখছি মনে করে গভীর ঘুমে ডুবে গেলাম___ ‘অনেক স্বপ্নের সিঁড়িই প্রশান্তিময় খোলা চোখ থেকে।’ এভাবে বড়জোর ১০-১২ মিনিট কেটেছে। মনে হল, কে যেন আমার পা টিপছে। চোখ মেলে দেখি___ দাহির; একটি কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে। বলছে, ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দুজন সেনা অফিসার এসে এই কাগজ দিয়েছে। এটুকু সংবাদই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। তবু তা হাতে নিলাম___ ‘রাজকীয় আহ্বানে কার কার নাম পড়েছে দেখি!’ দাহিরকে বললাম, তৈরি হতে আমার ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। ওদের অপেক্ষা করতে বলো। এরপর গোসল সারলাম, কাপড় পরলাম, কয়েকটি চিঠি লিখলাম এবং যখন বাইরে বেরুলাম তখন ঘড়ির কাঁটা ৫-৪৫ মিনিটে___ বিষয় ছিল জটিল, তবু তরল করে দিলাম।
গাড়ি যখন বেরিয়ে এল___ ভোর মিষ্টি করে হাসছে। সামনে তাকিয়ে দেখি, দুলে দুলে নাচছে সমুদ্র। ভোরের হাওয়া আলোর ভেতর খেলা করছে। ফুলের সৌরভ এনে দিচ্ছে সমুদ্রকে। আর ঢেউয়ে-ঢেউয়ে সেই সুবাস পাড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে সে। ওই হাওয়া এসে মোটরকার ছুঁয়ে গেলে অনিচ্ছায় গলা বেয়ে গালিবের গজল নেমে এল___ ‘তার চুলের গন্ধ মেখে বইছে আজ ভেজা হাওয়া/আমার মাতাল মন দাঁড়িয়েছে রহস্যের নতুন দুয়ারে।’ ভিক্টোরিয়া টার্মিনাল স্টেশনে এসে মোটরকার থেমে গেল। স্টেশনের পেছনটায় সৈনিকদের কড়া পাহারা। লোকাল ট্রেন ছাড়ার সময় চলে যাচ্ছিল; কিন্তু যাত্রীদের অনুপ্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। প্লাটফর্মে কিছুটা নড়া-চড়া দেখতে পেলাম। কয়েকজন একটি রেস্টুরেন্টকার বগির সাথে জুড়ে দিচ্ছে। বোঝা গেল, এই সেই বিশেষ উপাখ্যান___ কয়েদিদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ট্রেনে উঠে দেখলাম, গ্রেপ্তারের বিষয়টি খুব ভালো করেই আমলে নেওয়া হয়েছে। অনেকেই এসে গেছে। যারা আসেনি, অচিরেই এসে যাবে___ ‘অনেকেই পূর্বে এসেছিল/বাকিরা অপেক্ষায় প্রস্তুতি নিয়ে।’ বেশ কজন বন্ধুকে আমার আগেই নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের চোখ-মুখ ছিল নির্ঘুম-স্বপ্নহীন। কেউ বলছিল, রাত দুটো বাজে ঘুমুতে গিয়েছি; চারটা বাজেই ডাকা শুরু করেছে। কেউ বলছিল, ১ ঘণ্টাও ঘুমুতে পারিনি। আর আমি ভাবছিলাম, ঘুমন্ত ভাগ্যের কী অবস্থা কে জানে? তাকেও জাগাতে হয়তো চলে গেছে কেউ! ‘দীঘল রাত, আমার বিনিদ্র চোখ___কোনও বিষয়ই না/কিসমতের খবর এনে দাও, সে কোথায় কান্ত হয়ে আছে।’ কিন্তু এই থমথমে আবহাওয়ায়ও সময়টা ভালো কাটছিল। কারণ ট্রেনে রেস্টুরেন্টকার লেগে গিয়েছিল। কে যেন চায়ের কথাও বলে গেল। চা পান করেছিলাম; তবু আবারও চাইলাম। আর নিমন্ত্রণ জানালাম ঘুমকে___ ‘এসো, এই ভোরের পেয়ালায়/বিগত রাতের মদিরার নেশা নাও।’ এখানে ‘বিগত রাতের মদিরা’ বাক্যাংশ শুধু ‘ভোরের পেয়ালা’-এর টানেই কলমে এসে গেছে। কিন্তু পঙ্ক্তি আর পরিস্থিতি দেখুন কতটাই মিলে গেছে। শুধু এক সন্ধ্যা-সকালে কতটা পাল্টে গেছে সব। রাতের শীতলতা কেড়ে নিয়েছে ভোরের চিনচিনে মাথাব্যথা। এখন শুধু অবসাদ ভরা সকালের নিরস হাই তোলা___ ‘অতীতের আনন্দস্মৃতি হাইতোলে/বিচলিত হয়/এতটা শরাব ছিল না যে নেশার বেদনা ঘুচাই।’ রাত যতটাই সতেজ ও গতিময়, ভোরের মাদকতা ততই গাঢ়-কঠিন। যদি রাতের অন্ধমাতলামির পর এখন ভোরের নেশার তিক্ততা অনুভব না হত, তাহলে এমনটা ঘটত না। কারণ থাকত না আমার অভিযোগ-অনুযোগেরও। তবু আফসোস রয়েই গেল। যখন এমনই হওয়ার ছিল, তবে তো হৃদয়ের কামনা পূর্ণ প্রকাশ হতে পারত এবং মাপামাপি ছেড়ে বোতলের পর বোতল লুটিয়ে দেওয়া যেত। খাজা মীর কী বেদনাভরেই না বলে গেছেন___ ‘কখনো তো আনন্দ দিয়েছে হৃদয়কে আমার/কোনো এক মদ্যপের পান/এই সাকি, মুখোমুখি করে দাও/ সুরার পেয়ালা-আমাকে।’
সাড়ে ৭টায় ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। হাফিজের সুপ্রসিদ্ধ গজলের এই পঙ্ক্তি কমপক্ষে হাজারবার পড়েছি আর শুনেছি। কিন্তু এর আসল স্বাদটা পেলাম তখন___ ‘জানে না কেউ মনজিল কোথায়/বাতাসে ভেসে যায় শুধু যাত্রাধ্বনি___ টুংটাং।’ গ্রেপ্তারের আগে মুম্বাইয়ে পরোয়ানার খবর রটেছিল। তখন সবাই বলছিল, আমাদের আহমদনগর কেল্লায় বা আগাখান প্যালেসে নিয়ে যাওয়া হবে; কিন্তু ট্রেন কালিয়া স্টেশন ছেড়ে পুনার পথে মোড় নিলে ভাবনা এলো, পুনাই আমাদের গন্তব্য। এরপর পুনার কাছাকাছি এক বিরান স্টেশনে কয়েকজন সঙ্গীকে নামিয়ে নেওয়া হলো। নামতে বলা হলো মুম্বাইয়ের স্থানীয় দলটিকেও। শুধু আমাকেই কিছু বলা হলো না। আবার হুইসেল দিল ট্রেন___ ঘণ্টা আর্তনাদ করে যাচ্ছে; ওহে পথিক সাড়া দাও, সাড়া দাও! এখন সবার মুখে ছিল শুধু আহমদনগর। কারণ আমাদের যদি পুনায় না নামানো হয় তাহলে এদিকটায় আহমদনগর ভিন্ন আর কোনও গন্তব্য নেই। এক ভদ্রলোক জানালেন, পুনা আর আহমদনগরের মাঝখানে বড়জোর ৭০-৮০ মাইলের দূরত্ব। আর মাত্র দুই-দেড় ঘণ্টার পথ; কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। অবশ্যই আহমদনগর দূরে নয়। শিগগিরই এসে যাবে; কিন্তু এখানে কি যাত্রা শেষ হয়? এখান থেকে তো সফরের শুরু। না চাইতেই আবুল আ’লা মাআররির পঙ্ক্তি চলে এল___ ‘হায় খাইফের বাসিন্দা! ভালবাসা কতই না কাছে/তবু কি সে ছুঁতে পারে তাকে।’ এটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। ভূ-ভারতের প্রায় সব ঐতিহাসিক স্থানই দেখা হয়েছিল; কিন্তু আহমদনগর কেল্লা দেখার সুযোগ কখনো হয়নি। একবার মুম্বাইয়ে থাকাকালীন ইচ্ছাও করেছিলাম। সময় হয়ে ওঠেনি। এ শহরটি হিন্দুস্থানের ওই বিশেষ জায়গাগুলোর একটি, যার নামের সঙ্গে মিশে আছে কয়েক শতাব্দীর সেরা আন্দোলনগুলোর ইতিহাস। অনেক আগে ভেঙর নামের এক নদী বইতো এ দিকটায়। নদীর নামেই তীরে গড়ে ওঠে একটি ছোট্ট গ্রাম। ১৫০০ খিস্ট্রাব্দের শেষদিকে দেকানের বাহমানি শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে বিজয়ের পতাকা উড্ডীন করেন মুলুক আহমদ নেযামুল মুলুক ভেরি এবং ভেঙরের পাশেই আহমদনগরের ভিত্তিস্থাপন করে জুনাইরের পরিবর্তে একেই প্রধান শহর করেন। এরপর নেযামশাহী রাজত্বের রাজধানী হয়ে ওঠে শহরটি। ঐতিহাসিক ফারিস্তা, যার পূর্ব পুরুষ মাজান্দারান থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেছিল, লেখেন___ কয়েক বছর পেরুতেই শহরের প্রাচুর্য-জৌলুস এতটাই বৃদ্ধি পেল যে, লোকে এর তুলনা করতে লাগল মিশর ও বাগদাদের সঙ্গে।
মুলুক আহমদ নির্মাণ করেছিলেন মাটির কেল্লা। তার ছেলে প্রথম শাহ বোরহান নেজাম পুরোপুরি নতুন করে পাথরে নির্মাণ করলেন এবং এতটাই উঁচু ও মজবুত করলেন যে, এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল ইরান-মিশর অবধি। ১৮০৩ সালে মারহাট্টের দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় জেনারেল ভেলজালি বলেছিলেন, এ এক রহস্যময় দুর্গ। দীর্ঘ ৩ শতাব্দীর বহু ঝড়-ঝাপ্টা বয়ে গেছে এর ওপর দিয়ে। তবু সামন্য চিড় ধরেনি___ ‘ইতিহাস চলছে এঁকেবেঁকে/ ধুলোয় ছাপ রেখে যায় পথিকেরা।’ এই সে কেল্লা, যার পাথুরে দেয়ালে বোরহান নেজাম শাহের বোন চান্দবিবি নিজের বীরত্ব আর দৃঢ়তার অবিস্মরণীয় সব উপাখ্যান খোদাই করে গেছেন। ইতিহাস যাকে পাথরখ- থেকে নামিয়ে এনে নিজের পাতায় গেঁথে নিয়েছে। এই আহমদনগরেই আব্দুর রহিম খান সাখানাহের বীরত্বের কাহিনি প্রদর্শিত হয়___ ‘আমাদের সম্পর্ক জমে আছে মধ্যবর্তী শীতল হাওয়ায়/কেবলি সম্মুখে চোখ; কবর আর নক্ষত্রের গন্ধ ঝরে গেছে আহমদনগর!’ স্মৃতির তলদেশে জমে থাকা কতো কথাই না জাগিয়ে তুলছে। দ্রুতগতিতে ট্রেন ছুটে চলছে, প্রান্তরের পর প্রান্তর ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ পিছলে যাচ্ছে নানা দৃশ্যের ওপর। মাথার ভেতরও সবকিছু এলোমেলো। আহমদনগর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টোচ্ছে। ৬০০ বছরের ইতিকথা। এক পৃষ্ঠা দেখতে না দেখতেই অন্য পৃষ্ঠা চলে আসছে____‘যদি চাও বুকের দাগগুলো ধরে রাখতে/পৃষ্ঠা-পৃষ্ঠা প্রেম উল্টাতে থাক।’ ভাবনা এলো, যদি বন্দি করে রাখতে এই জায়গাটিকেই নির্বাচন করা হয়ে থাকে, তাহলে আর কোনো কথা নেই। নির্জনভরা জীবনের জন্য এমন জায়গাই তো চাই___ ‘পৃথিবীর বেদনা ফুরোলে/নির্জনতাকেই দরোজা মনে হয়।’
আহমদনগর পৌঁছতে দুটো বাজল। ফাঁকা-শূন্য স্টেশন। কেবল টহলরত দু-চারজন সৈনিক। স্থানীয় ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। এরপর সোজা কেল্লার দিকে। পথে কোনো বাঁক ছিল না। দেখে ভাবছিলাম, গন্তব্যের রাস্তাও ঠিক এমন। পা ফেললে আর কোনো বাঁক-মোড় চোখে পড়ে না। কোনো দিকে ফিরতে চাইলে খোলা থাকে শুধু পেছনটা। কিন্তু সে তো আরও আগে বন্ধ হয়ে যায়___ ‘হ্যাঁ, পথ প্রেমের; ফেরার গলি নেই কোনো/এখানে শাস্তি আছে ভুলের, মার্জনা নেই প্রিয়।’ স্টেশন থেকে কেল্লার দূরত্ব বড়জোর ১০-১২ মিনিটের। কিন্তু মনে হচ্ছিল কেল্লার প্রাচীর অনেক দূর। এরপর কয়েক মুহূর্তেই ব্যবধান ঘুচে গেল। এখন দুর্গের বাহির আর ভেতর পৃথিবীর মাঝে শুধু এক পায়ের ব্যবধান। চোখের পলকে তাও অতিক্রান্ত হল। দুর্গে প্রবেশ করলাম। জীবনের প্রতিটি পর্যায়েরই একই অবস্থা। জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধানও এক পা থেকে বেশি নয়___ ‘অস্তিত্ব-বিলীনের মধ্যবর্তী মুহূর্তের পথ/পৃথিবী থেকে ডুবে যাওয়ার মতো ভ্রমণ আর কী-বা হতে পারে?’
কেল্লার ভেতরটায় প্রথমে দেখতে পেলাম লরির সারি। এরপর ট্যাংকের। গাড়ি থেমে গেল। মুম্বাই থেকে সঙ্গে আসা ইন্সপেক্টর জেনারে অব পুলিশ আমাদের নামের তালিকা কমান্ডিং অফিসারের হাতে দিল। সে তালিকা নিয়ে দাঁড়াল দরোজায়। এখন দায়িত্ব মুম্বাই পুলিশের কাছ থেকে চলে এলো সেনাবাহিনীর কাছে এবং প্রবেশ করলাম এক পৃথিবী থেকে আরেক পৃথিবীতে___ ‘আমাদের অনুসন্ধানে মিছেমিছি কাদা ঘাটবে না আর/আনকা পাখির ডানারও দূরত্বে বসে আছি।’ দরোজায় প্রবেশ করলাম। সামনে লম্বা দেওয়াল। আনুমানিক ১০ ফুট দীর্ঘ আর প্রস্থে দেড়শ ফুট। এর দুদিকে কামরার সারি। কামরার সামনে বারান্দা। বেশ খোলামেলা। কিন্তু মাঠ বলা যায় না। তবে কয়েদিদের জন্য মাঠই বটে। কামরা থেকে বেরুলে একে খোলা প্রান্তর বলেই মনে হবে। অন্তত এটুকু জায়গা তো অবশ্যই আছে যে, হৃদয় ভরে ধুলো উড়িয়ে নেওয়া যায়। ‘শিয়রে এনে দাও বেদনার ভিড়/এতো এক মুঠো মাটি; ওদিকে প্রান্তর বসে আছে।’ বারান্দার উত্তর দিকটায় এক পুরনো কবর। নিম গাছের ডাল এসে তাকে ছুঁতে চাইছে। পারছে না। কবরের শিয়রে একটি ছোট কাঠের সিঁড়ি। তাতে কোনো প্রদীপ নেই। কিন্তু মেহরাবের রঙ বলছে___ কখনো এখানটায় কেউ প্রদীপ জ্বালত___ ‘আহা, দীর্ঘশ্বাস!
এ ঘরে প্রদীপ শিখা জ্বলেছে কতটা বছর।’
জানা নেই এই কবর কার। চান্দবিবির হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে তো শুয়ে আছে কেল্লার বাইরে; পাহাড়ের ঢালে। অন্য কারও হবে। কিন্তু সাধারণ কারও নয়। কেননা, কেল্লার সব দালানকোঠা ভেঙে ফেলা হয়েছে, শুধু এই কবরটিই রয়ে গেছে। সুবহানাল্লাহ! কী আশ্চর্য! বিরানভূমিও যে একসময় আবাসময় ছিল, তার চিহ্ন ধরে রাখে। এই পুরনো কবরটির বিরান হওয়াও ছিল এজন্য যে, আমাদের মতো কয়েদিদের শোরগোলে সে একসময় ভরে উঠবে। পশ্চিম দিকের সবগুলো কামরাই ছিল খোলা। সারির প্রথম কামরাটি আমার ভাগে জুটল। ভেতরে পা রাখতেই খাটের শরণাপন্ন হলাম এবং দীর্ঘ ৯ মাসের ঘুম ও কান্তি আমার সঙ্গে বিছানায় এলো___ ‘আরামের শয্যা নেইনি বন্ধু/শরীরের ডাক আজ শয্যার হৃদয় ছুঁয়েছে।’ আনুমানিক ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘুমোলাম। এরপর রাত ৯টায় বিছানায় গেলাম। যখন চোখ মেললাম, তখন ঘড়ির কাঁটা ভোর তিনটায়___ ‘তীর-শিকারি দূরে কোথাও/কোলে পড়ে আছে প্রাচীন ফাঁদ/হাওয়া এসে গেছে প্রশান্তির।’ খুব সতেজ লাগছিল। না-ছিল মাথাব্যথা, না ছিল জ্বর। হিটারে চায়ের পানি বসিয়ে পেয়ালা হাতে বসে আছি। আর নিজেকে শুনিয়ে যাচ্ছি সেই পাহাড়ি উপাখ্যান___ ‘এক পৃথিবী লিখেছি তবু/আপন কাহিনি মধুবন।’ কত মাস হয় এমন ঘুম পায়নি। মনে হচ্ছে, গতকাল ভোরে মুম্বাইয়ে যেই আঁচল ঝেড়ে এসেছি তার সঙ্গে বহুদিনের কান্তিও দূরে সরে গেছে। কী সুমধুর সুরই না ছেড়ে গেছে জিন্দেকির গান___ ‘বন্ধু তুমি কেন আমায় প্রশ্ন কর জলের ভেতর___/কেন ছেড়েছি জায়েনামাজ/তুমি কি জানো না সাধনাশক্তি নেই আমার/ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কী করব আর বল না বন্ধু!’ এ গানে আরও কিছু পঙ্ক্তিমালা আছে। ধর্মীয় জ্ঞানে বিদগ্ধদের নিয়ে। খুবই সুপ্রসিদ্ধ___ ‘মুসলমানি রঙ মেখে পার হয়েছে শহরপিতা/কাফেরের এই ব্যবস্থাহীন ব্যবস্থার আর কী-বা গতি।’ অতীত পার হয়ে আসা সহজ ছিল না; কিন্তু দেখুন, কীভাবে বলে যাচ্ছে সব। শুধু বলছে না, রীতিমতো গলা করছে। আমিও পেয়ালার পর পেয়ালা চা ঢালছি, আর তার পুনরাবৃত্তি করছি___ ‘শরাব পেয়ালা ছুয়ে দগ্ধ না হলে এ হৃদয়ের দাগ/কী আর করব, বল না বন্ধু!’
প্রভুকে অশেষ ধন্যবাদ। এখানে ‘কী করব’ এই শব্দবন্ধ কি কেয়ামতই না করে চলছে হৃদয়ঘরে। মনে হচ্ছে আমার এ অবস্থার পূর্ণতা আনতেই পঙ্ক্তিগুলোয় সুর এসেছিল। ‘কী করব’___ একটু জোর দিয়ে পড়ে দেখুন। কিছুই অনুভব হচ্ছে না। কিন্তু চোখের তারায় ভেসে উঠছে আমার বর্তমান।
এ সব যাই লিখছি___ এলোমেলো, অনর্থ কথার বেশি নয়। এ-ও জানা নেই, আমার হৃদকম্পন আপনাকে স্পর্শ করবে কি না। কী করব বলুন, গল্প বলা থেকে যে নিজেকে ফেরাতে পারি না। মির্জা গালিবের ওই পঙ্ক্তির মতোই সময় যাচ্ছে___ ‘কলমের নিবে শুধু বেদনারা বসবাস করে।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন