গল্পটা
অনেক আগের।
ঘোরানিয়া
রাজ্যে জন্ম নিল এক অপূর্ব সুন্দর রাজপুত্র। তার চোখের মণি দুটো ছিল নীল। দেখামাত্রই
সবাই অবাক
হয়ে যেত। এ রকম চোখ
তারা আগে কখনো দেখেনি।
রাজপুত্রের
জন্মের পরে
রাজা চার দিকে খবর নিয়ে জানলেন যে কুন্দিলন রাজ্যের রাজসভায় একজন প্রাজ্ঞ
ব্যক্তি আছেন। তার
নাম জাউজান। তিনি
মানুষ দেখেই তার ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারেন। রাজা তাকে আনার জন্য রাজপানসি পাঠালেন এবং চিঠি লিখে দিলেন।
জাউজান
একজন
নিরহংকার মানুষ। রাজার
চিঠি পেয়ে তিনি খুশি হলেন এবং কুন্দিলনের রাজার কাছে অনুমতি চাইলেন। রাজা অনুমতি
দিলেন এবং রাজপানসি বোঝাই করে ঘোরানিয়া রাজ্যের রাজপুত্রের জন্য উপহারসামগ্রী পাঠালেন। উপহারসামগ্রী
গেল কুন্দিলনের
রাজপানসীতে এবং জাউজান গেলেন ঘোরানিয়ার রাজপানসীতে।
উপহারসামগ্রী
দেখে
ঘোরানিয়ার রাজা তো মহাখুশি। তিনিও কুিন্দলনের রাজার জন্য এক পানসী উপহার
পাঠালেন। বিশ্রামশেষে
জাউজানকে জানানো হল যে তাদের রাজপানসী চলে গিয়েছে। তার বেড়ানো
শেষ হলে তাকে ঘোরানিয়ার রাজপানসীতে করে পাঠানো হবে।
ঘোরানিয়ার
রাজা
তার ছেলেকে কোলে নিয়ে জাউজানের সামনে বসলেন। জাউজান রাজপুত্রকে দেখে এক গাল
হাসলেন, বললেন,
আমি কি
একটু কোলে নিতে পারি ?
রাজা
বললেন, কী
যে বলেন ! আপনি যে এসেছেন সেটা তো আপনার মেহেরবানি।
রাজা
তার
ছেলেকে জাউজানের কোলে দিলেন। জাউজান বললেন, এ রকম চোখ আমিও কখনো দেখিনি। নীল রংয়ের
মণি। নীলকান্তমণি। রাজকুমার
দীর্ঘজীবী হবে, যতদিন বাঁচবে তার দৃষ্টিশক্তি ততদিন থাকবে, অনেক মেধাবী
আর বুদ্ধিমান হবে। ও
মরে গেলেও ওর
চোখের মণি পঁচবে না। আমি
কি ওর একটা নাম রাখতে পারি ?
রাজা
বললেন, আপনি
নাম রাখলে তো আমি অনেক খুশি হব। রাখুন। আপনার মন থেকে যে শব্দটা বের হতে চাচ্ছে বলে ফেলুন।
জাউজান
আনন্দের সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সাফায়্যার।
রাজা
হেসে বললেন, বাহ
! খুব সুন্দর নাম।
সাফায়্যারের
জন্মের
সময় মারা গেলেন রানী। রাজা
আবার বিয়ে করলেন। বিয়ের
পক্ষে তার কাছে দুটো যুক্তি, একটা হচ্ছে সন্তানের দেখা-শোনা অন্যটা
হচ্ছে পরবর্তী সন্তানের জন্মদান। একটা ছেলে জন্ম নিয়েছে। সে বাঁচবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া একজন
রাজার জন্য একটা ছেলে যথেষ্ট নয়। যে কোনো সময় যে কোনো দেশ থেকে আক্রমন আসতে পারে। তখন নিজস্ব
কিছু মানুষ থাকা দরকার, যেমন- ভাই বা ছেলে। এরা হল রাজার
প্রকৃত সম্পদ বা বন্ধু। যেহেতু
রাজার কোনো ভাই নেই তাই একটা ছেলের ওপর তিনি ভরসা করতে পারছেন না।
মায়ের
পেটে থাকা অব¯থায়
সাফায়্যার
কখনো লাথি মারেনি। জন্মের
পরেও অহেতুক কান্না-কাটি করেনি কখনো। তার কান্নার কারণ ছিল গোসল,
খাওয়া
আর পায়খানা-প্র¯্রাবের কাপড় পরিবর্তন করে দেওয়া। ছোটবেলা
থেকেই সব কথা বুঝত। মা-হারা
এই বাচ্চাটাকে রাজা কাছে নিয়ে ঘুমুতেন। এক দিন রাতে ঘুমুতে গিয়ে তিনি বললেন, আজ আমার
শরীরটা ভালো নেই, বাছা, চুপ করে ঘুমিয়ে থেকো।
সত্যিই
ঘুমিয়ে রইল সাফায়্যার। রাজা-রানীও
ঘুমিয়ে
রইলেন। ভোর বেলা ঘুম
থেকে জেগে রানী দেখলেন যে সাফায়্যার পায়খানা-প্র¯্রাব কিছুই
করেনি। তিনি বললেন,
এতবড়
একটা রাত গেল, তুমি পায়খানা-প্র¯্রাব কিছুই করলে না ? কেন ?
তুমি
ভালো নেই ? কবিরাজ
ডাকব ?
সাথে
সাথেই পায়খানা-প্র¯্রাব করে দিল সাফায়্যার। রানী অবাক হয়ে গেলেন। রাজাকে বললেন,
দেখলেন,
মহারাজ
? আপনার
ছেলে সব কথা বোঝে।
: দেখলাম
তো, রানী। আমি যে ওকে
রাতে বলেছিলাম আমার শরীর ভালো নেই সে জন্যই ও পায়খানা-প্র¯্রাব করেনি।
: আপনি
ঠিকই বলেছেন, মহারাজ।
রাজা
এক দিন
রাজপুত্রকে বললেন, আমি রাজমহলের কাছাকাছি একটা পাঠশালা খুলতে চাই। তুমি সেই
পাঠশালায় অন্য সবার সাথে বসে পাঠ শিখবে। রাজি আছ ?
রাজপুত্র
আনন্দে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগল। রাজা রানীকে বললেন, আমার পুত্র রাজি আছে।
রানী
হাসলেন। বললেন,
কাছাকাছি
পাঠশালা থাকলে সাফায়্যারের জন্য ভালোই হবে।
সাফায়্যারের
বয়স
যখন দুই বছর তখন আরো একটা ছেলে হল রাজার। তার নাম রাখা হল রিকশিম। সাফায়্যারের
যতœ তার
মা বেশি দিন নিতে পারেননি। কারণ তিনি মা হতে যাচ্ছিলেন। মা হওয়ার আগে
শরীর খুব খারাপ থাকে। তখন
অন্যের যতœ তো
দূরের কথা,
নিজের
যতœই
ঠিকমতো নেওয়া হয় না। তার
নিজের সন্তান যখন পুত্রসন্তান হল তখন তো তাকে নিয়েই তিনি ব্যস্ত হয়ে
পড়লেন। সাফায়্যারের
দায়িত্ব দাসীর ওপরই থেকে গেল।
রাজার
মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকারসূত্রে রাজা হবে সাফায়্যার। কারণ সে বড়
ছেলে। এটা রানী
সহ্য করতে পারছেন না। তিনি
সাফায়্যারকে পুষ্টিকর খাবার খেতে উৎসাহ দেন না, আনন্দে থাকতে
সাহায্য করেন না। সব
সময় ভাবতে থাকেন
কী করে পরবর্তী রাজা হিসেবে রিকশিমকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। তার এ
ভাবনাটা
তিনি কারো কাছেই প্রকাশ করেন না, না রাজার কাছে, না রিকশিমের
কাছে, না
অন্য কারো কাছে। কারণ
রাজা রানীকে বলে দিয়েছেন, আমার পুত্ররা যেন কোনো দিন জানতে না পারে যে তারা দুজন ভিন্ন
মাতার সন্তান। সৎ মা হিসেবে
তুমি সাফায়্যারের
রাজা হওয়ার বিষয়টা নাও মানতে
পার
তবে সেটা যেন শুধু তোমার মনের মধ্যেই থাকে। কোনোভাবে যদি প্রকাশ পেয়ে যায় তাহলে এ
রাজ্যে তোমার ঠাঁই হবে না।
রানী
বলেছেন, আপনি
নিশ্চিন্তে থাকুন, মহারাজ। আমি কখনো দুই পুত্রকে দুই নজরে দেখি না। আপনার এ
ধরণের কথায় আমি কষ্ট পেলাম।
কষ্ট
পাওয়ার কিছু নেই, রানী। যেটা স্বাভাবিক আমি সেটাই বললাম, রাজার সহজ-সরল
কথা।
পাঠশালায়
সাফ্যায়ার
অনেক নাম করে ফেলেছে। রাজপুত্র
বলে কোনো অহংকার নেই। সবার
সাথে বন্ধুত্ব
তৈরি করেছে। সবাইকে
সব ধরণের সাহায্য করছে। রাজার
কানেও মাঝে-মধ্যে
এসব কথা আসছে। তিনি
রাতে খাবার সময় রানীর সাথে এসব কথা বললেন। সাফায়্যার
মিট মিট করে হাসছিল। রিকশিমও
ছিল সেখানে।
পরের
দিন রিকশিম রানীকে
বললেন, মাতাজি,
পাঠশালার
ছাত্রদেরকে সাহায্য করলে যদি পিতাজি খুশি হন তাহলে আমিও ওদেরকে সাহায্য করব। পাঠশালার সব
ছাত্রকে আমি স্বর্ণমুদ্রা দেব।
যে
কথা সে কাজ। রিকশিম
পাঠশালায় গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বলল, আমি তোমাদেরকে কিছু সাহায্য করতে চাই।
সবাই
তার দিকে তাকাল। সে
ব্যাগ খুলে একটা মুদ্রা বের করে একটা ছাত্রকে দিল। ছাত্রটা বলল,
কী এটা
?
: স্বর্ণমুদ্রা।
: আমাকে
কেন ?
: বললাম
না ? আমি
তোমাদের সবাইকে সাহায্য করব।
: কিন্তু
আমার তো সাহায্য দরকার নেই।
: আমি
তোমাদের বন্ধু।
: তবুও...
: তোমার
বিশ্বাস হচ্ছে না এটা স্বর্ণমুদ্রা ?
: বিশ্বাস
হচ্ছে বলেই তো নেব না।
: কেন
?
: আমি
ভিখিরির ছেলে নই।
রিকশিম
অন্য একটা ছাত্রকে বলল, তুমি নাও।
: ও
যেটা নেবে না সেটা আমি নেব কেন ? আমি কি ভিখিরির ছেলে ?
: তোমরা
আমার সাথে এ রকম করছ কেন ?
: আমরা
কি তোমার কাছে সাহায্য চেয়েছি ?
: তোমরা
আমার ভাইয়ের কাছ থেকে সাহায্য নাও কেন ? তার কাছে কি তোমরা চাও ?
: তোমার
ভাইয়ের কাছ থেকে আমি কোনো দিন সাহায্য নিইনি। আমার পিতার
যা আছে তাতে
আমাদের হয়ে যায়। আমরা
অন্যের সাহায্য নিই না। তুমি
রাজপুত্র বলে আমাদেরকে
অপমান করতে পার না।
রিকশিম
সবার উদ্দেশে বলল, আমি অনেকগুলো স্বর্ণমুদ্রা এনেছি। তোমরা যে যে
নিতে চাও নিতে পার।
কেউ
কথা
বলল না। রিকশিম মন
খারাপ করে বাড়ি চলে গেল। এক ছাত্র শিক্ষকের কাছে বলল, ওস্তাদজি, রিকশিম যদি
রাজার কাছে নালিশ করে তাহলে আমাদের শাস্তি হবে না ?
শিক্ষক
বললেন, না। মহারাজ অনেক
ভালো মানুষ। পাঠশালায়
যা কিছু হবে তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাবেন না। কারণ এখানে ওস্তাদরা আছেন।
রিকশিম
বাড়িতে
গিয়ে রানীকে সব খুলে বলল। রানী বললেন, মন খারাপ করো না, রিকশিম। তুমি আগে
ওদের বন্ধু হও। তবেই
তোমার সাহায্য ওরা নেবে। যাদের অভাব নেই তারা যদি তোমার বন্ধু না হয় তাহলে কেন
তোমারটা তারা নেবে ? ওদের কার কিসের অভাব আছে সেটা জানার চেষ্টা কর। সাফায়্যার
তোমার চেয়ে দুই বছরের বড়। সে তোমার চেয়ে বেশি বুঝবে এটাই তো স্বাভাবিক।
রানীর
কথা কিংবা রিকশিমের ইচ্ছেমতো সব কিছু হবে না এটাই তো নিয়ম। মানুষ যা
ভাবে তা সব সময় হয় না। দুবছর চলে গেল কিন্তু রিকশিম কাউকে সাহায্য করতে পারল না। সাফায়্যারের
মনে হতে
লাগল তার এত জনপ্রিয়তা তার ভাইকে দিন দিন মানসিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। এতে তার জন্য
রিকশিমের মনে ঈর্ষা জন্ম নিতে পারে। তাই সে ঠিক করল এর পর থেকে রিকশিমের দ্বারাই সবাইকে
সাহায্য করাবে। সাফায়্যার
রানীর সামনে দাঁড়িয়ে
রিকশিমকে বলল, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, এরপরে আমি আর কাউকে সাহায্য করব না। কারো কিছু
প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে বলব। তুমি তাকে সাহায্য করবে।
রিকশিম
এবং রানী খুব খুশি হলেন।
সাফায়্যারের
ধারনা,
মানুষ
মানুষকে ভালোবাসবে এটাই নিয়ম। তার বাবা তাকে যত উপদেশ দেন একটাও সে অগ্রাহ্য করে না। সে জানে যে
তার বাবা তার কল্যাণ কামনা করেন। বাবার কথার বাইরে গিয়ে যদি কোনো
বিপদ হয় তাহলে তিনি তাকে সাহায্য করবেন না।
সাফায়্যার
পাঠশালা
থেকে এসে রিকশিমকে বলল, এক লোকের স্ত্রী অনেক দিন ধরে অসু¯থ। আমি তার বাড়িটা
তোমাকে চিনিয়ে দেব। তুমি
তাকে একজন কবিরাজের ব্যব¯থা করে দেবে।
: কিভাবে
?
: কবিরাজকে
বলবে অমুক বাড়ি যাবেন, টাকা-পয়সা যা লাগে আমি দেব।
: আমার
সাহায্য তারা নেবে তো ?
: নেবে।
: আপনি
কী করে এতটা নিশ্চিত হলেন যে আমার সাহায্য তারা নেবেই ?
: আমার
মন বলছে।
রানী
বললেন, তোমার
মন কেন বলছে সেটা আমি জানতে চাই, সাফায়্যার। তুমি কি ঐ
চাষীর বাড়িতে গিয়েছিলে ?
: জি
না, মাতাজি। পাঠশালায়
যাওয়ার পথে চাষী আমাকে বলল।
: পাঠশালায়
যাওয়ার পথে তুমি মানুষের সুখ-দুঃখ শোন, না ?
: জি,
মাতাজি। সেটা দোষের
কিছু নয়। প্রজাদের
দুঃখ দূর করে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
: তুমি
কি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ ?
: জ্ঞান
দিচ্ছি না, মাতাজি। এগুলো পিতাজি
পছন্দ করেন।
: ভালো
কথা। ঐ গরিব
লোকটার সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়েছিল ?
: পাঠশালায়
যাওয়ার পথে। সে
বিষকাটালি পাতা পানিতে কচলায়। সেই পানি স্যাঁতসেঁতে মাটিতে ফেলে। মাটির ভেতর
থেকে কেঁচো বেরিয়ে আসে। সেই
কেঁচো বিক্রি
করে। বড়শির টোপ
হিসেবে কেঁচো ব্যবহার করা হয়। মানুষ কাপড়ে সাবান দিয়ে কাঁচে। সাবানের পানি
মাটিতে পড়ে। মাটির
ভেতর থেকে কেঁচো বের হয়। বাড়ি বাড়ি হেঁটে সে কেঁচো সংগ্রহ করে। এই তার আয়ের
একমাত্র উৎস। সে
অন্য কোনো কাজ
পারে না। তার স্ত্রী
বিছানা থেকেই উঠতে পারে না।
: সে
নিজে কেন বড়শি পাতে না ?
: সে
বসে থাকতে পারে না। অসু¯থ। পিঠে ব্যথা
হয়। আমি তাকে
আর্থিক সাহায্য করেছি। এরপর
থেকে রিকশিম করবে।
রাজা
পাশের কক্ষ থেকে সব কথা শুনেছেন। তাদের কাছে এসে রানীকে বললেন, ও যা করেছে ঠিকই করেছে। ওকে উৎসাহ দাও।
: জি
আচ্ছা, মহারাজ।
সাফায়্যার
খুব খুশি হল।
পরের
দিন পাঠশালায় যাওয়ার সময় রানী সাফায়্যারকে বললেন, তুমি তো কথা দিয়ে রাখলে না। তুমি বলেছিলে
যে তুমি আর কাউকে সাহায্য করবে না।
: আমাকে
মাফ করবেন, মাতাজি। অত অল্প
সময়ের মধ্যে সেটা চিন্তা করাও সম্ভবপর ছিল না। সাহায্য বলতে
আমরা যা বুঝি তা হল ঐ লোকের স্ত্রীকে কবিরাজ দেখানো। সেটা তো আমি
রিকশিমকে করতে বলেছি। আপনি
আশীর্বাদ করবেন, মাতাজি, আমরা যেন সারা জীবন মানুষের উপকার করতে পারি।
রানী
কিছুই বললেন না। সাফায়্যার
বলল, আমাকে
হাসিমুখে বিদায় দিন, মাতাজি। নইলে যে আমার অকল্যাণ হবে।
রানী
হাসিমুখে
বললেন, সাফায়্যার,
আমার
দুই পুত্র।
এক
পুত্রের গুনগান প্রজাদের মুখে মুখে। আর এক পুত্রের নাম কেউ জানেও না। মাতা হিসেবে
আমার কি মন খারাপ হতে পারে না ?
: আপনি
কোনো চিন্তা করবেন না, মাতাজি। রিকশিম একদিন অনেক সুনাম আর সম্মান কুড়োবে। আমি ওকে
পরামর্শ দেব, মাতাজি। সবাই আমার
প্রশংসা
করবে ; ওরটা
করবে না সেটা আমারও ভালো লাগে না। আমি সত্যি বলছি।
রানী
হাসিমুখে সাফায়্যারকে বিদায় দিলেন।
রানী
আছেন
মহাজ্বালায়, কইতেও
পারেন না, সইতেও
পারেন না। তিনি ভাবেন,
সাফায়্যার
রাজপুত্র
হিসেবে সুনাম কুড়োতে চায়, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ওকে অন্য
রাজ্যে
পাঠিয়ে দিলে চুপচাপ পড়াশোনা করবে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে সাহস পাবে না। তিনি এক দিন
রাজাকে বললেন, সাফায়্যার অনেক মেধাবী, অনেক বুদ্ধিমান। ওকে এখন পড়াশোনার
জন্য কোনো উন্নত রাজ্যে পাঠানো দরকার। ভ্রমনে জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ে। সাফায়্যার বড়
হয়ে একটার পর একটা রাজ্য জয় করতে পারবে।
: পড়াশোনার
জন্য যখন অন্য রাজ্যে যাবেই তখন দুজনকে একত্রেই পাঠাব।
: দুজন
একত্রে গেলে আমরা থাকব কী করে ? রাজমহল খা খা করবে। তার চেয়ে
সাফায়্যার পড়ে আসুক। তার
পরে রিকশিম যাবে।
: ভ্রমনে
বের হওয়ার বয়স ওর এখনো হয়নি। আর একটু বড় হোক। এখানকার পাঠশালায় যে পর্যন্ত পড়ানো হয় সে পর্যন্ত পড়–ক। এখান থেকে
নিয়ে গেলে ওস্তাদরা দুঃখ পাবেন।
রানী
সেদিন আর কথা বাড়াননি। তিনি
জানেন, রাজা
যা বলেন ভেবে-চিন্তেই
বলেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করেন। তিনি সাফায়্যারকে সব সময় অন্য রাজ্যে গিয়ে পড়াশোনা করার উপকারিতা
সর্ম্পকে বোঝাতে লাগলেন। সাফায়্যার এক দিন বলল, আমি দূরে
থাকলে আপনার কষ্ট হবে না, মাতাজি ?
: হবে,
বাছা,
অনেক
কষ্ট হবে তবুও আমি চাই, তুমি অনেক পড়াশোনা কর, অনেক বড় মাপের মানুষ হও।
: বড়
মাপের মানুষ কী, মাতাজি ?
: যে
অনেক বড় মনের মানুষ।
: বড়
মনের মানুষ হতে হলে অনেক পড়াশোনা করতে হবে কেন ?
: জ্ঞান-বুদ্ধি
বাড়বে।
: আমার
জ্ঞান-বুদ্ধি নেই ?
: আছে
কিন্তু তুমি তো অনেক ছোট। তুমি বুঝতে পার না কোনটা তোমার জন্য ভালো আর কোনটা তোমার জন্য
খারাপ।
: তাহলে
একা থাকা তো আমার জন্য অনেক বড় বিপদ। আমি যদি অন্য রাজ্যে বসে বিপদে পড়ি আমাকে উদ্ধার করবে কে ?
: তুমি
খবর পাঠাবে। তোমার
পিতাজি লোক পাঠাবেন।
: সেটা
তো সম্ভবপর নাও হতে পারে। তখন আমার কী হবে ?
রানী
সাফায়্যারকে চুমু খেয়ে বললেন, তোমার কোনো বিপদ হবে না, বাছা, আমার আশীর্বাদ
তোমার সাথে থাকবে।
রাজমহলের
পাশে
যে পাঠশালাটা ছিল সেটার পাঠ সাফায়্যার শেষ করল। আরো পড়াশোনা
করার জন্য
তাকে কুন্দিলন রাজ্যে পাঠানো হল। কুন্দিলনের সভাসদ জাউজানের কাছে রাজা শুনেছিলেন যে
ওখানে ভালো শিক্ষক আছেন। তাছাড়া ওখানকার রাজা যে তার ছেলের জন্য অনেক উপহার
পাঠিয়েছিলেন তাও তিনি ভোলেননি। তিনি ভোলেননি জাউজানের উদারতার কথাও।
পানসীতে
করে সাফায়্যার যাচ্ছে কুন্দিলন। জোয়ারের পানি যেদিকে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যও সেদিকে। মাঝিরা ভাবল
যে সবার কষ্ট করার দরকার নেই, একজন বসে হাল ধরলেই হল। পানসী বাইতে বাইতে মাঝিরা একটু ক্লান্ত হয়েও পড়েছিল। তারা সবাই
বৈঠা রেখে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত
মানুষের শুয়ে থাকা মানেই চোখ বন্ধ করে রাখা।
জোয়ারের
¯্রােতে
পানসী চলছে। একজন
মাঝি হাল ধরে আছে। সেও বেশির
ভাগ সময় চোখ বন্ধ করে রাখে। মাঝে-মাঝে তাকিয়ে দেখে নিশানা ঠিক আছে কিনা।
হঠাৎ হাল ধরা
মাঝি পানিতে পড়ে গেল। তাকে
বিশাল এক লগি দিয়ে
আঘাত করা হয়েছে। তাদের
পানসীর দু’পাশে
দুটো পানসী এলো। পানসীদুটো
থেকে লোক
এসে সাফায়্যারের পানসীতে উঠেছে।
রাজপানসী
তো অনেক বড়। একটা
ঘরের মতো। সাফায়্যার
ছিল ঘরের ভেতরে। তার
কান খাড়া ছিল। সে
বুঝতে পেরেছিল যে তার মাঝিকে ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং তার পানসীতে অন্য লোক উঠেছে। সে জানালার
ফাঁকা
দিয়ে দেখল যে তার
পানসীর
দু’পাশে দুটো বড়
পানসী। সে রাজপোষাক
খুলে সাধারন পোষাক পরল। তরবারিগুলো
কোষ
থেকে বের করল। তারপর
দরজা খুলে বের হল। দেখল
যে তার লোকেরা অসহায় অব¯থায় বসে আছে। দস্যুরা কয়েকজন তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একজনের হাতে
হাল। পানসীর অপর
প্রান্তেও কয়েকজন তরবারি হাতে। পাশের পানসীদুটোতেও অনেক তরবারিধারী লোক। সবাই
সাফায়্যারের মুখের দিকে তাকানো। সাফায়্যার আকাশের দিকে তাকাল। কী করা যায়
ভাবতে লাগল। তার
চোখের মণি দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল। দস্যুরা সবাই সাফায়্যারের চোখ
থেকে চোখ নামিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নিজেদের পানসীতে চলে গেল। সাফায়্যার
পেছন ফিরল।
এবার
ওপাশের লোকগুলোও নিজেদের পানসীতে চলে গেল। পানসীদুটো ক্রমশ সরে যেতে লাগল। সাফায়্যারের
পানসীর ওপরে ছোট
একটা ডিঙি ছিল। মাঝিদেরকে
বলল, ডিঙি
নিয়ে পেছনে যাও। সুজরকে
জীবীত বা মৃত
অব¯থায়
তুলে আন।
সুজর
হচ্ছে সেই মাঝি দস্যুরা যাকে পানিতে ফেলে দিয়েছিল। মাঝিরা তাকে
ডিঙিতে করে নিয়ে এলো। অনেক
পানি খেয়েছে। পেট
ফুলে গিয়েছে। বেঁচে আছে
কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তাকে
রাজপানসীতে তোলা হল। ডিঙিও
ওপরে
রাখা হল। সাফায়্যার
বলল, ওর
পেটে জোরে চাপ দাও। পানি
বের করে ফেল।
পেটের
পানি
বের করার পরে সুজর শ্বাস করতে লাগল। সাফায়্যার মাঝিদেরকে কোনো ধরনের তিরস্কার তো
করলই না বরং বলল, ভয় পেও না, আমাদের কাছে যথেষ্ট তরবারি আছে। কেউ যদি
দাঁড়াতে চায় আমরা ফেলে দেব।
মাঝিরা
সবাই প্রাণে বাঁচল যেন। এর আগে কারো মুখে কথা ছিল না, হাসি ছিল না। ভেবেছিল,
বিশ্রাম
নেওয়ার অপরাধে সাফায়্যার তাদেরকে শাস্তি দেবে। এবার এক জন
মুখ খুলল। বলল, শাহজাদা,
ওরা
আপনাকে
দেখেই চলে গেল কেন ?
: অত্যাচারিদের
মন সব সময়ই দুর্বল থাকে। মন দুর্বল থাকলে তরবারি চালাবে
কী করে ? ওরা
আমাকে দেখেই বুঝেছিল আমি ভয় পাইনি। যার ভয় নেই তার শরীরেও শক্তি থাকে।
কুন্দিলনে
যাওয়ার পরে রাজা ও জাউজানের সঙ্গে দেখা করার জন্য সাফায়্যারের সৌজন্যে এক নৈশ
ভোজের আয়োজন করা
হল। সাফায়্যার উপ¯িথত হলে তাকে
অভ্যর্থনা জানাল কুন্দিলনের রাজপুত্র তুরিন।
নৈশ
ভোজের মধ্যে তুরিন সাফায়্যারকে বলল, আমি হব তোমার সহপাঠী, তুমি কি তা
জানো ?
: না,
আমি
এখন পর্যন্ত কিছুই জানি না।
: তুমি
রাজপোষাক পরে আসনি কেন ?
: আমি
তো এখানকার রাজপুত্র নই, রাজপোষাক পরলে সহপাঠীরা আমার বন্ধু হবে না।
: হবে,
হবে,
ও নিয়ে
ভেবো না। না হলেই বা
ক্ষতি কী ? আমি
তো আছি। বন্ধু
হিসেবে
এক জনই যথেষ্ট যদি সে ভালো বন্ধু হয়। তুমি নিয়মিত রাজপোষাক পরবে। রাজা
সাফায়্যারকে বললেন, তুরিন তোমার ভালো বন্ধু হতে পারবে বলে আশা করি। কোনো সমস্যা
হলে তুমি আমাকে বলবে।
জাউজান
হেসে বললেন, আমি
তো আছিই, তোমার
পুরনো বন্ধু, নাকি
? হাহাহা...
সবাই
হাসল। সাফায়্যার
বলল, আপনি
ঠিকই বলেছেন। আপনাকে
দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। যদিও আমাকে বলা হয়নি আজকের নৈশ
ভোজ কাদের সাথে হবে। পিতাজি
আমাকে ঠিক জায়গায়
পাঠিয়েছেন।
আপনাদের
সবাইকে আমার খুব ভালো লেগেছে।
পরের
দিন ঘোরানিয়ার
রাজপানসী কুন্দিলন থেকে বিদায় নিল। ঘোরানিয়ার রাজা কুন্দিলনের রাজাকে যা কিছু উপহার দিয়েছিলেন
কুন্দিলনের রাজা তার চেয়ে অনেক বেশি পাঠালেন ঘোরানিয়ার রাজার জন্য। কুন্দিলনের
রাজা ঘোরানিয়ার রাজাকে চিঠি লিখে দিলেন যে সাফায়্যার এখানে যত দিন ইচ্ছে
থাকবে। তার জন্য
কোনো খরচ দিতে হবে না। সাফায়্যার
নিজেও তার বাবাকে চিঠি লিখে দিল, এখানকার রাজা এবং রাজকুমার অনেক ভালো। এখানে কোনো
সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ঘোরানিয়ার
রাজা ও
রানী চিঠিদুটো পড়ে খুব খুশি হলেন। তারা কিছুটা অবাকও হলেন। কোনো রাজা এত ভালো হতে পারে ? রাজারা তো সব
সময় অন্যের রাজ্য দখল করার চেষ্টা করে। এ রাজার
মধ্যে কি সে চেষ্টা নেই ?
কিছু
দিনের মধ্যেই সাফায়্যার ভালো ছাত্র হিসেবে নাম করে ফেলল। সে অত্যন্ত
বিনয়ী। সব
ছাত্রদেরকে পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্য করে। শিক্ষকরাও তার প্রতি সন্তুষ্ট।
কেমিও
উজিরের ছেলে। সে তুরিন ও
সাফায়্যারের সহপাঠী। সাফায়্যারের
এত সুনাম তার সহ্য হয় না। সে
তুরিনকে বলল, শাহজাদা,
আপনি
জানতেন সাফায়্যার আমাদের সাথে পড়তে আসবে ?
: জানতাম।
: ভিন
রাজ্যের এক রাজপুত্র আমাদের সমান শিক্ষিত হবে আপনার খারাপ লাগে না ?
: সে
তো এমনিতেই রাজপুত্র, আমার সমান। শিক্ষিত রাজপুত্রের চেয়ে অশিক্ষিত রাজপুত্ররা
বেশি বিপজ্জনক। আমি
চাই সব রাজপুত্ররা শিক্ষিত হোক। তাহলে ভবিষ্যতে রাজায় রাজায় হানাহানি থাকবে না বলে আশা করা যায়। প্রত্যেক
রাজা নিজ
নিজ রাজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। পৃথিবী তখন অনেক সুন্দর হবে। ঠিক না ?
: ঠিক।
যদিও
কেমিও
তুরিনের কথায় খুশি হতে পারেনি তবুও সেটা প্রকাশ করতে পারল না। হয়ত তুরিনের কথাই
ঠিক কিন্তু মনে ধরল না তার। সে ব্যাপারটা নিয়ে বিনটের সাথে আলাপ করল। বিনট বলল,
এটা তো
আমি প্রথম থেকেই মানতে পারছি না। কিন্তু রাজা বা রাজপুত্র যা করবেন তার ওপর তো আমাদের
কিছু করার নেই।
: কেন
নেই ? আমাদের
অবশ্যই করার আছে। এই
রাজ্য শুধু রাজা বা রাজপুত্রের নয় ; আমাদের সবার। এই সাফায়্যার
আমাদেরটা খেয়ে-পরে মানুষ হয়ে এক দিন আমাদের রাজ্যই দখল করবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। ওর সাথে এমন
খারাপ আচরন করতে হবে যাতে ও এখান থেকে চলে যায়।
: মহারাজ
খাল কেটে কুমির এনেছেন।
: কুমির
আমরা ফেরত পাঠিয়ে দেব।
: কথায়
কথায় ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে হবে।
এক
দিন
সাফায়্যার কিংশুকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে। বিনট গিয়ে কিংশুকে বলল, তুমি যদি পড়া
বুঝতে না পার আমাদের কারো কাছ থেকে বুঝে নিও। সাফায়্যার
ভিন রাজ্যের
ছেলে। তার কাছে
তুমি আমাদেরকে ছোট করতে পার না। এতে রাজ্যকে, রাজ্যের শিক্ষিত সমাজকে অসম্মান করা হয়।
: তোমাদের
কাছে অনেক দিন পড়া বুঝতে চেয়েছি। তোমরা বুঝিয়ে দাওনি। তখন তো তোমরা নিজেদের কাছে ছোট হওনি। আজ তোমাদের
এত আত্মসম্মানবোধ এলো কোত্থেকে ?
: তুমি
ভিন রাজ্যের একটা ছেলের সামনে বসে আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন ? এত সাহস তুমি
কোথায় পেয়েছ ? তুমি জানো আমি তোমার কী করতে পারি ?
: জানি। মানুষের
ক্ষতি ছাড়া তুমি আর কিছুই করতে পার না।
সাফায়্যার
কিংশুকে
বলল, এভাবে
কথা বলতে নেই, কিংশু। একজন রাগ করলে অন্যজনকে বিনয় দেখাতে হয়। দুজন একই সময়
রাগ করলে অশান্তি সৃষ্টি হয়, বন্ধু।
: আপনি
জানেন না, রাজকুমার,
এরা কত
খারাপ। এদের সাথে
এভাবে কথা না বললে এরা পেয়ে বসে। মানুষের উদারতাকে এরা কাজে লাগায়। এরা যে কোনো
সময় আপনারও ক্ষতি করতে পারে।
সাফায়্যার
আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগল। অমনি তার
চোখের মণি দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল। বিনট কিছু বলার জন্য রাগের সাথে সাফায়্যারের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই
রাগটা পড়ে গেল। বলল,
আমি
দুঃখিত, রাজকুমার,
আপনি
যাকে ইচ্ছে পড়া বুঝিয়ে দিতে পারেন। আমাকে ক্ষমা করবেন।
সাফায়্যার
দাঁড়িয়ে
বিনটকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। সে নিজেও জানে না যে সে আকাশের দিকে তাকালে তার
চোখের মণি জ্বল জ্বল করে এবং সেই মণির দিকে যে তাকায় তার মধ্যে বিনয় জন্ম
নেয়। বিনয়
সাফায়্যারের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
কেমিও
কিন্তু সাফায়্যারের
পেছনে লেগেই রইল। সাফায়্যার
সেটা বুঝতে পারে তবে কারো কাছে বলে না। তার ধারণা,
সেও এক
দিন তার ভুল বুঝতে পারবে।
কেমিও
এক জন শিক্ষকের কাছে বলল, ওস্তাদজি, আমার পকেটে একটা হীরক ছিল। সেটা
সাফায়্যার চুরি করেছে।
তিনি
অবিশ্বাস
নিয়ে বললেন, তুমি
কী বলছ, কেমিও
? সাফায়্যার
রাজপুত্র। অনেক বড়
মনের
মানুষ। সে এমন কাজ
করতে পারে না। তুমি
ভালো করে মনে করার চেষ্টা কর। আমার মনে হচ্ছে তুমি কোথাও ভুল
করছ।
: আমি
ভুল করছি না, ওস্তাদজি,
সাফায়্যার
আমার পেছন দিক থেকে গলায় হাত দিয়েছিল।
: ও
তো কখনো কারো গলায় হাত দেয় না !
: আমার
গলায় দিয়েছিল।
: এখন
আমাকে কী করতে বলছ ?
: ওকে
আপনি ঘোরানিয়া পাঠানোর ব্যব¯থা করুন। একটা চোর আমাদের রাজ্যে থাকতে পারে না।
: এটা
হয় ? যে
ছেলে মহারাজের মাধ্যমে এসেছে, তাঁর আতিথ্যেই আছে তাকে আমি পাঠিয়ে দিতে পারি ?
: তাহলে
আমি মহারাজের কাছেই নালিশ করব।
: সেটা
ঠিক হবে না।
: তাহলে
আমার হীরকটা কে দেবে ?
: তুমি
মনে করার চেষ্টা কর কোথায় হারাতে পারে। তাছাড়া হীরক নিয়ে তুমি পাঠশালায় কেন
এসেছিলে ?
: বন্ধুদেরকে
দেখানোর জন্য।
: তুমি
দুদিন চিন্তা কর। তার
পরে আমার সাথে দেখা করো।
কেমিও
জানে
যে দুদিন কেন দুমাস চিন্তা করেও কোনো লাভ হবে না। কারণ
অভিযোগটা মিথ্যে। তাই সে
সন্ধ্যার পরে তুরিনের উদ্দেশে বের হল। সে জানে যে তুরিন মাঝে-মধ্যে
একাকী হাঁটতে পছন্দ করে। তুরিনকে সে পেয়ে গেল এবং হীরক চুরির মিথ্যে
গল্পটা তার কাছে বলল। তুরিন
বলল, সাফায়্যার
তোমার হীরক চুরি করেছে ?
: হ্যাঁ।
: পকেটে
হীরক নিয়ে তুমি কেন এসেছিলে পাঠশালায় ?
: আপনাকে
দেখানোর জন্য, শাহজাদা।
: হীরকটা
তুমি কোথায় পেয়েছিলে ?
: আমার
মাতার কাছে।
: আনার
সময় তুমি তাকে বলেছিলে ?
: জি।
: তুমি
কালকে সাফায়্যারের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে ?
: পারব।
: আচ্ছা,
তুমি
যাও।
সাফায়্যার
ওদের
কাছাকাছি ছিল কিন্তু ওরা দেখতে পায়নি। সে খুব কষ্ট পেল এবং ভাবল যে কেমিও তার
সামনে দাঁড়িয়েও এই গল্প বলতে পারবে। তাতে তার একটুও দ্বিধা লাগবে না। সে তার ঘরে
ফিরে এলো। দরজা বন্ধ
করে দিল। মনের দুঃখে
মেঝেতে শুয়ে পড়ল। তার নামে এত বড় বদনাম। এই কথা যখন সবাই জানবে তখন সে কী করে
তাদের সাথে কথা
বলবে ? এসব
ভাবতে ভাবতে তার চোখ দিয়ে অশ্রুধারা নামতে শুরু করল।
সাফায়্যার
যখন
নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল তখন সে উঠে বসল। আলো জ্বালল। দেখল যে তার চোখের
পানি শুকিয়ে জমাট হয়ে আছে। হাতে নিয়ে দেখল সেটা হীরকে পরিণত হয়েছে। খুশিতে তার
মন ভরে গেল। সে
তার ঘোড়া নিয়ে কেমিওর কাছে গেল। রাতের অন্ধকারে তার যাওয়ার কথা শুনে যেমন ভয় পেল কেমিও তেমন ভয় পেলেন
তার মা-বাবা।
সাফায়্যার
কেমিওকে নির্জনে ডেকে নিয়ে বলল, তোমার পকেট থেকে নাকি এক খন্ড
হীরক হারিয়ে গিয়েছে তাই আমি তোমার জন্য এক খন্ড হীরক নিয়ে এসেছি। এটা এত বড় যে
সহজে হারাবে না। তোমার
যখন যে সমস্যা হবে তুমি আমাকে বলবে। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
: আপনি
কী, রাজকুমার
?
: কেন
?
: আমি
হীরকটা হারিয়েছি জানলে আমার পিতা-মাতা আমাকে অনেক রাগ করবেন তাই আমি ঠিক করেছি
চুরির দায়টা আপনার ঘাড়ে চাপাব। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে এক খন্ড হীরক দিতে পারবেন।
: তুমি
তো জানোই তোমাকে এক খন্ড হীরক আমি দিতে পারব তাহলে তুমি আমার সাহায্য চাইলে না কেন
? কেন
তুমি খারাপ চিন্তা করলে ?
: আমার
ভুল হয়ে গিয়েছে, রাজকুমার, আমাকে ক্ষমা করবেন। এ রকম ভুল আমি আর কোনো দিন করব না।
পরের
দিন
কেমিও পাঠশালায় গিয়ে দেখল, তুরিন গম্ভীর হয়ে বসে আছে। যে শিক্ষকের
কাছে
কেমিও নালিশ দিয়েছিল তার মুখটা একেবারেই মলিন। সাফায়্যার
তখনও আসেনি। কেমিও তুরিনের কাছে গিয়ে বলল, হীরক পেয়েছি, শাহজাদা।
: যাকে
সন্দেহ করেছিলে তার কাছে ?
: জি
না, শাহজাদা,
আমার
শার্টের পকেটে।
: পকেট
ভালোমতো না খুঁজে অভিযোগ করেছ কেন ?
: ভুল
হয়ে গিয়েছে, শাহজাদা,
আমাকে
ক্ষমা করবেন। এ
রকম ভুল আমি আর কোনো দিন করব না।
তুরিন
শিক্ষককে বলল, ওস্তাদজি, আপনি কি জানেন হীরক চুরির দায় ও কার ওপর চাপাতে চেয়েছিল ?
: জানি,
তুরিন।
: তাহলে
ওকে এমন শাস্তি দিন যাতে ও আর কোনো দিন এ রকম কথা বলার সুযোগ না পায়।
: কেমিও
উজিরের পুত্র। ওকে
আমি সেই শাস্তি দিতে পারি না।
তুরিন
গিয়ে
তার বাবার কাছে সব কথা বলল। সে কেমিওর বিচার চাইল। জাউজান তাদের কাছে ছিলেন। রাজা বললেন,
শাস্তি
দিলে কি কেমিও ভালো মানুষ হয়ে যাবে ?
: আমি
জানি না, পিতাজি,
আমি
শুধু জানি, যে
অপরাধ করে শাস্তি তার পাওনা। তাছাড়া সাফায়্যার আমাদের
রাষ্ট্রীয় মেহমান। তাকে
অপমান করলে রাষ্ট্রকে অপমান করা হয়।
: তুমি
এই দেশটাকে অনেক ভালোবাস, না ?
তুরিন
কেঁদে কেঁদে বলল, জি, পিতাজি। আমি সাফায়্যারকেও অনেক ভালোবাসি। ওর জন্য আমার
খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি
এই অপরাধের বিচার চাই।
: সাফায়্যার
কি জানে, কেমিও
ওকে চোর সাব্যাস্ত করতে চেয়েছিল ?
: জানি
না।
জাউজান
বললেন, আমার
মনে হচ্ছে সাফায়্যার এটা না জেনে পারে না।
রাজা
বললেন, কেন
মনে হচ্ছে ?
: সাফায়্যার
কোনো সাধারণ ছেলে নয়। ওর
ভেতরে অলৌকিক কিছু আছে। ও
সহজে আকাশের দিকে
তাকায় না। আকাশের দিকে
তাকালে ওর চোখের মণিদুটো জ্বলজ্বল করে। ও নিজেও তা জানে না।
: সত্যি
?
রাজা
অবাক হয়ে গেলেন। নড়ে-চড়ে
বসলেন। জাউজানকে
বললেন, কারণ
কী ?
: কারণ
ওর চোখের মণিদুটো অন্য সবার থেকে আলাদা। নীলকান্ত মণি।
রাজা
তুরিনকে বললেন, তুমি সাফায়্যারকে ডেকে নিয়ে এস। আমরা সামনে
গিয়ে বসছি।
সাফায়্যারকে
নিয়ে তুরিন আসলো।
রাজা
বললেন, সাফায়্যার,
তুমি
কি জানো, কেমিওর
এক খন্ড হীরক হারিয়ে গিয়েছিল ?
সাফায়্যার
আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, সে কী জবাব দেবে।
সবাই
সাফায়্যারের
চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার
চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। জাউজান
পরম আনন্দের
সাথে রাজার দিকে তাকালেন। রাজা দাঁড়িয়ে সাফায়্যারকে বুকে টেনে নিলেন। চোখের পানি
ফেলে বললেন, তুমি
কী, সাফায়্যার
? তুমি
কি মানুষ ? একটা
ছেলে
তোমাকে চোর প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে অথচ তুমি আমাকে বলছ না ওকে আমি শাস্তি দেব
বলে ?
: ভুল
তো মানুষই করে, মহারাজ। শাস্তি দিলে কেমিও লজ্জা পাবে। তাতে আরো হিং¯্র হয়ে উঠতে
পারে।
তুরিন
বলল, পিতাজি,
আমি
একটা কথা বলতে চাই।
রাজা
সাফায়্যারকে ছেড়ে দিলেন। সবাই বসলেন। তুরিন বলল, আপনি লিখিত দিবেন যে আপনার মৃত্যুর পরে
কুন্দিলন রাজ্যের রাজা হবে সাফায়্যার।
জাউজান
অবাক হয়ে বললেন, কেন, রাজকুমার ?
: কারণ
আমি এই রাজ্যটাকে অনেক ভালোবাসি। এখানে সাফায়্যারের মতো একজন রাজাই দরকার।
রাজা
বললেন, আর
তুমি ?
: আমি
ওর ভাই হিসেবে থাকব।
সাফায়্যার
তুরিনকে বলল, আমি
তো ঘোড়ানিয়া রাজ্যের রাজপুত্র, না ?
: ওখানে
তোমার ভাই আছে। তোমার
ভাই নিশ্চয়ই তোমার মতো হবে। রাজ্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজন বিণয় আর বুদ্ধি। আমি আমার
চেয়ে তোমাকে বেশি যোগ্য বলে মনে করি।
: তা
হয় না, রাজকুমার।
: অবশ্যই
হয়।
রাজা
আর জাউজান খুব
খুশি। তুরিন রাজাকে
বলল, পিতাজি,
আপনি
রাজসভা ডেকে এটা জানিয়ে দেবেন। আমার পক্ষ থেকে সাফায়্যারের জন্য
সামান্য উপহার।