বাংলা সাহিত্যের দশকবিভাজনের ধারা বেশ পুরানো না হলেও একেবারে সাম্প্রতিক নয়। অনেক দিন থেকেই এধারা চলে এসেছে। কে প্রথম এ দশকভিত্তিক সাহিত্য চর্চার ধারা শুরু করেছিলেন? কী মনে করে তিনি শুরু করেছিলেন, আজ আর জানার উপায় নেই। দশকবিভাজনের উদ্দেশ্য কী? বিভিন্ন দশক ভিত্তিক কবিতা ও কথা সাহিত্যের সংকলনগুলোর পাতায় পাতায় পাঠ-অযোগ্য কবিতা ও কথাসাহিত্যের ছড়াছড়ি। প্রশ্ন হলো, কেন এই ুদ্র সীমানায় নিজেকে বন্দি করা? ‘আমি সমগ্রের অংশ নই, সমগ্রের সঙ্গে সম্মিলিত নই, সমগ্রের মধ্যে গৃহিত নই’Ñ স্ক্যন্ডিনেভিয়ান দার্শনিক সোরেন কিয়ার্কে গার্ড এভাবে বন্ধনহীন অসীমের কথা বলেছিলেন। আবু হাসান শাহরিয়ার বিভিন্ন প্রবন্ধে, সাাৎকারে সাহিত্যে দশক বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি প্রায় বলেন, ‘দশক গৌণ কবিদের আশ্রয়’। দশকে দশকে ঝাঁকে ঝাঁকে যে পরিমাণ গৌণ কবির আবির্ভাব ঘটে, তারা শেষ পর্যন্ত দম ধরে রাখতে পারেন না। পথেই তাদের দম ফুরিয়ে যায়। ফলে একদা কবি থাকার অহংকারকে পূঁজি করে দশকিয়া সংকলনে স্থান পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। শুধু গৌণ কবি নয়, গৌণ ছোটগল্পকারদেরও আশ্রয় এই দশকের সাইন বোর্ডের নিচে। গল্পকারদের ভেতরও এ প্রবণতা লণীয়। তবে উপন্যাসে তেমন দেখা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথম কাব্য রচনা করেন, তখন তার কাব্যের প্রশংসাসূচক আলোচনার সাথে সাথে বিরূপ সমালোচনাও হয়। রবীন্দ্রনাথের অর্ন্তদৃষ্টি (ওহঃৎড়ংঢ়বপঃরড়হ) বড্ড বেশী ছিল। তিনি মনের ভাব অতি সূèভাবে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করতেন। একটি মাত্র হৃদয় অথবা এক হৃদয়ের ভাববিশেষ নিয়ে এত নেড়েচেড়ে, উলটে-পালটে পরীা করেন যে, তার কোনোভগ্নাংশেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার জো নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন- তিনি দার্শনিক বা ঋষি নন। তিনি শুধু কবি। ইঙ্গিত করেছেন, এই কবি সেই কবি, মুক্ত চেতনার কবি। মুক্ত সময়ের কবি। যে কবিকে কোন দশকিয়া বৃত্তে বেঁধে রাখা সম্ভব হয় না। পাঠককে চমক দেখানোর জন্য দশকের সাইনবোর্ড টাঙানো কবির ল্য হওয়া উচিৎ নয়। কবির ল্য হওয়া উচিৎ কবিতা চর্চা। কবিতাই কবিকে বাঁচিয়ে রাখে। এটাই হয়ে এসেছে হাজার বছরের সাহিত্যভুবনে। দশকের গণ্ডিতে কবি-সাহিত্যিককে বন্দি করা সম্মানজনক হতে পারে না কখনো। স্বাভাবিকভাবে তাই প্রশ্ন জাগে, কেন এই দশক বিভাজন? কারা দশকবিভাজনের শুরু করেন? কী উদ্দেশ্য ছিল তাদের? যারা দশকের সাইন বোর্ডের নিচে আশ্রয় পেতে চান, তারা মূলত গৌণ সাহিত্যিক। জীবনানন্দ লিখেছেন-‘উপমাই কবিত্ব’। আর বিখ্যাত সমালোচক রিচার্ডস লিখেছেন- ‘রূপক রচনার শক্তির ওপরই কবির কৃতিত্ব নির্ভর করে’। আর এ দশকবাদী কবি-কথাসাহিত্যিক ও সমালোচকদের ধারণা সাহিত্যের সমৃদ্ধি নির্ভর করে, দশকিয়া প্লাটফর্মের ওপর।
রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় লিখেছিলেন- ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়।’ কবিতার কাজই হচ্ছে সাম্প্রতিকতাকে অতিক্রম করে যাওয়া। আবার, স্টিফেন স্পেন্ডার বহুকাল আগে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন ‘আধুনিক ও সাম্প্রতিক’। এতোদিন পরও কথাগুলির সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমর্থনা পাওয়া যায় মোহাম্মদ নূরুল হক’র ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’ গদ্যে। এই মুক্তগদ্যে মোহাম্মদ নূরুল হক লিখেছেন,
যারা সারাজীবনে হয়তো একটিও কালোত্তীর্ণ কবিতা, উপন্যাস কিংবা ছোটগল্প লিখতে পারেননি, কিন্তু কবি কিংবা কথাশিল্পী হিসেবে সহজে আত্মপ্রচারের সুযোগ পেতে চান, তারাই দশকবিভাজনে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। মূলত দশকবিভাজনে আগ্রহী তারাই, যারা সাহিত্যের নানা বাঁক ও প্রবণতা শনাক্তিতে অসমর্থ। সমকালীন সাহিত্যরুচির উত্তাপ উপলব্ধিতে ব্যর্থরাও জনরুচি ও সাহিত্যরুচিকে একই গ্লাসে গুলিয়ে পান করার প।ে দশকবিভাজন সাহিত্যের জন্য কোনও সম্মান বয়ে আনতে পারে না। তাই নির্বিচারী দশকিয়া সংকলনগুলো অকবিতা, বানানো কাহিনীতে ভরে ওঠে।
এই মুক্তিগদ্যটি প্রকাশিত হয়, দৈনিক যুগান্তরের সাময়িকী পাতায়। কবিকে দশক নামক কয়েদখানায় বন্দি করা মানে, কবির মানসশক্তির স্বতঃস্ফূর্ত সঞ্চালনে বাধাগ্রস্থ করা। কবিকে একটি বৃত্তের মধ্যে বেঁধে ফেলা কাম্য নয়। মোহাম্মদ নূরুল হক’র মুক্তগদ্য ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’ কি বদলে দেবে দশকবাদীদের চিন্তাবিশ্বকে? যুগযুগ ধরে যারা দশক-দশক বলে গগনবিদারী আর্তচিৎকার করে গলা ফাটিয়েছেন, তারা কি ভেবে দেখেছিলেন, দশকবিভাজনে সাহিত্যের অবমূল্যায়ন হয়।
সাহিত্যের দশকবিভাজনের বিরুদ্ধে মুক্তচিন্তার অধিকারীরা যতই মতামত ব্যক্ত করুন, দশকবাদীদের তাতে বিভ্রম ঘুচে না। দশকের ফিতা ফেলে দশকবাদীরা সাহিত্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করে। এসব ভূঁইফোঁড় সমালোচক দশকিয়া গদ্যের কাদাছোঁড়াছুড়িতে সাহিত্যাঙ্গনকে কলুষিত করার হীনচেষ্টা করেন। অনেক অকবিকে কবি সনদ দিয়ে বসলেও, বাদ পড়ে যান প্রতিভাবান কবিরা। প্রতিভাবাবানদের জন্য এটা সৌভাগ্য যে, এমন বামন সমালোচক তাদের উচ্চতা অনুমান করতে পারে না। দশকিয়া ছিঁচ কাঁদুনে প্রবন্ধে বনসাই হয়ে বটের উচ্চতা মাপার দুঃসাহস করে না। তাই বাদ পড়ে সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান কবির নাম। সাম্প্রতিককালে এই ভাঁড় সমালোচকের আলোচনা থেকে বাদ পড়ে যান আবু হাসান শাহরিয়ার, আমিনুল ইসলাম, রহমান হেনরী, কাজী নাসির মামুন, রনজু রাইম, মামুন রশীদ সহ কয়েকজন প্রধান কবি। তাদের পাঠভীতি ও পাঠকার্পণ্যই এর জন্য দায়ী। এসব ভাঁড় সমালোচকদের কাজই হলো, চমক সৃষ্টি করা। প্রতিভাহীনের প্রতিভার ঔজ্জ্বল্য না থাকলেও চাতুর্য থাকে। এরা পাঠবিমুখ। তাই পড়াশোনা না করেই ছলচাতুরীর আশ্রয়ে চলতি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেয়, আর মন্তব্যসর্বস্ব প্রলাপকে প্রবন্ধের নামে চালিয়ে দেয়। এদের এসব ফরমায়েশী প্রবন্ধে কোনও যুক্তির প্রমাণ থাকে না, থাকে না আলোচ্য বিষয়ের বিশ্লেূষণও। এরা মূলতঃ স্ট্যান্টবাজ। এসব স্ট্যান্টবাজরা প্রকৃতসাহিত্যিকের নামের সাথে নিজেদের নাম লেখানোর অসৎ উদ্দেশ্যে প্রকাশ করে বিভিন্ন দশকীয়া সংকলন। এরা যুক্তি দেখায় দশকভিত্তিক আলোচনার উপকারিতাও আছে, তারা নিজেদের বিশেষ দশকের প্রধান কবি-লেখক হিসেবে প্রমাণ করার জন্যই যুক্তি দেখায়। অলেখক-অকবিকেও লেখক-কবির সঙ্গে একই সভায় আসন পেতে বসার সুযোগ দেয়া যায়? দশকিয়া সংকলনে এও সম্ভব। বটবৃরে সঙ্গে আগাছার নামটিও একত্রে মুদ্রিত থাকে। আর কি চাই এসব দশকীয়া পরগাছাদের! দশকভিত্তিক সংকল, প্রবন্ধ রচনা কিংবা সাহিত্যিক গোষ্ঠীর আত্ম প্রকাশ ও আত্মপ্রচার একধরণের সংকীর্ণ ও অসম্পূর্ণ মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এ থেকে প্রকৃত কবি-সাহিত্যিককে বেরিয়ে আসতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন