বুধবার, ২৮ মে, ২০১৪

নাজিব ওয়াদুদ ।। শেকড়



বেশি রাইত্ কইরো না।
কথাটা খুবই সাধারণ। দাবিটাও সামান্য ও স্বাভাবিক। সারাদিনের জন্যে বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়ে যাওয়া স্বামীর প্রতি এক স্ত্রীর, বিশেষ করে যে থাকে সারাদিন একেবারেই একাকী, তার পক্ষে এ রকম কথা বলা খুবই সঙ্গত। তবু কথাটা শুনে অবাক হয় নাজিম। এতোদিনের দাম্পত্য জীবনে বউয়ের মুখে এমন কথা কখনো শোনেনি সে। এর মধ্যে ভালোবাসা বা আকুলতার গন্ধও হয়তো নেই। তারপরেও কথাটা নতুন। অভাবিতপূর্ব। কথাটা বারবার তার কানে অনুরণিত হতে-হতে, তার হƒদয়ের আকুলতার প্রভাবেই হয়তো বা, এক ধরনের রং পায়। সেটা যেন একটা আকাক্সক্ষা, একটা তৃষ্ণার লাজুক প্রকাশ হিসেবে প্রতিভাত হয় তার কাছে। কেননা আজকের ব্যাপারটা আলাদা। একেবারেই আলাদা। রাশিদা আজ পোষমানা বিড়াল। এটা সম্ভব হয়েছে কেমন করে সে কথা ভেবে সে নিজেই অবাক। একেই বোধ হয় বলে মানুষের মন। একা-একা ভাবে নাজিম। একটা রহস্যে ঘেরা মেয়েমানুষ এই রাশিদা। কতই না সংসারী। অথচ মন নেই স্বামীর প্রতি। তাই বলে যতেœরও অভাব নেই। কিন্তু তাতে যে ভালোবাসা নেই তা অনুভব করতে কষ্ট হয় না নাজিমের। হয়তো কোনো কারণে তাকে ভালোবাসতে পারেনি সে। কিন্তু সে নিজে ভালোবেসেছে অন্তর দিয়ে। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ভালোবাসা দিতে হয়, সে চেষ্টা সে করেছে আন্তরিকভাবেই। তার ফল ফলেছে এতদিনে। পুরো ঘটনাটা বারবার ছায়াছবির মতো ফুটে ওঠে তার মনের পর্দায়। সে আজ দারুণ খুশি।
তাদের দাম্পত্যের বছর চারেক পেরিয়ে গেছে এর মধ্যেই। কিন্তু মেয়েটাকে আজও বুঝে উঠতে পারেনি নাজিম। কী চমৎকার গোছানো স্বভাবের মানুষ রাশিদা। তাকে ঘর-বাড়ি নিয়ে কখনো ভাবতে হয় না। পুরনো বেড়ার বাড়ি ভেঙ্গে মূল ভিটা ছেড়ে নতুন জমিতে নতুন ইটের বাড়ি তুলেছে। সে বাড়ি বানাতে হাতে-বুকে-পায়ে-ঠেলে কাজ করেছে মেয়েটা। এমন বউয়ের বিরুদ্ধে সংসারের প্রতি টান নেই এই অভিযোগ করা যায় না। হয়তো তার স্বভাবটাই এ রকম। এমন সব মানুষ হয়তো থাকে, যাদের বোঝা যায় না কোনো মতেই। মানে সবাই বুঝতে পারে না। রাশিদা সংসারে আসার পর থেকে তার ব্যবসায় বরকত হয়েছে। নিজের যথেষ্ট পুঁজি থাকলে এতদিনে সে লাখপতি বনে যেত। ইদানীং ব্যবসায় মন বসাতে পারছে না সে। টাকা বানানোর জন্য যে নেশা দরকার আজকাল তার যেন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে নাজিমের মধ্যে। শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, মাঝখানে যেভাবে বাড়ছিল, ব্যবসার হাল এখন আর সে রকম নেই। আসলে মন ভালো নেই তার। লোকে বলে, ঘরে শান্তি না থাকলে বাইরের স্বস্তি নষ্ট হয়। নাজিমের হয়েছে সেই অবস্থা। অথচ রাশিদার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ নেই তার। অভিমানও নেই। শুধু একটাই দুঃখ তার বউটার মনের হদিস পেল না। রাশিদার কোনো চাহিদাই নেই যেন। কেন নেই সেটাই জট পাকায় নাজিমের মনে। তার বাসনা, তার কাছে কিছু দাবি করুক সে, বলুকÑ এটা দাও, ওটা দাও। এই-চাই, ওই-চাই করে-করে প্রতিদিন, সারাক্ষণ, জ্বালাতন করুক তাকে। শাড়ি-গয়না কোনো কিছুর প্রতিই তার মোহ নেই। অন্তত সে রকম কোনো লক্ষ্মণ তার মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয় না। অথচ দিলে প্রত্যাখ্যানও করে না। একেবারে নিরাসক্তও নয়, আবার আহাদে উদ্বেলও হয় না। স্বামীর কাছ থেকে কিছু চেয়ে পাওয়ার সুখ, আনন্দ বা অধিকার কি সে অনুভব করে না?
প্রথম প্রথম সন্দেহ করেছে নাজিম। মেয়েটার কি অন্য কোনো পুরুষের প্রতি গোপন টান আছে? সম্ভাব্য অনেকের কথাই ভেবেছে সে। হোসেন তার মধ্যে একজন। আপন চাচাতো ভাই-বোন ওরা। একই বাড়িতে একসঙ্গে মানুষ হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু সৌহার্দ্য, কিছু ভালোবাসা, কিছু টান থাকতেই পারে। সে রকম কিছু কখনো-কখনো লক্ষ করেছে, তার বেশি কিছু নয়। অনেক ভেবে দেখেছে নাজিম এগুলোকে গর্হিত ভাবা কষ্টকল্পনা বৈ কিছু নয়। তাহলে কি স্রেফ ব্যাপারটা এমন যে, মনে মনে যে রকম একটা পুরুষের কল্পনা রাশিদা করেছিল নাজিমের মধ্যে তা পায়নি? কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। বউয়ের মন পাওয়ার জন্য কী-ই না করেছে সে। দীর্ঘদিন একাদিক্রমে লেগে থেকে, একটা-একটা করে তার পছন্দগুলো আবিষ্কার করেছে, আর সেগুলো এনে হাজির করেছে তার সামনে। সেসব দূরে ঠেলে দেয়নি রাশিদা। কিন্তু খুশি হয়ে গ্রহণ করেছে, তার মন গলেছে এমন কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি তার আচরণ থেকে। ভেবেছে সন্তান হলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ সে নেয়ামত থেকেও তাদের বঞ্চিত করে রেখেছে। কতো বলেছে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য। তাতেও রাজি নয় সে। ইদানীং হতাশ এবং কান্ত নাজিম। তাদের দুজনের সংসার এখন চলছে যান্ত্রিক নিয়মে। যেন দম দেওয়া আছে ঘড়ির কাঁটার মতো, তেমন করেই ঘুরছে তাদের জীবনের কাঁটা। তারা দুজন যেন মানুষ নয়, চাবি দেওয়া দুটো খেলনা পুতুল। মাঝে-মধ্যে এমন সব আচরণ করে রাশিদা যে, তার ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না নাজিম। যেমন সেদিন রাতে ভাত না খাওয়ার ব্যাপারটা। কেন খেলো না? কার ওপর রাগ? কিসের জন্য রাগ?
সকালে যাওয়ার সময় কোনো গোলমাল হয়নি। ঝগড়া-ঝাঁটি তাদের মধ্যে হয় না। সেদিনও হয়নি। হ্যাঁ, বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়েছে। সারাদিন সে বাইরে ছিল। মাঝে-মধ্যে এটা হয়। তা-ই বা আর কতো! এমনিতে প্রায়ই তো সাড়ে নটা-দশটা বাজে। সেদিন এগারটা পেরিয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা করতে-করতে হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিল রাশিদা। নির্জন বাড়িতে একাকী রাত কাটানো, সেটি নিশ্চয়ই কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু তার জন্য তাকে গালাগালি করুক না! যা আসে মুখে বলুক। তাতেও শান্তি পাবে সে। তার নীরব, প্রতিবাদহীন, প্রতিক্রিয়াহীন আচরণ তাকে আরও কষ্ট দেয়। রাশিদা কি তার জন্য উৎকণ্ঠায় থাকে? তার আচরণ দেখে নাজিমের কখনো তা মনে হয়নি। সেদিন রাতেও তার চোখে-মুখে তেমন কোনো আভাস-ইঙ্গিত সে দেখতে পায়নি। যেন এটাই স্বাভাবিক, এর অপেক্ষায়ই ছিল সে, তা যত কষ্টের কারণই হোক। এ রকম নিরাসক্তি ও ঔদাসীন্যই দেখা গেছে তার মধ্যে। হয়তো সে ধরে নিয়েছে যে ব্যাপারটা কষ্টের, কিন্তু এটাই তার ভবিতব্য। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই নির্বিকারচিত্তে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। আবার ভাবে, যদি তা-ই হবে তাহলে ভাত না খাওয়ার অভিমান, শরীর স্পর্শ করতে না দেওয়ার রাগÑ এসবের মানে কী?
হতে পারে এর পেছনে আসলে অন্য কোনো হেতু আছে। হয়তো তার শরীর খারাপ ছিল। হয়তো বৃদ্ধ বাপ-মায়ের কথা মনে করে দুঃখ পাচ্ছিল। এসব কষ্টের কথা প্রিয় কাউকে বলতে পারলে হালকা হয় বুক। তা পারেনি। এ নিয়ে কোনো অভিমান-রাগের তো প্রশ্ন আসে না। কারও ওপরেই না। তার ওপরে তো নয়-ই। এই অভিমান কেবল তখনই আসতে পারে... কেবল তখনই... যখন হƒদয়ে রক্তক্ষরণ হয় কোনো অপ্রকাশিতব্য যন্ত্রণায়...! কোনো অকহতব্য দুঃখের জ্বালায়! কিন্তু কী সেটা? কিসের যন্ত্রণায় নিজেকে পোড়ায় মেয়েটা? আর তাকেও জ্বালায়? ভেবে কূল পায় না নাজিম। অস্থিরতায় ভোগে সে। বুক পোড়ে। অনেক রাতে যখন সে বাড়ি ফিরেছিল রাশিদা তখনো জেগে। তার চোখে ঘুমের ঘোর। রোজকার মতো খাওয়া-দাওয়া সাজানোই ছিল। তবে অবাক হলো নাজিম। কারণ রাশিদাও থালা টেনে নিয়ে বসল। সে যে আজকাল কখন খায়, কী খায়, না কি খায়ই না জানতে পারে না নাজিম। তবে এটুকু ছাড়া আর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। তাই সেটা তার মনে আছর করেনি। এমনিতেই তার শরীর-মন দুটোই খারাপ ছিল। সোলেমান শেখের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। বেশ কিছুদিন থেকেই বনিবনা হচ্ছে না লোকটার সঙ্গে। ইচ্ছা করে তার কিছু টাকা আটকে রেখেছে শেখ। সেটা চাইতে গিয়েই ঝগড়া। তারপর হরিদাস স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে তার মাথা আরও গরম। যে গয়নাগুলো নিয়ে রাশিদার সন্দেহ তাকে, সেই গয়নাগুলো স্বর্ণকারের কাছে বন্ধক। শরীরে রাগ ধরছিল না। ঘটনাক্রমেই ব্যাপারটা জানতে পারে সে। ভেবে পায় না তাকে না জানিয়ে গয়না বন্ধক রাখা কেন। খুব অপমান বোধ হয় তার। তারপর তার মনে একটা আশার আলো উঁকি দেয়। গয়নাগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে সে। তুলে দেবে রাশিদার হাতে। ভেবে খুব আনন্দ পায় নাজিম। কিন্তু টাকার অভাবে সেগুলো ছাড়াতে পারেনি।
খাওয়ার পর শোয়া। এ তাদের নিত্যকার অভ্যাস। কিন্তু না শুয়ে বসে থাকে নাজিম। পথে আসতে-আসতে নিজেকে বারবার বুঝিয়ে-বুঝিয়ে রাগ ধুয়ে তারপর বাড়ি ফিরেছে। খুব মোলায়েম সুরে সে বলে, তোর যে ট্যাকার দরকার আমাক্ বুলিস্নি ক্যান্? বিস্মিত রাশিদা। কিন্তু সে-ও আজ কঠিন শাসনে বেঁধেছে নিজেকে। তাই নরম সুরে বলে, আমার ট্যাকার দরকার তুমাক্ কে বুইল্লো? তাহিলে গয়না বন্ধক রাখলি যে? থতমত খেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় রাশিদাÑ সত্যি কথা বুইল্বা? একটু থামে, তারপর নাজিমের নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে বলে, আমার লিজের কামে তুমার ট্যাকা আমি লিতে চাইনি। তাছাড়া তুমার বিলাকের পাপের ট্যাকা হাতে লিয়ার ইচ্ছা নাই আমার। কথাটা এবার বেশ একটু রূঢ় এবং তীর্যক হয়ে যায়। হয়তো কণ্ঠেও ক্ষোভ প্রকাশ পায়। কথাগুলো বলে ফেলার পর আফসোস করতে লাগল সে। আজ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল রাশিদা কোনো বিষয় নিয়েই ঝগড়া-মনোমালিন্য করবে না নাজিমের সঙ্গে, রাগ দেখাবে না। কিন্তু এ বোধ হয় তার বদ-অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
ক্ষেপে যায় নাজিমও। সারা রাস্তার প্রচেষ্টা, এখনকার প্রয়াস, কোনোটাই আর কাজে লাগে না। সে চিৎকার করে ওঠেÑ আমার, আমার, আমার! খালি আমার! তুই কার? বুল্, তুই কার? উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় সে। পায়চারী করতে থাকে ঘরময়। টেবিল থেকে বড় আয়নাটা তুলে মেঝেতে ছুঁড়ে মারেÑ বুল্, তুই কার? বুল্! হঠাৎ বিছানায় এসে রাশিদার মুখোমুখি বসে নাজিম। দুহাতে তার চুল আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাতে থাকেÑ তুই কি মানুষ না রে রাশিদা? তোর বুকে কি ইট্টুক্ ভালোবাসাও নাই? কার লেগি আগলায়ে রাইখিছিছ্ তোর ভালোবাসা? বুল্ তো! তারপর হাউমাউ করে কাঁদেÑ তোক্ আমি ভালোবাসি রে রাশিদা। তোক্ আমি ভালোবাসি। তোর লেগি আমি সব কিছু কর্ইতে পারি...সব! কিন্তুক্ তোর ঘিন্না-অবহেলা আমার আর সহ্য হোচ্ছে না। রাশিদাকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কাঁদতে থাকে সে। রাশিদা সাড়া দেয় না। কিন্তু প্রত্যাখ্যানও করে না। কোনো রা-ও করে না। রোজকার মতো ভোর হয়। ঘুম ভাঙে ওদের। নিত্যদিনের কাজ-কর্ম সারে। নাজিমের এখন বের হওয়ার সময়। বারান্দার ধাপির পাশে বসে আছে রাশিদা। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে নামে নাজিম।
তুমি বুলে দুকান খুইল্ছো আবার? থমকে দাঁড়ায় নাজিম। রাতের ঘটনার পর তার মনটা অনেক হালকা লাগছে এখন। কান্নার দরকার ছিলো হয়তো। অনেক দিনের জমাট পাথরের মতো দুঃখ ও জ্বালা গলে-গলে বেরিয়ে গেছে তার বুক থেকে। কিন্তু নিজেকে বড্ড ছোট আর হীনও মনে হচ্ছে তার। সকালে উঠে এখন পর্যন্ত রাশিদার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি সে। এখন অবাক হয় এই ভেবে যে, তার খবর রাখে রাশিদা। সত্যিই সে কয়েকদিন থেকে দোকান খুলছে এবং নিজেই বসছে। কিছু মাল-পত্রও তুলেছে দোকানে। দোকান সাজানোর জন্য আরও টাকা দরকার। সব টাকা সোলেমান শেখের সঙ্গে চোরাকারবারিতে আটকে আছে। চেষ্টা করছে সে টাকা তুলে ব্যাবসায় লাগাতে। সোলেমান শেখের সঙ্গে দহরম-মহরম শুরু থেকেই পছন্দ নয় রাশিদার। লোকটা কালোবাজারিদের থানদার। মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। কীভাবে-কীভাবে যে তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে নাজিম তা সে নিজেও বুঝতে পারে না। এখন সহজে বেরিয়ে আসাও সম্ভব নয়। লোকটা এতই চালাক যে, কোনো-না-কোনো সূত্রে বেঁধে রাখবেই। যেমন এখন তার টাকা আটকে রেখেছে।
দুকানে মুন দ্যাও। ওই সলেমান হারামির সাথে ওঠা-বসা বাদ দ্যাও।
কী বলবে ভেবে পায় না নাজিম। একবার কেবল মুখ তুলে দেখে তাকে। তারপর পা বাড়ায়। তখন তার সামনে একটা হাত বাড়িয়ে ধরে রাশিদা। হাতে এক তাড়া নোট।
দুকানে মাল তুইলো।
কিসের ট্যাকা?
যারই হোউক। হালাল ট্যাকা।
দ্রুত বিদ্যুৎ খেলে যায় নাজিমের মস্তিষ্কেÑ এই মাল তুলার লেগি তুমি গয়না বন্ধক দিইছো? তার বুকের ভেতরটা উথলে ওঠে। অশ্রুসজল চোখ দুটো টলমল করে। লজ্জায় স্ত্রীর দিকে তাকাতে পারে না সে। দ্রুত পা বাড়ায় বাহিরমুখে।
বেশি রাইত্ কইরো না।
এবার দ্রুত পেছন ফিরে তাকায় নাজিম। কিন্তু স্ত্রীর মুখটা দেখতে পায় না ভালো করে। তার চোখের জলে ঝাপসা। তোলপাড় করে তার বুক। দ্বিধা-সন্দেহে দোদুল্যমান হƒদয়ে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে যায় সে। সন্ধ্যা পেরোতেই দ্রুত দোকান বন্ধ করে নাজিম। বাড়ি যাওয়ার আগে একবার সোলেমান শেখের গদিতেও যেতে হবে। টাকা পেলে রাশিদার বন্ধকী গয়না তুলে নিয়ে যাবে। সেটা আজকের জন্য নিশ্চয়ই একটা প্রয়োজনীয় কাজ। গদিতে নেই শেখ। কিন্তু আজ তাকে টাকা পেতেই হবে। শেখও কড়াল করেছে আজ তাকে টাকা দেবে বলে। সে গুদাম চত্বরের অফিসের দিকে এগোয়। বাইরে গেটের মুখে আলো জ্বলছে। লোহার গেটের ভারী পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢোকে নাজিম। অফিসঘরের দরজার কাছে যাওয়ার আগে আধখোলা জানালা। সেই জানালা গলে শাদা আলো পড়ছে বাইরের বারান্দায়। সেটা পেরোতেই একটা কথা কানে আসে তার। চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে সেখানেই। শেখ বলছে, ওইসব সমিতি-টমিতি সব ফিনিশ কইরা দিতে হইবো। আজ বাঁধডা কাইট্যা দে, গাঙের পানিতে ডুইব্যা ভাইস্যা যাউক সব কিছু। আর ওই হারামি মাস্টারের একটা পা-ও যেন আস্ত না থাকে। তারপর দেখছি আমি। শিউরে ওঠে নাজিম। সোলেমান শেখ নদীতীরের বাঁধ কেটে সব ডুবিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে! তার রাগটা বোঝে নাজিম। লোকটা যে কেবল চোরাকারবারি তা-ই নয়, সুদখোর মহাজনও বটে। মাস্টার গ্রামের লোকদের নিয়ে সমিতি করে ব্যাংক এবং এনজিও থেকে ঋণের ব্যবস্থা করেছেন। এতে তার মহাজনী ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে কারণে মাস্টারের ওপর তার ভীষণ রাগ।
এ সময় ঘরে ঢোকা ঠিক হবে কি না ভাবে নাজিম। বরং ফিরে যাওয়াই ভালো মনে হয় তার। বেরোবে বলে ঘোরে। আর তখনই ঘর থেকে দরজা ঠেলে বেরয় একজন। তাকে দেখে হইহই করে ওঠে লোকটাÑ কে? এই, কে ওইডা? কণ্ঠটা অচেনা। এক ঝলক দেখে তাকে শনাক্ত করতে পারে না নাজিম। কোনো নতুন লোক হবে। হয়তো ময়মনসিংহ এলাকা থেকে গু-া ভাড়া করে এনেছে। সেই এলাকারই মানুষ শেখ। থতমত খেয়ে দৌড় লাগায় নাজিম। লোকটা ধর-ধর করে চেঁচাতে থাকে। হইচই শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আরও সব লোকজন। তাড়া করে তাকে। আলোয় পেছন থেকে তাকে চেনা যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাজারে গেলে ঠিকই তারা খুঁজে বের করবে তাকে। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে যে কোনো মূল্যে পাকড়াও করতে চাইবে তারা। তাছাড়া শেখের এই ষড়যন্ত্রের খবর জানাতে হবে গ্রামবাসীকে। দৌড়াতে-দৌড়াতেই এসব চিন্তা তার মাথায় ভিড় করে। সেজন্য বাজারে না গিয়ে বাড়ির পথে ছোটে নাজিম। গু-াদের গতিবিধি লক্ষ করতে একটু এগিয়ে মাঠের মধ্যে খানিকক্ষণ লুকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ সেদিকে কেউ আসে না দেখে বাড়ির পথ ধরে শেষে। ওরা হয়তো বাজারের দিকে গেছে। এই ফাঁকে পালাতে হবে। গ্রামে গিয়ে শেখের সব ষড়যন্ত্রের কথা বলে দেবে সে। বাঁধ কেটে দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভেসে যাবে গোটা গ্রামÑঘর-বাড়ি, গরু-ছাগল, ক্ষেতের ফসল, সব কিছু। সেটা সে হতে দেবে না। জেনে-শুনে এতো বড় সর্বনাশ হতে দিতে পারে না সে। সাবধান করে দিতে হবে মাস্টারকেও। আগে-ভাগেই। আর তার জন্য অপেক্ষা করছে রাশিদা। বলেছে, ‘বেশি রাইত্ কইরো না।’ নিশ্চয়ই তার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করছে সে।
আসলে অনেক দিন থেকেই উপায় খুঁজছিল সোলেমান শেখ। তার মহাজনী সুদের ব্যবসা মার খাচ্ছিল। কালোবাজারিরও অসুবিধা হচ্ছিল। গ্রামবাসীকে ম্যানেজ করতে চেয়েছিল সে। এ কাজে ব্যবহƒত হতে রাজি হয়নি নাজিম। এখন অন্য পথ নিয়েছে শেখ। লোকটা যে এতো সাংঘাতিক তা তার ধারণার অতীত ছিল। তাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে লোকটা। সে তার কাছে ঋণী। তাই বলে তার এতবড় অন্যায় কাজ বরদাশত করা কি সম্ভব? কোনো মতেই এটা হতে দেবে না সে। আকাশে ঘন মেঘ। দূরে বিজলি চমকাচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। তার কাছে টর্চলাইট আছে, কিন্তু জ্বালাচ্ছে না। পাছে আলো দেখে শত্রুরা টের পেয়ে যায়। তীক্ষè চোখে, কান সজাগ রেখে চলেছে সে। পায়ের নিচে রাস্তাভর্তি কাদা।
হঠাৎ বাম দিকে মাঠের মধ্যে একটু শব্দ ওঠে বলে মনে হয় নাজিমের। সেদিকে তাকায় সে। কিন্তু এমনই গভীর অন্ধকার যে কিছুই চোখে পড়ে না। শব্দটাও আর শোনা যায় না। কাদা-পানিতে কোনো জলজ প্রাণী বা জন্তুর নড়াচড়ার শব্দ হবে হয়তো। একথা ভেবে একটু বা স্বস্তি পায়। তখনই তাকে অতর্কিত চমকে দিয়ে গুলির শব্দ হয়। পরপর কয়েকবার। বাম জানুতে একটা জোর ধাক্কা লাগে। সামলাতে না পেরে পড়ে যায় নাজিম। যন্ত্রণায় ভয়ে গুমরে ওঠে। আবার গুলি। সাঁই-সাঁই করে তার মাথার ওপর দিয়ে ছুটে যায় পর-পর কয়েকটা। কয়েকজন মানুষের ছুটে আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা যে শেখের গু-া, তাকে মারতে ওঁৎ পেতে ছিলো, তা বুঝতে আর বাকি থাকে না তার। দ্রুতই টের পায় সে তার বাম জানুতে গুলি লেগেছে। ক্ষতস্থান ছুঁয়ে দেখে ভেজা। গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। বাম হাত দিয়ে চেপে ধরে ক্ষতস্থান। ওরা ছুটে আসছেÑশালারে লাগছে মুনে লয়। র্ধ শালারে। পেছনে সরতে থাকে নাজিম। পথে থাকলে ওকে ধরে ফেলবে গু-ারা। বামে, ওরা পথের যেদিকে আছে সেদিকেই নামে সে। রক্তের চিহ্ন দেখে-দেখে তাকে অনুসরণ করবে ভেবে দ্রুত গায়ের জামা খুলে শক্ত করে বাঁধে ক্ষতটার ওপরে। তারপর ছোটে। গু-ারা পথের ওপর উঠে টর্চ মেরে-মেরে খুঁজছে তাকে। মাঠের মধ্যে পানি এখন। দৌড়ানো তো দূরের কথা দ্রুত হাঁটতেও পারছে না সে। পায়ে গুলির ক্ষত। তার ওপর শব্দ হবে এই ভয়। সামনে একটা পাটের জমি। তার মধ্যে ঢুকে একটুখানি বসে নাজিম।
গু-ারা একবার রাস্তার এদিকে, আরেকবার ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে। তারপর এক জায়গায় জড়ো হয়ে দাঁড়ায়। টর্চের আলো গুনে নাজিম ধারণা করে গু-ারা সংখ্যায় চার-পাঁচ জন হবে। হয়তো পরামর্শ করছে। তারপর পথের ডানে মাঠের মধ্যে নামে ওরা। ওটা টাঙ্গনে যাওয়ার সোজা, সংক্ষিপ্ত মেঠো রাস্তা। দিনেরবেলা বা শুকনোর সময় টাঙনের লোকেরা ওই পথেই আসা-যাওয়া করে। তার মানে তাকে ছেড়ে গু-ারা হয়তো বাঁধ কাটতে এগুলো। অস্থির হয়ে ওঠে নাজিম। এখন যে কোনো উপায়ে তার বাড়ি ফেরা দরকার। তখন হঠাৎ নিজেকে তার খুব দুর্বল অনুভব হয়। শরীরটা ভারী হয়ে উঠেছে। কষ্ট করে পাটক্ষেতের আরও ভেতরে ঢোকে সে। একবার আড়াল করে ত্বরিত টর্চ জ্বেলে দেখে রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার পা। গলগল করে রক্ত ঝরছে। আজ অনেক হালকা রাশিদার মন। কাল থেকে খুব কেঁদেছে। কখনো ঝমঝম বৃষ্টির মতো, কখনো খেজুর গাছের রস চোঁয়ানোর মতো টিপটিপ করে অশ্রু ঝরেছে দুচোখ ফেটে। কান্নায় কান্নায় বুকের বরফ-জমাট কষ্ট গলে বেরিয়ে গেছে। অবশ্য এখনো কুয়াশার মতো দুঃখ-মেঘের আনাগোনা তার মনের ঘোলাটে আকাশে। যেমন কি না কদিনের ভারী বর্ষণের পর আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়নি, কিন্তু আকাশ এখনো কালচে মেঘে আচ্ছন্ন। রোদহীন দিনটা কেমন যেন ছায়াময়-মায়াময়-রহস্যাবৃত।
দেখতে দেখতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। পাড়ার মসজিদে মাগরিবের আজান পড়ে। বুড়ো খালেক দাদার ভাঙা গলার আওয়াজে কেমন যেন কান্নার সুর। প্রায়ই শোনে সে এই আজান। কিন্তু আজ কেন যেন মনটা ভারী হয়ে ওঠে রাশিদার। তবু পাত্তা দেয় না। হাঁস-মুরগিগুলো খোঁয়াড়ে ভরে। হারিকেন জ্বালায়। নামাজ পড়ে। তারপর রাঁধতে বসে। আউশের গরম ভাত ভারি পছন্দ নাজিমের। এই জাতের ধান আজকাল আর হয় না। পদ্মা মরে যাওয়ায় অনেক ফসলই এখন আর সে রকম ফলে না এই অঞ্চলে। চোত-বোশেখ মাসে জমি শুকিয়ে খা-খা। বৃষ্টি হয় না। ধানের বীজ বোনাই যায় না। তারপর কোনো বছর কোনো রকমে বুনতে পারলেও রসের অভাবে চারা বাড়ে না। ধানের শীষ ফোটে না। দুধ জমে না ধানে। ধানের দানা শুকিয়ে পাতান হয়। আউশ ধানের মিষ্টি চাল আজকাল মেলা ভার। তারপরেও কিছু-না-কিছু চাষ হয় বটে। কিছু চাল আছে তার ভাঁড়ারে। নাজিমেরই সংগ্রহ করা। সেই চাল বের করে রাশিদা। মনের মতো রাঁধবে সে আজ। রান্না-বান্না তো রোজকার কাজ। কিন্তু আজকের কথা ভিন্ন। তার মনের মধ্যে আজ সেই ভিন্নতার সুর বাজে। ঝিঁঝিঁ পোকারা সেই সুরের সঙ্গে সুর মেলায়। ঘন অন্ধকারের নৈঃশব্দ্য কেমন মুখর হয়ে ওঠে। রান্না শেষ করে আবার ঘর-দোর পরিষ্কার করে রাশিদা। খাটের নিচ থেকে বাকসো টেনে খুঁজে খুঁজে একটা জামদানি শাড়ি তুলে নেয়। প্রায় বছরখানেক আগে তার জন্যে সখ করে শাড়িটা কিনে এনেছিল নাজিম। একদিনও পরা হয়নি। এমনকি ভাঁজটাও খোলা হয়নি। নাজিমের প্রতি তার এই বিরাগের কী কারণ ছিল? সে নিজেই এখন তার কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না। মানুষের মন এমনই বিচিত্র, রহস্যময়। সে অনেক সময় নিজের মনকে নিজেও চিনতে পারে না। এটা ঠিক যে, নাজিমকে সে বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু ছেলে হিসেবে কোনো দিক থেকেই সে তার অনুপযুক্ত নয়। তবু এই সামান্য বিরাগই তাকে এতদিন ধরে স্বামীর প্রতি নিস্পৃহ করে রাখল। শত অপমান, বঞ্চনা সয়েও নাজিম তাকে আপন করে নিতে কম কসুর করেনি। কিন্তু বশ মানেনি রাশিদা। সেই অনমনীয় মনটাই আবার কত সহজেই না গলে গেল।

************
কালকের সামান্য একটা ঘটনা তার বাঁকা মনকে সোজা করে দিয়েছে। জীবনকে আর ফাঁকি দিতে চায় না সে। জামদানি শাড়িটা পরে রাশিদা। একটু সাজেও। তুলে-রাখা নতুন চাদর-বালিশ পাতে বিছানায়। নাজিমকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। ঠিক তাড়াতাড়িই ফিরবে সেÑ এ তার দৃঢ় বিশ্বাস। এই বিশ্বাস তার নতুন অর্জন। এশার আজানের আগেই এসে পড়বে ভালোবাসার কাঙাল লোকটা, তার মন বলছে। হারিকেনের আবছা আলোয় আয়নায় তার মুখটা ভালো করে ফোটে না, তবু তা-ই দেখে, নিজে-নিজেই শরমে মুখ লুকায়। কখন যে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল টের পায়নি রাশিদা। কিসের একটা শব্দে যেন ভেঙে যায় কাঁচা ঘুম। ধড়মড় করে উঠে বসে। তখন সব মনে পড়ে।
কদিন থেকেই তার বুকটা ধুকপুক করছে। তলপেটে কেমন যেন অনুভূতি। রজঃস্রাব হচ্ছে না। কী একটা আশঙ্কা আর আনন্দে তার হƒদয় সব সময় আনচান করছে। কাউকে বলা দরকার। বারবার নাজিমের কথাই তার মনে হচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছে না। ইদানীং লোকটা বদলে যাচ্ছে। কেমন শীতল আর বাকসংযমী হয়ে উঠেছে। ‘বিলাক’ নিয়ে মেতেছিল। তাতেও আর মন নেই। সে শুনেছে বন্ধ দোকানটা আবার খুলছে নাজিম। শুনে ভালো লেগেছে। পুঁজি না হলে ব্যবসা করবে কী দিয়ে? সব টাকা তো সলেমান শেখের গদীতে আটকা পড়ে আছে। ও টাকা কবে তুলতে পারবে, বা পারবে কি না কে জানে। এ নিয়ে অনেক ভেবেছে সে। ভেবে-চিন্তেই তার গয়নাগুলো বন্ধক দিয়ে টাকা এনেছে। সে-ও কয়েকদিন হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই সে কথা নাজিমকে বলতে পারছিল না সে। পারছিল না টাকাগুলো তার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু সেজন্য এমন নাটুকে ঘটনা ঘটে যাবে সেটি সে ভাবেনি কখনো। ভারি হাসি আর লজ্জা পায় তার।
বিছানায় বসে আছে রাশিদা। স্বামীকে বরণ করার জন্য সেজে-গুজে তৈরি হয়ে আছে। মানুষটাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। তাড়াতাড়িই ফিরবে সে। সে যে প্রেমিক-প্রাণ, তার জন্য দিওয়ানা! সে বোঝে সেটা। আজ থেকে তারা নতুন জীবন শুরু করবে। কিন্তু এখনো ফেরে না কেন? তার মনে হয় অনেকক্ষণ থেকে বসে আছে সে। এখন অনেক রাত। সে নিজেই অবাক হয়ে অনুভব করে অজানা আশঙ্কায় তার হƒদয়ে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। এমন তো আগে হয়নি কখনো! বিছানা থেকে নামে রাশিদা। বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। টিনের চালে তার গানের ঝুমঝুম শব্দ। হঠাৎ সেই শব্দ ছাপিয়ে তার কানে ঢোকে লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি। তার বুকে কে যেন হাতুড়ি পেটাতে শুরু করে। হারিকেন হাতে নিয়ে বারান্দায় বেরয়। সেকি! উঠোনভর্তি পানি। পানি তো নয়, পানির স্রোত! এমন বৃষ্টি তো হয়নি যে সব ভেসে-ভুসে যাবে! ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সে। নিশ্চয়ই বাঁধ ভেঙে গেছে। গাঙের পানি ঢুকছে হু-হু করে। একবার এ রকম হয়েছিল। তখন অনেক ছোট ছিল সে। বাঁচতে হলে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে। এতসব ভাবে সে, কিন্তু ভয়ে নিচে নামতে পারে না। ভয়ার্ত চিৎকারে গলা ফাটাতে থাকে।
 কয়েকটা পাকা বাড়ি আর বড় বড় কিছু গাছ মাথা জাগিয়ে আছে কেবল। বাকি শুধু পানি আর পানি। মানুষের ঘর-বাড়ি, আসবাব, পোশাক-আষাক, তৈজস-পত্র, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কুকুর-বিড়ালের মরদেহ ভেসে বেড়াচ্ছে যত্র-তত্র। অনেকগুলো মানুষের লাশ উদ্ধার হয়েছে। যেন নূহ নবীর প্লাবন বয়ে গেছে। গাঙের পেটে বিলীন হয়ে গেছে টাঙনসহ আরও কয়েকটা গ্রাম। এই গ্রামগুলো যেন ছিলোই না কোনো দিন। সবখানে শুধু পানি আর পানি। ঘোলা পানির স্রোত বয়ে চলেছে উত্তরে। যেন গাঙটা পশ্চিম থেকে ধেয়ে এসে এখানে উত্তরমুখো একটা শাখা ঠেলে দিয়েছে। ময়নার বাপ, খালেক হাজী, ছুরাতন বেওয়া, এবং এদের মতো আরও পাঁচ জন মুরুব্বি ও এগার জন শিশুর লাশ পাওয়া গেছে। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আরও অনেকের। গভীর রাতের অকস্মাৎ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে ওরা। ছুটে এসেছে সরকারি-বেসরকারি উদ্ধারকারীরা। মানুষ সরে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। এ রকম বন্যার কবলে কখনো পড়েনি এ অঞ্চলের মানুষ। আসল কথা জানতে বিকেল গড়ায়। লোক পাঠিয়ে বাঁধ কেটে দিয়েছে সোলেমান শেখ। এ খবর জানতে পেরে গ্রামে ছুটে যাচ্ছিলো নাজিম। শেখের গু-ারা তাকে গুলি ছুঁড়ে আহত করে। অনেক কষ্টে পালিয়ে পাশের গ্রামে পৌঁছেছিল সে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। লোকেরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার শরীর রক্তশূন্য হয়ে পড়েছিল। তাকে বাঁচাতে পারেনি ডাক্তাররা। কিন্তু অজ্ঞান হওয়ার আগেই অনেক কথা বলতে পেরেছে নাজিম। সে খবর বারুদের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে বানেশ্বর বাজারে। তারপর আশপাশের গ্রামে। তারপর সর্বত্র। শত শত মানুষ বানেশ্বর বাজারে সোলেমান শেখের বাড়ি ঘেরাও করে। পুলিশ আসে। সরকারের লোকেরা আসে। জনতাকে শান্ত ও নিবৃত্ত করার পর শেখকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ওরা।
হাসপাতালে গিয়েছিল রাশিদা। কিন্তু সে পৌঁছার আগেই মারা যায় নাজিম। স্বামীর লাশ দেখে এতটুকুও কাঁদেনি সে। দিনকয়েক পর গাঙের রাগ পড়ে। কিছু পানি নেমে যায় উত্তরে, ঘর-বাড়ি খাল-বিল ডুবিয়ে-ভাসিয়ে। বাকিটা ধীরে ধীরে ফিরে যায় পদ্মায়। গোটা গ্রামে এখন কাদা আর কাদা। কারও কারও ভিটের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। সব মাটিসমান। খাদ-খন্দক-পুকুর-নালা কাদা-পানিতে থকথক করে। মাঠময় ছিকছিকে বন্যার পানি। ফসলের চিহ্নও নেই কোথাও। গাছপালা উপড়ে পড়ে আছে এখানে-সেখানে। কদিন যেতে না যেতেই বসবাসের অযোগ্য এই কাদা-পানির মধ্যেই গ্রামে ফিরতে শুরু করে গ্রামবাসী। রাশিদার বাড়িতে বেজায় ভিড় আজ। তাকে দেখতে এসেছে সবাই। জব্বার মুনশি এসেছে সিংড়া থেকে। মেয়েকে নিয়ে যাবে। এ গাঁয়েরই বাশিন্দা ছিল জব্বার মুনশি। বছর দুয়েক হলো সে সিংড়ায় শ্বশুরের দেশে গিয়ে বসত গেড়েছে। তার ধারণা, পদ্মা নদী মরে যাবে। ফসল হবে না আর এ অঞ্চলে। মরুভূমি হয়ে যাবে গোটা এলাকা। তার মতো আরো অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। প্রবল বিরোধিতা করেছিল রাশিদাÑকবে দ্যাশ মরুভূমি হয়ে যাবে বুইলি ভিটি ছেইড়ি পালাবে? তুমি কী রকুম মানুষ বাপজান? কিন্তু এখনকার কথা আলাদা। সকালে যখন সে কথাটা পাড়ে তখন রাশিদা বেঁকে বসেছিল বটেÑআমি যাবো না বাপজান। সুয়ামির ভিটি ছাইড়ি কুনুঠে যাবো না আমি। মুনশি ভাবে এরকম আবেগ স্বাভাবিক, এ অবস্থায় একটু জোর খাটাতে হয়Ñএকা-একা কী কইরি থাক্পি রে মা? কী কইরি দিন গুজরান হবে তোর ভাইবিছিছ্ সেকথা? আমার সুয়ামির ব্যবসা আছে, জমি আছে, আমার অভাব কিসের? আমি ব্যবসা কইরবো... আবাদ কইরবো...
তুই ম্যা মানুষ, একলা...
ক্যান বাপজান? আমার কি বুদ্ধি নাই? গতরে শক্তি নাই?
মহা ফাঁপরে পড়ে মুনশি। মেয়ে এখনো যুবতী। সারাটা জীবন পড়ে রয়েছে সামনে। পাশে স্বামী নেই, সন্তান নেই...জীবন কি এতই সোজা? আবেগের জোরে অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্তু আবেগ চিরদিন থাকে না। রূঢ় বাস্তবতার আগুনে আবেগের রস শুকাতে সময় লাগে না। তবু অবুঝ মন মেয়ের। স্বামীর ভিটে ছেড়ে যেতে চায় না। মেয়ের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে পাঞ্জাবির খোঁটায় চোখ মোছে জব্বার মুনশি। পাড়ার লোকেরা ভাবে, হঠাৎ ভারি স্বামীভক্ত হয়ে উঠেছে মেয়েটা। এমন তো ছিলো না আগে! তারাও বোঝায় তাকে। শেষ পর্যন্ত বোঝে রাশিদাÑএ তার বাপের মতো দেশ মরুভূমি হয়ে যাবে বলে পালানো নয়, তার শেকড় ছিঁড়ে গেছে! এখন তার আশ্রয় দরকার। বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে প্রস্তুত জব্বার মুনশিÑচল্ মা, বেলা হয় যায়ছে।এর-ওর কাছে বিদায় নিতে থাকে রাশিদা। হঠাৎ কী যে হয় ওয়াক-ওয়াক করে ওঠে। দ্রুত ছুটে যায় উঠোনের এক কোণে। তার পেছন পেছন মেয়েরাÑ কী হলো? ও মা, কী হলো?
সামান্য কিছু ওঠে-কি-ওঠে না, শুধু ওয়াক-ওয়াক।
মেয়েরা কানাকানি শুরু করে।
এগিয়ে যায় মুনশিÑ কী হলো রে মা?
প্রথম কিছুক্ষণ বাপের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারে না রাশিদা। তারপর যখন মুখ তোলে তখন মুনশি দেখে কী তরল, কোমল, দরদ-উথলানো চোখ দুটো তার মেয়ের! প্রথম মা হওয়ার লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে তার শুকনো মুখ। কী করা বা বলা দরকার ভেবে পায় না মুনশি। শেষ পর্যন্ত মেয়েই তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেÑ তুমি যাও বাপজান, আমি আর যাব না।
ক্যান্ রে মা? কী হলো আবার?
বুঝতে পারছ না? তুমি যে নানা হবে গো মুনশি! ভাবি সম্পর্কের এক প্রৌঢ়া এগিয়ে এসে বলে কথাটা। তা সে কিছুটা টের পেয়েছে বৈকি। তার হতভম্ব অবস্থা দেখেই কি না কে জানে ধমক খাওয়া ছোট্ট বালিকার মতো ফুলতে ফুলতে কান্নায় ভেয়ে পড়ে রাশিদা। বাপকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল সেÑ বুলো বাপজান? মানুষের কি সুয়ামি মরে না? তাই বুইলি সুয়ামির ভিটি ছাইড়ি পালায়ে যায় মানুষ? কেউ কর্ইলেও কর্ইতে পারে, আমি সে রকুম মানুষ না। গুমরে ওঠা কান্নার মধ্যেও মেয়ের হƒদয়-উৎসারিত কণ্ঠের জোর টের পায় মুনশি। তার চোখ ফেটেও কান্নার ঢল নামে। তখন শেষ বিকেলের লালচে আলোয় দিগন্তবিস্তৃত চরাচর জুড়ে কতো যে রঙের খেলা! বিশাল দুকূলপ্লাবী গাঙের এক কোণে ডুবে যাচ্ছে সূর্যটা। আগামীকাল তার এই বিপুল কোলের আরেক কোণ থেকে জেগে উঠবে নতুন একটি সোনালি ভোর। ঘনায়মান সন্ধ্যার রহস্যময়তার গভীরে যেন ঘটে চলেছে তারই স্বপ্ন রচনার কাজ। সেদিকে তাকিয়ে মুনশি ভাবে, মেয়ের এখন শেকড় গজিয়েছে। তাকে আর টলানো যাবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন