মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। গলিতে স্ট্রিট লাইট জ্বলে ওঠেছে (যে কটা লাইট ভালো আছে সেগুলো)। গলির শেষপ্রান্তটি আসলে শহর, না গ্রাম, নাকি পাহাড়Ñ এটা কেউই নিশ্চিত নয়। এটাকে কেউ চাইলে শহর বলতে পারে, আবার গ্রামও বলা যায়। পাহাড়ি টিলার তলানিতে বলে পাহাড়ও বলে কেউ। এরকম একটি অস্পষ্ট পরিচিতির স্থানটিতে কেরামত মিয়ার চায়ের দোকান। সেই চায়ের দোকানটির বয়সও কেরামত মিয়ার বয়সের মতো গোঁজামিল দেওয়া। কেউ বলে দশ-বিশ, কেউ বলে পঁচিশ-ত্রিশ। কেরামত মিয়াও সঠিক বলতে পারে না (হয়তো ওভাবে হিসাব রাখেনি, হিসাবের দরকারও পড়েনি)। তবে সে মাঝে মাঝে কাউকে বলে, ‘ধরো তখনো বগলে লোম গজায় নাই। সেই সময় থেকে এখানে স্টল দিছি।’ তার কথাই ঠিক হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। যে যখন থেকে চা-স্টলটি দেখছে, কথা ওঠলে সেভাবেই হিসাব করে।
তবে অনেকেই প্রথম দিকের কথা টেনে বলে, ‘তখনতো পাকাঘর ছিল না। ছন-বাঁশের একটা খুপরি ছিল।’ আসলে জায়গাটা শহরের মধ্যে, নাকি বাইরেÑ তা নিয়েও কথা আছে। তবে যারা এখানে আসেন, এই স্থানের সঠিক পরিচয় নিয়ে তাদের তেমন বাড়তি কোনো কৌতুহল আছে বলে মনে হয় না। এখানে যারা আসেন, তাদের কেউ সরকারি চাকরিজীবী, কেউ বেসরকারি চাকরিজীবী, পুলিশ, শিক্ষক, ব্যবসায়ীÑ নানা ধরনের মানুষ। কেরামত মিয়ার স্টলটি শহরের কোলাহল থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন জায়গায় বলে নিরিবিলি। এখানে মিঠে-কড়া তর্ক করার মতো সুন্দপরিবেশ আছে। এ কারণে অনেকেই সন্ধ্যা হলে হাঁটতে হাঁটতে তার স্টলে গিয়ে ভিড় করেন অনেকেই। আর তাদের মধ্যে প্রায় নিয়মিত অনেকেই আছেন। মদের নেশার মতো তাদের একটা টান রয়েছে এই স্টলের প্রতি। এখানে যারা আসেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মদ পান করে থাকতেও পারেন। তারা কারা, এটা কেরামত মিয়ার জানা আছে। তিনি কখনো কখনো কাউকে ভেতরের একটি ছোট কক্ষে মদ পান করার সুযোগও করে দেন। এতে তার বাড়তি কোনো লাভ নেই। অনেকদিনের একটা সম্পর্ক, সকলের সাথে পরিবারের মতো হয়ে গেছে। কেরামত মিয়ার বয়স পঁয়তালিশ-পঞ্চাশ, একটু এদিকওদিকও হতে পারে। বউয়ের বয়স তার চেয়ে বেশ কমই মনে হয় (এটা আসলে বউয়ের ঢলানি গা-গতর দেখে অনুমান। অনেকের বয়স হলেও শরীর দেখে সেটা বোঝা যায় না। কেরামত মিয়ার বউয়ের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু হতে পারে। বয়স তার শরীরে কোনো কারণে এখনও ছোবল দিতে পারেনি)। এখনও চোখে লাগার মতো। সেই বউ স্টলের রান্নাঘরটি একাই দুই হাত-দুই পায়ে সামাল দিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত জমিয়ে রাখেন। যারা নিয়মিত আসেন, তাদের বউরা কেরামত মিয়ার বউকে নিয়েও খোঁচা মারতে কসুর করেন না।
Ñ‘চা, আড্ডা এসবতো অছিলা মাত্র। মনে করো কিচ্ছু বুঝি না। যাওতো তার বউয়ের কাতলা মাছের মতো পাছা দেখতে।’
অনুমান ঠিকও হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে কেরামত মিয়ার বউয়ের দিকে টানের কথাটা একেবারে মিছা না। কেরামত মিয়ার বউয়ের শরীরের মতো শরীর যে কারো কারো বউয়ের নেই, এমন না। কিন্তু কেরামত মিয়ার বউয়ের শরীরের মাঝে চোখ আটকে যাওয়ার মতো একটা নেশা ধরা বিষয় আছে। এটা ঠিক ব্যাখ্যা করে বলা যায় না। তবে এটাও ঠিক, এযাবৎ তার বউকে নিয়ে এখানে কোনো কেলেঙ্কারিও সৃষ্টি হয়নি।
সেদিন সবকটি স্ট্রিট লাইট কেন জানি জ্বলেনি (সেদিনই না, প্রায়ই স্ট্রিট লাইট নিভে থাকে। কেন যে এমন হয়, এটা কারো কাছে ম্পষ্ট না)। ওয়াহিদ উদ্দিন বাসা থেকে বেরিয়েই অন্ধকারের নাড়িভুঁড়িতে ঢুকে গেলেন। মেয়রের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠলো; কিন্তু কিছু বললেন না (বললেও বোঝার উপায় নেই। আশপাশেতো কেউ নেই)। কেরামত মিয়ার স্টলের দিকে হাঁটতে থাকলেন। তার পাশ দিয়ে বড়সরো একটা প্রাণি সরসর করে চলে গেলো। কুকুর, না শেয়ালÑ তা আন্দাজ করতে পারেননি। এদিকে এখনও বেশ শেয়াল দেখা যায়। রাত হলে একসাথে অনেকটি কোরাস শুরু করে (শেয়াল ডাকলে কেন জানি দেশে আছেন, মানে এখনও গ্রামে আছেন, এরকম একটা অনুভূতি হয় ওয়াহিদ উদ্দিনের)। ওয়াহিদ উদ্দিন অনুমান করলেন, এটা শেয়ালই হবে। কুকুর হলে তাঁর পিছু পিছু হাঁটতো। ওয়াহিদ উদ্দিন স্টলে পৌঁছে বুঝতে পারলেন, আগে থেকেই আসর পুরোমাত্রায় জমে গেছে। এই আসরের একক কোনো চরিত্র নেই। যেদিন দেশে বা বিদেশে, শহরে বা পাড়ায় যে ঘটনা আলোচিত হয়; আলোচনার প্রধান বিষয় সেটিই। এর ফাঁকেফুকে আরো অনেক কিছু হয়তো ঢুকে পড়ে।
ওয়াহিদ উদ্দিন স্টলে এসে রাস্তার দিকের একটি চেয়ারÑটেবিল নিয়ে বসে পড়েন। তাকে দেখে এগিয়ে আসেন তছবিহ কাজিমÑ অর্থাৎ কাজিম উদ্দিন। ইদানিং তার হাতে প্রায় বারো মাসই একগাছা তছবিহ ঝুলে থাকে। তিনি অবশ্য আড্ডার নিয়মিত কেউ নন। মাঝেমধ্যে আসেন। আর তখনই সবার চোখে পড়ে হাতে একগাছা তছবিহ আঙুলের ঠোকা খেতে খেতে চক্কর খাচ্ছে। এ নিয়ে কেউ কথা বলেন না। যার ভাব তার লাভ। কার মনে কী আছে, এটাতো বলা যায় না (যদিও কাজিম উদ্দিনকে নিয়ে অনেক কথাই বলতে পারেন অনেকে। এমন কোনো জাতের আকাম নেই, তিনি তার সাথে জড়িত ছিলেন না। অনেকেই বলেন, তার প্রধান পেশাই ছিল মেয়ে-মানুষের দালালি করা। শহরের বড়লোক-পয়সাঅলাদের ইচ্ছামতো মেয়েমানুষ সরবরাহ করতেন। আর একটা সময় যখন কেরামত মিয়া বিয়া করেননি, তখন তার স্টলের পেছনের দিকে; এখন যেখানে কেরামত মিয়া বউ-ছাওয়াল নিয়ে বাস করেন, সেখানে মেয়ে-মানুষ রাখতেন। এতে কাজিম উদ্দিন ও কেরামত মিয়ার দুজনের কিছু না কিছু নগদ লাভ হতো। এখন নাকি তিনি আর কোনো ব্যবসাপাতির সাথে নেই। ছেলেরা বড় হয়েছে, তারাই সংসার চালাচ্ছে)। সারাক্ষণ হাতে তছবিহ থাকে বলে অনেকেই এখন তাকে তছবিহ কাজিম বলে ডাকেন (তবে ডাকের পেছনে অন্য একটা কারণও আছে। এই এলাকায়ই ছোট-বড় বেশ কজন কাজিম উদ্দিন আছে। নামের আগে-পিছে আলাদা কিছু না বসালে বোঝা যায় না, কার কথা বলা হচ্ছে)।
কাজিম উদ্দিন বলেন, ‘ভাইজান। চা খাবেন না খাওয়াবেন।’
Ñ‘এইমাত্র আইলাম। আগে একটু জিরাই নেই। তুমি খেতে চাও খাও। আমি আরো পরে খাবো।’ বলেই ওয়াহিদ উদ্দিন গলা ছেড়ে বলেন, ‘এই কেরামত কাজিমরে এককাপ চা দেতো।’
ওয়াহিদ উদ্দিন বলেন, ‘শুনলাম তুমি নাকি এবার হজে যাবে।’
Ñ‘জ্বী ভাই, নিয়ত করেছি। এটাতো চাইলেই হয় না। কপালে থাকতে হয়। ইচ্ছা আছে।’
Ñ‘ভালো ভালো।’
এ সময় তাদের কথার মধ্যে এসে ঢুকে যায় ফরিদ মুন্সি। ফরিদ মুন্সি কেরামত টি-স্টলের নিয়মিত কাস্টমার। ফরিদ মুন্সি বলেন, ‘টেলিভিশনে একটা খবর দেখে আসলাম ভাই। মনটা খুব খারাপ লাগছে। একটা লোক তার ছেলে-মেয়েদের খাওয়াতে পারে না বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এনে এক ছেলে ও এক মেয়েকে যমুনা নদীতে ফেলে দিছে। ভাবুনতো দুইটা শিশুর কথা। ইস, ভাবতে গেলেই আমার পুয়া-পুরির কথা মনে আসে। রক্ত হিম হয়ে যায় ভাইজান।’...
‘কিন্তু আমার মাথায় কাজ করছে না, লোকটা যে এমন পশুর মতো কাজ করলো, সে সুস্থ আছেতো। নাকি নিজের ছেলে-মেয়েকে উপুস থাকতে দেখে বাপ হিসেবে আর সইতে পারছিলো না।...’ওয়াহিদ উদ্দিন, কাজিম উদ্দিনসহ যারা তার কথা শুনছিলো, তারা হাঁ করে তার কথা গিলছিলো। এছাড়া তাদের আর কোনো পথও নেই। ফরিদ মুন্সি নিজে থেকে কথা না থামানো পর্যন্ত তাকে আর থামানো যাবে না। ফরিদ মুন্সি বলেন, ‘হয়তো আরো এরকম ঘটনা নীরবে ঘটছে। আমরা আর কয়টা জানতে পারি।’ ফরিদ মুন্সি কথা একটু বেশি বলেন; কিন্তু মিথ্যা বা বানানো কথা খুব একটা বলেন না (হয়তো এক কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেন, এই আর কি)। ওয়াহিদ উদ্দিনের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তার মাথার উপর যেন কড়কড় শব্দে একটা বাজ ভেঙে পড়ে। বিদ্যুৎ চমক নেই, তাই তার বুকের ভেতরে বাজপতনের ভয়াবহতা কেউ টের পায় না। মানুষের বিপন্নতা তাকে খুব বেশি বিচলিত করে।
ফরিদ মুন্সির কথায় স্টলের মেজাজটাই ঝরাপাতার মতো মচমচে হয়ে আছে। পরিবেশ এতোটাই থম ধরা যে, খানিক টোকা লাগলেই যেন সবকিছু হুড়মুরিয়ে ভেঙে পড়বে। ওয়াহিদ উদ্দিন কোনো সময়ই বেশি কথা বলেন না। কথা বলার চেয়ে শোনেন বেশি। এক্ষেত্রে তাই হলো। এ বিষয়ে কোনো কিছু জানতে না চেয়ে মনে মনে ঠিক করলেন, টেলিভিশন বা খবরের কাগজ পড়ে নিজেই বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবেন (এখানে এর বেশি না জানতে চাওয়ার একটা কারণ হয়তো ফরিদ মুন্সিকে আর কথা বলার সুযোগ না দেওয়া)। ঘটনাটি যদি সত্য হয়, যদি একজন পিতা অভাবপীড়িত জীবন থেকে মুক্তি দিতে নিজের সন্তানকে জলে ফেলে দেনÑ তাহলে সামনের সময়টা কীরকম হবে! বিষয়টি ভাবতে খুব ভয় পান তিনি। তাহলে চারপাশে এতো যে রঙচঙ, এতো জৌলুসÑ এটা আসলে ফানুস ছাড়া কিছু নয়! একটু ফুটো হলেই নেতিয়ে পড়বে।
এভাবে সবাই মুখ গোমড়া করে বসে থাকবেথÑ এটা আর যাই হোক, কেরামত মিয়ার চায়ের স্টলের মেজাজ হতে পারে না। এই সময়টায় কম পানিতে পুঁটি মাছের মতো কথারা ওড়ে এখানে। কে যে কী বলে, অনেক সময় তা আলাদা করে বোঝা যায় না। কাজিম উদ্দিন তছবিহটা পকেটে পুরে এই থম ধরা মেঘকে উড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।Ñ‘বোঝছো, সব অইলো আল্লার হুকুম। এ নিয়া আমরা ক্ষুদ্র মানুষ মাথা ঘামিয়ে কোনো কূল-কিনারা পাইমু না। সব আল্লার ওপর ছেড়ে দাও। শান্তি পাইবা, তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করো। এর চাইতে আর বড় কোনো শান্তি নাই।’...ওয়াহিদ উদ্দিন আস্তে করে বলেন, ‘তা কাজিম, এই দুইটা শিশুÑ যারা জীবন কারে কয়, তার কিছুই জানলো না। তারা কি জšে§র আগে জানতো, তাদের পিতা তাদেরকে যমুনার পানিতে ছুড়ে দিবো। এটা কিরকম হুকুম... আল্লাহই জানেন। তিনি সর্বশক্তিমান...!’ এ সময় হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। এই বিদ্যুৎ যাওয়া নিয়ে যদিও কারো কোনো উদ্বেগ নেই। কখন বিদ্যুৎ আসে, কখন যায়Ñ এটা কেউ বলতে পারেন না। দিনে-রাতে অসংখ্যবার বিদ্যুতের এই আসা-যাওয়া চলে। ওয়াহিদ উদ্দিন মাঝেমধ্যে বলেন, ‘এটা অইলো সভ্যতার বিড়ম্বনা।’
কেউ তার কথা বুঝলো কি বুঝলো নাÑ এটা নিয়ে কোনো কৌতূহলও তার নেই। শুধু তার মনে পড়ে, তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে কুপিবাতি ও হারিকেনের আলোয়। তখন এই বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার যন্ত্রণাটা ছিল না। যদিও এখন আর সেই সময়টা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না, আবার এই যে বিড়ম্বনাÑ এটাও তার কাছে ভালো লাগে না। স্থানটি পাহাড়ঘেঁষা বলে এখানে অনেক গাছপালা, বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘুটঘুটে অন্ধকার নামে। চারপাশের কিছুই বোঝা যায় না। কিছুক্ষণ তাকালে সেই আঁধারে জোনাকপোকার আলোর সেলাইকর্ম চোখে লাগে। তারা ছোটবেলায় তাড়া করে এই জোনাকপোকা ধরতেন। অনেক সময় কাচের বোতলে সেটা পুরে রাখতেন। আঁধারে ডুবে থাকা ঘরের মধ্যে তখন একবিন্দু আলো জ্বলতো। ভাই-বোনরা মিলে দারুণ মজা পেতেন। এমন সময় বনের দিক থেকে একদল শেয়াল একসাথে ডাক দিয়ে ওঠে। শেয়ালের ডাকের একটা ঐকতান আছে। একটা ডাক শুরু করলো, এরপর একটা একটা করে ডাকতে শুরু করলো। পরে সকলে মিলে একসাথে ডাকতে থাকে। আশপাশের কুকুরগুলোও ডেকে ওঠে পাল্লা দিয়ে।
টুক করে তখন বিদ্যুৎ চলে আসে। আবার ফকফকা ঘর। সকলের মুখই আবার আলোয় ভেসে ওঠে। ফরিদ মুন্সিই ফের কথা শুরু করে।Ñ‘তা বেশ কদিন ধরে শোয়েব সাবরে দেখছি না যে!’ ঠিক তখন অনেকেরই মনে পড়লো, ঠিকইতো লোকটাকে বেশ কিছুদিন ধরে দেখা যাচেছ না। শোয়েব আহমদ ব্যবসা করেন। বেশ পয়সা-টয়সা কামিয়ে নিয়েছেন। হয়তো এজন্যই তার ওঠাবসাও অনেক ওপরের সমাজে। সরকারি লোকজনের সাথেই তার সম্পর্ক। এখানে যখন আসেন, তখন কোন মন্ত্রী, কোন সচিব, কার সাথে কথা হলো, দেখা হলোÑ এসব নিয়েই বেশি কথা বলেন। এটা ওয়াহিদ উদ্দিনের পছন্দ না। তারাওতো সমাজের মানুষ, কোনো না কোনোভাবে কারো সাথে সামাজিক, পারিবারিক, ব্যবসায়িকÑ নানা কারণে সম্পর্ক একটা হতেই পারে। তাদের নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলার কী আছে (যদিও তিনি বোঝেন, এটা আসলে বোঝানো যে, মন্ত্রী-সচিবদের সাথে যার সম্পর্ক। সে অনেকরকম ক্ষমতা রাখে। এখন টাকা-পয়সা মানেই ক্ষমতা। মানুষ হিসেবে তার যে মর্যাদা, এটা অর্থবিত্তের নিরিখে মাপা হয়!)। এসব শুনলে ওয়াহিদ উদ্দিনের খারাপ লাগে। এটাকে তিনি সমাজের উন্নতি বা অগ্রগতি ভাবতে পারেন না। মানুষের কাজ দিয়ে, আচার-আচরণ দিয়ে তার সম্মানের স্থান নির্ধারণ হবে (যদিও মানুষ হিসেবে তার সম্মানটা সব সময়ই প্রাপ্য)Ñ তা না, অর্থ ও ক্ষমতা দিয়ে হবে। সেটা কি পশু সমাজের মতো হয়ে গেল না! যে বনে যে পশুর ক্ষমতা বেশি, সেই রাজা! এ নিয়ে অনেকের সাথেই ওয়াহিদ উদ্দিনের তর্কাতর্কি লেগে যায়। তাহলে মানুষ হিসেবে নিজেরা পশুসমাজ থেকে আলাদা হলেন কী করেÑ এই দ্বন্দ্ব থেকে ওয়াহিদ উদ্দিন চাকরিটাও ছেড়েছিলেন। তিনি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতেন ষোলোআনা; কিন্তু পরিস্থিতিটা এখন এমন, শুধু কাজ দিয়েই যোগ্যতা প্রমাণ হয় না। এর বাইরে আরো অনেককিছু লাগে। কারণে-অকারণে বসকে তোয়াজ করতে হয়। অনেকে যেটাকে তেল দেওয়া বলেন। বস হাসলে হাসবেন, না হলে কোনো কারণ না থাকা সত্ত্বেও মুখ গোমড়া করে থাকতে হবে। সকালে অফিসে গিয়ে বসের দিকে তাকাতে হবে। বস যদি হাসিখুশি থাকেন, তাহলে হাসিখুশি, না হলে মুখ বেজার! বসের দৃষ্টি কাড়াটা এখন প্রধান যোগ্যতা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। ওয়াহিদ উদ্দিনের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। তাই তাকে কাজের ক্ষেত্রে অনেক অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে)!
ওয়াহিদ উদ্দিন শোয়েব আহমদ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। শুধু জানেন, লোকটার অনেক রকম ব্যবসা আছে। এই অনেক রকম ব্যবসা কী, তা জানারও তার আগ্রহ নেই (এটা অবশ্য শোয়েব আহমদই নন, কেউ নিজ থেকে কিছু না বললে বা নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে কারো সম্পর্কেই তার বাড়তি কোনো আগ্রহ নেই। তার মনে হয়, কেন অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় খুঁড়ে দেখবো। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের নিজের মতো একটা জগত হয়তো আছে, এটা শুধু তারই)। এরমধ্যে কয়েকদফা চা-পান হয়ে গেছে। আগে খুব বেশি সিগারেট টানতেন। মাঝেমধ্যে মদও পান করতেন, তবে দিশি মদ বা চোলাই তিনি কখনো খেতে পারেননি। এর বিদঘুটে গন্ধ তার একদম সহ্য হয় না। এখন আর এসব পান করেন না। এখন শারীরিক নানা ঝুঁট-ঝামেলার কারণে সিগারেটও কমিয়ে দিয়েছেন। তবে কেরামত মিয়ার চা-স্টলে এসে বসলে সবার সাথে এক-দুইটা সিগারেট জ্বালিয়ে জীবন পোড়ানোর স্বাদটা নেন। ...শোয়েব আহমদ সম্পর্কে কথা ওঠায় এবার কেরামত মিয়া তথ্যটা সরবরাহ করেন। তার চায়ের স্টলে রাজা-উজির মারা থেকে শুরু করে দেশ-দুনিয়া নিয়ে এতো যে কথা বলা হয়, তিনি শুধু শুনে যান। কেউ কিছু জানতে না চাইলে তিনি কোনো কথা বলেন না। কেরামত মিয়া বলেন, ‘করিম ভাই কইলো শোয়েব সাহেবরে নাকি পুলিশ এরেস্ট করেছে। কোন এক মহিলা নাকি তার বিরুদ্ধে মামলা করছেন!’
পুলিশ ধরছে, কথাটা শুনে সবার মধ্যে একটা প্যাঁচ লেগে যায়। শোয়েব আহমদতো সারাক্ষণ তাদের সাথেই ওঠবস করেন! তাকে কেন পুলিশ ধরবে। সবার তখন আব্দুল করিমের কথা মনে পড়ে। এই একটা লোক রাতের আড্ডায় একেবারে শেষে আসেন। তিনি এলে সবাই ধরে নেন, আর উলেখযোগ্য তেমন কেউ আসার নেই। এর আগ পর্যন্ত অনেকেই আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। সে আসে শেষে এবং বেরিয়ে যায় একেবারে শেষের দিকে। সে বের হওয়ার পরই কেরামত মিয়া দোকানের শাটার টানেন। সবার নীরব অপেক্ষা কখন আব্দুল করিম আসেন। ওয়াহিদ উদ্দিনও মনে মনে চাইছেন, আব্দুল করিম এলে ঘটনাটা কী জানা যাবে। আড্ডার একটা লোককে পুলিশ ধরেছে, ঘটনাটা জানা দরকার। এখানে যারা আসেন, তাদের সাথে কোনো সমস্যা হলো কি-না, নাকি এমন কোনো অপরাধের সাথে যুক্ত তিনিÑ যার থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা দরকার।
রাতও তখন বেশ চনচনে। রাতের গভীরতা বাড়ছে। রাস্তা দিয়ে ঘরফেরা মানুষের চলাচল। সেই চলাচলকারী মানুষের মধ্য থেকেই যেন বিজলি চমকানোর মতো আব্দুল করিম চা-স্টলে ঢোকেন। আব্দুল করিমকে খুব হাসিখুশি ও সরলসিধে ধরনের মানুষ বলেই মনে হয় ওয়াহিদ উদ্দিনের। তবে তার কাছে অনেক খবর থাকে। যেন মানুষের হাঁড়ি-পাতিলের খবরও তার কাছে উড়ে চলে আসে। অথবা হয়তো নিজে থেকেই যেখানে যা পান কুড়িয়ে নিয়ে আসেন। একটা খালি চেয়ারে বসেই হাঁক দেন, ‘কেরামত মিয়া চা দিতে কও।’ এটা আব্দুল করিমের অনেক পুরনো অভ্যাস। তার বলার ঢঙ যেন সে বহুকাল চা পান করেনি। কেরামত মিয়াও রান্নাঘরের দিকে মুখ বাড়িয়ে কথাটা সরবরাহ করেন, ‘এই করিম ভাইরে চা দেও।’ সবাই নড়েচড়ে বসেন। কেউ একজন শোয়েব আহমদ নিয়ে কথাটা তোলেনÑ ‘শুনলাম শোয়েব সাবরে নাকি পুলিশে ধরছে।’ আব্দুল করিম প্রশ্নকারীর মুখের দিকে একঝলক তাকিয়ে হাসেন।
Ñ‘এসব বড়লোকদের কাজকারবার। আমাদের এ নিয়ে কথা না বলাই ভালো। পুলিশ ধরছে। আইনে ছাড়বো।’ আব্দুল করিম কিছুটা থেমে আবার বলেন, ‘কোন এক মহিলা নাকি তার ওপর নারী নির্যাতনের মামলা করছেন। দুই বছর আগে এই মহিলারে তিনি ধর্ষণ করছেন। কী জানি বাবা, কে যে কী করে, কোন প্যাঁচে পড়ে। সময়টা বুঝছো খুব খারাপ। খালি প্যাঁচ লাগে। মানুষ জীবনটারে আর সোজা-সাজা দেখতে চায় না।’
আব্দুল করিম এ বিষয়ে এরবেশি আর কথা বলেন না। কেউ আর তাকে খোঁচায়ও না। আব্দুল করিমকেতো সবাই চিনে। তার ইচ্ছা না হলে তার পেট থেকে বোমা মেরেও কেউ কিছু বের করতে পারবে না। ওয়াহিদ উদ্দিন ওঠে পড়েন। তাকে উঠতে দেখে আব্দুল করিম বলেন, ‘কি ভাই এতো তাড়াতাড়ি যাইবেনগি!’
Ñ‘হ, করিম। শরীরটায় কেমন চেতমেত লাগছে না। আর আকাশেও বিদ্যুৎ চমকায়। বৃষ্টি-টিষ্টি নামলে আটকে পড়বো।’ বলেই চায়ের টাকাটা পরিশোধ করে ওয়াহিদ উদ্দিন চা-স্টল থেকে বেরিয়ে আসেন। চা-স্টলের সামনে একটা বাতি জ্বলছে। সেই বাতির আলো থেকে ধীরে ধীরে তিনি রাতের অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন (স্ট্রিট লাইট জ্বললে এই অংশটা অতোটা অন্ধকার থাকে না)। তার মাথার ভেতর তখন আকাশে চকমক করা বিদুৎরেখার মতো অনেক কথার খেলা।... একটা ধর্ষণের ঘটনা টের পেতে কারো দুইবছর লাগলো! তাইলে এই দুইবছর তিনি কই ছিলেন, ঘুমে! অন্ধকারের ভেতর মৃদু হাসলেন ওয়াহিদ উদ্দিন। কড়াত করে কোথাও তখন একটা বাজ পড়লো। ওয়াহিদ উদ্দিন হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন