কিছু কিছু কথা আছে যা চম্কে দেয়। সেই চমকে থাকে মুগ্ধতা। অভিনব অনুভূতি। কবিতার বেলায় এর মুখোমুখি হতে হয় বেশী ক’রে। প্রতিদিনের অনুভব আবেগ দৃষ্টির তুলিতে এঁকে শব্দ সাজিয়ে কবিতার শরীর গড়ে তোলেন কবিরা। আমরা কথার রকমারিতে সাজাই সারাটা সময়। দৈনন্দিন কথোপকথনের বেলায় সাদামাটা শব্দই সই। তবে বিশেষ কোনো ভাবনা, ভাললাগা, অনুভব, অভিজ্ঞতা শিল্পময় ক’রে তুলতে হলে তা শিল্পিত উপস্থাপনা দাবী করে। কবিতা সেইরকম শিল্পের সবচেয়ে মার্জিত, নন্দিত ও ফুলেল শিল্প-সুষমা।
কবি রনজু রাইমের কাব্যগ্রন্থ “দেবতাগণ”-এর কিছু কবিতা আমার অনুভব ও ভাবনায় অন্যএক দ্যোতনা এনেছিল। চারটি কবিতা পড়েছিলাম একদিন --- ‘গরুগ্রাম’ , ‘ক্ষমতা’, ‘ছাতা’ ও ‘জানালামাত্র’। ‘গরুগ্রাম’ নামটা আনকোরা আকর্ষণে টেনে নিলো:
‘গরুগ্রামের মানুষেরা কৃষিজীবী নয়-- গরুজীবী
বিস্তর ফসলি জমিতে গরুদের জন্য তারা
ঘাসের আবাদ করে
নগরে নগরে তারা ফেরি করে গরুর খাঁটি দুধ’
(কবিতা / গরুগ্রাম )
গল্পের আদলে সমাজের ‘দেবতাগণ’ সম্পর্কে চমৎকার সাবলীলতায় ইঙ্গিত এগিয়ে গেলো শেষ শব্দটি পর্যন্ত।
‘ক্ষমতা’য় শুরুর তিনটি লাইন টেনে নামাল যেন জলে,--- ‘সীমাবদ্ধ জলে’। যেখানে ‘সামর্থ্যের সবটুকু খেলা’ দেখানো কঠিন, কারণটা ওই সীমাবদ্ধ জল। গন্ডী নির্দিষ্ট। সামর্থ্য বিস্তৃত বা অবারিত হবার ক্ষেত্র থেকে বঞ্চিত হয়। তবে যারা ‘পরিহাসপ্রিয়’ তারা ‘অক্ষমতার দায়’ ঠিকই চাপিয়ে দেয় ‘কাঁধে’।
‘কেননা এ যুগের পা-িত্য যে কেবল মূর্খদের দখলে।
তোমাকে ওজন দেবে তারা বামনের খেলনা নিক্তিতে
সমুদ্র সমুদ্র বলে হাঁক ছাড়লেও তোমাকে ডোবার
ঘোলাজলেই সারতে হবে ¯œান
( কবিতা / ক্ষমতা )
‘ছাতা’ কবিতাটি ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় অসঙ্গতি উপস্থাপনের এক চমৎকার উদাহরণ :
“ছাতা এবং মাথ এ দুয়ের সম্পর্কও
সুদূর পরাহত
তবুও কত ছাতামাথার ঝক্কি পোহাতে হয়—
....................................................
কারো কারো মাথার ভেতর ছাতা -- ওপরে নয়
বলছি এবার তাদেরই কথা ”
( কবিতা / ছাতা )
‘জানালামাত্র’ খোলা হাওয়ার হিমেল স্পর্শের মতো আবেশ নিয়ে আসে। মিহিজলের কল্লোলে ছন্দসুর রিনিরিনি ঝংকৃত হয়ে চলে যেন। আলতো ভেসে যায় যেমন জলের বুকে ঝরাফুল, পাতা, বা শেওলার সাদাটে বেগুণী ফুলের ঘূর্ণিময় চঞ্চলতা। পাঠকের ভাললাগা, ভাবনার প্রস্ফুটন বিমোহিত হতে হতে এগোয় এর লাইনের পরতে পরতে। শেষের দুটো প্যারা :
“আমার আছে দুটোমাত্র চোখ
দৃষ্টি যে তার অভিন্নতা ঘিরে
দেহের ভিতর যা কিছু উন্মুখ
যায় হারিয়ে অদেখাতে ফিরে
ঘর জুড়ে ¯্রফে একটি জানালা
দুই পাট তার যুগল চোখের মতো
যদিও ঘওে রুদ্ধ লোহার তালা
প্রাণটুকু এই দুর্গে অরক্ষিত -- ”
( কবিতা / জানালামাত্র )
এ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের অন্যান্য কবিতা ভিন্ন ভিন্ন পশরা নিয়ে আসে পাঠকের সামনে। এখানে যেমন আছে গূঢ় ভাবনার গভীরতা। আছে ‘ঘরহীন’ এই সুখের রাজ্যপাট’-এ ‘মগ্ন দুপুরে পথের পাশে’র ‘নদীর বুকে নৌকো’ ভাসানো আর ‘পাখিদের কুজন’ শুনবার আহবান” :
“ঘরহীন এই সুখের রাজ্যপাট
নগর কি আর অট্টালিকায় আছে
বৃক্ষলতা অচেনা পথ-ঘাট
হৃদয় খুলে ডাকছে বুকের কাছে
( কবিতা / মগ্ন দুপুর )
‘অন্দর-বাহির’-এ পাঠকের ভাবনা ঘিরে এক দোলাচল চঞ্চল হয় যখন কবি বলেন, ‘কোন্ ফুলের কেমন সৌরভ তা-কি ফুলবিক্রেতা জানে?’ অথবা :
“এ কালের মানুষেরা গুণবিচারী নয়, দেখে বাইরের সাজ
ইান্দনিক পরিচর্যার কথা তারা যেন ভুলতেই বসেছে
বুঝতে চায় না তারা মেয়েদের গৃহবাসী মন --
বেকার মুহূর্তে সেই মেয়েরাও জানে না বিভোর সন্তরণ
( কবিতা : অন্দর বাহির )
‘দেবতাগণ’ কাব্যগ্রন্থে নানা আকৃতির কবিতার সমাবেশ রয়েছে। তিন লাইন থেকে ক্ষুদ্রতম দুই লাইনের কবিতাও নজরে আসে। যেমন, ‘কবিতার পাঠক’ :
“কবিতা না বুঝলে তুমি চিরদিন অবুঝই রয়ে যাবে
অ-কবিতা বোঝো যে তা-ও শিল্পীত জ্ঞানের অভাবে--”
তাঁর কতকগুলো ব্যাঙ্গাত্মক কবিতার উপস্থাপনা এরকম : “গৃহবিবাদ মেটাতে না পারা অক্ষম মানুষ তিনি / রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর ঝাড়লেন ব্যক্তিগত ব্যর্থতার খেদ” ( কবিতা : টকশো ) । “মনে মনে নিজেকে মহারাজা ভাবলে / বাধা দেবে কে আর বলো -- / কেননা সবারই তো জানা আছে / পাগলের সুখ মনে মনে” ( কবিতা : লাগাম ) । “শেখানো বুলিতে তোতাপাখি / হওয়া যায় / কবি হওয়ার জন্য চাই / স্বাধীনভাবে ডাকবার / গান গাইবার ক্ষমতা” ( কবিতা : কারুবাসনা ) ।
প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন স্মরণে কবি রনজু’র কবিতা ‘হোমওয়ার্ক’ নস্টালজিকতায় আচ্ছন্ন করে। ভালো লাগে যখন তিনি তার ‘নাট্যগুরু’ সম্বন্ধে বলেন : জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী যে ঝুলন্ত রেখা / তোমার চাকা সেখানেও পথ ক’রে নেবে” ।
‘একনায়ক’-এ সাহসী উচ্চারণ নতুন উজ্জীবন দান করে : “এমন কোনো আগুন নেই পোড়াবে আমার মন”। গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘অনুসনেট’-এর নিচের দুই লাইনের চিত্রকল্প সকরুণতায় ধরা দেয় :
“সফেদ পায়রাগুলো শিকারীর জালে ধরা নিল
পালকে পালকে লেখা সেই সব করুণ কাহিনী
বেশকিছু লাইন ও শব্দ-সমষ্টি মুগ্ধকর । যেমন : ‘ডানাখসা পালকের আশকারা বাতাসে আজ আকাশ মাতায়’, ‘শীতঘুমে তারা অলস ওমে’ ( কবিতা : পাখিদের ডায়রি ), ‘শাখার আদর’ , ‘বাইরে রক্ষাব্যুহ ভিতরে অনন্ত দ্রোহ’, ‘ঘুমের সঙ্গে রাতভর’, ‘অবিকল্প হাতছানি’, ‘ঝনঝন ক’রে ওঠে বিবাদ আর বিভেদের তরবারি’, ‘কত কী সম্ভোগ আছে তবু কেন প্রেম নিয়ে ছলা / বাহারি গোলাপগুলো সেই শোকে বিষণœ অবলা’, ‘নৈ:শব্দের রাজাধিরাজ’, ‘ক্ষমা পেয়ে আপনি তো নিজেকে শোধরালেন না’, ‘ভালোবাসার নেই তো ফিতে-গজ’, ‘স্বঘোষিত দেবতারা পুজো চায় নানান ছলে’, ‘সবকিছু প- করেছেন বলেই তো তিনি আজ যথার্থ প-িত’, ‘প্রণয়ের কৃষ্ণসাধক’. ‘ভিক্ষালব্ধ ধনে বলো তুমি কতদূর যাবে’, ‘পদ লেহনে পদক’, ‘ গোষ্ঠী বিচারী কবি’ ইত্যাদি।
কতকগুলি শব্দের বানান ও সঠিক শব্দ-রূপের দিকে খেয়াল করলে ভাল হতো। যেমন, ‘দোষারূপ ( দোষারোপ ), ‘বুঝে’ ( বোঝে), ‘বুঝো’ ( বোঝো )। এগুলো হয়ত মুদ্রণ-প্রমাদ। তবুও কবিতার বই শতভাগ মুদ্রণ-শুদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয় বোধ হয়। কবি রনজু রাইম-এর কাব্যচর্চায় বাংলা কবিতার অংগন আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন