সাহিত্য মনের শৈল্পিক অভিব্যক্তি। তা স্বত’স্ফূর্ত ও অবারিত। আরোপিত নয়। এই নির্জলা একটি বিষয়ের ওপরে আলোচনা বা সমালোচনা একটু স্পর্শকাতর ব্যাপার বটে। একই গ্রন্থ বা বিষয়ের ওপর একের অধিক আলোচনা হলে তা বিচ্ছুরিত হবে আলাদা আলো ও রঙে। এখানে দৃষ্টিভঙ্গি রুচি ও পছন্দ প্রাধান্য পায়।
সত্যিকার সাহিত্য-ব্যক্তিত্বই প্রকৃত সাহিত্য সমালোচনা লিখতে পারেন। পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে, ভার ভারিক্কি ভাষায় পা-িত্য প্রকাশ করা সহজ। এর সাথে সঙ্গতি রেখে লেখার মর্মে আলো ফেলা ততই কঠিন। তাই যারা কবি বা সাহিত্যিক তাঁরাই আলোচনায় তুলে আনতে পারেন আলোচিত বিষয়ের একজন হয়ে। শুধুই সমালোচক যারা, তাদের উদাহরণ বোধ করি এমন কোথাও পড়েছিলাম: সমালোচনার খাতিরে যারা সমালোচক তারা নিজেরা গাড়ী চালাতে জানেন না অথচ গাড়ী যারা চালান তাদেরকে কীভাবে চালাতে হবে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতে কমতি করেন না। যারা হয়তো জীবনে লেখেননি একটি কবিতা বা গল্প তারাই বলেন এর নানাদিক। লেখার ভালোদিক এড়িয়ে প্রথমেই বসে যান ব্লেড হাতে। জিহ্বা সরিয়ে ওখানেও বসিয়ে নেন ক্ষুর। তাই যতদূর আমরা ভাবিনা কেনো, তাদের তথাকথিত সাহিত্য সমালোচনা থেকে অনাগত কাল সমসমসাময়িক সাহিত্যের প্রকৃত চিত্র পরম্বরা পায় না।
কবি মোহাম্মদ নূরুল হক ‘গদ্যকথন’ - এ বলছেন: “কবি-সাহিত্যিকের খ-িত পরিচয়, কিংবা বিশেষ শ্রেণীর লেবেল পরিয়ে দিয়ে সমালোচককুল আত্মপ্রশান্তি পান হয়তো, কিন্তু সাহিত্যিক তাতেই বিব্রতবোধ করেন। সঙ্গতকারণে একজন কবি, কিংবা একজন সাহিত্যিকের সামগ্রিকরূপ নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ । খ-িত কালসীমার পরিসরে কোনও সাহিত্যআন্দোলন গড়ে ওঠে না। অথচ নিজেকে একটি বিশেষ কালখ-ের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। বিষয়টা সাহিত্যের পথে মঙ্গলজনক নয়” ‘গদ্যকথন’ কবি’র ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’ প্রবন্ধ-গ্রন্থের ভূমিকা। এই বইতে মোট ২০টি প্রবন্ধ রয়েছে। ১৬০ পৃষ্ঠার সুপুষ্ট বইখানি যেমন অবয়বে স্থ’ুল তেমনি বিষয়-বৈচিত্র্য, গাম্ভীর্য ও সুক্ষè আলোচনায় সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের নানাদিক আলোকপাতের জন্য তাঁকে ভ্রমণ করতে হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের সূর্যোজ্জ্বল উপত্যকায়। সবগুলো প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না ঠিকই, তবে বিশেষ বিশেষ প্রবন্ধের ওপর সাধ্যানুসারে আলো ফেলার প্রচেষ্টা থাকবে। কারণ, পাঠক সত্যিকার রসাস্বাদন করতে পারবেন মূল প্রবন্ধগুলো আদ্যোপান্ত পড়ার পরই।
বইয়ের অন্দরে যাবার আগে লেখক সম্বদ্ধে একটু বলে নেয়া ভাল। মোহাম্মদ নূরুল হক কবি। ‘মাতালনদীর প্রতœবিহার’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা তিনি। তবে তার আলোচনা শুধু কবিতার ওপরেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রাধান্য আছে। ছোট ছোট বাক্যে রয়েছে কাব্যিকতা ও প্রয়োজনীয় অসংখ্য উদ্ধৃতি। এতে তাঁর গভীর পাঠ-সমৃদ্ধির দেখা মেলে। যা একজন আলোচকের পয়লা যোগ্যতা। নিজে কবি হওয়াতে আলোচিত কবিদের মরমে অনুপ্রবেশ ক’রে ক’রে উপলদ্ধ উপমা, গঠন, বিষয় ও শৈলী’র শিখর স্পর্শ করতে পেরেছেন। আর এগুলো তিনি সম্ভব করেছেন তাঁর কবিতাক্রান্ত, স্বচ্ছ অথচ গভীর গদ্যভঙ্গির জন্যে। ঠাঁসবুনটে কোনো কোনো অংশই হয়ে উঠেছে এক একটি মন্থিত কবিতাংশ। উদাহরণ :
“কবিতা বুদ্ধির দীপ্তি, প্রজ্ঞার জৌলুস, চিন্তার সৌকর্য এবং আবেগের সংহত ও পরিশীলিতরূপের বিবর্তনেরই মিথস্ক্রিয়া। অবয়ব সৃজিত হয় ছন্দ, অলংকার, ভাষা এবং প্রকরণের যথার্থ ও অনিবার্য পরম্পরায়। শুধু বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞার অনুশাসনে কবিতার স্বতঃস্ফূর্তভাব, চরিত্র ও প্রাণচাঞ্চল্যেও সর্বস্ব হরণ করে। বস্তুসত্যের যৌক্তিক ব্যাখ্যার প্রশ্নে কাব্যসত্য আপাতত কিশে হয়ে আসে; কিন্তু শুদ্ধতম অনুভূতি ও অন্তরের আহবানকে মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করতে চিন্তার পরিশীলিতরূপের সঙ্গে হৃদয়াবেগের সংহতরূপকে অস্বীকার করা যায় না।”
( কবিতার অবয়ব ও আন্তঃসংগঠন প্রক্রিয়া)
প্রবন্ধগুলোতে লেখক সাহিত্য আলোচনার সামগ্রিকরূপ তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। এবং সফলও হয়েছেন। সাহিত্য-চর্চার জন্য যা প্রয়োজন সেগুলো উঠে এসেছে অতি আকর্ষণীয়ভাবে। এখানে প্রাসঙ্গিক একটা শব্দ ব্যবহার করতে ইচ্ছে হয়,--- সার্বভৌম। তিনি সার্বভৌম প্রাবন্ধিক হিসেবেই পরিগণিত হন। ‘কবিতার নেপথ্যকথা’ থেকে শুরু করে ‘কবির তপস্যা ও কবিতার সৃজনক্রিয়া’, ‘কবিতা পাঠের অনুভূতি ও বিস্ময়’ জাগিয়ে আমাদেরকে নিয়ে চলেন, ‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ দেখাতে; ‘কাব্যসত্য ও পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষা’র অন্বেষণে, চিনিয়ে দেন মানবমনের অনন্ত জিজ্ঞাসা ও কবিতার শত্রু-মিত্র’ কে। অবারিত করেন, ‘রূপসীবাংলা ও বালিকাআশ্রম: নিসর্গের অহংকার-প্রাণের ঐশ্বর্য’কে। এভাবে ‘গদ্যের বিষয়বস্তু ও ভাষাশৈলী’র পথ বেয়ে উপসংহারে আসেন ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’-এর মাধ্যমে।
‘কবির তপস্যা ও কবিতার সৃজনক্রিয়া’ বাংলা সাহিত্য শুধু নয় বিশ্ব-সাহিত্যের দিকপালদের কাব্যভাবনা ও উদ্ধৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এতে কবি’র সাধনার ধরন ও সৃজনশৈলীর পথরেখা নির্দেশিত। এই যে সাধনা, এই যে সত্যের মুখোমুখি কবির অবস্থান তা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সত্যের মতো কঠোর যে হিমালয়ের মতো সামনে এসে দাঁড়াতে চায়। এখানে কবিগুরু সম্পর্কে বলছেন, “রবীন্দ্রনাথ বলেছিনে, ‘সত্য যে কঠিন, তাই কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। রবীন্দ্রনাথ আকস্মিক চমক দেখানোর যাদুকর নন। কঠিনকে ভালোবেসে নিরন্তর পরিচর্যায় হয়ে উঠেছেন বিস্ময়কর। দেশ-কালের সীমা ছাড়িয়ে পরিণত হয়েছেন সর্বজনীন। এ সত্য ছন্দমুক্তির তপস্যা করার স্মরণ রাখা বাঞ্ছনীয়।...... রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে জীবনশিল্পী, সে অর্থে নেরুদা, হুইটম্যান এবং নজরুলও। চ-ীদাস বায়রন, শেক্সপিয়র, সাঁত্রে, গোর্কিও। মানুষকে অস্বীকার ক’রে এদেও সাহিত্যের ঐশ্বর্যপূর্ণ সৌধ গড়ে ওঠেনি। সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যে, শেক্সপিয়রর শ্রেষ্ঠ ট্রাজিডিগুলো, সফোকিসের ট্রাজিডি কিং ইডিপাসেও মানবাত্মার জয় ঘোষিত।” কবিতা কখন কবিতা হয়ে ওঠে এ সম্পর্কে সুজিত সরকারের উদ্ধৃতি টেনেছেন, “শব্দ দিয়ে রচিত হয়েও যা শব্দকে অতিক্রম করে যায়, তাই কবিতা। শব্দের সীমানা অতিক্রম করার এই ক্ষমতাই হলো ব্যঞ্জনা।” প্রবন্ধে টি এস এলিয়ট-এর উক্তি, “শিল্পের আবেগকে নৈর্ব্যিিক্তক হয়ে উঠতে হবে।” কখন একটি কবিতা সত্যিকার কবিতা হয়ে ওঠে, সোমত্ত হয় সে বিষয়ে লেখকের এই লাইনটি তুলে দেয়ার প্রয়াস পাই: “আবেগের সংহতি, যুক্তিবোধ ও যুক্তিহীনতার শৃঙ্খলা যখন প্রজ্ঞাশাসিত পথে অনুগমন করে, তখনই কবিতা সম্পন্ন হয়ে ওঠে।”
‘কবিতা পাঠের অনুভূতি ও বিস্ময়’-এ লেখকের নি¤েœাক্ত লাইনগুলো স্বত:সিদ্ধ সত্যে প্রতিভাত হয়: “একটি কবিতায় গুণের চেয়ে দোষের পরিমাণ খুঁজে বের করার মধ্যে গবেষক জীবন সার্থক হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু তাতে কবিতার রস-উপলদ্ধ হয় না। কবিতার উদ্দেশ্য আবিষ্কারের ভেতর পা-িত্য থাকতে পারে; প্রেম থাকে না। প্রেম বিবর্জিত কবিতাপাঠে কবিতা সম্ভ্রম হারায়, হৃদয়কে আলোড়িত করে না............. কোনও ক্রমপরিবর্তনমান শিল্প-প্রপঞ্চ সম্পর্কে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের প্রতি প্রশ্নশীল হওয়া জরুরী। যে প্রশ্নের উত্তর নিজের মন দিতে অপারগ, সে প্রশ্ন প্রকৃতিকেও করা অনুচিৎ।” প্রবন্ধের অনত্র বলছেন, “ বিস্ময়বোধ জাগিয়ে তোলাই কবির প্রধান কীর্তি। বিস্ময়য়েরই আরেক নাম কবিতা। তাই শত বছরের ব্যবধানেও এক কবির চেতনার সঙ্গে অন্য কবির চেতনার কী অবিশাস্য মিল! কবি যখন একা থাকেন, তখনই নিজের ভেতর সম্পন্ন মানুষকে আবিষ্কার করেন। তখন পুরুষ কিংবা নারী আর সাপেক্ষ পদ থাকে না। থাকে না অন্যেও মুখাপেক্ষিও। হয়ে ওঠেন স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সার্বভৌম।”
‘কবিতার নেপথ্য কথা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার একটি। কবিতা পরিপূর্ণ অবয়ব লাভ করার আগে তার ভাব, ভাষা, গঠন ও প্রকৃতি কেমন হয় তা সত্যিই কৌতুহলের বিষয়। কবি মাত্রই এক অনিবার্য অন্ত:দহনের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেন। ক্ষণিক কোনো দৃশ্য বা অনুভব এমন সুষম আকারে ধরা দিতে পারে মানসপটে যে তা তখনই আকৃতি পায় মনোলোকে। কাগজে অক্ষরবিন্যাস হয়ে আসাটাই যা বাকী। এমনও জানতে পারা গেছে যে কোনো কোনো কবিতা দেখতে পান কবি মনের চোখে। আবার কিছু কিছু বিষয়ের ওপর নিবিষ্ট সাধনা এনেই গড়ে তুলতে হয় পঙক্তির পর পঙক্তি। এর পরও কবিতার কিন্তু সার্বজনীন সংজ্ঞা নিরূপন দুরূহ। প্রবন্ধকার যেমন বলেছেন, “কবিতা সম্পর্কে প্লেটো’র চড়বঃৎু রং ‘রহংঢ়রৎবফ সধফহবংং’.’ এবং গধঃঃযবি অৎহড়ষফ এর ‘ধ পৎরঃরপরংস ড়ভ ষরভব’ কিংবা জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতা অনেক রকম’ কোনও সংজ্ঞাই সার্বজনীন নয়। ......... কবিতা একান্ত উপলব্ধি ও উপভোগের বিষয়। ভোগ করার মতো স্পৃশ্য শরীর এর নেই। তাই ভোগের প্রশ্নে কবিতা অনঙ্গ। সে অনঙ্গ শিল্পের পথে একাকী রাতখচিত সময় কাটান কবি। কবির অনিদ্রা কবিতার সৃজন মুহূর্তের পূর্বাভাষও।........ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মানুষ যেমন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে শেখে, তেমনি কবিও প্রতিটি কবিতা সৃষ্টির পূর্বমুহূর্তে এক অলৌকক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকেন। সবাই সে সৃজন যন্ত্রণা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে না। যিনি পারেন তিনি কবি।...... কবিতা কবির দিনলিপিও। ....... কবি কোনও কোনও সময় কবিতার ভেতর আত্মপ্রকৃতিও এঁকে রাখেন। আত্মপ্রকৃতি আঁকার বাসনা থেকেই কবি দীর্ঘকাল যাবত একটি অখ- কবিতাই লেখার সাধনা ক’রে আসছেন। কিন্তু কোথাও তৃপ্ত হওয়ার অবসর নেই তার। ........ কবি কবিতাকে চিত্তের এমন স্তরের বিষয় পরিণত করেন, যেখান থেকে কবিতাকে নিছক বুদ্ধির মারপ্যাঁচ দিয়ে বোঝার বিষয়ে পর্যবসিত করা যায় না। ........ কবিতা পরিকল্পনা ক’রে লেখা যায় না। ...... কবির মনোভূমে দৈবশক্তির অস্তিত্ব প্রয়োজন। তা হলে দেখা যাবে কষ্টকল্পনার স্থানে স্বতঃস্ফূর্ততা এসে কবিতাকে মহিমান্বিত ক’রে তুলবে।”
‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ কবি মোহাম্মদ নূরুল হকের এক প্রতিনিধিত্বকারী প্রবন্ধ ব’লে মনে হয়েছে। নাতিদীর্ঘ এই আলোচনায় তিনি সমসাময়িক সাহিত্য পরিম-লের অনস্বীকার্য বাতাবরণের বাতায়ন অবারিত করেছেন। বিশেষ ক’রে বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক আবহের ইঙ্গিত এসেছে সুস্পষ্টভাবে। তাঁর কথায়: “একজন কবির খ-িত পরিচয় কোনও সুফল বয়ে আনে না। বরং কবির পাঠক বলয়ের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।......... মতান্ধের মতবাদে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কবিতা। ......... বর্তমানে বাংলাদেশে প্রগতিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দলে বিভক্ত সাহিত্যসমাজ। .......... ধার্মিক মাত্রই মৌলবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল নন। আস্তিক্যবাদী দর্শনের সঙ্গে আধুনিকতাবাদের সম্পর্ক কি সাংঘর্ষিক? তাহলে খ্রিস্টিও ধর্মাবলম্বী ও ঐতিহ্যের অনুসারী টি এস এলিয়ট কী ক’রে আধুনিক কবি হন? কিংবা লিও টলস্টয়?......... সাহিত্যের কোনও প্রবণতা উপলদ্ধি করতে হলে দশক কিংবা মতবাদ নয়, নয় কোনও তত্ত্বকেন্দ্রিক চিন্তাও; তার জন্য চাই নির্দিষ্ট প্রকরণের সামগ্রিক রূপ। একটি কবিতা, গল্প কিংবা উপন্যাসের ভেতর একই সঙ্গে বিভিন্ন তত্ত্ব ও প্রকরণ যেমন থাকতে পারে, তেমনি একটি কবিতা গল্প কিংবা উপন্যাস একটি বিশেষ দশকে রচিত হয়েও রসগুণে তা চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে।”
‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’ প্রবন্ধে দশক বিষয়ক দ্বন্দ্ব আরও স্বচ্ছতায় তুলে ধরেছেন প্রবন্ধকার। প্রথম লাইনই পরিষ্কার করে দিনের আলোর মতো দশক বিভক্তির কুফল। “বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের একটি বিষফোঁড়া--- দশক বিশ্লেষণ। এটি যেমন সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি সৃষ্টিশীলতার অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক। মহাকালের হিসাবের খাতায় শতকই যেখানে গৌন, দশক সেখানে অতি তুচ্ছ বিষয় মাত্র।........ দশক বিভাজন নিয়ে অরুণ মিত্র বলেন--- ‘আমি দশক বিভাজনে একেবারেই বিশ্বাসী নই। সাহিত্যের গতি দশ বছর অন্তর পাল্টায় না। এমন কোনও নিয়ম নেই। কোনও বিশেষ সাহিত্যের ধারা হয়তো দশ বছর বা পঞ্চাশ বছর থাকতে পারে। তার পরে হয়তো পাল্টায়। দশক বিভাজন করলে একটা সুবিধা হয় এই যে, অনেক কবির নাম ঢুকিয়ে দেয়া যায়’। ......... যারা সারাজীবন হয়তো একটিও কালোত্তীর্ণ কবিতা, উপন্যাস, কিংবা ছোটগল্প লিখতে পারেননি, কিন্তু কবি কিংবা কথাশিল্পী হিসেবে সহজে আত্মপ্রচারের সুযোগ নিতে ও পেতে চান, তারাই দশকবিভাজনে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। মূলত দশকবিভাজনে আগ্রহী তারাই, যারা সাহিত্যের নানা বাঁক ও প্রবণতা শনাক্তিতে অসমর্থ। সমকালীন সাহিত্যরুচির উত্তাপ উপলব্ধিতে ব্যর্থরাও জনরুচি সাহিত্যরুচিকে একই গ্লাসে গুলিয়ে পান করার পক্ষে।”
প্রবন্ধের উপসংহার খুবই প্রণিধানযোগ্য। পুরো বইয়ের নির্যাস স্থিত এই ক’টি লাইনে: “আত্মপ্রসাদের কর্মযজ্ঞে দশকবাদী বনসাঁইরা আত্মরতিতে ভুগলেও সে-আত্মরতি অচিরেই আত্মগ্লানিতে পরিণত হয়। তখন প্রকৃত মহীরুহ সমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। অতএব কালের বিবর্তনে, বিকৃতির ধুলোর আবরণ মুছে গেলে, দশকভিত্তিক সংকলন ও গদ্য থেকে বাদপড়া কিংবা সেখানে অবমূল্যায়িত হওয়া কবি-লেখকরাই যে কালের বিচারে শ্রেষ্ঠ’র আসনগুলো অলংকৃত করবেন, সে-ব্যাপারে সন্দেহ কী!”
‘কবিতার অবয়ব ও আন্তঃসংগঠনপ্রক্রিয়া’ : কবিতার আকার বা গঠন কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে বিচার করা সম্ভব নয়। কবিতা দুই থেকে দুই হাজার লাইনেরও হতে পারে। ভাব ও বক্তব্য প্রকাশের ধরনই বেঁধে দেয় এর অবয়ব-কাঠামো। লেখক বলছেন, “কবিতা হয়ে উঠার জন্য মৌলিক অনুষঙ্গ,ছন্দ-ভাষা যথোপযুক্ত অলঙ্কার অনিবার্য।........... কবির প্রত্যক্ষণে যে বস্তু দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠে না কোনো মতে; সে বিষয়াবলীও কবির বলার ঢংয়ে পাঠকমনে বিশ্বস্ততার সঙ্গে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বস্তু বা বিষয়ের বৈশিষ্ট্যের চেয়ে বলার ভঙ্গিই মুখ্য”।
‘কাব্যসত্য ও পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষা’ : প্রবন্ধটিতে স্বল্প পরিসরে কবিতার চিরন্তনতা, স্থায়ীত্ব ও অবিনশ্বরতা এবং এর সাথে ‘পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তির অন্বেষা’র চমৎকার সাযুজ্য অনন্য সাবলীলতায় উপস্থাপিত হয়েছে: “ সাহিত্যেও সত্য চিরন্তন। চ-ীদাস সে প্রাচীন যুগে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘শোনো হে মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। দেবদেবীর মাহাত্ম্যকে ম্লান ক’রে দেয়া সে অমোঘ উচ্চারণ আজও যুক্তিনিষ্ঠ মানুষের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে সমান ঢেউ তুলতে সক্ষম। ......... কাব্যসত্যের সঙ্গে বস্তুসত্যের পার্থক্য বস্তুগত, চেতনাগত নয়। বুদ্ধি বৃত্তিক অন্বেষার উত্তর হয়তো এখানেই নিহিত। যেখানে অন্তরের সত্যকে নির্ভিকচিত্তে ঘোষণা করেন কবি, সেখানেই জ্ঞানের, নন্দনের, দর্শনের নানা ¯্রােত এসে একটি বিপুল ঘূর্ণনের সৃষ্টি করে। তারপরই নিখিলসমুদ্রসঙ্গমের আয়োজন সম্পন্ন হয়। সে সঙ্গমোত্তর ফলাফল বিশ্লেষণেই স্পষ্ট হয় পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষার অমোঘ ও অবিনশ্বর উত্তর।”
‘মানবমনের অনন্ত জিজ্ঞাসা ও কবিতার শত্রু-মিত্র’ : অন্যতম উপভোগ্য একটি আলোচনা। প্রিজমের মতো নানাদিকে আলোক-বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়ে আবছায়া থেকে আভাময় করা হয়েছে কবিতার বৈরীতাকে। এখানে কবিতার শত্রু হিসেবে ধর্ম, সমাজ, তত্ত্বপ্রচারক, সাম্প্রদায়িক মনেবৃত্তি, অসাহিত্যিক মনোবৃত্তি, রাজনীতি, এক সময়ের রাজা-বাদশাহ, এমনকি কবি ও উপকবির দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে। মনের জিজ্ঞাসা উপস্থাপিত হয়েছে ঐতিহাসিক অনন্য এক উদাহরণের মাধ্যমে : “ মানবমনের অস্ফূট প্রশ্নের উত্তর জমা থাকে সংবেদনশীল মানুষের কাছেই। প্রশ্নশীল চারিত্র্য কি মানুষকে শিল্পী ক’রে তোলেনি? যে বেদনাবোধ থেকে সফোকিস কিং ইডিপাস লিখে মানবজাতিকে অনন্ত দু:খের কাহিনী শুনিয়েছিলেন, সে মর্মযাতনার মূলেও মানবাতœার অনন্তজিজ্ঞাসা উপস্থিত। ....... সমকালীন বাংলা সাহিত্য কি অনেকটা দলীয় রাজনীতিদুষ্ট? কিছুটা বৃত্তবদ্ধের স্বার্থশ্লিষ্ট? পুরো ডানপন্থী ও বামঘরানায় বিভক্ত। তার প্রভাব সাহিত্যেও পড়েছে। মানুষ আপন সমাজের প্রভাব সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে না। স্বসমাজের অভ্যাস আচরণ রপ্ত ক’রে যে কবি-কথাশিল্পী আত্মপ্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, তার পক্ষে সে বৃত্ত ছাড়িয়ে বৃত্তহীন হওয়া সম্ভব নয়। বিপরীত দৃশ্যও রয়েছে। নিরন্তর চেষ্টায় স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যকে পরিমার্জিত ক’রে মার্জিত রুচিবান হয়ে ওঠার প্রমাণও আছে। বৃত্তের ভেতর থেকে বৃত্ত ভাঙার ঔদার্য দেখানো কবি-সাহিত্যিকও রয়েছেন। হৃদয়ের ঔদার্য দিয়ে সমস্ত সংকীর্ণতাকে জয় ক’রে মানবমনের অর্ন্তলীন বাসনার ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন এমন কবি সংখ্যাল্প হলেও দুর্নিরীক্ষ নয়। সে সংখ্যাল্প কবি-কথাশিল্পীর আত্মোন্মচনই সাহিত্যকে গতিশীল রাখে।.......... প্রচারমাধ্যমের দৌরাতেœ্য প্রকৃত শিল্পী আপাতত অপরিচয়ের আড়ালে প’ড়ে যান। কবিতার সবচেয়ে বড় শত্রু ‘উপকবি’। এ উপকবিই পাঠকমনে কবিতাসম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম দেয়ার জন্য দায়ী। তাই ‘উপকবি’কে কবির ছায়ার নিচে মাড়িয়ে দিলে সে ছায়া থেকে বড় কবির আত্ম-উদ্বোধন সম্ভব।”
আলোচনা-বইয়ের আলোচনায় বাড়তি কোনো কথা বলা থেকে যথাসম্ভব বিরত থেকেছি। শুধু আলোচ্য বিষয় মৃদু উন্মোচনের অভিপ্রায়ে লেখকের উদ্ধৃতির আগে আগে বলেছি দু’কথা। বিশটি প্রবন্ধের বিস্তৃত ভূমিতে বিচরণও এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয় কোনোমতেই। মাত্র আটটি প্রবন্ধের মর্ম থেকে লেখকের লেখনীর মনন-চিত্র উদ্ভাসিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যাতে পাঠকের বইটি পড়বার সাগ্রহী মন তৈরি হয়ে ওঠে সহজেই ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন