বাঙালিচিন্তকের
সমস্যা দুদিকে। একদিকে সমাজ বোঝার, অন্যদিকে নিজের
অনুভূতি-উপলব্ধি-অভিজ্ঞতা অন্যকে বোঝানোর। এই বোঝা-বোঝানোর ব্যাপারটা
নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর। এক. সভাসেমিনারে বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া দুই.
প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গদ্য রচনা। এই প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গদ্য রচনারও রয়েছে নানা ধরন,
নানা ধাঁচ। একদল লেখেন, অতি দরকারি প্রবন্ধ। অন্যদল লেখেন, আপাত দৃষ্টিতে
বেদরকারি গদ্য। দরকারি প্রবন্ধ লেখকেরা মূলত কর্মী, সমাজ তাঁদের কাজের
সরাসরি উপকারভোগী। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাকর্ম থেকে শুরু করে, মাঠজরিপের
ফলপ্রকাশ___ সবই তাদের প্রবন্ধের বিষয়-আশয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক থেকে শুরু করে, সমাজকর্মী-স্থানীয় তহশিলদার___ সবার
কাছেই সমান কদর ওই সব রচনার। বিপরীতে আপাত-বেদরকারি গদ্যলেখকেরা লেখেন মনের
আবেগে, প্রজ্ঞার শাসনে। তাদের গদ্য তাৎক্ষণিক সমাজের কোনো কাজে আসে না।
দরকারি প্রবন্ধের রচয়িতারা কর্মী হলে আপাত-বেদরকারি গদ্যের লেখকেরা
শব্দশ্রমিকের পাশাপাশি শিল্পীও। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার___ কর্মীরা
পারিশ্রমিকেই তুষ্ট; শিল্পী চান সম্মানি-সম্মান___ দুটোই। এ জন্য শিল্পীকে
অপেক্ষা করতে হয়। পরিচয় দিতে হয় পরম ধর্য্যরে। কর্মী-শিল্পীর পার্থক্য
এখানেই সুস্পষ্ট। আহমদ ছফা সম্পর্কে একবাক্যে বলতে গেলে তাকে এই
আপাত-বেদরকারি গদ্যলেখকের দলেই বিবেচনা করতে হয়।
আহমদ ছফার লেখালেখির ভুবন সর্বত্রগামী না হলেও বিচিত্রমুখী। লিখেছেন কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও ছোটগল্প। অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অনুবাদ করেছেন গ্যাটের ‘ফাউস্ট’। তবে এসবের ভেতর সবচেয়ে উজ্জ্বল পরিচয় বোধ করি তাঁর সমাজচিন্তক সত্তা। ছফা বাঙালির মানস-সংকট, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় পরিচয়ের ভেতর জাতীয় পরিচয়ের উৎস সন্ধান করেছেন। কিন্তু এ সন্ধান প্রাতিষ্ঠানিক অভিসন্ধর্ভের ধাঁছে নয়। করেছেন একান্ত বেদরকারি-গদ্যলেখকের মতোই___ আপন মনের খেয়ালে, আপনার মতো করে। এক্ষেত্রে ছফা গবেষক নন, পর্যবেক্ষক। পর্যবেক্ষণদৃষ্টি তীক্ষ্ম, উপলব্ধি স্বচ্ছ। তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গদ্যের বিষয় যেমন সমকালীন অন্য লেখকদের চেয়ে ভিন্ন, তেমনি তার উপস্থাপনকৌশলও। ছফা বাঙালির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য-স্বভাব শনাক্তিসহ সবিস্তারে আলোচনা করেছেন ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ও ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শীর্ষক দুটি বইয়ে।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালিচিন্তকদের সম্পর্কে রূঢ়সব মন্তব্য করেছেন। অবশ্যই এসব মন্তব্যের শক্ত ভিতও রয়েছে। সাত চল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ___ দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আত্মবিক্রয়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কীভাবে পুরস্কার-পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তার তথ্য-উপাত্তও সাধ্যমতো উপস্থাপন করেছেন। একইসঙ্গে তাঁর মন্তব্যসহ ব্যাখ্যা করেছেন পরিস্থিতি। লেখাটি শুরু করেছেন নেতিবাচক পর্যবেক্ষণলব্ধ মন্তব্যসহ। লিখেছেন___ ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।’ বুদ্ধিজীবীরা সত্যা-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দের নিরিখে কখনো ভূমিকা পালন করেন না। তাঁরা মূলত সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন, সমাজের কল্যাণসাধনের জন্য নয়, নিজেদের আখের গোছাতে। ফলে তাঁরা যখন কোনো পক্ষাবলম্বন করেন, তখন যেমন তাঁদের কোনো পূর্বপরিকল্পনা থাকে না, তেমনি পক্ষত্যাগকালেও থাকে না। ছফার মতে, ‘আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়___প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন___সেও ঠেলায় পড়ে।’ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁদের চরিত্রও পাল্টায়। তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-বিশ্বাস নেই। একারণে তিনি বুদ্ধিজীবীদেরকে সুবিধাবাদী হিসেবেই বিচার করেছেন তিনি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের আগে-দেশস্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশ্বস্তি, স্বৈরশাসকের জীবনী অনুবাদ___ এসব বিষয়কে ছফা দেখেছেন লেখকদের মেরুদ-হীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষাৎ-পূর্বমুহূর্তে লেখকসমাজের নিষ্ক্রিয়তা-যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা, ভারতে পালিয়ে বেড়ানো, ভোগবিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ছফা তুলে ধরেছেন, স্বাধীনতাপূর্ববর্তী বাংলাদেশের লেখকসমাজ কী পরিমাণ অপরিণামদর্শী-অদূরদর্শী ছিলেন। তাঁরা একটি দেশের পটপরিবর্তনের আভাষটুকুও উপলব্ধি করতে পারেন না। এই লেখকসমাজ নিজেরাই অনুভব করতে পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে___ তাই জাতিকে সতর্ক করারও প্রয়োজন তাঁরা অনুভব করেননি। তাঁরা কেবল যা ঘটে তারই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকারী। যা ঘটতে যাচ্ছিল, তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তাঁদের কল্পনায়ও ধরা দেয় না সম্ভাব্য-ভবিষ্যৎ। তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে ছফার মূল্যায়ন দ্ব্যর্থহীন___ ‘বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কিছু কিছু পোশাকি ভূমিকা পালন করেছেন।’ বাঙালিচিন্তক-লেখকদের চরিত্রে দ্বিমুখিনতা ছফা খোলাসা করেছেন উদাহরণ-ব্যাখ্যাসহ। সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ‘প্রয়োজনে-ঠেলায়’ পড়ে বিশেষ বিশেষ ঘটনার আগে যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দেন, ঘটনার পরে লেখেন তার উল্টো কাসুন্দি। ফলে তাদের কোনো চিন্তা-কর্ম-উপদেশ সমাজের বিশেষ কোনো কাজে আসে না। কারণ এই বুদ্ধিজীবীরা সমাজকে কোনো নতুন কিছু উপহার দেওয়া দূরের কথা, আসন্ন বিপদ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগাম খবরটুকুও দিতে ব্যর্থ হন। সফল হবেন কী করে___ তাঁরা তো সমাজমঙ্গল নিয়ে কোনো চিন্তা করেন না, কাজ করেন না মানুষের কল্যাণে। যেটুকু করেন, সেটুকু কেবল নিজের স্বার্থে।
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অতীত-আসক্তি ভয়ানক রকমে উপস্থিত। তাই অতীতের তুচ্ছ বিষয়গুলোর মোহে এতই অন্ধ থাকেন যে, সামনের দিনগুলো সম্পর্কে ধারণা করতে পর্যন্ত পারেন না। তাঁদের বতর্মান থাকে আপসকামিতায় আকীর্ণ। অর্থাৎ তাঁদের উপস্থিতকাল কাটে ক্ষমতাবানদের স্তুতি, পুরস্কার-পদক গ্রহণে। আহমদ ছফা এই জাতীয় বুদ্ধিজীবীর চারিত্র্যিক স্খলন-খোলনলচে বদলানোর স্বভাব ব্যাখ্যা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। পাশাপাশি বলেছেন, দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণ ভেতর থেকে জেগে উঠেছে। দেশমাতৃকার সংকটকালে জনগণ-জনযোদ্ধারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাতে বুদ্ধিজীবীদের কোনো কার্যকর ভূমিকা ছিল না।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ আর ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। প্রায় একদশক পর প্রকাশিত বইয়েও ছফার মূল আক্রমণের শিকার বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণীর বাঙালি। বাঙালি লেখক-কবিরা কীভাবে যুক্তিহীন আবেগে ভেসে গেছেন, জনগণের সঙ্গে কীভাবে সুক্ষ্ম প্রতারণা করেছেন, তারই ব্যাখ্যা দিয়েছেন ছফা। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শুরুই হয়েছে পুঁথিসাহিত্যের প্রসঙ্গ দিয়ে। ছফা পুঁথিকারদের মনের ভেতর দিয়ে সৃজনশীল বাঙালিকে চেনার চেষ্টা করেছেন। দেখিয়েছেন বাঙালি মুসলমান মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দুর উত্তরাধিকারী। উচ্চবর্ণের স্বধর্মীয়দের অত্যাচার নিপীড়ন থেকে বাঁচতে যারা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, তারাই আজকের বাঙালি মুসলমান। ছফার মতে, বাঙালি মুসলমানের আদৌ কোনও গৌরবজনক অতীত নেই। ছিল না কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে প্রভাববিস্তারী অতীত-ভূমিকাও। তারা প্রথমে ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু, পরে শ্রমিকশ্রেণীর-কৃষিজীবীশ্রেণীর মুসলমান। মূলত উৎপাদনেই তাদের সময় কেটেছে, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী কোনো কাজ কিংবা পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির ক্ষেত্রে আন্দোলনে তেমন কোনো আধিপত্য ছিল না। ছফা দেখিয়েছেন কীভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হওয়ার পর অতীতের নিপীড়িত জীবনস্মৃতি মনে রেখে, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিশোধ নেয় পুঁথি রচনা করে। তাদের রচিত পুঁথির পটভূমি চরিত্র সবই আরবের, কিন্তু ধর্ম-সংস্কৃতি বাংলার। বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য ছফার___ ‘মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো হয়তো চর্বিতচর্বণ, নয়তো ধর্মীয় পুনর্জাগরণ। এর বাইরে চিন্তা, যুক্তি এবং মনীষার সাহায্যে সামাজিক ডগ্মা বা বদ্ধমতসমূহের অসারতা প্রমাণ করেছেন তেমন লেখক-কবি মুসলমান সমাজে আসেননি। বাঙালী মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসা ভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সঙ্কুচিত। বাঙালী মুসলমানের মন এখনো একেবারে অপরিণত, সবচেয়ে মজার কথা এ-কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না। যেহেতু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রসারমান যান্ত্রিক কৃৎকৌশল স্বাভাবিকভাবে বিকাশলাভ করছে এবং তার একাংশ সুফলগুলোও ভোগ করছে, ফলে তার অবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এঁচড়েপাকা শিশুর মতো। অনেক কিছুরই সে সংবাদ জানে, কিন্তু কোনো কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপন করতে জানে না। যখনই কোনো ব্যবস্থার মধ্যে কোনোরকম অসংগতি দেখা দেয়, গোঁজামিল দিয়েই আনন্দ পায় এবং এই গোঁজামিল দিতে পারাটাকে রীতিমত প্রতিভাবানের কর্ম বলে মনে করে। শিশুর মতো যা কিছু হাতের কাছে, চোখের সামনে আসে, তাই নিয়েই সে সন্তুষ্ট। দূরদর্শিতা তার একেবারেই নেই, কেননা একমাত্র চিন্তাশীল মনই আগামীকাল কি ঘটবে সে বিষয়ে চিন্তা করতে জানে। বাঙালী মুসলমান বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেই জানে না এবং জানে না এই কথাটি ঢেকে রাখার যাবতীয় প্রয়াসকে তার কৃষ্টি-কালচার বলে পরিচিত করতে কুণ্ঠিত হয় না।’ কথাগুলো কেবল বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে যে খাটি তা নয়, একই সঙ্গে সমগ্র বাঙালির জন্যও প্রযোজন্য। ছফা বাঙালি মুসলমানকে আঘাত কওে জাগিয়ে তুলতেছিলেন। তাই কেবল বাঙালি মসুলমান সমাজের ত্রুটি-সীমাবদ্ধতা, অজ্ঞতা-মূর্খতাকে কাঁক্ষ করেছেন। কিন্তু সাধারণ চোখে যদি সমগ্র বাঙালি সমাজকে দেখি, তাহলে কী দেখি? দেখি___ পুরোসমাজটাই সবজান্তার ভান করে বসে আছে। এ সমাজে যে কিছুই জানে না সে এবং যে অনেক কিছু জানে সে___ এই দুই-ই প্রায় একই রকম। দুজনকেই অল্পজানা লোকেরা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফলে সমাজে ও মননশীলতার অঞ্চলে ব্যপক সংঘর্ষ বাধে। তবে এ সংঘর্ষ থাকে প্রচ্ছন্ন। সমাজে যা কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তার জন্য ষোলো আনা দায়ী সবজান্তারা। এই সবজান্তার ভান কেবল বাঙালি মুসলমানই করে তা নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও সমানে-সমান এ ক্ষেত্রে। ছফার বাঙালি দর্শন তাই এত বিচিত্র, এত যৌক্তিক।
বাঙালির জীবনসংগ্রামের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, বিপ্লবের কথা যেমন উৎপাদনব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সন্ধি-অভিসন্ধি, শিক্ষাব্যবস্থার বহুমাত্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন, ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’, ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’, ‘বাংলা ভাষা : রাজনীতির আলোকে’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘রাজনীতির লেখা’, ‘সঙ্কটের নানা চেহারা’, ‘শান্তিচুক্তি’ ‘বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র’ প্রভৃতি প্রবন্ধ ও বইগুলোয়। এর মধ্যে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ যতটা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কিত, ঠিক ততটা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারও নির্যাস। নিজের উচ্চশিক্ষাবিমুখের কারণ এবং এ ঘটনার সঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাকের প্রভাব সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এ কারণে বইটি হয়ে উঠেছে একই সঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাকের মূল্যায়ণ ও ছফার নানা অনুষঙ্গের বিবরণ।
‘শতবর্ষের ফেরারী : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ আপত-সমালোচনামূলক মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। এই বইয়ে ছফা বঙ্কিমসমালোচনায় একনিষ্ট নন, নিন্দায় আকীর্ণ। তিনি গড়পরতা বাঙালির কাতারে ফেলেই বঙ্কিমকেও বিচার করেছেন। ফলে বঙ্কিমের সামাজিক অবস্থান, মুসলমানদের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবের কারণ অনুসন্ধান করেননি। ‘বাঙালি মুসলমান মন’ যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে, যে দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখেছেন, একই মনোভাব নিয়ে বঙ্কিম মূল্যায়ণও করেছেন। ফলে বিচারটা হয়ে পড়েছে একপেশে।
বাঙালির বুদ্ধিজীবীদের অর্থলোলুপ স্বভাব এবং সাধারণ নাগরিকের হুজুগে বৈশিষ্ট্যকে কটাক্ষ করেছেন। বাদ দেননি সামাজিক বিকার-মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টিও। আহমদ ছফা বোধ করি জানতেন___ বাঙালি দুর্লভকে লাভ করার সাধনা তেমন করে না। তাই সহজে কোনো দুর্লভ কিছু পেয়ে গেলেও ওই মহার্ঘ বস্তুকে তখন কেবল খাটো করেই দেখে। সহজে পায় বলে কদর করে না সে। অর্থাৎ বাঙালির জন্য সেই পুরনো বাণীই সত্য___ ‘বানরের গলে দিলে মুক্তার হার / ফল ভেবে দাঁতে কেটে করে চুরমার।’ তাই বিবেকবান মাত্রই গুণাগুণ বিবেচনায় বস্তুকে উপযুক্ত স্থানেই রাখেন। বস্তুর যেমন স্থানিকগুরুত্ব রয়েছে, তেমনি মানুষেরও। ব্যক্তিকে তার মেধা, প্রতিভা, কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সমাজ-আসন নির্বাচন করতে হয়। নিজের চেয়ে নীচুস্তরের সমাজ মূল্য বোঝে না, উঁচুতলায় দেয় না যথার্থ সম্মান। অর্থাৎ যস্মিন দেশে যদাচার নীতি মেনে চলাই উত্তম। এ থেকে সহজ সমীকরণ করা যেতে পারে___ যে সমাজে গুণীর কদর জানে না, সেখানে গুণীকে সহজলভ্য করা মহাপাপ। বাঙালি মুসলমানেরও মূল সমস্যা এখানে। তারা নিম্নবর্ণের নিন্দুদের সঙ্গে মিশতে পারেনি, উচ্চবর্ণ তাদের গ্রহণ করেনি কোনোকালেই। সঙ্গতকারণে পুরো সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি। বাঙালির এই চরিত্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ছফা। প্রকাশও করেছেন সরাসরি, কোনো ভণিতা ছাড়াই।
আহমদ ছফার গদ্যভাষা নিরুত্তাপ নয়। পরন্তু অনেকটা রাগী; কিছুটা ঝাঁঝালো। বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভাষার মেজাজ নির্মাণ করেছেন তিনি। কবিতার মতোই আবেগের সংহতি তাঁর গদ্যের অলঙ্কার হতে পারত। কিন্তু হয়নি যে, তার কারণ ছফার মনে যে কথার উদয় যেভাবে হয়েছে, ঠিক ঠিক সেভাবেই প্রকাশ করেছেন। ফলে কোনো ঘষামাজা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁর গদ্যের ভাষা প্রবহমান নদীর মতো, কোথাও হোঁচট খায় না। কিন্তু সময়-স্থান বুঝে যে, একটু খানি বিরতি দিয়ে, চলার বেগের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটিয়ে চিন্তার বিস্তৃতি ঘটানো___ তাঁর গদ্যের কোথাও এর দেখা মেলে না।
এরপরও সত্য___ছফা বাঙালির সদর-অন্দরের খবর রপ্ত করেছেন উত্তমরূপেই। প্রকাশ করেছেন, এ জাতির মনের কথা, তার পোশাকি শৈলি, অন্তরের দুর্বলতা, আবেগের তীব্রতা, কল্পনার সীমাহীনতা, বুদ্ধির বন্ধ্যাত্ব ও জ্ঞানের সংকীর্ণতা। বাঙালি মুসলমানের মন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাধারণের চেয়ে পুঁথিলেখকদের মানসিকতা পর্যবেক্ষণ করেছেন তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। একই সঙ্গে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুনবিন্যাস’-এ যতটা না সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও যুদ্ধশেষে বুদ্ধিজীবীদের দায়দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তারও বেশি সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকাও পর্যবেক্ষণ করেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়ে ব্যাপার হলো___আহমদ ছফা মেরুদণ্ডসম্পন্ন বাঙালি বলতে মূলত বুঝেছেন, চাষাভূষাকেই, আর বাঙালি মুসলমান বলতে চিনেছেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিতদের। যারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
আহমদ ছফার লেখালেখির ভুবন সর্বত্রগামী না হলেও বিচিত্রমুখী। লিখেছেন কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও ছোটগল্প। অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অনুবাদ করেছেন গ্যাটের ‘ফাউস্ট’। তবে এসবের ভেতর সবচেয়ে উজ্জ্বল পরিচয় বোধ করি তাঁর সমাজচিন্তক সত্তা। ছফা বাঙালির মানস-সংকট, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় পরিচয়ের ভেতর জাতীয় পরিচয়ের উৎস সন্ধান করেছেন। কিন্তু এ সন্ধান প্রাতিষ্ঠানিক অভিসন্ধর্ভের ধাঁছে নয়। করেছেন একান্ত বেদরকারি-গদ্যলেখকের মতোই___ আপন মনের খেয়ালে, আপনার মতো করে। এক্ষেত্রে ছফা গবেষক নন, পর্যবেক্ষক। পর্যবেক্ষণদৃষ্টি তীক্ষ্ম, উপলব্ধি স্বচ্ছ। তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গদ্যের বিষয় যেমন সমকালীন অন্য লেখকদের চেয়ে ভিন্ন, তেমনি তার উপস্থাপনকৌশলও। ছফা বাঙালির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য-স্বভাব শনাক্তিসহ সবিস্তারে আলোচনা করেছেন ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ও ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শীর্ষক দুটি বইয়ে।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালিচিন্তকদের সম্পর্কে রূঢ়সব মন্তব্য করেছেন। অবশ্যই এসব মন্তব্যের শক্ত ভিতও রয়েছে। সাত চল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ___ দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আত্মবিক্রয়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কীভাবে পুরস্কার-পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তার তথ্য-উপাত্তও সাধ্যমতো উপস্থাপন করেছেন। একইসঙ্গে তাঁর মন্তব্যসহ ব্যাখ্যা করেছেন পরিস্থিতি। লেখাটি শুরু করেছেন নেতিবাচক পর্যবেক্ষণলব্ধ মন্তব্যসহ। লিখেছেন___ ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।’ বুদ্ধিজীবীরা সত্যা-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দের নিরিখে কখনো ভূমিকা পালন করেন না। তাঁরা মূলত সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন, সমাজের কল্যাণসাধনের জন্য নয়, নিজেদের আখের গোছাতে। ফলে তাঁরা যখন কোনো পক্ষাবলম্বন করেন, তখন যেমন তাঁদের কোনো পূর্বপরিকল্পনা থাকে না, তেমনি পক্ষত্যাগকালেও থাকে না। ছফার মতে, ‘আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়___প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন___সেও ঠেলায় পড়ে।’ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁদের চরিত্রও পাল্টায়। তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-বিশ্বাস নেই। একারণে তিনি বুদ্ধিজীবীদেরকে সুবিধাবাদী হিসেবেই বিচার করেছেন তিনি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের আগে-দেশস্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশ্বস্তি, স্বৈরশাসকের জীবনী অনুবাদ___ এসব বিষয়কে ছফা দেখেছেন লেখকদের মেরুদ-হীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষাৎ-পূর্বমুহূর্তে লেখকসমাজের নিষ্ক্রিয়তা-যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা, ভারতে পালিয়ে বেড়ানো, ভোগবিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ছফা তুলে ধরেছেন, স্বাধীনতাপূর্ববর্তী বাংলাদেশের লেখকসমাজ কী পরিমাণ অপরিণামদর্শী-অদূরদর্শী ছিলেন। তাঁরা একটি দেশের পটপরিবর্তনের আভাষটুকুও উপলব্ধি করতে পারেন না। এই লেখকসমাজ নিজেরাই অনুভব করতে পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে___ তাই জাতিকে সতর্ক করারও প্রয়োজন তাঁরা অনুভব করেননি। তাঁরা কেবল যা ঘটে তারই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকারী। যা ঘটতে যাচ্ছিল, তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তাঁদের কল্পনায়ও ধরা দেয় না সম্ভাব্য-ভবিষ্যৎ। তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে ছফার মূল্যায়ন দ্ব্যর্থহীন___ ‘বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কিছু কিছু পোশাকি ভূমিকা পালন করেছেন।’ বাঙালিচিন্তক-লেখকদের চরিত্রে দ্বিমুখিনতা ছফা খোলাসা করেছেন উদাহরণ-ব্যাখ্যাসহ। সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ‘প্রয়োজনে-ঠেলায়’ পড়ে বিশেষ বিশেষ ঘটনার আগে যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দেন, ঘটনার পরে লেখেন তার উল্টো কাসুন্দি। ফলে তাদের কোনো চিন্তা-কর্ম-উপদেশ সমাজের বিশেষ কোনো কাজে আসে না। কারণ এই বুদ্ধিজীবীরা সমাজকে কোনো নতুন কিছু উপহার দেওয়া দূরের কথা, আসন্ন বিপদ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগাম খবরটুকুও দিতে ব্যর্থ হন। সফল হবেন কী করে___ তাঁরা তো সমাজমঙ্গল নিয়ে কোনো চিন্তা করেন না, কাজ করেন না মানুষের কল্যাণে। যেটুকু করেন, সেটুকু কেবল নিজের স্বার্থে।
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অতীত-আসক্তি ভয়ানক রকমে উপস্থিত। তাই অতীতের তুচ্ছ বিষয়গুলোর মোহে এতই অন্ধ থাকেন যে, সামনের দিনগুলো সম্পর্কে ধারণা করতে পর্যন্ত পারেন না। তাঁদের বতর্মান থাকে আপসকামিতায় আকীর্ণ। অর্থাৎ তাঁদের উপস্থিতকাল কাটে ক্ষমতাবানদের স্তুতি, পুরস্কার-পদক গ্রহণে। আহমদ ছফা এই জাতীয় বুদ্ধিজীবীর চারিত্র্যিক স্খলন-খোলনলচে বদলানোর স্বভাব ব্যাখ্যা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। পাশাপাশি বলেছেন, দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণ ভেতর থেকে জেগে উঠেছে। দেশমাতৃকার সংকটকালে জনগণ-জনযোদ্ধারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাতে বুদ্ধিজীবীদের কোনো কার্যকর ভূমিকা ছিল না।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ আর ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। প্রায় একদশক পর প্রকাশিত বইয়েও ছফার মূল আক্রমণের শিকার বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণীর বাঙালি। বাঙালি লেখক-কবিরা কীভাবে যুক্তিহীন আবেগে ভেসে গেছেন, জনগণের সঙ্গে কীভাবে সুক্ষ্ম প্রতারণা করেছেন, তারই ব্যাখ্যা দিয়েছেন ছফা। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শুরুই হয়েছে পুঁথিসাহিত্যের প্রসঙ্গ দিয়ে। ছফা পুঁথিকারদের মনের ভেতর দিয়ে সৃজনশীল বাঙালিকে চেনার চেষ্টা করেছেন। দেখিয়েছেন বাঙালি মুসলমান মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দুর উত্তরাধিকারী। উচ্চবর্ণের স্বধর্মীয়দের অত্যাচার নিপীড়ন থেকে বাঁচতে যারা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, তারাই আজকের বাঙালি মুসলমান। ছফার মতে, বাঙালি মুসলমানের আদৌ কোনও গৌরবজনক অতীত নেই। ছিল না কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে প্রভাববিস্তারী অতীত-ভূমিকাও। তারা প্রথমে ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু, পরে শ্রমিকশ্রেণীর-কৃষিজীবীশ্রেণীর মুসলমান। মূলত উৎপাদনেই তাদের সময় কেটেছে, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী কোনো কাজ কিংবা পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির ক্ষেত্রে আন্দোলনে তেমন কোনো আধিপত্য ছিল না। ছফা দেখিয়েছেন কীভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হওয়ার পর অতীতের নিপীড়িত জীবনস্মৃতি মনে রেখে, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিশোধ নেয় পুঁথি রচনা করে। তাদের রচিত পুঁথির পটভূমি চরিত্র সবই আরবের, কিন্তু ধর্ম-সংস্কৃতি বাংলার। বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য ছফার___ ‘মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো হয়তো চর্বিতচর্বণ, নয়তো ধর্মীয় পুনর্জাগরণ। এর বাইরে চিন্তা, যুক্তি এবং মনীষার সাহায্যে সামাজিক ডগ্মা বা বদ্ধমতসমূহের অসারতা প্রমাণ করেছেন তেমন লেখক-কবি মুসলমান সমাজে আসেননি। বাঙালী মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসা ভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সঙ্কুচিত। বাঙালী মুসলমানের মন এখনো একেবারে অপরিণত, সবচেয়ে মজার কথা এ-কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না। যেহেতু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রসারমান যান্ত্রিক কৃৎকৌশল স্বাভাবিকভাবে বিকাশলাভ করছে এবং তার একাংশ সুফলগুলোও ভোগ করছে, ফলে তার অবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এঁচড়েপাকা শিশুর মতো। অনেক কিছুরই সে সংবাদ জানে, কিন্তু কোনো কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপন করতে জানে না। যখনই কোনো ব্যবস্থার মধ্যে কোনোরকম অসংগতি দেখা দেয়, গোঁজামিল দিয়েই আনন্দ পায় এবং এই গোঁজামিল দিতে পারাটাকে রীতিমত প্রতিভাবানের কর্ম বলে মনে করে। শিশুর মতো যা কিছু হাতের কাছে, চোখের সামনে আসে, তাই নিয়েই সে সন্তুষ্ট। দূরদর্শিতা তার একেবারেই নেই, কেননা একমাত্র চিন্তাশীল মনই আগামীকাল কি ঘটবে সে বিষয়ে চিন্তা করতে জানে। বাঙালী মুসলমান বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেই জানে না এবং জানে না এই কথাটি ঢেকে রাখার যাবতীয় প্রয়াসকে তার কৃষ্টি-কালচার বলে পরিচিত করতে কুণ্ঠিত হয় না।’ কথাগুলো কেবল বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে যে খাটি তা নয়, একই সঙ্গে সমগ্র বাঙালির জন্যও প্রযোজন্য। ছফা বাঙালি মুসলমানকে আঘাত কওে জাগিয়ে তুলতেছিলেন। তাই কেবল বাঙালি মসুলমান সমাজের ত্রুটি-সীমাবদ্ধতা, অজ্ঞতা-মূর্খতাকে কাঁক্ষ করেছেন। কিন্তু সাধারণ চোখে যদি সমগ্র বাঙালি সমাজকে দেখি, তাহলে কী দেখি? দেখি___ পুরোসমাজটাই সবজান্তার ভান করে বসে আছে। এ সমাজে যে কিছুই জানে না সে এবং যে অনেক কিছু জানে সে___ এই দুই-ই প্রায় একই রকম। দুজনকেই অল্পজানা লোকেরা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফলে সমাজে ও মননশীলতার অঞ্চলে ব্যপক সংঘর্ষ বাধে। তবে এ সংঘর্ষ থাকে প্রচ্ছন্ন। সমাজে যা কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তার জন্য ষোলো আনা দায়ী সবজান্তারা। এই সবজান্তার ভান কেবল বাঙালি মুসলমানই করে তা নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও সমানে-সমান এ ক্ষেত্রে। ছফার বাঙালি দর্শন তাই এত বিচিত্র, এত যৌক্তিক।
বাঙালির জীবনসংগ্রামের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, বিপ্লবের কথা যেমন উৎপাদনব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সন্ধি-অভিসন্ধি, শিক্ষাব্যবস্থার বহুমাত্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন, ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’, ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’, ‘বাংলা ভাষা : রাজনীতির আলোকে’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘রাজনীতির লেখা’, ‘সঙ্কটের নানা চেহারা’, ‘শান্তিচুক্তি’ ‘বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র’ প্রভৃতি প্রবন্ধ ও বইগুলোয়। এর মধ্যে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ যতটা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কিত, ঠিক ততটা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারও নির্যাস। নিজের উচ্চশিক্ষাবিমুখের কারণ এবং এ ঘটনার সঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাকের প্রভাব সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এ কারণে বইটি হয়ে উঠেছে একই সঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাকের মূল্যায়ণ ও ছফার নানা অনুষঙ্গের বিবরণ।
‘শতবর্ষের ফেরারী : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ আপত-সমালোচনামূলক মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। এই বইয়ে ছফা বঙ্কিমসমালোচনায় একনিষ্ট নন, নিন্দায় আকীর্ণ। তিনি গড়পরতা বাঙালির কাতারে ফেলেই বঙ্কিমকেও বিচার করেছেন। ফলে বঙ্কিমের সামাজিক অবস্থান, মুসলমানদের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবের কারণ অনুসন্ধান করেননি। ‘বাঙালি মুসলমান মন’ যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে, যে দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখেছেন, একই মনোভাব নিয়ে বঙ্কিম মূল্যায়ণও করেছেন। ফলে বিচারটা হয়ে পড়েছে একপেশে।
বাঙালির বুদ্ধিজীবীদের অর্থলোলুপ স্বভাব এবং সাধারণ নাগরিকের হুজুগে বৈশিষ্ট্যকে কটাক্ষ করেছেন। বাদ দেননি সামাজিক বিকার-মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টিও। আহমদ ছফা বোধ করি জানতেন___ বাঙালি দুর্লভকে লাভ করার সাধনা তেমন করে না। তাই সহজে কোনো দুর্লভ কিছু পেয়ে গেলেও ওই মহার্ঘ বস্তুকে তখন কেবল খাটো করেই দেখে। সহজে পায় বলে কদর করে না সে। অর্থাৎ বাঙালির জন্য সেই পুরনো বাণীই সত্য___ ‘বানরের গলে দিলে মুক্তার হার / ফল ভেবে দাঁতে কেটে করে চুরমার।’ তাই বিবেকবান মাত্রই গুণাগুণ বিবেচনায় বস্তুকে উপযুক্ত স্থানেই রাখেন। বস্তুর যেমন স্থানিকগুরুত্ব রয়েছে, তেমনি মানুষেরও। ব্যক্তিকে তার মেধা, প্রতিভা, কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সমাজ-আসন নির্বাচন করতে হয়। নিজের চেয়ে নীচুস্তরের সমাজ মূল্য বোঝে না, উঁচুতলায় দেয় না যথার্থ সম্মান। অর্থাৎ যস্মিন দেশে যদাচার নীতি মেনে চলাই উত্তম। এ থেকে সহজ সমীকরণ করা যেতে পারে___ যে সমাজে গুণীর কদর জানে না, সেখানে গুণীকে সহজলভ্য করা মহাপাপ। বাঙালি মুসলমানেরও মূল সমস্যা এখানে। তারা নিম্নবর্ণের নিন্দুদের সঙ্গে মিশতে পারেনি, উচ্চবর্ণ তাদের গ্রহণ করেনি কোনোকালেই। সঙ্গতকারণে পুরো সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি। বাঙালির এই চরিত্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ছফা। প্রকাশও করেছেন সরাসরি, কোনো ভণিতা ছাড়াই।
আহমদ ছফার গদ্যভাষা নিরুত্তাপ নয়। পরন্তু অনেকটা রাগী; কিছুটা ঝাঁঝালো। বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভাষার মেজাজ নির্মাণ করেছেন তিনি। কবিতার মতোই আবেগের সংহতি তাঁর গদ্যের অলঙ্কার হতে পারত। কিন্তু হয়নি যে, তার কারণ ছফার মনে যে কথার উদয় যেভাবে হয়েছে, ঠিক ঠিক সেভাবেই প্রকাশ করেছেন। ফলে কোনো ঘষামাজা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁর গদ্যের ভাষা প্রবহমান নদীর মতো, কোথাও হোঁচট খায় না। কিন্তু সময়-স্থান বুঝে যে, একটু খানি বিরতি দিয়ে, চলার বেগের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটিয়ে চিন্তার বিস্তৃতি ঘটানো___ তাঁর গদ্যের কোথাও এর দেখা মেলে না।
এরপরও সত্য___ছফা বাঙালির সদর-অন্দরের খবর রপ্ত করেছেন উত্তমরূপেই। প্রকাশ করেছেন, এ জাতির মনের কথা, তার পোশাকি শৈলি, অন্তরের দুর্বলতা, আবেগের তীব্রতা, কল্পনার সীমাহীনতা, বুদ্ধির বন্ধ্যাত্ব ও জ্ঞানের সংকীর্ণতা। বাঙালি মুসলমানের মন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাধারণের চেয়ে পুঁথিলেখকদের মানসিকতা পর্যবেক্ষণ করেছেন তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। একই সঙ্গে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুনবিন্যাস’-এ যতটা না সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও যুদ্ধশেষে বুদ্ধিজীবীদের দায়দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তারও বেশি সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকাও পর্যবেক্ষণ করেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়ে ব্যাপার হলো___আহমদ ছফা মেরুদণ্ডসম্পন্ন বাঙালি বলতে মূলত বুঝেছেন, চাষাভূষাকেই, আর বাঙালি মুসলমান বলতে চিনেছেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিতদের। যারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন