রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৪

ঈদোৎসবের সমাজতত্ত্ব ।। বীরেন মুখার্জী




Biren Mukherjee

উৎসবপ্রিয় জাতি হিসেবে বাঙালির সুনাম রয়েছে। উৎসবে মেতে ওঠার এ রেওয়াজ বাঙালির দীর্ঘদিনের। শত প্রতিকূল পরিস্থিতি উপেক্ষা করেও দেশে-বিদেশে বাঙালি জাতিকে নিজ নিজ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, সামাজিক-পারিবারিক পরিপ্রেক্ষিত, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবস, এবং জাতিসত্তাভিত্তিক সংস্কৃতি পালনে নানা উৎসবে মেতে উঠতে দেখা যায়। বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসব এবং বাঙালি সংস্কৃতি নবায়নে অনুষ্ঠিত উৎসবগুলো জমকালো অনুষ্ঠানের মর্যাদা পায়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাধারণত দুটি রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। একটি শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা, অন্যটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সংক্ষিপ্ত পরিসরে, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে সত্য; কিন্তু এসব উৎসবের সামাজিক দিকটিরও গুরুত্ব বিশাল। কর্মব্যস্ত জীবনে ধর্মীয় উৎসবের সামাজিক দিকটি মানুষের জীবনে যোগ করে নতুন মাত্রা। উৎসবের ব্যবহারিক দিকে যেমন সার্বজনীন চেতনা লক্ষণীয় তেমনি এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। সময়-কাল ও যুগরুচির বিবর্তনের ফলে উৎসবের প্রকৃতি পাল্টায়। এতে যোগ হয় নতুন নতুন উপাদান। আবার বর্জিতও হয় অনেক কিছু। বর্তমানে ধর্মীয় উৎসবাদির যে আনুষ্ঠানিকতা তা আজ থেকে একশ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। ‘উৎসব এখন একটি প্রথা। আর, প্রথা মাত্রেই সামাজিক পরিবেশের ফল।’১ এই পরিবেশ গড়ে ওঠে সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা প্রপঞ্চের সহায়তায়, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ তার জীবন ধারণের প্রয়োজনে একটা না একটা উপলক্ষ খুঁজে মেতে উঠেছে ক্লান্তি নিরসনে। এই উপলক্ষ বা উৎসবই কালের বিবর্তনে মানুষের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির একটি অংশ হিসেবে মান্যতা পেয়েছে এই ‘উৎসব’, যা বিনোদন লাভেরও একটি অন্যতম মাধ্যম।

ঈদোৎসব ইসলাম ধর্মালম্বীদের আধ্যাত্মিক জীবনে আত্মসংযম ও আত্মবিনোদনের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। রমজানের সময় দীর্ঘ এক মাস ধরে আত্মসংযমের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের প্রতি যে ভক্তি আর মনের বিশুদ্ধতা অর্জিত হয়, তাতে মানুষের মনের কুপ্রবৃত্তিগুলো দমিত হয়ে মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সুখী করে তোলে। রমজানের শিক্ষা হলো বিশুদ্ধ জীবনচর্যার মধ্যদিয়ে কলুষমুক্ত সমাজ গঠন। এটা ঈদুল ফিতরের স্পিরিচুয়্যাল দিক। আর উৎসবের ব্যবহারিক দিক হলো, ধনী গরিব নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মুসলিম মানব, সমান অধিকার নিয়ে ঈদের নামাযে সমবেত হয়ে একটি আদর্শ মানবসমাজের সৃষ্টি করেন। যেখানে ভক্তি, প্রেম ও সমান সাহচর্যের প্রতিফলন আশা করা হয়। উৎসব মানে যাবতীয় ভেদাভেদ ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, শুভেচ্ছা আর কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে অন্তরের উষ্ণ স্পর্শ গ্রহণ। বিশ্বব্যাপী মুসলিম অধ্যুষিত দেশে এই ধর্মীয় উৎসবটি উদযাপিত হয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বন্ধন হিসেবে। উৎসবটির সর্বজনীন দিক হলো, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ ঈদের আনন্দের অংশীদার হতে পারেন শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে এবং মুসলিম ভাইদের আতিথ্য গ্রহণ করে। এটা সামাজিক রীতিরই অংশ। এর আরও একটি সর্বজনীন দিক আছেÑউৎসবটি কেবল বাঙালি মুসলমানের নয়, বিশ্বে ইসলাম ধর্মের অনুসারী বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও ভাষাভাষী মানুষও একই উদ্দেশ্য নিয়ে এটি পালন করে থাকেন। সেটি হলো সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, আনন্দ ও ঈশভক্তি লাভ। তবে বাঙালি তার ঐতিহ্যসূত্রে পাওয়া চিরকালীন নিজস্ব সংস্কৃতিকে উৎসবের সঙ্গে যোগ করতে ভোলেন না। ধর্মীয় বাধানিষেধ যাই-ই থাক, ঈদুল ফিতর বাঙালি যখন উদযাপন করেন তখন তাতে বাঙালির কৃষ্টিসভ্যতার ছোঁয়া স্পষ্ট করেই ছায়া ফেলে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘকাল সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছে। এদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের। আর মুসলমানের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর, যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত। শাব্দিক অর্থে ‘ঈদ’ অর্থ খুশি। ধর্মীয় ভাবে ঈদ পালিত হয় সকালে জামাতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়ের মধ্যদিয়ে।  লৌকিক আনন্দ লাভের অংশ হিসেবে যথাসাধ্য নতুন, পরিচ্ছন্ন বা সুন্দর পোশাক পরিধান, ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ঈদের দিন প্রতিটি পরিবারের একই চিত্র দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে এদিনে ধনী-গরীবে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। ফলে, দৃশ্যত ঈদের দিনে মোলাকাত, পাশাপাশি বসে নামাজ আদায় করার মধ্য দিয়ে মানুষে-মানুষে ব্যবধানহীন ব্যূহ-ই যেন রচিত হতে দেখা যায়। এ চিত্র ঈদোৎসবের সামাজিক গুরুত্বকে আরো বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। তবে কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের ঈদোৎসবের আয়োজন এত বৈচিত্রময় ছিল না। আখতার হোসেন উল্লেখ করেছেন, ‘সময়ের পরিক্রমায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঈদ উৎসব আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে প্রায় এক হাজার বছর আগে এদেশে ইসলাম প্রসার শুরু হলেও প্রাচীনকালের ঈদ উৎসবের ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না।’২ আবার রফিকুল ইসলামের ‘ঢাকার কথা’ গ্রন্থের বিবরণে জানা যায়, তৎকালীন বাংলার সুবেদারদের নেতৃত্বে ঈদের আনন্দমিছিল হতো। সেখানে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। মূলত ঈদের আনন্দ ও উৎসব অভিজাত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন ধনী-গরীব নির্বিশেষ ঈদোৎসব পালিত হয়ে থাকে। এ পার্বণে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও এখন যোগ দেয়। আগে মুসলমান পরিবারের খাবারের স্বাদগ্রহণ অন্য সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দুদের জন্য ধর্মবিচ্যুতির নামান্তর হিসেবে গণ্য হতো। বাংলাদেশে এখনো কোথাও কোথাও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় এ শাসনব্যবস্থা চালু থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যত্যয় ঘটে। ঈদ উৎসব সামাজিকীকরণের প্রভাবেই এই শিথিলতা এসেছে বলে অনেক গবেষক মনে করেন।

ইতিহাসপাঠে জানা যায়, ইউরোপের শিক্ষার প্রভাবে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি অক্ষুণœ থাকে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক পর্যন্ত। এর ‘৪৭ এর দেশবিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানেরা তাদের স্বকীয়তা খুঁজে পায়। এরপর স্বাধীনতা অর্জনের পর তা পূর্ণাঙ্গ হয়। ফলশ্রুতিতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের যে কোনো উৎসব-আয়োজনে সব শ্রেণি-পেশা-ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে সর্বজনীনতা পেতে থাকে। বর্তমানে এই উৎসব এখন আর কোনো বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং হয়ে উঠেছে প্রত্যেক মানুষের উৎসবের অংশ। সত্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর বাঙালির আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জগতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পাশাপাশি যোগাযোগ ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ায় দেশিয় সংস্কৃতির সঙ্গে বিদেশি সংস্কৃতির যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। মানুষে-মানুষেও যোগাযোগ হয়েছে উন্নততর। সামগ্রিক বিবেচনায় এখন বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামেরই মানুষ কর্মসূত্রে রাজধানী ঢাকা বা বিদেশে অবস্থান করছে। ফলে দেশি-বিদেশি সব তথ্য দ্রুতগতিতে গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। গ্রামের মানুষও দেশি-বিদেশি সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়ায় প্রতিমুহূর্তে নিজেকে নবায়ন করার সুযোগ পাচ্ছে।

যোগাযোগব্যবস্থার সহজলভ্যতার কারণেই ঈদোৎসবে গ্রামমুখী হচ্ছে মানুষ। দীর্ঘ কর্মব্যস্ততার পর একত্রে মিলিত হওয়ার সুবাদে যেমন পরস্পরের আত্মিক বন্ধন সুদৃঢ় হচ্ছে তেমনি প্রতিবেশিদের সঙ্গেও সখ্যতা বাড়ছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা উপহার আদানপ্রদান, আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে মিলনসম্মিলন, নানা উপাদেয় খাদ্য খাওয়া আর খাওয়ানো হয়। ছোট-খাটো সামাজিক সমস্যাও নিরসনে এই সম্মিলন রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাঙালির উৎসবে সার্বজননীতার ছোঁয়া কেবল দেশ, কাল, সীমানা অতিক্রম করে সভ্যতা, সংস্কৃতি কিংবা ধর্মীয় চেতনার বিস্তার লাভের মধ্যে সংহত নয়। বলা যায়, কৃষিসভ্যতার মন্থর জীবনে বাংলার আদিমতম কৌম সমাজের মানুষ বিভিন্ন অভিঘাতের মধ্যদিয়ে নিজেদের যেমন সংস্কার করেছে তেমনি হয়ে উঠেছে রুচিবান। বাঙালি আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে সজাগ আবার নানা সামাজিক উৎসবের মধ্যেও বৈচিত্রসন্ধানী। উৎসবে, আনন্দ-আয়োজনে চেতনার বিস্তৃতি ঘটায় পর্যায়ক্রমে নানামাত্রিক বৈচিত্র্য যোগ হয়েছে উৎসবগুলোতে। কেননা, উৎসব হলো সামাজিক মানুষের ব্যবহারিক জীবনে আত্মপ্রপ্রকাশের এমন একটি স্বাভাবিক মানসবৃত্তি, যেখানে তার বাস্তব বুদ্ধি ও কল্পনাগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবিই প্রতিফলিত হয়।


 সূত্র :

১. উৎসব বারো মাস, লোককৃতি বিচিত্রা : আতোয়ার রহমান, বাংলা একাডেমি ঢাকা, জুন ১৯৯৯, পৃ. ১২১।
২. প্রবন্ধ : বাঙালি মুসলমানের ঈদ ও সামাজিক উৎসব, আখতার হোসেন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন