শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৪

সাহিত্যের রাজনীতি ।। মোহাম্মদ নূরুল হক



মানুষের চিন্তার স্রোত সব সময় একমুখী হয় না, থাকে না বাঁকহীনও। নানা চড়াই-উতরাইৎরায় পার হতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। এই অভিজ্ঞতা মানুষকে ধীরে ধীরে বদলে দেয়। পরিবর্তন ঘটে তার আচরণে, মনোজগতে। আর এই পরিবর্তন ঘটে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সাহিত্যিকদের। সাহিত্যিক ও সাহিত্যশ্লিশষ্টদের ভেতর চিন্তার পরিবর্তন ও বিবর্তন কখনো কখনো ঘটে আকস্মিক; কখনো কখনো সুপরিকল্পিতভাবে। পরিবর্তন ঘটে দুভাবে। প্রথমত, লব্ধ ধারণা ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজ-পরিবর্তনে লেখক অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পড়েন। ফলে মাঙ্গলিক চিন্তায় পূর্ণ হয়ে ওঠে সৃষ্টির ভুবন। দ্বিতীয় পরিবর্তন ঘটে আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছায়। এ পরিবর্তন যাদের মধ্যে প্রবল তারা লেখালেখির চেয়ে লেখালেখিকেন্দ্রিক কৌশলে আগ্রহী বেশি। লেখালেখিকে অবলম্বন করে জাগতিক স্বার্থসিদ্ধি-ই এই শ্রেণীর মূল্য উদ্দেশ্য। এই স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা গঠন করে বিভিন্ন সংঘ, গোষ্ঠী। দখন করে নেয় দৈনিকলগ্ন সাহিত্য পাতা, সাময়িকী এবং প্রকাশ করে নানা রকম গৌণ ইস্যুভিত্তিক সংকলন। ওই সংকলনগুলোর ভিত্তি সাধারণত কোনো দশক, কিংবা তুচ্ছ কোনো মতবাদ। ওই সংকলনগুলোর মূল উদ্দেশ্য_ একজন বা একাধিক কথাশিল্পীর সঙ্গে নিজেকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা। এই প্রবণতার সরল নামকরণ হতে পারে সাহিত্যের রাজনীতি।
পৃথিবীতে যত ধরনের রাজনীতি রয়েছে, এর মধ্যে সাহিত্যের রাজনীতি সবচেয়ে ভয়ানক। অন্য যেে কোনো পেশার লোকের চেয়ে সাহিত্যশ্লিশষ্ট লোকের আত্মম্ভরিতা বেশি। গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, স্টান্টবাজি ও স্নবরি- এ অঞ্চলের মতো অন্য কোথাও নেই। ইংরেজি পলিটিক্স শব্দের যথাযথ প্রতিশব্দ বাংলায় নেই। তাই রাজনীতি শব্দটা কাছাকাছি হওয়ায় গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু কী সেই রাজনীতি? প্রতিভাবানকে উপেক্ষা করে মেধাহীনদের দৌরাত্ম্যের ইতিহাস অনেকের-ই জানা। অনুরাগী পাঠক ও খ্যাতিপ্রত্যাশীদের প্রচার-প্রচারণায় সমকালে যিনি খ্যাতির শিখরে উঠতে পেরেছেন, তিনি কখনো নিজের আশে-পাশে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীদের প্রশ্রয় দেন না। নিজেও কোনো জ্ঞানী কিংবা নিজের চেয়ে প্রতিভাবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন না এবং নিজের চেয়ে বেশি প্রতিভাবানকে সহ্য করতে পারেন না। সাহিত্যের রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা অনুসারী সৃষ্টি ও লালনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন। আর অনুসারী লালনে তাঁদের কিছু নগদ অর্থও ব্যয়িত হয়। এই নগদ অর্থের উৎস- লেখক-কবিযশপ্রার্থী-আমলা-ব্যবসায়ীদের লেখক বানানোর প্রকল্প। এই প্রকল্প থেকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দুই ধরনের অর্থ উপার্জন সম্ভব। পাঠবিমুখ-অপ্রস্তুত সাহিত্য সম্পাদকেরা বিত্তশালীদের রচনা ছাপিয়ে সময়ে-অসময়ে কিছু আর্থিক সুবিধা আদায় করেন। সে অর্থেই চলে তাঁদের অনুসারীগোষ্ঠী লালন। তাঁরা ভুলে যায়-প্রজ্ঞাবানেরা আইডিয়া নিয়ে নিজে নিজে ভাবেন, পর্যালোচনা করেন নিজের সঙ্গে নিজে। নির্বোধেরা নিজের মনে কোনো চিন্তার উদয় হওয়া মাত্র-ই দশজনকে জানায়; চালাকেরা ওই আইডিয়া ধার করে নিজের বলে চালিয়ে দেয়। এই নিয়ম যুগ -যুগ ধরে চলে আসছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না- ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না, মাঝেমাঝে কেউ কেউ কিছুদিনের জন্য বিকৃত করে মাত্র। ইতিহাস আপনি গতিতে চলে এবং স্বমহিমায় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। এ-ও সত্য- সূর্য থেকে আলো আর উত্তাপ নিতে হয় প্রাণীজগৎ আর উদ্ভিদ জগতের। সূর্যের বুকে কেউ পৌঁছতে পারে না, বিপরীত চেষ্টা করলে ভস্ম হতে হয়। কিছু মানুষ সব সময়-ই ক্ষমতাবানদের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য লালায়িত থাকেন। তাঁরা ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সময় সুবিধাবাদী অবস্থানে থাকেন এবং ডিগবাজি খান।
তোষামোদকারী যতই ক্ষমতাবানদের কাছে ঘেঁষতে থাকে, প্রাজ্ঞজনেরা ততই উপেক্ষিত হতে থাকেন। এর কারণ ক্ষমতাবানেরা অনেক সময় তোষামোদকারীদের স্তুতির বন্যায় এমন-ই ভেসে যেতে থাকেন যে প্রায় অন্ধ হয়ে যান। যৌক্তিক-অযৌক্তিক বিষয়কে আলাদা করার পর্যবেক্ষণ শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তখন মোসাহেব বেষ্টিত থাকার কারণে প্রকৃত সত্য জানার সুযোগ পান না। বিস্ময়ের বিষয় হলো,-  এই চরম সত্য থেকে তোষামোদকারী কিংবা ক্ষমতার মোহে অন্ধরা কোনো দিন শিক্ষা নেন না। পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাস এই সাক্ষ্য-ই বহন করে।
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য এ শ্রেণীর সাহিত্যশ্লিশষ্টরা দায়ী। তাঁদের মূল্য লক্ষ্য- সমাজকে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেওয়া, সৃষ্টি করা নৈরাশ্যজনক সাহিত্য সমাজ। যেখানে ক্রমাগত শিষ্টাচার- বহির্ভূত আচরণ করতে থাকবে, কবি-কথাশিল্পী-যশপ্রার্থীরা। নিজেদের ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণকে চিত্তের দার্ঢ্য আর গোঁয়ার্তুমিকে দ্রোহ বলে-ই দাবি করে। তাঁদের স্বভাবজাত প্রবণতা হলো- সমাজের সম্মানিত কাউকে অসম্মান করা। ছোটকে বড় আর বড়কে ছোট বলে প্রচার করা মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ধরনের অপরাধ যাঁরা করেন তাঁরা মূলত অসাহিত্যিক সাহিত্য-সম্পাদক। অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা সাহিত্য পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পেলে পুরো পাতাটিকে পারিবারিক সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের দেয়ালিকায় পরিণত করেন। এই অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখকদের প্রতি তাকান ভীত সন্ত্রস্ত চোখে, আর আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চানাচুর মার্কা পত্রস্থ করেন যত্মসহকারে। সাহিত্যসমাজে যখন স্নবরি  বা স্টান্টবাজ লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন নির্মোহ, নিরাসক্ত ও নির্লোভ প্রাজ্ঞ ও হৃদয়বান সাহিত্যিকেরা উপেক্ষিত হতে থাকেন। প্রচল সমাজ ব্যবস্থার নিরিখে নির্মোহ, নিরাসক্ত সাহিত্যিককে কারও কারও কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। মনে হতে পারে অপ্রকৃতিস্থও। প্রচল স্রোতের সঙ্গে গা ভাসাতে না পারা প্রতিভাবানদের এই এক সমস্যা। লোভের পৃথিবীতে নিস্পৃহ-নির্লোভীরা কোনো দিন যথাযথ সম্মান পায় না। এই লোভ ও হুজুদের  পৃথিবীতে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থান চাটুকারদের জন্য বরাদ্দ। চাটুকারদের দৌরাত্ম্যে প্রতিভাবান-সত্যবাদীরা উপেক্ষিত হতে থাকেন নানাভাবে। কিন্তু সত্যবাদীরা ব্যক্তিগত জীবনে যতই সত্যের চর্চার করুক কিন্তু সমাজের ওপর তেমন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না উপস্থিতকালে। বিপরীতে চাটুকারেরা নিজেদের সুবিধা আদায় করে নেয় প্রায় তাৎক্ষণিক। সত্যবাদীদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজপতিরা, শাসকবর্গ। ফলে সত্যবাদীদের জন্য প্রতিমুহূর্তে উপেক্ষার যন্ত্রণা নির্ধারিত থাকে। চাটুকারদের সঙ্গে আপাতত তাদের পরাজয়ই বড় হয়ে ওঠে। এর কারণ- চাটুকারের পেছনে থাকে ক্ষমতার শক্তি, সত্যবাদীর জন্য ক্ষমতার খক্ষ।
কিন্তু এই সত্যবাদীদেরও শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। এক শ্রেণীর সত্যবাদী রয়েছে, যারা আসন্ন বিপদের সংকেত না বুঝেই, সময় না বুঝেই, নিজের উপলব্ধি যেখানে-সেখানেই প্রকাশ করে। অন্য েেশ্রণীর সত্যবাদীরা পরিস্থিতি বুঝে, সময়মতো সত্য প্রকাশ করে। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর সত্যবাদীরা অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সত্য প্রকাশেও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়ন। এই শ্রেণীর সত্যবাদীরা-ই প্রকৃতপক্ষে প্রজ্ঞাবান। বিষয়টা অনেকটা ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর মতো। বোকারা ঝড়ের সময় আম কুড়ায়, বুদ্ধিমানেরা ঝড় শেষে; আর প্রজ্ঞাবানেরা পর্যবেক্ষণ করে। ফলে ঝড়ের কবলে ফলে বোকারা মাঝেমাঝে প্রাণ হারায়, বুদ্ধিমানেরা তাদের ঠকিয়ে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে আর প্রজ্ঞাবানেরা কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়েই ফসল তোলে ঘরে। প্রসঙ্গটা আপাতত, অসংলগ্ন মনে হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের রাজনীতির আলোচনায় এ প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। ফলে যারা সাহিত্যের রাজনীতি করে, অন্যকে খাটো করে নিজের সুবিধা আদায়ের হীন চেষ্টায় লিপ্ত থাকে, তাদের মানসিকতা বোঝার জন্য উপর্যুক্ত বিষয়ের ধারণা রাখারও প্রয়োজন রয়েছে। সে সঙ্গে এ-ও পরিষ্কার হয়ে যাবে- সমকালে সাহিত্যের রাজনীতির শিকার-উপেক্ষিত মাত্র-ই দুর্বল নন, নন উত্তরকালে হারিয়ে যাওয়ার কোনো মামুলি সত্তা। বরং উপেক্ষিতদেরই ভেতর থেকেই কেউ কেউ হয়ে ওঠে মহীরুহ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন