প্রশ্নের মীমাংসার আগে জামায়াতে ইসলামীর অতীতের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকাতে হয়। বিতর্কিত নেতা আবুল আলা মওদুদির নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠা করা হয় জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। ’৪৭ সালে দেশভাগের পর মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করে জামায়াত। এ কারণে ১৯৬৪ সালে দলটিকে নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান সরকার। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের মু্িক্তযুদ্ধ ও ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবিরও বিরোধিতা করে এই জামায়াত। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার লক্ষ্যে জামায়াত একাধিক দলও গঠন করে। এসব দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল___ রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও ইসলামী ছাত্র সংঘ।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্নের। সে লক্ষ্যে দলটি বেশ এগিয়েছেও। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচার শুরু করাসহ রায় কার্যকর পর্যন্ত ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ারও রয়েছে দীর্ঘ পথপরিক্রমা। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতনেতা আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের যাত্রা শুরু। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনে সরকার। এ সময় ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠন বা দলের বিচারের বিধান জুড়ে দেওয়া হয়। এর আগের বিধান অনুযায়ী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার সুযোগ ছিল না। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ফলে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগও বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন। হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার রায় দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের ‘আইনি প্রক্রিয়ায় শক্ত ভিত্তি’ হিসেবে কাজ করবে। তবে এ প্রসঙ্গে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, এ রায় দিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন হাইকোর্ট। ইসি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছিল। তার মতে, একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসির দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় ইসির অক্ষমতারই প্রকাশ ঘটেছে।
জামায়াতনেতা গোলাম আযমের মামলার ঘোষিত রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি উল্লেখ করেছেন___ জামায়াতে ইসলামী একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’। সংগঠনটির রাজনীতি প্রতারণাপূর্ণ। এখনও বাংলাদেশে জামায়াতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা। দলটি স্বাধীনতাবিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেনি। এখনও তারা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত। সরকারি-বেসরকারি শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধী কোনও ব্যক্তিকে না বসানো এবং সরকারি পদ থেকে ওইসব ব্যক্তিকে সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন ট্রাইব্যুনাল।
জামায়াতের কারণে তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে বলেও মনে করেন ট্রাইব্যুনাল। এই সক্রিয় স্বাধীনতাবিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তাদের অবস্থান এখনও পরিবর্তন করেনি। এ ব্যাপারে তারা কোনও অনুশোচনা প্রকাশ করেছে বলে জাতির কাছে কোনও প্রমাণ নেই। সুতরাং এই অপরাধী সংগঠনের নেতাকর্মীদের স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার, ভোটাধিকার প্রয়োগ ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার থাকতে পারে কি না___ এটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিবেচনা করতে হবে। একটি অপরাধী সংগঠনকে যদি রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়, তা হলে বাংলাদেশের অখ-তা হুমকির সম্মুখীন হবে, তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই।
সুপ্রিম কোর্ট দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনই চাইলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দিতে পারে। আবার যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়া করানোও যায়। সে ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থী পক্ষকে ভেবে দেখতে হবে, জামায়াতের সর্বোচ্চ দ- কী হতে পারে।
জামায়াত জঙ্গি সংগঠন। মূলত ওই পর্যবেক্ষণের পরই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রার্থীরা নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। অবশ্যই এর আগে দলের বিচারের দাবি ওঠার পর জামায়াতের নবীন-প্রবীণ নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। নবীনরা চেয়েছেন দলের সংস্কার। তারা প্রবীণদের দল থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা___ জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংকসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ এখনও প্রবীণদের হাতে। ফলে তাদের বাদ দিয়ে দল পুনর্গঠন করা হলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নবীনরা অর্থসংকটে পড়বে। হয়তো এসব দিক বিবেচনা করেই শেষপর্যন্ত নবীনরা সংস্কারের দাবি থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া দেখতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপ পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ৩ দিনের সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আধুনিক অপরাধ আইনে ব্যক্তির বিচার করা হয়ে থাকে, সংগঠনের বিচার করা হয় না। জাতীয় সংহতি সুরক্ষার স্বার্থেও দলের বিচার সমীচীন নয়। তার মতে, একটা রাজনৈতিক দলে হাজার হাজার কর্মী থাকেন। তারা দলকে অপরাধ করার সিদ্ধান্ত দেননি। দলের নেতৃত্ব কিংবা অন্য কোনও পর্যায়ের ব্যক্তিরা অপরাধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিবর্গ অপরাধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই অপরাধ যারা করেছেন শুধু তাদের বিচার করা উচিত। রাজনৈতিক দলের বিচার করাটা ভবিষ্যতে জাতীয় সংহতির জন্য সহায়ক নয়।
তার এই অভিমতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। তার মতে, র্যাপের বক্তব্য তার নিজস্ব বক্তব্য। বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যে অবশ্যই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করা উচিত।
জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করালে, বিচারে দলটি নিষিদ্ধ হলে, সে ক্ষেত্রে জামায়াতের নেতাকর্মীরা পরবর্তী সময়ে কী করবে? তাদের সবাইকে নিশ্চয় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে দ-িতরা নতুন নামে নতুন দল গঠন করবে। আর তাদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিলে তাতে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠবে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে। এছাড়া প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকারবঞ্চিতরা চলে যাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে। চালাতে থাকবে চোরাগোপ্তা হামলা। প্রশাসন পড়বে চরম বিপাকে। রাজনৈতিক নেতার কাছে যেমন সহজে জবাবদিহিতা চাওয়া যায়, রাজনৈতিক পরিচয়হীনের কাছে তত সহজে চাওয়া যায় না। তাকে শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে বিচারে জামায়াতের শাস্তি যা-ই হোক, সরকারকে কিছু বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিচারপরবর্তী কালে দলটির নেতাকর্মীরা যেন কোনওভাবেই আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে জড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারেও সরকারকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
লেখক : সংবাদকর্মী