রবিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৪

সুখ উড়ে ।। সৈয়দা আমিনা ফারহিন



মৃদু সুরে চোখ বন্ধ করে থাকি।
সুরটা কাছে এসে ছুঁয়ে যায়-
ধরতে গেলে ধরা দেয় না।
চোখ বুজে মনের ভেতরে যাচ্ছি-
সুরে ভাসছি --
ছোট ছোট না পাওয়া মান-অভিমান নেশার মতন তন্দ্রাচ্ছন্ন
না পাওয়া আকাঙ্খা থেকে
সুখ উড়ে ---


পাহাড়ী রাস্তায় দু'জনে হারিয়ে যাওয়া এখনো চোখ বুঝলে দেখি।। পাহাড়ী শীত শীত সম্ভার। চোখ কাজল, তোমার দেয়া নুপূর, রেশমী চুড়ি পড়ে লাল টুকটুকে বউ সাজতে ইচ্ছে হয় ---আমি প্রতিদিনই বউ সাজি।। পাহাড়ী একেবেকে পথে  নামতে নামতে মার্মা বুড়োর অভয় দেয়া মনে ভাসছে।। "young মানুষ। দৌড়ে নিচে নেমে পড়" - বলে হাসছিল।


কুয়াশায় ভেজা মাটির নিচের দিকে নেমে যাই। পাহাড়ী সেগুনের গ্রামে ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখে চাটগা ভাষায় বড়দের আলাপ শুণে বিরক্ত হই। নতুন বউ দেখতে আসা বাঙ্গালী মহিলারা চকমকে শাড়ি পড়ে হেঁটে যাচ্ছে আর চিটাগাং এর ভাষায় কথা বলে চলছে। তোমার খুব ভালো লাগছে এসব দেখে।


সুরের ভেতর ঢুকে পড়ছি। চোখ বন্ধ করে পাহাড়ী রাস্তাটা ভেসে উঠছে। তুমি, আমি, প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো। বুড়ী দাদী বাঁশের কঞ্চি নিয়ে নাতনীকে দৌড়াচ্ছেন। নাতনী দৌড়ে পাহাড়ে উঠতে উঠতে দাদীকে ভেঙ্গিয়ে " আস, আস" করে ডাকছে। শরীরের বল আর মায়ার খেলা দেখে হাসি। বুড়ী চিৎকার করে করে চিটাগাং এর ভাষায় বলছে; "ওরা কে? আমাকে দেখে মিষ্টি হাসে।"


হেনরী রাইডার হেগার্ড থাকলে আমাদের নিয়ে কি কি বলত তুমি বলে যাও। আমি জানি ওঁর কথার মধ্য দিয়ে তুমি আমার বর্ণনা দাও। তোমাকে আমার জুলুপ্রধান মনে হয় মাকুমাজান। হাহা...

পাহাড়ী ছোট ছোট বেগুনী ঘাসফুল আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সীমের বিচীর মত ফল দেখে বসে পড়ি ওখানে। ঝোপের মত গাছে হলুদ হলুদ ফুল। তুমি জানো কি ছোটবেলায় পাহাড়ের প্বাদ্ভভূমিতে ছিল আমার বাস, আমার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব পাহাড়ের উপর। পাহাড়কে নিয়ে তাই আলাদা করে ভাবিনি। পাহাড়েই তো মিশে আমি। আমি এখনো পর্যন্ত ঘাসফুল কুড়াই।

পাহাড়ী রাস্তাটায় সন্ধ্যাকালীন হাঁটতে আসা-যাওয়া অপরিচিত মানুষেরা কখনো মনে করছে আমরা হানিমুনে এসেছি। গাঢ় কমলা সূর্যটার নিচের দিক লাল টুকটুক। এক নিঃশ্বাসে সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখলাম। বাতাসের ছোট ছোট শব্দ ভয়াবহ আন্দোলিত করে তুলছে। চারপাশটাতে পাহাড়- পাহাড়ী বুনো ঝাড়- বাঁশবন - ওদিকটার ঢালুতে আনারস বাগান ছিল গতবছর। এবছর অনাবৃষ্টিতে আনারস বাগান করেনি। ঝোপঝাড় হয়ে আছে। ঝোপগুলো বেয়ে ছোট ছোট জলোধারা নেমে জলাধার সৃষ্টি করেছে। একেকটা জলাধার যেন একেকটা স্বর্গ। এদিকটায় জুম ছাড়া নামে না কেউ।


পাহাড়ের খাদে খুটি দিয়ে টুপুর দোকান। আজকে ও নেই। টিপুর বাবা উখ্যযই মার্মা। টিপুর নাম আসলে মংসাইচিং মার্মা। লোকে টিপু বলে ডাকে। ওদের দোকানটি পৃথিবীর সেরা স্থাপনার একটি। পাহাড়ের চূড়ার ধারে মাচা করে দু'টো বাঁশের পোক্ত বেঞ্চি। নিচেই নেমে গেছে কয়েশক হাত নিচু খাড়া পাহাড়। এরপরের পাহাড়ে বাঁশবন অদ্ভুত মায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা চা আর পাহাড়ী বিনী চালের পিঠে খাচ্ছি। এই প্রথম দোকানের ভেতরটায় বসলাম। জানালার পাশে পা তুলে বিনী চালের পিঠা আর চা খাচ্ছি। একটু ঝুকলেই পাহাড়ের খাদ। আমরা দু'জন বকবক করতে থাকি। আমাদের সন্তান যদি পাহাড় ভাল না বাসে সে শংকা করে ও। আমার হাসি পায়। এমন হলে ঘর থেকে বের করে দেব বললে ওর শংকা আরো বাড়ে।  এসব নিয়ে চিন্তা করি না। জীবনের বাঁকে বাঁকে কি আসে কে জানে। আমি এসময়টুকুন উপভোগ করছি।


ও ঘরে ফিরতে চাইলে আমার ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে এখানে বসে চাঁদ ওঠা দেখব। কেন যে চাঁদ এখন রাত দু'টার দিকে উঠবে? ঘুটঘুটে অন্ধকারে পাহাড়ী রাস্তা আর আমরা দু'জন। রাজ হাকডাকে রোয়াংছড়ির শেষ বাসটা চলে গেল। ও উলটা পালটা কথা বলে আমার মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছে। ফলাফল বউয়ের হাতের খামচি খেয়ে হাত ছেঁড়া। ওর বকবক আরো ভালো লাগে - বকবকও বাড়তে থাকে। ওর ডার্লিং-দের এখানে আনার কথা বলে। ব্যাটারে পিটাইতে ইচ্ছা করতেছে। দৌড়াই- দৌড়াই। ওও দৌড়ায়- আরো দূরে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দৌড়াতে থাকি। মাঝে তিনটা মোটর সাইকেল আর একটা টমটম গেল।


এত রোমান্টিক সময়টা ওকে মেরে কেন নষ্ট করছি সেই কৈফিয়ত চাইল। ওর ডার্লিং-রা হলে করত না --শুণে ইচ্ছা করে আরো ঘুষি দেই - আরো খামচি দেই। আমরা দৌড়াতে থাকি। ও পাহাড় থেকে নিচে যেতে থাকে। টেনে উপড়ে তুলি। একটা গান না গাইলে পাহাড় থেকে নামব না বলি। মমতাজ মার্কা একটা গান শুরু হয়। ওফ---ওকে টেনে আবার পাহাড়ের উপড়ে উঠতে থাকি।


এনিগমার গানটা আবার ছেড়ে দিলাম। আমার সমস্ত না পাওয়ার কষ্ট, মৌনতা সুর হয়ে যাচ্ছে। কষ্টগুলোকে সুখের কাছে জমা দিয়েছি। হোকনা বেদনা কাঁদায়, সুখগুলো আরো বড়। পাহাড়ের কোলে বউ সাজি - ছোট সংসারে সারাদিনের ব্যস্ততা- আমাদের খুনসুটি -বাচ্চাদের মত উচ্ছলতা - আমরা ভালোবাসি-আমাদের আপন ভুবন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন