মঈন শেখ ।। ফেরা : চেনা জগতের গাথা
গল্পে গল্প থাকবে কি না, কিংবা থাকাটা আবশ্যক কিনাথ__ এই প্রশ্নটা এখন গুরুতর। তবে দুই প্রশ্নকারই হলেন গল্পকার। যারা গল্পে গল্প না থাকার দলে, তারা বোধকরি ‘ছোটগল্প’র নামটাও বদলে অন্যকিছু রাখতে চান। আমি অবশ্য গল্পে গল্প থাকার দলে। কারণ প্রতিটি রচনার পেছনেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো গল্প বা ঘটনা থাকে। তা তন্ময় হোক আর মন্ময়ই হোক। এমনকি একটি কবিতাও কোনো না কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতেই সৃষ্টি হতে পারে কবির মনে। তাই আমার মনে হয় গল্পে যদি গল্প না থাকবে তবে এর নাম গল্প কেন? আসলে যারা প্রকৃত অর্থে গল্প ফাঁদতে জানেন না তাদেরই এই খোঁড়া যুক্তি। আর এভাবেই আমরা আমাদের পুষ্পিত বাংলা সাহিত্যকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছি তা হয়তো জানি না কিংবা জেনে বুঝে নিয়ে যাচ্ছি সেই গন্তব্যে। হয়তো এটাও ঠিক, এই না বুঝে ফলিত ফসলই একদিন জঞ্জাল হয়ে দাঁড়াবে, অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিশাপও। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যা এখনই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এই অবতারণা এই কারণেই করছি যে, আমার আলোচ্য গল্পগ্রন্থ ‘ফেরা’ সম্পর্কে বলতে গেলে এ কথাগুলো আবশ্যক ছিল। গল্পকার সাবরিনা আনাম এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্প গড়ে তুলেছেন একটি গল্পের আশ্রয়ে; মূল উপজিব্যও বলা যেতে পারে। ‘ফেরা’ গ্রন্থে মোট গল্পের সংখ্যা ১৩টি। গল্পগুলো হল__ ক্ষমতা, পিপাসা, আশ্রয়, নীল খাম, মর্জিনার ঘর, জাফরানী আঁচল, বৃত্তাবদ্ধ, খেলাঘর, কণ্টক পথ, ভাগ্য নিয়ন্তা, পরী, স্বপ্নবীজ ও ফেরা। গল্পগুলোর মধ্যে কিছু ত্রুটি থাকতেই পারে। তবে যে কারণে রচনাগুলো গল্প হওয়ার জোর হকদার তা হল এর ভেতরের গল্প। যার পথচলা সহজ ও সরল। পাঠক যে পথে চলতে পারে আরো সহজে।
সাবরিনা আনাম গল্পগুলো লিখেছেন গল্পের গল্প-অক্ষে অবস্থান করে। আবার কখনো কখনো খুব নিবিড়ভাবে গল্পকে টেনে এনেছেন নিজ অক্ষে। তিনি তার চেনা ও জানা জগতের বাইরে গল্প লিখেননি। লিখেছেন নিজের চেনা জগৎ আত্মস্থ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে তা নিজ পর্যবেক্ষণের ফলও বটে। সাবরিনা আনাম প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের এক কর্মকর্তা। তিনি যখন কোনো বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান, তখন তা এক পরির্শকের দৃষ্টিতেই দেখেন না। সেই দেখাতে যোগ হয় এক লেখকের দৃষ্টি। যার প্রতিফলন থাকে লেখায়। তাছাড়া গল্পকারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি বলেও কথাগুলো বলতে পারছি। যেমন__ এই গ্রন্থের ‘ক্ষমতা’ গল্পটির মূল উপজীব্য একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘটনা-প্রবাহ।
চিত্রময়তা সাবরিনা আনামের গল্পে বিশেষত্ব দান করেছে। এই চিত্রময়তা পাঠককে গল্পের স্বাদ আস্বাদনে এক আবেশ দেয়, দেয় অন্যমাত্রা। এছাড়া তিনি কবিতার অনেক অলঙ্কার পরিয়েছেন তার গল্প-দেহে। যেমন___ চিত্রকল্প, উপমা রূপক, প্রতীক ইত্যাদি। তবে রক্ষা যে, এই ব্যবহার হয়নি কবির স্বভাবে, ব্যবহার হয়েছে গল্পকারের স্বভাবে। সাবরিনা আনামের মনের কবিত্ব গল্পে এসে হয় কথাশিল্পীর তুলির আঁচড়। যেমন ‘ফেরা’ গল্পের শুরুটা এসেছে এভাবে__ ক্ষেতের অর্ধেক জুড়ে হলুদ সর্ষের চাদর, বাকি অর্ধেকে আড়াআড়িভাবে ধান মটরশুঁটি আর আলু বোনা। ধানের সদ্য গজানো কচি চারাগুলো উন্মুখ হয়ে রোদ আর বাতাসের স্পর্শ মাখছে। ক্ষেতের আইলের ধারে, এখানে সেখানে বেশ কিছু খেজুর গাছ বুকে মাটির কলস নিয়ে দাঁড়িয়ে।... যতদূর চোখ যায় কোথাও হালকা সবুজ, কোথাও ঘন সবুজ আর হলুদে মেশানো সুখের রং। বাতাসে সমৃদ্ধির ঘ্রাণ। ঠিক একইভাবে ‘জাফরানী আঁচল’ গল্পটিও শুরু হয়েছে। যেখানে গল্পকার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন চিত্রকল্পতার মধ্যদিয়ে। যদিও গল্প শেষ হয়েছে অন্যভাবে। কথোপকথন গল্পের শুরুর রেস আলগা করেছে কখনো কখনো।
সাবরিনা আনামের গল্পের অন্য বৈশিষ্ট্য, গতিময়তা। এ গতি ভাষার নয়, এর যা গতি, তা গল্পে। পাঠককে উন্মুখ করে তোলা গল্পের জন্য। যেহেতু এই গ্রন্থের গল্পগুলো গল্পনির্ভর। কাজেই এই দায়বদ্ধতা লেখকের নিজেরই। যেমন__ ‘ফেরা’ গল্পে লেখক একই সঙ্গে চার-পুরুষের বর্ণনা করেছেন। অথচ গল্পের অবয়ব যে বড় তা নয়। লেখক তা না করলেও পারতেন।
সাবরিনা আনাম গল্প ফেঁদেছেন আপন অভিজ্ঞতার আলোয়। তিনি যতটুকু বুঝেছেন বা উপলদ্ধি করেছেন তা-ই গল্পের উপজিব্য। এক কথায়, লেখকের ভালোগা-মন্দলাগা অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চেয়েছেন নিজের শিল্পবোধ দিয়ে। সার্থকতাও এসেছে এখানে। যেমন__ তিনি ‘ক্ষমতা’ গল্পে এনেছেন আমাদের প্রথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বিশেষ দিকের চিত্র। শিক্ষকরাও যে স্থানীয় ধনীক শ্রেণি দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছেন, তা এখানে এসেছে। এমন চিত্র এর আগে আমরা দেখি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘টিচার’ গল্পে। সেখানে আমরা দেখেছি শিক্ষক গিরীন ও স্কুল সেক্রেটারি রায়বাহাদুর অবিনাশ তরফদারকে। আর সাবরিনা আনামের ‘ক্ষমতা’ গল্পে পেলাম শিক্ষক শেফালী আর স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কাসিম মোল্লাকে। এ চিত্র চিরকালীন। ‘ফেরা’ গল্পে এসেছে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা। অবশ্য তা লেখকের উপলদ্ধিতে এসেছে ভিন্ন চিন্তায়। যা প্রচলিত চিন্তার বাইরে। ‘ভাগ্যনিয়ন্তা’ গল্পে উšে§াচিত হয়েছে আমাদের দেশের পাতিনেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের চরিত্রের নেপথ্যের কলুষতা। আর বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জীবন্ত চিত্র ‘আশ্রয়’ গল্পটি। তথাকথিত দেশদরদী, দেশরত্ন, দেশের গর্ব, বাঙালির অহঙ্কার প্রভৃতি খেতাবে ভূষিত নেতারা যখন আমাদের উদ্ধার করতে কোনো শহরে আসেন, তখন যে আমরা চরম জনদুর্ভোগে পড়ি, তারই চিত্র এই গল্প। পত্র-পত্রিকায় যার চিত্র আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই। লেখকও তার মনবেদন ব্যক্ত করেছেন এই গল্পে। পারভেজ যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
বড় কথা, সাবরিনা আনাম পাঠকের সঙ্গে কানামাছি খেলেননি। অলীক কিছু সৃষ্টি করেননি চেনা জগতের বাইরে গিয়ে। তিনি যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন, এমনকি তিনি যা উপলদ্ধিতে এনেছেন, তা-ই ভাগাভাগি করতে চেয়েছেন অন্যের সঙ্গে। আর তা ভাগ করেছেন সরল ভাষায়, সহজ অভিজ্ঞানে। বইটির সাজগোজ বেশ ভালো। তবে প্রচ্ছদ আরো একটু ভালো হতে পারতো। বইটির বহুল প্রসার ও প্রচার কামনা করি।
ফেরা
সাবরিনা আনাম
প্রচ্ছদ : সিকদার আবুল বাশার
প্রকাশক : গতিধারা, ঢাকা।
মূল্য : ১০০ টাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন