[‘নতুন চোখ’ সাহিত্য আন্দোলন মুন্সীগঞ্জে বসবাসরত কয়েকজন তরুণ সাহিত্যিকের নতুন কিছু করার প্রয়াস। এ আন্দোলনের নির্দিষ্ট কিছু রীতি-নীতি ছিল। ইশতেহার ছিল। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা কবিতা পাঠকের কাছে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে নতুন কোনও প্রকাশভঙ্গিতে কবিতা লেখা। এ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন পাঁচ তরুণ কবি। এরা হলেন জন মোহাম্মদ, অনু ইসলাম, জুনায়েদ, নাজমুল আরেফীন এবং কাজী মহম্মদ আশরাফ। আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর কাজী মহম্মদ আশরাফের ঘরে এক আড্ডা ও আলোচনা হয়। সে আড্ডার মূল বিষয় ছিল সাহিত্যে আন্দোলনের গুরুত্বসহ নানা দিক। দীর্ঘ সে আড্ডার কিছু অংশ শিল্পমূল্যে মূল্যবান বিবেচনা করে এখানে তুলে ধরা হল। ]
জুনায়েদ: আমরা যারা এখানে
উপস্থিত আছি সবাই কবিতা পড়ি এবং লিখি। আমাদের বেডলাক কিনা জানি না, আমি
আমার বন্ধুদের Ñঅনেকের কবিতা বুঝি না। অনেকে আমার কবিতাও বোঝেন না। তাহলে
এখানে দুর্বোধ্যতার প্রশ্ন এসে যায়। দুর্বোধ্যতার কারণ কী? অনেকের মতে
বিশ্বায়নের প্রভাব। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাও একটা কারণ। নানা জায়গা থেকে নানা
কিছু গ্রহণ করার ফলে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে।
জন: কবিতা দুর্বোধ্য হলে সমস্যা কী? যে কবিতা আপনার কাছে দুর্বোধ্য তা আমার কাছে সুবোধ্য। আমরা যখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনি, সবাই তা বোঝেন না। অনেকের কাছে তা দুর্বোধ্য মনে হয়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে যদি সহজবোধ্য করা হয়, তাহলে তা আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থাকবে না। আমাদের অক্ষমতার জন্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে সহজ করার দরকার নেই।
নাজমুল: সঙ্গীত আর কবিতা একই প্যাটার্নের হলেও দুটি ভিন্ন ধারার। কবিতার দুর্বোধ্যতার কারণ আমার মনে হয় ঔপনিবেশিকতার প্রভাব। বিশ্বায়নের প্রভাব। আমাদের নিজেদের ঐতিহ্য থাকতে আমরা তা গ্রহণ করব কেন? আধুনিকতাবাদীদের মতে সৃষ্টি ভালো হলে হাই, না হলে লো কোয়ালিটির। পোস্টমডার্নিজম বলে যা কবিতা হয়ে উঠেছে তাই বিশ্বের। কেউ কেউ হয়তো ইচ্ছা করে দুর্বোধ্য করার চেষ্টা করছে। অপরিচিত বিদেশি মিথ ব্যবহার করছে। আসলে কি তা দরকার?
জন: কবিতার দুর্বোধ্যতা আগেও ছিল, এখনও আছে। আমার মতে কবিতা সুবোধ্য হওয়ারও দরকার নেই। কবিতা দুর্বোধ্য হওয়ার আরেকটি কারণ জীবনের মান ও পরিবর্তন। দৈনন্দিন জটিলতা। এসব আছে বলে কবিতা দুর্বোধ্য থাকবে।
অনু: বর্তমানে যে সব কবিতা দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা হচ্ছে তার কারণ জীবনের প্রভাব। অর্থনীতি, রাজনীতি ও অন্যান্য জটিলতার কারণেই এই দুর্বোধ্যতা।
আশরাফ: কবিতায় দুর্বোধ্যতা সুবোধ্যতা বলে স্থায়ী কিছু নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এবং আন্তঃযোগাযোগটাই আসল। শহরবাসী সন্তানের ভাষার কারণে মায়ের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করলে একজন লেখকের লেখায় যা কিছু উপাদান যোগ হবে অন্যদের লেখায় তা হবে না। প্রযুক্তির অগ্রসরতাকেই দুর্বোধ্য বলা হচ্ছে। জনের কথাটাই সত্য যে, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা বিমূর্ত শিল্পকলাকে দুর্বোধ্য বলে দূরে ঠেলে রাখা যাবে না। যারা এর স্বাদ বুঝবেন তারা গ্রহণ করবেন। যার পেটে দুধ কিংবা মধু সয় না, তিনি পানি মিশিয়ে খাবেন। কিন্তু গাভী ও মৌমাছি তা তরল করে উৎপাদন করবে না।
নাজমুল: ভাষার সহজেবোধ্যতাই আসলে দরকার। এর কারণেই এলিয়েনেশন সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির দূরত্ব বাড়ছে।
আশরাফ: ভাষাগত দূরত্ব যদি চেষ্টাকৃত হয় তাহলে কবিতায় তা খুব সহজেই বোঝা যাবে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণে যে ভাষাগত দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। ধরা যাক গ্রামের একটি ছেলে শহরে গিয়ে নতুন পরিবেশে একটা ধারণা পেল, ‘প্রাইভেসি।’ এটা শহরের অনিবার্য বিষয়। কিন্তু গ্রামের লোক এই শব্দটিরই অর্থ বুঝবে না; বিষয়টি বুঝবে দূরের কথা। ছেলেটি গ্রামে আসার সময় তো শব্দটি শহরে ফেলে রেখে আসতে পারে না।
জন: আসলে আমরা যখন কবিতায় ঢুকি তখন দুর্বোধ্যতার কথা মনে থাকে না। রৌদ্র-গন্ধ-ডানা-চিল প্রভৃতি সহজ শব্দ। কিন্তু জীবনানন্দ যখন এগুলো একত্র করে কবিতায় লেখেন তার ভাষা সহজ, কিন্তু তা অর্থের দিক থেকে জটিল।
আশরাফ: একটা সময় কবিতা ছিল লেখকের দিক থেকে আত্মচিৎকার বা আত্মপ্রকাশ। আমার মনে হয় কবিতা শুধু বিশুদ্ধ মনের পরিশুদ্ধ প্রকাশ। কিন্তু পাঠকের দিক থেকে বিনোদন। কবিতা থেকে অন্য অনেক শাখা বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন আছে শুধু বিশুদ্ধ কবিতা। সুতরাং কবিতার পাঠক এখন কম হবেএটাই স্বাভাবিক। কবিতা পাঠ ঐচ্ছিক বিষয় ও সক্রিয় ক্রিয়া আর ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বিনোদন উপভোগ করা অনৈচ্ছিক ক্রিয়া। শুধু সুইচ অন করলেই চলে। এখন ঐসব দর্শকের কাছে কবিতা জোর করে পৌঁছে দিতে হবেই, এমন কথা নেই।
জুনায়েদ: সাহিত্য আন্দোলন কখন হয় বলে আপনার মনে হয়?
অনু: আসলে আন্দোলন সময়ের দাবি।
নাজমুল: তার মানে দর্শনটা পাঠক বুঝে নেবে সময়ের কাছ থেকে?
জুনায়েদ: আসলে আমাদের আগেই আলোচনা করা উচিত ছিলÑ কবিতা আমরা কেন লিখি, নিজের জন্য নাকি অন্যের জন্য।
নাজমুল: তোমার কি মনে হয় সাহিত্যে আন্দোলনের প্রয়োজন আছে?
জুনায়েদ: আন্দোলন মানে নাড়াচাড় করা। কোনও কিছু নাড়াচাড়া করে ছড়িয়ে দেওয়া।
নাজমুল: তাহলে তো সহজবোধ্যতাই কাম্য।
আশরাফ: নতুনত্ব আনার জন্যই আন্দোলন। বাজারি পণ্য বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেয়। আর সৃজনশীল শিল্পবস্তু শুধু আন্দোলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। ধরা যাক, একটা স্কুলে শিক্ষক শুধু ফার্স্টবেঞ্চের ছাত্রছাত্রীদের সাথেই সবকিছু শেয়ার করতে পারেন। লাস্টবেঞ্চের স্টুডেন্টরা অমনোযোগীÑ চোর-ডাকাত-পুলিশ খেলে। একই তারিখের একই ক্লাসে সামনের বেঞ্চের ছাত্রছাত্রীরা যা শিখছে, পেছনের বেঞ্চের ছাত্রছাত্রীরা তা পারছে না বা করছে না। তাহলে সময়কে সবাই সমানভাবে ধরতে পারে না। সময়কে ধরার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন। আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন বিষয়টা সবাই দ্রুত জানতে পারে।
জন: যোগ্য বিষয়গুলো একটা সময় ঠিকই অবস্থান করে নেয়। জীবনানন্দের অনেক কবিতা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছে। আন্দোলন হল কয়েকজন লেখকের একটা বিশ্বাসে পৌঁছা। যদি তারা একমত হতে পারেন, তখন সবাই একসাথে কাজ করলে তা দূরের সময়ের অপেক্ষায় না থেকে সমকালেই ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
আশরাফ: অনু বলেছে আন্দোলন সময়ের দাবি, কথাটা সত্য; তবে সময় তো আপেক্ষিক। সাহিত্যের সময়ের দাবি আর সাহিত্যিকের সময়ের দাবি এক নয়। জন বলেছে একটা প্রাথমিক বিশ্বাসে পৌঁছার কথা। হ্যাঁ, এভাবেই হয়। বিশ্বাসের সাথে সাথে মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হয়। কাজে তার লক্ষণ ফুটতে থাকে। প্রস্তুতি না থাকলে, লক্ষণ দেখা না দিলে এমনকী বিশ্বাসে না পৌঁছালে আন্দোলনে নাম লেখানো যায় মাত্র; মহাকালে টিকে থাকা যায় না। ‘কল্লোল যুগে’এমন অনেক রথী-মহারথী ছিলেন যারা পরে কালের ধূলায় মিশে গেছেন। আবার অনেকে সরাসরি আন্দোলনের কর্মী ছিলেন না, বিশ্বাসের ঐক্য নিয়ে নিবিড় সাধনা করে গেছেন তারা কালোত্তীর্ণও হয়েছেন। অনুরূফ ঘটতে দেখা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ এবং ‘ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্য আন্দোলনে’ও।
জুনায়েদ: আমার মনে হয় আন্দোলন শুধু তরুণরাই করে। যাদের পরিচিতি গড়ে ওঠে নি। প্রতিষ্ঠিতদের এতে অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই।
নাজমুল: প্রতিষ্ঠিতরা তরুণদের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলে স্বকীয়তা হারায়। এতে লাভ হয় তরুণদের। তাদের আদর্শের জয় হয়।
আশরাফ: আমার মনে হয়, যদি কবিতার বর্তমান ধারায় আস্থাশীল না হই, তাহলে আমরাও একটা আন্দোলন শুরু করতে পারি।
জুনায়েদ: একটা সময় সময় কবিতায় আত্মকেন্দ্রিকতা ছিল না, বর্তমানে প্রবল। আমার মনে হয় আমাদের উচিত এখান থেকে বেরিয়ে আসা।
নাজমুল: এলিয়টের কথাটাই গুরুত্ব দিতে পারিÑ নৈর্ব্যক্তিকতা। আত্মবিলোপন ঘটাতে হবে কবিতায়। তিনি বলেছেন আমরা কাচের জানালার দিয়ে দৃশ্যবস্তু দেখি; কাচ দেখি না। কবিতার ভেতর দিয়ে চিত্রকল্প ও দৃশ্যকল্প দেখব, কবিতাকে দেখব না।
জুনায়েদ: আমার মনে হয় কবিতায় ‘আমি-তুমি’ শব্দদুটি যথাসম্ভব কম ব্যবহার করলেই ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যায়।
আশরাফ: আসলে ‘আমি-তুমি’ শব্দ দুটি থাকলেই যে ক্ষতি হবে এমন কোনও কথা না। ধরা যাক সুধীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন, আমার মনের আদিম আঁধারে/ বাস করে প্রেত কাতারে কাতারে। এখানে ‘আমি’ শব্দটিতে পাঠকেরও অংশগ্রহণ আছে। অনেক সময়‘আমি-তুমি’ বাদ দিলেও আমিত্বের বোধ থেকে যায়। আমরা যদি কবিতায় আত্মবিলোপ ঘটাতে চাই তাহলের আমিত্বের বোধটাই বাদ দিতে হবে।
জন: ‘আমি-তুমি’ শব্দ না থাকলেও আমার মতে, আমিত্ববোধ থাকা উচিত। কারণ কবি প্রধানত ব্যক্তিমানুষ। বোধ ও উপলব্ধি তার নিজের।
জুনায়েদ: কবির উপলব্ধিকে পাঠক কেন নিজের বলে ভাববে না? তার নিজের বিষয়ে পাঠকের শেয়ার না থাকলে লেখক-পাঠকের সেতুবন্ধন হবে না।
আশরাফ: কবির আহরণ ব্যক্তিগত; বিতরণ নৈর্ব্যক্তিক। কবি তার ব্যক্তিগত অনুভূতি ও উপলব্ধি প্রকাশ করবেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে। সেটা যাতে সবার হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’তে কবি উপস্থিত আছেন; কিন্তু নিজেকে তিনি বিলুপ্ত করে ফেলেছেন বলে আমরা বিশাল ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ক্ষুদ্র কৃষ্ণকলিকেই প্রবলভাবে দেখতে পাই। আবার নজরুলের ‘অভিশাপ’ ও জীবনানন্দের ‘সুরঞ্জনা’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা হলেও তা পাঠকের হয়ে উঠেছে। যদিও জীবনানন্দ প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় প্রথম পংক্তিতেই লিখেছেন ‘আমি সেই কবি’ পরে আমিত্বের প্রভাব তিনি কমিয়ে এনেছেন। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ ব্যক্তিগত অনেক ঘটনার কাব্যরূফ দিয়েছেন যার বেশির ভাগই বাজে কবিতা। এটা ঘটেছে কবিখ্যাতির চূড়ায় ওঠার পরে। সেই পরিচ কে ভিত্তিভূমি ধরে যা কিছু লেখা হয়েছে তার মান সর্বদা সুরক্ষিত হয় নি। শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা বিষয়ক কবিতাগুলোর গ্রহণযোগ্যতাই প্রমাণ করে বিপরীত ধারার কবিতাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিতান্তই কম। তুমি কবির ব্যক্তিগত পাঁচালী শুনে পাঠকের কী লাভ যদি তাতে পাঠকের অনুভূতির অংশগ্রহণ না থাকে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান কেন পাঠক-শ্রোতার হয়ে ওঠে?
অনু: আসলে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে সব বিষয় একঘেয়েরূপে চলে এসেছে, তা এখন বাদ দেওয়ার সময় হয়েছে।
নাজমুল: এলিয়ট কিন্তু আলফ্রেড প্রুফুুক নৈর্ব্যক্তিকতায় লিখেছেন। ‘ওয়েস্টল্যান্ডে’ খবঃ ঁং বলে পাঠকদের টেনেছেন, এটা কিন্তু ব্যক্তিগত নয়। তাহলে দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়টিকে কীভাবে প্রকাশ করা যায়?
অনু: মুহূর্তকে জয় করতে না পারলে কালকে ধারণ করা যায় না। চোখে দেখা বস্তুকে রূপক ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করতে হবে।
নাজমুল: পুরনো কবিদের যেমনÑ শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ কিংবা মহাদেব সাহাদের কাব্যাদর্শ কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া যাবে?
জন: নতুন কাউকে জায়গা করে নেওয়ার জন্য পুরনোকে অস্বীকার করতেই হবে। আমাদের উচিত তাদের যেখানে শেষ, আমাদের সেখান থেকেই শুরু করা। আমাদের নিজস্ব ভাষা খুঁজে নিতে হবে। যেমন, কবিতায় এখন আর বিরামচিহ্নের প্রয়োজন নেই। আমার একটি কবিতা যদি দশজন পাঠক পড়েন, তা হবে দশটি কবিতা। কিন্তু বিরামচিহ্ন বসিয়ে যদি বাইন্ডিংসে ফেলা হয় তা বহুমাত্রিকতা হারিয়ে ফেলবে। দশজন পাঠক কিন্তু তখন একটি কবিতাই পড়বে।
জুনায়েদ: বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর বিরামচিহ্নের প্রবর্তন করেছেন গদ্যের জন্য।
আশরাফ: আসলেই তাই। বিরামচিহ্ন মূলত গদ্যসাহিত্যের জন্য।
নাজমুল: কবিতায় যৌনগন্ধ, রাজনীতিগন্ধ, আদর্শগন্ধ, দর্শনশাস্ত্রীয় কিংবা বিজ্ঞানগন্ধ এসব দরকার আছে কি না?
জুনায়েদ: এসব গন্ধ ও দুর্গন্ধের কারণে বর্তমান কবিতার শিল্পমূল্য আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এসব বিষয়কে এড়িয়ে নতুন কিছু করতে পারলে স্বাগত জানাব।
আশরাফ: হাজার বছরের বাংলা কবিতা দিনে দিনে দায়মুক্ত হয়েছে। এখন আবার কেন কবিতা কেন আদর্শের বোঝা বইতে যাবে? কবিতা হবে ¯্রফে কবিতা।
জন: আমি মনে করি, এগুলো কবিতার জন্য একেকটি দেয়াল বা বাধা।
আশরাফ: বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসু সর্বপ্রথম কবিতাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তখন প্রবল বামপন্থীরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন। কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বুদ্ধদেব বসু ঠিক কাজটিই করেছেন। বামপন্থীরা যদি কবিতাকে রাজনীতি বা আদর্শ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে অন্যান্য পন্থীরাও তাই করবে। আজ আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? মৌলবাদীরাও ঠিক তাই করছে। দুহাজার এক সালে বাংলাদেশেরর সংখ্যালঘু নির্যাতন আর গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে লেখা দুটি কবিতা পশ্চিমবাংলার এক কাগজে পাঠিয়েছিলাম। তারা আমার কবিতা নিয়মিত ছাপাত। কিন্তু সেবার শুধু বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে লেখা কবিতাটাই ছেপেছে। কাগজটির সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধরা পড়ল আমার কাছে। আমার একটি কবিতা হিন্দু মৌলবাদীরা কৌশলে ব্যবহার করেছে। তাই বুদ্ধদেব বসুর কথা অনুসারে কবিতাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা উচিত ছিল।
জন: হ্যাঁ, কবিতা অস্ত্র না, ঢালও নয়।
আশরাফ: কবিতা কারও বুকে-পিঠে ছুরি মারবে না, কারও পায়ে তেলও মাখবে না। ব্যক্তিকে নিয়ে স্তুতিমূলক কবিতা রচনার বিরুদ্ধে আমরা। কবিতা কারও কাছে মাথা নত করবে না। কবিতা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে কিন্তু কারও পায়ে মাথা নত করে না। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা অনেক কবিতা আছে, সে গুলো ঐ কবিদের শ্রেষ্ঠকবিতার তালিকায় স্থান পায় নি। এর মানে এগুলো নিকৃষ্ট। চিত্তরঞ্জন দাসকে নিয়ে ‘চিত্তনামা’ এবং সত্যেন্দ্রনাকে নিয়ে নজরুল ‘সত্যেন্দ্রপ্রয়াণগীতি’ লিখেছেন, কিন্তু এগুলো তার উৎকৃষ্ট কবিতা নয়।
নাজমুল: হোক কবির ব্যক্তিগত প্রেমিকা অথবা রাজনৈতিক নেতা, কাউকে খুশি করার জন্য কবিতা লেখা পছন্দ করি না। কবিতা উৎসর্গ করাও আমি পছন্দ করি না।শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ নারী পটানোর জন্য অনেক কবিতা লিখেছেন। বায়রন, লরেন্স প্রমুখ লিখেছেন যখন, তখনকার সমাজে যৌনতা নিষিদ্ধ ছিল বলে অতি আকর্ষণীয় ছিল। সমাজ অনেক বদলেছে। এখন আর সে সব কবিতা লিখে সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া মধ্যযুগে নারীর রূপটাই প্রধান ছিল। এখন তাদের ব্যক্তিত্ব, কর্মগুণ স্বীকৃতি পেতে পারে। আমরা অবশ্য এসব নিয়েও স্তাবকমূলক লেখা কবিতাও পছন্দ করি না। আচ্ছা কবিতায় মিথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশি এবং বিদেশি এর মধ্যে কোনটা প্রাধান্য দিতে পারি?
অনু: পরিচিত দেশি মিথ ব্যবহারে ফলে কবিতার অনুষঙ্গটি পাঠকের কাছে পরিচিত বলে মনে হবে বলে কবিতার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বাড়বে। বিদেশি অপরিচিত মিথ ব্যবহারের ফলে পাঠকের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
নাজমুল: দেশীয় সাহিত্যের চরিত্রেরও পুনর্ব্যবহারও করা যায়। রবীন্দ্রনাথ-শরৎ কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য চরিত্র প্রাসিঙ্গকভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়।
জুনায়েদ: দেশি সাহিত্যের উদ্ধৃতি ব্যবহার করাও ভালো।
নাজমুল: কেন তা ভালো?
জুনায়েদ: এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দেশী মিথগুলো বিশ্বসাহিত্যে এ জাতির প্রতিনিধিত্ব করবে। পাশ্চাত্যের মিথ ও ঐতিহ্য আমরা নেব কেন? আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য আছে।
জন: সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা তো ভিখারি না। আমরা কারও কাছে ধার করতে যাব না। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য।
নাজমুল: মার্কেজ যে মিথ ব্যবহার করেছেন তাকে বলা হয় জাদুবাস্তবতা। আসলে তো ওরা (পাশ্চাত্য তাত্ত্বিকরা) বোঝে না। আমাদের মিথগুলো সচেতনভাবে প্রয়োগ করে দেখাতে হবে এগুলো কতটা সমৃদ্ধ। এগুলো নতুন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে।
আশরাফ: হ্যাঁ, ভাষায় থাকতে হবে বহুমাত্রিকতা। দুহাজার বছর আগের পাঠকেরা রামায়ণ যে কারণে পাঠ করেছে, এক হাজার বছর আগের পাঠকেরা সে অর্থে পড়েনি। আজকের পাঠকেরাও তা ভিন্ন অর্থে পড়ে। কাজেই কবিতার ভাষায় থাকবে বহুমাত্রিকতা। বিষয়ে থাকবে বৈচিত্র্য। তবে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, চরম নৈর্ব্যক্তিকতা যেন কবিতাকে গল্প কিংবা প্রবন্ধ বানিয়ে না ফেলে। প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের মতো কবির ভেতরেও একটি আলোচক সত্তা থাকে, একটি কথক সত্তা থাকে। সে কবি যদি আলোচনা-প্রবন্ধ এবং গল্প না লেখেন তাহলে ঐ দু’টি সত্তার চাপে কবিসত্তাই আলোচক ও কথক হয়ে ওঠে। এর ফলে কবিতা হয়ে ওঠে প্রবন্ধ এবং গল্প। আমাদের কিন্তু সচেতনভাবেই গদ্যচর্চা করতে হবে। নজরুলের প্রাবন্ধিক সত্তা দুর্বল ছিল বলে অনেক প্রবন্ধ পদ্যে প্রকাশিত হয়েছে। শামসুর রাহমান ভালো গল্প লিখতে পারতেন, কিন্তু তিনি হুমায়ুন আজাদের মুখে তার গদ্যের কটু সমালোচনা শুনে গদ্য লেখা ছেড়ে দেন। এতে অনেক গল্প তার হাতে কবিতা হয়ে বেরিয়েছে। উভয়ক্ষেত্রেই কবিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জুনায়েদ: এতক্ষণের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি, চলমান গতানুগতিক সাহিত্যধারা থেকে আমাদের রুচি ভিন্ন। রুচিগত মিলকে বিশ্বাসের ঐক্য ধরে আমরা নতুন কিছু করার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
অনু: অন্যদের থেকে ভিন্নতাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। কবিতায় এখন যদি তা স্পষ্ট করে তুলতে পারি, তাই হয়ে দাঁড়াবে আন্দোলনের কাঠামো।
জুনায়েদ: আমাদের ঐক্যের জয় হোক।
জন: কবিতা দুর্বোধ্য হলে সমস্যা কী? যে কবিতা আপনার কাছে দুর্বোধ্য তা আমার কাছে সুবোধ্য। আমরা যখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনি, সবাই তা বোঝেন না। অনেকের কাছে তা দুর্বোধ্য মনে হয়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে যদি সহজবোধ্য করা হয়, তাহলে তা আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থাকবে না। আমাদের অক্ষমতার জন্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে সহজ করার দরকার নেই।
নাজমুল: সঙ্গীত আর কবিতা একই প্যাটার্নের হলেও দুটি ভিন্ন ধারার। কবিতার দুর্বোধ্যতার কারণ আমার মনে হয় ঔপনিবেশিকতার প্রভাব। বিশ্বায়নের প্রভাব। আমাদের নিজেদের ঐতিহ্য থাকতে আমরা তা গ্রহণ করব কেন? আধুনিকতাবাদীদের মতে সৃষ্টি ভালো হলে হাই, না হলে লো কোয়ালিটির। পোস্টমডার্নিজম বলে যা কবিতা হয়ে উঠেছে তাই বিশ্বের। কেউ কেউ হয়তো ইচ্ছা করে দুর্বোধ্য করার চেষ্টা করছে। অপরিচিত বিদেশি মিথ ব্যবহার করছে। আসলে কি তা দরকার?
জন: কবিতার দুর্বোধ্যতা আগেও ছিল, এখনও আছে। আমার মতে কবিতা সুবোধ্য হওয়ারও দরকার নেই। কবিতা দুর্বোধ্য হওয়ার আরেকটি কারণ জীবনের মান ও পরিবর্তন। দৈনন্দিন জটিলতা। এসব আছে বলে কবিতা দুর্বোধ্য থাকবে।
অনু: বর্তমানে যে সব কবিতা দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা হচ্ছে তার কারণ জীবনের প্রভাব। অর্থনীতি, রাজনীতি ও অন্যান্য জটিলতার কারণেই এই দুর্বোধ্যতা।
আশরাফ: কবিতায় দুর্বোধ্যতা সুবোধ্যতা বলে স্থায়ী কিছু নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এবং আন্তঃযোগাযোগটাই আসল। শহরবাসী সন্তানের ভাষার কারণে মায়ের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করলে একজন লেখকের লেখায় যা কিছু উপাদান যোগ হবে অন্যদের লেখায় তা হবে না। প্রযুক্তির অগ্রসরতাকেই দুর্বোধ্য বলা হচ্ছে। জনের কথাটাই সত্য যে, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা বিমূর্ত শিল্পকলাকে দুর্বোধ্য বলে দূরে ঠেলে রাখা যাবে না। যারা এর স্বাদ বুঝবেন তারা গ্রহণ করবেন। যার পেটে দুধ কিংবা মধু সয় না, তিনি পানি মিশিয়ে খাবেন। কিন্তু গাভী ও মৌমাছি তা তরল করে উৎপাদন করবে না।
নাজমুল: ভাষার সহজেবোধ্যতাই আসলে দরকার। এর কারণেই এলিয়েনেশন সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির দূরত্ব বাড়ছে।
আশরাফ: ভাষাগত দূরত্ব যদি চেষ্টাকৃত হয় তাহলে কবিতায় তা খুব সহজেই বোঝা যাবে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণে যে ভাষাগত দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। ধরা যাক গ্রামের একটি ছেলে শহরে গিয়ে নতুন পরিবেশে একটা ধারণা পেল, ‘প্রাইভেসি।’ এটা শহরের অনিবার্য বিষয়। কিন্তু গ্রামের লোক এই শব্দটিরই অর্থ বুঝবে না; বিষয়টি বুঝবে দূরের কথা। ছেলেটি গ্রামে আসার সময় তো শব্দটি শহরে ফেলে রেখে আসতে পারে না।
জন: আসলে আমরা যখন কবিতায় ঢুকি তখন দুর্বোধ্যতার কথা মনে থাকে না। রৌদ্র-গন্ধ-ডানা-চিল প্রভৃতি সহজ শব্দ। কিন্তু জীবনানন্দ যখন এগুলো একত্র করে কবিতায় লেখেন তার ভাষা সহজ, কিন্তু তা অর্থের দিক থেকে জটিল।
আশরাফ: একটা সময় কবিতা ছিল লেখকের দিক থেকে আত্মচিৎকার বা আত্মপ্রকাশ। আমার মনে হয় কবিতা শুধু বিশুদ্ধ মনের পরিশুদ্ধ প্রকাশ। কিন্তু পাঠকের দিক থেকে বিনোদন। কবিতা থেকে অন্য অনেক শাখা বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন আছে শুধু বিশুদ্ধ কবিতা। সুতরাং কবিতার পাঠক এখন কম হবেএটাই স্বাভাবিক। কবিতা পাঠ ঐচ্ছিক বিষয় ও সক্রিয় ক্রিয়া আর ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বিনোদন উপভোগ করা অনৈচ্ছিক ক্রিয়া। শুধু সুইচ অন করলেই চলে। এখন ঐসব দর্শকের কাছে কবিতা জোর করে পৌঁছে দিতে হবেই, এমন কথা নেই।
জুনায়েদ: সাহিত্য আন্দোলন কখন হয় বলে আপনার মনে হয়?
অনু: আসলে আন্দোলন সময়ের দাবি।
নাজমুল: তার মানে দর্শনটা পাঠক বুঝে নেবে সময়ের কাছ থেকে?
জুনায়েদ: আসলে আমাদের আগেই আলোচনা করা উচিত ছিলÑ কবিতা আমরা কেন লিখি, নিজের জন্য নাকি অন্যের জন্য।
নাজমুল: তোমার কি মনে হয় সাহিত্যে আন্দোলনের প্রয়োজন আছে?
জুনায়েদ: আন্দোলন মানে নাড়াচাড় করা। কোনও কিছু নাড়াচাড়া করে ছড়িয়ে দেওয়া।
নাজমুল: তাহলে তো সহজবোধ্যতাই কাম্য।
আশরাফ: নতুনত্ব আনার জন্যই আন্দোলন। বাজারি পণ্য বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেয়। আর সৃজনশীল শিল্পবস্তু শুধু আন্দোলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। ধরা যাক, একটা স্কুলে শিক্ষক শুধু ফার্স্টবেঞ্চের ছাত্রছাত্রীদের সাথেই সবকিছু শেয়ার করতে পারেন। লাস্টবেঞ্চের স্টুডেন্টরা অমনোযোগীÑ চোর-ডাকাত-পুলিশ খেলে। একই তারিখের একই ক্লাসে সামনের বেঞ্চের ছাত্রছাত্রীরা যা শিখছে, পেছনের বেঞ্চের ছাত্রছাত্রীরা তা পারছে না বা করছে না। তাহলে সময়কে সবাই সমানভাবে ধরতে পারে না। সময়কে ধরার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন। আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন বিষয়টা সবাই দ্রুত জানতে পারে।
জন: যোগ্য বিষয়গুলো একটা সময় ঠিকই অবস্থান করে নেয়। জীবনানন্দের অনেক কবিতা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছে। আন্দোলন হল কয়েকজন লেখকের একটা বিশ্বাসে পৌঁছা। যদি তারা একমত হতে পারেন, তখন সবাই একসাথে কাজ করলে তা দূরের সময়ের অপেক্ষায় না থেকে সমকালেই ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
আশরাফ: অনু বলেছে আন্দোলন সময়ের দাবি, কথাটা সত্য; তবে সময় তো আপেক্ষিক। সাহিত্যের সময়ের দাবি আর সাহিত্যিকের সময়ের দাবি এক নয়। জন বলেছে একটা প্রাথমিক বিশ্বাসে পৌঁছার কথা। হ্যাঁ, এভাবেই হয়। বিশ্বাসের সাথে সাথে মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হয়। কাজে তার লক্ষণ ফুটতে থাকে। প্রস্তুতি না থাকলে, লক্ষণ দেখা না দিলে এমনকী বিশ্বাসে না পৌঁছালে আন্দোলনে নাম লেখানো যায় মাত্র; মহাকালে টিকে থাকা যায় না। ‘কল্লোল যুগে’এমন অনেক রথী-মহারথী ছিলেন যারা পরে কালের ধূলায় মিশে গেছেন। আবার অনেকে সরাসরি আন্দোলনের কর্মী ছিলেন না, বিশ্বাসের ঐক্য নিয়ে নিবিড় সাধনা করে গেছেন তারা কালোত্তীর্ণও হয়েছেন। অনুরূফ ঘটতে দেখা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ এবং ‘ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্য আন্দোলনে’ও।
জুনায়েদ: আমার মনে হয় আন্দোলন শুধু তরুণরাই করে। যাদের পরিচিতি গড়ে ওঠে নি। প্রতিষ্ঠিতদের এতে অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই।
নাজমুল: প্রতিষ্ঠিতরা তরুণদের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলে স্বকীয়তা হারায়। এতে লাভ হয় তরুণদের। তাদের আদর্শের জয় হয়।
আশরাফ: আমার মনে হয়, যদি কবিতার বর্তমান ধারায় আস্থাশীল না হই, তাহলে আমরাও একটা আন্দোলন শুরু করতে পারি।
জুনায়েদ: একটা সময় সময় কবিতায় আত্মকেন্দ্রিকতা ছিল না, বর্তমানে প্রবল। আমার মনে হয় আমাদের উচিত এখান থেকে বেরিয়ে আসা।
নাজমুল: এলিয়টের কথাটাই গুরুত্ব দিতে পারিÑ নৈর্ব্যক্তিকতা। আত্মবিলোপন ঘটাতে হবে কবিতায়। তিনি বলেছেন আমরা কাচের জানালার দিয়ে দৃশ্যবস্তু দেখি; কাচ দেখি না। কবিতার ভেতর দিয়ে চিত্রকল্প ও দৃশ্যকল্প দেখব, কবিতাকে দেখব না।
জুনায়েদ: আমার মনে হয় কবিতায় ‘আমি-তুমি’ শব্দদুটি যথাসম্ভব কম ব্যবহার করলেই ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যায়।
আশরাফ: আসলে ‘আমি-তুমি’ শব্দ দুটি থাকলেই যে ক্ষতি হবে এমন কোনও কথা না। ধরা যাক সুধীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন, আমার মনের আদিম আঁধারে/ বাস করে প্রেত কাতারে কাতারে। এখানে ‘আমি’ শব্দটিতে পাঠকেরও অংশগ্রহণ আছে। অনেক সময়‘আমি-তুমি’ বাদ দিলেও আমিত্বের বোধ থেকে যায়। আমরা যদি কবিতায় আত্মবিলোপ ঘটাতে চাই তাহলের আমিত্বের বোধটাই বাদ দিতে হবে।
জন: ‘আমি-তুমি’ শব্দ না থাকলেও আমার মতে, আমিত্ববোধ থাকা উচিত। কারণ কবি প্রধানত ব্যক্তিমানুষ। বোধ ও উপলব্ধি তার নিজের।
জুনায়েদ: কবির উপলব্ধিকে পাঠক কেন নিজের বলে ভাববে না? তার নিজের বিষয়ে পাঠকের শেয়ার না থাকলে লেখক-পাঠকের সেতুবন্ধন হবে না।
আশরাফ: কবির আহরণ ব্যক্তিগত; বিতরণ নৈর্ব্যক্তিক। কবি তার ব্যক্তিগত অনুভূতি ও উপলব্ধি প্রকাশ করবেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে। সেটা যাতে সবার হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’তে কবি উপস্থিত আছেন; কিন্তু নিজেকে তিনি বিলুপ্ত করে ফেলেছেন বলে আমরা বিশাল ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ক্ষুদ্র কৃষ্ণকলিকেই প্রবলভাবে দেখতে পাই। আবার নজরুলের ‘অভিশাপ’ ও জীবনানন্দের ‘সুরঞ্জনা’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা হলেও তা পাঠকের হয়ে উঠেছে। যদিও জীবনানন্দ প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় প্রথম পংক্তিতেই লিখেছেন ‘আমি সেই কবি’ পরে আমিত্বের প্রভাব তিনি কমিয়ে এনেছেন। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ ব্যক্তিগত অনেক ঘটনার কাব্যরূফ দিয়েছেন যার বেশির ভাগই বাজে কবিতা। এটা ঘটেছে কবিখ্যাতির চূড়ায় ওঠার পরে। সেই পরিচ কে ভিত্তিভূমি ধরে যা কিছু লেখা হয়েছে তার মান সর্বদা সুরক্ষিত হয় নি। শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা বিষয়ক কবিতাগুলোর গ্রহণযোগ্যতাই প্রমাণ করে বিপরীত ধারার কবিতাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিতান্তই কম। তুমি কবির ব্যক্তিগত পাঁচালী শুনে পাঠকের কী লাভ যদি তাতে পাঠকের অনুভূতির অংশগ্রহণ না থাকে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান কেন পাঠক-শ্রোতার হয়ে ওঠে?
অনু: আসলে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে সব বিষয় একঘেয়েরূপে চলে এসেছে, তা এখন বাদ দেওয়ার সময় হয়েছে।
নাজমুল: এলিয়ট কিন্তু আলফ্রেড প্রুফুুক নৈর্ব্যক্তিকতায় লিখেছেন। ‘ওয়েস্টল্যান্ডে’ খবঃ ঁং বলে পাঠকদের টেনেছেন, এটা কিন্তু ব্যক্তিগত নয়। তাহলে দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়টিকে কীভাবে প্রকাশ করা যায়?
অনু: মুহূর্তকে জয় করতে না পারলে কালকে ধারণ করা যায় না। চোখে দেখা বস্তুকে রূপক ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করতে হবে।
নাজমুল: পুরনো কবিদের যেমনÑ শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ কিংবা মহাদেব সাহাদের কাব্যাদর্শ কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া যাবে?
জন: নতুন কাউকে জায়গা করে নেওয়ার জন্য পুরনোকে অস্বীকার করতেই হবে। আমাদের উচিত তাদের যেখানে শেষ, আমাদের সেখান থেকেই শুরু করা। আমাদের নিজস্ব ভাষা খুঁজে নিতে হবে। যেমন, কবিতায় এখন আর বিরামচিহ্নের প্রয়োজন নেই। আমার একটি কবিতা যদি দশজন পাঠক পড়েন, তা হবে দশটি কবিতা। কিন্তু বিরামচিহ্ন বসিয়ে যদি বাইন্ডিংসে ফেলা হয় তা বহুমাত্রিকতা হারিয়ে ফেলবে। দশজন পাঠক কিন্তু তখন একটি কবিতাই পড়বে।
জুনায়েদ: বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর বিরামচিহ্নের প্রবর্তন করেছেন গদ্যের জন্য।
আশরাফ: আসলেই তাই। বিরামচিহ্ন মূলত গদ্যসাহিত্যের জন্য।
নাজমুল: কবিতায় যৌনগন্ধ, রাজনীতিগন্ধ, আদর্শগন্ধ, দর্শনশাস্ত্রীয় কিংবা বিজ্ঞানগন্ধ এসব দরকার আছে কি না?
জুনায়েদ: এসব গন্ধ ও দুর্গন্ধের কারণে বর্তমান কবিতার শিল্পমূল্য আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এসব বিষয়কে এড়িয়ে নতুন কিছু করতে পারলে স্বাগত জানাব।
আশরাফ: হাজার বছরের বাংলা কবিতা দিনে দিনে দায়মুক্ত হয়েছে। এখন আবার কেন কবিতা কেন আদর্শের বোঝা বইতে যাবে? কবিতা হবে ¯্রফে কবিতা।
জন: আমি মনে করি, এগুলো কবিতার জন্য একেকটি দেয়াল বা বাধা।
আশরাফ: বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসু সর্বপ্রথম কবিতাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তখন প্রবল বামপন্থীরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন। কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বুদ্ধদেব বসু ঠিক কাজটিই করেছেন। বামপন্থীরা যদি কবিতাকে রাজনীতি বা আদর্শ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে অন্যান্য পন্থীরাও তাই করবে। আজ আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? মৌলবাদীরাও ঠিক তাই করছে। দুহাজার এক সালে বাংলাদেশেরর সংখ্যালঘু নির্যাতন আর গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে লেখা দুটি কবিতা পশ্চিমবাংলার এক কাগজে পাঠিয়েছিলাম। তারা আমার কবিতা নিয়মিত ছাপাত। কিন্তু সেবার শুধু বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে লেখা কবিতাটাই ছেপেছে। কাগজটির সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধরা পড়ল আমার কাছে। আমার একটি কবিতা হিন্দু মৌলবাদীরা কৌশলে ব্যবহার করেছে। তাই বুদ্ধদেব বসুর কথা অনুসারে কবিতাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা উচিত ছিল।
জন: হ্যাঁ, কবিতা অস্ত্র না, ঢালও নয়।
আশরাফ: কবিতা কারও বুকে-পিঠে ছুরি মারবে না, কারও পায়ে তেলও মাখবে না। ব্যক্তিকে নিয়ে স্তুতিমূলক কবিতা রচনার বিরুদ্ধে আমরা। কবিতা কারও কাছে মাথা নত করবে না। কবিতা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে কিন্তু কারও পায়ে মাথা নত করে না। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা অনেক কবিতা আছে, সে গুলো ঐ কবিদের শ্রেষ্ঠকবিতার তালিকায় স্থান পায় নি। এর মানে এগুলো নিকৃষ্ট। চিত্তরঞ্জন দাসকে নিয়ে ‘চিত্তনামা’ এবং সত্যেন্দ্রনাকে নিয়ে নজরুল ‘সত্যেন্দ্রপ্রয়াণগীতি’ লিখেছেন, কিন্তু এগুলো তার উৎকৃষ্ট কবিতা নয়।
নাজমুল: হোক কবির ব্যক্তিগত প্রেমিকা অথবা রাজনৈতিক নেতা, কাউকে খুশি করার জন্য কবিতা লেখা পছন্দ করি না। কবিতা উৎসর্গ করাও আমি পছন্দ করি না।শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ নারী পটানোর জন্য অনেক কবিতা লিখেছেন। বায়রন, লরেন্স প্রমুখ লিখেছেন যখন, তখনকার সমাজে যৌনতা নিষিদ্ধ ছিল বলে অতি আকর্ষণীয় ছিল। সমাজ অনেক বদলেছে। এখন আর সে সব কবিতা লিখে সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া মধ্যযুগে নারীর রূপটাই প্রধান ছিল। এখন তাদের ব্যক্তিত্ব, কর্মগুণ স্বীকৃতি পেতে পারে। আমরা অবশ্য এসব নিয়েও স্তাবকমূলক লেখা কবিতাও পছন্দ করি না। আচ্ছা কবিতায় মিথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশি এবং বিদেশি এর মধ্যে কোনটা প্রাধান্য দিতে পারি?
অনু: পরিচিত দেশি মিথ ব্যবহারে ফলে কবিতার অনুষঙ্গটি পাঠকের কাছে পরিচিত বলে মনে হবে বলে কবিতার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বাড়বে। বিদেশি অপরিচিত মিথ ব্যবহারের ফলে পাঠকের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
নাজমুল: দেশীয় সাহিত্যের চরিত্রেরও পুনর্ব্যবহারও করা যায়। রবীন্দ্রনাথ-শরৎ কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য চরিত্র প্রাসিঙ্গকভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়।
জুনায়েদ: দেশি সাহিত্যের উদ্ধৃতি ব্যবহার করাও ভালো।
নাজমুল: কেন তা ভালো?
জুনায়েদ: এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দেশী মিথগুলো বিশ্বসাহিত্যে এ জাতির প্রতিনিধিত্ব করবে। পাশ্চাত্যের মিথ ও ঐতিহ্য আমরা নেব কেন? আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য আছে।
জন: সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা তো ভিখারি না। আমরা কারও কাছে ধার করতে যাব না। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য।
নাজমুল: মার্কেজ যে মিথ ব্যবহার করেছেন তাকে বলা হয় জাদুবাস্তবতা। আসলে তো ওরা (পাশ্চাত্য তাত্ত্বিকরা) বোঝে না। আমাদের মিথগুলো সচেতনভাবে প্রয়োগ করে দেখাতে হবে এগুলো কতটা সমৃদ্ধ। এগুলো নতুন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে।
আশরাফ: হ্যাঁ, ভাষায় থাকতে হবে বহুমাত্রিকতা। দুহাজার বছর আগের পাঠকেরা রামায়ণ যে কারণে পাঠ করেছে, এক হাজার বছর আগের পাঠকেরা সে অর্থে পড়েনি। আজকের পাঠকেরাও তা ভিন্ন অর্থে পড়ে। কাজেই কবিতার ভাষায় থাকবে বহুমাত্রিকতা। বিষয়ে থাকবে বৈচিত্র্য। তবে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, চরম নৈর্ব্যক্তিকতা যেন কবিতাকে গল্প কিংবা প্রবন্ধ বানিয়ে না ফেলে। প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের মতো কবির ভেতরেও একটি আলোচক সত্তা থাকে, একটি কথক সত্তা থাকে। সে কবি যদি আলোচনা-প্রবন্ধ এবং গল্প না লেখেন তাহলে ঐ দু’টি সত্তার চাপে কবিসত্তাই আলোচক ও কথক হয়ে ওঠে। এর ফলে কবিতা হয়ে ওঠে প্রবন্ধ এবং গল্প। আমাদের কিন্তু সচেতনভাবেই গদ্যচর্চা করতে হবে। নজরুলের প্রাবন্ধিক সত্তা দুর্বল ছিল বলে অনেক প্রবন্ধ পদ্যে প্রকাশিত হয়েছে। শামসুর রাহমান ভালো গল্প লিখতে পারতেন, কিন্তু তিনি হুমায়ুন আজাদের মুখে তার গদ্যের কটু সমালোচনা শুনে গদ্য লেখা ছেড়ে দেন। এতে অনেক গল্প তার হাতে কবিতা হয়ে বেরিয়েছে। উভয়ক্ষেত্রেই কবিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জুনায়েদ: এতক্ষণের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি, চলমান গতানুগতিক সাহিত্যধারা থেকে আমাদের রুচি ভিন্ন। রুচিগত মিলকে বিশ্বাসের ঐক্য ধরে আমরা নতুন কিছু করার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
অনু: অন্যদের থেকে ভিন্নতাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। কবিতায় এখন যদি তা স্পষ্ট করে তুলতে পারি, তাই হয়ে দাঁড়াবে আন্দোলনের কাঠামো।
জুনায়েদ: আমাদের ঐক্যের জয় হোক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন