রবিবার, ১ জুন, ২০১৪

ত্রিশাখ জলদাসের একগুচ্ছ কবিতা







Photo


[ত্রিশাখ জলদাস__কবি; আপাদমস্তক। তাঁর কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে তীব্র আবেগের ফোয়ারা, পড়তে পড়তে মনে হয়__তাঁর মস্তিষ্কেও হৃদয়ের ছাপ। কোথাও কোনো হিসাবী মানুষের স্বাক্ষর নেই। আছে কেবল প্রেম আর প্রেম। এখানে প্রকাশিত কবিতাগুলোয় তারই প্রমাণ পাবেন পাঠক।]

 

 সংবৃত শ্লোক

পাতা পতনের শব্দে
উড়ে যাচ্ছে
সবুজ ঘাসফড়িঙ,

মৃত
পাখিদের নিয়ে
বসে আছে রাত্রি।

আমি খাম খুলে রঙগুলো
উড়িয়ে দিলাম


রাত্রিকে একাকী
নগ্ন রেখে
চাঁদ চলে গেলে
মৃত নদী হেসে উঠে

আমি ছায়া বিক্রি করি
জোনাকিদের আলোয়...


নিবিড় আমাকে ডাকে কীর্তিনাশা।
একটি শীর্ণ নদী
ডোবা কিম্বা জলে!
তার অন্ধকারে বালির আড়ালে।

একটি যুগল চোখ,
নুয়ে আছে নির্ণীত জমিনে...
        শিকারি চতুর।

মানুষের লাশগুলো গুনে গুনে রাখা,
এর বাইরেও কিছু আছে - নিপুণ সার্কাসে।



বিমূর্ত স্বর

জেলের নৌকায় বসে তুমি উড়ন্ত মাছের খেলা দেখ,
আর কাঁকর বিছানো পথে একটি বেড়াল দৌড়ে যাচ্ছে—

এই দৃশ্য দু টি আমি পাশাপাশি
এঁকে যাচ্ছি ক্যানভাসে
বারবার বদলে যায় আদল

প্রতিটি প্রাণের ভেতরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে বিনাশ।


অনন্তের নিসর্গ কন্যারা শুয়ে আছে নক্ষত্রের বনে
আর একটি অন্ধকার দীর্ঘায়িত হচ্ছে
সমর্পিত ছায়ার ভেতর।

এসবই নির্ণীত খোলসাবৃত
এবং দৃশ্যমান
ক্রমাগত ক্রিয়াশীল প্রাণে ও উদ্ভিদে...

দ্বিধান্বিত মানুষেরা ভীতু ও সাহসী,
বৃক্ষের শেকড়ে জমা থাকে জলজ আখ্যান।


শাদা মৃত্যুর ভেতর একাকী নিঃসঙ্গতা, অনিশ্চিত রাত্রি—
কী নিপুণ ছায়া বিকশিত হচ্ছে এক খণ্ড ঘুমে;
আর আস্ত একটি আকাশ শুয়ে আছে সমর্পিত ফ্রাই-পেন

শাদা মৃত্যুর ভেতর সমর্পণ,
উড়ন্ত পাখপাখালি।
চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো প্রসন্নতা;
হাওয়ার ভেতর ঘুরছে জলকল,
খণ্ড খণ্ড নদী ভারী হয় স্নান ঘরে।

শাদা মৃত্যুর ভেতর শঙ্খচূড়, বিষাক্ত ময়াল—
ক্রমাগত দৃশ্যমান ছায়া-অন্ধ মানুষের জিভ।



এপিটাফ

নিমগ্ন প্রাচীন বৃক্ষ—জলে তার ছায়া
কাঁপে, আর বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার আঁধারে
ডুবে চাঁদ কিম্বা কুসুমের গাঢ় ঘুমে—
স্পর্শে জ্বলে ওঠে। এই বুঝি অকস্মাত্
নেমে আসে রাত, এই বুঝি জলস্রোত
ছুঁয়ে দেয় রতি-বিদ্ধ মাছের শরীর।


নিমগ্ন প্রাচীন বৃক্ষ—তীব্র তীক্ষ্ন হিমে
শুয়ে আছে নিরুত্তর জলের মৃন্ময়,
আর তার দেহে, খাঁজে কিম্বা উত্কীর্ণ
শস্যের দানায় গ্রন্থিত রয়েছে স্থির;
এই পৃথিবীর আদিমতম কথন।
 

শব্দ

শব্দ কি কেবল অলুপ্ত স্বর, সারিবদ্ধ অক্ষর
শ্বাসমূলে জমে থাকা বিষণ্ন রোদ্দুর
শব্দ কি ভেঙে যাওয়া ঢেউ, টুকরো টুকরো ছল
নগ্ন পায়ে হেঁটে যাওয়া এক নিরুত্তাপ দুপুর -

শব্দ কি পাতা ঝরার গান, মৃত শালিকের ডানা
ফাতনার বনে ঝোপে শুয়ে থাকা নিদ্রালুপ্ত ফাঁদ?


আমার ভেতর অপূর্ণ শব্দরা অবিরাম হাঁটে,
অহর্নিশ ছুঁয়ে দেয় ঈশ্বরের নির্ণীত আকাশ -
অন্ধকারে ফুটে থাকে অলক্ত বাহারি ফুলে।

আমার ভেতর অপূর্ণ শব্দরা দৃশ্যত নির্জনে
কিম্বা ছায়া অন্ধ তীব্র হিমে,
শুয়ে থাকে সংহিতার ঘুমন্ত শহরে।


টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাওয়ার পর
রক্তবীজের মত গড়িয়ে পড়েছি
ধুলোয়,
বদলে যাচ্ছি শব্দে, সুরে ও বীজে ...
ঔষধি লতার মতো নুয়ে আছি ফুলে।

কয়েকটি শাদা মৌমাছি অনতিদূরে
মধু সংগ্রহে ক্রিয়াশীল থেকেও
মৃত চাঁদের গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে অবসাদে।
 

 অপূর্ণতা

ঘরসুদ্ধ দুলছি হাওয়ায়,
আমাকে নামিয়ে এনেছে ধুলো,
তুলে রেখেছে প্রত্নভান্ডরে।

ঘরসুদ্ধ ভাসছি জলে,
আমাকে তুলে এনেছে পাখি,
নিবিড় করেছে পালকে।

ধুলো আর পাখিদের ছেড়ে,
ঘর আর বৃক্ষদের ছেড়ে,
দুলছি সুনীলের ছায়ার ভেতর।

ছায়া থেকে ফিরে এসে দেখি
অপূর্ণতা নামছে অন্ধকারে,
জলের মৌতাতে দুলছে পৃথিবী।



দেহাতী কবিতা

পাতার আড়ালে শুয়ে আছে দেহাতী সময়,
তার পাশে ফুটে আছে ঘাস ফুল,
তার পাশে পাথুরে জীবন।

একটি ভগ্ন চাঁদ
কিম্বা
ক্ষয়ে যাওয়া কয়েক টুকরো রোদ
পড়ে আছে পথের ওপাশে।

দেহাতী মেয়েরা হারিয়ে ফেলেছে পথ...
আমরা যাব না আর নদীর ওপারে।

পাতার আড়ালে কাঁপে, তাপ
জ্যোৎস্না ও জোনাকি।

পাতার আড়ালে
ক্রমাগত ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে অন্ধকার।

অয়োমুখ


এই শূন্যতা কি নুয়ে আসে
নিশীথের ডানার আড়ালে !
জল ও মাটির গন্ধে
দ্বিখণ্ডিত জোনাকিরাও কি পড়ে থাকে
পাশাপাশি নিরুত্তাপ !

যাকে তুমি পুষ্প ভেবে  বসেছিলে পাশে,
তার জিভ থেকে ক্রমাগত
উঠে আসে বিষ – অগ্নিদাহ -
গলিত বিষাদ।


এই জন্ম আজ  ভুলে ভরা- অচঞ্চল
এই জন্ম কুয়াশা ছড়ানো –দুর্বিনীত

শিলাস্তর চুয়ে নেমে যাচ্ছে  কৃষ্ণ-দগ্ধ  জল।

অগ্নিদাহ

বিষাদ তোমাকে ছুঁয়ে আছে
         অনন্তের বালিকারা-
দলবদ্ধ হাঁসগুলো চলে গেছে দক্ষিণের দিকে

তারা আনন্দ লুকিয়ে রেখেছিল
পালকের ওমে ।

চাঁদের কন্যারা কিম্বা
তার বেদনারা নিমগ্ন বৃক্ষের ছায়া-
ফেলে দেয়া কিছু স্মৃতি
এমন দাঁড়িয়ে রয়েছে শিয়রে
           -অনুতপ্ত বিষফল।

জন্মান্ধ মানুষের কাছে
       আলো আর অন্ধকার
       বেদনার দুই বোন-
ছুঁয়ে থাকা পৃথিবীর বিষণ্ণ শরীর।

মোমঘর

আমার ভেতর একটি অন্তর্মুখী নদী গান করে।
ছায়া শূন্য একটি নদী
প্রবাহিত হচ্ছে মুখোমুখি স্রোতে;
কয়েকটি নরমমুখী ফুল
ধারালো স্রোতের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে—
আমার ভেতর প্রজাপতি উড়ে…

____মৃত প্রজাপতি ভেবে ফু দিচ্ছে হাওয়াকল
____এক গুচ্ছ ফুলের ভেতর নুয়ে আছে অনুতাপ

আমার ভেতর একটি অন্ধ পাখি গান করে।
পাখির শরীর থেকে ক্রমাগত
খসে যাচ্ছে সোনালী পালক;
কয়েকটি ঘুণ পোকা
পালকের শরীর বেয়ে হেটে যাচ্ছে—
আমার ভেতর মৌমাছিরা উড়ে…

____মধু মৌমাছিরা উড়ে যাচ্ছে ছড়ানো সৌরভের দিকে
____মাটির বিপরীতে হেটে যাচ্ছে তাদের ছায়া

আমার ভেতর একটি নিষণ্ণ আকাশ গান করে
প্রায় অন্ধ একখণ্ড আকাশ
ক্রমাগত নুয়ে যাচ্ছে মায়াবী বিষণ্ণতায়;
কয়েকটি দুর্গা-টুনটুনি
মহুয়া বনের বিপরীতে হেঁটে যাচ্ছে—
আমার ভেতর মেঘ বালিকার উড়ে…

____ছায়াঘুমে ফিরে যাচ্ছে অনুরুদ্ধ মেঘদূত
____দুটি অগ্নিমুখী সাপ পাশাপাশি মোমঘরে


 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন