সোমবার, ২ জুন, ২০১৪

প্রকৃতি ও পুরাণের গল্প ।। প্রণব আচার্য্য

পুকুরে ডুব দিয়ে জলের উপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনেছেন কখনো? শুনে দেখবেন কেমন অদ্ভুত এক হারমোনি তৈরি হয় জলে, বৃষ্টিতে। যখন ছোট ছিলাম, পাঁচ-সাত বছরের বালক, আমরা গ্রামের বালক-বালিকারা মিলে বৃষ্টির দিনে দল বেধে পুকুরে নেমে পড়তাম। অবশ্য তার আগে ইচ্ছে মতো কাদায় মাখামাখি খেলা। বর্ষা শুরুর প্রধান আকর্ষণ ছিল কে প্রথম আছাড় খাবে। প্রথম বৃষ্টিতে আমাদের উঠোন দারুণ পিচ্ছিল হয়ে থাকতো। ফলে আমার সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম কে হবে বছরের প্রথম। যে-ই প্রথম আছাড় খাক, তারপরই শুরু হয়ে যেতো আমাদের আছাড় খাওয়ার মহোৎসব, কাদায় মাখামাখি, আর অবধারিত ভাবেই সংশ্লিষ্ট কারণে মায়ের হাতের মার খাওয়া- শৈশবে এটাই ছিল আমাদের বর্ষা উৎসব। 

আমাদের পুকুরের উপর নোয়ানো ছিল একটি হিজল গাছ। গাছটি এখনো আছে। অনেকটা খয়েরি ধরনের রেনুময় ফুলগুলি ভাসতো পুকুরে। সেই পুকুরে চলতো দুরন্ত দাপাদাপি। আমাদের মধ্যে যারা একটু সিনিয়র, তারা অবশ্য সাতার কাটতো পার্শ্ববর্তী খালে। খালটিতে তখন বেশ স্রোত ছিল। এটাই ছিল সিনিয়রটির প্রকাশ। সাতার শেখার স্মৃতি আমার মনে নেই। এতটুকু মনে আছে যেদিন আমি ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হই, সেদিন স্কুল থেকে ফিরে খালেই সাতার কেটেছিলাম। অর্থাৎ সেদিন আমি বড়দের দলের গর্বিত সদস্যপদ লাভ করি। পুকুরের চেয়ে খালের জল অনেকটাই ঠাণ্ডা আর স্রোতের চ্যালেঞ্জ তো ছিলই। 

এক সময় এ খালে প্রচুর নৌকা চলতো। আমাদের বাড়ির সামনেই রাজগঞ্জ বাজার। এটিই ছিল পুরো ইউনিয়নের মধ্যে বড় বাজার। ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে নৌকা-ভর্তি মালামাল আসতো, আর থামতো বাড়ির সামনে। এ ছাড়া যাত্রীবাহী নৌকা তো ছিলই। স্রোতের বিপরীতে নৌকার গুণটানা দেখে আমরাও ছোট নৌকায় দড়ি বেঁধে গুণ টানতাম। অবশ্য স্রোতের বিপরীতে গুণটানার শক্তি ছিল না। সেই খালে এক ধরনের গুল্ম জন্মাতো। ওগুলোকে বলতাম ভাট। খেতে অনেকটা শাপলা ফুলের গর্ভাশয়ের মতো, ছোট ছোট দানাদার। 

বর্ষায় সেই খালে চলতো মাছ ধরার উৎসব। কত মাছ যে স্রোতে ভেসে আসতো। কেউ বড়শিতে, কেউ জাল ফেলে; আর আমরা ছোটরা রবি ঠাকুরের 'ছোট নদীর' মতো গামছা দিয়ে ধরতাম। মাছের চেয়ে অবশ্য সাপই বেশি ধরা পড়তো আমাদের গামছায়। কী আশ্চর্য তখন সাপকে মোটেও ভয় পেতাম না! সেই স্রোতস্বিনী খাল, হা! ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ যখন আগুন লাগানো হলো খাল পাড়ের মালী বাড়িতে তখন আগুন নেভানোর জন্য এক ফোটা জলও পাওয়া যায়নি সেই খালটিতে। আমরা এভাবেই ধ্বংস করছি প্রকৃতিকে, এভাবেই বাধাগ্রস্ত করে তুলছি নিজেদের সুরক্ষাকে।


শৈশবে একই সাথে বাস করেছি প্রকৃতি ও পুরাণের মধ্যে। তখনো আমাদের গ্রামে পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি গাড়েনি। ফলে রাত হলেই ঝুম অন্ধকার নেমে আসতো। হারিকেন আর কেরোসিনের বাতি সত্যি তৈরি করতো একটি পৌরাণিক আবহ। সেই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে, বিশেষত অমাবশ্যার রাতে, জংলার উপর জোনাক পোকার ঝিলিমিল যেন আলোর ফুলের নাচান। জোনাক ধরতে খুব ইচ্ছে হতো। কিন্তু জোনাক ধরলে নাকি বিছানা ভেজানোর রোগ হয়, সেই ভয়ে আর সাহস হতো না। 

আমাদের বাড়িতে সকলেরই পৈতৃক ব্যবসা ছিল খনকারি, মানে তাবিজ-কবচ, জীন-ভুত তাড়ানোর ব্যবসা। শুধু আমার দাদুর পঞ্চপুত্র দুই কলম পড়াশোনা শেখায় এ ব্যবসায় নামতে হয়নি। রাতে ঠাকুরমার কাছে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শুনে বিস্ময়ের সীমা থাকতো না; আর সেই সাথে যুক্ত হতো খোনকারদের জীন-ভুত তাড়ানোর গল্প। খোনকারি ব্যবসা করতে হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জীন ভুতের নানা গল্প চালু রাখতে হয়। সেইসব গল্প শুনে আমাদের মনোজগত আরো পৌরাণিক হয়ে যেতো। 

তখন আমাদের আকাশ ভর্তি থাকতো নানা দেবতারা। যারা অসুরদের সাথে যুদ্ধ করতেন, মানুষদের অভিশাপ দিতেন। পার্বতী বাপের বাড়ি আসতে চাইতো। আর শিব আসতে দিত না। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। সেই ঝগড়ার শব্দ হচ্ছে মেঘের গর্জন। তবে সেই শব্দ শুধু শিবের। পার্বতীর নয়। পরবর্তী শুধু নীরবে কাঁদতো। সাপকে ভয় না পাওয়ার কারণ অবশ্য তখন একটা মন্ত্র জানতাম। সেই মন্ত্র পড়লে সাপ আর কামড়ায় না বলে আমাদের বিশ্বাস ছিল। মন্ত্রটি হচ্ছে- ‘ওম আস্তিকস্য মুণি মাতা’। এই মন্ত্র তিনবার পড়লে সাপ আর কামড়ায় না। এটা সাপেদের দেবী মনসার মন্ত্র। ছোট্ট নির্দোষ এই মন্ত্রটি আপনারও শিখে রাখতে পারেন। কে জানে, হয়তো কোন একদিন কাজে লেগে যেতেও পারে! 

শৈশবে আমাদের আরেকটি আবশ্যিক কাজ ছিল গাছে চড়া। সেদিন গ্রামে গিয়েছিলাম। দেখি এখনো গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা গাছে চড়ে বেড়াচ্ছে। আম গাছ, সুপোরি গাছ, গাব গাছ কত গাছেই না চড়েছি তখন। যতক্ষণ ডাঙ্গায় থাকতাম ততক্ষণ আসলে গাছেই চড়ে বসে থাকতাম। হরিতকি, পেয়ালা, জাম, জামরুল পেড়ে খেতাম। তখন প্রচুর ফলজ গাছ ছিল গ্রামে। অবাধে এইসব ফল পেড়ে খাওয়া যেতো। গৃহস্থের নিষেধ ছিল না। আমাদের বাড়ির উত্তরে একটা কবর ছিল। এটিকে ফুলির কবর বলতো। এক সময় বাঁধানো ছিল- অযত্নে ভেঙ্গে গেছে। ফুলি কে, তার ইতিহাস কী- জানতাম না। শুধু জানতাম রাত হলে এ কবরে 'ভুতের লুয়া' দেখা যেতো। কবরে যে ফসফরাসের আলো জ্বলে তাকে 'ভুতের লুয়া' বলতো। বাড়ির পেছনেও ছিল একটা শশ্মাণ; তারপাশে ছিল কাশ বন। কাশ ফুলগুলোকে তখন বলতাম ভুতের ফুল। কারণ আমাদের বিশ্বাস ছিল এই বনে ভুত থাকে।

 কাউ নামে এক ধরনের ফল আছে। এই ফলের খোসা দিয়ে আমরা বাতি বানাতাম। গোল কাউফলকে এমন ভাবে কাটতাম ভেতরের ফলটুকু বের করে নিলে অনায়াসে একটি বাতি তৈরী হয়ে যেতো। খোসার উপরের অংশ ছিদ্র করে সেখানে একটি কাপড়ের সলতে ঢুকিয়ে দিতাম। কেরসিন খুব দ্রুত জ্বলে বলে বাতির ভেতরে সরষের তেল দিতাম। সরষের তেলে আগুন খুব ধীরে ধীরে জ্বলতো বলে দীর্ঘক্ষণ বাতিটি জ্বলে থাকতো। এভাবে ২০/২৫টি কাউফলের বাতি বানিয়ে সন্ধ্যায় পুকুরে ভাসিয়ে দিতাম। জলের উপর বাতিগুলো দুলে দুলে জ্বলতো। অন্ধকারে মনে হতো পুকুরে তারা ভাসছে। সেই দৃশ্য অনেকদিন দেখা হয় না; যেমন দেখা হয় না জোনাক পোকার উজ্জ্বল আনন্দ আর। আমরা অগোচরে হারিয়ে ফেলেছি আলোর দিন, সুবর্ণ শৈশব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন