শনিবার, ১৪ জুন, ২০১৪

মিজানুর রহমান রানার গুচ্ছ কবিতা

 


সবাই চলে যাবে


সবাই চলে যাবে, যাবে সবাই চলে
এক এক করে ভাগীরথী নদীর পানিও যাবে শুকিয়ে
আর অন্য দশটা দিনের মতো বেলা শেষে সন্ধ্যা হবে
পাখি ডাকবে, আকাশ বিদীর্ণ করে বজ্রপাত হবে

আমি আর থাকবো না এই শহরে, এই কোলাহল আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেবে
আমি কোলাহল আর মানুষের চিৎকার সহ্য করতে পারি না
আমার কান্না আসে, দম বন্ধ হয়ে যায় ঘুঘুর ডাকে

যে শালিখ মরে যায়, মরে যায় বিস্তীর্ণ েেতর সব ফসল
যে পতঙ্গের ডানা ভেঙ্গে যায়, সুউচ্চ থেকে ডাকের তার সারথী
আমি এসব আর দেখতে চাই না অন্ধকারে পেঁচার মতো বসে বসে
আমি আমার অন্তিম শয়নে পাশে চাই না কাউকে
শুধু নিজকে নিজে প্রশ্ন করবো, কেনো জন্মেছিলে তুমি এই মৃত শকুনের দেশে?

যখন মেঘনার জল শুকিয়ে যাবে, যখন ডাকাতিয়ার বুকে চর জাগবে
তখন আমি মনে মনে হাসবো রাুসীর মতো,
এই দেশটা একদিন মরুভূমি হবে, যেমন আমার হৃদয়টা আজ
ফেটে চৌচির সাহারার মতো
লু হাওয়া, বৃষ্টি নেই, পানি নেইÑ লবণাক্ত সাগরের বুকে
পাল উড়িয়ে কেউ কি মেটাতে পারে বুকভরা তেষ্টা?

রচনাকাল : ২৪ মে ২০১৪ খ্রি.

বাথানের পথ ধরে



প্রতিদিন একটি শুভ সকাল দেখি
বিকেল গড়িয়ে পরিশ্রান্ত মৌনপ্রেমী রাত
রাতের আঁধার হাওড়ে লুকোচুরি মানুষশিকারীর দল
বিনিদ্র রজনী কাটে পথ হারানোর এই নিশ্চিদ্র তটে।

পাথরও বলে কথা- নবাঙ্কুর একদিন এই পথপ্রান্তরে
ধূলিময় আস্তরণ ছুটিয়ে যে বংশীবাদক গিয়েছিলো চলে
সন্ধ্যার প্রোজ্জ্বল নত্র বিদায় জানায় গভীর রাতের আঁধার
চারদিকে দুমদাম আওয়াজ, কান্নার রোল, প্লেগ, চিন্তার সমীকরণ

যে পথিক জন্ম থেকে চলছে পথ অজানা
কোনো প্রাহসনিক কান্না, ব্যথা, প্রাসাদ বেদনা
কেউটের ফক্কা-দংশন থামিয়ে দিতে পারে না
দিনভর বিরামহীন পথচলা।

আমিও ছুটে চলেছি বাথানের পথ ধরেÑ এই পথে
যে পথ আমার পূর্বপুরুষরা কখনও মাড়ায়নি জানা-অজানায়
মাঝে মাঝে কিংবর্তব্যবিমূঢ় মানুষের অহঙ্কার-অমানিমায়
ইন্দ্রজালের মতো চেপে ধরে পথের অশান্ত ছায়া-প্রচ্ছায়া

হয়তো একদিন কোনো এক গোধূলি বেলা
দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে- অনিমেষে
ইথারে ভেসে আসবে আরক্তিম বাসন্তী সন্ধ্যায়
বেলী, হাস্নাহেনার অশরীরী সুবাতাস
মানুষের মাঝে ঘুচে যাবে সব দ্বন্দ্ব
পর্যুদস্ত হবে অহমিকা আর উদ্ভট চিন্তাজালের সমাহার।


মিথ্যার অক্টোপাস

সব সত্য সত্য নয়
বুকের মাঝে কেবলি একটি উৎপ্রো কথা কয়
অন্য এক সত্যের বীণা বাজায়

রিনঝিন বাজে শব্দের পঙ্ক্তি সেই বীণা মাঝে
কথা কয়, সুর তোলে হৃদয়ের অভিব্যক্তি সাজিয়ে সকাল সাঁঝে

আমি পারি না সব সত্যকে বাজিয়ে দেখতে
মাঝে মাঝে মনে হয় সত্য; সেতো সত্য নয়
মিথ্যার এক কূটচাল মাত্র- উদ্বেলিত তরঙ্গমালা।
কাননের ফুলগুলো শুকিয়ে যায়
নির্মল কানাই শতরূপী গান গায়।

মিথ্যার বেসাতি যে শহরে মানুষের মনে
সেখানে সব আগাছারা পৌরুষহীন প্রতিনিধিত্ব করে
ফুল ফুটবে যে গাছে কাপালিক সন্ধ্যায়
সেসব গাছ অবহেলায় অযতেœ একদিন মরে ঝরে যায়।

একটা চারাগাছকে বড় কোরে তুলতে হলে
পানি দিতে হয় পর্যাপ্ত
সেবা-যতœ আলো-বাতাস
সর্বদাই দিতে হয় উপহার

এসব না করে তাকে যদি ক্রমাগত সূর্যের রঙিন আলোকে
ছেড়ে দিয়ে তামাশা দ্যাখে কিছু মানুষ
অবশেষে
একটি চারাগাছ এইসব সত্য-মিথ্যার বেড়াজাল ভেঙ্গে
মাঝে মাঝে বড় হোয়ে ওঠে ঔজ্জ্বল্যবিহীন
তারপর কালবৈশাখীর মিথ্যা প্রলোভনে জড়িয়ে
তাকে দূরে সরে দেয়Ñ সত্যের অনেক দূরে

ঔকান্তিক আবদার কর্পূরের
তবুও সত্য কখনও মিথ্যা হতে পারে?
পারে হয়তো অথবা পারে না
যদি সে চিরসত্য হয় তাহলে জ্বলবে বিপ্লব-বিদ্রোহের আগুন
চিরসত্যের অমোঘ বাণী :
কানকথা শুনে প্রিয়জনকে দূরে সরিয়ে দিও না
তখোন আবার ভুল বুঝে
কাফ্ফারা দিয়ে শত কাছে টানতে চাইলেও
মিথ্যের অক্টোপাস তাকে আর
নিজের মানুষ বলে পাশে দাঁড়াতে দেবে না

কুটনির কুচিন্তায় কখনও কুচাগ্রও সত্যের অপলাপ হয় না।

আপনাকেই বলছি

আমি আপনাকেই বলছি, হে কর্ণধার!
কুম্ভকর্ণের ঘুমে এখনো কেনো অচেতন সারাবেলা?

এখনো আইনের অস্ত্র ডাকাতের অস্ত্রের মতো গর্জে ওঠে নির্বিচারে
এখনো পটুয়াখালির মুন্নী, বাগাতীপাড়ার খুশি যৌন হয়রানির মরণ ছোবলে
এখনো সীমান্তে ফেলানির নির্যাতিত মৃতদেহ আছে ঝুলে
চারপাশে ুধার্তের হাহাকার নিত্যদিন
বেকারত্বের নির্মম পরিহাস সকাল-বিকাল- জ্বলে ওঠে দুর্বিসহ তুণ

আমরা প্রতিদিনই জ্ঞানগর্ভ সুরে শুনি :
সুপ্রভ একুশের চেতনার কথা, স্বাধীনতার কথা
দেশরার কথা, আইনের কথা
দেশপ্রেমের কথা, মানুষে মানুষে ভালোবাসার কথা

অথচ দেশের কর্ণধারগণ কর্ণমাঝে তুলো দিয়ে
আইন গড়ি, আইন ভাঙ্গি
মিছে ভালোবাসা- দেশপ্রেমের অভিনয় করি
একুশের চেতনার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করি
স্বাধীনতা-দেশরা- দেশপ্রেমের জন্যে ভাবি না ধর্মাধিকারী

কাঁদে ভুখা-নাঙ্গা নিগৃহীত পানসে মানুষের দল
কাঁদে নির্যাতিত লাঞ্ছিত বঞ্চিত সখিনারা- কালে কালে
অন্যায় অত্যাচার হাসে খিলখিল করে
হাসে বিবেকশূন্য আততায়ী
শেয়ার মার্কেটে ধ্বস নামায়
মাথায় বাজ পড়ে হাজার হাজার প্রবঞ্চিত মানুষের
কোন্ ঘুমে আচ্ছন্ন হে দেশের কর্ণধার?

জনগণ যে দেশে নির্ঘুম রাত কাটায়
সেদেশের ভুখা-বঞ্চিত মানুষ অবশেষে কোনো আইন মানে না
ভাঙতে চায় শৃঙ্খল-বন্ধন চিরদিনের যতো
জেগে ওঠে ওরা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো

বিষ্ফোরণ ঘটায় অসাম্য চারদিকে দিকবিদিক
তখন আপনার চিরনিদ্রা টুটে যাবে হে শাসক
সময় থাকতে তাই খুঁজে নিন সচেতন সুন্দর পথ
বেছে নিন সত্যিকারের একুশের চেতনা-ঊষসী
তবেই শান্তিময় পৃথিবী, ছন্দোবদ্ধ হবে দেশবাসী।

অক্টোপাস


একটা অক্টোপাসের সাথে দেখা হয়েছিল
গতকাল এক সমুদ্র জলরাশির
আটটি পায়ে জড়িয়ে জড়িয়ে স্বপ্নের জাল ছিহ্ন করে
হৃদয়ে গেঁথে দেয় গভীর ত, মরিচীকা অমানিশা।

স্বপ্নÑ সদ্য ফোটা ফুলের পাপড়ি বিস্তীর্ণ সন্ধ্যায়
ম্লান হয়ে ঝরে পড়ে কুয়াশার মতো টুপ্ করে
আবাবিল উড়ে পাহাড়ের ওপারে
মাকড়সারা জাল বোনে; উড়ে যায় কালবৈশাখী ঝড়ে।

কুটিল পৃথিবীর সব রামলীলা সাঙ্গ করে
শাদা মেঘেদের পথ ধরে হেঁটেছিল কে কবে
সমুদ্র পথে এসেছিল যে মৎস্যারোহী
আজও সে বাতাসের উল্টোপথে বিমূঢ় বসে।

তুমি কখনোই তার দেখা পাবে না
যদি না তুমি ধৈর্যের পাহাড় ডিঙাতে পারো
বিশাল সমুদ্রতটে যে ঢেউ আছড়ে পড়ে
তাকেও দূর সাগর থেকে পাহাড়-মনোবল নিতে হয়।

তুমি চিরদিন বন্ধু থাকো- দরকার নেই সাথী হবার;
যে নদীর সৃষ্টিই ঝরণা থেকে
তাকে তো চিরদিনই কাঁদতে হয়
সমুদ্র বন্ধুর সুচিন্তনের জন্যে।


রচনাকাল : চাঁদপুর; ২৩ এপ্রিল, সন্ধ্যা ৬টা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন