মনের ভাবের কোনো ছক নেই, চৌহদ্দি নেই। কিন্তু ভাষার শক্তির সীমা আছে। মননশীল মন সেই সীমায় বাধা পায়, মুক্তি চায়, পথ খোঁজে।
চেনা শব্দে গোনা শব্দে যখন তার চলে না, মন তখন শব্দে ভর করে সেই শব্দকে ছাড়িয়ে
যায়। উড়োজাহাজ চাকায় ভর করেই চাকার সীমা ছাড়িয়ে অসীম আকাশে পাখা মেলে, দূরাভিসারী
কবিমন তেমনি শব্দকে আশ্রয় করেই শব্দোত্তর অনন্তের দিকে উড়ে চলে।
কবিতা যা বলে, আর কেউ তা পারে না। কবিতা যেমন করে বলে, তেমন আর কিছু বলে
না। এই ‘যা’ ও ‘যেমন’-এর বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই কবিতার
প্রকৃতি, তার কৃতি, তার সার্থকতা। এখানেই গদ্যের ওপরে তার মহিমা, পদ্যের চেয়ে সে
উচ্চতর এখানেই। গদ্য কাজের কথা বলে, পদ্য সুন্দর কথা বলে, কবিতা সুন্দরের কথা বলে।
“সেদিন রেলে দেখলাম, এক কুলিকে
জনৈক বাবু সাব ঠেলে নিচে ফেলে দিল। চোখ ফেটে জল এল— জগৎ জুড়ে এভাবে কি দুর্বলেরা মার খাবে?”
এটা গদ্য। সরল কাহিনি, সহজ বক্তব্য। এ ধরনের বক্তব্যের জন্যে কবিতার দরকার
নেই। একে কবিতার আকারে লিখলেও, প্রকারে তা কবিতা হবে না। কেননা এতে এমন উঁচু কোনো ভাব
নেই, যা একান্তই কবিতার। সবলের হাতে দুর্বল মার
খাচ্ছে – দুঃখজনক, কিন্তু সাধারণ ঘটনা।
এ ঘটনা দেখে যে-কোনো ভালোমানুষ দুঃখ পেতে পারেন। মহৎ মানুষ হলে কেঁদে ফেলতেও
পারেন। এমনকি প্রতিবাদও করতে পারেন। তবু এ ঘটনা ও তা দেখে দুঃখ পাওয়ার ‘বিবরণ’ কবিতা নয়। এমন সাধারণ আবেগ রাজা-চাষা-হরকরা-বাদামঅলা
প্রভৃতি যে-কারো মনে জাগতে পারে। পড়ালেখা জানলে এঁরা তা লিখে রাখতেও পারেন। কথা
বলার মতো লিখলে গদ্য হবে। ছন্দ ও মিল দিয়ে লিখলে পদ্য হবে। নজরুল ছন্দ ও মিল দিয়ে
লিখেছেন। তিনি খুব সুন্দর পদ্য লিখেছেন:
“দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে—
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল!”
এখানে
পদ্যের সৌন্দর্য আছে, কাব্যের ঐশ্বর্য নেই। অতল
ভাবনা নেই। গূঢ় তাৎপর্যের ইশারা নেই। অধরাকে ধরবার আকুলতা নেই। শব্দোত্তর ব্যঞ্জনা
নেই। গহন উদ্বোধন নেই। দুরূহ দ্বন্দ্ব নেই। অলোকের আলোক
নেই। রহস্যের ছায়া নেই। কবিতার কিছুই নেই। সরল ঘটনা ও তরল আবেগ নিয়ে পঙক্তিগুলি
চমৎকার পদ্য – কবিতা
নয়।
কিন্তু এর ঠিক পরেই যখন আবৃত্তি করি – “যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে” – দেখি, এই দধীচি শব্দটি, ওই পৌরাণিক উপমাটি, আগে-পরের তাবৎ পদ্যপঙক্তি নিয়ে
উঠে আসতে চাইছে কবিতার কাতারে। দধীচি তখন শব্দমাত্র নয় আর, তার তলে একটি অর্থমাত্র
চাপা নেই শুধু – আছে তার বেশি কিছু। ওই বেশিটুকুই কবিতা। বজ্রার্থে আত্মত্যাগী যে-দধীচি
স্বত্যাগচেতনার প্রতীক, কবি একে সঞ্চারিত করেন আবহমান শ্রমে, লক্ষ লক্ষ কুলি-মজুর
তখন দধীচি হয়ে ওঠে। এভাবেই এক বজ্রকর প্রতীকায়নের সাহায্যে শব্দোর্ধ্ব অতিরেকের
বিদ্যুৎ-সংযোগ ঘটান কবি, আর তখুনি জ্বলে ওঠে তাঁর কবিতা।
এই যে শব্দোর্ধ্ব অতিরেক, মানে শব্দ যে-অর্থ ধারণ করে শব্দকে তার বেশি কিছু
বলানো, এ-ই কবিতার আসল শক্তি। এ শক্তির অধিকারেই কবি শক্তিমান স্রষ্টা। কবিতার
উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক, বিমূর্তে রূপদান ও জড়ে প্রাণারোপ এ শক্তিরই প্রকাশক। এ
নইলে কবিতা হয় না। এ শক্তির কেরামতি না জানলে কেউ কবি নয়। কবিতাকে অকবিতা থেকে,
কবিকে ছদ্মকবি থেকে আলাদা করে চেনার এই একটাই পথ – শব্দোত্তর প্রকাশশক্তি। অতএব ‘কবিতা কী বলে’ এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর বিষয়বাচক নয়, গুণবাচক – কবিতা বেশি বলে, বলার
সম্ভবতার চেয়ে; কবিতা অসীমের ইশারা আনে।
কবিতা সবসময় আপাদমস্তক কবিতা হয় না। এক পেয়ালা পানিতে এক চিমটি চা-পাতা
মেশালে পেয়ালার সবটুকু পানিই চায়ে পরিণত হয়, তেমনি একপাতা কথায় বা একরাশ পঙক্তিতে একটুকু
কবিতেয় রহস্য মিশিয়ে দিলে ক্ষেত্রবিশেষে সব বাক্য-পঙক্তিকেই তা কবিতায় উত্তীর্ণ
করে তুলতে পারে। নজরুলের চুয়াল্লিশ পঙক্তির দীর্ঘ ‘কুলি-মজুর’ – অকাব্যিক বর্ণনা, ঘোষণা ও
বক্তব্য নিয়ে প্রধানত যা পদ্যই – তিন-চারটি পঙক্তির কারণে কবিতাখ্যেয়। যেমন শেষ পঙক্তিটা: ‘ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে
কাঁপিতেছে শয়তান’ – ঠেলে কাউকে নিচে ফেলে দেওয়ার
মতো সাধারণ দেখা ঘটনার বর্ণনা নয়, এ অতিসাধারণ কাব্যিক চিত্রকল্প। ইনসাফ ও যুলম
এখানে ভগবান ও শয়তানের রূপ ধরে জীবন্ত ও দৃষ্ট হয়েছে। ফলে তাতে কবিতার ‘অতিরিক্ত’ শর্ত সৃষ্ট হয়েছে। যে-কবিতায়
এ অতিরেক যত বেশি, তা তত সার্থক কবিতা।
খবরের ভাষা নির্দিষ্ট, জ্ঞানের ভাষা স্পষ্ট – কিন্তু কবিতার ভাষা প্রচ্ছন্ন, কুয়াশাময়। কারণ কবিতা
খবরিয়া নয়, শাস্ত্রীয় জ্ঞানের কারবারিও নয় – তার কারবার গহন বোধ ও অন্তরস্থ অভিজ্ঞানের কারবার। গহন
বোধ যেহেতু আম নয়, অভিজ্ঞান সুলভ নয়, কবিতাও তাই সকলের জন্যে নয়। ছড়া খুব ছড়াতে
পারে, পদ্য পেতে পারে প্রবাদের সর্বপ্রিয়তা, কিন্তু কবিতা সচরাচর সেভাবে জনপ্রিয়
হয় না। আবদুল হাকিমের ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ কিংবা রঙ্গলালের ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে
চায় হে’ অথবা মদনমোহনের ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’ প্রভৃতি পঙক্তিমালা প্রবলভাবে
সেকেলে সমাজনৈতিক অভিপ্রায় ও মূল্য ধারণের সুবাদে শত শত বছর ধরে বিখ্যাত
নিত্যাবৃত্ত পঙক্তি – তবু
সাদা পদ্য ওসব, কবিতা নয়। প্রাচীন চর্যাপদ বা সাবআ মুয়াল্লাক্বাও আসলে কবিতা নয়,
যদিও তাতে কবিতার কিছু রং ইতস্তত ছিটোনো দেখা যায়; তবে কালিদাসের মেঘদূত, রুমীর
মসনবী ও লালনের বিস্রস্ত ভজনগুলি কবিতা, উত্তীর্ণ কবিতা। যেগুলোকে বলছি কবিতা নয়,
কবিতা নয় মানে যে এসব কিছুই নয় তা কিন্তু নয়, সফল পদ্য ও আলঙ্কারিক রচনা হিসেবে
যথাযথ সাহিত্যমূল্য এগুলির অবশ্যই আছে।
এককালে চল ছিল মহাকাব্যের। নাম মহাকাব্য হলেও প্রকৃতপক্ষে ওগুলো কাব্য ছিল না। ছিল ছন্দোবদ্ধ কেচ্ছা। রাজার গুণকেচ্ছা, যুদ্ধের বড়াইকেচ্ছা,
হায় হায় শোককেচ্ছা। দিন গিয়েছে, সময়ের সিদ্ধান্তে কথিত মহাকাব্যও পরিত্যক্ত
হয়েছে। আজকাল
কেউ মহাকাব্য লেখে না, আর লিখবে বলেও বোধ হয় না। ওডিসি-শাহনামা-মহা শ্মশান ঐতিহাসিক সম্পদ বলে বর্ণিত
হয়, পঠিত হয় না।
সময়ের স্পর্শের বাইরে কিছুই নেই। দিন গিয়েছে, দিন এসেছে, কবিতাও বদলেছে,
বদলাচ্ছে। সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে আমাদের কবিতাবোধ। ঘটনা, বিশ্বাস, রুচি ও মতবাদের
পরিবর্তনে কবিতার নিরিখও পরিবর্তিত হয়েছে, আধুনিকায়িত হয়েছে। নতুন দিনের কবি লিখছেন নতুন কবিতা। পাশাপাশি পরিবর্তনের কোলাহলে খেই
হারিয়ে ছদ্মকবিরা লিখে চলেছেন লক্ষ্যহীন বিশেষণভার আর অর্থহীন দুবোর্ধ্যতায়
আক্রান্ত অসংলগ্ন ছদ্মকবিতা। রোমান্টিক কবির কাল ফুরোল বলে। পরাবাস্তবতাও মলিন হতে
লেগেছে। স্বকালের বহু কবি ও কবিতা এখন কবি ও কবিতা নয়। দুঃখজনক উদাহরণ,
সত্যেন্দ্রনাথ – কত অজস্র অবাক করা দুলিয়ে
দেওয়া পঙক্তিমালা তাঁর। তবু সময়ের মুরব্বিয়ানার ওপরে কথা চলে না। যদিও সময় হার
মানে কোথাও কোথাও। প্রতিভার আলোয় সময়কে পথ দেখান কেউ কেউ, যেমন রবীন্দ্রনাথ।
সূক্ষ্মতর বোধের বৈভবে কেউ আবার ডিঙিয়ে যান সময়ের সীমানা, যেমন জীবনানন্দ। যা বলা
যায় না, এঁরা তা-ই বলেন, মানবাত্মার অন্ধকার অতল খুঁড়ে তুলে আনেন মণি-মুক্তো।
আবার বলি, কবিতার প্রাণের ধন সেই কথাটি: যা আদৌ বা ঠিক সুরে বলা হয় নি, হয়
না, সাধারণত হওয়ার নয়। প্রকৃত কবির কাজ: সেই অধরাকে ধরা, যার নাগাল কেউ পায় না
কিংবা ঠিক ঠিক ধরতে পারে না। শুধু কবিতা পারে। কেবল কবি পারেন। বিশ্বকবির গভীর
কণ্ঠে তাই শুনতে পাই:
‘শেষের মধ্যে অশেষ আছে
এই কথাটি মনে
আজকে আমার গানের শেষে
জাগছে ক্ষণে ক্ষণে।’
শুদ্ধতম
কবিই টের পান:
‘অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা
নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন