শুক্রবার, ৬ জুন, ২০১৪

মূল্যবোধের সংকট ও পুঁজির বিকার ।। মোহাম্মদ নূরুল হক

সাধারণ মানুষের সঙ্গে শিল্পীর মিলের চেয়ে অমিল বেশি। এই অমিলের জন্য দায়ী শিল্পীরাই। সমাজে সংঘটিত ঘটনাবলির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ঘটে কালেভদ্রে। এর কারণ সমাজ যেদিকে ধায়, তারা সেদিকে যান না। নিজেদের জন্য পথসৃষ্টির স্বপ্ন দেখেন। চেষ্টা করেন স্বকৃত পথে চলতে। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে তারা প্রায় ঘোরের ভেতর থাকেন। অথচ আকস্মিক কোনও ঘটনা ঘটে গেলে, সঙ্গে-সঙ্গে জানার সুযোগ পান না। শিল্পী-সাহিত্যিকেরা ছাড়াও সমাজে চিন্তক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, এনজিওকর্মী___ প্রভৃতি শ্রেণীর মানুষ রয়েছেন। তারা যেভাবে সমাজ পরিচালনার পরিকল্পনা করেন, শিল্পীরা সেভাবে করেন না। ফলে তাদের সঙ্গে শিল্পীর প্রায় আদর্শিক সংঘর্ষ বাধে। 
সমাজসচেতনতার প্রশ্নে জনগণের সঙ্গে শিল্পীর পার্থক্য অনেক। জনসাধারণের একটি বিশাল অংশ যেখানে গণজোয়ার সৃষ্টি করে, সেখানেও কখনও-কখনও শিল্পীকে নিস্পৃহ থাকতে দেখা যায়। শিল্পীরা কোনও বিশেষ ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে-সঙ্গে উদ্বেল হয়ে ওঠেন না। তারা কালের রুচি, ঘটনাপুঞ্জের অভিঘাত উপলব্ধির চেষ্টা করেন আগে। এরপর ওই ঘটনাপুঞ্জকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন এবং সঙ্গে-সঙ্গে নতুন রুচি গঠনের সাধনায় মগ্ন হন। কারণ শিল্পী সমাজকর্মী-রাজনীতিক নন। তার কাজ সামাজিক পরিবর্তন সাধন নয়, সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখানো। শিল্পী নিজের রুচি-কল্পনার প্রকাশ ঘটান শিল্পকর্মের মাধ্যমেই। এ জন্য তাকে ধর্যের প্রমাণ দিতে হয়, সৃষ্টি করতে হয় নিজস্ব ভুবন। বিষয়কে উপলব্ধি করার জন্য বুঝতে হবে শিল্পীর স্থান, কাল ও রুচির। ‘একটি শিল্পকর্মের জন্য শিল্পীর জীবন এবং বিশ্বাসকে আমাদের জানা প্রয়োজন, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত জানা প্রয়োজন, শিল্প সৃষ্টির সময়কালে দার্শনিক এবং নন্দনতাত্ত্বিক উপলব্ধি প্রয়োজন, সঙ্গে সঙ্গে শিল্পরীতি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজন।’ (শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য : সৈয়দ আলী আহসান)।  না হলে শিল্পীকে বোঝার ও শিল্পরস উপলব্ধির উদ্দেশ্য প্রায় ব্যর্থ হতে পারে।
প্রায় উপস্থিতকালের প্রচল রীতিনীতির সঙ্গে শিল্পীর মেলে না। জনতার ঐকতানে অংশ নেন না শিল্পীরা। এর কারণ গণআন্দোলনের উদ্দেশ্য, পরিপ্রেক্ষিত অনেক সময় সুস্পষ্ট থাকে না। জনতা রাজনীতিকদের কূটকচালের শিকারও হতে পারেন। বিষয়টা শিল্পীরা ধরতে পারলেও তাৎক্ষণিক জনতাকে হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই নিজেদের সামাজিক-রাজনৈতিক জীব মনে করেন। ফলে তারা শিল্পীর সতর্কবাণীকে উপেক্ষা করেন। এ কথা জনতা মানতে নারাজ, ‘উৎকট বিশ্বাস ও অন্ধ ভাবাবেগ সাংস্কৃতিক জীবনের অন্তরায়। যে কোনো উৎকট ভাব মানুষের বুদ্ধি ও মনকে করে রাখে সম্মোহিত ও আচ্ছন্ন। বিপ্লব ও আন্দোলন জাতীয় জীবনে নিয়ে আসে ঝড় ও ভূমিকম্পের প্রচ-তা, তখন কারো মন থাকে না সুস্থ ও দৃষ্টি থাকে না স্বচ্ছ। ফলে তখন সংস্কৃতি থেকে সংস্কার হয়ে ওঠে বড়। এই সংস্কারই জাতীয়, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের লেবেল এঁটে বাধায় বিরোধ। ফলে সমাজ বা সম্প্রদায় হয়ে পড়ে আত্মকেন্দ্রিক। আত্মকেন্দ্রিকতার অপর নাম হচ্ছে কূপমণ্ডুকতা।’ (সংস্কৃতি : আবুল ফজল)। পুরো জাতি যখন কোনও একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন শিল্পী তাতে অংশ না নিলে তার প্রতি জনতার শ্রদ্ধা কমে, থাকে না ভালোবাসাও।  কখনও-কখনও শিল্পকর্মকে উপেক্ষা করা হয়। গুরুত্ব দেওয়া হয় না তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মকেও। গণআন্দোলনের কর্মী যে জনতা, তাদের কাছে শিল্পীও একজন সামাজিক মানুষ বৈ কিছু নয়। উপরন্তু তারা ভাবেন, শিল্পীও কোনও না-কোনও রাজনৈতিক ধারাপন্থী। কিন্তু শিল্পী সমকালীন রাজনীতির চোরাবালিতে পা না দিয়ে, কৌশলে যে সমাজবদলের স্বপ্ন দেখান জাতিকে, জাতির বৃহত্তর অংশটিই তা মানতে নারাজ। কেবল সাধারণ আন্দোলনকারী জনতা নয়, বুদ্ধিবৃত্তিকশ্রেণীর মতেও ‘সাহিত্যিক যতক্ষণ সাহিত্যকর্মরত ততক্ষণ তিনি একমাত্র নিজের প্রতিভারই অনুগামী, অন্য-কোনো অধিনায়কের প্রত্যাদেশ মেনে চললে তিনি স্বধর্মচ্যুত হবেন, লক্ষ্যভ্রষ্ট হবেন। কিন্তু সাহিত্যিক তো মানুষও বটে, এবং মানুষ সামাজিক জীব। যত আত্মসমাহিতই হোক সাহিত্যিকের জীবন ও মন, সমাজের সঙ্গে নানা নিবিড় সূত্রে তা গ্রথিত।’ (সাহিত্যিকের সমাজচেতনা : আবু সয়ীদ আইয়ুব)। 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু হয়েছে, শিল্পীকেও কোনও না-কোনও রাজনৈতিক দল বা শক্তির পক্ষে থাকতে হবে। যুদ্ধে-বিগ্রহে-নির্বাচনে পক্ষাবলম্বনে তাকে হতে হবে সতর্ক। শিল্পীর পক্ষ-শক্তি যুদ্ধে বা নির্বাচনে জয়লাভ করলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আর পরাজিত হলে তাকে দেখা হয় বাঁকা চোখে। বিশ্বসাহিত্যে এজরা পাউন্ড এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলায় ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যাবে।  ফররুখ আহমদ-আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, এবিএম মূসার ভূমিকা ও পরিণতির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায়___ শিল্পীর রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন কতটা জরুরি। অর্থাৎ বৈশ্বিক পরিবেশের পাশাপাশি দেশীয় সমাজব্যবস্থারও সিংহভাগ গ্রাস করেছে দলীয় রাজনীতি। প্রচল স্রোতের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে হঠাৎ আলোর ঝলকানি হয়তো দেখানো সম্ভব, কিন্তু সমাজ ওই ভূমিকাকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করে না। যতক্ষণ না সমাজের গড়পড়তা স্বভাবের সঙ্গে স্রোতের বিরুদ্ধ-সাঁতারুর কোনও মিল খুঁজে পাওয়া না যায়।
প্রকৃত প্রস্তাবে এ সবের মূল নিয়ামক কিন্তু রাজনীতি নয়; পুঁজি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্কগুলো পর্যন্ত পুঁজির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ পুঁজি যার, স্বপ্ন তার। তারই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সমাজের সমস্ত প্রতিভাবানকে ক্রীতদাসের মতো সশরীরে হাজির হতে হয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নারায়ণগঞ্জে অপহরণোত্তর ৭ খুন, ফেনীতে পুড়িয়ে একরাম হত্যার পেছনেও পুঁজিপতির ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। এ সবের মূলে রয়েছে চোরাচালান কারবার, ক্ষমতার আধিপত্যবিস্তার। যা পরবর্তী সময়ে ওই দুই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃতদের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত।
প্রথাগত পুঁজিপতিরা যত ভয়ানক, তারও বেশি ভয়ানক তারা; যারা প্রথম যৌবনে সমাজতন্ত্র, শ্রেণীবৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেন।  শ্রেণীবৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টারা পুঁজির মালিক হলে, সমাজের খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে অনেক সময় মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করেন না। তারা মালিকানাধীন প্রতিটি খাত থেকে শর্তহীন মুনাফা প্রত্যাশা করেন। তাদের এই প্রত্যাশার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুঁজির মালিক হতে না-পারা তাদেরই সতীর্থরা। যারা প্রথম যৌবনে একসঙ্গে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন শ্রেণীবৈষম্যহীন সমাজগঠনের।
পুঁজিপতি ছাড়া সমাজের বাকি মানুষেরা মূলত ক্রীতদাস। সমাজে পুঁজিপতিদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যেই শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক থেকে শুরু করে শ্রমজীবী মানুষেরা পরিশ্রম করেন, মেধা খাটান। জ্ঞানীদের দেখানো পথে চলে না বর্তমান সমাজ; চলে পুঁজিপতিদের ইচ্ছানুসারে। ‘ধনার্জনের চেয়ে জ্ঞানার্জন শ্রেয়’ শীর্ষক যে বাংলা প্রবাদটি রয়েছে, তার মর্মার্থ যতই সুন্দর হোক, আসলে বাক্যটি অন্তঃসারশূন্য। অন্তত বর্তমান কালের প্রেক্ষাপটে। এখন প্রবাদটির বিপরীত পাঠই গ্রহণ করা উচিত___ ‘জ্ঞানার্জনের চেয়ে ধনার্জনই শ্রেয়’। কারণ সহস্র জ্ঞানী একত্র হলেও একজন পুঁজিপতিকে তাদের ইচ্ছানুসারে পরিচালিত করতে পারবেন না। অথচ মাত্র একজন পুঁজিপতি চাইলেই সহস্রাধিক জ্ঞানীকে তার দাসে পরিণত করতে পারবেন। এর মূল কারণ, যে কেউ চাইলেই জ্ঞানার্জন করতে পারেন। কিন্তু ইচ্ছা করলেই পুঁজিপতি হওয়া যায় না। একই সঙ্গে এ-ও সত্য___ পুঁজিপতিরা বেশির ভাগই উত্তরাধিকার সূত্রে, ব্যবসায় সূত্রে অর্জিত। কিন্তু কোনোভাবেই উত্তরাধিকার সূত্রে জ্ঞানী হওয়া যায় না। তবু সমাজের জ্ঞানীরা, শিক্ষিতরা নিজেদের পুঁজিপতির পরামর্শক ভেবে তৃপ্তি পেতে চান। বাস্তবতা হল___ পুঁজির মালিক, যিনি বিনিয়োগ করেন, তিনি যাদের নিয়োগ দেন, তাদের কর্মচারী অর্থাৎ চাকরবাকর অর্থাৎ ক্রীতদাসের বেশি কিছু ভাবেন না। তবে নিজের মর্জিমাফিক কাজ আদায় করে নেওয়ার কৌশল হিসেবে এই চাকরবাকরকে কখনও-কখনও ভাই-বন্ধু বলে সম্বোধন করেন বটে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না___ এই ভাই-বন্ধু সম্বোধন মূলত পোশাকি, আন্তরিক নয়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন