‘আজ তাহলে উঠছি’- বলে নিজেকেও যুগপৎ অবাক করে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি। মুহুর্তকাল বিলম্ব করে স্মিত হেসে আমার হাতে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো সমুদ্দুর। একটা শিহরণ... ইলেক্ট্রিক্যাল শকের মতো প্রবল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তীক্ষ্ণ অসাড়তা ছড়িয়ে গেলো আমার হৃদ অলিন্দ থেকে সমস্ত শিরা উপশিরায়। এমন হওয়ার কথা না। হয়নি কখনো। কিন্তু অবিশ্বাস্য সত্যি কথা হলো এখন হচ্ছে! উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম চৈতালী হাওয়ায় দোল খাওয়া বাবুই পাখির বাসার মতো দুলছে শরীরটা! চিন্তাশক্তি হারিয়ে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে... সমুদ্দুর পাশে এসে দাঁড়াতেই কালবোশাখী ঝড়ে উপড়ে পড়া বৃক্ষের মতো আছড়ে পড়লাম আমি তার বুকে... অতঃপর একটি স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্নের ঘোর লাগা মগ্নতায় কেটে গেছে কিছু বেহিসাবি সময়... ব্যাখ্যাহীন কত কিছুইতো ঘটে যায় জীবনে, কী এমন যায় আসে তাতে! তবুও নিজের উপর প্রচন্ড ঘৃনায় বিষাক্ত হয়ে উঠে মনটা... আমি এমন কিছু চাইনি!!! একসময় চাইতাম... খুব চাইতাম। একটুখানি কাছে যাওয়ার, একটুখানি ছোঁয়া পাবার কি ব্যাকুলতাই না ছিল! ইয়্যুনিভার্সিটির কোলাহলমুখর বান্ধব আড্ডায় সমুদ্দুর ছিল এক প্রানোচ্ছলতার নাম। আর আমি এক নিস্প্রানতা! সমুদ্দুরের বন্ধু অনেক। আর আমার চারপাশে মানুষ অনেক। কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতায় গুটানো আমি... পাখা মেলা হয় না! মানুষরা দলবেঁধে ওড়ে, হাসে- মুগ্ধতায় জীবনের অর্থবোধক পথকে প্রসারিত করে। অথচ কী আশ্চর্য- বন্ধুদের ভীঁড়েও একলা হাঁটি আমি। স্বপ্ন অথচ সংকটময় পথ ধরে যে গন্তব্যের পথে হাঁটা সেখানে আমার আকাশে একটুকরো মেঘ হয়ে আসে সমুদ্দুর। ওর মাদক চোখের চাহনী আমায় অবশ করে দেয়! ওই চোখ দু’টোর জন্যেই খুন হয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। ব্যাস, ওইটুকুই। অন্তর্দহনে পুড়ে ছাই হয়েছি অবিরত। মুখে কখনো বলা হয়নি- ভালবাসি! আমার চোখের ভাষা বুঝেনি সে, অথবা না বুঝার ভান করতো নির্লিপ্ত চিত্তে। আমিও অগাধ সম্ভ্রম রেখেই পা বাড়িয়েছি জীবনের ভিন্ন স্রোতে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় পরে সমুদ্দুরের সাথে হঠাত দেখায় শুরুতে তেমন কোনো ভাবোদয় হয়নি আমার। সমুদ্দুর যখন আপ্লুত কন্ঠে বলল- ‘আগে কেন বলিসনি?’ কোন অনুকম্পা ছাড়াই মুচকি হেসে পাল্টা প্রশ্ন করি আমি- ‘আগে কেন বুঝিসনি?’ আমার মস্তিষ্কের মনিটরে ভেসে উঠে একটি কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যা। কোন এক ষোল ডিসেম্বরের সাঁঝ প্রহরের আবছা আলোআঁধারিতে বিজয়মেলার উৎসব মুখর প্রাঙ্গণ থেকে দলছুট হয়ে একা আমি আনমনে হাঁটছিলাম দিঘীর পাড় ঘেঁষে। হাজার মানুষের ভীঁড়েও একা থাকা এই আমি নিজেকে হারাই ক্ষনে ক্ষনে...। আচমকা হাতে কারো স্পর্শ পেতেই চমকে ফিরে তাকালাম- সমুদ্দুর! আগুনঝরা কন্ঠে সমুদ্দুর বলে চলল- ‘একা এদিকে এসেছিস কেন? সবাই খুজে মরছি! তাছাড়া... এদিকটায় কত্ত বাজে লোকের আনাগোনা, জানিস তুই? যদি কোন অঘটন...’ ‘তাতে তোর কি!’ সেই নিঝুম সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোয় দেখি স্তব্ধ সমুদ্দুরের অপলক দৃষ্টি আমার চোখের সমুদ্রে স্থির হয়ে আছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি আমার সেই সমুদ্রের উপচে পড়া জলকণা তার দৃষ্টি ছোঁয়নি! মেঘহীন আকাশতলায় লুটিয়ে থাকা শান্ত দিঘীর মতোই কিছু সময় নিশ্চুপ বসে থাকি আমরা জারুলতলায়- দু’টো হাত মুঠোয় নিয়ে...। স্রেফ এতটুকু পাওয়া... এই বাধাহীন হৃদবন্ধন... হৃদয়ের অদৃশ্য টানে আরো এক পা এগিয়ে যাওয়া আশাবাদী প্রানে...! আমার বিষণ্ণ প্রহরে কী তুমুল উচ্ছলতা এটুকু মন ছুঁয়ে যাওয়াতে! সমুদ্দুর বোঝেনা তার এক রত্তিও, অথবা স্বভাবসুলভ চাঞ্চল্যে পাশ কাটিয়ে চলে...! ছাইচাপা অনল ভেতরে পোড়ায় আমায়। তবু বলা হয় না... বলা হয় না- ‘তোকে ভালবেসে মরতে পারি!’ বলতে হবেই বা কেন! কেন বুঝিস না তুই! যত্তসব আঁতলামি! সেই একটি সন্ধ্যা আজও আমায় মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়ার মতো এলোমেলো করে দিয়ে যায়! সেই হাতের একটুখানি নিবিড় ছোঁয়া আজও আমার কত বিষণ্ণবেলা আবেশে ভরিয়ে রাখে! যাপিত জীবনের বাইরের এ যেন আরেক জীবন- আমার ভেতরের আমার! ঝরা পাতার মতো ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে একদিন আমার ঠিকানা হয়েছিল শিশিরের বুকে। ধীরে ধীরে জলরঙের মতন নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি সংসারের ক্যানভাসে- অভিযোজনের অদ্ভুত প্রক্রিয়ায়! শিশিরের তীব্র ভালবাসা আর অগাধ বিশ্বাস কাচের দেয়ালের মতো ঘিরে রাখে আমায় সারাক্ষন। আমিও নিজেকে উজাড় করে শিশিরের বুকেই অনন্ত সুখের স্বর্গ রচনা করে চলেছি নিভৃতে, নিবিড় মমতায়...। অথচ একটি বেসামাল দুপুর নিমিষেই নিঃশেষ করে দিলো... আমারই আঘাতে ভেঙে যাওয়া সে ই কাচের দেয়ালের আঘাতে রক্তাক্ত, ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছি আমি। সুক্ষ কাচের কনায় মনের ভেতর বিঁধছে অবিরাম! সুতীব্র অপরাধবোধের চাকা অনবরত পিষ্ট করে চলেছে বুকের ভেতরটা। একমুহুর্তের একটুখানি অযাচিত দুর্বলতা আচমকা ধেয়ে আসা সাইক্লোনের মতো ভেংগেচুরে তছনছ করে দিলো... নিমিষেই গুঁড়িয়ে দিয়ে গেলো আজন্ম লালিত দৃঢ়তা, শত ঘাত প্রতিঘাতেও যত্ন করে আগলে রাখা আত্মসম্ভ্রমবোধ, রক্ষনশীলতা... আর আত্মবিশ্বাস... তবুও বেঁচে আছি, বাঁচতে হয় তাই... কী চরম দায়বদ্ধতা এই ঠুনকো জীবনটার প্রতি!"
সোমবার, ১৬ জুন, ২০১৪
কাচের দেয়াল অথবা একটি বেসামাল দুপুর ।। মায়মুনা লীনা
‘আজ তাহলে উঠছি’- বলে নিজেকেও যুগপৎ অবাক করে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি। মুহুর্তকাল বিলম্ব করে স্মিত হেসে আমার হাতে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো সমুদ্দুর। একটা শিহরণ... ইলেক্ট্রিক্যাল শকের মতো প্রবল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তীক্ষ্ণ অসাড়তা ছড়িয়ে গেলো আমার হৃদ অলিন্দ থেকে সমস্ত শিরা উপশিরায়। এমন হওয়ার কথা না। হয়নি কখনো। কিন্তু অবিশ্বাস্য সত্যি কথা হলো এখন হচ্ছে! উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম চৈতালী হাওয়ায় দোল খাওয়া বাবুই পাখির বাসার মতো দুলছে শরীরটা! চিন্তাশক্তি হারিয়ে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে... সমুদ্দুর পাশে এসে দাঁড়াতেই কালবোশাখী ঝড়ে উপড়ে পড়া বৃক্ষের মতো আছড়ে পড়লাম আমি তার বুকে... অতঃপর একটি স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্নের ঘোর লাগা মগ্নতায় কেটে গেছে কিছু বেহিসাবি সময়... ব্যাখ্যাহীন কত কিছুইতো ঘটে যায় জীবনে, কী এমন যায় আসে তাতে! তবুও নিজের উপর প্রচন্ড ঘৃনায় বিষাক্ত হয়ে উঠে মনটা... আমি এমন কিছু চাইনি!!! একসময় চাইতাম... খুব চাইতাম। একটুখানি কাছে যাওয়ার, একটুখানি ছোঁয়া পাবার কি ব্যাকুলতাই না ছিল! ইয়্যুনিভার্সিটির কোলাহলমুখর বান্ধব আড্ডায় সমুদ্দুর ছিল এক প্রানোচ্ছলতার নাম। আর আমি এক নিস্প্রানতা! সমুদ্দুরের বন্ধু অনেক। আর আমার চারপাশে মানুষ অনেক। কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতায় গুটানো আমি... পাখা মেলা হয় না! মানুষরা দলবেঁধে ওড়ে, হাসে- মুগ্ধতায় জীবনের অর্থবোধক পথকে প্রসারিত করে। অথচ কী আশ্চর্য- বন্ধুদের ভীঁড়েও একলা হাঁটি আমি। স্বপ্ন অথচ সংকটময় পথ ধরে যে গন্তব্যের পথে হাঁটা সেখানে আমার আকাশে একটুকরো মেঘ হয়ে আসে সমুদ্দুর। ওর মাদক চোখের চাহনী আমায় অবশ করে দেয়! ওই চোখ দু’টোর জন্যেই খুন হয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। ব্যাস, ওইটুকুই। অন্তর্দহনে পুড়ে ছাই হয়েছি অবিরত। মুখে কখনো বলা হয়নি- ভালবাসি! আমার চোখের ভাষা বুঝেনি সে, অথবা না বুঝার ভান করতো নির্লিপ্ত চিত্তে। আমিও অগাধ সম্ভ্রম রেখেই পা বাড়িয়েছি জীবনের ভিন্ন স্রোতে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় পরে সমুদ্দুরের সাথে হঠাত দেখায় শুরুতে তেমন কোনো ভাবোদয় হয়নি আমার। সমুদ্দুর যখন আপ্লুত কন্ঠে বলল- ‘আগে কেন বলিসনি?’ কোন অনুকম্পা ছাড়াই মুচকি হেসে পাল্টা প্রশ্ন করি আমি- ‘আগে কেন বুঝিসনি?’ আমার মস্তিষ্কের মনিটরে ভেসে উঠে একটি কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যা। কোন এক ষোল ডিসেম্বরের সাঁঝ প্রহরের আবছা আলোআঁধারিতে বিজয়মেলার উৎসব মুখর প্রাঙ্গণ থেকে দলছুট হয়ে একা আমি আনমনে হাঁটছিলাম দিঘীর পাড় ঘেঁষে। হাজার মানুষের ভীঁড়েও একা থাকা এই আমি নিজেকে হারাই ক্ষনে ক্ষনে...। আচমকা হাতে কারো স্পর্শ পেতেই চমকে ফিরে তাকালাম- সমুদ্দুর! আগুনঝরা কন্ঠে সমুদ্দুর বলে চলল- ‘একা এদিকে এসেছিস কেন? সবাই খুজে মরছি! তাছাড়া... এদিকটায় কত্ত বাজে লোকের আনাগোনা, জানিস তুই? যদি কোন অঘটন...’ ‘তাতে তোর কি!’ সেই নিঝুম সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোয় দেখি স্তব্ধ সমুদ্দুরের অপলক দৃষ্টি আমার চোখের সমুদ্রে স্থির হয়ে আছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি আমার সেই সমুদ্রের উপচে পড়া জলকণা তার দৃষ্টি ছোঁয়নি! মেঘহীন আকাশতলায় লুটিয়ে থাকা শান্ত দিঘীর মতোই কিছু সময় নিশ্চুপ বসে থাকি আমরা জারুলতলায়- দু’টো হাত মুঠোয় নিয়ে...। স্রেফ এতটুকু পাওয়া... এই বাধাহীন হৃদবন্ধন... হৃদয়ের অদৃশ্য টানে আরো এক পা এগিয়ে যাওয়া আশাবাদী প্রানে...! আমার বিষণ্ণ প্রহরে কী তুমুল উচ্ছলতা এটুকু মন ছুঁয়ে যাওয়াতে! সমুদ্দুর বোঝেনা তার এক রত্তিও, অথবা স্বভাবসুলভ চাঞ্চল্যে পাশ কাটিয়ে চলে...! ছাইচাপা অনল ভেতরে পোড়ায় আমায়। তবু বলা হয় না... বলা হয় না- ‘তোকে ভালবেসে মরতে পারি!’ বলতে হবেই বা কেন! কেন বুঝিস না তুই! যত্তসব আঁতলামি! সেই একটি সন্ধ্যা আজও আমায় মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়ার মতো এলোমেলো করে দিয়ে যায়! সেই হাতের একটুখানি নিবিড় ছোঁয়া আজও আমার কত বিষণ্ণবেলা আবেশে ভরিয়ে রাখে! যাপিত জীবনের বাইরের এ যেন আরেক জীবন- আমার ভেতরের আমার! ঝরা পাতার মতো ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে একদিন আমার ঠিকানা হয়েছিল শিশিরের বুকে। ধীরে ধীরে জলরঙের মতন নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি সংসারের ক্যানভাসে- অভিযোজনের অদ্ভুত প্রক্রিয়ায়! শিশিরের তীব্র ভালবাসা আর অগাধ বিশ্বাস কাচের দেয়ালের মতো ঘিরে রাখে আমায় সারাক্ষন। আমিও নিজেকে উজাড় করে শিশিরের বুকেই অনন্ত সুখের স্বর্গ রচনা করে চলেছি নিভৃতে, নিবিড় মমতায়...। অথচ একটি বেসামাল দুপুর নিমিষেই নিঃশেষ করে দিলো... আমারই আঘাতে ভেঙে যাওয়া সে ই কাচের দেয়ালের আঘাতে রক্তাক্ত, ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছি আমি। সুক্ষ কাচের কনায় মনের ভেতর বিঁধছে অবিরাম! সুতীব্র অপরাধবোধের চাকা অনবরত পিষ্ট করে চলেছে বুকের ভেতরটা। একমুহুর্তের একটুখানি অযাচিত দুর্বলতা আচমকা ধেয়ে আসা সাইক্লোনের মতো ভেংগেচুরে তছনছ করে দিলো... নিমিষেই গুঁড়িয়ে দিয়ে গেলো আজন্ম লালিত দৃঢ়তা, শত ঘাত প্রতিঘাতেও যত্ন করে আগলে রাখা আত্মসম্ভ্রমবোধ, রক্ষনশীলতা... আর আত্মবিশ্বাস... তবুও বেঁচে আছি, বাঁচতে হয় তাই... কী চরম দায়বদ্ধতা এই ঠুনকো জীবনটার প্রতি!"
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন