শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০১৪

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইনলঙ্ঘন কাঙ্ক্ষিত নয় ।। মোহাম্মদ নূরুল হক


আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। দেশের ভেতরে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ-খুনে ঘটনায় তদন্ত, অপরাধীদের আটক-গ্রেপ্তার করা এ বাহিনীর কাজ। কিন্তু পুলিশ যখন এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তখন, তাদের  প্রতি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। সম্প্রতি পুলিশের বিরুদ্ধেই উঠেছে___ হত্যা, চাঁদাবাজি, স্বর্ণ চোরাকারবারিদের কাছ  থেকে উদ্ধারকৃত স্বর্ণ আত্মসাৎসহ,  গ্রেপ্তার-আটকবাণিজ্য, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও কন্টাক্ট কিলিংয়ের।
চলছে সংযমের মাস রমজান। সামনে বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদ। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমান কর্মস্থল থেকে প্রাণের টানে ঘরের পানে ছুটে যায়। দীর্ঘদিন পর মিলিত হয় পরিজন-স্বজনের সঙ্গে। ঈদের আনন্দ উপভোগ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নতুন পোশাক। ধনীদরিদ্র, নারীপুরুষ নির্বিশেষে ঈদের আগে প্রত্যেকের রুচি-সামর্থ্য অনুযায়ী পোশাক কেনেন। কেনাকাটা করেন অলঙ্কারসহ গৃহসজ্জার নানা পণ্যও। এই আনন্দ উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মৌসুমি চাঁদাবাজরা।
খবরে প্রকাশ__ ঈদকে সামনে রেখে আয়-রোজগার বৃদ্ধির দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে পেশাদার চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা। একই সঙ্গে মৌসুমি অপরাধীরাও জড়িয়ে পড়েছে চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের সঙ্গে। বিশেষ করে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে নতুন ফর্মুলা ইফতারি-ঈদ কার্ড। শীর্ষসন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীনদের নামে ইফতারি-ঈদকার্ড দিয়ে এসব চাঁদা আদায় হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব  যে-কোনও ধরনের বেআইনি কর্মকা- প্রতিহত করা। একই সঙ্গে চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া এবং অপরাধীদের আটক-গ্রেপ্তারপূর্বক বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে এর উল্টো চিত্র। চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের শিকার যারা, তারা পুলিশিসাহায্য নিতেও সাহস পাচ্ছেন না। থানায় চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা-জিড়ি করতে গেলে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে উল্টো ক্ষতিগ্রস্তদেরই। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ___ মামলা তদন্তের চেয়ে থানাপুলিশ পকেট ভর্তিবাণিজ্যে বেশি মনোযোগী। এ কারণে এসব ঘটনার কোনও কূলকিনারা হয় না।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ___ চেকপোস্ট আর মহাসড়কে মালবাহী গাড়ি তল্লাশির নামে পুলিশ ঈদকেন্দ্রিক চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছে। গৃহমুখী মানুষ এবং নিত্যপণ্যবাহী গাড়ি এখন পুলিশের ঈদ-বখশিসের অন্যতম উৎসে পরিণত। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ বহু পুরনো। বাংলা প্রবাদবাক্য___ ‘শর্ষের ভেতর ভূতের’ সার্থকতা আর কোথাও না থাকুক, বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীতে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যে বাহিনীর কাজ, আইনলঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটানো এখন সেই বাহিনীর জন্য নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ থেকে  মুক্তির উপায় কী?
সমাজে সংঘটিত বেআইনি কর্মকাণ্ড রোধে দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আর সে বাহিনীই যদি আইনলঙ্ঘনে জড়িত থাকে, তাহলে তাদের প্রতিরোধ করা সমাজের সচেতনশ্রেণীর কর্তব্য। এর জন্য চাই___ নৈতিক সততা, চারিত্র্যিক দৃঢ়তা ও তীব্র মানসিক শক্তি। অর্থাৎ শর্ষের ভেতর থেকে ভূত তাড়াতে হলে, আগে প্রয়োজন ভূত তাড়ানোর মন্ত্র জানা। আবার মন্ত্র জানাও সব নয়। জানতে হবে প্রয়োগবিধিও। তবেই ভূততাড়ানো ওঝার কৃতিত্ব! কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালি সমাজের প্রথা এই যে___ কোনও তথা-ভূতগ্রস্তকে ভূতের আছরমুক্ত করার কাজটা ওঝা একা করে না। সঙ্গে থাকে তার সমান দক্ষ একাধিক সহযোগী। তারাই মূলত ভূত তাড়ানোর কাজটা সম্পন্ন করেন। এক্ষেত্রে শর্ষের ভেতর যে ভূত রয়েছে, তাও তারাই শনাক্ত করেন। কারণ তারা চেনেন, কোনটা ভূতের চোখ আর কোনটা শর্ষের দানা। 
একটি সমাজে যখন অবক্ষয় শুরু হয়, তখন সর্বত্রই এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তখন যার থাকার কথা অন্তরালে সে বেরিয়ে আসে মঞ্চে। যার হওয়ার কথা রক্ষক, সে হয়ে ওঠে নিষ্ঠুরতম ভক্ষক। এরই স্বাভাবিক পরিণতি ঘটেছে পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রে। যেখানে পুলিশের ঠেকানোর কথা ছিনতাই-চাঁদাবাজি, সেখানে এই বাহিনীর সদস্যরাই জড়িয়ে পড়ছে এ ধরনের বেআইন কর্মকাণ্ডে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জনসাধারণের কাছ থেকে পারিতোষিক, উৎকোচ আদায় আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৬১ ও ৩৮৫ ধারার বিধান মতে মামলা দায়ের করা যায়। কিন্তু থানায় যদি কেউ মামলা করতে চায়, থানা পুলিশ সহজে মামলা নিতে চাইবে না__ এটাই স্বাভাবিক।
জনসচেতনতা ও গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে এই চাঁদাবাজি বন্ধের পরামর্শ দিতে হয়তো দেবেন সমাজকর্মী-অপরাধবিশেষজ্ঞরা। কিন্তু গণপ্রতিরোধের একটা বিরাট সমস্যা হল___ দেশের সংবিধান বা কোথাও জনগণকে বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পরন্তু বিভিন্ন রকম অসমাজিক কর্মকা- বন্ধে পুলিশি সহায়তা চাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর এক্ষেত্রে ৫৪ ধারায় পুলিশকে বরং এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যে ক্ষমতা বলে, পুলিশ যে কাউকে আটক করতে পারে। শেষপর্যন্ত পুলিশ ৫৪ ধারার ক্ষমতার অজুহাতে যে কাউকে যে কোনও স্থানে আটক করে হয়রানি করার সুযোগ নেয়।
পুলিশি হেফাজতে মানুষের মৃত্যুর অভিযোগ অনেক পুরনো। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমানের হাতে ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজন খুন, বরিশালের গৌরনদীতে দাবিকৃত ১ লাখ টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রবাসীর ছেলে কম্পিউটার ব্যবসায়ী শাহীন মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা, ১ হাজার টাকার জন্য আশুলিয়ার নবীনগরে চা-বিক্রেতা রিপন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষকে ভীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। পুলিশ এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেসব কারণ দাঁড়ায় করায়, সেগুলো অনেক চেনা ও বহুলব্যবহারে মানুষের মনে বিরক্তি জন্মেছে। পুলিশের দাবিমতে, অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় পুলিশের সঙ্গে কেবল পুলিশের ৩৯ ও র‌্যাব- পুলিশের সঙ্গে যৌথ বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হন।
পুলিশের হওয়া উচিত জনগণের সেবক, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাহারাদার। কিন্তু এই বাহিনীর সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়েন কেন? এখন সময় এসেছে___ এর উত্তর খুঁজে বের করার। এই দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্রের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন