শনিবার, ৩১ মে, ২০১৪

আত্মধ্বংসের বিপক্ষে কবিতা ।। আহমেদ স্বপন মাহমুদ


রাজার পোশাক

রাজার পোশাক পড়ে প্রজারা
রাজা সেজে বাজারে এসেছে
এই অনভিজ্ঞ অভিলাষ সংকেতময়-
ক্রমাগত লাল ও সবুজ ভেঁপু বাজাচ্ছে।

সমস্ত অসুখ, আগুন ও জ্যোৎস্না
শুয়ে আছে রাত্রির গায়ে
অভিনয়ে!

অনুচিত ক্ষত হয়ে-

রাজার পোশাক পুড়ে প্রজাদের ঘরে!


কাণ্ড

আসুন আমরা পরিণতির কথা ভাবি।
আপাত-কৌশলে যেসব মাছ কাদায় মুখ লুকিয়ে ভাবছে সাফল্য-বৃত্তান্ত,
চূড়ান্ত রোদের আঁচে তারাও জলহীন হয়ে পড়বে ক্রমশ।
যতসব খুন ও উন্মত্ততা অবিকশিত বাজারে
থামবে না নক্ষত্র না দেখা পর্যন্ত।
ক্ষণসময়ের আলেয়া দেখে যারা আলোর মুখোমুখি
তারাও অন্ধকারে ডুবে যাবে অচিরেই।
বাজারে নতুন পোশাকে যারা নেমেছে তারাও অত্যাচারী-
রূপকথার রাজা-উজিরের সাথে আধুনিক মারণাস্ত্রের অনেক তফাৎ।
বুদ্ধির বহর খুলে যারা বাহবা দিচ্ছে বলপ্রয়োগে,
তারাও ডুবে মরবে খুনের নদীতে।

কোনো জল নেই চরাচরে, কোনো পারাপার।

আসুন আমরা পরিণতির কথা ভাবি,
মুখ ভার করে বসে থাকি।

রাজার কাণ্ড দেখে হেসে খিলখিল টিকটিকি!

২৮ ডিসেম্বর ২০১৩




শ্বাসরুদ্ধকর

দম ফেলবার আগে আপনি রাজার অনুমতি নিন।
পা ফেলার আগে পিস্তল ও বন্দুকের নল
তাক করা কিনা দেখে নিন পুনরায়।

আপনি মানুষ কিনা বারবার ভাবুন।

মানুষের পোশাক আইন ও রাজার গায়েই
মানানসই, ভাবছে পামর চাটুকাররা
সমস্ত বুলি তারা রপ্ত করেছে, সাময়িক-
আপনার মাথা সংবিধানসম্মত গুলি ভেদ করবে
আইনি হাতে। আপনি খুন হবেন, অমায়িক!

শ্বাসপ্রশ্বাসের আগে ছাড়পত্র নিন
কথা বলার প্রাক-অনুমতি
আইনি হাত যত লম্বা আপনার তত খাটো।

ক্ষমতাপন্থি না হলে আপনি মানুষ কিনা বারবার ভাবুন।


পরিস্থিতি বদলাবার আগে আপনি মানুষ নন;
আপনার পোশাক সংবিধান ও রাজার গায়ে
আইনসম্মতভাবে হাসছে, এমনকি এই শীতকালেও।

পরিস্থিতি বদলাবার পর আপনি মানুষ হয়ে উঠুন।

২৮ ডিসেম্বর ২০১৩



শঙ্কার শীতকাল

চরম বিপদগ্রস্ত না হলে কেউ আঙুল চুষতে চায় না।
আমাদের এখন ঘটা করে আঙুল চুষবার পালা।
অনন্যোপায় সমবেত তর্জনী নুয়ে পড়লে
খুন ও নৃশংসতায় হেসে ওঠে চেতনাসকল!

শীতকালে কুয়াশার ভয়, অনাচার কম নয় জেনে
তোমার দিকেই হেলে রয় মাঝে মাঝে তৃষ্ণার অধর;

ডর ও লড়াই প্রতিকূলে, মন তাই ফলমূলে যেতে চায়
সন্ধ্যায় আগুনে পোড়ার ভয় এড়িয়ে
আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ফলমূল-

শীতকালে মদ, ফল ও তার নিপল ভালো লাগে!

আঙুল চুষার বদলে এই কাজটি অনেক মহৎ
স্বৈরিণী সময়ে তোমার কাছেই সকল পরাজয়,
দেশ শঙ্কায়, কী জানি কী হয়!

২৭ ডিসেম্বর ২০১৩


চিহ্ন

তৃতীয় চোখে তুমি নাসপাতি
অপর পৃথিবী- চিহ্ন ছেড়ে জেগে ওঠেছো
পানশালার বাইরে- সুপক্ব মিহি ত্বক ছেড়ে
মহাজাগতিকহীন।

আমি ইন্দ্রিয় পরায়ন, ঘ্রাণ থেকে
মাংসাসী পযর্ন্ত রিপুর কারিশমা
দেখে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন হয়ে
অতীন্দ্রয়তায় পড়ে থাকি!

তৃতীয় চোখ দেখে বুঝতে চাই
জগত ও বহির্জগতে নোঙর করা
জাহাজের মাস্তুল কতটা ইর্ষা পরায়ন!

তৃতীয় পক্ষ চিহ্নের অধিক সমীচীন জেনে
হাসিচিহ্নগুলো বারবার চিমটি কাটছে, কটাক্ষে
নাসপাতি হাসছে।

ডিসেম্বর ২০১৩

উপ-বিকল্প সম্পাদকীয় : মোহাম্মদ নূরুল হক

 

 
†iv‡`i AuvPo
wPr n‡q ï‡q _vKv gvby‡li †PvL Auv‡K Qv‡`i AvKvk
Zviv¸‡jv g‡i †M‡j M‡j hvIqv ivZ¸‡jv wVK †R‡b hvqÑ
GKevi b`x‡`i ag©N‡U KweZviv †XD G‡bwQj|
†mevi wk‡LwQjvgÑP‚ovq DV‡Z †bB; P‚ov Lye †QvU
Avwg Rvwb gy‡VvfwZ© b`x¸‡jv †Kv‡bvw`b P‚ovq I‡Vwb|

m¤ú‡K©i †eYx a‡i cZ‡bi cvøywjwc cvV K‡iv hw`
BwZnv‡m a~‡jv R‡g, evZv‡mI jv‡M †mB †iv‡`i AuvPo
GKSuvK AÜKvi Lyu‡U Lvq P‚‡ovi DÌvbÑ
cZ‡bi bxwZ Av‡QÑN„YviI BwZnvm|
nq‡Zv wbwLj bx‡j Qwe Auv‡K wPiAÜ Av‡jvi mš¿vm;
Avgv‡K Dš§v` †f‡e gvBj-gvBj ivZ wM‡j wM‡j Lvq|
cÖZviK wPÎKi;
Avgv‡K cvq bv Lyu‡R wgwQ‡ji Av‡M-c‡i †Mv‡q›`v evqm!

GB bvI mvܨb`x; m~h© g‡i †M‡j w`‡qv gvZvj PzgyK
Avgvi c‡KUfwZ© Z…lvZzi ˆP‡Îi AvKvk
gM‡R †¯øvMvb Zz‡j †R‡M _v‡K ivZ¸‡jv Av‡jvi Kv•ÿvq
P‚ovq I‡V bv b`xцh I‡V †m cy‡o g‡i  Zzgyj N„Yvq|

R‡ji Aÿ‡i †jLv iƒcK_v¸‡jv 

†KejB ¯^cœ Avi ev¯Í‡ei Zzgyj Awg‡j
c„w_ex I nƒ`‡qi `~iZ¡ †g‡cwQ
†f‡ewQ g„Zz¨i w`b gvby‡liv cZ½¯^fv‡e
Ny‡i Ny‡i ¯^cœ †`‡L Zij ivwÎi|

AvKv‡k DošÍ b`x Wvbvi cvjK wM‡j Lvq
Kzgvix ¯Í‡bi g‡Zv _‡iv_‡iv †iv‡`i AmyL
eûw`b e„wó †bB gv‡V gv‡V MwjZ Av¸b
Avgv‡`i `„wó Zey m~h© fv‡jvev‡m!

Pvwiw`‡K †iv‡`i wgwQj
evZv‡miv D‡o D‡o †g‡Ni mš¿vm
†Pv‡Li †KvU‡i bv‡g dvwj dvwj jvj ZigyR
wÎfzR evZv‡m fv‡m †iv‡`i cvjK
Avi †divwi †hŠeb
wkgyj Zzjvi g‡Zv †b‡g Av‡m eq¯‹ `ycy‡i

Avgv‡`i g‡b n‡Z _v‡K
GLv‡b kÖveY wQjÑe„wó n‡Zv cÖv_©bvi g‡Zv
AweKj cøve‡bi w`bÑ
jwL›`i †`‡LwQj MvOfiv g„‡Zi fvmvb
g‡b n‡Z _v‡KÑ
Gfv‡e bxj Kgj dzu‡m D‡VwQj
†µv‡ai Av¸b Zvi R¡‡jwQj i‡³i †fZi|

    
†`k‡cÖg welqK †mwgbvi †_‡K wd‡i

G fv‡e ZvKvI hw` AvZ¥vi †fZi ïwb cZ‡bi WvK! ÿzavZ© evN¸‡jvi KiæY gy‡Li w`‡K ZvKv‡Z ZvKv‡Z, wb‡R‡K Lye GKvKx g‡b nq, g‡b nq AvwgI nwiY| niàvi b`xRy‡o ïiæ n‡j m~‡h©i †iv`bÑwPr n‡q ï‡q _vwK; `„wóRy‡o Qwe Auv‡K Ph©vi AvKvk| nwiY I  evN welqK †mwgbv‡i wkKvixiv N„wYZ Z¯‹i| Avgv‡`i ivóªhš¿ fv‡jv †P‡b †kK‡ji Uvb; Avwg †M‡j D‡o D‡o `~i MÖn‡jv‡K, msm‡` wej I‡VÑ gvSiv‡Z †W‡K I‡V cÖvPxb ZÿK! Zey †Kb fv‡jvevwm cuPv Wvj, †ik‡bi Pvj? NygšÍivRKb¨vi †Pv‡L ¯^cœ bv‡g c½cv‡ji gZb| Avgv‡`i Nyg ZvB P‡j hvq †¯^”Qv wbe©vm‡b| dzu‡m I‡V RbZvi Xj| Gw`‡K mgy`ªRy‡o nvO‡ii †mªvZ gvby‡li i³ fv‡jvev‡m| jwL›`i cy‡o †M‡j gbmvi †µv‡ai Av¸‡bÑwek¦vq‡b †f‡m hvq Avgv‡`i †cÖg| †mwgbv‡i So †Zv‡j Zzgyj ZvwK©KÑZzwg †Kb Clv‡Yi fvlv fz‡j WvK bv‡g Wv‡Kv?



ক্রীতদাসের ইতিকথা

বন্ধুরা জানেন__ কবির ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয় না কখনো।
কবি বলেছেন, মানুষেরা ফিরে যাচ্ছে দাসযুগে।
সঙ্গমে অনীহ তারা, ধর্ষণে তাই সুখ খোঁজে।
মানুষেরা খুন করে মানুষের আশা, খুন করে আশ্বাস-বিশ্বাস।
এইসব মানুষের রমণ-গমণ-ক্রোধ সবই দাসের মতন।

ক্রীতদাসেরা
কে কার আগে খুলবে নিজের মেরুদণ্ড, নামে এই প্রতিযোগিতায়;
কে কত মেরুদণ্ডহীন, কার ঘটে কত তেল, সকলই গরল ভেল
যদি না কাজে আসে, মনিবের চরণমালিশে।
এই তেলমালিশেও আছে নানা কায়দাকানুন।
অকারণেই কারও-কারও মাথা নত থাকে।
কারও কারও মেরুদণ্ড খুলে পড়ে অবিকল কেঁচোর মতোন।
আর তারা গড়াগড়ি খায় অর্থেশ্বরের পায়ে চুমো খেতে-খেতে!

সবচে গোপন সত্য___ক্রীতদাসেরা দাস হতো দ্বৈবচক্রে
আজকাল মানুষেরা ভালোবাসে কৃতদাস হতে।

প্রশ্ন সিরিজ: ১

আমার মৃত্যুর দিন চারিদিকে বয়ে যাবে সুরের ঝরনা
একফালি বাঁকা চাঁদ দুলে-দুলে এঁকে যাবে অনন্ত অতীত
লাল-লাল সূর্যাস্তের পশ্চিম আকাশ__আর তারার উঠোন।
আমার যত অচিন্ত্য দিন, রঙিন দুপুর, সাতরঙা সন্ধ্যা
মুত্যুরে করেছে হেলা___তারা সব ভীড় করে দাঁড়াবে তখন।

ডান চোখে জলভরা দিঘি আর বাম চোখে বহমান নদী
ডানাঅলা মাছগুলো সাঁতার ভুলেছে দেখো ওড়ার আনন্দে।
অথচ তাদের কথা ছিল উড়ে উড়ে দূর কোনো বিশ্বে যাওয়ার
কিন্তু আকাশে মেলেনি ভিসা, মেঘেরাও ডেকেছিল ধর্মঘট।

আমার দিনের সূর্য অস্ত গেলে তোমার রাত্রিকে ডেকে এনে
মৃত সব নক্ষত্রের আহ্বানে জেগেছ তুমি কুটিল চিন্তায়।
আমি যাব জলগন্ধা হিজলের বনে-বনে ঘুরে ঘুরে কোনো
এক নিশিপাখি-ডাকা গ্রামের ভেতর।
তোমাকে কী করে ডাকি বলো সেই নিঃসঙ্গ জীবনে আমার?

সংশয়

দাঁড়িয়েছিলাম মেঘের জানালায়
ভেতর থেকে মারেনি কেউ টোকা
বুকের ভেতর ভাঙলো হঠাৎ ঢেউ-
কৃষ্ণ কেন বাঁশিতে ফুঁ দিলো

রাধার বুকে ঘুমিয়েছিল কেউ?

আকাশে সেই পুরনো চাঁদ হাসে
বাতাস বাজায় সেই পুরনো বাঁশি
তবে কেন আমি আবার ছুটি

ঘুমের ঘোরে নদীর ঢেউয়ে-ঢেউয়ে?

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অথবা নীরবতাকে


জানালার পাশে কেন? ওখানে তোমাকে ভালো লাগছে না।
যদি পারো নেমে এসো এইখানে__এই মাঠে বৃষ্টির সংগীতে
যদি আসো__বৃষ্টির এস্রাজ শুনে শুনে ভেসে যাব মেঘের সাম্পানে
তুমি শুধু উড়ে যাবে খোলাচুলে।  আর আমি রঙিন প্রজাপতির
ডানা থেকে রঙ এনে নদীরপ্রচ্ছদে এঁকে যাব প্রেমের কবিতা।

জানো মেয়ে জানালার বাইরে কিছুই নেই, ওখানে ধুধু প্রান্তর
ওখানে কৃষ্ণচূড়ায় ফুল নয়, গুচ্ছগুচ্ছ সূর্যের আগুন
তোমাকে ভষ্ম করবে পুড়িয়ে-পুড়িয়ে
তুমি এমন নীরব থাকলে কবি কষ্ট পাবেন, জানো তো__
নীরবতা ভালো নীরবতা ভালো, শুধু মৃত্যুর চেয়ে।

অপেক্ষারও মাত্রা আছে, ধর্যেরও সীমা


অপেক্ষারও মাত্রা আছে, ধর্যেরও সীমা।

শিখেছি মেঘের কাছে___পৃথিবীতে নারী ও নদীর
মতো প্রবহমান কিছু নেই।
তবু আমি ধর্য ধরে থাকি
কেন যে আমাকে
এমন জৈষ্ঠ্যের রোদে পুড়িয়ে-পুড়িয়ে
ভষ্ম করে____

মনেরে কত বার বলি : তুমি একা ছিলে, একাই থাকো।
কার এত গরজ পড়েছে যে, সাড়া দেবে তোমার ডাকে!

মন তবু কাকে যেন ডেকে বলে__
কেন যে আমাকে ধর্যহীন করো তোলো তুমি!

মানুষ কেন আত্মহত্যা করে

হঠাৎ মেঘে ভেসে এলো আওয়াজ
আকাশ ভরা চাঁদের আলাপন
তারারা গায় মন খারাপের গান
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?


হঠাৎ যদি কেঁদে ওঠে নদী
পাহাড়ও কি উড়াল দিতে চায়
সাগর আমার সহপাঠী হলে
হাজার মাইলের রাত্রি তবে কার?

রাত্রি তো নয়, সকালও নয়, তবু__
সূর্যকান্ত শিশুবৃক্ষ ছায়া
কাঁপলো কেন? হাসলো কেন হাওয়া?

হঠাৎ কেন তারারা আজ রাতে
যমুনা নয়, গোমতীও নয়, শেষে
মেঘনায় এলো কবিতা ভাসানে?


কে বলেছে কবিতা পাঠ? কে?
জীবন ঘষে প্রশ্ন তোলা  যে!
আঁধারজোড়া রাত্রি আছে, রাতও
তবুও নদী আদিম প্রশ্ন তোলে___
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?


আমার সম্পর্কে  লোকেরা মনে-মনে যা বলে

লোকটা আকাটমূর্খ। কিছুই জানে না। তবু মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটে।
বাদশাহী ভাবখানা। শালা, বদরাগী! বদের হাড্ডি। কাউকে তোয়াক্কা করে না।
কেমন নির্বিকার দিন কাটে তার। কারও কথায় বিচলিত হয় না তেমন।

এই তো সেদিন এলো নগরে। অথচ ভাব দেখায়, বহুকাল ধরে আছে।
দুদিনের যুগী শালা, কথা বলে আমাদের সমানে-সমান।
ঠোঁটকাটা। অপরিণামদর্শী। অসহ্য লাগে, অসহ্য তার-সঙ্গ।
ইচ্ছা করে___ ঘাড় ধরে বের করে দিই___ লাত্থি মারি পাছায়।
শালা গ্রাম্য রাখাল। নগরে এসেছ; ঘুঘু দেখেছ; ফাঁদ দেখোনি।

আমরা কত কী জানি, তুমি তার তিলার্ধও জানো না। অথচ সেই তুমিই
আমাদের করো চরম অবজ্ঞা। বলো, আমাদের এই হয় না, সেই হয় না।
আমাদের চলনে দোষ, বলনেও। শালা গ্রাম্যরাখাল নগরের হাল-চাল
কী বুঝবে তুমি? তোমার পুংটামি বড় বেশি বিরক্তির। কখনো-কখনো ভয়ঙ্কর।


নগরের রীতিনীতি কোনোদিন বুঝবে না তুমি। এসেছ গ্রাম থেকে, গ্রামেই ফিরে যাও।


ময়নাতদন্তের পর লাশের উক্তি

আমার মৃত্যুর পর যারা বেশি খুশি হয়েছিল, তাদের কান্না দেখে অনেকে মনে করেছিলেন আমার মৃত্যুটা বুঝি তারা মেনে নিতে পারেনি। আসলে রোদনবিলাসীদের ক্ষোভ ছিল___ আরও আগে কেন মরিনি! আমি তো অনেক আগেই মরতে চেয়েছিলাম, জীবনানন্দের মৃত্যুর দিন। জীবনানন্দ আমাকে প্রলুব্ধ করেছিলেন। বলেছিলেন, এসো আমরা দুজনে একসঙ্গে মরে যাই। পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকা আসলেই অর্থহীন। এসো মরণে হই ইতিহাস। জীবিত আমাদের মূল্য কানাকড়িও নেই। কবির কথা বিশ্বাস করিনি। ফলত কিছুদিন পর জীবনানন্দের মরনোত্তর-খ্যাতি দেখে ভাবলাম আমার মৃত্যুর সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু যমদূত আমাকে এতটাই ভয় পেতেন যে আমার ত্রিসীমায় ঘেঁষার সাহসই হলো না তার।  শেষপর্যন্ত  স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে-ই এলাম। আমার মৃত্যুর পর লাশ পড়েছিল বহুদিন বারান্দায়-উঠোনে। যারা আমাকে কোনো না-কোনোভাবে ঈর্ষা করতেন, তারা আমার মৃত্যুতে এমন ভান করলেন,  যেন সহমরণে যাবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো__ আমার মৃত্যু যাদের খুব কাম্য ছিল, তারা আমার মৃত্যুর দিন এমন ডুকরে কাঁদলো কেন? তবে কি আমার লাশের গন্ধে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল?


ছবি
জোছনার নখের আঁচড় লেগে থাকা রাতের উঠোনে
জেগে থাকে একজোড়া নিরীহ আকাশ।
আমাদের সন্ধ্যাগুলো ঘনমেঘে ঢাকা
একজোড়া কবিতার রাজহাঁস জলে নামে কেন
কেন তবে দুচোখের কার্নিশ পোড়ানো ছবি আঁকা!

কত দিন নদীদের সমুদ্রসঙ্গম দেখে দেখে
একজোড়া চাঁদ এসে লিখে গেছে হাঙরের প্রেম
ওই ছবি এঁকে গেল অদেখা রোদ্দুর
আমার চোখের ডান পাশে তবু জ্বলে ওঠে নদী
কেন তবে আমি হব এই রাতে প্রেমিক মৃত্যুর?


এপ্রিলের রাত

তোমাকে দেখি না। দেখি__ মাঝে-মাঝে জানালায় ওড়ে
তোমার শাড়ির নীল আঁচলের মতো একখø
বয়স্ক রাতের নদী। এপ্রিলে প্রলাপ বকে কারা?
মুখভর্তি ডিম নিয়ে যন্ত্রণায় কাতর মাছেরা
পাড়ি দেয় অন্ধকার সময়ের ঘড়ি; চোখজোড়া
স্বপ্ন নিয়ে জেগে থাকে মাইল-মাইল কালো রাত।
এইসব স্বপ্নবান ভোরের নদীরা উড়ে যায়
ডানাঅলা মেঘ হয়ে কালিদাস্য শ্রাবণসন্ধ্যায়;
আহা রাজকন্যাদের চোখে শুধু ঘুম আর স্বপ্ন
নামে। সোনার কাঠিরা ভেঙে গেলে রূপার কাঠিরা
অন্ধকারে চাঁদ ভালোবাসে। সূর্য তবু দেশান্তরী।

জানালার পাশে বসে দেখি নীল আকাশের তলে
বৃক্ষগুলো গান শোনে শব্দহীন বাতাসের কানে
একঝাঁক ঝরাপাতা পুড়ে গেলে কারো দীর্ঘশ্বাসে
ভেঙে পড়ে চিরায়ত লাল-নীল মিথের প্রাসাদ,
সত্য তবু প্রিয় নয়; যত প্রিয় মোহন মিথ্যারা!
আকাশ উড়াল দিলে আজকাল বিষণœ সন্ধ্যায়
নির্ঘুম কদম তবু ভালো চেনে পার্বতীর খোঁপা
এ বড় রহস্য জানো__ এপ্রিলের বয়স্ক রাতেরা
একা পেয়ে ঢেউ তোলে কামে-প্রেমে শরীরে আমার!

বাম চোখে চোখ রেখে পাড়ি দিলে কালরাত
অশোকের শিলালিপি থেকে যায় আজন্ম ধূসর;
তোমাকে পাই না কাছে; স্বপ্নে তবু ধরা দাও বুকে।


জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকলে মনে-মনে যা বলতেন

তবু তুমি চুপ থাকো, এই সব শুয়োরের ঘোঁৎ-ঘোঁতে কষ্ট পেয়ো না মানুষ। আত্মশ্লাঘায়  ভোগা শুয়োরেরা কোনোদিন মানুষেরে করেনি সম্মান। এই সত্য মেনেছেন সক্রেটিস-গৌতম-যিশু-মুহাম্মদ। তবে আর তুমি কেন কষ্ট পাও? তুমি কেন পারো না মেনে নিতে? তুমি  তো তাদের মতো নও, তুমি তো পথের মানুষ, ঘোরো-ফেরো পথে-পথে।  চাঁদের বুকের ঢেউকে যারা কলঙ্কের দাগ বলে প্রচার করে, তারা হয়তো সুখ পায় মিথ্যাচারে। কিন্তু চাঁদের তাতে কী আসে-যায়?
জানো  তো, অপমানে যে জ্বলে ওঠে সে হয়তো সাহসী; কিন্তু যে চুপ থাকে সে বড় দুঃসাহসী!


জোনাক রাতের ছবি


কবির রাত্রি নিদ্রাবিহীন নদী
সঙ্গে জাগে মাতাল চাঁদের ঢেউ
হালকা হাওয়ায় মেঘের আঁচল ওড়ে
ঢেউ ভাঙে কার হৃদয়-উপকূলে
জোনাকি নয়, চিত্রকল্প পোড়ে।

শরীরের আর কী দোষ তবে বলো
রাত্রি কাটে সঙ্গীবিহীন চাঁদের
ভরা ফাগুন, বয়স যখন সিকি
এই বয়সে পোড়ায় আগুন, পোড়ায়
জোনাকরাতে শরীরের সব দিকই!




মিথ্যা

পকেট ভর্তি মিথ্যারা তুমুল বিতর্কে মেতে ওঠে
ঢেউদের জুতো পরে নাকি মেঘ পার হতে হতে
পোয়াতি নদীরা ঠিক রাত্রির দূরত্ব মেপে রাখে
এদিকে ফেরারি সূর্য অভিমান ভুলে__
নদীর কোমর খুলে জলরঙে হাওয়াদের ডাকে!

ফেসবুকে খুদে বার্তা পাঠানোর আগে
একজোড়া চাঁদ দেখে মৃত্যুদণ্ড লেখে দূর্বাঘাস
মানিব্যাগে ক্যাশকার্ড পুড়ে যায় ফার্স্টফুডে গেলে
যখন জেনেছি রাত মুখরা রমণী__
চোখজোড়া  উপমার স্বপ্ন নিয়ে কেন তবে এলে?


এপ্রিল : ২০১২
১.
হলুদ সন্ধ্যায় ওড়ে মৃতসব নক্ষত্রের লাশ
তবু যে হৃদয় বলে, এই তো সময়
আমাদের ভেসে যাওয়া স্বপ্নসাধ শ্রাবণের রাত
মুহূর্তের জন্য তবু মৃত্যু ভালোবাসে!

চারিদিকে অফুরান সময়ের স্রোত
প্রাণের কল্লোল আর মানুষের মুখের মতন
বোশেখের মেঘ এসে বলে তবু : এই তো সময়!
আহা ঝড়ের তাøব মানুষের মৃত্যু ভালোবাসে!
তবু ওই বোশেখের মেঘ যেন রমণীর মুখ
ঠিক যেন গলে যাবে মোমের আগুনে।
বৃক্ষদের নীরব স্লোগানে
মেঘের গর্জনে
যে সব অমোঘ সত্য শুনেছি, জেনেছি এতকাল-
সেই সব অভিজ্ঞতা সমস্বরে বলে;
বলে অবিকল মানুষের মতো : এই তো সময়!

কোনো এক দৃশ্য আকি; এঁকে রাখি ঘুমের ভেতর
তুলির আঁচড় তবু ভালোবাসে মেঘলা জমিন
বামচোখ বন্ধ রেখে হেঁটে গেলে রাতের আকাশ
মাছ ভেবে চুমো খাই মেঘেদের গালে
অসৎ নদীর স্রোতে ভেসে গেলে মৃত লখিন্দর
জোছনার গান শোনে হাঙরের ঝাঁক
মাছের চোখের মতো স্থির দিন বুড়ো হতে থাকে
জš§ান্ধ ফড়িঙ তবু এঁকে রাখে চারকোনা চাঁদ।

অথবা স্বপ্নের ইতিহাস
মুছে ফেলে রোদের প্রচ্ছদ
লিখে রাখে নিশাচর মানুষের দুর্বোধ্য স্বভাব।
তোমাকে যেদিন পাখি ডেকেছিল ঘুমের ভেতর
বলেছিল : অনুবাদ করে দাও অপাঠ্য আকাশ;
সেদিনও অবিকল মেঘের ভাষায়
গান গেয়ে পাখিগুলো বলেছিল : এই তো সময়!

২.
সবাই বসে আছেন মুখোমুখি হাতে হাতে বিয়ারের গ্লাস।
সে আসরে আমি-
আমার সব লাম্পট্য মেপে দিয়ে হৃদয়ের দরে
চুপচাপ মনোযোগী শ্রোতা!
গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকি, স্মৃতি রোমন্থন
রাজনীতির বিবিধ হিসাব-নিকাশ
অবিকল উঠে এলো কজন বাউণ্ডুলের মহার্ঘসভায়।
সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন তখন;
আজন্ম আসক্তিহীন আমি
সিগারেট-হুইস্কি-বিয়ারে
তবু
মেতে আছি স্মৃতির সভায়
একজীবনে মানুষ কতকিছু পায়; হারায় তারও বেশি
আমিও কি হারিয়েছি কিছু?
ভালোবাসা, প্রিয় রাত্রি? মৃত্যুর মতন প্রিয় ঘুম?
আমার কি কোনো তাড়া ছিল, মনে পড়ে গিয়েছিল কোনো প্রিয় মুখ?

তবে কেন-
আমার বিনিদ্র রাতে উড়ে যায় আকাশের ছাদ
একমুঠো তারা জ্বলে চোখের কার্নিশে
তুমি এসে মুখ তোলো, তুমি এসে জোছনার নদী!

আকাশ মেঘলা হলে কার ক্ষতি বলো?
তোমার ডাক নামের মতো মনে পড়ে শিশুকাল
অবুঝ দোয়েল ডাকা বিষণ্ন দুপুর
রূপার থালার মতো গলে গলে পড়ে যেন রোদ
আমার বিনিদ্র রাতে চুপচাপ নেমে আসে যদি
রূপার থালার মতো থকথকে সূর্য
অথবা ক্ষুধার্ত চোখজোড়া জ্বলে ওঠে আজ কারও-

কেন তবে গান করো প্রেমহীন পৃথিবীতে আর?


আমার হত্যাকারীর প্রতি

আমাকে হত্যার আগে ছুরিটায় শান দিয়ে নিয়ো
গোলাপের পাপড়ির ঘ্রাণে দেখে নিয়ো একবার
আমার হৃদপিণ্ডের ভেতর কেমন জেগে থাকে
আমার হত্যাকারীর প্রতি ভালোবাসা। বিকেলের
সব নদী নদী নয়, কিছু নদী নক্ষত্রের রাধা!

আমাকে হত্যার আগে লিখে রেখো ঘৃণার কবিতা
আমার চোখের কোনে ফুটে থাকা চাঁদের প্লাবনে
ভেসে গেলে লোকালয়__ভেঙে গেলে মেঘের প্রাসাদ
মানুষেরা ভাবে বুঝি__পেয়ে গেছি প্রাণের অকুল...
তোমার বুক পকেটে ডুব দিলে আলোর জোনাক
আঠার হাজার নদী তবে বলো কেন উছলায়?
আমার ঘুমের নাম শ্রাবণের অমাবস্যা; জানো?
কালোরাতে পানকৌড়ি উড়ে গেলে ডানার হাওয়ায়
তুমি এসে খুন করে চলে যেও আমাকে তুমুল।

আমাকে হত্যার আগে হাত ধুয়ে নিয়ো যথারীতি
আয়নায় দেখে নিয়ো মাতালের মুখ;
আমি জানি তুমি সেই নির্দয়-নির্মম হত্যাকারী।
জানতে চাও__
         কেন আমি আত্মহত্যা করি না কখনো?
জানো তুমি প্রতিবার আমি শুধু খুন হতে থাকি
কেন আমি অপেক্ষায় থাকি এক হন্তারকের?

আমি জানি তুমি সেই হন্তারক; তুমি সেই খুনি
শোনো খুব ভোরে এসো; নাস্তার টেবিল পার হয়ে
দেয়ালের ঘড়িটার মতো উল্টোমুখী থাকো যদি
দেখবে আমার মেয়ে__আমার স্ত্রী টেরই পাবে না;
দ্বিধাহীনচিত্তে তুমি বসাতে পারবে নীল ছুরি
গরম ভাতের ধোঁয়া ওঠা দেখো যদি বুঝে নিয়ো
একজন লালনের কান্না বড়__ কৃষ্ণের হৃদয়!
তোমাকে বসতে দিয়ে জানালার ছবি এঁকে নেব
বাতাসের আর গতি কত, যত জোর বিশ্বাসের
তোমাকে বিশ্বাস করে আইহন গেল দূর দেশে
তুমি কেন বৃন্দাবনে ছল করে বাজিয়েছ বাঁশি?

রান্নাঘর খুব প্রিয় নয় যাদের, তাদের ভাগ্য
সুপ্রসন্ন হয় মাঝে-মধ্যে; তবে চিরকাল যেন
মাঠে-ঘাটে আর ক্ষেতে যারা শ্রম দেয়, তারা নাকি
নিজের মগজে জ্বালে স্বরচিত সূর্য; অতএব
আকাশকে সাক্ষী রেখে হেঁটে যাও মেঘের আগুনে।

সেখানে প্রিয়নারীর ঘৃণাগুলো অনূদিত হয়
লালরাত্রির ভাষায়; তুমিও কি মধ্যরাতে কাঁদো
ভালোবাসো লালরাত্রি, রক্তলাল মানুষের দেহ?
এসো প্রাজ্ঞ, হে ব্রুটাস, করো খুন আমাকে এবার।


মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা

এদিকে মত্যু আসন্ন!
মানুষেরা ভুলে যায় যৌবনের লাভা আর রূপের আঙুর।
মেঘের শয্যায় কেন ঘুমায় আবার
এইসব চিন্তা বাড়ে হলুদসন্ধ্যায়
সব মেঘ মেঘ নয়__ কিছু কিছু হাওয়ার ছলনা
স্বপ্ন আর বাস্তবের যুগ্মছবি এঁকেছিল যারা
একদিন তারা সব উড়ে উড়ে পৌরাণিক পাখি;
তারা সব মৃত রাতে আলো জ্বেলে স্লোগান মুখর
মানুষের চিন্তা তবু ঘিরে তার যাপিত জীবন
চারিদিকে জমে ওঠে যুগ্মক্ষতি__স্মৃতির শৈশব
রাষ্ট্রযন্ত্র-রাজনীতি__সোনালি মিছিল
প্রেমিকার বামহাতে রক্তের স্বাক্ষর
চুলের বেণীতে দোলা রোদের আঁচল
দৃষ্টির অঙ্গার__মনে পড়ে!
মনে তবু পড়ে__শ্রাবণে মাতাল নদী__অজানা সাঁতার!
অনঙ্গ রূপার চাঁদ দোল খায় টোলপড়া গালে
উঠোনের বামপাশে পুঁই আর লাউয়ের ঝাঁকে
জোনাকি না মেয়েটির হাসি!
মনে নেই? মনে কেন পড়ে না এখন?
ক্রমাগত মাথা দোলে, দ্রুত কাঁপে চোখের পাতা
মগজে কম্পন তুলে থেমে যায় অচেনা আলোক!
এই দৃশ্য স্বপ্নে নয়__জাগরণে আঁকা।

মৃত্যু সমাগত!
পঙ্গু এক শুয়ে আছে জলের চাদরে
স্বপ্নে নয়__জেগে জেগে এই ছবি আঁকে
মৃত্যু তবু বসে আছে হৃদয়ের সমান দূরে
মৃত্যু কেন বসে থাকে? তবে কি মৃত্যুও ঘৃণা করে? ভয় পায়?
রাতভর জেগে থাকে মানুষের চোখে?
মগজে জাগিয়ে ভয় ঘৃণা করে ঘুমন্ত শরীর?
কামনার ভাষা তবু বোঝে না মরণ!
শরীরের ভেতরে শরীর
জেগে ওঠে যখন ক্ষুধায়__মৃত্যু তারে দেয় কোন সান্ত¡নার স্বাদ?
মাথায় ঢোকে না কিছু
কোনো কোনো দৃশ্য তবু জ্বলে ওঠে মগজের কোষে
যেন খুব পরিচিত অথবা সঙ্গত
আসলে স্মৃতি মাত্রই প্রতারণা__বিষ
অহেতুক ডেকে আনা খালের কুমির!
যতক্ষণ আসে যায় এই সব স্মৃতি
যতক্ষণ ঢেউ তোলে স্মৃতির ভাসান
ততক্ষণ বেঁচে থাকা; মানুষের ভালোবাসা
মানুষের প্রেম__উপেক্ষার ভাষা আর ছলনার হাসি
বহুদিন দিয়েছিল এমন আঘাত।
মৃত্যু তবু ঘৃণা করে আমার শরীর?
ঘুম নয়, হতে চাই অন্তহীন নির্ঘুম অসাড়;
মানুষেরা ভুলে যায় মানুষের স্মৃতি
স্বার্থ নয়; স্বার্থ তবু বড় হয়ে ওঠে
বেঁচে থাকা__স্বার্থপর মানুষের দাবি?

কেন তবে বেঁচে থাকা আর
কেন তবে সহে যাওয়া অবহেলা আর
কেন তবে বাঁচা এই করুণার দান?
মানুষের মৃত্যু হলে
মানুষেরা সুখ পায়__হাসে__গায় গান
মানুষেরা মেতে ওঠে খুশির উৎসবে
আমার মৃত্যুর পর সে রকম দৃশ্য হবে জানি
মুহূর্ত অপেক্ষা শুধু!এরপর শুধু
একখø চিরকুট লিখে যেতে চাই__
লিখে যেতে চাই__ঘৃণার স্বাক্ষর আর
অক্ষম আক্রোশ আর ছলনার হাসি
আর ভালোবাসা নয়__নয় কোনো অভিমান
আমি একা যেতে চাই__তর্কহীন প্রাণের ওপারে!

মূর্খ অথবা কবি সম্পর্কিত কয়েক পঙক্তি

এককালে কবিদের সর্বশাস্ত্র জানা ছিল বলে
একালে মূর্খরা কবি!
মাস্তান-ব্যর্থপ্রেমিক__ পাঠ নেই শিল্পে-ইতিহাসে
পড়েনি ভূগোল আর
বিজ্ঞান দর্শনে বিরাগ যার, সেও কবি।

ব্যাকরণমূর্খ-ছন্দকানা অধ্যাপক
বিদেশফেরত টাকমাথা যত বেশ্যার দালাল
আর যত নেশাখোর__সেও হতে চায় কবি!

জগতে সবই চলে নিয়ম-মাফিক
কেবল গ্লমূর্খরা তোলে নিয়মভাঙার দাবি!


বয়স্ক দুপুরের গাথা

বয়স্কদুপুর আজ ঝনঝনে রূপোর কয়েন
বেজে-বেজে ওঠে এক মাথার ভেতর
মনে হয়__
অনন্ত পথের শেষে জাগে কার ধূসর হৃদয়!

দুঃখ তুই চিরসখা হবি যদি তবে
হৃদয়েরে কেন আর মূল্য দিতে চাস?
আহা বেদনারে কত ভালোবাসি
কত মাইল-মাইল রাত পাড়ি দিয়ে
গলিত সূর্যের বুকে এঁকে যাই বেহায়া চুম্বন
একথা তো জানত না কেউ,
না কোনো শিল্পরসিক,
               না কোনো প্রেমিক কবিতার;

ও দুপুর মেঘবন্ধু, ও আকাশ  নেমে এসো আজ
একখণ্ড শাড়ি হও করোটিশূন্য মগজের!



দূরত্ব

যতটা দূর সম্ভব, তারও বেশি দূরে তুমি
তবু কেন মনে হয়__ নিশ্বাসের কাছাকাছি?

একদিন-একরাত খুব বেশি ঘনিষ্টে কাটালে
আজীবন জমা থাকে দহনের স্মৃতি!
আকাশ অনন্ত হলে পথের দূরত্ব বাড়ে
মাতাল সমুদ্র খোঁজে আকাশের নীল
মানুষের বেদনারা বেঁচে থাকে ব্যর্থ কবিতায়।



জন্মদিন

জন্মদিন এলে মনে পড়ে
কত বর্ষা-কত শীত-হেমন্ত-বসন্ত
পার করে এসেছি এমন!

কত  শৈশব-কৈশোরে
কত জলভরা দিঘি-ঢেউ ঢেউ নদী
আমাকে একেলা পেয়ে দেখিয়েছে মনসার ভয়।
আমিও চাঁদসদাগর; হাতে হেঁতালের লাঠি
নির্ভয়ে দিয়েছি পাড়ি সমুদ্রমাতাল।
মৃত্যুরে করিনি ভয়।

আহা মধুর যৌবন__
মৌবনে ঝড় তুলে অসুখী এখন
আমাকে দেখায় নিত্য পাপ-পুণ্যের ভয়।
আমিও জলের নাগর
চুমো খাই হাঙরের ঠোঁটে
তবে কেন হায়__
যতবার ফিরে ফিরে আসে জš§দিন
ততবার শুনি এক মৃত্যুর সঙ্গীত!


হেমন্তের গান

প্রবল ঘুমের স্রোতে ভেসে গেল যারা, তারা নাকি
মৃত রাত ভালোবেসে বহুদিন পর জেগে ওঠে
ধ্রুপদী গানের মতো রোদে ভেজা আকাশে আকাশে!

অথচ আমার চোখে কোনোদিন ঘুম নামে নাই

এমন বেদনা পেলে মাইল-মাইল রাত শেষে
ভিখিরিও রাজাদের সিকি ছুড়ে দিতে ভালোবাসে!
আমার হেমন্ত জুড়ে কত রাত কুয়াশার নদী
একজোড়া মেঘ হয়ে উড়ে যায়__ ঠিক যেন গলে
যাওয়া প্রান্তরের চাঁদ!
অকালে ঘুমালো কেন পথভোলা রাতের বাউল? 




মধ্যরাতের গজল
এক.
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়; মধ্যরাতে চাঁদ__
একলা ঘরে উঁকি মারে বন্ধ জানালায়
দিঘিও নয়, নদীও নয়, শরীর ভরা ঢেউ
উছলে ওঠে শ্রাবণরাতে আমার বিছানায়।

বর্ষা এলো, বৃষ্টি এলো__ কী যেন কী নেই
সংসারে সব ঠিক-স্বাভাবিক, মনের হদিস কই
আমিও কেমন হদ্দনবিস ভুলেছি নামধাম
নইলে এমন মধ্যরাতে চাঁদ করে থই থই!


দুই.
শহরজুড়ে রাত্রি জেগে আছে
ঝুলন্ত চাঁদ মদের বোতল যেন
কীসের নেশায় বাতাসে কান পাতি?

হঠাৎ দেখি__ আকাশ উল্টে দিঘি
হাজার তারায় পদ্মপাতার ঢেউ
দিঘিও নয়, আকাশও নয়, তবু

তোমার চোখে কীসের নেশা জাগে?


তর্ক অথবা রূপকথা

আজকাল কারো সঙ্গে তেমন তর্ক করি না; চুপচাপ থাকি। হঠাৎ মেঘের সঙ্গে হোঁচট খেলেও আর উড়ন্ত নদীকে আমার মনে হয় না তর্কলিপ্ত সুগন্ধি সাবান। ল্যাপটপ খুলে বসি___ মনিটরে ভেসে ওঠে ভার্চুয়াল ঠোঁট, চুম্বনের দাবি নেই; সঙ্গমেই পেতে চায় জলের স্বাক্ষর। অথচ রক্তের নদী নেচে ওঠে নির্বিকার দেহের ক্ষুধায়। আমরা হেঁটেছি রাত গুনেগুনে তারাভরা মানুষের চোখ। স্বপ্নমুহূর্তের ছবি মনে করে কতদিন নীরবে হেঁসেছি__ কতদিন দাঁড়িয়েছি মুখোমুখি নিজেরা তুমুল। একজোড়া চোখ কেন এমন চৈত্রেও ভাসে শ্রাবণধারায়? তর্কের তুফান তুলে তারাগুলো মরে যায় জেগে থাকে রাত__ আমাদের সত্য তবু সূর্যকান্ত দিন। জলের গহীনে যারা শুনে মৃত মাছের মিছিল__তারা নাকি রূপকথা ভালোবেসে লিখে যায় জলজ লিরিক।


অনামিকা বিষয়ক একটি চিঠির খসড়া

তোমার মেয়ের নাম অনামিকা শুনেছি সেদিন
নেই কেন আমাদের ভালোবাসা-প্রেমের ফসল?
কেন আজ শূন্য এই সোনার কলস?
কেন তুমি নেই পাশে__ এই সব প্রশ্ন আজ জেগে ওঠে মনে।

তোমার স্বামীর কোলেপিঠে নাচে হাসে অনামিকা
তুমি দেখে হেসে খুন__ চুমো খাও মেয়ের কপোলে
শুনে আমি দিশাহারা__ খোদার কসম।
আমার বুকে হাতুড়ি পেটায় ঈর্ষার দেবশিশু...

তোমার নামের সাথে  মানিয়েছে বেশ
ও নাম ভারি সুন্দর,
যখনই শুনি অনামিকা তোমার মেয়ের নাম
শ্রাবণের মেঘ ঝরে পড়ে দুচোখে আমার।
আমি ঘুরি হৃদয়ের বালুচরে__ ফকির লালন
আকাশের নীল রঙ ফেরারি প্রেমিক
লোকে তার ভিন্ন অর্থ খোঁজে।

কখনো কি মনে পড়ে আমাদের হারানো অতীত?
যদি মনে পড়ে সেই ভালোবাসা, লুকোনো চুম্বন...
কখনো যদি ফিরে যাও অতীতের সিঁড়ি বেয়ে
দুজনের স্বপ্ন রচনার হৃদয় নদীর তীরে
বুঝি তখন তেমার দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে
তোমার স্বামীর পাশে অন্ধকার রাত্রির কফিন!



শিরোনাহীন

নামলে যদি জলে তবে ডুব দিলে না কেন?
সমানসুখী বান্ধবীরা দাঁড়িয়ে ছিল কূলে?
রিবন বাঁধা চুলের ভীড়ে চাঁদ ডুবে যায় যদি
নকল জলে স্নান করো আর কেন?

সুখ কি তবে তোমার হাতের মুঠোয় পুরে রাখো
লতার মতো বেড়ে ওঠে আমার গোপন চুমো?
তা হলে আর শরীর ভরা ঢেউ জাগে রোজ কেন
না কি তোমার কামরাঙ্গা মন ভেজাতে চাও জলে?


না-শাশ্বতের গজল
কোনো কিছুই শাশ্বত নয়; না মানুষ, না-কোনো দেবতা। তাহলে মানুষ এত ছোটে কোন স্বপ্নের পেছনে__ এই এক প্রশ্ন নিজেকে করেছি বহুজন্ম ধরে। যখন এসেছি জীবনের উদ্যোনে, তখন মৃত্যুরা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। ভেবেছিল কালান্ধের দেশে এ কোন যমদূত? না-কোনো ভালোবাসার টানে, না-কোনো ঘৃণার__ কোনো ধর্মেই আস্থা নেই দুর্বিনীতের! কী গোয়ার্তুমি এসে ভর করেছে এমন রাতে। আমি বসে আছি যার অপেক্ষায়, সেও গেছে বৃন্দাবনে কৃষ্ণের সন্ধানে। জেনেছি এখানে কেউ একা কৃষ্ণ নয়;  হাজার হৃদয়ে জন্ম নেয় রাধার প্রেমিক ।



অন্ধদের ভূগোলে আমি

অন্ধদের ভূগোলে কে তুমি অন্ধ জাদুকর
এই পড়ন্ত বেলায় রুদ্ধশ্বাসে?
পশ্চিমে যেতে কে চায়? পশ্চিমে বিকেল
প্রৌঢ় এই দিন ডাকে অন্ধদের পাঁজর পাড়ায়

অতীতের ঢেউ জাগে বাতাসের আগে
বিরহের দিন বাড়ে হৃদয়ের ভুলে।
কেউ কেউ রাধা নয় পাখি চায়
তারা জানে না আজও পাখি বড় অসহায়।
আজ আর গান  গেয়ে পাখি হবো কেন!



হতচ্ছাড়া হৃদয় আমার

তুমিও জানো, তুমিও জানো ভালো
অন্ধরাতের গন্ধমাখা মেঘে
হঠাৎ যদি আষাঢ়-শ্রাবণ নামে
মনে পড়ে লুকিয়ে খাওয়া চুমু।

মনে পড়ে পালকভাঙা শালিক
উড়তে গেলে শূন্য আকাশ কাঁদে
আকাশও নয়, শ্রাবণও নয়, তবু
হৃদয় আমার নদী হতে চায়।

হায়রে হৃদয় হচ্ছাড়া তুই
আকাশ ভরা তারাই দেখলি যদি
কেন তবে কবির হতে গেলি?


চাবির রিং বিষয়ক

চাবির রিংকে হৃদয় ভেবে চায়ের কাপে জুড়িয়ে নিয়েছি দুপুর। মুদ্রিত আকাশ পাঠে বৃক্ষদের মুরিদ হয়েছি, হাঁটু গেড়ে বসেছি ছায়ায়। হঠাৎ মেঘের গর্জনে থেমে গেলে স্বরচিত স্বপ্নের উড়াল,  মাটির পালঙ্কে কাটিয়েছি সময়ের দূরত্ব। হিসাব কষে দেখেছি প্রতিটি রাত্রির সঙ্গে মানুষের বয়সের একটা সম্পর্ক আছে। এ-ও এক ধরনের ষড়যন্ত্র বলা যায়। মানুষের জীবন মাপতে হয় খরচ হওয়া মুহূর্তগুলোর আগে। না হলে ফসলের মাঠ ভরে যায় আগাছায়। বিষয়টা কে কীভাবে দেখছে এ নিয়ে একটা গবেষণাও হতে পারে; এর সঙ্গে অভিসন্দর্ভ রচনার কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্যই যারা চাবির রিংকে নিজের জীবনের বৃত্ত মনে করে, তাদের কথা আলাদা। আর যারা বুক পকেটকে কোনো রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভেবে যে কোনো সময় ঢুকে পড়ে রেস্টুরেন্টে তারা খুব ভাগ্যবান। আমার হিসাব মেলেনি কোনোকালে। তবে রাত্রিকে রাত ভেবে পার করেছি অজস্র তারার বয়স। এখানেই চাবির রিং আর মানুষের আচরণের একটা মৌল পার্থক্য রচনা করা যেতে পারে।


দুঃখ-দুঃখ খেলা এক ধরনের আনন্দের নাম

যারা নিজেদের দুঃখী দাবি করেন, তাদের বেশির ভাগই দুঃখবিলাসী। আজকাল দুঃখও বাণিজ্যিক, তুল্যমূল্যে চলে লেনদেন।  হৃদয়ের লেনদেনে কেউ-কেউ পাকা হারামি। নাহলে  দুঃখটুকু একেবারে বিশুদ্ধ রাখা যেত। মানুষ মাত্রই বিচিত্রগামী,পরন্তু ভেজালপ্রিয়। তাই এই বাণিজ্যিক যুগে বিশুদ্ধ দুঃখী নেই। আসলে দুঃখ-দুঃখ খেলা এক ধরনের আনন্দের নাম। এ খেলার কোলাহলে দুঃখবিলাসীরা কখনো সমুদ্র চেনে না। তাই কোনোদিন জানতে পারে না__ আকাশ নেমে এলে সমুদ্র সঙ্গমে, নীরবতার মানে হয় হাজার রকম।


যে কোনো নামে ডাকতে পারো

আমার আছে তেত্রিশ হাজার ডাক নাম
যার যেমন খুশি ডাকতে পারো
পৃথিবী ও আকাশের মধ্যবর্তী কোনো শূন্যতা নয়
বিশ্বাস ও আপেলের মসৃণ দেহের স্বাদ
কখনো সমার্থক হয় না যদিও
তবুও ধার্মিকেরা মিথ্যেভরা কবিতা ভালোবাসে।

আহা, এও তো এক বিস্ময়!
আমার ডান চোখে স্বপ্নদৃশ্য কাঁপে
বাম পাশে হৃদয়;
আমারে কে কয় কবি, আমি তো মাঠের রাখাল;
আজীবন মাঠে-মাঠে বাজালাম বাঁশি।

তবু কেউ আমারে রাখে না মনে।
রাত্রি যত লাল হয়, তত আমি পার করি রাত
বেদনারে তুমুল ভালোবেসে।


ভুলি বলেই প্রিয়পাঠ্য

এখনো আমি শিক্ষনবিস। পড়ছি তোমার পৃষ্ঠাগুলো।
   
তোমার মেঘের দাঁড়ি-কমা, নদীর স্বভাব, সেমিকোলন;
সবই আমি ভুলতে থাকি; ভুলেই তো যাই প্রায়-প্রতিদিন।
ভুলি বলেই প্রিয়পাঠ্য
যত বারই মুখস্ত হও, ততবারই ভুলতে থাকি!

হায়রে আমার পাঠ্যসূচি
শেকড়-বাকড় সব ভুলেছি
পাতার স্বপ্নে সবুজ আঁকি। আকাশ তবু নীল হতে চায়!
তোমার নদীর রাধিকা নাম
তবু আমার এই ভুলো মন।
ভুলি বলেই মুছে ফেলি তোমার দেওয়া ক্ষতচিহ্ন।


আমার কবিতারা

আমার কবিতারা বেড়াতে গেছে গদ্যের বাড়ি
ফিরে আসবে শিগগিরই,  কোনো এক অচেনা শ্রাবণে
তুমি তো কবিতা ভালোবাসো
তুমিও ঘুরে আসো, দূর  কোনো মেঘের সড়কে।

কবিতা কবিকে ছেড়ে যায়, কবিতারা যায়
কবিতারা ফিরে আসে, ফিরে-ফিরে আসে
তোমরা ফেরো না সখী!
যদি ফেরো  দেহ ফেরে, মন কবু ফেরে না কো আর!


পায়ের ছন্দে মাপি দূরের গন্তব্য

আমি পদাতিক, পায়ের ছন্দে মাপি দূরের গন্তব্য
দু কদম হাঁটার অভিজ্ঞতা হয়নি যার
সেও যদি শেখাতে চায় পথের ভূগোল?

মাথায় খুন চাপে, চোখে জ্বলে হাজার সূর্যের আগুন
মনে হয় খুনি হই__ 
যারা আমার মাইল-মাইল পথের সঙ্গী
সেসব রাত্রিকে ডেকে আনি
হৃদয়েরে বলি : খুনি হও, খুনি হও!
চলার ছন্দ শেখাও, পায়ে-পায়ে দূরের আকাশ।


জন্মসূত্রে আমি তোর প্রেমিক ছিলাম

জন্মসূত্রে আমি তোর প্রেমিক ছিলাম
এই কথা কেন তুই রাষ্ট্র করে দিলি?

দিলি যখন, তখন কেন
ও মেয়ে মেঘের সখী, বৃষ্টি ধোয়া মুখ
অন্ধকারে আবার তুই আড়াল করে নিলি?

গোপন কথাটি যদি না থাকে গোপন

আয় তবে জল হয়ে, আমি তৃষাতুর
আকাশ কেঁদে উঠুক মেঘের বিচ্ছেদে
তুই-আমি ডুব দেব নিকষ-আন্ধারে।



ভুল পথে এসেছি যখন

আমার অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিল। এখানে আসার কথা ভাবিনি কখনো।
তবু ভুল পথে হেঁটে-হেঁটে এতটা পথ এলাম; কিন্তু গন্তব্য পেলাম না।
সবাই যে যার গন্তব্যে কত সহজে পৌঁছে গেলেন,
আমি একা নির্বান্ধব আকাশের তলে চিৎ হয়ে শুয়ে গুনি তারাদের নিখিলসঙ্গম।

চাঁদ মরে গলে গেলে রমণীরা কোমরে কলসে ভাঙে, আমার রাত্রিরা ঘন হয়ে আসে।
আমি সেই রাত্রিকে বিছানায় তুলি, চুমো খাই মৃত সব নক্ষত্রের থরোথরো স্তনে।
আকাশ যখন নেমে আসে কামাদ্র সমুদ্রে, মাঝে-মাঝে ঝড় ওঠে হৃদয়ে আমার।


উপ-বিকল্প সম্পাদকীয়

হঠাৎ ক্ষেপে উঠলে মনে হয় পৃথিবীটা আস্ত বানচোদ
চারিদিকে কেবল স্বার্থের হোলি।

আবাল্য গ্রামে ছিলাম__ মাঠের রাখাল
শ্লীল-অশ্লীল বুঝিনি
হঠাৎ ক্ষেপে উঠলে__ দিয়েছি গর্জন
আমার গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠেছিল
তেপান্তরের মাঠ__ শান্ত দিঘি, দুরন্ত নদীও।

নগরে এসেছি বলে
ভুলে যাইনি আজও সেই সমুদ্রের ডাক
কেউ লাঠি হাতে সামনে দাঁড়ালে
আজও নির্ভয়ে বলে দিতে পারি__ কাউরে চুদি না।







সুতার কল ।। শরাফত হোসেন

বড়ো খাপছাড়া এ জীবন, রেলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে
পেরিয়ে যাই সমুদ্রতলদেশ, সীমান্তের বেড়া ঠেলে
গুটিকয়েক স্বপ্ন ঢুকে পড়ে পরদেশি ললনার ঠোঁটে
আঁকে মানচিত্র।

ঝুমবৃষ্টি, বাতাস উড়িয়ে নিলে পরনের গামছা
সুতাকলে জেগে ওঠে বৃষ্টির গান, মৃত্যু-সম্ভাবনা তাড়িয়ে
ক্ষুধাতুর দেহ আড়াল করে রঙিন কষ্ট।

গুম হওয়ার আগে ।। মুক্তি মণ্ডল

আমিও গুম হয়ে যেতে পারি
ফাঁসি ঠেকানো মতলবে রাস্তায় মৌলবীদের তাণ্ডবে ঝলসে যেতেও পারি
বোবা বৃক্ষশাখায় ঝুলে থাকতে পারে
আমার হৃৎপিণ্ডের টুকরো টুকরো অংশ ও কবজির দাগ
যে কোন মুহূর্তেই পায়ের রগ উধাও হয়ে যেতে পারে

এই আশংকায় গণ আকাঙ্ক্ষার তলপেট ফুটো করে আমি ঢুকে যেতে চাই
গণতন্ত্রের হৃদয়াভ্যন্তরে
ফালিফালি করতে চাই তার টাটকা হলুদ কলজে ও ফুসফুস
টকশোবাজ, হলুদ পাখি ব্যবসায়ী, দার্শনিক ও বকধার্মিক কবিদের নাকে এসে
লাগুক কলজে ও ফুসফুসের সুস্বাদু ঘ্রাণ

আনন্দে ডগমগ হয়ে নাচতে থাকো হে রাষ্ট্র হে ক্ষমতার রসুই ঘর

রোদ্দুরের আঁচ এসে উসকে দিক আমাদের সুবর্ণ স্বপ্নকে
উধাও হওয়ার আগে
আমিও চাই আমার নাগে এসে লাগুক তাজা কয়লায় সেকা মাংসের ঘ্রাণ
হাতা গুটানো জামার হাতায় চোখের পানি মুছুক
বুজুর্গ ও কামেল

তেতে উঠুক আমাদের হাসি-ঠাট্টার মনুষ্যচর্বি ও আসমানী বিজলি ঘর

আন্দোলন হল কয়েকজন লেখকের একটা বিশ্বাসে পৌঁছানো


[‘নতুন চোখ’ সাহিত্য আন্দোলন মুন্সীগঞ্জে বসবাসরত কয়েকজন তরুণ সাহিত্যিকের নতুন কিছু করার প্রয়াস। এ আন্দোলনের নির্দিষ্ট কিছু রীতি-নীতি ছিল। ইশতেহার ছিল। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা কবিতা পাঠকের কাছে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে নতুন কোনও প্রকাশভঙ্গিতে কবিতা লেখা। এ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন পাঁচ তরুণ কবি। এরা হলেন জন মোহাম্মদ, অনু ইসলাম, জুনায়েদ, নাজমুল আরেফীন এবং কাজী মহম্মদ আশরাফ। আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর কাজী মহম্মদ আশরাফের ঘরে এক আড্ডা ও আলোচনা হয়। সে আড্ডার মূল বিষয় ছিল সাহিত্যে আন্দোলনের গুরুত্বসহ নানা দিক। দীর্ঘ সে আড্ডার কিছু অংশ শিল্পমূল্যে মূল্যবান বিবেচনা করে এখানে তুলে ধরা হল। ]

জুনায়েদ: আমরা যারা এখানে উপস্থিত আছি সবাই কবিতা পড়ি এবং লিখি। আমাদের বেডলাক কিনা জানি না, আমি আমার বন্ধুদের Ñঅনেকের কবিতা বুঝি না। অনেকে আমার কবিতাও বোঝেন না। তাহলে এখানে দুর্বোধ্যতার প্রশ্ন এসে যায়। দুর্বোধ্যতার কারণ কী? অনেকের মতে বিশ্বায়নের প্রভাব। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাও একটা কারণ। নানা জায়গা থেকে নানা কিছু গ্রহণ করার ফলে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে।
জন: কবিতা দুর্বোধ্য হলে সমস্যা কী? যে কবিতা আপনার কাছে দুর্বোধ্য তা আমার কাছে সুবোধ্য। আমরা যখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনি, সবাই তা বোঝেন না। অনেকের কাছে তা দুর্বোধ্য মনে হয়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে যদি সহজবোধ্য করা হয়, তাহলে তা আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থাকবে না। আমাদের অক্ষমতার জন্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে সহজ করার দরকার নেই।
নাজমুল: সঙ্গীত আর কবিতা একই প্যাটার্নের হলেও দুটি ভিন্ন ধারার। কবিতার দুর্বোধ্যতার কারণ আমার মনে হয় ঔপনিবেশিকতার প্রভাব। বিশ্বায়নের প্রভাব। আমাদের নিজেদের ঐতিহ্য থাকতে আমরা তা গ্রহণ করব কেন? আধুনিকতাবাদীদের মতে সৃষ্টি ভালো হলে হাই, না হলে লো কোয়ালিটির। পোস্টমডার্নিজম বলে যা কবিতা হয়ে উঠেছে তাই বিশ্বের। কেউ কেউ হয়তো ইচ্ছা করে দুর্বোধ্য করার চেষ্টা করছে। অপরিচিত বিদেশি মিথ ব্যবহার করছে। আসলে কি তা দরকার?
জন: কবিতার দুর্বোধ্যতা আগেও ছিল, এখনও আছে। আমার মতে কবিতা সুবোধ্য হওয়ারও দরকার নেই। কবিতা দুর্বোধ্য হওয়ার আরেকটি কারণ জীবনের মান ও পরিবর্তন। দৈনন্দিন জটিলতা। এসব আছে বলে কবিতা দুর্বোধ্য থাকবে।
অনু: বর্তমানে যে সব কবিতা দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা হচ্ছে তার কারণ জীবনের প্রভাব। অর্থনীতি, রাজনীতি ও অন্যান্য জটিলতার কারণেই এই দুর্বোধ্যতা।
আশরাফ: কবিতায় দুর্বোধ্যতা সুবোধ্যতা বলে স্থায়ী কিছু নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এবং আন্তঃযোগাযোগটাই আসল। শহরবাসী সন্তানের ভাষার কারণে মায়ের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করলে একজন লেখকের লেখায় যা কিছু উপাদান যোগ হবে অন্যদের লেখায় তা হবে না। প্রযুক্তির অগ্রসরতাকেই দুর্বোধ্য বলা হচ্ছে। জনের কথাটাই সত্য যে, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা বিমূর্ত শিল্পকলাকে দুর্বোধ্য বলে দূরে ঠেলে রাখা যাবে না। যারা এর স্বাদ বুঝবেন তারা গ্রহণ করবেন। যার পেটে দুধ কিংবা মধু সয় না, তিনি পানি মিশিয়ে খাবেন। কিন্তু গাভী ও মৌমাছি তা তরল করে উৎপাদন করবে না।
নাজমুল: ভাষার সহজেবোধ্যতাই আসলে দরকার। এর কারণেই এলিয়েনেশন সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির দূরত্ব বাড়ছে।
আশরাফ: ভাষাগত দূরত্ব যদি চেষ্টাকৃত হয় তাহলে কবিতায় তা খুব সহজেই বোঝা যাবে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণে যে ভাষাগত দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। ধরা যাক গ্রামের একটি ছেলে শহরে গিয়ে নতুন পরিবেশে একটা ধারণা পেল, ‘প্রাইভেসি।’ এটা শহরের অনিবার্য বিষয়। কিন্তু গ্রামের লোক এই শব্দটিরই অর্থ বুঝবে না; বিষয়টি বুঝবে দূরের কথা। ছেলেটি গ্রামে আসার সময় তো শব্দটি শহরে ফেলে রেখে আসতে পারে না।
জন: আসলে আমরা যখন কবিতায় ঢুকি তখন দুর্বোধ্যতার কথা মনে থাকে না। রৌদ্র-গন্ধ-ডানা-চিল প্রভৃতি সহজ শব্দ। কিন্তু জীবনানন্দ যখন এগুলো একত্র করে কবিতায় লেখেন তার ভাষা সহজ, কিন্তু তা অর্থের দিক থেকে জটিল।
আশরাফ: একটা সময় কবিতা ছিল লেখকের দিক থেকে আত্মচিৎকার বা আত্মপ্রকাশ। আমার মনে হয় কবিতা শুধু বিশুদ্ধ মনের পরিশুদ্ধ প্রকাশ। কিন্তু পাঠকের দিক থেকে বিনোদন। কবিতা থেকে অন্য অনেক শাখা বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন আছে শুধু বিশুদ্ধ কবিতা। সুতরাং কবিতার পাঠক এখন কম হবেএটাই স্বাভাবিক। কবিতা পাঠ ঐচ্ছিক বিষয় ও সক্রিয় ক্রিয়া আর ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বিনোদন উপভোগ করা অনৈচ্ছিক ক্রিয়া। শুধু সুইচ অন করলেই চলে। এখন ঐসব দর্শকের কাছে কবিতা জোর করে পৌঁছে দিতে হবেই, এমন কথা নেই।
জুনায়েদ: সাহিত্য আন্দোলন কখন হয় বলে আপনার মনে হয়?
অনু: আসলে আন্দোলন সময়ের দাবি।
নাজমুল: তার মানে দর্শনটা পাঠক বুঝে নেবে সময়ের কাছ থেকে?
জুনায়েদ: আসলে আমাদের আগেই আলোচনা করা উচিত ছিলÑ কবিতা আমরা কেন লিখি, নিজের জন্য নাকি অন্যের জন্য।
নাজমুল: তোমার কি মনে হয় সাহিত্যে আন্দোলনের প্রয়োজন আছে?
জুনায়েদ: আন্দোলন মানে নাড়াচাড় করা। কোনও কিছু নাড়াচাড়া করে ছড়িয়ে দেওয়া।
নাজমুল: তাহলে তো সহজবোধ্যতাই কাম্য।
আশরাফ: নতুনত্ব আনার জন্যই আন্দোলন। বাজারি পণ্য বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেয়। আর সৃজনশীল শিল্পবস্তু শুধু আন্দোলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। ধরা যাক, একটা স্কুলে শিক্ষক শুধু ফার্স্টবেঞ্চের ছাত্রছাত্রীদের সাথেই সবকিছু শেয়ার করতে পারেন। লাস্টবেঞ্চের স্টুডেন্টরা অমনোযোগীÑ চোর-ডাকাত-পুলিশ খেলে। একই তারিখের একই ক্লাসে সামনের বেঞ্চের ছাত্রছাত্রীরা যা শিখছে, পেছনের বেঞ্চের ছাত্রছাত্রীরা তা পারছে না বা করছে না। তাহলে সময়কে সবাই সমানভাবে ধরতে পারে না। সময়কে ধরার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন। আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন বিষয়টা সবাই দ্রুত জানতে পারে।
জন: যোগ্য বিষয়গুলো একটা সময় ঠিকই অবস্থান করে নেয়। জীবনানন্দের অনেক কবিতা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছে। আন্দোলন হল কয়েকজন লেখকের একটা বিশ্বাসে পৌঁছা। যদি তারা একমত হতে পারেন, তখন সবাই একসাথে কাজ করলে তা দূরের সময়ের অপেক্ষায় না থেকে সমকালেই ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
আশরাফ: অনু বলেছে আন্দোলন সময়ের দাবি, কথাটা সত্য; তবে সময় তো আপেক্ষিক। সাহিত্যের সময়ের দাবি আর সাহিত্যিকের সময়ের দাবি এক নয়। জন বলেছে একটা প্রাথমিক বিশ্বাসে পৌঁছার কথা। হ্যাঁ, এভাবেই হয়। বিশ্বাসের সাথে সাথে মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হয়। কাজে তার লক্ষণ ফুটতে থাকে। প্রস্তুতি না থাকলে, লক্ষণ দেখা না দিলে এমনকী বিশ্বাসে না পৌঁছালে আন্দোলনে নাম লেখানো যায় মাত্র; মহাকালে টিকে থাকা যায় না। ‘কল্লোল যুগে’এমন অনেক রথী-মহারথী ছিলেন যারা পরে কালের ধূলায় মিশে গেছেন। আবার অনেকে সরাসরি আন্দোলনের কর্মী ছিলেন না, বিশ্বাসের ঐক্য নিয়ে নিবিড় সাধনা করে গেছেন তারা কালোত্তীর্ণও হয়েছেন। অনুরূফ ঘটতে দেখা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ এবং ‘ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্য আন্দোলনে’ও।
জুনায়েদ: আমার মনে হয় আন্দোলন শুধু তরুণরাই করে। যাদের পরিচিতি গড়ে ওঠে নি। প্রতিষ্ঠিতদের এতে অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই।
নাজমুল: প্রতিষ্ঠিতরা তরুণদের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলে স্বকীয়তা হারায়। এতে লাভ হয় তরুণদের। তাদের আদর্শের জয় হয়।
আশরাফ: আমার মনে হয়, যদি কবিতার বর্তমান ধারায় আস্থাশীল না হই, তাহলে আমরাও একটা আন্দোলন শুরু করতে পারি।
জুনায়েদ: একটা সময় সময় কবিতায় আত্মকেন্দ্রিকতা ছিল না, বর্তমানে প্রবল। আমার মনে হয় আমাদের উচিত এখান থেকে বেরিয়ে আসা।
নাজমুল: এলিয়টের কথাটাই গুরুত্ব দিতে পারিÑ নৈর্ব্যক্তিকতা। আত্মবিলোপন ঘটাতে হবে কবিতায়। তিনি বলেছেন আমরা কাচের জানালার দিয়ে দৃশ্যবস্তু দেখি; কাচ দেখি না। কবিতার ভেতর দিয়ে চিত্রকল্প ও দৃশ্যকল্প দেখব, কবিতাকে দেখব না।
জুনায়েদ: আমার মনে হয় কবিতায় ‘আমি-তুমি’ শব্দদুটি যথাসম্ভব কম ব্যবহার করলেই ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যায়।
আশরাফ: আসলে ‘আমি-তুমি’ শব্দ দুটি থাকলেই যে ক্ষতি হবে এমন কোনও কথা না। ধরা যাক সুধীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন, আমার মনের আদিম আঁধারে/ বাস করে প্রেত কাতারে কাতারে। এখানে ‘আমি’ শব্দটিতে পাঠকেরও অংশগ্রহণ আছে। অনেক সময়‘আমি-তুমি’ বাদ দিলেও আমিত্বের বোধ থেকে যায়। আমরা যদি কবিতায় আত্মবিলোপ ঘটাতে চাই তাহলের আমিত্বের বোধটাই বাদ দিতে হবে।
জন: ‘আমি-তুমি’ শব্দ না থাকলেও আমার মতে, আমিত্ববোধ থাকা উচিত। কারণ কবি প্রধানত ব্যক্তিমানুষ। বোধ ও উপলব্ধি তার নিজের।
জুনায়েদ: কবির উপলব্ধিকে পাঠক কেন নিজের বলে ভাববে না? তার নিজের বিষয়ে পাঠকের শেয়ার না থাকলে লেখক-পাঠকের সেতুবন্ধন হবে না।
আশরাফ: কবির আহরণ ব্যক্তিগত; বিতরণ নৈর্ব্যক্তিক। কবি তার ব্যক্তিগত অনুভূতি ও উপলব্ধি প্রকাশ করবেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে। সেটা যাতে সবার হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’তে কবি উপস্থিত আছেন; কিন্তু নিজেকে তিনি বিলুপ্ত করে ফেলেছেন বলে আমরা বিশাল ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ক্ষুদ্র কৃষ্ণকলিকেই প্রবলভাবে দেখতে পাই। আবার নজরুলের ‘অভিশাপ’ ও জীবনানন্দের ‘সুরঞ্জনা’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা হলেও তা পাঠকের হয়ে উঠেছে। যদিও জীবনানন্দ প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় প্রথম পংক্তিতেই লিখেছেন ‘আমি সেই কবি’ পরে আমিত্বের প্রভাব তিনি কমিয়ে এনেছেন। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ ব্যক্তিগত অনেক ঘটনার কাব্যরূফ দিয়েছেন যার বেশির ভাগই বাজে কবিতা। এটা ঘটেছে কবিখ্যাতির চূড়ায় ওঠার পরে। সেই পরিচ কে ভিত্তিভূমি ধরে যা কিছু লেখা হয়েছে তার মান সর্বদা সুরক্ষিত হয় নি। শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা বিষয়ক কবিতাগুলোর গ্রহণযোগ্যতাই প্রমাণ করে বিপরীত ধারার কবিতাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিতান্তই কম। তুমি কবির ব্যক্তিগত পাঁচালী শুনে পাঠকের কী লাভ যদি তাতে পাঠকের অনুভূতির অংশগ্রহণ না থাকে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান কেন পাঠক-শ্রোতার হয়ে ওঠে?
অনু: আসলে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে সব বিষয় একঘেয়েরূপে চলে এসেছে, তা এখন বাদ দেওয়ার সময় হয়েছে।
নাজমুল: এলিয়ট কিন্তু আলফ্রেড প্রুফুুক নৈর্ব্যক্তিকতায় লিখেছেন। ‘ওয়েস্টল্যান্ডে’ খবঃ ঁং বলে পাঠকদের টেনেছেন, এটা কিন্তু ব্যক্তিগত নয়। তাহলে দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়টিকে কীভাবে প্রকাশ করা যায়?
অনু: মুহূর্তকে জয় করতে না পারলে কালকে ধারণ করা যায় না। চোখে দেখা বস্তুকে রূপক ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করতে হবে।
নাজমুল: পুরনো কবিদের যেমনÑ শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ কিংবা মহাদেব সাহাদের কাব্যাদর্শ কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া যাবে?
জন: নতুন কাউকে জায়গা করে নেওয়ার জন্য পুরনোকে অস্বীকার করতেই হবে। আমাদের উচিত তাদের যেখানে শেষ, আমাদের সেখান থেকেই শুরু করা। আমাদের নিজস্ব ভাষা খুঁজে নিতে হবে। যেমন, কবিতায় এখন আর বিরামচিহ্নের প্রয়োজন নেই। আমার একটি কবিতা যদি দশজন পাঠক পড়েন, তা হবে দশটি কবিতা। কিন্তু বিরামচিহ্ন বসিয়ে যদি বাইন্ডিংসে ফেলা হয় তা বহুমাত্রিকতা হারিয়ে ফেলবে। দশজন পাঠক কিন্তু তখন একটি কবিতাই পড়বে।
জুনায়েদ: বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর বিরামচিহ্নের প্রবর্তন করেছেন গদ্যের জন্য।
আশরাফ: আসলেই তাই। বিরামচিহ্ন মূলত গদ্যসাহিত্যের জন্য।
নাজমুল: কবিতায় যৌনগন্ধ, রাজনীতিগন্ধ, আদর্শগন্ধ, দর্শনশাস্ত্রীয় কিংবা বিজ্ঞানগন্ধ এসব দরকার আছে কি না?
জুনায়েদ: এসব গন্ধ ও দুর্গন্ধের কারণে বর্তমান কবিতার শিল্পমূল্য আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এসব বিষয়কে এড়িয়ে নতুন কিছু করতে পারলে স্বাগত জানাব।
আশরাফ: হাজার বছরের বাংলা কবিতা দিনে দিনে দায়মুক্ত হয়েছে। এখন আবার কেন কবিতা কেন আদর্শের বোঝা বইতে যাবে? কবিতা হবে ¯্রফে কবিতা।
জন: আমি মনে করি, এগুলো কবিতার জন্য একেকটি দেয়াল বা বাধা।
আশরাফ: বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসু সর্বপ্রথম কবিতাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তখন প্রবল বামপন্থীরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন। কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বুদ্ধদেব বসু ঠিক কাজটিই করেছেন। বামপন্থীরা যদি কবিতাকে রাজনীতি বা আদর্শ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে অন্যান্য পন্থীরাও তাই করবে। আজ আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? মৌলবাদীরাও ঠিক তাই করছে। দুহাজার এক সালে বাংলাদেশেরর সংখ্যালঘু নির্যাতন আর গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে লেখা দুটি কবিতা পশ্চিমবাংলার এক কাগজে পাঠিয়েছিলাম। তারা আমার কবিতা নিয়মিত ছাপাত। কিন্তু সেবার শুধু বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে লেখা কবিতাটাই ছেপেছে। কাগজটির সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধরা পড়ল আমার কাছে। আমার একটি কবিতা হিন্দু মৌলবাদীরা কৌশলে ব্যবহার করেছে। তাই বুদ্ধদেব বসুর কথা অনুসারে কবিতাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা উচিত ছিল।
জন: হ্যাঁ, কবিতা অস্ত্র না, ঢালও নয়।
আশরাফ: কবিতা কারও বুকে-পিঠে ছুরি মারবে না, কারও পায়ে তেলও মাখবে না। ব্যক্তিকে নিয়ে স্তুতিমূলক কবিতা রচনার বিরুদ্ধে আমরা। কবিতা কারও কাছে মাথা নত করবে না। কবিতা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে কিন্তু কারও পায়ে মাথা নত করে না। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা অনেক কবিতা আছে, সে গুলো ঐ কবিদের শ্রেষ্ঠকবিতার তালিকায় স্থান পায় নি। এর মানে এগুলো নিকৃষ্ট। চিত্তরঞ্জন দাসকে নিয়ে ‘চিত্তনামা’ এবং সত্যেন্দ্রনাকে নিয়ে নজরুল ‘সত্যেন্দ্রপ্রয়াণগীতি’ লিখেছেন, কিন্তু এগুলো তার উৎকৃষ্ট কবিতা নয়।
নাজমুল: হোক কবির ব্যক্তিগত প্রেমিকা অথবা রাজনৈতিক নেতা, কাউকে খুশি করার জন্য কবিতা লেখা পছন্দ করি না। কবিতা উৎসর্গ করাও আমি পছন্দ করি না।শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ নারী পটানোর জন্য অনেক কবিতা লিখেছেন। বায়রন, লরেন্স প্রমুখ লিখেছেন যখন, তখনকার সমাজে যৌনতা নিষিদ্ধ ছিল বলে অতি আকর্ষণীয় ছিল। সমাজ অনেক বদলেছে। এখন আর সে সব কবিতা লিখে সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া মধ্যযুগে নারীর রূপটাই প্রধান ছিল। এখন তাদের ব্যক্তিত্ব, কর্মগুণ স্বীকৃতি পেতে পারে। আমরা অবশ্য এসব নিয়েও স্তাবকমূলক লেখা কবিতাও পছন্দ করি না। আচ্ছা কবিতায় মিথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশি এবং বিদেশি এর মধ্যে কোনটা প্রাধান্য দিতে পারি?
অনু: পরিচিত দেশি মিথ ব্যবহারে ফলে কবিতার অনুষঙ্গটি পাঠকের কাছে পরিচিত বলে মনে হবে বলে কবিতার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বাড়বে। বিদেশি অপরিচিত মিথ ব্যবহারের ফলে পাঠকের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
নাজমুল: দেশীয় সাহিত্যের চরিত্রেরও পুনর্ব্যবহারও করা যায়। রবীন্দ্রনাথ-শরৎ কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য চরিত্র প্রাসিঙ্গকভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়।
জুনায়েদ: দেশি সাহিত্যের উদ্ধৃতি ব্যবহার করাও ভালো।
নাজমুল: কেন তা ভালো?
জুনায়েদ: এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দেশী মিথগুলো বিশ্বসাহিত্যে এ জাতির প্রতিনিধিত্ব করবে। পাশ্চাত্যের মিথ ও ঐতিহ্য আমরা নেব কেন? আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য আছে।
জন: সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা তো ভিখারি না। আমরা কারও কাছে ধার করতে যাব না। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য।
নাজমুল: মার্কেজ যে মিথ ব্যবহার করেছেন তাকে বলা হয় জাদুবাস্তবতা। আসলে তো ওরা (পাশ্চাত্য তাত্ত্বিকরা) বোঝে না। আমাদের মিথগুলো সচেতনভাবে প্রয়োগ করে দেখাতে হবে এগুলো কতটা সমৃদ্ধ। এগুলো নতুন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে।
আশরাফ: হ্যাঁ, ভাষায় থাকতে হবে বহুমাত্রিকতা। দুহাজার বছর আগের পাঠকেরা রামায়ণ যে কারণে পাঠ করেছে, এক হাজার বছর আগের পাঠকেরা সে অর্থে পড়েনি। আজকের পাঠকেরাও তা ভিন্ন অর্থে পড়ে। কাজেই কবিতার ভাষায় থাকবে বহুমাত্রিকতা। বিষয়ে থাকবে বৈচিত্র্য। তবে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, চরম নৈর্ব্যক্তিকতা যেন কবিতাকে গল্প কিংবা প্রবন্ধ বানিয়ে না ফেলে। প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের মতো কবির ভেতরেও একটি আলোচক সত্তা থাকে, একটি কথক সত্তা থাকে। সে কবি যদি আলোচনা-প্রবন্ধ এবং গল্প না লেখেন তাহলে ঐ দু’টি সত্তার চাপে কবিসত্তাই আলোচক ও কথক হয়ে ওঠে। এর ফলে কবিতা হয়ে ওঠে প্রবন্ধ এবং গল্প। আমাদের কিন্তু সচেতনভাবেই গদ্যচর্চা করতে হবে। নজরুলের প্রাবন্ধিক সত্তা দুর্বল ছিল বলে অনেক প্রবন্ধ পদ্যে প্রকাশিত হয়েছে। শামসুর রাহমান ভালো গল্প লিখতে পারতেন, কিন্তু তিনি হুমায়ুন আজাদের মুখে তার গদ্যের কটু সমালোচনা শুনে গদ্য লেখা ছেড়ে দেন। এতে অনেক গল্প তার হাতে কবিতা হয়ে বেরিয়েছে। উভয়ক্ষেত্রেই কবিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জুনায়েদ: এতক্ষণের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি, চলমান গতানুগতিক সাহিত্যধারা থেকে আমাদের রুচি ভিন্ন। রুচিগত মিলকে বিশ্বাসের ঐক্য ধরে আমরা নতুন কিছু করার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
অনু: অন্যদের থেকে ভিন্নতাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। কবিতায় এখন যদি তা স্পষ্ট করে তুলতে পারি, তাই হয়ে দাঁড়াবে আন্দোলনের কাঠামো।
জুনায়েদ: আমাদের ঐক্যের জয় হোক।

ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ ।। সিপাহী রেজা

  চিৎকার করে কবে যেন বলেছিল ওরা -শান্তি, মাগো শান্তি
তারপর কবুতর তার দানা শেষে উড়ে গেছে
অন্ধকার ডানা মেলে শহুরে কাক ঠিক যেন কথা রাখে !

চোখের সামনে বুড়ো হয় বাবা, মা; দাদা-দাদীর মরা চোখ!
জোয়ান শরীর, জোয়ান শহর
চারদিকে আশ্বাস, আহা বিশ্বাস -কথা রাখে !

বেরিয়ে যে যাই আসলে কোথায় যাই ?
দরজার বাইরে সেটেলমেন্ট, দরজার ভেতরে সেটেলমেন্ট
            বিষধর ফণা তোলা সেটেলমেন্ট !
            লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ...

দেহের লোভ মনের কাছে এসে হেরে যায় বহুবার
           হাসি বলতে যেটা
                    দেখে না দেখার ভান,
                               শুনে না শোনার ভান

           সেটাও তো গলার কাছে এসে মরে যায়,
           পচে গন্ধ ছড়ায়।

তারচে মুখ বুজে থাকাই ভালো।
চলছে চলুক মন্দ কি –অন্নকে গিলে ফেলুক অন্ন !

শুক্কুরে শুক্কুরে হল আষ্টো দিন !
আমি না জানি প্রেম, না জানি নিবেদন,
কি আর বলবো, ইদানীং ঈশ্বরও বুঝি গঞ্জের মহাজন !

পিতৃত্ব ।। রাজীব নূর


মালতিপাড়া মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ আবদুল মোতালেব আলী হাজতে। নিজের মেয়েকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে। হাজতে আনার একদিন পরই তাকে আদালতে হাজির করিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আজ তার হাজতবাসের ষষ্ঠদিন, রিমান্ডের পঞ্চমদিন।

এর মধ্যে ওর নিজের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের কেউ তাকে দেখতে আসেনি। আজ প্রথমবারের মতো যে দেখতে এসেছে, সে তার কেউ নয়, হওয়ার কথাও নয়। কান্দাপাড়ার রমলা মাসি কারো কিছু হয় না। অথচ সবাই তাকে চেনে। যারা ওই পাড়ায় যায়, তারা এবং যারা ভুলেও ওমুখো হয় না, তারাও। সবাই জানে রমলা মাসির নাম।

রমলা মাসিকে থানায় দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে পুলিশের লোকজনও। অবশ্য রমলা মাসির হাত যে অনেক লম্বা জানা আছে তাদের। তাই দায়িত্বরত সাব-ইন্সপেক্টর হাজতখানা থেকে মোতালেবকে বের করে পাশের রুমে এনে মাসির সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কনস্টেবলকে।

হাজতখানাটি আয়তাকার। সামনে তেরো শিকের লোহার দরজা। এরপর আরো একটি লোহার দরজা রয়েছে। দরজার ফাঁক দিয়ে সামান্য বাতাস আসে, যা মোতালেবের মতো আরো হাজতবাসীর সহায় হয়েছে। একমাত্র টয়লেটের ছাদ দেয়াল পর্যন্ত ঠেকানো হয়নি, অর্ধেক তোলা। তার ওপর দিয়ে দুর্গন্ধ হাজতখানার ভেতরে আসতে থাকে। টয়লেটের ময়লা যাওয়ার নালাটাও খোলা।

আজান দেওয়া মোতালেবের পেশা হলেও মসজিদ কমিটির দেওয়া মাসিক তিন হাজার টাকাই তার একমাত্র ভরসা নয়। তার বাবা ছিলেন সম্পন্ন গেরস্ত এবং তাকে একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখেই তিনি পরলোকগমন করেছেন। ফলে তাকে হাজতের মতো এত খারাপ অবস্থায় কখনো দিনাতিপাত করতে হয়নি। এর মধ্যে খাবার-দাবারের কষ্ট করতে হচ্ছে তার। কয়েকদিন ধরে বারবার ডাক পাঠিয়েও জিনদের কাউকে উপস্থিত করতে না পারায় ওরাই খুনটা করেছে, এমন ধারণাটা আরো পোক্ত হয়েছে তার মনে। খুন না করলে তার ডাকে সাড়া না দেওয়ার আর কী কারণ থাকতে পারে? মোতালেব নিজেই অন্য একটি কারণ খুঁজে পায়, তার মনে হয়, বাথরুমের দুর্গন্ধ জিনদের আসতে নিরুৎসাহিত করছে।

যেদিন তাকে পুলিশ ধরে আনল, সেদিনও দু-দুবার জিনেরা এসেছিল তার কাছে। বিকেলে জিনদের একজন পিরালি এসেছিল তাকে সাবধান করার জন্য। অন্যজন শেরালি এসেছিল মাগরিবের নামাজের পর, তখন সে পুলিশের হাতে আটক হয়ে গেছে। শেরালি এলো তাকে অভয় দেওয়ার জন্য।

বিকেলে পিরালি মোতালেবকে বিপদ আসন্ন জানালেও বিপদের স্বরূপ সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেনি। তবু মোতালেব বুঝতে পারে, ঝামেলাটা করবে পুলিশ। তাই প্রথমে ঠিক করে ইমাম সাহেব ফিরে এলেই সে পালাবে। ইমাম সাহেব প্রায়ই তার ওপর আজান দেওয়া থেকে জামাতে ইমামতি করার দায়দায়িত্ব দিয়ে পাশের গ্রামে অবস্থিত নিজের বাড়িতে ঘুরে আসতে যান। ওইদিনও ইমাম সাহেব বললেন, ‘মোতালেব, আমি বাড়ি থিকা একটা ঘুরান দিয়া আহি। তুমি আসর আর মাগরিবের নামাজটা চালাইয়া দিও।’

পুলিশ আসবে তাকে ধরতে, এটা বুঝতে পারলেও তখনই পালানোর প্রয়োজন বোধ করেনি মোতালেব। কারণ, সে পুুলিশকে কখনই মাঝরাতের আগে আসামি ধরার জন্য আসতে দেখেনি। তবু মাগরিবের পর পালানোর প্রস্তুতি হিসেবে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে। তাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে মেয়েদের একজন এসে জানতে চায়, ‘আব্বা, কই যাবেন?’

মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা, ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি মোতালেব। অনুপস্থিত ইমামের রুমের বারান্দায় নিজের কাপড়চোপড়-ভরা ব্যাগটা রেখে প্রথমে অজু করে নিল সে। অজু করতে না করতেই অন্য এক মসজিদে মাগরিবের আজান শুরু হয়ে গেল। তাই তাড়াতাড়ি অজু শেষ করে আজান দিতে দাঁড়াল সে। মোতালেব অন্যদিনের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে আজান দিলো আজ। আজান শেষ হতে না হতেই মসজিদ ভরে গেল মুসল্লির উপস্থিতিতে। মুসল্লিদের মধ্যে পুলিশের পোশাক পরা দুই ব্যক্তিকে দেখে মোতালেব বুঝে গেল, তার আর পালানোর সুযোগ নেই। এ-অবস্থায় সে জীবনে প্রথমবারের মতো প্রচণ্ড ভয় পায়। হঠাৎই কে একজন কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘ডরাইয়েন না?’

জিনের আশ্বাসে ভয়ডর কেটে যাওয়ায় মনপ্রাণ উজাড় করে ইমামতি করল মোতালেব।

সেই থেকে এই থানাহাজতেই আছে মোতালেব। মাঝে একবার কোর্টে ঘুরিয়ে আনা হলো তাকে। তার পক্ষে কোনো উকিলই দাঁড়ায়নি। উকিল দাঁড় করানোর মতো মোতালেবের যে আত্মীয়স্বজন একেবারে নেই তা নয়; কিন্তু নিজের আত্মজাকে হত্যা করার অপরাধে যাকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে, তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবে কে? হাজতেও তাকে দেখতে আসার কেউ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।

মোতালেব আশা করেছিল, আর কেউ না এলেও তার বড় মেয়েটা আসবে। থানাহাজত থেকে হাঁটাপথে মিনিট দশেকের দূরত্বে বড় মেয়ে খাদিজার বাসা। খাদিজার স্বামী মোহাম্মদ আবু তাহেরকে মোটামুটি অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী বলা চলে। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও তাহের মোল্লাগিরি না করে ব্যবসাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। কন্ট্রাক্টরি করে সে। তা ছাড়া শহরের ব্যস্ততম এলাকা, সদর হাসপাতালের সামনেই তার বিরাট ওষুধের দোকান। দুই সন্তানের মা-বাবা ওরা।

খাদিজা তার মা-বাপের একের পর এক সন্তান জন্ম দেওয়াটাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। বাবার সামনেই সে একবার তার মা হোসনা বেগমকে বলে বসল, ‘আম্মা, আপনেরা কি শরম-লজ্জার মাথা খাইছেন। নাতি-নাতনিগোর নগে নিজেগো পোলাহান মানুষ করতে কি ইটটুও শরম লাগে না।’

খাদিজারা সাত বোন। খাদিজার বয়স ২৫, আয়শার বয়স ২১। সাত সন্তানের এই দুজনের নাম মোতালেবের পছন্দে রাখা হয়েছিল। এরপর মোতালেব একটি ছেলের আশায় আরো পাঁচটি মেয়ের জন্ম দিয়ে গেল এবং প্রতিটি মেয়ের জন্মমাত্রই এতটা হতাশ হলো যে, তাদের নাম রাখারও প্রয়োজন বোধ করেনি। ফলে কোরানের হাফেজ মুয়াজ্জিনের মেয়েদের নাম রাখা হলো অলি, কলি, জুলি, মলি ও পলি।

মুয়াজ্জিন মোতালেব আলীর একটা ছেলে চাই-ই চাই। তাই তার স্ত্রী হোসনা বেগম যখন অষ্টম সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে, তখন তার দ্বিতীয় মেয়ে আয়শা দ্বিতীয়বারের মতো সন্তানসম্ভবা হয়েছে আর বড় মেয়ে খাদিজার ছেলেমেয়ে দুটির বড়টি পা দিয়েছে স্কুলের বারান্দায়।

খাদিজা এসেছে মাকে দেখতে। অন্য মেয়েরা মোতালেবের সামনে কথা বলতে ভয় পেলেও খাদিজা কখনো বাবাকে তেমন তোয়াক্কা করে না। তাই বাপের সামনেই মাকে ভর্ৎসনা করার ছলে বাপকে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে বলল, ‘আরো একটা মেয়া হইব আপনেগো।’

মোতালেব অনেকক্ষণ চুপচাপ মেয়ের কথা শুনে যাচ্ছিল, এবার আর সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে বলল, ‘এইবার মেয়া অইলে তোর মায়রে তালাক দিয়া আরেকটা বিয়া করুম আমি।’

‘আব্বা এইসব কী কইতাছে, হুনছেন?’

খাদিজা পাশের ঘর থেকে তার স্বামী তাহেরকে ডেকে আনে, ‘আপনে আব্বারে বুঝাইয়া কন তো পোলা না মাইয়া হইব তা মাইয়ালোকের না, পুরুষমাইনষের ব্যাপার।’

মাদ্রাসাশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও ওষুধের দোকান চালানোর কারণে ডাক্তারিবিদ্যার অনেক কিছুই জানা হয়ে গেছে আবু তাহেরের। মেয়েজামাইয়ের কথাবার্তা শুনতে শুনতে মোতালেবের মনে হয়, তার মেয়ে ও মেয়েজামাই Ñ দুইটাই বড় নির্লজ্জ হয়ে গেছে। রাগ সামলাতে না পেরে বলে, ‘যদি এবারও আরেকটা মাইয়ার জন্ম হয়, ওইটারে আমি নুন খাওয়াইয়া মাইরা ফালামু।’

সাত চড়ে রা করে না যে-মানুষটি, সেই হোসনা বেগম কিনা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে হাতে বঁটিদা তুলে নিয়ে বলে, ‘ঘর থেকে বাইর অন। নাইলে আমি আপনেরে কোপাইয়া মারুম।’

খাদিজা মাকে আঁকড়ে ধরে নিরস্ত করে এবং তাহের শ্বশুরকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়ে হোসনা বেগম। মেয়ে ও জামাই মিলে হাসপাতালে নিয়ে যায় তাকে।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর শুরু হয় প্রসববেদনা এবং যথারীতি আরো একটি মেয়ের জন্ম দেয় হোসনা বেগম। অকালে প্রসব হলেও মেয়েটি বেশ সুস্থ-সবল অবস্থাতেই পৃথিবীতে আসে।

স্ত্রী-সন্তান মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করলেও এ-খবর পেতে পুরো দুটি দিন লেগে যায় মোতালেবের। তাও আবার খবর নিয়ে আসে প্রতিবেশীদের একজন। আজান দিতে যাওয়ার পথে দেখা হয় তবারক আলীর সঙ্গে। তবারক বলে, ‘মুয়াজ্জিন, আছ কিবা?’ মোতালেবের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সে জানায়, ‘গ্যাসটিকের ব্যাদনাডা বাইরা যাওয়ায় হাসপাতালে গেছিলাম।’ মোতালেব চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। তবারক আলী এবার বোমা ফাটায়, ‘তোমার মেয়া দেইখা আইলাম। একদম তোমার মতো অইছে।’

মোতালেব বিস্মিত হয়। বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই তবারক বলে, ‘তুমি কিন্তুক আবার আমার কাছ থিকা খবর পাইছ, এইডা কেউরে কইও না। খাদিজা আমারে বারবার অনুরোধ কইরা কইছে তোমারে জানি খবরডা না জানাই। আমি তো জানি, আমি খবর গোপন রাখলেও জিনেরা তোমারে খবর জানাইয়া দিব। তাই কইয়া দিলাম আর কী?’

এতদিন ধরে দুই-দুইটা জিন পোষার গল্প করে এসেছে যাদের কাছে তাদের একজন তবারক আজ জানল, আসলে জিনের গল্পটা সত্য নয়। সত্য হলে এই অতি সাধারণ খবরটা মোতালেবের অজানা থাকত না।

মোতালেব ভাবে, শেরালি ও পিরালি তার সঙ্গে এই প্রতারণা করল কেমনে? এ-কথা ভেবে নামাজের পরও মসজিদে বসে থাকল মোতালেব। মনে মনে সে জিনদের ডাকতে লাগল। ডাকতে ডাকতে যখন হতাশায় নিমজ্জিত হতে চলেছে মোতালেব, ঠিক তখন তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে জিনদের দুজনই এসে হাজির হলো, ‘তবারক মিয়া ঠিকই কইছেন, আপনের মেয়েটা এক্কেবারে আপনের মতন হইছে।’

‘তোমরা আমারে আগে জানাইলা না কেন?’

কোনো উত্তর নেই জিনদের।

হঠাৎ মোতালেবের মনে হয় তার স্ত্রী মিথ্যা বলে না, আসলে জিনটিন কিছুই নেই। সবই তার মনের কল্পনা। একই কথা অবশ্য ইমাম সাহেবও বলেন। তাই বলে গ্রামের মানুষ মোতালেবের পোষা জিনের ওপর একটুও সংশয় রাখে না। শুধু কি তার নিজের গ্রাম, আশপাশের ১০ গ্রামের মানুষ আসে শেরালি ও পিরালির কাছ থেকে পাওয়া পানিপড়া নিতে। প্রথম প্রথম লোকজন মোতালেবের কাছে পানিপড়া নিতে আসার সময় এটা-ওটা উপহার নিয়ে আসত। অবস্থাপন্নরা চাইত নগদ টাকা দিতে। মোতালেব কঠোরভাবে এসব উপহার-উপঢৌকন ফিরিয়ে দেওয়ায় মানুষের আস্থা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। ক্রমে ভিড় বাড়তে থাকে তার বাড়ির আঙিনায়। মোতালেব আবার কড়া নিয়ম মেনে চলে, সে কোনোক্রমেই দিনে ১১ জনের অতিরিক্ত একজনকেও পানিপড়া দেয় না। তার এই পানিপড়া খেয়ে কতজনের কত ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, কিন্তু নিজের পুত্রসন্তান পাওয়ার ইচ্ছাটা অপূর্ণই থেকে গেল। হোসনা বেগম কতবার কতভাবেই না তার কাছে মন্ত্রপূত পানিপড়া চেয়েছে। মোতালেবের এক জবাব, ‘এই পানিপড়া আমার নিজের লাইগ্যা ব্যবহার করন যাইব না।’

‘যদি আপনের নিজেরই কামে না লাগল তাইলে জিন পাইল্যা লাভ কী?’

‘তুমি এহন যাও। এই জিনিস বুঝন মাইয়া মাইনসের কাম না।’

হোসনা বেগম উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘আসলে তো জিন নাই। আপনে নিজেই একটা জিন হইয়া বইয়া রইছেন।’

উত্তেজনার বশে হোসনা বেগম যে-কথা বলেছিল, তা যে ষোলো আনা মিথ্যা, এমন দাবি মোতালেবও করতে পারে না। তার প্রায়ই মনে হয়, জিন দুইটা আসলে সে নিজেই। নিজেই সে নিজের সঙ্গে কথা বলে। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে আসা মানুষদের মন্ত্রপূত পানিপড়াও দেয়। কিন্তু তার কাছে তাজ্জব লাগে যখন সে হঠাৎ দেখা কোনো মানুষের অতীত-বর্তমান বলতে শুরু করে এবং তা নির্ভুলভাবেই বলতে পারে।

মেজাজ খারাপ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় মোতালেব। শেরালি ও পিরালি তার সঙ্গ ছেড়ে যায়নি বলে সে ঘরে না গিয়ে ঘরের দাওয়ায় তুলে রাখা বাইসাইকেলটা নামিয়ে আনে এবং মেয়েদের কাউকে কিছু না জানিয়ে শহরের পথে রওনা দেয়।

হাসপাতালে কি মোতালেব গিয়েছিল? মোতালেবের স্ত্রী হোসনা বেগম মামলা করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এলো, যে-ওয়ার্ডে সে ছিল, সেটা সরেজমিন পরিদর্শন করতে। পুলিশের কাছে হোসনা বেগম জানিয়েছে, ‘বাচ্চাটা ঘুমাইয়া ছিল। ওরে রাইখ্যা আমি বাইরে গেছিলাম।’

পাশের সিটের মহিলা হোসনা বেগমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করে, ‘হঠাৎ কইর‌্যা খুটখাট শব্দ শুইনা ঘুম ভাইঙা গেল আমার। তাকাইয়া দেহি দাড়িআলা এক বেডা ওয়ার্ডে খাড়াইয়া রইছে। আমি জিগাইলাম, আপনে কার কাছে আইছেন। হে কইল, হোসনা বেগম কোনে? আমি কইলাম, বাথরুমে। হে কইল, অ তাইলে এইডা আমার মাইয়া। কইয়া সে মাইয়ারে কোলে নিল। আমি তারে নিষেধ করলাম। আমার কথা কানেই নিল না। আমার দিক পিছ ফিইরা খাড়াইয়া থাকায় মাইয়াডারে গলা টিইপ্যা মারছে কিনা জানি না।’

হোসনা বেগম বলে, ‘আমি বাথরুম থিকা বাইর অইয়া দেখলাম খাদিজার বাপ চইল্যা যাইতাছে। আমি তারে ডাক দিয়া কইলাম, আপনে চইল্যা যাইতাছেন ক্যা, খাড়ান। কথা কইয়া যান। সে উত্তর না দিয়া কান্ধের গামছা দিয়া মুখ ডাইক্যা বাইর হইয়া গেল।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কবির আহমেদ তদন্তের অগ্রগতিতে খুশি হয়ে চলে যায় এবং পরের দিন আদালতে আবেদন করে মোতালেবকে রিমান্ডে নিয়ে আসে। রিমান্ডে আনার পর জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতেই মোতালেব স্বীকার করে নেয় যে, সে নিজেই তার মেয়েকে খুন করেছে। সহজ-সরল স্বীকারোক্তিতে রেহাই পায় না সে। বরং এ-স্বীকারোক্তির মধ্যে একজন পিতার  যে-নিষ্ঠুরতা প্রমাণিত হয়, তা তদন্ত কর্মকর্তাকে উত্তেজিত করে তোলে এবং সে সিপাইদের দুজনকে মোতালেবকে দলাই-মলাই দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

পুলিশের এক কনস্টেবল যখন তাকে ঘুম থেকে জাগায় তখন সারাশরীরে তার ব্যথা। কনস্টেবল যখন জানায়, ‘চল বেটা মুয়াজ্জিনের বাইচ্চা, তর লগে দেখা করতে কান্দাপাড়ার রমলা মাসি আইছে।’ তখনো সে কিছু বুঝতে পারে না। কনস্টেবল মুখ খারাপ করে বলে, ‘রমলা মাসির নাম শুইন্যা ধোন খাড়া কইরো না, বাপজান। মাসির যৌবন গেছে বহুদিন। তোমার লগে দেখা করতে আসছে সত্তর বছরের এক মাগি। সে এখন পাড়ার মাসি, মাগির দালালি করাই তার কাম।’

কান্দাপাড়া যে শহরের একমাত্র পতিতাপল্লি, তা মুয়াজ্জিন হলেও মোতালেবের অজানা নেই। ওই পাড়ার এক মাসি দেখা করতে এসেছে শোনার পরও তার মনটা নেচে ওঠে। কেউ একজন তো এসেছে দেখা করতে।

পুলিশের সঙ্গে কান্দাপাড়ার রমলা মাসির যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা ওদের দেখা করিয়ে দেওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা থেকেই বুঝতে পারে মোতালেব। মাসি ঘরের একমাত্র খালি চেয়ারটি দেখিয়ে মোতালেবকে বসতে ইশারা করে। তারপর বলে, ‘মুয়াজ্জিন সাব, আমি আপনারে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করব।’

কেন করবেন? মোতালেবের মনে এ-প্রশ্ন এলেও সে প্রশ্ন করে না। বরং রমলা মাসি হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে বলে, ‘কেন করুম জানতে চাইলেন না যে?’

‘আপনেই কইন’ বলে চেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়ায় মোতালেব।

‘করুম, কারণ আমার অনেক মেয়ে বাইচ্চা দরকার।’

মোতালেব তার মুক্তির সঙ্গে রমলা মাসির মেয়ে বাচ্চা দরকারের সম্পর্কটা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয় না, বরং সে অকূল সাগরে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো বলে, ‘আগে আমারে বাইর করনের ব্যবস্থা করেন।’

‘করনের জন্যই তো আসছি, বাইর করনের পর আপনে প্রথমে আপনের বউরে তালাক দিবেন।’

সে আর বলার অপেক্ষা রাখে, মোতালেব তো মনে মনে অনেক আগেই এটা ঠিক করে রেখেছে, যে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে তালাক না দেওয়ার কোনো কারণ নেই, তাই জোর গলায় বলে, ‘অবশ্যই তালাক দিমু।’

‘শর্তের হেরফের করলে কিন্তু আমি কাউরে ক্ষমা করি না।’

‘হেরফের অইব না। আপনে আমার মা-বাপ, যেমনে পারেন আমারে বাইর করেন আগে।’

‘ঠিক আছে। এইবার পুলিশ আর রিমান্ড চাইব না। ডাক্তার রিপোর্ট দিব যে, আপনের বাচ্চারে কেউ খুন করে নাই, সে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।’

‘বিশ্বাস করেন মাসি, আমি খুন করি নাই’, মোতালেব এই প্রথমবারের মতো নিজের সন্তানকে খুন করার অভিযোগ মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল।

‘খুন করছেন কি করছেন না, সেইটা আপনে জানেন আর পোষা জিনেরা জানে।’

‘আপনে আমার জিনের কথা জানেন? আসলে জিন বলে কিছু নাই, থাকলে আমার কপালের এই অবস্থা অইত না’, বলল মোতালেব। তারপর টুপি খুলে কপালের ফোসকাগুলো দেখিয়ে বলে, ‘না, জিন বইল্যা কিছু নাই, সবই আমার কল্পনা।’



দুদিন পরের ঘটনা। আদালতের বারান্দায় কান্দাপাড়ার রমলা মাসিও উপস্থিত। মোতালেবকে পুলিশ বারান্দা দিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি হাসল মাসি। মাসি যে যথেষ্ট প্রভাবশালী তা মোতালেবের পক্ষে জেলার সবচেয়ে দামি উকিল উঠে দাঁড়ালে আবার টের পেল সে। রিমান্ডে মোতালেব বারবার আত্মজাকে খুন করার কথা স্বীকার করলেও কোর্ট ইন্সপেক্টর জানাল, ‘মোতালেব বলেছে, সে হাসপাতালে গিয়েছিল মেয়েকে দেখতে এবং স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি থাকার কারণে হোসনা বেগমের ডাকে সাড়া না দিয়ে পালিয়ে চলে এসেছিল।’ শুধু তা-ই নয়, ইন্সপেক্টর আরো জানাল, ‘হাসপাতালের ডাক্তাররা ছোট্ট মেয়েটির মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া বলে শনাক্ত করেছেন।’

মামলা চলাকালে বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষকে আদালতে হাজির হতে হয়। কাজেই হোসনা বেগম উপস্থিত রয়েছে, রয়েছে তাদের বড় মেয়ে খাদিজা ও খাদিজার জামাই। দুর্বল সাক্ষ্যপ্রমাণের পর আসামিকে জামিন না দেওয়ার উপায় থাকে না বিচারকের। জামিন পেয়ে কোর্টের বারান্দায় ভিড় জমানো লোকজনের উপস্থিতিতে মোতালেব মামলার বাদী তার স্ত্রী হোসনা বেগমকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তোমারে আমি তালাক দিলাম। এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বাইন তালাক।’

মুয়াজ্জিন মোতালেব জানে এভাবে তালাক শরিয়তসিদ্ধ হয় না। তবু তালাকের ঘোষণায় তার স্ত্রী ও মেয়ে যখন হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল, তখন তালাক দেওয়ার কঠিন কাজটি এত সহজে সেরে ফেলতে পারায় মোতালেব মনে মনে স্বস্তিবোধ করে। তার স্বস্তির রেশ না কাটতেই টিংটিংয়ে প্রায় ছয় ফুটি এক যুবক, যার নাম দেওয়া যায় তালপাতার সেপাই, সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে মোতালেবের কাছে এবং তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। সে জানতে চায়, ‘টানাটানি করতাছুইন কির লাইগ্যা।’

মোতালেবকে আশ্চর্য করে তালপাতার সেপাই বলে, ‘আমি রমলা মাসির লোক, মাসি আপনেরে নিয়া যাইতে কইয়া গেছে।’

‘আত ছাড়েন, আমি তো যাইতাছি।’

তালপাতার সেপাইয়ের সঙ্গে এক রিকশায় করে মুয়াজ্জিন মোতালেব যখন কান্দাপাড়ায় হাজির হয় ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। আসার পথে জানতে পায়, সে যাকে মনে মনে তালপাতার সেপাই ডাকছে, লোকটি সত্যি পুলিশের একজন সিপাই ছিল এবং পাড়ার সবাই তাকে সিপাই নামে ডাকে। কান্দাপাড়ার নাম জানা থাকলেও মোতালেব এর আগে কোনো দিন এ-পাড়ার পাশ মাড়ায়নি। তাই রংচঙে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের দেখে ভয় পেয়ে যায়। মেয়েদের একজন, চিল যেমন মুরগির ছানাকে ছোবল দিয়ে উড়াল দেয়, ঠিক সেরকম উড়াল দেওয়ার মতো তাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলে মোতালেবের ভয় আরও বাড়ে। ভয়ে সে সিপাইকে ডাকতে পর্যন্ত ভুলে যায়। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে ফিরে তাকাতেই ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করে তালপাতার সিপাই, ‘আরে জুঁই, করতাছস কী? রমলা মাসি এই বেডারে জেলহাজত থেইক্যা ছাড়াইয়া আনছে। আগে অরে মাসির ঘরে নিয়া যা।’

মেয়েটি এবার হাত ছেড়ে বলে, ‘আসেন, মাফ কইরা দিয়েন, আমি বুঝতাম পারি নাই যে আপনে মাসির স্পেশাল গেস্ট। অবশ্য স্পেশাল গেস্টদের খেদমত করার জন্য মাসি বেশির ভাগ সময় আমারেই দায়িত্ব দেয়।’

মাসি দরজায় দাঁড়িয়ে যেন মোতালেবের আসার অপেক্ষা করছিল, ‘আসেন, আসেন, মুয়াজ্জিন সাহেব।’

মোতালেবের সঙ্গে জুঁই আর সিপাইও আসে রমলা মাসির ঘরে। মোতালেব দেখতে পায়, এতক্ষণ যেসব খুপরি ঘর দেখে এসেছে, সেগুলোর তুলনায় মাসির ঘরটা বেশ বড়। পুরনো আমলের খাটে পরিচ্ছন্ন চাদর বিছানো। মাথার ওপর ফলস সিলিং দেওয়ায় টিনের চাল দেখা যাচ্ছে না এবং গরমও কম লাগছে। ফলস সিলিং ছিদ্র করে একটা লোহার ডান্ডা নামিয়ে আনা হয়েছে নিচের দিকে, ওই লোহার মাথায় ঘুরছে ফ্যান। ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে মাসি বলে, ‘মুয়াজ্জিন সাব, জুঁইরে পছন্দ হইছেনি আপনের?’

মোতালেব একটু লজ্জা পেলেও জুঁই হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘ও মাসি, তুমি কি এই লোকের কথা কইছিলা আমারে। আমি যদি তার লগে থাকি তাইলে আমার তালপাতার সিপাইয়ের কী অইব?’

‘সিপাই আজকা থেইক্যা কঙ্কনের লগে থাকব। ওরে দিয়া তো বাচ্চা ফুটাইয়া লাভ নাই। ও খালি পোলাপানেরই জন্ম দিতে জানে।’

‘মাসি, কামডা কিন্তু ভালো অইল না’, বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সশব্দে পা ফেলে মাটিতে, যেন পিটি-প্যারেড করছে পুলিশের সাবেক এই সিপাই।

রমলা মাসি জুঁইকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করে বলে, ‘তর আজকা কোনো কাস্টমার ডাকনের দরকার নাই। মুয়াজ্জিন থাকব তর লগে।’

মোতালেব এতক্ষণে মুখ খোলে, ‘মাসি, এইগুনা কী কইতাছেন। আমি আপনের পাড়ার মাইয়া লোকের লগে থাকতে যাইমু কোন দুঃখে?’

‘আমি থানায় গিয়া কথাবার্তা পাকা কইরা আসি নাই? আপনেরে আমি কই নাই, আমার অনেক মাইয়া বাচ্চা লাগব। আমার হিসাবমতন জুঁই যদি আজকা সহবাস করে তার পেটে বাচ্চা আসনের আশা আছে। আপনে আজকা জুঁইয়ের সঙ্গে রাত কাটাইবেন।’

‘এইডা তো বেশরিয়তি কাম’, বলে একটু থামে মোতালেব, আবার বলে ‘মাসি, আপনে আমারে এত বড় শাস্তি দিয়েন না।’

‘দেখেন মুয়াজ্জিন সাব, শরিয়ত আমারে শিখাইয়েন না। আপনেরে কি শরিয়ত শেখানোর লাইগ্যা আমি বার কইর‌্যা আনছি।’

‘আমি তো বেগানা নারীর সঙ্গে সহবাস করবার পারুম না।’

‘এইটা তো আগে ভাবি নাই।’ বলে কী যেন ভাবে রমলা মাসি, তারপর বলে, ‘ঠিক আছে, বেগানা নারীর সঙ্গে আপনের সহবাস করা লাগব না। আজকাই আমি আপনের লগে জুঁইয়ের বিয়া দিমু।’

‘আমি আপনের পাড়ার মেয়ে, জেনা করা যার জীবিকা, তারে বিয়া করতে যামু কোন দুঃখে?’

রমলা মাসি এবার রেগে যায়, ‘করবেন। আমি আপনেরে এই শর্ত দিয়া মৃত্যুদণ্ডের হাত থেইকা বাঁচাইয়া আনছি। আমি আজকা আপনের লগে জুঁইয়ের বিয়া দিমু। কদিন পর রেশমারে, তারপর আপনের লগে বিয়া দিমু চশমা আর মৌরিরে। শরিয়তে চাইর বিয়া করন যায়। আপনের চার বউয়ের যে আগে গর্ভবতী হইব, তারেই আপনে তালাক দিবেন। তখন আবার নতুন আরেকটা মাইয়ারে বিয়া দিমু আপনের লগে। কোনো সময় চারজনের বেশি বউ থাকবে না আপনের।’

মোতালেব এবার ভয় পেয়ে যায়। সে রমলা মাসির পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মাসি, আমারে ছাড়ানের লাইগ্যা আপনার যত টাকা গেছে, আমি জমিজমা বিক্রি কইরা তা শোধ কইরা দিমু। তবু আপনে আমারে ছাইড়া দেন।’

‘টাকা শোধ কইরা তো পার পাইবেন না। আপনের মামলা আবার কোর্টে উঠব। ডাক্তাররা কইব, আপনের বাচ্চাটারে গলা টিইপা মারনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আগের রিপোর্ট ভুল আছিল।’

উপায়হীন মোতালেব গুমরে কাঁদতে শুরু করলেও ঘিঞ্জি এ-পল্লির অনেকেই তা শুনতে পায়। কাজেই রমলা মাসির ঘরের সামনে মেয়েদের ভিড় জমে যায়। ভিড়ের মধ্য থেকে জুঁইকে ডেকে এনে মাসি বলে, ‘মুয়াজ্জিন সাবরে তর ঘরে লইয়া যা। খাওনদাওন করাইয়া ওনারে রেস্ট নেওনের ব্যবস্থা কইরা দে।’

ক্ষিধে ছিল প্রবল, ঘুমও। তাই খাওয়া-দাওয়া শেষে লম্বা একটা ঘুম দেয় মোতালেব। জুঁই অবশ্য এর মধ্যে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেছে। মোতালেবের সাড়া না পেয়ে একসময় তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নারীদেহের স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেলে নিজের মধ্যে কেমন যেন সাড়া টের পায় সে। তবু নিজেকে হয়তো নিবৃত্ত করতে পারত, কিন্তু জুঁইয়ের প্ররোচনায় নিষেধের বাঁধ ভেঙে যায়। অসামান্য সুন্দরী এক নারীর দেহ তাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে। কাজেই সন্ধ্যায় যখন তার জন্য নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি নিয়ে আসা হলো, বিনা ওজরে সে দুলহা সেজে চলল বিয়ে করতে। কাজি অফিসে যাওয়ার পর জানল জুঁইয়ের আরো একটি নাম আছে এবং সেই নামই কাবিননামায় লেখা হলো।

কান্দাপাড়া ছাড়িয়ে তাদের রিকশাটি যখন হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করছিল, তখন কেমন যেন একটু ভয় ভয় লাগছিল, মনে হচ্ছিল পরিচিত কেউ তাকে দেখে ফেললে কী হবে? তাই নবপরিণীতা জুঁইয়ের আঁচল টেনে নিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখে। মোতালেবের মুখ ঢাকার এ-চেষ্টায় হাসিতে ভেঙে পড়ে জুঁই, ‘আরে হুজুর, আপনে শরম পাইতাছেন কী জন্য। এ-বিয়াটা আসলে ছোটবেলার বিয়া বিয়া খেলার মতন একটা ঘটনামাত্র। আমার পেটে বাইচ্চা আসলে মাসি আপনেরে কইব, এইবার জুঁইরে তালাক দেন।’

লজ্জা কাটানোর চেষ্টায় বলা জুঁইয়ের কথা যেন মোতালেবকে আরো লজ্জায় ফেলে দেয়। জুঁই সেটা বুঝতে পেরে মোতালেবকে আরো লজ্জা দেওয়ার জন্য বলে, ‘আমার মনে হয় বিকালে যে শট লাগাইছেন, তাতেই কাম হইয়া গেছে। আমি পেটের ভিতরে একটা বাইচ্চার কান্দন শুনতাছি।’

মোতালেব নিচুস্বরে বলে, ‘লজ্জা-শরমের মাথা খাইছেন আপনে। রিকশাআলা হুনতাছে না?’

‘শমসের শুনতাছ নি?’ এবার জুঁই রিকশাঅলাকে ডাকে এবং উত্তরে রিকশাঅলা হেসে বলে, ‘কান ত অহনও নষ্ট হয় নাই।’

‘হুজুর শরমাইয়েন না, শমসের মিয়া আমরার পাড়ার বান্ধা কাস্টমার। আমার লগেও বহুবার শুইছে সে। আজকাও দুপুরে আপনে যখন ঘুমাইতেছিলেন, তখন একবার দরজা ধাক্কাইয়া গেছে। আমি তারে কইছি, আমি এখন আমার স্বামীর লগে আছি, তুমি আরো কয়দিন পরে আইও।’

‘আপনে চুপ করেন। নাইলে আমি কিন্তু রিকশা থেইক্কা নাইমা আডা দিমু।’

রিকশা থেকে নেমে হাঁটা দেওয়ার শক্তি যে মোতালেবের নেই, তা জুঁইও জেনে গেছে। পেছনের রিকশায় সিপাইসহ স্বয়ং রমলা মাসি আছে। তবু মোতালেবকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘হুজুর, আপনে অইলেন আমার বিবাহ করা স্বামী। আপনে চুপ করতে কইলে চুপ না কইরা উপায় আছে? এই যে আমি মুখে তালা দিলাম। আপনে না কওন পর্যন্ত এই তালা আর খুলতাম না।’

জুঁইয়ের যে-ঘর থেকে মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে তারা বেরিয়ে গিয়েছিল, সে-ঘরই বেশ সাজানো হয়েছে। দরজায় রঙিন নিশান কেটে ঝালর লাগানো হয়েছে। ঘরের ভেতরেও ঝালর টানানো হয়েছে। বেলি, রজনীগন্ধা ও গোলাপ দিয়ে বানানো মালা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে বিছানার চারদিক। রেশমা, মৌরি ও চশমা ধান-দূর্বা দিয়ে তাদের ঘরে তুলে আনলে হঠাৎ মোতালেবের মনে পড়ে বহু বছর আগে হোসনা বেগমকে বিয়ে করে নিয়ে আসার পর তাদের বরণ করে ঘরে তুলবে বলে মঙ্গলকুলো নিয়ে এভাবেই দাঁড়িয়েছিল মাতৃকুলের নারীরা। একই সঙ্গে গ্লানি এসে গ্রাস করে তাকে, মনে পড়ে হোসনা বেগমকে সে যেভাবে তালাক দিয়ে এসেছে, তা শরিয়ত মোতাবেক হয়নি এবং এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ইদ্দতকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই সে এমন একজনকে বিয়ে করেছে, জেনা করাই যার কর্ম। শুধু তা-ই নয়, আজ বিকেলে সে নিজে জেনার মতো গুরুতর পাপ করেছে। ফলে রমলা মাসির নিজের হাতে বহু যক্ষ করে রান্না করা পোলাও-কোর্মা খেতে গিয়ে বমি হয়ে যায় তার এবং রাতে জুঁইয়ের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও সে সহবাসে লিপ্ত হতে পারে না।

দিনকয়েক পর জুঁইয়ের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব শোনার পর মাসি ডেকে আনে মোতালেবকে, ‘আপনে মিয়া কেমন মরদ। আমার মাইয়াগুলানের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও যুবতী মাইয়াটার লগে বিচিকাটা খাসির মতন পইড়া পইড়া ঘুমান।’

‘আমার ডর লাগে।’

‘কিয়ের ডর?’

‘রোজ হাশরের ময়দানে জেনা করনের কী জওয়াব দিমু।’

‘আল্লাহর কাছে আমার নামে বিচার দিয়া কইবেন, কান্দাপাড়ার রমলা মাসি আপনেরে বন্দি কইরা জেনা করতে বাধ্য করছে। গুনাগাতা সব আমার নামে লেখাইয়া দিবেন।’

জুঁই হাসতে হাসতে বলে, ‘মাসি গো, তোমারে কী কমু, পয়লা দিন তুমি আমার ঘরে হুজুররে খাওইয়া-দাওয়াইয়া রেস্ট করাইতে পাঠাইলা না। তিনি খাইলেন, খাইয়া নাক ডাকাইয়া ঘুম দিলেন। আমি আর কী করুম হুজুরের পাশে শুইয়া ঘুম দিলাম। কতখান ধইরা ঘুমাইছি কইতে পারি না। হুজুরের চুমাচাপটির চোটে ঘুম ভাইঙ্গা গেল আমার। বাধা দিয়া থামাইতে পারি নাই।’

রমলা মাসি কৌতুকের হাসি দিয়ে বলে, ‘কী মিয়া, বিয়ার আগে যে-কামটা জোর কইরা করলা, বিয়ার পর সেইটা পারো না কী জন্য?’

‘মাসি, আমার হুজুররে আর বকাবকি দিও না। সব ঠিক অইয়া যাইব।’

দুই.

‘কী ঠিক অইব। তুই মাগি তোর জোয়ানকি দিয়া কী করছ? একটা মরদের মধ্যে মর্দানি জাগাইতে পারছ না। নে, বড়িটা ল, ঘুমাইতে যাওয়ার ঘণ্টাখানিক আগে তর হুজুররে এইটা খাইতে দিবি।’

বড়ির গুণে হোক আর জুঁইয়ের জোয়ানকির জোরে হোক মোতালেব সে-রাতে আবার নারীর স্পর্শে শিহরিত হয়।

পরের দিন জুঁইয়ের কাছ থেকে এ-তথ্য জানার পর রমলা মাসি এবার রেশমার সঙ্গে মোতালেবের দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন করে। শুধু তা-ই নয়, মাসির পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী একে একে চশমা ও মৌরিকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় মোতালেব।

মোতালেব প্রথম প্রথম কয়েকদিন তার পোষা দুই জিন শেরালি ও পিরালিকে ডাকাডাকি করছিল। একসময় তার মনে হয়, এই পাপপুরীতে ওরা আসতে নারাজ, অন্য সময় মনে হয় তার স্ত্রী হোসনা বেগম ঠিকই বলত, জিনটিন কিচ্ছু নেই, এগুলো তার কল্পনা। শেরালি ও পিরালির সাড়া না পেয়ে রিকশাঅলা শমসের মিয়াকে দিয়ে খবর পাঠায় খাদিজার জামাই তাহেরের কাছে। শমসের খবর নিয়ে এসে বলে, ‘তাহের মিয়া আপনের লাইগ্যা কিছু করত পারব না। হে আপনেরে জানাইতে কইছে আপনের বউ মইরা গেছে। আপনের দ্বিতীয় মেয়ে আয়শারে তার জামাই তালাক দিয়া কইছে, যার বাপ মুয়াজ্জিন অইয়া বেশ্যাপাড়ায় আশ্রয় নিছে, তার লগে ঘর করন যায় না। বাচ্চা দুইটারে রাইখা দিয়া আপনের মেয়েরে আপনের বাড়িত পাঠাইয়া দিছে।’

মোতালেব এ-খবর পেয়ে অস্থির বোধ করে, তার আরো পাঁচটি মেয়ে অলি, কলি, জুলি, মলি ও পলির কথা মনে পড়ে, যাদের নাম সে রাখেনি, রেখেছিল ওদের মা। মোতালেব ঠিকই ওদের চিনত; কিন্তু সবসময় না চেনার ভান করত, অলিকে হয়তো কলি ডাকত আবার পলিকে ডাকত অলি। এখন মনে হয়, মেয়েগুলোরে আরেকটু ভালোবাসা দিয়ে বড় করা উচিত ছিল তার।

মেয়েদের খবর এনে দিতে শমসের মিয়াকে ধরে মোতালেব। খবর যা পায়, তা তাকে পাগল করে তুলে এবং সে এক রাতে পালানোর চেষ্টা করে। পারে না, ধরা পড়ে যায় তালপাতার  সেপাই এবং অন্য পাহারাদার জাম্বো ও গাম্বোর কাছে। শাস্তি হিসেবে রমলা মাসি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মোতালেবকে মুগুরপেটা করায়। পরে আবার ডাক্তার ডেকে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে। মোতালেবের চার বউয়ের দুজন রেশমা ও চশমা মারধরের এ-ঘটনা দেখে পাড়ার আর সব মেয়ের সঙ্গে হাসি-তামাশা করলেও জুঁই ও মৌরি এ নিয়ে মাসির সঙ্গে ঝগড়াঝাটি পর্যন্ত করতে শুরু করে।

দিনের বেলা তার বউদের সবাই কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কখনো কখনো রাতেও তার চার স্ত্রীর সবাই স্পেশাল ডিউটিতে নিযুক্ত হয়। তখন সে তালপাতার সেপাইয়ের সঙ্গে পাড়া পাহারা দিয়ে বেড়ায়, পাহারা দেওয়ার এক ফাঁকে পালানোর মতলবে সিপাইকে ফাঁকি দিয়ে পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে যায়। বেরোতে গিয়ে ধরা পড়ে। মোতালেবকে মারধর করার পর জুঁই তাকে নিয়ে নিজের ঘরে তোলে এবং মাসির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পুরো এক সপ্তাহ জুঁই তার ঘরে কোনো খদ্দের ঢুকতে দেয় না।

সে রাতদিন সেবা করে মোতালেবের, মাঝেমধ্যে মৌরিও আসে। রিমান্ডে গরম পানি ঢালায় তার কপালে যে দাগ পড়েছিল প্রতিদিন তিনবেলা মলম লাগিয়ে তাও প্রায় সারিয়ে ফেলে জুঁই। এ ঘটনায় অভিভূত হয়ে পড়ে মোতালেব। টুপি তো পল্লিতে ঢোকার দিন মাথা থেকে ফেলে দিয়েছিল, এবার জুঁইয়ের ইচ্ছায় দাড়িও উধাও করে দিলো। অবশ্য তার নিজেরও মনে হচ্ছিল এত পাপাচারের মধ্যে দিন গুজরান করে দাড়ি রাখার কোনো অর্থ হয় না।

পুরো এক সপ্তাহ পর মোতালেব তখন বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে, জুঁই রাতে তার এক বান্ধা বাবুর সঙ্গে থাকতে রাজি হয়। বাবুকে ঘরে রেখে বাইরে এসে মোতালেবকে ডাকে, ‘হুজুর, একটা কথা আছে।’

জুঁই প্রথম দিন থেকেই মোতালেবকে ‘হুজুর’ ও ‘আপনি’ সম্বোধন করে আসছে, মোতালেবও তাকে ‘আপনি’ বলেই ডাকে। জুঁইয়ের ডাকে পাড়ার একপ্রান্তে এসে দাঁড়ায় মোতালেব। আসার পথে মেয়েদের কেউ কেউ তাকে ‘বেরেশ’ মানে ‘ষাঁড়’ বলে যে রসিকতা করছে তাও বুঝতে পারে। প্রথম প্রথম এরকম ডাক শুনে তার রাগ হতো। এখন মেনে নিয়েছে। আজ আবার ‘বেরেশ’ ডাক শোনার পর তার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে, তাদের গ্রামে একমাত্র শুক্কুর আলীরই একটা ষাঁড় ছিল। গাই গরুর যখন প্রজননের সময় হয়, তখন সে ডাকাডাকি শুরু করে, যাকে মোতালেবদের যমুনা চরের গ্রামগুলোতে গাইয়ের ডাক ওঠা বলে। ডাক উঠলে সবাই গরু নিয়ে যেত শুক্কুর আলীর বাড়িতে। মোতালেবের মনের মধ্যে যে-ঝড় বয়ে চলছে তা তো জুঁইয়ের জানা নেই, তাই সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, ‘হুজুর, শুনেন, আমার বাইচ্চা অইব। আমি কিন্তু অহনও মাসিরে কিছু জানাই নাই। আপনে কিছু কইয়েন না।’

‘আসমানে চান উঠলে সেইডা আপনে গোপন রাখবেন কেমনে?’

মোতালেবের প্রশ্নের উত্তরে জুঁই বলে, ‘সময় অইলে জানানো যাবে। কিন্তু একটা কথা আপনেরে জানাইয়া রাখি, আমি চাই না, আমার মাইয়া এই বেশ্যাপল্লিতে বড় হোক।’

‘মাইয়া হইব নিশ্চিত হইছেন কেমনে?’

‘আপনেরে তো মাসি আনছে মাইয়া জন্ম দেওয়ানোর লাইগ্যা।’

এরপর আর কথা চলে না। মোতালেবের মনে পড়ে, একবার তাদের গাই গরুটার ডাক উঠলে সে নিজেও তার আব্বার সঙ্গে নিজেদের গাই গরু নিয়ে গিয়েছিল। তাদের গাই গরুর সঙ্গে বেরেশের মিলন ঘটিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে পাঁচ টাকা দিতে হয়েছিল শুক্কুর আলীকে। জুঁই যখন তাকে জানাল সে গর্ভবতী হয়েছে, নিজেকে তার শুক্কুর আলীর ষাঁড়ের মতো মনে হলো। তবু জুঁইয়ের আনন্দ ম্লান করে দেওয়া হবে বলে নীরবতা অবলম্বন করে।  অবশ্য সিপাই চলে আসায় চাইলেও মোতালেব আর কিছু বলতে পারত না। সিপাই বলে, ‘জুঁই, তর বান্ধা বাবু বইয়া বইয়া বিরক্ত অইতাছে। তাড়াতাড়ি যা।’

জুঁই চলে যাওয়ার পর সিপাই বলে, ‘লও মুয়াজ্জিন, চা-বিড়ি খাইয়া আসি।’

গত কয়েক মাসের মধ্যে মুয়াজ্জিন মোতালেবের জীবনে আরো একটা বড় পরিবর্তন হলো। এখন সে চা-সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সিপাই জোর করে মাঝে কয়েকদিন মদও খাইয়ে দিয়েছে তাকে। মদ্যপানে এখন আর আপত্তি নেই তার। তবে মদ গলা দিয়ে নামার সময় যে জ্বলুনি শুরু করে, তা সে সহ্য করতে পারে না বলেই এড়িয়ে চলে। সিপাই বলে, ‘পয়সা থাকলে কান্দাপাড়ায় বাঘের চোখও কিনতে পারবা। কিন্তু পলাইতে চাইলে পারবা না।’

মোতালেব বলে, ‘যদি আমার শেরালি আর পিরালিরে আনতে পারতাম?’

একসময় এই পল্লির অনেকের জন্য মোতালেব মুয়াজ্জিনের দেওয়া জিনের পানিপড়া আনতে গিয়েছে। সে-কথা সে এখন স্বীকার করতে নারাজ। তাই হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ধুর মিয়া, জিনটিন বইল্যা কিছু নাই।’

‘হেইডা বুঝনের মতো ঘিলু তোমার আছেনি? আমি কোরানের হাফেজ, আমি জানি, জিন আর ইনসানের মাজেজা।’

‘হ, সবজান্তা শমসের অইছ?’

সিপাইয়ের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে গেলেও মোতালেব পালানোর তক্কে তক্কে আছে, তাই বলে, ‘লও, তোমারে মাল খাওয়ামু। আমার চাইর বউ পাঁচশো কইরা মোট দুই হাজার টাকা দিছে।’

পরিকল্পনা ছিল সিপাইকে মদ খাইয়ে মাতাল করে পালানোর চেষ্টা করবে। প্রকৃতপক্ষে ঘটে উলটোটা। নিজেই মদ খেয়ে এত মাতাল হয় যে বমি করে ভাসায় মদের দোকান এবং একসময় অচেতন হয়ে দোকানের চাটাইয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে রমলা মাসি এসে ভাঙায় তাদের ঘুম, ‘বলি মুয়াজ্জিন, আজকা যে তোমার কোর্টে হাজিরার দিন, এইটা মনে নাই?’

কান্দাপাড়ায় বন্দি হওয়ার পর অনেকবারই মোতালেবের মনে হয়েছে, কোনটা ভালো ছিল, জেলখানা, না পতিতাপল্লি? শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিদ্ধান্তে আসতে পারে না সে। কারণ, তার মনে হয়, মেয়েটাকে বোধহয় সে নিজেই খুন করেছে আর খুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

জুঁই ও মৌরি তার কাছে বারবার জানতে চেয়েছে, ‘হুজুর, সত্য কইরা কন, আপনে কি সত্যই নিজের মাইয়ারে খুন করছেন?’

‘না। আমি খুন করি নাই। বাচ্চাটা মনে হয় আমি কোলে নেওয়ার আগেই মারা গেছিলো।’

রিমান্ডে যেমন বারবার নিজের মেয়েকে খুন করার কথা স্বীকার করেছে, তেমনি জুঁইয়ের প্রশ্নে বারবারই অস্বীকৃতি জানিয়ে যাচ্ছে। তবু জুঁই জানতে চায়, ‘মাসি যে কয় সে পয়সাপাতি দিয়া খুনের ঘটনাটা চাপা দিছে। ডাক্তাররে মেলা টাকা দিয়া নিউমোনিয়ার কথা লিখাইয়া আনছে?’

জুঁইকে বোঝাতে গিয়ে মোতালেব যেন নিজেকেই বোঝায় যে, সে তার মেয়েকে খুন করেনি। এখন কোর্টে হাজিরা দিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে গিয়ে সে ওই ঘটনাটা আরও একবার ভেবে দেখার চেষ্টা করে। মোতালেব তো হাসপাতালে আসার আগে ঠিক করে এসেছিল স্ত্রীর কাছে মাফ চেয়ে নেবে, অথচ তাকে বাথরুম থেকে বেরোতে দেখে মুখ ঢেকে পালাল।

পালাল কেন? একবার মনে হয় লজ্জা পেয়ে পালিয়েছিল সে। এত বছরের দাম্পত্য জীবনে হোসনা বেগম তো সাত চড়ে রা করেনি, অথচ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসার দিন সে স্বামীকে মারার জন্য বঁটি নিয়ে তাড়া করেছিল, ওই ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় পালিয়েছিল সে? কিছুই ঠিকমতো মনে করতে পারে না। তার আবার মনে হয় কোলে নিতে গিয়ে বাচ্চাটার গলা টিপে ধরেনি তো? তার মাথা কি তখন থেকে খারাপ হয়ে গেছে, বাড়তি কিছু ভর করেছে যার প্ররোচনায় সে নিজের মেয়েকে খুন করেছে?

মামলার বাদী হোসনা বেগম মারা যাওয়ার পর আদালতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবীও উপস্থিত থাকে না এবং সাক্ষ্য-প্রমাণে বিবাদী যে নিরপরাধ, তা প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক মামলার একমাত্র আসামি মুয়াজ্জিন ও হাফেজ আবদুল মোতালেব আলীকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। পাড়ায় ফেরার পথে মোতালেবের একবার মনে হয়, যত পাহারা থাকুক, সে পালাতে চাইলে জনগণ তাকেই সহযোগিতা করবে। শেষ পর্যন্ত সে তা করে না, তার মনে হয়, এই মুখ নিয়ে আয়শার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কী করে। খবর পেয়েছে, খাদিজা ও আয়শার ছোট পাঁচ বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি, যার নাম পলি, সে তাঁতিদের এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। বাকি চারজনকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি আগলে রেখেছে আয়শা। খাদিজা ও তার জামাই আবু তাহের যেমন পারে সহযোগিতা করছে ওদের।

বেকসুর খালাস হয়ে ফিরে আসার পর মোতালেব কান্দাপাড়ার পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে আরো খাপ খাইয়ে নেয়। নিজের চার স্ত্রী জুঁই, রেশমা, চশমা ও মৌরির সঙ্গে সারাক্ষণ রঙ্গরসিকতা করে বেড়াচ্ছে। আজ এর কাছ থেকে টাকা নেয় তো কাল ওর কাছ থেকে। চাইলে মাসিও টাকা-পয়সা দেয় তাকে। সেই টাকা সে ওড়ায় তালপাতার সেপাইয়ের সঙ্গে মদ-সিগারেট খেয়ে।

দিন-মাস কাটে। সন্তান প্রসবের সময় এগিয়ে আসছে জুঁইয়ের। রমলা মাসি চাপ দিচ্ছে, ‘মুয়াজ্জিন সাব, অহন তুমি জুঁইরে তালাক দেও।’

মোতালেবের এখন আর কোনো কথা বলতেই বাধে না, মাসির মুখের ওপর বলে দেয়, ‘আপনে তো নিয়মনীতি কিছুই জানেন না, পোয়াতি স্ত্রীরে শরিয়ত মোতাবেক তালাক দেওয়া যায় না। আগে বাইচ্চাডা হোক, তারপর ভাইবা দেখবেন নে।’

‘তো তোমার এই কথাডা না হয় মাইনা লইলাম। কিন্তু তোমার বাকি তিন বউয়ের পেটে বাইচ্চা আসতাছে না কেন?’

‘আমি তো আর আল্লাহ না। জীবন তাইনে দেন।’

‘কথায় কথায় এত আল্লাহবিল্লাহ কইরো না তো? আমার তো মনে অইতাছে তোমার লগে মিইল্যা গিয়া আমার মাইয়াগুলান বাচ্চা না অওনের কোনো ব্যবস্থা নিছে।’

মোতালেবের চার বউয়ের মধ্যে একমাত্র মৌরি এ-সময় উপস্থিত ছিল। বয়সে সে সবার ছোট হলেও সে সবার তুলনায় ঠোঁটকাটা, মাসির মুখের ওপর আঙুল তুলে বলে, ‘আমি তো মুয়াজ্জিনরে আমার সঙ্গে থাকার সময় জোর কইরা পায়জামা পরাইয়া লই?’

‘কেন? এই কাজ করছ কেন? আমি তরারে কই নাই আমার অনেক মেয়ে বাচ্চা লাগব।’ রাগে যেন কাঁপে রমলা মাসি। সে মোতালেবকে বলে, ‘তুমি কনডম পরাইতে দেও কেন?’

মোতালেবের উত্তর দিতে হয় না, মৌরি বলে, ‘হ, বাইচ্চা বিয়াই আর তুমি তারারে দিয়া ব্যবসা করো?’

‘চুপা করিস না, মৌরি। আগামী দুই মাসের মধ্যে পেট বাঁধাইতে না পারলে তরে আমি দৌলতিয়ায় বেইচ্যা দিমু।’

‘তোমার কেনা মাল, তুমি যেখানে ইচ্ছা বেচবা’ বলে চলে যায় মৌরি।

ওইদিন রাতে মরিয়ম ওরফে মৌরির সঙ্গে থাকতে গিয়ে মোতালেব জানতে চায়, ‘কেনা মাল বলতে মাসিরে কী বুঝাইছিলা?’

মৌরি জানায়, সে প্রেমিকের হাত ধরে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল বিয়ে করে ঘরসংসার পাতবে বলে। সে জানত না, তার প্রেমিক কত বড় নষ্ট মানুষ। ওই প্রেমিক তারে কুমিল্লা থেকে নিয়ে আসে টাঙ্গাইলে। দুই রাত হোটেলে কাটানোর পর নিজেদের জন্য বাড়ি দেখার নাম করে কান্দাপাড়ায় রেখে পালায়। সে একে একে বলে রেশমা ও চশমার কথা। ওরা দুজন চাচাতো বোন। রমলা মাসির এক মহিলা দালাল গার্মেন্টসে চাকরি দেবে বলে রংপুর থেকে এখানে নিয়ে আসে তাদের।

মোতালেবের আগ্রহ জুঁইয়ের কথা জানার, যা সে জুঁইয়ের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেও জানতে পারেনি। তাই জানতে চায়, ‘জুঁইয়ের কথা কিছু কইলা না?’

‘ও আল্লাহ, জুঁই আপা তোমারে কিছু জানায় নাই? তার লগে না তোমার গলায় গলায় পিরিত।’

‘না, জানায় নাই, আমি কত জিগাইলাম, হে উত্তর দেয় না।’

‘জুঁই আপা নিজের ইচ্ছায় আইছে এই পাড়ায়।’

মোতালেব আশ্চর্য হয়, ‘এইডা কী কইলা?’

‘আগে শুইন্যা লও, জুঁই আপা কিন্তু এসব কথা আমারে ছাড়া আর কাউরে কয় নাই। তুমিও কাউরে কইবা না কিন্তু। জুঁই আপা আছিল হিন্দু। তার আগের নাম ছিল জয়শ্রী। আচ্ছা, তুমি কি আমার আসল নামটা জানো?’

‘জানি, তোমার আসল নাম মরিয়ম। হজরত ঈসা নবীর মায়ের নামে নাম। আচ্ছা, জুঁইয়ের কথা কও।’

‘জুঁই আপা কলেজে পড়ত। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে চাইর মুসলমান বেডা তারে ধইরা নিয়া পাটক্ষেতের ভিতর ফালাইয়া র‌্যাপ করল। র‌্যাপ করার দৃশ্য ভিডিও করল তারা। তারপর ওই ভিডিও আবার ছড়াইয়া দিলো আশপাশের সব জাগায়।’

‘কী আশ্চর্য, র‌্যাপ করল আবার ভিডিও করল? ভিডিওতে ওই চারজনরে দেখা যায় নাই?’

‘না, ওই বেডাদের একজন ছিল ভিডিও দোকানের মালিক, সে জুঁই আপার সঙ্গে প্রেম করতে চাইছিল। আপা রাজি না হওয়ায় তিন বন্ধুরে লইয়া এই কাজ করছে।’

‘হের পর?’

‘আর কী, ঘটনা জানাজানি হইয়া যাওয়ায় আপারে তার বাড়ির মানুষ শেল্টার না দিয়া দিলো বাড়ির বার কইরা। আপা আইস্যা ধরল ওই ভিডিঅলারে। কইল, তুমি আমারে বিয়া করবা, নাইলে আমি গলায় ফাঁস দিমু আর সবকিছু লেইখ্যা রাইখ্যা যামু। বেডা ডরাইয়া গিয়া রাজি অইল। জুঁই আপাও মুসলমান হইয়া তারে বিয়া করল, নতুন নাম রাখল সালেহা।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী? বন্ধুবান্ধব লইয়া যে-মেয়েরে গ্যাং র‌্যাপ করছে, তারে কি আর বউ হিসেবে মানতে পারে পুরুষ মানুষ। বেডা আপারে ছোঁইয়াও দেখে না আর। বাইরে বাইরে পলাইয়া বেড়ায়। এর মধ্যে আরেকটা বিয়া কইরা বউ আইন্যা ঘরে তুলল। নতুন বউ খাটে পা তুইল্যা খায় আর আপা খাইট্টা মরে। তাইলে সইত, কিন্তু বেডা আবার দিন-রাইত যখন ইচ্ছা আপারে ধইরা মাইরধর করে। না পাইরা আপা পলাইয়া আইস্যা নিজেই এই কান্দাপাড়ায় উঠল।’

মৌরি যখন জুঁইয়ের জীবনের করুণ কাহিনি মোতালেবকে শোনাচ্ছিল, তখনই জুঁইয়ের প্রসববেদনা শুরু হয়। মাসি তাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দেয়। সঙ্গে নিয়ে যায় সিপাইকেও।

পরদিন সকালে দরজা খুলে মোতালেব দেখে খুশির বান ডেকেছে রমলা মাসির পট্টিতে। এ-ওকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। রমলা মাসি বলে, ‘মুয়াজ্জিন, তাড়াতাড়ি হাতমুখ খুইয়া আসো। পরীর মতন একটা মাইয়া হইছে তোমার।’

হাত-মুখ ধুয়ে মাসির কাছ থেকে এক বাটি মিষ্টি নিয়ে মৌরির ঘরে যায় মোতালেব। ততক্ষণে মৌরির ঘুম ভেঙে গেছে এবং মাসির চিৎকার করে দেওয়া খবর তার কানেও এসে গেছে। মোতালেবকে মিষ্টি খেতে দেখে ফুঁসে ওঠে মৌরি, ছোবল দেওয়ার আগে সাপ ফণা তুলে যেমন শব্দ করে, তেমন হিসহিস শব্দ করে বলে, ‘মিষ্টি না খাইয়া তুমি বিষ খাইতে পারো না?’

‘কী অইছে, ক্ষেপছ কিয়ের নিগা।’

‘তোমার এখন জুঁই আপারে ডিভোর্স দেওয়া লাগব। মাসি একটা নতুন মেয়ে কিনছে, তোমার লগে তার বিয়া দিব। তবে মাইয়াডা কুনোভাবে পোষ মানতাছে না। মাইরধর চলতাছে। কিন্তুক মাইয়ার এক কতা। বিষ খাইব, তবু পরপুরুষের লগে জিনা কইরব না।’

‘বালাই কয় মাইয়া। না, আমিও আর বিয়াসাদিত নাই। আমি আমার বাচ্চাডারে তো নিমুই, লগে জুঁইরে লইয়া পলামু। তুমি খালি আমারে এই পাড়া থিকা বাইর অওনের ব্যবস্থা কইরা দিও।’

‘সত্যই আপনে জুঁই আপারেও লইয়া যাইবেন?’

‘হ, সত্যই নিয়া যামু।’

‘ঠিক আছে, তাইলে আমি ব্যবস্থা কইরা দিমু।’

হাসপাতালে এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফিরেছে জুঁই। মোতালেব ঘুরেফিরে জুঁইয়ের ঘরে আসে। মৌরি তো সারাক্ষণের জন্য আসন পেতে বসেছে এ-ঘরে, ‘কী হুজুর, তুমি না জুঁই আপা আর তার বাচ্চারে নিয়া পলাইবা?’

‘পলামু, কটা দিন যাক।’

‘হুজুর, আমি তো আপনের লগে যামু না। আমরা তো জানি, আপনে নিজের মাইয়ারে খুন কইরা জেলে গেছিলেন।’ জুঁই স্পষ্ট আপত্তি জানিয়ে বলে, ‘পারলে আমি নিজেই মাইয়াটারে লইয়া পলামু।’

‘আপনেরারে আমি কতবার কইছি, আমি আমার মাইয়াডারে খুন করি নাই। মাইয়ার মা সন্দেহ কইরা মামলা দিছিল।’

হঠাৎ ‘আগুন, আগুন’ চিৎকার শুনে দৌড়ে বেরিয়ে যায় মৌরি ও মোতালেব। ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই জানতে পায়, নতুন আনা মেয়েটা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মৌরির কাছে মোতালেব নতুন মেয়েটার নাম জানতে চায়।

‘নাম জাইনা কী অইব?’

‘কও না, জাইনা রাখি।’

‘পলি।’

আচমকা যেন পাগলামি ভর করে মোতালেবের গায়ে। ‘কী কইলা? পলি...’ বলতে বলতে ছুটতে থাকে সে। সবাইকে ঠেলে এগিয়ে যায়। তারপর মেয়েটি যেখানে মরে পড়ে আছে, সেখানে গিয়ে থামে সে। পলি!  এ যে তার ছোট মেয়েটা।

হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে মোতালে১বের। আগুনে পোড়া এই ঝলসানো শরীরের মেয়েটা তার আত্মজা! আর এর সঙ্গেই কিনা তার বিয়ে দিতে চেয়েছিল রমলা মাসি।

একটু সুস্থির হওয়ার পর ভিড়ের মধ্যে জুঁইকে দেখতে পায় এবং এটাই সুযোগ বুঝতে পেরে দ্রুত ফিরে যায় জুঁইয়ের ঘরে।

বাচ্চা মেয়েটি ঘুমাচ্ছে। তার মনে হয়, ওর সঙ্গে পলির কোথায় যেন একটা মিল আছে। এমন সময় বহুদিন পর শেরালি ও পিরালির কথা শুনতে পায় সে। ওরা বলে, ‘মাইয়াডারে কোলে লন, কেউ দেখতে পাইব না।’

‘এমুন মাসুম বাইচ্চারে আমি মানুষ করুম কেমনে?’

এবার আর জিনেরা কথা বলে না, কথা বলে মৌরি, ‘লইয়া যান, নিয়া আপনের মেয়েদের হাতে তুইল্যা দেন। তারাই এরে বড় করতে পারব।’

মোতালেবকে দ্বিধা করতে দেখে মৌরি নিজেই বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়, ‘আপনে শর্টকাট মাইরা মেইন রোডে গিয়া খাড়ান, আমি ঘুরাপথে অরে লইয়া আয়তাছি।’

মৌরি বেরিয়ে যেতে জিনদের দুজনও তাড়া লাগায় এবং সেও ভাবে, এক মেয়েকে হারিয়ে আরেক মেয়ে পেয়েছে। এখন কেবল বাচ্চাটারে নিয়ে মালতিপাড়ায় পৌঁছতে পারলেই হয়।

আবুল হাসানের কবিতা : দহনের নান্দীপাঠ || বীরেন মুখার্জী


 

ত্রিশ দশক আধুনিক বাংলা কবিতার মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। ত্রিশোত্তর কবিদের কাব্য সাধনায় তাই ত্রিশের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশের প্রভাব
 বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। সংগত কারণে কবিতার নির্মাণ কাঠামো থেকে শুরু করে প্রায়োগিক উপযোগগুলোর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি প্রাথমিক পর্যায়ে এড়াতে পারেননি ত্রিশোত্তর কবিকুল। তারপরও কয়েকজন কবি তাদের মেধা-মননের উৎকর্ষে স্বকীয়তা বজায় রেখে কাব্য সাধনায় ব্রতী থেকেছেন। এ ধারার শক্তিমান কবি আবুল হাসান। বাংলা কবিতার প্রেক্ষিত বিবেচনায় ‘কবিতার যুবরাজ’ আখ্যা পাওয়া কবি আবুল হাসানের উত্তরণের সময়কাল হিসেবে ধরা হয় ষাটের দশকের মধ্যভাগ। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ (১৯৭২), ‘যে তুমি হরণ করো’ (১৯৭৪) এবং ‘পৃথক পালঙ্ক’ (১৯৭৫) কাব্যগ্রন্থ তিনটি কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৮৫ সালে মুহম্মদ নুরুল হুদা, ফকরুল ইসলাম রচি ও জাফর ওয়াজেদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা’ এবং ১৯৯৪ সালে বিদ্যাপ্রকাশ প্রকাশ করে ‘আবুল হাসান রচনা সমগ্র।’ অকাল প্রয়াত এই কবির উত্তরণের দশক ষাটের দশক বিশেষ কয়েকটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন কাব্যবোদ্ধারা। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, বিভিন্ন সময়ে পাশ্চাত্যের সাহিত্য আন্দোলনের ধারা বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে সঞ্চারিত হলেও এ দশকে বাংলা কবিতায় ভিন্নতর এক আন্দোলনের ধারা সূচিত হয়। বাংলার মাটি থেকে শুরু হওয়া ‘হাংরি জেনারেশন’ নামের এ সাহিত্য আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই সাহিত্যাঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। আন্দোলনের বিষয়বস্তু গ্রহণ-বর্জন নিয়ে দুই বাংলার কবিরা বিভাজিত হয়ে পড়েন। হাংরি আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিলো সাহিত্যের প্রচল ধারাকে অতিক্রম করে নবতর ধারা সৃষ্টি। এ মতের অনুসারী কবি-সাহিত্যিকরা তখন মনে করতেন কবিতায় বুর্জোয়া, বিপ্লবী, প্রতিবাদী এর কোনটিই সাহিত্যের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও এ আন্দোলনের কারণে অনেক কবি-সাহিত্যিককে নির্যাতিত হতে হয়। তারপরও আন্দোলনের এ ধারা সাহিত্যাঙ্গনে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একদিকে নবতর আন্দোলন আর অন্যদিকে জীবনান্দনীয় প্রভাব এ দুধারার মধ্যে আবুল হাসানের কাব্যধারা পৃথকতা নির্দেশনে কতটুকু সফল তা ধারণ করবে মহাকাল। তবে এটুকু বলা অতিশয়োক্তি হবেনা যে, ভাষা সংগ্রামের ক্লেদ, রক্তপাত এবং পরবর্তীতে বিজয়ের আনন্দ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতিকালীন পরিবেশ কবিরা কাব্য বিনির্মাণের প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেন। পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী থেকে প্রকৃত কবিরা বোধ খুঁজে পান এবং তা প্রকাশ করেন শিল্পঋদ্ধ ভাষায়। কবি আবুল হাসানও এসবের ব্যতিক্রম নন। তার কবিতা পাঠে বাংলাদেশের কাব্য-মানচিত্রে তাকে খুঁজে পাই প্রকৃত শিল্পসত্ত্বার ধারক হিসেবে। তিনি উচ্চারণ করেনÑশিল্প তো নিরাশ্রয় করে না, কাউকে দুঃখ দেয়নাকোনো হীন সিদ্ধান্তের মতোযৌবনের মাংসে তারা রাখেনা কখনোই কোনোঅভাবের কালো ব্যাধি, দূরারোগ্য ক্ষত!

শিল্প তো স্বাতীর বুকে মানবিক হৃৎপি-, তাইআমি তার হৃৎপিন্ডে বয়ে যাই চিরকাল রক্তে আমিশান্তি আর শিল্পের মানুষ!(স্বাতীর সঙ্গে এক সকাল/রাজা যায় রাজা আসে)ত্রিশের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘হৃদয় খুঁড়ে যে বেদনা জাগাতে ভালবাসেÑ সেই কবি’। সম্ভবত: অগ্রজ কবির ওই বাণীকে শ্বাশত জ্ঞানে হৃদয়ে ধারণ করে কবিতা চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন কবি আবুল হাসান। এ ছাড়া জীবনানন্দের কাব্য ও তার যাপিত জীবন পাঠ এবং বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশের ‘ট্রামনিয়তি’ কবি আবুল হাসানের মনে দারুণভাবে রেখাপাত করেছিলো। তিনি নিজের জীবনের সঙ্গে এর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন বোধ করি। যে কারণে দুঃখকেই তিনি ভালবেসেছিলেন। তার কাব্য পাঠে একজন দুঃখ ভারাক্রান্ত কবি হিসেবে আবিস্কার করি তাকে। কিন্তু কেন এই ব্যক্তিগত দুঃখবোধ? এ প্রশ্নের মিমাংশা একমাত্র কবি-ই করতে পারতেন। তবে আপাত সরল দৃষ্টিতে আমরা তাকে আপাদমস্তক কবি হিসেবেই দেখি। মানুষের প্রতি মমতা ও তীক্ষè শিল্প-সৌন্দর্যের পূজারি হয়েও ব্যক্তিগত দুঃখে জারিত হয়ে তিনি নীরবে সয়ে যান সব ধরণের নাগরিক যন্ত্রণা। নৈঃশব্দের কোলাহল ভেঙে নীরবেই তিনি কাব্যের মুক্তা ফলান। সমৃদ্ধ করেন কাব্যকলা, নিজস্ব শিল্পের ঘর। ‘ঝিনুক নীরবে সহোঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সয়ে যাওভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’(ঝিনুক নীরবে সহো/পৃথক পালঙ্ক)কবি আবুল হাসান কাব্যের মুক্তা ফলাতে প্রযত্ম থাকলেও একমাত্র উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেলে তাকে আমরা হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে দেখি। যা পরবর্তীতে তার কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। কবিতা মূল্যায়নের দিক বিবেচনায় রেখে বলা যায়, কবি আবুল হাসানের জীবনবীক্ষা থেকে উৎসারিত নৈরাশ্য কালক্রমে দখল করে নেয় চিন্তার দ্রাঘিমা। যে কারণে আবুল হাসানের কবিতা শিল্পে প্রেম আর অ-প্রেম, জীবন আর মৃত্যু পারস্পরিক দ্যোতনায় একাত্ম হয়ে চোখে পড়ে। মানব জীবনে প্রেমের দোলা আছে বলেই কবিতায় পৌনঃপুনিকভাবে, ঘুরে ঘুরে আসে শ্বাশত সমৃত্যুবোধ। এই মৃত্যুর আঁধারে থেকেই তিনি সন্ধান করেন প্রেমের অধরা-মাধুরী। দৃশ্যত জীবন, মৃত্যু, প্রেম, বিলাপ এবং দুঃখের জীবন্ত ছবি শিল্পীত দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল থাকে তার কবিতার পঙ্ক্তিতে। জীবনকে তিনি দেখেছিলেন মৃত্যুর সমান্তরাল তাই, ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা’ এর মতো সফল পঙ্ক্তি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন অনায়াসে। এত কিছুর পরও আবুল হাসানের কবিতার পাঠক হিসেবে প্রশ্নটি সামনে চলে আসে, তিনি কী নিজের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন? কিংবা তিনি কী বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাকে দিয়ে সাহিত্যের কিছুই হবে না? যদিও তিনি লিখলেন, ‘আমার হবেনা আমি বুঝে গেছি’ অথবা, ‘চলে যাবো দেশ ছেড়ে’র মত কবিতা। সত্যি কী কবি আবুল হাসানের কিছুই হয়নি? হ্যাঁ হয়েছে। আর হয়েছে বলেই তার কবিতা এখন পাঠ্যÑ প্রশংসিত। ‘বেঁচে থাকতে হলে আজ কিছু চাই! কিছুই কি চাই?গেরস্থালী নয়তো শূন্যতা? নয়তো সন্ন্যাস? নয় নীলাঞ্জনশ্যাম নারীনয়তো কিছুই নয়? বসে থেকে বেয়াকুল দিন দেখেদিন কাটানো অলস ভঙ্গিÑ সে ও বেঁচে থাকা নাকি?(এই ভাবে বেঁচে থাকো, এই ভাবে চতুর্দিক/যে তুমি হরণ করো)কবি শামসুর রাহমান ‘আবুল হাসান রচনা সমগ্র’র ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেন, ‘আবুল হাসান মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কবি, কবি ছাড়া আর কিছুই নন। তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে বয়ে গেছে কবিতা। তার এলোমেলো জীবনের ছাপ পড়েছে তার কবিতাতেও। এই এলোমেলোমি তার কবিতার দুর্বলতা এবং শক্তি।’ কবি শামসুর রাহমানের এ কথার সর্বৈব সত্য ধরা পড়ে যখন সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের কবিরা আবুল হাসান পাঠ থেকে কবিতার বোধ খুঁজে নেন এবং তার কবিতার বোধে দৃশ্যমান পলায়নপর মনোবৃত্তিকে সর্বাংশে পাশ কাটিয়ে কবিতা সৃষ্টিতে নিমগ্ন হন। সুতরাং আবুল হাসানের কবিতার দুর্বলতাগুলো ধরা পড়লেও তার কাব্যভাষা এবং কাব্যবোধের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। আবুল হাসানের উত্তরণের দশক ষাটের দশকের অন্য কবিদের মতো তিনিও আত্মবিশ্লেষণে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। কবিতায় তার আত্মদর্শন অন্যান্য সমসাময়িক কবিদের চেয়ে ভিন্নতর দর্শনের জন্ম দেয়। তিনি তার অভিজ্ঞতা ও বোধের উল্লেফনে উপস্থাপনগত কৌশল আলাদা করতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। এতে কবিতার প্রতি তার গভীর অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ‘এই ভাবে ভ্রমণে যাওয়া ঠিক হয়নি, আমি ভুল করেছিলাম!করাতকলের কাছে কাঠচেরাইয়ের শব্দে জেগেছিল সম্ভোগের পিপাসা!ইস্টিশানে গাড়ির বদলে ফরেস্ট সাহেবের বনবালাকে দেখেবাড়িয়েছিলাম বুকের বনভূমি!আমি কাঠ কাটতে গিয়ে কেটে ফেলেছিলাম আমার জন্মের আঙ্গুল!ঝর্ণার জলের কাছে গিয়ে মনে পড়েছিল শহরে পানির কষ্ট!স্রোতস্বিনী শব্দটি এত চঞ্চল কেন গবেষণায় মেতেছিলাম সারাদিনক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে!’(ভ্রমণ যাত্রা/যে তুমি হরণ করো)আবুল হাসান পাঠে দেখা যায়, যাপিত জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্ট তরল আবেগকে তিনি পরিপূর্ণভাবে সংযত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তার প্রাথমিক পর্যায়ের কবিতাগুলোতে এর প্রভাব তীব্রভাবে দেখা যায়। যদিও পরবর্তীতে তিনি যাবতীয় দীর্ঘশ্বাস, হতাশা আর শিল্পহীন অসারতা থেকে নিজেকে দূরে রেখে জীবনের নানা কৌণিক মেরু থেকে বোধের নির্যাস তুলে এনে কবিতা সৃষ্টিতে সচেষ্ট থেকেছেন। তার দশকের কবিদের ভিড়ে বয়সে অনতিতরুণ কবি আবুল হাসান অনেকটা নির্ভৃতচারী হয়ে পড়েন। নির্জনে কবিতা সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি একদিকে নিসর্গকে চিয়ায়িত করছেন তেমনি বিপরীতমুখী উচ্চারণে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন চিতার জলন্ত অগ্নিকুন্ড। একদিকে তিনি লেখেন, ‘সর্বাঙ্গে সবুজ আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো/পোষা পাখিদের কিচিরমিচির শুনি/শিশুদের কলরব শুনি/সুবর্ণ কঙ্কন পরা কামনার হাস্যধ্বনি শুনি!’ আবার লেখেন, প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না/আমি কে ছিলাম, কী ছিলামÑ কেন আমি/সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী/হয়েছি হিরণ দাহ, হয়েছি বিজন ব্যথা, হয়েছি আগুন।’ কবি আবুল হাসানের কাব্য পাঠে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন প্রকৃতার্থে একজন বেদনাবাহিত কবি। নিজের ব্যক্তিগত জীবনাচার থেকে তিনি যেসব দুঃখ-যন্ত্রণা, নৈরাশ্য, হতাশা পেয়েছিলেন তা উপজীব্য করে সৃষ্টি করেছেন তার কাব্যভা-ার। জীবনের পৌনপুনিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন শব্দের পেলবতায়। এক সময় জীবন তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি মুক্তি পেতে চান জীবন থেকে। নিজের কষ্টের কথা তিনি অবলীলায় উচ্চারণ করেনÑ‘আমার এখন নিজের কাছে নিজের ছায়া খারাপ লাগেরাত্রি বেলা ট্রেনের বাঁশি শুনতে আমার খারাপ লাগে’(আমি অনেক কষ্টে আছি/যে তুমি হরণ করো)কবি আবুল হাসানের কাব্যসাধনা এক দশক সময়কাল হলেও এই স্বল্পসময়ের কাব্য সাধনায় তিনি গভীর জীবনবোধ ধারণ করতে সক্ষম হন। তার সমাজচেতনা, স্বদেশ ভাবনা, নিসর্গচিন্তা ক্রমশ বিশ্ববীক্ষায় ছড়িয়ে পড়ে। রাজনীতি সচেতন এই কবির কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে বিচ্ছিন্নভাবে মৃত্যুযন্ত্রণা উঠে এলেও পৃথকভাবে কবিতার ধ্বনি চেতনা এবং আত্মশুদ্ধিমূলক উচ্চারণ তার কবিতাকে অবিশ্বাস্য রকমের উচ্চতায় পেঁৗঁছে দেয়। কবিতায় জীবনের কাক্সক্ষা ও শুভাশুভের নান্দনিক বিশ্লেষণে তিনি ব্রতী হন। একদিকে মঙ্গলচেতনা এবং অন্যদিকে বিষাদময় যন্ত্রণা তিনি উপস্থাপন করেন অপূর্ব শিল্পদৃষ্টিতে। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’ পাঠে আমরা একজন সফল, পরিপূর্ণ কবি আবুল হাসানকে দেখতে পাই। এ কাব্যগ্রন্থ পাঠে কবি আবুল হাসানকে উপলব্ধি করতে কষ্ট করতে হয়না, বেগ পেতে হয়না তার কাব্যভাষা উদ্ধারে। এ গ্রন্থে এসে তিনি ক্রমাগত ভাঙনে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রন্থের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে পৃথক পালঙ্কে সমাসীন হয়ে যান। নিজস্ব দশকে নিজস্ব পৃথক অভিধায় ভূষিত হন। খ্যাতি পান ‘কবিতার যুবরাজ’ হিসেবে। ‘পাতাকুড়োনীর মেয়ে তুমি কী কুড়াচ্ছো? ছায়া আমি ছায়া কুড়োই!পাখির ডানায় সিক্ত সবুজ গাছের ছায়া, গভীর ছায়া, একলা মেঘেকুড়োই, হাঁটি মেঘের পাশে মেঘের ছায়াÑ ছায়া কুড়োই!

পাতাকুড়োনীর মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছো? পাতা, আমি পাতা কুড়োই!কয়টি মেয়ে ঝরাপাতা : ঝরছে কবে শহরতলায়,শিরায় তাদের সূক্ষ্ম বালু,পদদলিত হুদয় ক’টি, বৃক্ষবিহীন ঝরাপাতাÑকুড়োই আমি তাদের কুড়োই!’(ধরিত্রী/পৃথক পালঙ্ক)সারাজীবন অতৃপ্তির রক্তক্ষরণে বসবাস করেও কবি আবুল হাসান বাংলা সাহিত্য ভা-ার পূর্ণ করেছেন ‘ধরিত্রী’র মত অনবদ্য অনেক কবিতা দিয়ে। সামগ্রিক কবিতা বিচারে কাব্যবোদ্ধাদের কাছে হয়তো কবি আবুল হাসান ‘ভাবালুতা’ ও ‘জীবনানন্দ দাশ’ প্রভাবিত। কিন্তু অপ্রাপ্তির তীব্র দহন, দুঃখবোধে জারিত হলেও সবকিছু অতিক্রম করে তার পরিচয় একটিইÑ তিনি প্রকৃত শিল্পস্রষ্টা, আপাদমস্তক একজন প্রকৃত কবি। কালপরিক্রমণে তার কবিতার জয়রথ মহাকালে ধাবমান। তার কবিতার পঠন পাঠন এবং কাব্যবোধ অন্বেষণে বর্তমান প্রজন্মের কবিকুল যখন তার দ্বারস্থ হন তখন বোঝা যায় আবুল হাসানের কবিতা সর্বজনীন, মানোত্তীর্ণÑ কালোত্তীর্ণ। আজ একথা অনস্বীকার্য যে, কবি আবুল হাসান এমনই এক শিল্পসত্ত্বার ধারক যার কবিতা পাঠে পাঠকচিত্তে সঞ্চারিত হয় দহনের তীব্র ঝঙ্কার।