মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৪

চার পাতার স্বপ্ন ।। সৈয়দ সাইফুর রহমান সাকিব


(১)
দলে ভারী নই তবু মেলা
আগামী বছর করে করে পার হয়ে যাচ্ছে বেলা
হাত গুটিয়ে বোঝাই সবাইকে, বুঝলে সাধনা!
কেউ দেখলো না
ঠিক তখনই মনে ধাক্কা দেয়
তপ্ত এক ঢেউয়ের দোলা। আহা! কত আশা
প্রচ্ছদে আঁকাবো সেই দীপ্ত সাদা বকটার পাখা।

ভাবনায় কতকিছু আসে
অভাব শব্দটা অপেক্ষা টাঙ্গিয়ে রাখে
নিজেকে আশ্বাস দেই, দেখো ঠিক একদিন হবে।
(২)
মাপ ঠিক নেই ছোট বড় হয়ে গেছে
তবু বই! নিজের হাতে বাঁধাই করি
স্কেচ জানি শক্ত মলাটে তাই হিরণ্যগর্ভ আঁকি।
দুতিনটা হাতে বাকিগুলো ব্যাগে
পরিবারকে কে বোঝাবে এটাই একমাত্র পথ
সংসারের থলে ভরবার জন্য
লেখা ছাড়া আর যে কিছুই শিখি নাই।
(৩)
দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যাই নতুন লেখক
প্রকাশকের এক বান্ডিল টাকা চাই
সাথে আছে শর্ত।
একদিকে স্বপ্ন অন্যদিকে শঙ্কা
বই বিক্রি হয় কিনা!
কি লজ্জা! কি লজ্জা! আত্মবিশ্বাসে বেহাল দশা।
তাকিয়ে রয়েছে যজ্ঞের হরেক মত
কিছু বলুন! গরম চায়ে পুড়ে যায় ঠোট।
(৪)
আহা! দেখুন না আইডিয়াটা মন্দ না
আমিই প্রথম
বই সাথে আবৃত্তির সিডি, একেবারেই ফ্রি!
জানি বই পড়ার সময় নেই
অসুবিধা কি ভাবীতো আছে সে পড়বে
ল্যাপটপে অথবা এনড্রয়েড ফোনে ভরে রাখবেন
কাজের ফাঁকে শুনতে পারবেন।
আরে না না কে চাইছে আপনার কাছে?
এমনিই একডজন রেখেছি।
ইয়ে আগামী মাসেই আছে এক আলোচনা সভা
না বললে শুনবো না! আপনাকেই প্রধান অতিথী করছি
কোম্পানীর নামটা ব্যানারে প্লেস করতে হবে যে
কবে দেখা করবো একটু যদি বলতেন!

বিস্ময়কর রাজপুত্র সাফায়্যার ।। নাসরিন সুলতানা

গল্পটা অনেক আগের
ঘোরানিয়া রাজ্যে জন্ম নিল এক অপূর্ব সুন্দর রাজপুত্রতার চোখের মণি দুটো ছিল নীলদেখামাত্রই সবাই অবাক হয়ে যেতএ রকম চোখ তারা আগে কখনো দেখেনি
রাজপুত্রের জন্মের পরে রাজা চার দিকে খবর নিয়ে জানলেন যে কুন্দিলন রাজ্যের রাজসভায় একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আছেনতার নাম জাউজানতিনি মানুষ দেখেই তার ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারেনরাজা তাকে আনার জন্য রাজপানসি পাঠালেন এবং চিঠি লিখে দিলেন
জাউজান একজন নিরহংকার মানুষরাজার চিঠি পেয়ে তিনি খুশি হলেন এবং কুন্দিলনের রাজার কাছে অনুমতি চাইলেনরাজা অনুমতি দিলেন এবং রাজপানসি বোঝাই করে ঘোরানিয়া রাজ্যের রাজপুত্রের জন্য উপহারসামগ্রী পাঠালেনউপহারসামগ্রী গেল কুন্দিলনের রাজপানসীতে এবং জাউজান গেলেন ঘোরানিয়ার রাজপানসীতে
উপহারসামগ্রী দেখে ঘোরানিয়ার রাজা তো মহাখুশিতিনিও কুিন্দলনের রাজার জন্য এক পানসী উপহার পাঠালেনবিশ্রামশেষে জাউজানকে জানানো হল যে তাদের রাজপানসী চলে গিয়েছেতার বেড়ানো শেষ হলে তাকে ঘোরানিয়ার রাজপানসীতে করে পাঠানো হবে
ঘোরানিয়ার রাজা তার ছেলেকে কোলে নিয়ে জাউজানের সামনে বসলেনজাউজান রাজপুত্রকে দেখে এক গাল হাসলেন, বললেন, আমি কি একটু কোলে নিতে পারি ?
রাজা বললেন, কী যে বলেন ! আপনি যে এসেছেন সেটা তো আপনার মেহেরবানি
রাজা তার ছেলেকে জাউজানের কোলে দিলেনজাউজান বললেন, এ রকম চোখ আমিও কখনো দেখিনিনীল রংয়ের মণিনীলকান্তমণিরাজকুমার দীর্ঘজীবী হবে, যতদিন বাঁচবে তার দৃষ্টিশক্তি ততদিন থাকবে, অনেক মেধাবী আর বুদ্ধিমান হবেও মরে গেলেও ওর চোখের মণি পঁচবে নাআমি কি ওর একটা নাম রাখতে পারি ?
রাজা বললেন, আপনি নাম রাখলে তো আমি অনেক খুশি হবরাখুনআপনার মন থেকে যে শব্দটা বের হতে চাচ্ছে বলে ফেলুন
জাউজান আনন্দের সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সাফায়্যার
রাজা হেসে বললেন, বাহ ! খুব সুন্দর নাম
সাফায়্যারের জন্মের সময় মারা গেলেন রানীরাজা আবার বিয়ে করলেনবিয়ের পক্ষে তার কাছে দুটো যুক্তি, একটা হচ্ছে সন্তানের দেখা-শোনা অন্যটা হচ্ছে পরবর্তী সন্তানের জন্মদানএকটা ছেলে জন্ম নিয়েছেসে বাঁচবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই তাছাড়া একজন রাজার জন্য একটা ছেলে যথেষ্ট নয়যে কোনো সময় যে কোনো দেশ থেকে আক্রমন আসতে পারেতখন নিজস্ব কিছু মানুষ থাকা দরকার, যেমন- ভাই বা ছেলে এরা হল রাজার প্রকৃত সম্পদ বা বন্ধুযেহেতু রাজার কোনো ভাই নেই তাই একটা ছেলের ওপর তিনি ভরসা করতে পারছেন না
মায়ের পেটে থাকা অব¯থায় সাফায়্যার কখনো লাথি মারেনিজন্মের পরেও অহেতুক কান্না-কাটি করেনি কখনো তার কান্নার কারণ ছিল গোসল, খাওয়া আর পায়খানা-প্র¯্রাবের কাপড় পরিবর্তন করে দেওয়াছোটবেলা থেকেই সব কথা বুঝতমা-হারা এই বাচ্চাটাকে রাজা কাছে নিয়ে ঘুমুতেনএক দিন রাতে ঘুমুতে গিয়ে তিনি বললেন, আজ আমার শরীরটা ভালো নেই, বাছা, চুপ করে ঘুমিয়ে থেকো
সত্যিই ঘুমিয়ে রইল সাফায়্যাররাজা-রানীও ঘুমিয়ে রইলেনভোর বেলা ঘুম থেকে জেগে রানী দেখলেন যে সাফায়্যার পায়খানা-প্র¯্রাব কিছুই করেনিতিনি বললেন, এতবড় একটা রাত গেল, তুমি পায়খানা-প্র¯্রাব কিছুই করলে না ? কেন ? তুমি ভালো নেই ? কবিরাজ ডাকব ?
সাথে সাথেই পায়খানা-প্র¯্রাব করে দিল সাফায়্যাররানী অবাক হয়ে গেলেনরাজাকে বললেন, দেখলেন, মহারাজ ? আপনার ছেলে সব কথা বোঝে
: দেখলাম তো, রানীআমি যে ওকে রাতে বলেছিলাম আমার শরীর ভালো নেই সে জন্যই ও পায়খানা-প্র¯্রাব করেনি
: আপনি ঠিকই বলেছেন, মহারাজ
রাজা এক দিন রাজপুত্রকে বললেন, আমি রাজমহলের কাছাকাছি একটা পাঠশালা খুলতে চাই তুমি সেই পাঠশালায় অন্য সবার সাথে বসে পাঠ শিখবেরাজি আছ ?
রাজপুত্র আনন্দে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলরাজা রানীকে বললেন, আমার পুত্র রাজি আছে
রানী হাসলেনবললেন, কাছাকাছি পাঠশালা থাকলে সাফায়্যারের জন্য ভালোই হবে
সাফায়্যারের বয়স যখন দুই বছর তখন আরো একটা ছেলে হল রাজারতার নাম রাখা হল রিকশিম সাফায়্যারের যতœ তার মা বেশি দিন নিতে পারেননিকারণ তিনি মা হতে যাচ্ছিলেনমা হওয়ার আগে শরীর খুব খারাপ থাকেতখন অন্যের যতœ তো দূরের কথা, নিজের যতœই ঠিকমতো নেওয়া হয় নাতার নিজের সন্তান যখন পুত্রসন্তান হল তখন তো তাকে নিয়েই তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেনসাফায়্যারের দায়িত্ব দাসীর ওপরই থেকে গেল
রাজার মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকারসূত্রে রাজা হবে সাফায়্যার কারণ সে বড় ছেলেএটা রানী সহ্য করতে পারছেন নাতিনি সাফায়্যারকে পুষ্টিকর খাবার খেতে উসাহ দেন না, আনন্দে থাকতে সাহায্য করেন নাসব সময় ভাবতে থাকেন কী করে পরবর্তী রাজা হিসেবে রিকশিমকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়তার এ ভাবনাটা তিনি কারো কাছেই প্রকাশ করেন না, না রাজার কাছে, না রিকশিমের কাছে, না অন্য কারো কাছেকারণ রাজা রানীকে বলে দিয়েছেন, আমার পুত্ররা যেন কোনো দিন জানতে না পারে যে তারা দুজন ভিন্ন মাতার সন্তান মা হিসেবে তুমি সাফায়্যারের রাজা হওয়ার বিষয়টা নাও মানতে
পার তবে সেটা যেন শুধু তোমার মনের মধ্যেই থাকেকোনোভাবে যদি প্রকাশ পেয়ে যায় তাহলে এ রাজ্যে তোমার ঠাঁই হবে না
রানী বলেছেন, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, মহারাজআমি কখনো দুই পুত্রকে দুই নজরে দেখি নাআপনার এ ধরণের কথায় আমি কষ্ট পেলাম
কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই, রানীযেটা স্বাভাবিক আমি সেটাই বললাম, রাজার সহজ-সরল কথা
পাঠশালায় সাফ্যায়ার অনেক নাম করে ফেলেছেরাজপুত্র বলে কোনো অহংকার নেইসবার সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করেছেসবাইকে সব ধরণের সাহায্য করছেরাজার কানেও মাঝে-মধ্যে এসব কথা আসছেতিনি রাতে খাবার সময় রানীর সাথে এসব কথা বললেন সাফায়্যার মিট মিট করে হাসছিলরিকশিমও ছিল সেখানে
পরের দিন রিকশিম রানীকে বললেন, মাতাজি, পাঠশালার ছাত্রদেরকে সাহায্য করলে যদি পিতাজি খুশি হন তাহলে আমিও ওদেরকে সাহায্য করবপাঠশালার সব ছাত্রকে আমি স্বর্ণমুদ্রা দেব
যে কথা সে কাজরিকশিম পাঠশালায় গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বলল, আমি তোমাদেরকে কিছু সাহায্য করতে চাই
সবাই তার দিকে তাকালসে ব্যাগ খুলে একটা মুদ্রা বের করে একটা ছাত্রকে দিলছাত্রটা বলল, কী এটা ?
: স্বর্ণমুদ্রা
: আমাকে কেন ?
: বললাম না ? আমি তোমাদের সবাইকে সাহায্য করব
: কিন্তু আমার তো সাহায্য দরকার নেই
: আমি তোমাদের বন্ধু
: তবুও...
: তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা স্বর্ণমুদ্রা ?
: বিশ্বাস হচ্ছে বলেই তো নেব না
: কেন ?
: আমি ভিখিরির ছেলে নই
রিকশিম অন্য একটা ছাত্রকে বলল, তুমি নাও
: ও যেটা নেবে না সেটা আমি নেব কেন ? আমি কি ভিখিরির ছেলে ?
: তোমরা আমার সাথে এ রকম করছ কেন ?
: আমরা কি তোমার কাছে সাহায্য চেয়েছি ?
: তোমরা আমার ভাইয়ের কাছ থেকে সাহায্য নাও কেন ? তার কাছে কি তোমরা চাও ?
: তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে আমি কোনো দিন সাহায্য নিইনিআমার পিতার যা আছে তাতে আমাদের হয়ে যায়আমরা অন্যের সাহায্য নিই নাতুমি রাজপুত্র বলে আমাদেরকে অপমান করতে পার না
রিকশিম সবার উদ্দেশে বলল, আমি অনেকগুলো স্বর্ণমুদ্রা এনেছিতোমরা যে যে নিতে চাও নিতে পার
কেউ কথা বলল নারিকশিম মন খারাপ করে বাড়ি চলে গেলএক ছাত্র শিক্ষকের কাছে বলল, ওস্তাদজি, রিকশিম যদি রাজার কাছে নালিশ করে তাহলে আমাদের শাস্তি হবে না ?
শিক্ষক বললেন, নামহারাজ অনেক ভালো মানুষপাঠশালায় যা কিছু হবে তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাবেন নাকারণ এখানে ওস্তাদরা আছেন
রিকশিম বাড়িতে গিয়ে রানীকে সব খুলে বললরানী বললেন, মন খারাপ করো না, রিকশিম তুমি আগে ওদের বন্ধু হওতবেই তোমার সাহায্য ওরা নেবেযাদের অভাব নেই তারা যদি তোমার বন্ধু না হয় তাহলে কেন তোমারটা তারা নেবে ? ওদের কার কিসের অভাব আছে সেটা জানার চেষ্টা করসাফায়্যার তোমার চেয়ে দুই বছরের বড়সে তোমার চেয়ে বেশি বুঝবে এটাই তো স্বাভাবিক
রানীর কথা কিংবা রিকশিমের ইচ্ছেমতো সব কিছু হবে না এটাই তো নিয়মমানুষ যা ভাবে তা সব সময় হয় না দুবছর চলে গেল কিন্তু রিকশিম কাউকে সাহায্য করতে পারল নাসাফায়্যারের মনে হতে লাগল তার এত জনপ্রিয়তা তার ভাইকে দিন দিন মানসিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছেএতে তার জন্য রিকশিমের মনে ঈর্ষা জন্ম নিতে পারেতাই সে ঠিক করল এর পর থেকে রিকশিমের দ্বারাই সবাইকে সাহায্য করাবেসাফায়্যার রানীর সামনে দাঁড়িয়ে রিকশিমকে বলল, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, এরপরে আমি আর কাউকে সাহায্য করব নাকারো কিছু প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে বলবতুমি তাকে সাহায্য করবে
রিকশিম এবং রানী খুব খুশি হলেন
সাফায়্যারের ধারনা, মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে এটাই নিয়মতার বাবা তাকে যত উপদেশ দেন একটাও সে অগ্রাহ্য করে নাসে জানে যে তার বাবা তার কল্যাণ কামনা করেন বাবার কথার বাইরে গিয়ে যদি কোনো বিপদ হয় তাহলে তিনি তাকে সাহায্য করবেন না
সাফায়্যার পাঠশালা থেকে এসে রিকশিমকে বলল, এক লোকের স্ত্রী অনেক দিন ধরে অসু¯আমি তার বাড়িটা তোমাকে চিনিয়ে দেবতুমি তাকে একজন কবিরাজের ব্যব¯থা করে দেবে
: কিভাবে ?
: কবিরাজকে বলবে অমুক বাড়ি যাবেন, টাকা-পয়সা যা লাগে আমি দেব
: আমার সাহায্য তারা নেবে তো ?
: নেবে
: আপনি কী করে এতটা নিশ্চিত হলেন যে আমার সাহায্য তারা নেবেই ?
: আমার মন বলছে
রানী বললেন, তোমার মন কেন বলছে সেটা আমি জানতে চাই, সাফায়্যারতুমি কি ঐ চাষীর বাড়িতে গিয়েছিলে ?
: জি না, মাতাজিপাঠশালায় যাওয়ার পথে চাষী আমাকে বলল
: পাঠশালায় যাওয়ার পথে তুমি মানুষের সুখ-দুঃখ শোন, না ?
: জি, মাতাজিসেটা দোষের কিছু নয়প্রজাদের দুঃখ দূর করে দেওয়া আমাদের কর্তব্য
: তুমি কি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ ?
: জ্ঞান দিচ্ছি না, মাতাজিএগুলো পিতাজি পছন্দ করেন
: ভালো কথাঐ গরিব লোকটার সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়েছিল ?
: পাঠশালায় যাওয়ার পথেসে বিষকাটালি পাতা পানিতে কচলায়সেই পানি স্যাঁতসেঁতে মাটিতে ফেলেমাটির ভেতর থেকে কেঁচো বেরিয়ে আসেসেই কেঁচো বিক্রি করেবড়শির টোপ হিসেবে কেঁচো ব্যবহার করা হয়মানুষ কাপড়ে সাবান দিয়ে কাঁচেসাবানের পানি মাটিতে পড়েমাটির ভেতর থেকে কেঁচো বের হয়বাড়ি বাড়ি হেঁটে সে কেঁচো সংগ্রহ করেএই তার আয়ের একমাত্র উসে অন্য কোনো কাজ পারে নাতার স্ত্রী বিছানা থেকেই উঠতে পারে না
: সে নিজে কেন বড়শি পাতে না ?
: সে বসে থাকতে পারে নাঅসু¯পিঠে ব্যথা হয়আমি তাকে আর্থিক সাহায্য করেছিএরপর থেকে রিকশিম করবে
রাজা পাশের কক্ষ থেকে সব কথা শুনেছেনতাদের কাছে এসে রানীকে বললেন, ও যা করেছে ঠিকই করেছেওকে উসাহ দাও
: জি আচ্ছা, মহারাজ
সাফায়্যার খুব খুশি হল
পরের দিন পাঠশালায় যাওয়ার সময় রানী সাফায়্যারকে বললেন, তুমি তো কথা দিয়ে রাখলে নাতুমি বলেছিলে যে তুমি আর কাউকে সাহায্য করবে না
: আমাকে মাফ করবেন, মাতাজিঅত অল্প সময়ের মধ্যে সেটা চিন্তা করাও সম্ভবপর ছিল নাসাহায্য বলতে আমরা যা বুঝি তা হল ঐ লোকের স্ত্রীকে কবিরাজ দেখানো সেটা তো আমি রিকশিমকে করতে বলেছিআপনি আশীর্বাদ করবেন, মাতাজি, আমরা যেন সারা জীবন মানুষের উপকার করতে পারি
রানী কিছুই বললেন নাসাফায়্যার বলল, আমাকে হাসিমুখে বিদায় দিন, মাতাজিনইলে যে আমার অকল্যাণ হবে
রানী হাসিমুখে বললেন, সাফায়্যার, আমার দুই পুত্রএক পুত্রের গুনগান প্রজাদের মুখে মুখেআর এক পুত্রের নাম কেউ জানেও নামাতা হিসেবে আমার কি মন খারাপ হতে পারে না ?
: আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, মাতাজিরিকশিম একদিন অনেক সুনাম আর সম্মান কুড়োবেআমি ওকে পরামর্শ দেব, মাতাজিসবাই আমার প্রশংসা করবে ; ওরটা করবে না সেটা আমারও ভালো লাগে নাআমি সত্যি বলছি
রানী হাসিমুখে সাফায়্যারকে বিদায় দিলেন
রানী আছেন মহাজ্বালায়, কইতেও পারেন না, সইতেও পারেন নাতিনি ভাবেন, সাফায়্যার রাজপুত্র হিসেবে সুনাম কুড়োতে চায়, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়ওকে অন্য রাজ্যে পাঠিয়ে দিলে চুপচাপ পড়াশোনা করবে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে সাহস পাবে নাতিনি এক দিন রাজাকে বললেন, সাফায়্যার অনেক মেধাবী, অনেক বুদ্ধিমানওকে এখন পড়াশোনার জন্য কোনো উন্নত রাজ্যে পাঠানো দরকারভ্রমনে জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়েসাফায়্যার বড় হয়ে একটার পর একটা রাজ্য জয় করতে পারবে
: পড়াশোনার জন্য যখন অন্য রাজ্যে যাবেই তখন দুজনকে একত্রেই পাঠাব
: দুজন একত্রে গেলে আমরা থাকব কী করে ? রাজমহল খা খা করবেতার চেয়ে সাফায়্যার পড়ে আসুকতার পরে রিকশিম যাবে
: ভ্রমনে বের হওয়ার বয়স ওর এখনো হয়নিআর একটু বড় হোকএখানকার পাঠশালায় যে পর্যন্ত পড়ানো হয় সে পর্যন্ত পড়এখান থেকে নিয়ে গেলে ওস্তাদরা দুঃখ পাবেন
রানী সেদিন আর কথা বাড়াননিতিনি জানেন, রাজা যা বলেন ভেবে-চিন্তেই বলেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করেনতিনি সাফায়্যারকে সব সময় অন্য রাজ্যে গিয়ে পড়াশোনা করার উপকারিতা সর্ম্পকে বোঝাতে লাগলেনসাফায়্যার এক দিন বলল, আমি দূরে থাকলে আপনার কষ্ট হবে না, মাতাজি ?
: হবে, বাছা, অনেক কষ্ট হবে তবুও আমি চাই, তুমি অনেক পড়াশোনা কর, অনেক বড় মাপের মানুষ হও
: বড় মাপের মানুষ কী, মাতাজি ?
: যে অনেক বড় মনের মানুষ
: বড় মনের মানুষ হতে হলে অনেক পড়াশোনা করতে হবে কেন ?
: জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়বে
: আমার জ্ঞান-বুদ্ধি নেই ?
: আছে কিন্তু তুমি তো অনেক ছোটতুমি বুঝতে পার না কোনটা তোমার জন্য ভালো আর কোনটা তোমার জন্য খারাপ
: তাহলে একা থাকা তো আমার জন্য অনেক বড় বিপদআমি যদি অন্য রাজ্যে বসে বিপদে পড়ি আমাকে উদ্ধার করবে কে ?
: তুমি খবর পাঠাবেতোমার পিতাজি লোক পাঠাবেন
: সেটা তো সম্ভবপর নাও হতে পারেতখন আমার কী হবে ?
রানী সাফায়্যারকে চুমু খেয়ে বললেন, তোমার কোনো বিপদ হবে না, বাছা, আমার আশীর্বাদ তোমার সাথে থাকবে
রাজমহলের পাশে যে পাঠশালাটা ছিল সেটার পাঠ সাফায়্যার শেষ করলআরো পড়াশোনা করার জন্য তাকে কুন্দিলন রাজ্যে পাঠানো হলকুন্দিলনের সভাসদ জাউজানের কাছে রাজা শুনেছিলেন যে ওখানে ভালো শিক্ষক আছেনতাছাড়া ওখানকার রাজা যে তার ছেলের জন্য অনেক উপহার পাঠিয়েছিলেন তাও তিনি ভোলেননিতিনি ভোলেননি জাউজানের উদারতার কথাও
পানসীতে করে সাফায়্যার যাচ্ছে কুন্দিলনজোয়ারের পানি যেদিকে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যও সেদিকেমাঝিরা ভাবল যে সবার কষ্ট করার দরকার নেই, একজন বসে হাল ধরলেই হলপানসী বাইতে বাইতে মাঝিরা একটু ক্লান্ত হয়েও পড়েছিলতারা সবাই বৈঠা রেখে শুয়ে পড়লক্লান্ত মানুষের শুয়ে থাকা মানেই চোখ বন্ধ করে রাখা
জোয়ারের ¯্রােতে পানসী চলছেএকজন মাঝি হাল ধরে আছেসেও বেশির ভাগ সময় চোখ বন্ধ করে রাখেমাঝে-মাঝে তাকিয়ে দেখে নিশানা ঠিক আছে কিনা
হঠা হাল ধরা মাঝি পানিতে পড়ে গেলতাকে বিশাল এক লগি দিয়ে আঘাত করা হয়েছেতাদের পানসীর দুপাশে দুটো পানসী এলোপানসীদুটো থেকে লোক এসে সাফায়্যারের পানসীতে উঠেছে
রাজপানসী তো অনেক বড়একটা ঘরের মতোসাফায়্যার ছিল ঘরের ভেতরেতার কান খাড়া ছিলসে বুঝতে পেরেছিল যে তার মাঝিকে ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং তার পানসীতে অন্য লোক উঠেছেসে জানালার ফাঁকা দিয়ে দেখল যে তার
পানসীর দুপাশে দুটো বড় পানসীসে রাজপোষাক খুলে সাধারন পোষাক পরলতরবারিগুলো কোষ থেকে বের করলতারপর দরজা খুলে বের হলদেখল যে তার লোকেরা অসহায় অব¯থায় বসে আছেদস্যুরা কয়েকজন তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একজনের হাতে হালপানসীর অপর প্রান্তেও কয়েকজন তরবারি হাতেপাশের পানসীদুটোতেও অনেক তরবারিধারী লোকসবাই সাফায়্যারের মুখের দিকে তাকানোসাফায়্যার আকাশের দিকে তাকালকী করা যায় ভাবতে লাগলতার চোখের মণি দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল দস্যুরা সবাই সাফায়্যারের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নিজেদের পানসীতে চলে গেলসাফায়্যার পেছন ফিরলএবার ওপাশের লোকগুলোও নিজেদের পানসীতে চলে গেলপানসীদুটো ক্রমশ সরে যেতে লাগলসাফায়্যারের পানসীর ওপরে ছোট একটা ডিঙি ছিলমাঝিদেরকে বলল, ডিঙি নিয়ে পেছনে যাওসুজরকে জীবীত বা মৃত অব¯থায় তুলে আন
সুজর হচ্ছে সেই মাঝি দস্যুরা যাকে পানিতে ফেলে দিয়েছিলমাঝিরা তাকে ডিঙিতে করে নিয়ে এলোঅনেক পানি খেয়েছেপেট ফুলে গিয়েছেবেঁচে আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে নাতাকে রাজপানসীতে তোলা হলডিঙিও ওপরে রাখা হলসাফায়্যার বলল, ওর পেটে জোরে চাপ দাওপানি বের করে ফেল
পেটের পানি বের করার পরে সুজর শ্বাস করতে লাগলসাফায়্যার মাঝিদেরকে কোনো ধরনের তিরস্কার তো করলই না বরং বলল, ভয় পেও না, আমাদের কাছে যথেষ্ট তরবারি আছে কেউ যদি দাঁড়াতে চায় আমরা ফেলে দেব
মাঝিরা সবাই প্রাণে বাঁচল যেন এর আগে কারো মুখে কথা ছিল না, হাসি ছিল নাভেবেছিল, বিশ্রাম নেওয়ার অপরাধে সাফায়্যার তাদেরকে শাস্তি দেবেএবার এক জন মুখ খুললবলল, শাহজাদা, ওরা আপনাকে দেখেই চলে গেল কেন ?
: অত্যাচারিদের মন সব সময়ই দুর্বল থাকে মন দুর্বল থাকলে তরবারি চালাবে কী করে ? ওরা আমাকে দেখেই বুঝেছিল আমি ভয় পাইনিযার ভয় নেই তার শরীরেও শক্তি থাকে
কুন্দিলনে যাওয়ার পরে রাজা ও জাউজানের সঙ্গে দেখা করার জন্য সাফায়্যারের সৌজন্যে এক নৈশ ভোজের আয়োজন করা হলসাফায়্যার উপ¯িথত হলে তাকে অভ্যর্থনা জানাল কুন্দিলনের রাজপুত্র তুরিন
নৈশ ভোজের মধ্যে তুরিন সাফায়্যারকে বলল, আমি হব তোমার সহপাঠী, তুমি কি তা জানো ?
  Nasrin Sultana
: না, আমি এখন পর্যন্ত কিছুই জানি না
: তুমি রাজপোষাক পরে আসনি কেন ?
: আমি তো এখানকার রাজপুত্র নই, রাজপোষাক পরলে সহপাঠীরা আমার বন্ধু হবে না
: হবে, হবে, ও নিয়ে ভেবো নানা হলেই বা ক্ষতি কী ? আমি তো আছিবন্ধু হিসেবে এক জনই যথেষ্ট যদি সে ভালো বন্ধু হয়তুমি নিয়মিত রাজপোষাক পরবে রাজা সাফায়্যারকে বললেন, তুরিন তোমার ভালো বন্ধু হতে পারবে বলে আশা করি কোনো সমস্যা হলে তুমি আমাকে বলবে
জাউজান হেসে বললেন, আমি তো আছিই, তোমার পুরনো বন্ধু, নাকি ? হাহাহা...
সবাই হাসলসাফায়্যার বলল, আপনি ঠিকই বলেছেনআপনাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি যদিও আমাকে বলা হয়নি আজকের নৈশ ভোজ কাদের সাথে হবেপিতাজি আমাকে ঠিক জায়গায় পাঠিয়েছেনআপনাদের সবাইকে আমার খুব ভালো লেগেছে
পরের দিন ঘোরানিয়ার রাজপানসী কুন্দিলন থেকে বিদায় নিলঘোরানিয়ার রাজা কুন্দিলনের রাজাকে যা কিছু উপহার দিয়েছিলেন কুন্দিলনের রাজা তার চেয়ে অনেক বেশি পাঠালেন ঘোরানিয়ার রাজার জন্যকুন্দিলনের রাজা ঘোরানিয়ার রাজাকে চিঠি লিখে দিলেন যে সাফায়্যার এখানে যত দিন ইচ্ছে থাকবেতার জন্য কোনো খরচ দিতে হবে নাসাফায়্যার নিজেও তার বাবাকে চিঠি লিখে দিল, এখানকার রাজা এবং রাজকুমার অনেক ভালোএখানে কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই
ঘোরানিয়ার রাজা ও রানী চিঠিদুটো পড়ে খুব খুশি হলেনতারা কিছুটা অবাকও হলেনকোনো রাজা এত ভালো হতে পারে ? রাজারা তো সব সময় অন্যের রাজ্য দখল করার চেষ্টা করেএ রাজার মধ্যে কি সে চেষ্টা নেই ?
কিছু দিনের মধ্যেই সাফায়্যার ভালো ছাত্র হিসেবে নাম করে ফেললসে অত্যন্ত বিনয়ীসব ছাত্রদেরকে পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্য করেশিক্ষকরাও তার প্রতি সন্তুষ্ট
কেমিও উজিরের ছেলেসে তুরিন ও সাফায়্যারের সহপাঠীসাফায়্যারের এত সুনাম তার সহ্য হয় নাসে তুরিনকে বলল, শাহজাদা, আপনি জানতেন সাফায়্যার আমাদের সাথে পড়তে আসবে ?
: জানতাম
: ভিন রাজ্যের এক রাজপুত্র আমাদের সমান শিক্ষিত হবে আপনার খারাপ লাগে না ?
: সে তো এমনিতেই রাজপুত্র, আমার সমানশিক্ষিত রাজপুত্রের চেয়ে অশিক্ষিত রাজপুত্ররা বেশি বিপজ্জনকআমি চাই সব রাজপুত্ররা শিক্ষিত হোকতাহলে ভবিষ্যতে রাজায় রাজায় হানাহানি থাকবে না বলে আশা করা যায়প্রত্যেক রাজা নিজ নিজ রাজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকবেপৃথিবী তখন অনেক সুন্দর হবেঠিক না ?
: ঠিক
যদিও কেমিও তুরিনের কথায় খুশি হতে পারেনি তবুও সেটা প্রকাশ করতে পারল নাহয়ত তুরিনের কথাই ঠিক কিন্তু মনে ধরল না তারসে ব্যাপারটা নিয়ে বিনটের সাথে আলাপ করলবিনট বলল, এটা তো আমি প্রথম থেকেই মানতে পারছি নাকিন্তু রাজা বা রাজপুত্র যা করবেন তার ওপর তো আমাদের কিছু করার নেই
: কেন নেই ? আমাদের অবশ্যই করার আছেএই রাজ্য শুধু রাজা বা রাজপুত্রের নয় ; আমাদের সবারএই সাফায়্যার আমাদেরটা খেয়ে-পরে মানুষ হয়ে এক দিন আমাদের রাজ্যই দখল করবে এটা মেনে নেওয়া যায় নাওর সাথে এমন খারাপ আচরন করতে হবে যাতে ও এখান থেকে চলে যায়
: মহারাজ খাল কেটে কুমির এনেছেন
: কুমির আমরা ফেরত পাঠিয়ে দেব
: কথায় কথায় ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে হবে
এক দিন সাফায়্যার কিংশুকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছেবিনট গিয়ে কিংশুকে বলল, তুমি যদি পড়া বুঝতে না পার আমাদের কারো কাছ থেকে বুঝে নিওসাফায়্যার ভিন রাজ্যের ছেলেতার কাছে তুমি আমাদেরকে ছোট করতে পার নাএতে রাজ্যকে, রাজ্যের শিক্ষিত সমাজকে অসম্মান করা হয়
: তোমাদের কাছে অনেক দিন পড়া বুঝতে চেয়েছিতোমরা বুঝিয়ে দাওনিতখন তো তোমরা নিজেদের কাছে ছোট হওনি আজ তোমাদের এত আত্মসম্মানবোধ এলো কোত্থেকে ?
: তুমি ভিন রাজ্যের একটা ছেলের সামনে বসে আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন ? এত সাহস তুমি কোথায় পেয়েছ ? তুমি জানো আমি তোমার কী করতে পারি ?
: জানিমানুষের ক্ষতি ছাড়া তুমি আর কিছুই করতে পার না
সাফায়্যার কিংশুকে বলল, এভাবে কথা বলতে নেই, কিংশুএকজন রাগ করলে অন্যজনকে বিনয় দেখাতে হয়দুজন একই সময় রাগ করলে অশান্তি সৃষ্টি হয়, বন্ধু
: আপনি জানেন না, রাজকুমার, এরা কত খারাপএদের সাথে এভাবে কথা না বললে এরা পেয়ে বসেমানুষের উদারতাকে এরা কাজে লাগায়এরা যে কোনো সময় আপনারও ক্ষতি করতে পারে
সাফায়্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগল অমনি তার চোখের মণি দুটো জ্বল জ্বল করে উঠলবিনট কিছু বলার জন্য রাগের সাথে সাফায়্যারের দিকে তাকালমুহূর্তেই রাগটা পড়ে গেলবলল, আমি দুঃখিত, রাজকুমার, আপনি যাকে ইচ্ছে পড়া বুঝিয়ে দিতে পারেনআমাকে ক্ষমা করবেন
সাফায়্যার দাঁড়িয়ে বিনটকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলসে নিজেও জানে না যে সে আকাশের দিকে তাকালে তার চোখের মণি জ্বল জ্বল করে এবং সেই মণির দিকে যে তাকায় তার মধ্যে বিনয় জন্ম নেয়বিনয় সাফায়্যারের প্রধান বৈশিষ্ট্য
কেমিও কিন্তু সাফায়্যারের পেছনে লেগেই রইলসাফায়্যার সেটা বুঝতে পারে তবে কারো কাছে বলে নাতার ধারণা, সেও এক দিন তার ভুল বুঝতে পারবে
কেমিও এক জন শিক্ষকের কাছে বলল, ওস্তাদজি, আমার পকেটে একটা হীরক ছিলসেটা সাফায়্যার চুরি করেছে
তিনি অবিশ্বাস নিয়ে বললেন, তুমি কী বলছ, কেমিও ? সাফায়্যার রাজপুত্রঅনেক বড় মনের মানুষসে এমন কাজ করতে পারে নাতুমি ভালো করে মনে করার চেষ্টা কর আমার মনে হচ্ছে তুমি কোথাও ভুল করছ
: আমি ভুল করছি না, ওস্তাদজি, সাফায়্যার আমার পেছন দিক থেকে গলায় হাত দিয়েছিল
: ও তো কখনো কারো গলায় হাত দেয় না !
: আমার গলায় দিয়েছিল
: এখন আমাকে কী করতে বলছ ?
: ওকে আপনি ঘোরানিয়া পাঠানোর ব্যব¯থা করুনএকটা চোর আমাদের রাজ্যে থাকতে পারে না
: এটা হয় ? যে ছেলে মহারাজের মাধ্যমে এসেছে, তাঁর আতিথ্যেই আছে তাকে আমি পাঠিয়ে দিতে পারি ?
: তাহলে আমি মহারাজের কাছেই নালিশ করব
: সেটা ঠিক হবে না
: তাহলে আমার হীরকটা কে দেবে ?
: তুমি মনে করার চেষ্টা কর কোথায় হারাতে পারেতাছাড়া হীরক নিয়ে তুমি পাঠশালায় কেন এসেছিলে ?
: বন্ধুদেরকে দেখানোর জন্য
: তুমি দুদিন চিন্তা করতার পরে আমার সাথে দেখা করো
কেমিও জানে যে দুদিন কেন দুমাস চিন্তা করেও কোনো লাভ হবে নাকারণ অভিযোগটা মিথ্যেতাই সে সন্ধ্যার পরে তুরিনের উদ্দেশে বের হলসে জানে যে তুরিন মাঝে-মধ্যে একাকী হাঁটতে পছন্দ করেতুরিনকে সে পেয়ে গেল এবং হীরক চুরির মিথ্যে গল্পটা তার কাছে বললতুরিন বলল, সাফায়্যার তোমার হীরক চুরি করেছে ?
: হ্যাঁ
: পকেটে হীরক নিয়ে তুমি কেন এসেছিলে পাঠশালায় ?
: আপনাকে দেখানোর জন্য, শাহজাদা
: হীরকটা তুমি কোথায় পেয়েছিলে ?
: আমার মাতার কাছে
: আনার সময় তুমি তাকে বলেছিলে ?
: জি
: তুমি কালকে সাফায়্যারের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে ?
: পারব
: আচ্ছা, তুমি যাও
সাফায়্যার ওদের কাছাকাছি ছিল কিন্তু ওরা দেখতে পায়নিসে খুব কষ্ট পেল এবং ভাবল যে কেমিও তার সামনে দাঁড়িয়েও এই গল্প বলতে পারবেতাতে তার একটুও দ্বিধা লাগবে নাসে তার ঘরে ফিরে এলোদরজা বন্ধ করে দিলমনের দুঃখে মেঝেতে শুয়ে পড়ল তার নামে এত বড় বদনামএই কথা যখন সবাই জানবে তখন সে কী করে তাদের সাথে কথা বলবে ? এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ দিয়ে অশ্রুধারা নামতে শুরু করল
সাফায়্যার যখন নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল তখন সে উঠে বসলআলো জ্বাললদেখল যে তার চোখের পানি শুকিয়ে জমাট হয়ে আছেহাতে নিয়ে দেখল সেটা হীরকে পরিণত হয়েছেখুশিতে তার মন ভরে গেলসে তার ঘোড়া নিয়ে কেমিওর কাছে গেলরাতের অন্ধকারে তার যাওয়ার কথা শুনে যেমন ভয় পেল কেমিও তেমন ভয় পেলেন তার মা-বাবা
সাফায়্যার কেমিওকে নির্জনে ডেকে নিয়ে বলল, তোমার পকেট থেকে নাকি এক খন্ড হীরক হারিয়ে গিয়েছে তাই আমি তোমার জন্য এক খন্ড হীরক নিয়ে এসেছিএটা এত বড় যে সহজে হারাবে নাতোমার যখন যে সমস্যা হবে তুমি আমাকে বলবেআমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব
: আপনি কী, রাজকুমার ?
: কেন ?
: আমি হীরকটা হারিয়েছি জানলে আমার পিতা-মাতা আমাকে অনেক রাগ করবেন তাই আমি ঠিক করেছি চুরির দায়টা আপনার ঘাড়ে চাপাবআপনি নিশ্চয়ই আমাকে এক খন্ড হীরক দিতে পারবেন
: তুমি তো জানোই তোমাকে এক খন্ড হীরক আমি দিতে পারব তাহলে তুমি আমার সাহায্য চাইলে না কেন ? কেন তুমি খারাপ চিন্তা করলে ?
: আমার ভুল হয়ে গিয়েছে, রাজকুমার, আমাকে ক্ষমা করবেনএ রকম ভুল আমি আর কোনো দিন করব না
পরের দিন কেমিও পাঠশালায় গিয়ে দেখল, তুরিন গম্ভীর হয়ে বসে আছেযে শিক্ষকের কাছে কেমিও নালিশ দিয়েছিল তার মুখটা একেবারেই মলিনসাফায়্যার তখনও আসেনি কেমিও তুরিনের কাছে গিয়ে বলল, হীরক পেয়েছি, শাহজাদা
: যাকে সন্দেহ করেছিলে তার কাছে ?
: জি না, শাহজাদা, আমার শার্টের পকেটে
: পকেট ভালোমতো না খুঁজে অভিযোগ করেছ কেন ?
: ভুল হয়ে গিয়েছে, শাহজাদা, আমাকে ক্ষমা করবেনএ রকম ভুল আমি আর কোনো দিন করব না
তুরিন শিক্ষককে বলল, ওস্তাদজি, আপনি কি জানেন হীরক চুরির দায় ও কার ওপর চাপাতে চেয়েছিল ?
: জানি, তুরিন
: তাহলে ওকে এমন শাস্তি দিন যাতে ও আর কোনো দিন এ রকম কথা বলার সুযোগ না পায়
: কেমিও উজিরের পুত্রওকে আমি সেই শাস্তি দিতে পারি না
তুরিন গিয়ে তার বাবার কাছে সব কথা বললসে কেমিওর বিচার চাইলজাউজান তাদের কাছে ছিলেনরাজা বললেন, শাস্তি দিলে কি কেমিও ভালো মানুষ হয়ে যাবে ?
: আমি জানি না, পিতাজি, আমি শুধু জানি, যে অপরাধ করে শাস্তি তার পাওনা তাছাড়া সাফায়্যার আমাদের রাষ্ট্রীয় মেহমানতাকে অপমান করলে রাষ্ট্রকে অপমান করা হয়
: তুমি এই দেশটাকে অনেক ভালোবাস, না ?
তুরিন কেঁদে কেঁদে বলল, জি, পিতাজিআমি সাফায়্যারকেও অনেক ভালোবাসিওর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছেআমি এই অপরাধের বিচার চাই
: সাফায়্যার কি জানে, কেমিও ওকে চোর সাব্যাস্ত করতে চেয়েছিল ?
: জানি না
জাউজান বললেন, আমার মনে হচ্ছে সাফায়্যার এটা না জেনে পারে না
রাজা বললেন, কেন মনে হচ্ছে ?
: সাফায়্যার কোনো সাধারণ ছেলে নয়ওর ভেতরে অলৌকিক কিছু আছেও সহজে আকাশের দিকে তাকায় নাআকাশের দিকে তাকালে ওর চোখের মণিদুটো জ্বলজ্বল করেও নিজেও তা জানে না
: সত্যি ?
রাজা অবাক হয়ে গেলেননড়ে-চড়ে বসলেনজাউজানকে বললেন, কারণ কী ?
: কারণ ওর চোখের মণিদুটো অন্য সবার থেকে আলাদানীলকান্ত মণি
রাজা তুরিনকে বললেন, তুমি সাফায়্যারকে ডেকে নিয়ে এসআমরা সামনে গিয়ে বসছি
সাফায়্যারকে নিয়ে তুরিন আসলো
রাজা বললেন, সাফায়্যার, তুমি কি জানো, কেমিওর এক খন্ড হীরক হারিয়ে গিয়েছিল ?
Nasrin Sultana
সাফায়্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, সে কী জবাব দেবে
সবাই সাফায়্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলতার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলজাউজান পরম আনন্দের সাথে রাজার দিকে তাকালেনরাজা দাঁড়িয়ে সাফায়্যারকে বুকে টেনে নিলেনচোখের পানি ফেলে বললেন, তুমি কী, সাফায়্যার ? তুমি কি মানুষ ? একটা ছেলে তোমাকে চোর প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে অথচ তুমি আমাকে বলছ না ওকে আমি শাস্তি দেব বলে ?
: ভুল তো মানুষই করে, মহারাজশাস্তি দিলে কেমিও লজ্জা পাবেতাতে আরো হিং¯্র হয়ে উঠতে পারে
তুরিন বলল, পিতাজি, আমি একটা কথা বলতে চাই
রাজা সাফায়্যারকে ছেড়ে দিলেনসবাই বসলেনতুরিন বলল, আপনি লিখিত দিবেন যে আপনার মৃত্যুর পরে কুন্দিলন রাজ্যের রাজা হবে সাফায়্যার
জাউজান অবাক হয়ে বললেন, কেন, রাজকুমার ?
: কারণ আমি এই রাজ্যটাকে অনেক ভালোবাসিএখানে সাফায়্যারের মতো একজন রাজাই দরকার
রাজা বললেন, আর তুমি ?
: আমি ওর ভাই হিসেবে থাকব
সাফায়্যার তুরিনকে বলল, আমি তো ঘোড়ানিয়া রাজ্যের রাজপুত্র, না ?
: ওখানে তোমার ভাই আছেতোমার ভাই নিশ্চয়ই তোমার মতো হবেরাজ্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজন বিণয় আর বুদ্ধিআমি আমার চেয়ে তোমাকে বেশি যোগ্য বলে মনে করি
: তা হয় না, রাজকুমার
: অবশ্যই হয়
রাজা আর জাউজান খুব খুশিতুরিন রাজাকে বলল, পিতাজি, আপনি রাজসভা ডেকে এটা জানিয়ে দেবেন আমার পক্ষ থেকে সাফায়্যারের জন্য সামান্য উপহার