সমাজচিন্তা

আতঙ্কের জনপদে খুনের নগরে ।। মোহাম্মদ নূরুল হক


আমাদের বসবাস আতঙ্কের জনপদে, খুনের নগরে। সম্প্রতি এই জনপদে চরম অবনতি ঘটেছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। নগরবাসী ভুগছে চরম নিরাপত্তাহীনতায়। তারা ভয়ে-আতঙ্কে রয়েছেন পথে-ঘাটে-কর্মস্থলে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে; এমনকি নিজগৃহও। হত্যাকারীরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড- ঘটিয়ে সটকে পড়ছে বাধাহীন-নির্বিঘ্নে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরতে পারছে না, ত্রে বিশেষে ধরছেও না। পুলিশের দায়িত্ব পালনে শৈথিল্যেও কারণেই ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনায় মানুষ খুনের হার বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।
এখানে মাত্র দুটি খুনের ঘটনা উল্লেখ করব। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে গত বুধবার রাতে। ওই রাতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর বাসায় ঢুকে খুন করে খুনিরা। তারা হাত-পা বেঁধে ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে পরের দিন বৃহস্পতিবার রাতে। ওই রাতে মগবাজারের  সোনালীবাগে খুনিরা বাসায় ঢুকে বৃষ্টি ওরফে রানু, মুন্না, বেলাল ও হৃদয় নামে চারজনকে গুলি করে।  ঘটনার রাতে চারজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন। গত দুদিনের দুটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেগুলো হলো____ ধর্মীয় মতাদর্শের ভিন্নতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, ব্যবসায়িক স্বার্থ, রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন ও চাঁদাবাজি। উভয়েেত্রই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ঘটেছে।
ফারুকী হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের ভাষ্য____ ডাকাতির উদ্দেশ্যে তাঁকে জিম্মি করে হত্যা করা হয়েছে। তবে কেউ-কেউ একে চরমপন্থী কোনো গোষ্ঠীর কা- বলেও ধারণা করছেন।
হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। খুনিকে আটক-গ্রেপ্তার করার আগেই খুনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা নিজের ধারণা গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করেন।
হত্যাকাণ্ড যারা-ই ঘটাক, জনগণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকেই দায়ী করবে। একই সঙ্গে এসব হত্যাকণ্ডের পেছনে জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয়, আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতাদের পরিচয় জানার পর নাগরিক ক্ষোভের লক্ষ্য ক্ষমতাসীনরাই হবেন। কারণ প্রায়-ই দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় লালিতরাই চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় লিপ্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক দিক সন্ত্রাসী লালন-পালন ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার ইতিহাস নতুন নয়। রাজনীতিবিদরা যখন ক্ষমতার মোহে উম্মত্ত হয়ে ওঠেন, তখনই বিরোধী মত দমনে প্রায় সন্ত্রাসীদের আশ্রয় নেন। এ অভিযোগ যেমন সত্য ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে, তেমনি বিরোধী দলগুলোর ক্ষেত্রেও।
ক্ষমতার উচ্চাভিলাষ বাড়ে জ্যামিতিক হারে। এর গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক সময় ক্ষেত্র পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে ক্ষমতাবানদের আভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখী কোন্দল বাড়ে। তীব্র আকার ধারণ করে আধিপত্য বিস্তারের অভিপ্সাও। আধিপত্য বিস্তার ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতালোভীরা ভোগেন অতৃপ্তিতে। বিষয়টা সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে, রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত গড়ায়। নিজেদের ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের জন্য ক্ষমতাসীন দল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি ছাড়াও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ব্যবহার করে। যা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মূল কারণ হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতা ঘটে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, গুম থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত। অনেক সময় সে খুন হয়ে ওঠে ভয়ানক-নৃশংস।
আর এসব নৃশংস খুনের ঘটনায় অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্রও ব্যবহৃত হচ্ছে। খুনি-সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালিত করলে খুনি-সন্ত্রাসীদের হাতে অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কমে আসত। একই সঙ্গে খুন-অপহরনের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেত।
একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে প্রধানত দায়ী পুলিশ। অপরাধীরা একের পর এক হত্যাকা- ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে, অথচ পুলিশ তাদের আটক-গ্রেপ্তার দূরের কথা, অনেক সময় সন্ধানই দিতে পারে না। পুলিশি গাফলতির কারণে অপরাধীরা আসকারা পেয়ে যাচ্ছে। একই কারণে পুলিশের মধ্যে জবাবদিহিতা কমে গেছে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী তো বটেই, বিরোধী দলকেও মনে রাখতে হবে____ সন্ত্রাসী লালন-পালনের মতো নেতিবাচক কর্মকা- রাষ্ট্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয় এবং আইনের শাসন বিঘিœ হয়।  এ কারণে পাল্টাতে হবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। না হলে কখনোই  আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এ লক্ষ্যে সরকারকে যেমন পদক্ষেপ নিতে হবে,  তেমিন দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে বিরোধী দলুগলোকেও। ব্যত্যয়ে নাগরিক নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। এর দায়ভার নিঃসন্দেহে সরকারকেই নিতে হবে এবং বিরোধী দলগুলোও এ দায় এড়াতে পারবে না। আমাদের রাজনীতিকদের মনে রাখতে হবে, নগর পুড়লে দেবালয়ও এড়ায় না।
সরকারকে মনে রাখতে হবে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইনি তৎপরতা কমে গেলেই পেশাদার সন্ত্রাসী-খুনিরা বেপরোয়া ওঠে। হত্যাকাণ্ডের পর ঢালাওভাবে প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের ওপর দোষ চাপানোর রীতি বদলাতে হবে। না হলে প্রকৃত অপরাধীরা কখনোই ধরা পড়বে না। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন আইনের শাসন নিশ্চিত করা। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে জনমনে স্বস্তি আনার দায়িত্বও সরকারের।
তবে সরকার যে বাহিনীর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে, সে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বারবার। পরন্তু নিজেরাও জড়িয়ে পড়েছে অপহরণ, গুম, খুনের মতো বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের। ফলে জনগণ এখন বিশ্বাস রাখতে চায় না যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিরাপত্তা দিতে আন্তরিক। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শর্ষের ভেতর ভূত থাকলে কোনো ঘটনারই প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটলে ওই রাষ্ট্রের মানবাধিকারও হুমকির মুখে পড়ে। নাগরিকের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ব্যর্থতার জন্য শাসকশ্রেণীকে জবাবদিহিতা করতে হয়। নাহলে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে বাধ্য।
ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জে অপহরণোত্তর ৭ খুনের ঘটনায় অভিজাত বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাবের) জড়িত থাকার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। খুন ও অপহরণের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলা চলছে আদালতে। এছাড়া মিরপুরে ঝুটব্যবসায়ীকে মিরপুর থানার এসআই জাহাঙ্গীর পিটিয়ে খুন করেছেন, এমন অভিযোগও প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত। এ দুটি ঘটনার উল্লেখ এ জন্য করা যে, ঘটনা দুটি সম্প্রতি দেশবাসীকে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত করেছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি জনগণকে করে তুলেছে ভীতশ্রদ্ধ।
অপরাধ দমনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দতা বৃদ্ধি, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধে উৎকর্ষ সাধনসহ জনগণকে প্রচলিত আইন সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। কেবল আইন প্রণয়ন করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধ দমনে মার্চপাস্ট করালেই সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল হবে না। প্রচলিত আইন, নাগরিক আচরণ, নাগরিকের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। এবং সে দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। তাহলেই তিলোত্তমা ঢাকা পরিণত হবে না আর আতঙ্কের জনপদে, খুনের নগরীতে।

 

 

 

 

অপহরণ সুশাসন পরিপন্থী ।। মোহাম্মদ নূরুল হক



আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ দায়িত্ব পালনের ভার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ন্যস্ত। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে__ ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা__ যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ অথচ দেশে সম্প্রতি আশঙ্কাজনক হারে অপহরণ-গুম-খুন বেড়েছে। কর্মস্থল থেকে গৃহে ফেরার আগপর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে চরম-উৎকণ্ঠায়। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আতঙ্ক। কর্মস্থল, চলতি পথ থেকে শুরু করে বাসাবাড়ি। কোথাও মানুষের নিরাপত্তা নেই।
অপহরণের বেশিরভাগই ফিরে আসছেন না। কারও-কারও লাশ পাওয়া যাচ্ছে, কারও-কারও কোনও হদিস দিতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রায়ই অপহৃতের পরিবারের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন। যদিও এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ উপস্থিত করতে পারছেন না অভিযোগকারীরা। এসব অপহরণের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গেলে থানাপুলিশ মামলা নিচ্ছে না। যেসব ক্ষেত্রে মামলা-জিডি দায়ের হচ্ছে, ওই সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দৃশ্যমান কোনও সাফল্য দেখাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গত সোমবার নারায়ণগঞ্জ থেকে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জন এবং ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে দুই শিক্ষক অপহরণের শিকার হন। এরপর গতকাল বুধবার রাত ৯টা পর্যন্ত নজরুল ইসলামসহ ৬ জনের লাশ শীতলক্ষ্যা থেকে উদ্ধার করা হয়। আর ভালুকা থেকে অপহৃত দুই শিক্ষককে র‌্যাব সদস্যরা র‌্যাব-হেডকোয়ার্টারে হাজির করে। ওই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযোগ, তারা দুজন  ত্রিশালের জঙ্গিছিনতাই ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
রাজধানীর উত্তরা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে লক্ষ্মীপুর জেলা যুবদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শামছুল ইসলাম সোলায়মানকে পিস্তল ঠেকিয়ে অপহরণ করা হয়। এর দুদিন পর শনিবার তার লাশ পাওয়া যায় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বসুরহাট এলাকায়। নিহতের স্ত্রী সালমা ইসলামের ভাষ্য__ অস্ত্র ঠেকিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী ৮-৯ জন যুবক শামছুল ইসলামকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। লাশ উদ্ধারের পর লক্ষ্মীপুর সদর থানা পুলিশের বিবৃতি, নিহতের বিরুদ্ধে লক্ষ্মীপুর সদর ও নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানায় বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। পুলিশি ভাষ্যের সঙ্গে কাকতালীয় মিল রয়েছে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্যেও। গত রোববার ভাসানটেকে এক আলোচনা সভায় তিনি দাবি করেছেন, ‘দেশে কোনও গুম বা হত্যা হয় না। যাদের গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তারা আইনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’ অর্থাৎ অপহৃতদের স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলছেন, তার কিছুটা পরোক্ষ স্বীকারোক্তি মিলছে, প্রতিমন্ত্রী ও পুলিশের ভাষ্যে। যখনই কেউ অপহৃত হচ্ছেন কিংবা কারও লাশ পাওয়া যাচ্ছে, তখনই পুলিশ নিহতের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উত্থাপন করছে। এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিবৃতি শুনে মনে হয়, কেউ দাগি-সন্ত্রাসী বা মামলার আসামি হলে তাকে অপহরণ করা আইনসিদ্ধ! এখন প্রশ্ন হল__ অপহৃতের স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কেন অপহরণের অভিযোগ তুলছেন? আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অপরাধীদের শনাক্ত-গ্রেপ্তার করার চেয়ে অপহৃতদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ উত্থাপন করছেন কেন?
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকাবস্থায় খুন হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এছাড়া কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধেও নিহতের ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অপহরণের যে অভিযোগ উঠেছে, তা যে অমূলক, প্রমাণ করার দায়িত্ব তাদেরই। কারণ এসব ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব সাধারণ নাগরিকের নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
অপহরণের পর লাশ মিললেও অপহরণকারীরা শনাক্ত হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায় এড়াতে চাইলে তাদেরই প্রমাণ করতে হবে, তারা এই অপহরণের সঙ্গে জড়িত নয়। প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোও তাদের দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসকাবে সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল বলেছেন, দলমত-নির্বিশেষে যারাই নিখোঁজ হন না কেন, তাদের খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রতি কেবল সুলতানা কামাল নন, সমাজের সচেতন মহলের অনেকেই এ ধরনের মন্তব্য করবেন। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতই অপহরণের দায় অস্বীকার করুক, তবে এ তো সত্য__ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটক করে। ৫৪ ধারার অনুবলে পুলিশি আটক-বাণিজ্যের অভিযোগও নতুন কিছু নয়। ধারাবাহিক অপহরণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি জড়িত না-থাকে, তাহলে ভালুকা থেকে অপহৃত দুই শিক্ষককে গতকাল র‌্যাব হেডকোয়ার্টারে হাজির করা হল কেন? ওই দুই শিক্ষককে যদি জঙ্গিছিনতাইয়ে অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে বিষয়টি নিয়ে লুকোচুরি কেন? কেন  কোনও নাগরিককে আটক-গ্রেপ্তারের আগে এর কারণ  জানানো হবে না? কেন তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির না করে, অজ্ঞাতস্থানে রাখা হবে? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এসব আটক-গ্রেপ্তারের মাধ্যমে, নাগরিককে সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। আর সংবিধান লংঘন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী করছে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ। ধারাবাহিক অপহরণের ঘটনার দায় থেকে মুক্তি পেতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই প্রমাণ করতে হবে, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই এবং যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অপহৃতদের উদ্ধারের পদক্ষেপ নিতে হবে।
সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ নির্মূল করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। একই সঙ্গে অশিক্ষা-দারিদ্র্য-বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তিও। এসবই করতে হবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন