মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

খুনি ।। ইমতিয়াজ মাহমুদ


সব আত্মহত্যাই তো এক ধরনের হত্যা। হাসান আপনাকে কে হত্যা
করেছে এটা যদি কোনো কাগজে লিখে যেতেন তাহলে খুব ভালো হতো।
এখন তো আমার সবাইকে খুনি মনে হচ্ছে। আপনার বন্ধুরা শোকসভার
আয়োজন করলো। মুখ কালো করলো। হাসান, মুখগুলোকে আমার খুনি
মনে হয়েছে। ঘরে আপনার বোনেরা গলা ছেড়ে কাঁদছে। কোথায় তাদের
প্রবোধ দেব। তা না। -আমার খুনি মনে হচ্ছে। দৈনিক কাগজে আপনার
ছবি দেখলাম। হাসান কাগজটার হেডলাইন জুড়ে রক্ত। সংসদ ভবনের
সামনে পতাকা উড়ছে। -সবুজ ঐ পতাকাটা কি আপনাকে খুন করেছে!
বরং কোনো চিরকুটে যদি লিখে যেতেন কে হত্যাকারী। সন্দেহ হতো না।
হাসান, পুনরায় আত্মহত্যা করার আগে আমার কথাটা ভেবে দেখবেন।

তোমার কাল ঘুম ।। নূরুল হক


তুমি কি সেই কূম্ভকর্ণ!
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দাও সারারাত
আমি তোমাকে নাড়া দিতেই
দোলে উঠলো নকসাখচিত সেগুনের খাট
যাকে তুমি রাতের সঙ্গি মনে করো
রাতের মিতালী তার সাথে তোমার দীর্ঘদিনের
জানতাম, পৃথিবীসুদ্ধ নড়ে ওঠলেও
ভাঙ্গবেনা তোমার কালঘুম
নড়বেনা চোখের ওপর স্থির হয়ে বসে থাকা ঘুমের পাথর।
কাকে তুমি বেশী ভালোবাসো প্রিয়তম ?
ঘুমকে ? নাকি আমাকে ?
এ কথা বললেই তুমি নিমজ্জিত হও দ্বিধার লবন সমুদ্রে
একদিন আমি তোমার দ্বিধাগুলো
ভাঙ্গতে চেয়েছি কথার হাতুড়ি দিয়ে
যে ভাবে পথশিশুরা রাস্তার পাশে বসে
ইট ভাঙ্গে দূমুঠো অন্ন কেনার অভিপ্রায়ে
ঘুম নামক তোমার সেই বিশ্বস্থসহচরের কাছে ধরা পড়ে
ফিরে আসি আমি
জানি পরাজিত মানুষের কখনো ঘুম আসেনা
বোধের করোটি ভেদ হয়ে বের হয় চিন্তার বুদবুদ
চোখ থেকে বেরিয়ে আসে হতাশার কালো ধোঁয়া
কিছু ঘুনপোকা তাকে নিয়ে খেলতে থাকে,
খেলে যায় অবিরাম
তুমি নও, আমিই পরাজিত মানুষের একজন।

শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মাইল্লাডোবার চেয়ে প্রেমময়ী ।। সালমান তারেক শাকিল


সময়টা ভীষণ অসজ্ঞায়িত
রুদ্রটানে কেবলই মৃত্যুর খেলা
কেবলই যন্ত্রণাউৎসুক..

কী রাত্রি
কী দুপুরের বারান্দায়

কখনোই কেউ বলেনি
অপেক্ষা ‌‌‌‌‌‌‌‌‌তোমার জন্য।

মেঠোপথ ছেড়ে শহুরে রাজপথে
শব্দের অনস্বীকার্য প্রেম
অতপর একদিন বাংলা একাডেমির ঘাসে
লিখে দিলাম প্রেমের উত্তর।

তুমি বললে,

অনেকদিন পর, একা শহরে বালিকা হয়ে
তুমি বললে, এখানে কেউ নেই।
এখানে তুমি অার অামি।

অামি চেয়ে দেখি বাংলা একাডেমির ঘাসে সবুজ নেই।
পত্রপল্লবে চেতনার বুদ্বুদ।

তুমি নাকি রয়ে গেছ সেই গ্রামেই। সেই রোদ্দুরে।

প্রেমের কবিতা এত সস্তা না। একটা দাম, অাছে।

মাইল্লাডোবার চেয়ে প্রেমময়ী অার কেউ নেই।

বৃষ্টিময় মানবজন্ম ।। রেজাউল করিম রনি



হে আকাশ
তুমিতো বুঝে গেছো দূরগামি
                   মেঘের মন,
তাইতো বিশাল হয়ে আছো নিজস্ব নিয়মে।

জমিনের জমানো ধূলা বা জীবনে পথচলার স্মৃতি
আর দূর্বার নৈশব্দ-হাহাকার বুঝে
সেই মতো আজও বৃষ্টি হয় এই পৃথিবীর সবুজ জুড়ে।

বিশাল পাহাড় একবিন্দু জলের আগুনে জ্বলছে নিরব
হাওয়ার উদরে পাহাড় নিরাপদ ব্যাদনা নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে
আমরা শুধু দেখি এই সব ব্যবহারিক বিশালতা।
ভুলে গেছি, কি করে চড়ে হাওয়ার গোপন কোলে
                 সময় ইতিহাসের বাড়ির দিকে চলে।

আমরা যারা ভেসে ভেসে জন্ম নেই জলের পাঁকে
আমাদের চিবুকে ব্যাদনার চুমোর দাগ আর জলের দংশন লুকিয়ে
বলি মেঘের গল্প, দেখাই বিশালতার আকাশ।

পাহাড় আর মেঘের এই সারি সারি পথ চলা কখনও হয় না অতীত
ভালোবাসার ব্যাদনায় পৃথিবীতে বৃষ্টি হয়।
অধরা হাওয়ার প্রেম হয় না জানা
             মানুষের জন্ম কেবলই বৃষ্টিময়।

আধুনিক মগজ ।। ফিরোজ আহাম্মদ

চাদেঁর কাছে সূর্যের ঋন শোধ হলে
গলে যাবে ডাকাতিয়া নদী
ঢেউয়ের ডানায় প্রৌঢ় রাত্রির নিস্তব্ধতা।
দস্যু ইদুর গিলে নেয়
হৈমন্তের মাঠে ঝরা ফসলের লাশ
তোমার কাছে বেড়ে যাক দায়দেনা
শরীরের কাপড় খুলে নিলেও
আমার আধুনিক মগজে
আশ্রয় মিলবে উদ্ধাস্তু পাখিদের
ভুলপথে হেটে যাওয়া বাতাস
শরমের পালক ছিড়ে
নগ্ন বসে থাকে আমার সামনে
আরো ঋনী হতে দাও।

শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কামুক রোদ আর নির্বাসিত শীত ।। রুদ্রাক্ষ রহমান


পাতার ঠোঁটে চুমো খায় কামুক রোদ
রাত জেগে থাকে, শিশিরধোয়া একজোড়া পা দেখবে বলে।
পাখিরা সিনেমা হলে যায়, মানুষেরা তাদের নিয়ে কী বানায় তা দেখতে।

নদীরা নোংরা জলে সাঁতার কাটে
আর অভিসম্পাত দেয় মানুষের নামে।
সূর্য বসে বসে পোড়ায় গায়ের জ্বালা,
আর, আর শীতেরা নির্বাসনে থাকে দীর্ঘকাল!
ভরাবর্ষায় ছইয়ের নৌকায় যে বউ যায় বাপের বাড়ি
তার প্রতীক্ষায় একা কিশোর রোজ জলে নামে।
'আয় ঘুম আয়' বলে চাঁদ ডাকে-
একদিন ভরসন্ধ্যা বেলায় পৃথিবীটাই ঘুমিয়ে পড়ে।

বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

তোমাকে জেরক্স করে দেখি ।। আহমেদ স্বপন মাহমুদ

তোমাকে জেরক্স করে দেখি, চাখি।
ফটোশপে, সেজেগুজে দিয়ে
অনাবৃত রাখি স্তনোভার;
চিবুকে ও বুকে টোকা মেরে
দেখি লালাভায়, মনামার।

রেখে দেই আঙুলের কারসাজি
গুপ্তদেহের অঞ্চলে যথা
চঞ্চলে সে কত কথা বলে
কোমল, সহজিয়া, প্রাপ্ত-অভীপ্সার মতন
তাজা তাজা ভাব, উরুসন্ধি, উদ্দীপ্ত স্তন।
অপ্রত্যক্ষ এই দেখা সরাসরি হলে
ছেলেটিকে দিতে কী কিছুটা আদর
জেন্ডারজ্ঞানে, নারীবাদ টেনে এনে কোলে!
তোমাকে জেরক্স করে দেখি, চাখি।
অনাবৃতায় লেগে থাকে চোখ, গোপনে একাকী।

মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সারা টিজেল-এর কবিতা।। অনুবাদ : রেজা নুর


 [ সারা টীজেল (Sara Teasdale, 1884-1933 ] এর জন্ম ৮ আগস্ট, আমেরিকার মিজৌরী অঙ্গরাজ্যের সেন্ট লুইসে। প্রথম কবিতা প্রকাশ স্থানীয় পত্রিকা,  Reedy's Mirror এ, ১৯০৭ সালে।   ক্রমাগত  ভগ্ন-স্বাস্থের কারণে ৯ বছর বয়সকাল পর্যন্ত বাড়িতে পড়াশোনা করেছেন। ভাইবোনের ভেতর সবার ছোট, অত্যন্ত আদুরে সারা নিজেকে অভিহিত করেছেন এভাবে : "a flower in a toiling world."  তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর ঠাস-বুনন গীতিকবিতার জন্যে।  কবিতাগুলো আবর্তিত--- সৌন্দর্য,  প্রেম কিংবা মৃত্যু বিষয়ে একজন নারীর পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে। এগুলো কবির জীবনের প্রতিরূপ। অনেক সমালোকেরা তাঁকে আমেরিকার প্রধান কবিদের সারিতে গণ্য করেন নি যদিও, কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি পাঠক বা সমালোচক, সবার কাছেই সমাদৃত ছিলেন। ১৯১৮ সালে কলম্বিয়া পোয়েট্রি পুরস্কার (বর্তমানে, পুলিৎজার প্রাইজ) লাভ করেন।  সমালোচকদের কাছে তার কবিতা তেমন অভিজাত মনে না হলেও গীতল ভাষাভঙ্গি ও নির্মল আবেগে ভরা কাব্য প্রশংসিত হয়েছে। তাঁর  ‘Dark of the Moon’  বই সম্পর্কে নিউইয়র্ক টামস্ বুক রিভিউ : --- “the exquisite refinement of Sara Teasdale’s poetry,’ which ‘shows how near Sara Teasdale can come to art’s ultimate goals.”  ‘Flame and Shadow’   গ্রন্থ সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস,--- “Sara Teasdale has found a philosophy of life and death,” having “grown intellectually since the publication of her earlier books.” “ growth in artistry”  “… is a book to read with reverence of joy.”  ১৯৩৩ সালের ২৯ জানুয়ারি নিউইয়র্কে, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবনে সারা’র মৃত্যু হয় । ] 


আমি তোমার নই

আমি তোমার নই, হারাই নি তোমার ভেতর,
হারাই নি, যদিও ইচ্ছা আমার
হারিয়ে যাই দুপুরের জ্বলন্ত মোমের মতো
হারানো যেন সমুদ্রে গলে যাওয়া পলকা তুষার।

আমাকে ভালবাস, আর তোমাকে এখনও দেখি
সত্ত্বা এক অত্যুজ্জ্বল, অতীব সুন্দর
তবু আমি তো আমিই, আকাঙ্ক্ষা যার
হারায় আলোর মতো আলোর ভেতর।

ডুবে যাও গভীর প্রেমে--- দূর করো
চেতনা আমার, বধির আর অন্ধ করে দাও
তোমার প্রেমের ঝঞ্ঝায়
এ এক ঝোড়ো হাওয়ার প্রলিপ্ত দীপশিখাও।


আমার কি যায় আসে

আমার কি যায় আসে, স্বপ্নে ও উদাসীন বসন্তে
যদি আমার গানের দেখা না মেলে মোটেই?
কারণ, তারা সুগন্ধী আর আমি ফুলকি ও আগুন,
আমি এক জবাব, তারা শুধু একটি আহবান ।

কিন্তু আমার কি যায় আসে, কারণ প্রেম শেষ হবে শিগগির,
কথামালা খুলে দিক হৃদয়, নিশ্চুপ রয়ে যাক মন,
কারণ, আমার মন গর্বিত আর চুপ থাকতে পারঙ্গম,
আমার হৃদয়ই গান লেখে, আমি তো নই ।


চাঁদের আলো 

বয়স হলে দুঃখ পাবো না
চলমান ঢেউয়ে যেখানে  চাঁদের আলো পোড়ে
রূপালি সাপের মতো দংশাবে না আমাকে
বছরগুলো আমাকে দুঃখিত ও শীতল করবে,
সুখি হৃদয়ই তো ভেঙে যায়।

জীবন যা দিতে পারে না, হৃদয় তা-ই চায়,
এই বোধই পরিপূর্ণ বোধ,
মানিকের ভাঁজের ওপর, ঢেউয়ের  ভাঁজ ভেঙে পড়ে
তবে, সুন্দর এমনিতেই পলায়নপর,
বয়স হলে দুঃখ হবে না আমার ।


আমি পরোয়া করি না 

যখন আমি মৃত আর আমার ওপরে জ্বলজ্বলে এপ্রিল
তার বৃষ্টি-স্নাত চুল দোলায়,
যদিও ভাঙা-হৃদয়ে হেলান দেয়া উচিত তোমার, আমার ওপরে,
আমি পরোয়া করি না ।
শান্তি পাবো, যেমন পাতাশোভিত বৃক্ষেরা শান্তিময়
যখন বৃষ্টি তাদের শাখা নোয়ায়,
আমি আরও নীরব আর শীতল-হৃদয় হয়ে যাবো
এখনকার তোমার চাইতেও ।






সুমেরু-সকাল ।। প্রণব আচার্য্য

আমি তার ডাকনাম ভুলে গিয়েছি। অলস বৃষ্টিতে ঝোপঝাড়ে অতিবেগ আসে
আমি ভুলে গিয়েছি তুচ্ছ সাপ ও দড়ির খেলা, খেলনাঘর
আদি অক্ষরের গুহা থেকে পাখির গান ভাসে, মৃত্যুনগরে চলো ভালোবাসা শব্দটি বিক্রয় করে দিই
অতিবৃদ্ধ অথবা যুবকের দেনা শ্যাওলার দামে শোধ করি। জলের প্রস্রবণে
তোমাকে বলি, শোন, দৃষ্টি ও দৃশ্যের আঁতাত থেকে বাইরে এসে
বলে দাও সেই নাম, যার কুহক বাসনায় বধির হয়ে আছি, বৃষ্টি আর আলস্যের দেশে

তারপর ধুধু মাঠ; শষ্যহীন
গোধূলিমিনারে দাঁড়িয়ে আরো অনেকের মতো তাকালে দেখা যাবে সুমেরু-সকাল

প্লাস্টিক সার্জারি ।। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

পাখিরা ভুলে যাচ্ছে উড়ালের বানান ও ভাষা, কলাকৌশল
প্রজন্মপাখি প্রজাতি এখন উটপাখি।

প্রকৃত আর প্লাষ্টিক কখনই এক নয়; আমি তোমাকে চিনিনা কেনো?
নৃতত্বের আয়নায় খুঁজে পাইনা নিজেকে। আমি সংখ্যালঘু, আমি কাঁদি; আমরা না।

ঘুড়িরা ফিরে আসেনা। তবু লাটাই সুঁতায় লেগে থাকে মমতা মাখানো নাড়ির টান,
ঘুড়ির শিরা-প্রতিশিরা-উপশিরায় প্রতিমহূর্তে প্রবাহিত আমার স্বত্তা-অস্তিত্ব।


আমি তো ভুলিনি রোদে দগ্ধ পিঠে শুকিয়ে যাওয়া ঘামের লবনাক্ত নদীর নাম
তুমি ভুলে গেলে, আউশ-আমন-বোর ভাতের ঘ্রাণস্মৃতিনেশা!

শাহানা সিরাজী ।। অনুভব ৩৭


কর্ণফুলীকে প্রবাহমান রাখায় ফেনী নদীর দৃঢ়তা
দেখে লুসাই পাহাড় শঙ্কিত হয় ... আমি আছি তো
কর্ণফুলী ফেরায় না, দাও , সারা বিকেল পান করিনি
ঝিরঝিরে বাতাস জলের শরীর ছুঁয়ে যায়

শান্ত ওচোখ লাইটার ...
চশমা পরিনি চিরুনি দিইনি পান খাইনি
দুরন্তপনায় হুড়মুড় চৌকাঠ গ্লাস হাতে
এসো...
কিছু ময়লা জৈবসার হয়
কিছু দাগ থেকেই যায়
কিছু কথা চুপচাপ কাতর
কিছু সময় হাঁটে , একা,সাত রাস্তা হতে চেনা পথ
আবার অচেনা ...
এমনি করে রাত ফুরায় পথ ফুরায় না
মোহনায় নদীর ব্যক্তিগত নাম থাকে না

ভালোবাসা অথবা অধরা মূহূর্ত ।। রেজাউল করিম রনি


তোমাদের এতো এতো পোষা অতীত বলো কোথায় গেলো?
আমারে কেউ একবার গতদিনের হাসি অথবা
কান্না দেখাও অবিকল!

আঁধারের ভীতি পেতে চায় স্থিতি -সময়ের নামে
পৃথিবীতে কোন দিন, কোন সময় কোথাও যায় না।
আগুন অথবা ভোরের নিয়মে সময় শুধু আসেই।
কোথায় গেছে আমাদের মহান মৃতরা?
এরা তো কোথাও যায় না।
চিহ্নহীন ফিরে ফিরে আসে সবুজের অসিয়তে।
আজ নয়, কাল নয়, নয় অন্য কোন দিন বা কালের হিসাব
আমিতো ভালোবাসি প্রতিটি নিঃশ্বাসের সমান বয়সী জীবন নিয়ে
তোমাদের ধূলা খেলা --অলিক অবহেলা।
তোমার স্বপ্নরা কাশ ঝাড়ের আইল ধরে ছুটে ঘোর গাদলা দিনেও
অামাদের জীবন বৃষ্টির শব্দের মতোন উৎসব ঘিরে-
ধীরে ধীরে মাটি আর সবুজের অলিখিত প্রেমের ঘরে যায় ফিরে।
এই পৃথিবীতে সব শব্দেরা শহীদ হয়ে যায় কালে কালে অর্থের চাপে
ফলে চিরকাল আমার ভালোবাসা অধরা মুহূর্তের মতো নিবীর নিরব হয়ে থাকে।

ফলবাজারের তাজা খবর ।। আইরিন সুলতানা



কমলার দুই গোলার্ধ ইদানীং চেপে গেছে আরো,
মালটার আগ্রাসনে।
বহুবর্ষের কোয়া কোয়া রাজত্য মালটার প্রকোষ্ঠে মুখ থুবড়ে পড়েছে আজ।
উন্নত মেরুর সুডৌল মালটা,
পাশে চিমসে যাওয়া আদি কমলার ইতস্তত পড়ে থাকা।
সেয়ানা দোকানীরা খদ্দেরের সম্মুখে ঠেলে দেয়
রূপ। রঙ। রস। 
লালায়িত কর্পোরেট জিহ্ববা মজে যায় মালটার উজ্জ্বল গাত্রবর্ণছটায়।
মালটার ফালি বেয়ে বুঁদ বুঁদ অহং গড়ায়।
পরাস্থ কমলা পড়ে থাকে একদা-এক সময়ের ঝুড়িতে।
উৎসুক চোখে সদ্য আগত ক্রেতাটি দেখে,
ফলবাজারের ছত্রে ছত্রে মালটার জয় জয়কার।

পত্রিকার কাটতি বেড়ে আকাশচুম্বী
শিরোনামে  ফলবিদের উক্তি-
'মালটা একটি আগ্রাসী ফল’।

তূর হক-এর দুটি কবিতা

মৃত্যুসংবেদ

পাপগ্রস্থ আঙ্গুলে কিছু মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়া রাত্রি, ক্রমশ গত হয়েছে আমাদের কতিপয় আয়নাসঙ্কেতে।
তোর ঠোঁটের উপর তখন স্বেচ্ছাচারী বিষপিঁপড়ার দল; নীল রক্তের সাথে পুরনো রিদমে বেজে ওঠে প্রত্নসঙ্গীত, বিস্তারিত হাওয়ায় হাওয়ায়...
আমি জেগে উঠি গুহাকালে, আদিম বাইসনচিত্রে; ধূসর বৃষ্টিরাতে শিখি নিখুঁত মৃত্যুসংবেদ।
তোর পবিত্রতার প্রতিটি বিরামচিহ্ন আমার ঘরে আনে কবরের সুবাস; আর আমি জেগে থাকি বিভ্রান্তিতে, পরলৌকিক গুল্মছায়ায়...


মৌমিতা

শৈশবকালীন পরাগরেণুর বিষণ্ণ গন্ধ,
লালনীল সাইকেলে বেজে ওঠা নিপুণ প্রেম,
ঘুমপাহাড়ে গিয়ে বাষ্প হলে-
ডালিম শিখিয়ে দেয় আমাদের নির্ভুল রক্তইশারা
শহুরে বাতাসে তোমার আর্দ্রতা-
ও পাখি, তুমি ধরা পড়ো বিরহখাঁচায়।

প্রতিটি প্রেম বস্তুতঃ নিখুঁত পুনর্জন্মের খেয়াল,
তোমার অধরে ব্র্যাকেটবন্দি লাল টেলিগ্রাম... 

বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কবিতার সময় ও মনীষার দান ।। মোহাম্মদ নূরুল হক


শিল্পের মূল উৎস- কালের রুচি, যুগের অভিঘাত এবং শিল্পীর সংবেদনশীল মন। প্রত্যেক নতুন যুগের জিজ্ঞাসার উৎস সমকালের অভিঘাত এবং অতীতের স্মৃতি। এক যুগের অভ্যাস ও আচরণ যতই আকর্ষণীয় এবং ফলপ্রসূ হোক, বহুব্যবহারে এক সময় কিশে হয়ে আসে। শিল্পে-সাহিত্যে___বিশেষত কবিতায় এ বিষয়টি গভীর রেখাপাত করে। অতীতের স্মৃতি এবং কর্মযজ্ঞ সমকালের সংঘর্ষে নতুন তাৎপর্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এভাবে কবিতা কাল থেকে কালান্তরে বিবর্তিত হয়। অতীতের সব আয়োজন এবং সমকালের কৌতূহল ব্যক্তির মনোজগৎকে করে তোলে সংশয়ী। এ সংশয়ী চিত্তই জন্ম দেয় অনুসন্ধিৎসু সত্তার; উদ্ভাবকেরও।
কবিতা___শেষ পর্যন্ত কবির বিশুদ্ধ কল্পনা এবং মৌলিক চিন্তার যুগ্ম স্বাক্ষর। পাঠলব্ধ জ্ঞান নির্বিশেষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে; জীবনোপলব্ধি একান্ত নিজস্ব___স্বাতন্ত্র্য অনস্বীকার্য। মানুষ তার প্রতিদিনের কাজে বিভিন্ন ধরনের আচরণের মুখোমুখি হয়। এই আচরণগুলো সব সময় একই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না সত্য; কিন্তু প্রতিটি আচরণই স্থান-কাল-ব্যক্তিভেদে একটি সাধারণ প্রতিক্রিয়াকে প্রতিপন্ন করে। প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতি এ ধরনের আচরণকে অস্বীকার করে না। এ ছাড়া সময়ের ব্যবধানে মানুষের আচরণগত যত পার্থক্যই থাকুক, ইতিবাচক আচরণ বা শিষ্টাচারের প্রতিক্রিয়ায় নেতিবাচক আচরণ সাধারণত অসম্ভব। এ নিয়ম স্থান-কাল-ব্যক্তি নির্বিশেষে মান্য। শিল্পে কল্পনাকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মনে করতেন হেগেল। তার মতে___The work of Art is of higher rank than anyproduct of nature what ever which has not submitted to the passage through themind. . অর্থাৎ শিল্প প্রাকৃতিক সৃষ্টির চেয়ে অনেক উন্নত, কারণ শিল্প সৃষ্টির নেপথ্যে থাকে মনের মধ্যস্থতা। মনের মধ্যস্থতার অর্থ হলো কল্পনা এবং বস্তুসত্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। আবার প্লেটো যখন বলেন___শিল্প ইমিটেশন বা নকল, এ কারণে তা সত্য থেকে অনেক দূরে। তখন অ্যারিস্টোটল শোনান অন্য কথা___শিল্প বাস্তবের নকল হলেও বস্তুগত সত্যের চেয়ে বেশি জীবন্ত। এ অর্থে কবিতা সমাজের ছবি নয়; প্রতিচ্ছবি। ছবি যে দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থান থেকে তোলা হোক, প্রায় একই রকমই দেখায়, কিন্তু প্রতিচ্ছবি বা প্রতিকৃতি একই শিল্পীর হাতেও বিভিন্ন রূপ নেয়। সুতরাং সত্য থেকে দূরের বিষয় হয়েও কবিতা-শিল্প মানবমনে বস্তুসত্যের চেয়ে বেশি অভিঘাত সৃষ্টি করে।
মানুষ কল্পনায় সব সময় মৌলিক___প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র কল্পনা-শক্তির অধিকারী। সৃজনশীলতার অঞ্চলে এ তথ্য আরও বেশি সত্য; বিশেষত কবির কল্পনা। মানুষ নির্বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে___একজনের পাঠলব্ধ ধারণা এবং জীবনাভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্যজনের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু এমন দু জন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না___যাঁরা অবিকল একই স্বপ্ন দেখেন এবং একই ধরনের কল্পনার অধিকারী। কবিদের ক্ষেত্রে এই কথাগুলো শতভাগ খাঁটি। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় জীবনানন্দ দাশ বলেছেন___‘কবিতা কী___এ জিজ্ঞাসার কোনো আবছা উত্তর দেওয়ার আগে এটুকু অন্তত স্পষ্টভাবে বলতে পারা যায় যে কবিতা অনেক রকম।’ উদাহরণ হিসেবে হোমার, মালার্মে, র‌্যাঁবো, রিলকে, শেক্সপিয়র, বদলেয়ার, রবীন্দ্রনাথ ও এলিয়টের কবিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ ‘কবিতা অনেক রকম’___কথাটার অর্থ এই নয় যে, আবেগঘন মানপত্র কিংবা ঘনরসে সিক্ত প্রেমপত্রও কবিতা। যেমন ‘মানুষ অনেক রকম’ বললে, নৃতত্ত্বের দিক থেকে ককেশিয়ান, মঙ্গোলিয়ান এবং নিগ্রোহ, লৈঙ্গিক দিক থেকে নারী-পুরুষ, সভ্যতার দিক থেকে সভ্য-অসভ্য___বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ করা যায়। কিন্তু কেবল চেহারার সাদৃশ্যের কারণে কেউ গরিলাকে মানুষের পর্যায়ভুক্ত করে নিশ্চয় মানবজাতির শ্রেণীকরণ করেন না। তেমনি ‘কবিতা অনেক রকম’ বললে বুঝে নিতে হবে, কবিতা-ই অনেক রকম। কবিতার কাছাকাছি ভাবালুতাপূর্ণ কোনো মানপত্র-প্রেমপত্র-আত্মবিলাপের কাব্যিক বিলাস নয়। কবির মনীষার কাছে কবিতা সৃষ্টির কৌশলই বড় দায়। কবিতার মুখ্য উদ্দেশ্য___মানবচিত্তে রস সঞ্চার। এর জন্য লেখককে হতে হয় মৌলিক চিন্তা ও কল্পনার অধিকারী। যিনি স্রষ্টা, বিনির্মাতা নন; তিনি মেকি শিল্প বিনির্মাণ প্রকল্পে অনীহ এবং দৃঢ়চিত্ত। টলস্টয় ‘হোয়াট ইজ আর্ট’ প্রবন্ধে মেকি শিল্পসৃষ্টির ৪টি অনুষঙ্গের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো___ধার করা, অনুকৃতি, চমকসৃষ্টি এবং কৌতূহলোদ্দীপন। শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘সমাজের কোনো একজনের তীব্র আবেগ অন্যের চিত্তে সঞ্চারের জন্য যখন কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, একমাত্র তখনই হয় সর্বজনীন শিল্প।’ অন্যদিকে মেকি শিল্পীরা উচ্চবিত্তের রুচি ও দাবি মেটানোর জন্য শিল্প সৃষ্টি করেন। ফলে মেকি শিল্পের উৎস শিল্পীর অন্তর্নিহিত আবেগ-উৎসারিত নয়, উচ্চবিত্তের দাবি মেটানোর প্রয়াস মাত্র। সৎ-সাহিত্য মাত্রই সৃষ্টি___মেকি সাহিত্য বিনির্মাণ বা অনুকৃতি। এ কারণে মেকি সাহিত্যিকের চিন্তা ও কল্পনা যেমন ধার করা, তেমনি অনুকরণও। কবি যেখানে বোধের গহনে অভিঘাত সৃষ্টি করেন সেখানে উপ-কবির অবলম্বন বাক-চাতুর্য। এই তিনের সমন্বয়ে কৌতূহলের জন্ম। কিন্তু কবি নিজের প্রজ্ঞার কাছে সৎ থাকেন বলে উপলব্ধি এবং বোধের অনুবাদ করেন। এর মূলে ভূমিকা পালন করে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা, পাঠলব্ধ ধারণা এবং নিত্য-অনিত্য ঘটনা-প্রবাহ।
কবির প্রধান সম্বল___কল্পনাশক্তি। এরপর দৃষ্টির প্রাখর্য, অনুভবের তীক্ষ্মতা এবং স্বতন্ত্র প্রকাশশৈলী। ব্যক্তির প্রতিভা বা মেধার স্তরভেদে কবিতার উৎকর্ষ-অপকর্ষ অনেকাংশে নির্ভরশীল। অনেকান্ত বিষয়ের ভেতরও প্রকৃত কবি নিজের কল্পনাকে প্রসারিত করেন, আপন রুচির অনুকূলে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নির্বাচনের দতা দেখাতে পারেন; দেখানও। শিল্পকলা এবং চিন্তার প্রায় অঞ্চলে প্রত্যেক শিল্পী এবং চিন্তক স্ব-স্ব ক্ষেত্রে আত্মমগ্ন। ওই বিশেষ অঞ্চল ঘিরেই তার স্বপ্ন-কল্পনা এবং চিন্তা আবর্তিত। জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতার কথা’য় ব্যক্তির বহুমুখী প্রতিভাকে স্বীকার করলেও একই সঙ্গে একই ব্যক্তির একাধিক অঞ্চলে সমান পারদর্শিতার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি এবং মননরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে একই সঙ্গে বিচরণ করা এবং প্রত্যেক বিভাগে সমান প্রকর্ষ দেখানোর সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন শাখায় যারা সমান পারদর্শী তাদের ‘উপকবি’ এবং ‘উপ-দার্শনিক’ বলে অভিহিত করে লিখেছেন___‘প্রতিভা যাকে কবি বানিয়েছে, কিংবা সঙ্গীত-বা চিত্রশিল্পী বানিয়েছে___বুদ্ধির সমীচীনতা___শিল্পের সেই দেশেই সে সিদ্ধ শুধু___অন্য কোথাও নয়’। তাই কবির কাছে তার সমাজের___সবকালের সব সমাজেরই প্রত্যাশা হওয়া উচিত___কবিতা। অন্য ধরনের রচনা তার সাধ্যাতীত না হলেও তার কাছ থেকে কবিতা ভিন্ন অন্য কাজ চাওয়া অনুচিত। কবিকে কবিতা ভিন্ন অন্য কোনো রচনায় ব্যস্ত রাখলে তার কবি প্রতিভার প্রতি সামান্য হলেও অবিচার করা হয় বলে মনে করতেন জীবনানন্দ দাশ। কবিতা লেখার আগে কবির ব্যাপক প্রস্তুতির ব্যাপার থাকে___পঠন-পাঠন নয় কেবল; দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যানস্থ হওয়ার মতো যথেষ্ট অবসর না পেলে তার কাছ থেকে সংখ্যাতীত কবিতাপদবাচ্যের রচনা হয়তো পাওয়া যায; কিন্তু সে সব রচনা তার মেধা ও প্রতিভাকে প্রতিভাত করতে সমর্থ হয় না।
কবিতার সময়___কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কবিতায় যে সময় চিত্রিত হয় সে সময়ের সঙ্গে কবির সম্পর্ক কেমন___ওই সময়ের ধারণা কবি সত্তাকে কী পরিমাণ আলোড়িত করে তা সততার সঙ্গে চিত্রায়িত করার সঙ্গে সঙ্গে    সমকালের রুচি এবং প্রধান অসুখ শনাক্ত করার দায় কবির ওপর বর্তায়। ব্যর্থতায় বর্তমানে বসেও কবি কেবল প্রাগৈতিহাসিক যুগের কল্পিত কাহিনিই বর্ণনা করবেন। ওই বর্ণনার সঙ্গে স্বকাল-স্বসমাজের কোনো সম্বন্ধ কিংবা সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। কবি স্বসমাজের গতি ও ঘটনা প্রবাহের প্রত্যদর্শী এবং ভাষ্যকার; কিন্তু ওই বিশেষ কালখণ্ডেই তার চিন্তা-কল্পনাকে সীমাবদ্ধ রাখেন না। এর কারণ সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসান ‘আধুনিক বাংলা কবিতা : ভূমিকা’য় উল্লেখ করেছেন___‘কবির দায়িত্ব হচ্ছে যুগের সত্যকে এবং প্রাণধর্মকে আবিষ্কার এবং এ আবিষ্কারের চেষ্টায় তিনি যুগের ঘটনা-পরম্পরাকে স্পর্শ করেন, কিন্তু তার মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না’। এভাবে যুগের সত্য    এবং কালের রুচির সম্মিলনে কবি হয়ে ওঠেন আত্মজিজ্ঞাসাতাড়িত। বাইরের ঘটনা পরম্পরার প্রতিক্রিয়ায় কবি ভেতরে ভেতরে উদ্দীপিত হন; সে উদ্দীপনা এবং উৎকণ্ঠা মিলে আত্মজিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। সব সময় ওই আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর সাজানো থাকে না___শিল্পে-সাহিত্যে-দর্শনে এমনকি বিজ্ঞানেও। ফলে কবিকে নিজের এবং স্বসমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। প্রবল আত্মক্ষরণে ক্লান্ত হতে হতে শেষ পর্যন্ত উত্তরশূন্য প্রশ্ন করে যান কবি। ওই প্রশ্নের উৎস স্বকালের আর্থ-সামাজিক অব্যবস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যক্তির মনোবিকার।
কবিকে কেবল প্রশ্নশীল হলেই চলে না___হতে হয় মনীষার অধিকারীও। মনীষার অভাব ব্যক্তির সব অনুসন্ধিৎসাকে করে তোলে নিছক পরিদর্শন। ফলে কবিতায় ঘোরের পরিবর্তে তৈরি হয় দুর্বোধ্যতার। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অনেক আগেই বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন। ‘উক্তি ও উপলব্ধি’ প্রবন্ধে লিখেছেন___‘এ-যুগের সহৃদয়হৃদয়সংবেদ্য সাহিত্যও মন্ময় নয়; এবং যাঁর চিৎপ্রকর্ষ যত অসামান্য, তিনি যদি ততোধিক নৈর্ব্যক্তিক হতে না পারেন, তবে তাঁর আত্মপ্রকাশের আশা বিড়ম্বনা। পক্ষান্তরে অহংকারবিস্মৃতির অনন্য উপায় বিনা প্রশ্নে অবগতির আজ্ঞাপালন; এবং অবগতি যেহেতু ঐকান্তিক, তাই তার বিজ্ঞাপন ন্যায়ত অসম্ভব।’ চিৎ-প্রকর্ষের প্রশ্নে ব্যক্তির নির্বুদ্ধিতা এবং মেধাশূন্যতার একটি নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। অনুভূতির তীক্ষ্মতা সত্ত্বেও অপ্রকাশের কারণে চিৎ-প্রকর্ষের প্রমাণ মেলে না; প্রচুর জীবনাভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মনীষার অভাবে সময়কে ধারণ করা সম্ভব হয় না। এর কারণ নির্বুদ্ধিতা এবং মেধাশূন্যতা। কবিকে একই সঙ্গে কালসচেতন এবং মনীষার অধিকারী হতে হয়। মনীষাভিন্ন ভাবালুতার চর্চা চলতে পারে, তাতে আবেগের বিশুদ্ধতা এবং কল্পনার অভিনবত্ব রা করা চলে না।
কবিতার সময় এবং কবির মনীষা একই সূত্রে গাঁথা। কবিতা কালজ্ঞানশূন্য প্রপঞ্চ নয়; সময়কে আশ্রয় করে হয়ে ওঠা ব্যক্তির আবেগ ও প্রজ্ঞার সততাপূর্ণ স্মারক। কবিতা চায় সাহিত্যিক সততা; চাতুর্যকে দেখে সন্দেহের চোখে। ফলে সময়ের কাছে, মানুষের আপন-আপন জীবনাভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির সত্যভাষণ প্রকাশ করতে হয় কবিকে। সময়ের অভিজ্ঞানের সঙ্গে ঐতিহ্য এবং আবহমানতার প্রসঙ্গও জড়িত। কবিকে ঐতিহ্যসচেতনও হতে হয়। এর কারণ, কবিতা পরম্পরাহীন কোনো জড়বস্তু নয়___পূর্বাপর ঘটনার ধারাবাহিক প্রপঞ্চ। ঐতিহ্যের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক সুনিবিড়। যেখানে ঐতিহ্যচেতনার স্বার মেলে, সেখানে ইতিহাসের পাঠও বড় ভূমিকা রাখে। এলিয়ট ‘ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত প্রতিভা’য় বলেছেন__ This historical sense, which is a sense of thetimeless as    well as of the temporal    and of the timeless    and of the temporal together, iswhat makes a writer traditional. And it is at the same time what makes a writermost acutely conscious of his place in time, of his own contemporancity.অর্থাৎÑইতিহাসচেতনা হলো এমন এক চেতনা, যা পৃথক পৃথকভাবে ঐতিহ্যিক চেতনা ও সীমাহীন চেতনা এবং এ দুটির সমন্বয় যা একজন লেখককে ঐতিহ্যিক করে তোলে। ইতিহাস- সচেতনতা লেখকের দায়িত্ব তাঁর সমসাময়িক প্রোপটে, কালপরম্পরায় তাকে সূক্ষ্মভাবে সচেতন করে তোলে।’ অতীতে সংঘটিত কোনো ঘটনার রেশ কিংবা বিশেষ কোনো ঘটনার প্রভাবে সৃষ্ট মিথ এবং ঐতিহ্য কথাশিল্পীকে করে তোলে চিন্তাশীল; কবিকে আত্মমগ্ন। ঐতিহ্যের রূপান্তর এবং সমকালের ঘটনা প্রবাহের বিশ্বস্ত চিত্রায়ণে কবির কালচেতনার স্বার মেলে। শেক্সপিয়র, সফোকিস, রবীন্দ্রনাথ, হুইটম্যান, বায়রন, নজরুল, মানিক, জীবনানন্দ প্রমুখের সাহিত্যকর্মে অতীত ঐতিহ্যিক পরম্পরা এবং সমকাল অভিজ্ঞতার আলোয় চিত্রিত। রবীন্দ্র-সাহিত্যে যতটা আধ্যাত্মসংকট প্রকাশিত, নজরুল-মানিকের সাহিত্যে মানবতা ততটাই উচ্চকিত। জীবনানন্দ বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রত্য করার পরেও সরব নন, কিন্তু গণদাবি এবং জনরুচির প্রতি তাঁর সমর্থন অকৃত্রিম এবং মানবপ্রেমে অবিচল।
কবির মনীষার গুণেই ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের শিা কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। মনীষার সংকট কবিতাকে করে তোলে নিছক বিনোদনের উপচার। কবিতা জ্ঞানার্জনের উপায় নয়,    কোনো বিশেষ কালের জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে কবিতা পাঠ করলে পাঠককে হতাশ হতে হয়। কবিতায় সময় ধারণ করতে হয়___সময়কে মহাকালের অংশ হিসেবে নয় কেবল, বরং সময়ের স্বারকে মহাকালের নিত্যসভায় ঠাঁই করে দেওয়ার লক্ষ্যেই। সময়ের সঙ্গে ঐতিহ্যের সম্পর্ক স্বীকার করে নিলে এও মানতে হয়___সময় ও স্থানের সম্পর্কও নিবিড়। শঙ্খ ঘোষ ‘কবি আর তাঁর উপাদান’ প্রবন্ধে বলেছেন___‘কবিতার আধুনিক প্রতিমায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্থানিক রূপের সঙ্গ গূঢ়ভাবে মিশে যায় সময়ের বোধ, দেশকালের সম্পৃক্ত হয়ে স্বপ্রতিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় এক-একটি ছবি।’ এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, কবি কালের জাতক হয়েও মহাকালের স্রষ্টা, চরাচরের জ্ঞান-অন্বেষণে ব্রতী হয়েও প্রজ্ঞার উৎস।
সময়ের অপব্যয় এবং মনীষার অপচয়ে শুরু হয় মূল্যবোধের অবয়। সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে কাব্যিক মূল্যবোধের পার্থক্য সূক্ষ্ম হলেও স্পষ্ট এবং ব্যাপক। কবিতায় নৈতিকতার প্রশ্ন অবান্তর___কাব্যিক মূল্যবোধ সামাজিক মূল্যবোধ থেকে ভিন্ন। সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সমাজের তৈরি। কোনো সময়ে কোনো একটি বিশেষ সমাজ ব্যবস্থায় ওই মূল্যবোধ সমান হারে সামগ্রিকভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু কাব্যিক মূল্যবোধ স্থান-কাল-ব্যক্তিভেদে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ মূল্যবোধ কবির স্বসৃষ্ট এবং তাঁরই ব্যক্তিগত ও কাব্যিক সততার সঙ্গে এর সম্পর্ক। বাইরের শক্তি এসে এ সম্পর্কে যেমন চিড় ধরাতে পারে না, তেমনি নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না। কাব্যিক মূল্যবোধ লালনের েেত্র কবি স্বয়ম্ভু; সার্বভৌমও। এ প্রসঙ্গে বেনেডেটো ক্রোচের উক্তি উল্লেখযোগ্য__Art is independent both of sceince   andof the useful and the moral. অর্থাৎ ‘শিল্প বৈজ্ঞানিক, ব্যবহারিক এবং নৈতিক জগৎ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।’ ক্রোচে আরও বলেছেন, শিল্পে কোনো উদ্দেশ্য সন্ধান সম্পূর্ণ হাস্যকর। এ প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ ‘সত্য ও বাস্তব’ প্রবন্ধে লিখেছেন___‘শিল্পের উদ্দেশ্য জীবনের সত্যকে উপলব্ধি করে তাকে ব্যক্ত করা। সত্যের অভিব্যক্তি বাস্তবের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন নয়, সম্পৃক্ত।’ ওপরের দুটি উদ্ধৃতি স্বীকার করে নিলে এও মানতে হয়, নৈতিকতা একটি আপেকি বিষয় এবং কাব্যিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণ শৈল্পিক, কোনোভাবে সামাজিক মূল্যবোধকে আশ্রয় করে নয়। শিল্পের সুর এবং জীবনের অনিবার্য সত্য একই সুরে বাজে___কখনো কখনো। জীবন-শিল্প এবং মহাজাগতিক বিষয়ে মানবচিন্তার অঞ্চলে মূলত প্রশ্নশীল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ প্রবন্ধে লিখেছেন___‘বিষয়ের বাস্তবতা-উপলব্ধি ছাড়া কাব্যের আর একটা দিক আছে, সে তার শিল্পকলা। যা যুক্তিগ্রাহ্য তাকে প্রমাণ করা সহজ, যা আনন্দময় তাকে প্রকাশ করতে চাই।’ আবেগ থেকে উৎসারিত বিষয়ের অধিষ্ঠান মানুষের হৃদয়; বুদ্ধির প্রাখর্য এবং প্রজ্ঞার শাসনে তার মর্ম-উপলব্ধি সম্ভব নয়। কবিতা বুদ্ধিবৃত্তিকে সমীহ করে, ভালোবাসে সংবেদনশীলতাকেই। এ সবই ঘটে সময়ের রুচিভেদে, মানুষের চিরায়ত বাসনার সঙ্গে নিত্য-অনিত্য অভ্যাসের অভিঘাতে।
সময়ের নির্দিষ্ট পরিচয় থাকে; থাকে বিশেষ সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিশেষ চিত্রও। এ জন্য কবিকে হতে হয় কাল-সচেতন। ওই কালসীমায় অর্থনীতির আবর্তন এবং অর্থের ব্যবহার সম্পর্কে পূর্ণ ধারণাও তাঁর থাকতে হয়। যুগের পরিবর্তনে প্রধান নিয়ামক শক্তি অর্থ; আর্থিক নিশ্চয়তা কবিকে রাখে সক্রিয় এবং চিন্তাশীল। চিন্তা ও কল্পনার সক্রিয়তাই কবি সৃজনক্রিয়ার প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠে। আধুনিক কালের কবির আশ্রয় যুক্তিহীন ভাবালুতা নয়; মনীষাশ্লিষ্ট অভিজ্ঞানে। আবেগের আতিশয্য নয়; সংহতিতেই তার স্বস্তি। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘উটপাখি’ কবিতায় স্বীকার করেছেন___‘আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশীদার/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে/ আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার’। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্বের ফলে একটি বিশেষ সময়ে সমাজে-রাষ্ট্রে যে পরিমাণ অভিঘাত সৃষ্টি করে, একই পরিমাণ রেখাপাত ঘটে ওই সময়ের অগ্রসর কবির হৃদয়ে। কবি___সহৃদয়হৃদয়সংবেদী বলেই, কখনো হয়ে পড়েন আবেগে আপ্লুুত, কখনো দুঃখে-যন্ত্রণায় কাতর। কিন্তু ওই মানবিক সংকট নিরংকুশ মনোবিকলন সৃষ্টি করে না, যুক্তিবোধ, মনীষা এবং কার্যকারণ সম্পর্ক কবিকে আÍজিজ্ঞাসা সচেতন করে তোলে। অশ্র“কুমার সিকদার ‘আধুনিক কবিতার আধুনিকতা’য় উল্লেখ করেছেন___‘তিনিই আধুনিক যিনি আধুনিক কালের মানুষ, এবং যাঁর রচনায় আধুনিক পরিস্থিতি তার জটিলতাময় সমগ্রতা নিয়ে পরিপূর্ণ মর্যাদায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে আধুনিক কালকে যিনি উপলব্ধি করেছেন এবং সেই উপলব্ধিকে যিনি তাৎপর্যময়ভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন’। সমকালের প্রবণতা এবং যুগজিজ্ঞাসা উপলব্ধির ক্ষেত্রে যিনি ব্যর্থ, তাঁর পে স্বকালের প্রতিচ্ছবি প্রকাশ করা সহজ নয়। আপন অভিজ্ঞতা এবং অর্জিত জ্ঞান তাঁকে যদি কাল-সচেতন করে তুলতে না পারে, তাঁর বিপুল আত্মমগ্নতা তাঁকে দেশকাল বিমুখ কবিতে পর্যবসিত করে। সমকাল যাকে সম্পূর্ণ উপো করে, মহাকাল তাকে বরণমালা পরায় না। প্রকৃতিতেও ভাবনা এবং চিন্তায় ব্যবহারিক দিকের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিনিময়কে মান্য করে। দুর্ভি, ক্ষুধা, দারিদ্র্যের মধ্যে বসে যে কবি কেবল আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠেন, সমাজ-রাষ্ট্রের দুঃসময় যার চিত্তকে ব্যথিত করে না, তার পে উপ-কবি হওয়া সম্ভব, প্রকৃত কবি ভিন্ন ধাঁচে গড়া, ভিন্ন সত্তা।
আধুনিক কালের প্রত্যেক কবির নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড থাকে, সে ভূ-খণ্ডেই তার স্বস্তি। প্রতিভার উন্মেষ, বিকাশ এবং আশ্রয় ওই ভূ-খণ্ড এবং তার স্বজাতিকে কেন্দ্র করেই। তাই সৎ কবিকে স্বদেশ-স্বজাতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হয়। স্বজাতি-স্বদেশপ্রেম কবিকে মাহাত্ম্য দেয়, কিন্তু স্বজাতি-স্বদেশপ্রীতির অতিরঞ্জন কবিকে করে তোলে বিশ্ববিমুখ এবং সংকীর্ণচিত্ত। পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু দশ বছরের আত্মজা ইন্দিরাকে ‘প্রকৃতির পাঠ’ শীর্ষক এক চিঠিতে লিখেছেন___‘আমরা যদি আমাদের এই বিশ্ব সম্পর্কে কিছু জানতে চাই, তাহলে কিন্তু সব দেশ আর তার সব মানুষ নিয়ে ভাবতে হবে___অবশ্যই। শুধু আমাদের ছোট জন্মভূমি নিয়ে ভাবলেই চলবে না।’ নেহেরুর এই পরামর্শ রাজনীতিবিদ নয় কেবল, কবিদের জন্যও জরুরি। আধুনিক কালের কবির বিবেচনার কাছে দেশ-কালের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বলোকই বিশেষ মর্যাদা পায়, উগ্র-দেশপ্রেম এবং অন্ধ জাতীয়বাদী চেতনা তার বুদ্ধির কাছে, প্রজ্ঞার কাছে প্রশ্রয় পায় না। শেক্সপিয়র, রবাট ফ্রস্ট, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশের নাটক ও কবিতাগুলো পাঠ করলেই তাঁদের হৃদয়ের ঔদার্য স্পষ্ট   হয়ে উঠবে। ড. আহমদ শরীফ বিষয়টি দেখেন আরও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। ‘সাহিত্যে দেশ-কাল ও জাতিগত রূপ’ প্রবন্ধে স্পষ্ট বলেছেন___‘মানুষের জীবনচেতনার বারো আনাই দেশকালের দান, বাকি চার আনা অনুশীলনলব্ধ। আবার বোধ, বুদ্ধি, জ্ঞান ও শিাভেদে মানুষের চেতনায় ও    বিকাশভেদেও বৈচিত্র্য থাকে। এই জন্যই মানুষের অভিব্যক্ত আচরণে মগ্ন চৈতন্যের প্রভাব যত বেশি, পরিস্র“ত চেতনার স্যা তত নেই। ফলে বোধ, বুদ্ধি ও জ্ঞান___সংস্কৃতি সম্পন্ন অগ্রসর মানুষের সংখ্যা কম।’ ইচ্ছা করলেই কবিতা লেখা যায় না, দেশকালের দান ব্যতীত কেবল কল্পনার ওপর ভর করে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়, তার জন্য দরকার অনুশীলন।
আধুনিক কালের কবির কাছে অনুশীলন, পাঠাভিজ্ঞতা এবং জীবনবোধ যতটা গ্রহণীয়, ততটা অনুপ্রেরণা নয়___অনুপ্রেরণার দোহায় পরিহাসজনক। ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অর্কেস্ট্রা’র ভূমিকায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন___‘অবশ্য বর্তমানের লেখনীর পাঘাত সত্ত্বেও, স্বপ্নচারী পথিককে যেমন, অনুপ্রাণিত কবিকেও আমি তেমন ডরাই; এবং কালের বৈগুণ্যে ইন্দ্রিয়প্রত্যরে মূল্য বাড়ছে বই কমছে না।’ সুধীন্দ্রনাথ অভিজ্ঞতাকে শিল্পের জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্যে গ্রহণ করেছেন এবং ইন্দ্রিয়প্রত্যণকে দিয়েছেন বিশেষ মর্যাদা। এই কথারই প্রতিধ্বনি মেলে উইলিয়াম ফকনারের কথায়। নোবেলজয়ী এই ঔপন্যাসিক ১৯৫৬ সালে জ্যাঁ-স্টেইনকে দেওয়া এক সাাৎকারে বলেছেন___‘লেখকের কাছে জরুরি হলো___অভিজ্ঞতা, পর্যবেণ এবং কল্পনা।’ এরপর তিনি অনুপ্রেরণার বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অনুপ্রেরণার বিষয়টি কেবল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কবিদের কাছে গ্রাহ্য হয়ে ওঠে। প্রথম শ্রেণীর কবির কাছে এর মূল্য নগণ্য। শামসুর রাহমান ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় লিখেছেন___‘কবিতা লেখার সময় কোনো এক রহস্যময় কারণে, আমি শুনতে পাই চাবুকের তুখোড় শব্দ, কোনো নারীর আর্তনাদ, একটি মোরগের দৃপ্ত ভঙ্গিমা, কিছু পেয়ারা গাছ, বাগানঘেরা একতলা বাড়ি, একটি মুখচ্ছবি, তুঁতগাছের ডালের কম্পন, ধিকিয়ে চলা ঘোড়ার গাড়ি, ঘুমন্ত সহিস ভেসে ওঠে দৃষ্টি পথে বারবার। কিছুতেই এগুলো দূরে সরিয়ে দিতে পারি না।’ এসব দৃশ্য একজন কবির যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত বলে, কবি এসব দৃশ্য সরিয়ে দিতে পারেন না। ফলে তাঁর কাছে অভিজ্ঞতাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
কিন্তু এরপরও চিন্তার দৈন্য, মননের দারিদ্র্য এবং কল্পনার আড়ষ্টতা কবিতাকে ভাবালুতায় পর্যবসিত করে। তাই, প্রকৃত কবি শিল্পকলা এবং জ্ঞান-প্রপঞ্চের প্রত্যেক শাখারই সারবত্তা আত্মস্থ করে, তাকেই ভাবে-ভাষায় রূপান্তরিত করেন। সব সময় দিনানুদিনের ঘটনা প্রবাহ নয়; প্রায় অনিত্য ঘটনা এবং অনুভূতি ও উপলব্ধিই কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে___সঙ্গে কেবল কল্পনা নয়, অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেণলব্ধ মনীষা কবিতাকে প্রমূর্ত করে তোলে। এ কারণেই কালজ্ঞান এবং মনীষা কবির স্বাতন্ত্র্যের পথে গুরুত্বপূর্ণ।

রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ : ভবিষ্যতের কবিতা ।। মোহাম্মদ নূরুল হক

বাংলা কবিতার অতীত উজ্জ্বল, বর্তমান অন্ধকার, ভবিষ্যত অনিশ্চিত।
পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল-জীবনানন্দ থেকে শুরু করে আল মাহমুদÑ এমনকী বিশ শতকের শেষ মুহূর্তে আবির্ভূত কবিদের রচনায় অতীত-ঔজ্জ্বল্যের প্রমাণ রয়েছে। আমরা যে সময়ে এখন বাস করছি, এ সময়টা আশ্চর্যজনকভাবে কবিতাশূন্য। কারণও স্পষ্ট। মানবসভ্যতার কোনো কিছুই দীর্ঘকাল ঊর্ধ্বগামী থাকে না। প্রতিটি প্রপঞ্চ একটি নির্দিষ্ট উচ্চতাপর্যন্ত ক্রমোন্নতির দিকে যায়। এরপর থেকে আবার ক্রমাগত নিম্নমুখীও হয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব বসু-অমিয় চক্রবর্তীদের আভির্ভাব, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা। এই পঞ্চকবি বাংলা কবিতাকে নিয়ে গেছেন বহুরৈখিকে ও চরম উৎকর্ষে। এরপর থেকে গত শতকের শেষমুহূর্তপর্যন্ত আরও অন্তত ৫/৬ জন বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য। বলা চলে গত শতকের বারো আনা কালই বাংলা কবিতার ক্রমোৎকর্ষের কাল। কিন্তু সভ্যতার অন্যান্য দিকের মতো কবিতায়ও হঠাৎ ধস নেমেছেÑ যেভাবে ইতিহাসে  একেকটা রাজবংশের পতন হয়েছে। আরও সহজ করে বলা চলে, পরিশ্রমী শিল্পীদের বিপরীতে প্রায় স্টান্টবাজদের সময়ে এসে পড়েছে বাংলা কবিতা। ফলে এখ তেমন আর কবিতা সৃষ্টি হচ্ছে না। যারা লিখছেন, তারা অকবি-স্টান্টবাজদের দৌরাত্ম্যে প্রায় উপেক্ষিত।
এ সময়ে যারা কবিতা লেখার কসরৎ করতে চেয়েছেন, তাদের সিংহভাগেরই রচনা হয় তীব্র ভাবাবেগের স্ফূরণ মাত্র, নয় কোনো মতবাদ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাষিক রূপ। যা তারা প্রেমিকা বা কোনো নারীর উদ্দেশে কিংবা মনোবিকলনের বিশেষ মুহূর্তে লিখেছেন। কিন্তু মনের স্বাভাবিক অবস্থায় ওই রচনার শিল্পমান নিয়ে কখনো ভাবেননি। প্রয়োজনও মনে করেননি। এ কথা সত্যÑ ব্যক্তিগত অভিরুচির প্রকাশ-প্রবণতা আধুনিকদের মজ্জাগত। কিন্তু আজকের যে তরুণরা কবিতা লিখতে এসেছেন, তাদের অভিরুচিই গড়ে ওঠেনি। যা গড়ে উঠেছে তা হলো অন্যকে বোঝার চেয়ে বোঝানোর, বহিঃজগতের নানা প্রপঞ্চ জানার চেয়ে নিজেকে বিজ্ঞপিত করার মানসিকতা। অথচ জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণুদে প্রমুখ কবির উত্থানকালে একচ্ছত্র অধিপতি রবীন্দ্রনাথ। লিখে চলেছেন মহৎ সব রোমান্টিক কবিতাÑ সাধনায় মগ্ন আধ্যাত্মের। চরাচরের দৃশ্য-চিত্র-শব্দ-বর্ণ-গন্ধ অনুষঙ্গে কবিতাকে আধুনিক মানুষের দিনানুদিনের অভ্যাসে পরিণত করেছেন। তবে সে সত্য প্রকাশে নাগরিক জীবনের   বৈকল্য-যান্ত্রিক অস্বস্তিকে যতটা গুরুত্ব দিলেন, তারও বেশি পল্লীর বিশ্বাস-পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধারণ করলেন কবিতায়। একই বৈশিষ্ট্য জসীমউদ্্দীনের কবিতায়, জীবনানন্দের কবিতায়ও পরিলক্ষিত। জসীমউদ্দীনের পল্লীপ্রেম সত্ত্বেও নাগরিক বোধ  থেকে তাকে সম্পর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আবার জীবনানন্দের কবিতায় গ্রামীণচিত্রের পাশাপাশি নগর জীবনের একাকীত্ব, নৈরাশ্য বিশ্বস্তভাবে চিত্রিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে বিশ্ববাসীর অভিজ্ঞতায় যোগ হয়েছে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব বিশ্বব্যাপী রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। মানুষের জীবনযাত্রায় বিপুল পরিবর্তন ঘটে। স্বপ্নের ভাষা ও ব্যাবহারিক ভাষার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। কারণÑ ‘মানব সমাজে রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন অনবরত ঘটে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রে কোনো বৃহৎ পরিবর্তন আসে না। উপস্থিতকালে জীবিত বুদ্ধিজীবীরা সবাই ভাবেন যে, রাজনীতির পরিবর্তন মানুষের চিন্তার রাজ্যেও বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। পরিবর্তন হয়তো আসে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আসে না।’ (আধুনিক বাংলা কবিতা : ভূমিকা :: সৈয়দ আলী আহসান) ।
এ দিকে রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধের ভয়াবহতাকে প্রত্যক্ষ না করেও অনুভব করার চেষ্টা করেছেন দার্শনিক প্রত্যয়ে-রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। রবীন্দ্রকাব্যের শব্দ-ভাষাশৈলী সহজ সরল সত্য; কিন্তু  তা কোনোভাবেই দিনানুদিনের ভাষা নয়। সে ভাষা সহজবোধ্য হলেও পোশাকি। অন্যদিকে  জসীমউদদীনের কবিতার বিষয়বস্তু যেমন পল্লী থেকে আহরিত, তেমনি ভাষাও পল্লিবাসীর কথোপকথন থেকে সংগৃহীত। ফলে জসীমউদ্্দীনের চেতনা প্রকাশভঙ্গিতে ঐকতান সুস্পষ্ট। জীবনানন্দ বিষয় নির্বাচনে যেমন জসীমউদ্দীনের সমগোত্রীয়, তেমনি রবীন্দ্রনাথেরও। কিন্তু শব্দ নির্বাচনে পল্লির বিষয়-আশয়কেন্দ্রিক হলেও তা সম্পূর্ণরূপে পল্লির নয়। পল্লি ও গ্রামীণ জনপদ থেকে শব্দ ও বিষয়-আশয় সংগ্রহ করেছেন সত্য; তাকেই অকৃত্রিমভাবে প্রকাশ করেননি। নিজের অনুশীলনগুণে পল্লি থেকে মন্থিত বিষয়-আশয় এবং শব্দসমবায়কে করে তুলেছেন মার্জিত। ফলে তার কাব্যভাষা না-গ্রাম্য, না-শহুরেÑ সংকরও নয়Ñ হয়ে উঠেছে শিক্ষিতজনেরর মার্জিত-পোশাকি কথ্যভাষা।
বাঙালির অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে প্রথম সংকট ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা, দ্বিতীয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি। ইংরেজ কবি এলিয়ট যুদ্ধোত্তর বিশ্বকে দেখেছেন রুক্ষ, রুঢ় ও নিরস রূপে। যা ওয়েস্টল্যান্ডের পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে উৎকীর্ণ। এদিকে বাঙালির মধ্যে একদিকে জাতীয়তাবোধ-দেশপ্রেম প্রবল হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে কোনো-কোনো বাঙালি জাতীয়তার বৃত্তকে সংকীর্ণ বৃত্ত ভেবে  দেশপ্রেমকে নিছক আঞ্চলিকতাপ্রীতি হিসেবে গণ্য করেছেন। প্রথমোক্তদের লক্ষ্যÑ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি-রাজনৈতিক স্বাধিকার। এ কারণে তাদের বিবেচনাবোধের কাছে সমগ্র মানবজাতির ঐক্য ও বিশ্বমানবতা গৌণ হয়ে উঠল। পক্ষান্তরে যারা মানুষকে প্রতিদিনের আচরণ ও ব্যক্তিস্বার্থের কদর্যময় চিত্রের ভেতর আবিষ্কার করতে চাননি, তারা মানুষকে গ্রহণ করতে চাইলেন সবধরনের দ্বেষ, প্রতিহিংসা, বৃত্ত ও সংকীর্ণতার বিপরীতে। ফলে তাদের চোখে শাসক-শাসিতের সম্পর্কের টানাপড়েন ততটা মূল্য পায়নি, যতটা মানবপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত তাদের চিন্তাÑ যে চিন্তায় তারা প্রকাশ করেছেন মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ও ব্যক্তির মনোবিকলনের রূপ। রবীন্দ্রনাথ এ শ্রেণীর বাঙালির প্রমূর্ত সত্তা। তার কবিতায় যতটা ভ্রাতৃত্ব ও আত্মাধ্যবোধ ব্যঞ্জিত, ততটা শোষিত-পরাধীন জাতির মুক্তির মূলমন্ত্র হয়ে ওঠেনি। এর কারণÑ রবীন্দ্রনাথ মানুষকে তার প্রতিদিনের কর্মের মধ্যে আবিষ্কার না করে তাকে স্নেহে-প্রেম-মমতা এবং আত্মনিবেদনের চিরন্তন মানবধর্মের মধ্যে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রমানসে কখনো ঠাঁই পায়নি। অথচ ইউরোপের প্রধান কবিরা তখন ব্যক্তির নৈঃসঙ্গ, নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যকে প্রমূর্ত করে তুলছেন কাব্যে। তারা আধুনিক জীবনযাত্রায় দেখছেন বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব, সংশয় এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উদগ্র বাসনা।
বাঙালি কবিরা ইউরোপীয় জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষদর্শী না হলেও ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়টের কবিতা পঠন-পাঠনের সুবাদে আধুনিক যুগ-যন্ত্রণার স্বরূপ উপলব্ধি করেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে কাব্যক্ষেত্রে আধুনিকতার রূঢ়-রূপ চিত্রায়নে ব্যাপক নিরীক্ষা করলেও, পশ্চিমের জীবনযাত্রার স্বরূপ বঙ্গীয়করণের চেষ্টা জোরালোভাবে করেননি। তবে বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ বেশি ঋণপরিগ্রহণ করেছেন।
পৃথিবীতে যত প্রপঞ্চ আছে, তার মধ্যে ধর্ম সবচেয়ে বেশি প্রভাবসঞ্চারী। যখন  কোনো একটি বিশেষ প্রপঞ্চ প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে ওঠে, তখন ওই প্রপঞ্চের প্রতি বিমুখ-আস্থাহীন-নিরপেক্ষ মানুষের শ্বাসরোধ হয়ে আসে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবসঞ্চারী প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে নিকটবর্তী প্রভাবসঞ্চারী প্রপঞ্চের অনুগামীরা হয়ে ওঠে প্রতিবাদমুখর। এ তথ্য অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, জাদু, ধর্ম, কবিতা ও শিল্পকলার তাবৎ অঞ্চল সম্পর্কে সত্য।
১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইনের ফলে ভারতবর্ষে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল, তার প্রভাব শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেভাবে পড়েছে, সেভাবে স্পর্শ করেনি এই কবিদের। তেমনি লাহোর প্রস্তাব, গান্ধী-নেহেরু-জিন্না মতবিরোধের ফলে দেশেসৃষ্ট দাঙ্গার ঘটনাও তাদের ব্যথিত করেনি। তাদের কবিতায় ব্যক্তির মনোজগত যতটা প্রতিফলিত; বহির্জগতের আচরণ ও কর্মব্যস্ততা ততটা নয়। ফলে প্রেম, হিংসা, বিদ্বেষ, ভালোবাসা, মান-অভিমান কবিতার মূল অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতার বিষয়গুলো কবিতায় অঙ্গীভূত হতে পারেনি।
সমাজে বিভিন্ন সময়ে বিত্তবান ও ক্ষমতাবানদের আচরণে সাধারণ ও নিম্নবিত্ত অবদমিত থাকে। এই অবদমন থেকে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ। সময়ে এই অসন্তোষই ক্ষোভে পরিণত হয়। ক্ষোভ থেকে জš§ নেয় বিদ্রোহের। যা চিত্রিত হয়েছে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সিকান্দার আবু জাফর, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ থেকে শুরু করে রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ প্রমুখের কবিতায়। উপস্থিতকালের যুগযন্ত্রণা সবাইকে সমানভাবে ব্যথিত করে না, আবার জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব বসুর সতীর্থ কবি সমর সেন তার স্বকালের কবিতা সম্পর্কে ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেনÑ ‘আমাদের অভিজ্ঞতা এখনও অনেকটা ধরা করা, বই পড়া; দেশের মাটির, দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বলতে গেলে সবেমাত্র শুরু হয়েছে, আত্মীয়তায় এখনও পরিণত হয়নি। ফলে নতুন প্রভাবে বাগাড়ম্বরের দিকে বাঙ্গালীর স্বাভাবিক ঝোঁক আরও প্রখর হতে পারে, মানবিকতার নামে কীর্তনের ভাবালুতা আবার আসতে পারে এবং কবিরা ভুলে যেতে পারেন যে বুদ্ধি ও আবেগের সমন্বয়ই সার্থক কবিতার উৎস।’ আধুনিক বাংলা কবিতা পূর্ববর্তী বাংলা কবিতারই ধারাবাহিক প্রপঞ্চ, ঐতিহ্যিকও। তবে পূর্ববর্তী ধারা ও রবীন্দ্রকাব্যের সঙ্গে আধুনিক বাংলা কবিতার বেশ কিছু পার্থক্যও সুষ্পষ্ট ছিল। যেমন জীবনানন্দ-সুধীনদত্ত প্রমুখের কবিতার সঙ্গে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ; রফিক আজাদ, নির্মন্দেু গুণের সঙ্গে আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লা, আবু হাসান শাহরিয়ার প্রমুখের কবিতার আঙ্গিক-প্রকরণ-ভাষাশৈলীর ক্রম পার্থক্য সুষ্পষ্ট।
এ ধরনের পরিবর্তনে কতগুলো নিয়ামক কাজ করেছে। প্রধম কারণ পারিবারিক-সামাজিক, দ্বিতীয় কারণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক। মানুষ স্বামাজিক জীব, পারিবারিক বন্ধন মানুষকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও নির্ভরশীল করে তোলে। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে ভাই-বোন, বাবা-মা পরস্পরের সুখে-দুঃখে সহমর্মী ও সহযোগী হন। বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান। এদেশের মানুষ মূলত কৃষিপ্রধান জীবিকা নির্বাহ করে। মানুষ যতদিন গ্রামে থাকে ততদিন তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনও সুদৃঢ় থাকে। একেক গ্রামে, একেক পরিবারের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, রুচিবোধ ও আচরণবিধি, পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ একেক রকম। একজনের সঙ্গে অন্যজনের মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। কিন্তু মানুষ যতই শিক্ষাদীক্ষা অর্জন করে ততই কৃষিভিত্তিক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিতে চায় বেশি। শহরে শিল্প নির্ভর সংস্কৃতি ও পেশাদারিত্ব গড়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। শিক্ষিত মানুষেরা গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়। বিয়ে থেকে শুরু করে নানা রকম সামাজিক সম্পর্কগুলো নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। এক সময় শহরেই থিতু হতে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে অভিবাসনের ফলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। একেক জনের সঙ্গে একেক জনের নানা রকম ভিন্নতা দেখা  দেয়। শিথিল হতে থাকে পারিবারিক বন্ধন। শুরু হয় নিঃসঙ্গতা। এ নিঃসঙ্গতা হয়ে উঠেছে আধুনিক কবিতার বিষয়, একই সঙ্গে আঙ্গিকও। অর্থাৎ বিশ শতকের কবিরা কবিতায় বিষয়-শব্দ-বাক্যে যেমন একাকীত্ব-নিঃসঙ্গতাকে তুলে এনেছেন, তেমনি ছন্দ-মাত্রা-পঙ্ক্তিবিন্যাসে করেছেন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। স্বরবৃত্ত-মাত্রবৃত্তে পঙক্তিদৈর্ঘ্যে এনেছেন বৈচিত্র্য। পর্বের সমতা ভেঙে পঙ্ক্তিগুলো করে তুলেছেন বিসমপার্বিক। তুলে দিয়েছেন অন্ত্যমিল। এর পরিবর্তে মধ্যমিলকে দিয়েছেন গুরুত্ব। আর অক্ষরবৃত্তকে এমনভাবে গদ্যের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন, তাতে গদ্যপদ্যের স্থূল প্রভেদ প্রায় ঘুচে গেছে। 
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যÑ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সাত চল্লিশের দেশবিভাগ, পাকিস্তানপ্রীতি ও পাকিস্তানবিদ্বেষ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, একত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের মুজিব হত্যা, সামরিক শাসন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান। এসব ঘটনার সঙ্গে জাতির অর্থনৈতিক বিষয়গুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাজনৈতিক মুক্তি ব্যতীত অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব। অর্থনৈতিকভাবে দাসত্বের কারণে ব্যক্তি  হয়ে পড়ে ভীরু, মেরুদ-হীন। তাই গত শতকের কবিরা রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তিরও দাবি তুলেছেন। বিষয়-আঙ্গিকের পাশাপাশি তাদের চেষ্টা ছিল কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠাও।
কিন্তু আজকের কবিযশপ্রার্থীরা কবিতার কোনো শর্তই মানতে অনীহ। তাদের মনে কোনো একটি বিশেষ ভাবের উদয় হওয়া মাত্রই তা অক্ষরে-শব্দে-বাক্যে রূপ দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্যের একটি দৃশ্যমান শরীরই সৃষ্টি হচ্ছে কেবল, তাতে প্রাণ-রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ থাকছে না। তারা লিখে যাচ্ছেন, স্বীকৃতিও দিচ্ছেন একে অন্যকে। তাদের প্রায় রচনা আত্মপ্রতারণায় পর্যবসিত হচ্ছে। পূর্ববর্তী কালের কবিদের সাধনা-নিরীক্ষাকে তারা উড়িয়ে দিচ্ছেন, গ্রহণ করছেন না বোদ্ধাসমালোচক-অগ্রজ কবিদের কোনো পরামর্শ।
তাদের মধ্যে আত্মঅহম বড় হয়ে উঠেছে। এই আত্মম্ভরিতাকে প্ররোচনা দিচ্ছে। শিল্পে শত্রু কিছু প্রতিষ্ঠান-সংঘ। এই প্রতিষ্ঠান-সংঘ পুরস্কার-পদকের ফাঁদে ফেলে তরুণদের করে তুলছেন বিপথগামী। দৈনিকলগ্ন সাহিত্যপাতাগুলোও বর্তমানকে কবিতাশূন্য কালে পর্যবসিত করার জন্য দায়ী। ‘অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা সাহিত্য পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পেলে পুরো পাতাটিকে পারিবারিক সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের দেয়ালিকায় পরিণত করেন। এই অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখকদের প্রতি তাকান ভীত সন্ত্রস্ত চোখে, আর আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চানাচুর মার্কা রচনা পত্রস্থ করেন যত্মসহকারে। সাহিত্যসমাজে যখন স্নবরি বা স্টান্টবাজ লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন নির্মোহ, নিরাসক্ত ও নির্লোভ প্রাজ্ঞ ও হৃদয়বান সাহিত্যিকেরা উপেতি হতে থাকেন।’ (সাহিত্যের রাজনীতি : মোহাম্মদ নূরুল হক)। এই অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা নিজের বান্ধবী,  আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের অকবিতা ছাপিয়ে ছাপিয়ে সমাজে একধরনের ধারণা দিয়ে রাখেনÑ এই হলো কবিতা। ওই সব অকিবতা পরবর্তী সময়ে বই আকারে প্রকাশিতও হয়। কিন্তু পাঠক-সমালোচক গ্রহণ না করলেও ওই সব বই ঠাঁই পায় বিভিন্ন পুরস্কার দাতা প্রতিষ্ঠান আর প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মানীপ্রাপ্ত সাহিত্যবিচারকদের ড্রয়িংরুমে। একসময় ওই বইগুলোর মলাটজুড়ে পুরস্কার জোটে। ওই পুরস্কার প্ররোচিত করে অনতি তরুণদের। তারা  ভেবেই নেয়, পুরস্কারই কবি জীবনের বড় প্রাপ্তি। তারা ছোটে ওই পুরস্কার দাতাদের  পেছনে। পুরস্কার দাতা-গ্রহীতাদের মধ্যেও রয়েছে বিভিন্ন দলবাজি-গোষ্ঠীপ্রীতি- গোষ্ঠীবিদ্বেষ। তারা নিজেদের গোষ্ঠীর লেখকের রচনা ছাড়া অন্যদের রচনা পড়ে  দেখেন না, স্বীকারও করেন না। এছাড়া পুরস্কার না পেলে তারা ওই কবিকেও স্বীকৃতি  দেন না। অথচ এই স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি ও পুরস্কা-পদকের সঙ্গে কবিতার কোনো সম্পর্ক নেই।  একারণেই বাংলা কবিতার বতর্মান অন্ধকারে নিমজ্জিত।
আর ভবিষ্যতের কবিতা_ নির্ভর করবে, বর্তমানের সৎ-পরিশ্রমী কবিদের নিষ্ঠা-প্রস্তুতির ওপর। আগেই বলা হয়েছে, সবকিছুরই উত্থান-পতন রয়েছে। তেমনি কাল-কালান্তরের কবিতারও। উপস্থিতকালের কবিদের প্রস্তুতি-নিষ্ঠা কবিতাবান্ধব হলেও ভবিষ্যতে যথার্থ কবিতা-ই সৃষ্টি হবে। হয়তো দশ কি বিশ বা ত্রিশ বছর সময়ের মধ্যেই বাংলা কবিতা ফিরে আসবে, স্বরূপে, স্বমহিমায়। যেমন পদাবলির দীর্ঘকাল পর মাইকেল, এর দীর্ঘদিন পর রবীন্দ্রনাথ। তারপর রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে স্বীকার করেও সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে জীবনানন্দ-সুধীনদত্ত-বিষ্ণু দে_ প্রমুখের হাতে আধুনিক বাংলা কবিতার সৃষ্টি।