পাঠোদ্ধার

হেনরী লুইসের অ্যাকোরিয়ামের কচ্ছপ ।। মোস্তাফিজ কারিগর






হেনরী লুইস। বাংলা কবিতার বাগানে এই নামটা সদ্য ফুটে ওঠা ফুলের মতো, একদম নতুন, নতুন ধানের গন্ধের মতো। মেহেরপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে শৈশবের দিনগুলো বয়ঃক্রমের ক্যানভাসে রেখা রেখা করে তুলে রেখেছে, তারপর কিছুকাল কুষ্টিয়াতে কেটেছে উচ্চতর শিক্ষার প্রয়োজনে, আরো কিছু উচু শিক্ষা হলো এই ঢাকা শহরে, যা না হলে বিয়ে করে বৌ-ছেলে নিয়ে এই ঢাকার শহরে টেকার জন্যে মার্চেন্টডাইজিং-এর চাকরি তার নিশ্চয়ই ঝুটতো না। এই মেট্রোপলিটনের ঘুলঘুলির ভেতরে আমাদের এই বন্ধু আদেও আর কবিতায় ফিরে আসবে, সেটা ভাবাই ছিলো আমাদের জন্যে এক ধরণের পাগলামি। কিন্তু এমন আত্মঘাতী পাগলামি সে নিজেই করে চলেছে ভেতরে ভেতরে তা আমরা জানতে পারি নি। মোবাইলের ম্যাসেজ বক্সে, মানিব্যাগের টুকরো কাগজে, অফিস থেকে ফেরার পথে বিষময় ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে বসে বসে চালিয়ে গেছে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ। হঠাৎ এই সব আবিষ্কার করলো বন্ধু ঋপন পরামানিক, আমার মেইল ওপেন করে দেখতে পেলাম-এই রাজধানীর ফ্লাটবন্দি জীবন, জ্যামের ঘামে ভেজা অন্তর্বাসের মেজাজ, পুরানো প্রেমিকার উস্কানি, বাজার কাঠামো, রাষ্ট্রের সঙ্গমবিধানের টুকরো টুকরো কোলাজ- এক একটা সম্পূর্ন কবিতা। লুইসের কবিতা। ভেতরে অনাবিল আনন্দ ঘন হয়ে উঠলো। আমি আর ঋপন লাফালাফি করে উঠলাম একপ্রস্থ পুস্তক প্রকাশের দাবিতে; শেষমেষ বোঝা গেল এই সমস্রোত লুইস নীরবে নীরবে বয়ে বেড়াচ্ছিল নিজেই, আমরা মুখে রা আনতেই ও যেনো মাজা বেধে লেগে পরলো। প্রতিদিন অফিস শেষ করে আমাদের চে’কুঠিতে আসা ওর বদঅভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। মোবাইলের ওপারে ঋপন, আর সামনাসামনি আমরা বসে প্রুফ দেখা, কবিতার পঙতি ভাঙা...এইসব। আমরা নিজেরা নিজেরা কাগজ কিনলাম, প্রেসে দৌঁড়ালাম...না; এই শহরের কোন কুরুচিপূর্ণ, লোভী, প্রতারক প্রকাশকের দরবারে হাজির হলাম না। চে’কুঠি কোন বাণিজ্যিক প্রকাশনাগার নয়, এর উদ্দেশ্য আজ অব্দি তা নয়- চে’কুঠির নামে কিছু আইএসবিএন নেওয়া ছিল- তার একটা লেগে গেলো লুইসের অ্যাকুরিয়ামে কচ্ছপের বাড়ি বইয়ের কাভারে...এই কাভার আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, একেছি ঠিক তাই। বই দাঁড়িয়ে গেল।

চলতি বইমেলার ১৯৩ নং দোকানে ( রাঁচী গ্রন্থনিকেতন) ও লিটলম্যাগ চত্বরে কবি’র দোকানে বইটি বিক্রয়ের বাহানায় দেওয়া হয়েছে। আমার কবিতাপাঠের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- কেউ বইটি টাকা খরচ করে সংগ্রহ করলে একেবারেই ঠকবেন না, অন্তত কবিতা হয়ে ওঠার টুকরো টুকরো যন্ত্রনা আপনাকে আনন্দ দেবে।








মোহাম্মদ নূরুল হক ।। জড়তুল্য পাথর : মন ও মননের স্বাক্ষর


কবিতার মৌল দায় পাঠকমনে আলোড়ন তোলা। যে কবিতা পাঠককে নাড়া দিতে সমর্থ হয় না, সে কবিতা মুদ্রিত অক্ষরেই বন্দি থাকে। কবি মাত্রই মানবহƒদয়ে দোলা দেন আপনসৃষ্টি দিয়ে। আধুনিক কবিতা দোলা দেওয়ার উপাচার মাত্র নয়; মননশীলতার চৌকর্যময় প্রকাশও। আধুনিক কবির আবেগ এবং প্রজ্ঞার সম্মিলনে সৃষ্টি হয় একেকটি সার্থক কবিতা। ত্রিশাখ জলদাসও সে ধারার সার্থক কবি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জড়তুল্য পাথর’। এ কাব্যের বিষয় মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট। মনস্তাত্ত্বিক বিষয়নির্ভর কবিতাগুলোয় কবি একধরনের ঘোরের সৃষ্টি করেছেন। সে ঘোরের ভেতর যুক্তিরহিত ঘটনাবলি পরম্পরাহীন ঘটেÑ সৃষ্টি হয় আলো-আঁধারির দৃশ্য। সেখানে মূলত মনোবিকলনই প্রাধান্য পায়। মনোবিকলনের কারণে ‘একটি অসরল কবিতা’য় ‘হাফপ্যান্ট’কে মনে হয় ‘ল্যাম্পোস্ট’। সমাজের স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম লঙ্ঘনের ফলে যে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, সে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সন্ধিপ্রস্তাবও কখনো-কখনো যুক্তিহীন ঠেকে। এমন যখন পরিস্থিতি, তখন ‘উলটে গেলে ছায়াÑকয়েকটি গর্দভ গান তোলে মানুষের গলায়’। মানবস্বভাবের একটি স্বাধারণ বৈশিষ্ট্য এই পঙ্ক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কবি এই একটি পঙ্ক্তি কবিতাটির দুস্তবকের শেষেই জুড়ে দিয়েছেন। এতে একটি জটিল সময়ের মানচিত্র পাঠকের সামনে উšে§াচিত হয়েছে খুব সহজে।
অবদমন এবং সামাজিক বিচ্যুতির সঙ্গে ব্যক্তির মনোজগতজুড়ে ক্রমাগত স্ববিরোধ জšে§। ব্যক্তি তখন নিজের পারিপার্শ্ব এবং অন্তর্জগতের মধ্যে সমন্বয় খোঁজার চেষ্টা করেন। সবসময় সাফল্য তার ভাগ্যে ধরা দেয় না; কিন্তু যখন দেয়, তখন ‘ফিরে যাই অস্খলিত বীর্যের ভেতর সন্তর্পণে পরাজয়ে’ কবিতায় উচ্চারণ করেনÑ ‘সবিস্তারে শুয়ে থাকে একাকী বন্দর’। আত্মজিজ্ঞাসাতাড়িত কবি কাকে প্রশ্ন করেনÑ ‘আমিও কি ফিরে যাই ঘুমের ভেতর’? আর এই অবদমন এবং ব্যর্থতার ফলেই প্রত্যাবর্তনের আগে কবিতায় কবির মনে হয়Ñ ‘প্রতিবার সঙ্গম শেষে নারীর যুগল স্তন/সাপের ফণার মতো দুলে ওঠে’। ‘আমি ও আমার ঈশ্বর’ কবিতায় স্রষ্টার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং চরাচরের বস্তু ও নির্বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্কের যে চিত্র আঁকেন, সে চিত্রে নৈরাশ্য প্রাধান্য পায়। ‘অবিচ্ছিন্ন স্বপ্নে’র ভেতর দেখি স্বপ্নচারীর কাক্সক্ষা এবং প্রাপ্তির সমীকরণ। বহু-কাক্সিক্ষত বিষয়ের সঙ্গে প্রাপ্ত বস্তুর বৈসাদৃশ্য কবিকে ব্যথিত করে। তাই যে নেকড়ের ছবি আঁকার স্বপ্ন তার বহুদিনেরÑ মনে সেই নেকড়েটি ‘তীক্ষœ দাঁতের উল্লাসে বনের সমস্ত নির্জনতা, সমস্ত পবিত্রতা এবং পূর্ণতাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় আর আমার হাতের ধারালো ছুরিটি জড়তুল্য পাথরের মতো ডুবে যায় জলের গভীরে’। এখানে পাথর এবং জড়কে আলাদা সত্তায় বিবেচনা করা হয়েছে। জড় নি®প্রাণের এবং পাথর প্রাণের ব্যঞ্জনা ধারণ করেছে।
‘কতিপয় বাণীচিত্র’ মূলত আত্মজিজ্ঞাসাপীড়িত সত্তার আত্মোপলব্ধি। তাই হয়তো তার পক্ষে সহজ হয়ে ওঠেÑ ‘কবিতা আহত হলে সিজোফ্রেনিয়ায়/অসংখ্য রোদ্দুরে খেলে চতুর বিষাদ’। এই কবিতার রোদ্দুর অনুষঙ্গ কবির একটি প্রিয় প্রসঙ্গ। ‘অরীতি ও রোদ্দুরের গান’-এর বক্তব্য এবং অন্তর্জগতজুড়ে এই রোদ্দুরের বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য উচ্চারিত হয়েছে। ছায়াপথ, ওষ্ঠ পার হয়ে ‘রোদ্দুরের মর্মমূলে পড়ে আছে একটুকরো কাগজি বিশ্বাস’। এ সব উচ্চারণে কবিকে সত্যনিষ্ঠ, বস্তুবাদী মনে হয়। কিন্তু ‘আমার শীতকাল’ কবিতায় কবি হয়ে ওঠেন সম্পূর্ণ ভাবাবেগাক্রান্ত। সঙ্গতকারণে তীব্র ভাবাবেগে উদ্বেল কবির মনে হয়Ñ ‘শুধু একটি চন্দ্রমণি তার নরম চঞ্চুয় তুলে নেয়/আমার শীত কাল’। মানুষের আচরণ এবং অনুভূতির সম্মিলনে যে অভিজ্ঞতার অর্জন, কবিতায় তার শিল্পরূপ চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে। সেখানে কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কারের চেয়ে, উচ্চারিত শব্দসমবায়ের আন্তঃসৌন্দর্যে বিস্মিত হয় মুগ্ধপাঠক। মুগ্ধপাঠক ভালো লাগা না-লাগার ব্যাখ্যায় অনীহÑপাঠোদ্ধারেই তার স্বস্তি।
নিশীথে সঙ্গম শেষে কার আঁচলে কে এসে মুছে যায় ঘাস
কার আগুনের তাপে পড়ে যায় অসীমের প্রতিমা পুতুল
মৌনতার চোখে জল, তবু
শুব্ধস্বর শুয়ে আছে পাশাপাশি দীর্ঘরাত আত্মার উঠোনে।
অনন্ত রাত্রির শেষে বৃষ্টির বিস্বাদ এসে যদি
ছুঁয়ে যায় কোনও এক নিষিদ্ধ নদীর জল, তবে
হুহু করে কাঁদে নারী, উলটে যায় আত্মমগ্ন সর্পিল চিতল।
চিতল, আত্মমগ্ন এবং একসময় উলটে যায়, এর কারণ কী? রাতের শেষে বৃষ্টি ছুঁয়ে গেলে নদী তখন নারী কাঁদে বনে? তার মানে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, কাক্সিক্ষত বস্তুর পরিবর্তে অনাকাক্সিক্ষত বিষয়ের উপস্থিতিতে মানবমন বিষিয়ে ওঠে? অপ্রিয় বস্তুর সাক্ষাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মানবমন? ‘চারপঙ্ক্তি’ তিনখ-ে লিখিত কবিতা। প্রথম খ-ের শুরুর পঙ্ক্তি ‘এক টুকরো মুগ্ধতা    নিমগ্ন রোদ্দুর’ বলে যে প্রস্তাবনা, শেষ খ-ের শেষ পঙ্ক্তি ‘পড়ে থাকে শূন্য চাক    জমাট বিনাশ’। পুরো কবিতায় প্রকাশ করা হয়েছে ব্যক্তির বিলোড়িত চিত্তের মুগ্ধতা এবং অচরিতার্থতা। কবিতা ব্যক্তির রক্তক্ষরণের ভাষিক রূপ হলেও সমাজস্থ মানুষের আচরণ ও চিন্তাও বাদ যায় না। ফলে কবি যখন কবিতা লিখতে বসেন, তখন কেবল নিজের চিন্তা ও স্বপ্নকেই গুরুত্ববহ করে তোলেন না, সঙ্গে সমাজস্থ মানুষের প্রতিভূর দায়িত্বও অনেকটা পালন করেন। কবি সামাজিক দায় এড়িয়ে চলতে পারেন না বলেই, সমাজের বিভিন্ন বিষয়েও নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। সমাজের স্তর বিন্যাসে কবিহƒদয় স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাই ‘পাথর চোখ’-এ উচ্চারণÑ ‘অনন্তের আত্মার খোলসে কাকে তুমি নিয়েছ নিঙ্ড়ে/ তপ্ত-দগ্ধ বণিকস্বভাবে!’ কবি এখানে প্রশ্নশীলতার চেয়ে বিস্ময়বোধকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘ধানগীত’ কবিতায়ও কবি আত্মজিজ্ঞাসাপীড়িত এবং সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি দেখে মর্মাহত। একই ধারার কবিতা ‘পরাবৃত্ত কথন’, ‘ছাপচিত্র’, ‘সম্পর্ক’, ‘রোদ্দুর ও একখ- আকাশ’। ‘যমজ’ কবিতায় কবিচিত্তের চাঞ্চল্য এবং গোপনাকাক্সক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। তাই হয়তো তার সহজ উক্তিÑ ‘আমার রক্তের ভেতর অন্য এক রক্তের উত্তাপ!’। কী রকম সে উত্তাপ? সঙ্গমমুহূর্তের মতো নয়, নয় ভালোবাসার মতোও। মূলত অবদমিত মনের একটি বিশেষ স্তরে যে ধরনের ঘটনার ঘনঘটা জমাট বেঁধে ওঠে, সে ধরনের পূর্বাভাসের কথাই রয়েছে এখানে। কিন্তু কবি কোনওভাবেই তা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে চান না।
প্রকৃত কবি মাত্রই আশাবাদী। নৈরাশ্য এবং নৈরাজ্য কবিস্বভাবের বিরুদ্ধে। দুঃখ এবং কষ্টকে জয় করার মন্ত্রপাঠে কবি সবার আগে। ‘ছুঁড়ে দাও দুঃখবোধ’, ‘ও আমার হেমলতা’, ‘দ্বিধা’, ‘সংবিধিবদ্ধ স্বপ্নে’ ব্যক্তির নৈঃসঙ্গ, হতাশা এবং সমাজের প্রতি দায়বোধ অঙ্কিত হয়েছে। ‘শোক’, ‘এই স্রোত বয়ে যায়’, ‘আমার ঘুমে দুলে যায় চন্দ্রবান বালিকানিবাস’ একই ধারার কবিতা। এসব কবিতায় নিজের প্রতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি কবির। ফলে সমাজের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির মনোবিকারও এসব কবিতায় প্রতিফলিত। ‘সময়ের গীত’ কবিতায় স্মৃতিভারাতুর ব্যক্তি মেলে। ‘কৃষ্ণকলি, কী অদ্ভুত স্বপ্নের ভেতর’ একজন স্বপ্নচারী চোখে দেখা রূঢ় পৃথিবীর ছবি। তাই ‘কৃষ্ণকলি, কী অদ্ভুত স্বপ্নের ভেতর/আমি জেগে উঠলাম’ বলে যে কবিতার শুরু, সে কবিতার শেষ এই চরমÑ ‘কৃষ্ণকলি, স্বপ্নে/কিম্বা জাগরণে নয়, আমাদের প্রেম/ডুবে থাকবে অনুভূতির পূর্ণতায়’ পঙ্ক্তিতেই। কবিতাজুড়ে সাক্ষাৎ মেলে এক স্ববিরোধী মানুষের। যে মানুষ চিন্তা ও স্বপ্নে এবং বাস্তবে দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। কবি কেবল বিষয়বস্তুর সন্ধানে ব্যস্ত নন, সঙ্গে কিছু দৃশ্যও আঁকেন নিজের মতো করে। সে দৃশ্যের নাম রাখেন, ‘কোনও এক জীবনানন্দকে বিনীতভাবে’, ‘অবিস্তীর্ণ শ্রুতি’, ‘কালো কুসুমের ভেতর’, ‘সংক্রমিত গীত’ কিংবা ‘বাঘবন্দী’। এ পর্বের সবচেয়ে জটিল কবিতার নাম ‘বাড়িটা’। আপাতত সরল শব্দসমবায়ে রচিত কবিতাটি হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত এক দার্শনিকের আত্মক্ষরণের মূর্তপ্রতীক।
ওই যে উঠোন একা একা চলে যাচ্ছে,
তার পেছনে ফিরে যাচ্ছে রোদ্দুর।
কিন্তু সারিবদ্ধ গাছ, দরজা জানালা
কিম্বা খাটসমেত বাড়ি কোথাও যাচ্ছে না।

বাড়িটাকে মূলত একা ভাবা যায় না।
তবে বাড়িটার এপাশে আগুনমুখী,
ওপাশে কমলা সুন্দরী হাট।

অথচ বাড়িজুড়ে এখন ক্রিয়াশীল
        উপবৃত্ত এবং শূন্যতা।
পুরো কবিতায় একটি পরাবাস্তব জগতের ছবি এঁকেছেন কবি। এবং সেখানে মূলত নিজের একাকীত্বকেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
এই বইয়ের শেষ কবিতার নাম ‘কফি সপে’। একজনের অর্থমোহ অন্যজনের প্রেমিকহƒদয় এখানে মূল বিষয়। আর এই বিষয়কে ঘিরে গড়ে ওঠা স্মৃতির অলিন্দ নিয়ে শব্দের পর শব্দের সৌধ গড়ে তুলেছেন কবি। ‘ক্ষরিত চিন্তা’, ‘ শূন্যতায় ভেসে থাকে কৃষ্ণচাঁদ’, ‘আমার ঘুমে দুলে যায় চন্দ্রবান বালিকানিবাস’ কবিতায় ‘আমার ঘুমে দুলে যায় চন্দ্রবান বালিকানিবাস’, ‘সংবিধিবদ্ধ স্বপ্নে’ কবিতায় ‘স্বমেহনে জেগে থাকে/নগ্ন এক চাঁদ’ পঙ্ক্তিগুলো পাঠ গভীরভাবে পাঠ করলে ধরা পড়েÑ ত্রিশাখ জলদাস কবিতায় চিত্রকল্প এবং উপমায় প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তার চিত্রকল্প কেবল দৃশ্যের প্রমাণ দেয় না, সঙ্গে অনুভব ও ইতিহাসও মূর্ত করে তোলে। ছন্দনির্বাচনে ত্রিশাখ জলদাসের পক্ষপাত অমিল অক্ষর বৃত্তের প্রতি। স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের প্রতি তার ঔদাসীন্যের কারণ বোঝা যায় না। তবে কোনো কোনো কবিতায় স্বরবৃত্তের চাল থাকায় বোঝা যায়, স্বরবৃত্তে তার দখল রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় ত্রিশাখ জলদাসের ‘জড়তুল্য পাথর’ এ সময়ের ব্যতিক্রমী কাব্য। পাঠকদের ভালো লাগবে বলে বিশ্বাস।


জড়তুল্য পাথর
লেখক : ত্রিশাখ জলদাস
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশক : পাঠসূত্র,
দ্বিতীয় প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৩,
মূল্য : ১০০ টাকা ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন