রাজনীতি

বাক-স্বাধীনতার প্রয়োগ-অপ-প্রয়োগ ।। মোহাম্মদ নূরুল হক



চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত। কিন্তু বাক-স্বাধীনতা স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন। সবাই সব ধরনের চিন্তা করলেও তা প্রকাশে কাউকে হতে হয় সংযমী, কাউকে বজ্রকণ্ঠ আবার কাউকে-কাউকে বিনয়ী। যে কথা সবিনয়ে বলার, তা বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হলে বক্তব্যের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। একজনের তথা-স্বাধীন বাক্যবাণে অন্যের সম্মানহানি ঘটলে তাকে বাক-স্বাধীনতা বলা যায় না। তাতে মানুষের এই মৌলিক অধিকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় মাত্র। ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গে সংবিধানের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে— (১) ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ এবং  (২)  ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট— চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার সঙ্গে বিবেকের স্বাধীনতাও যুক্ত করা হয়েছে।  অর্থাত্ ব্যক্তিমনে যা কিছু উদয় হবে, যেমন করে মন চাইবে, ঠিক তেমন করে কোনও বিষয় প্রকাশ করার নাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতার সঙ্গে সংযম, বিবেচনা ও ন্যায়বোধও সম্পৃক্ত।

চোখে দেখা দৃশ্য যা বলে, কানে শোনা কথা তার সাক্ষ্য দেয় না সব সময়। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের ‘চক্ষুকর্ণের বিবাদ’ না-মেটে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও বিষয়ে মন্তব্য না-করাই বাঞ্ছনীয়। দেখা বা শোনামাত্র কোনও বিষয়ে ‘সব বুঝে ফেলার ভানে’ সমাজে-রাষ্ট্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, বিভ্রান্ত হয় মানবসমাজ। এতে বিনষ্ট হয় সামাজিক শৃঙ্খলা, শান্তি, ভ্রাতৃভাব। কিন্তু আমাদের সমাজের দিকে তাকালে কী দেখি আমরা? দেখি রাজনীতিবিদরা পরস্পরকে কুরুচিপূর্ণ বাক্যবাণে জর্জরিত করছেন। এমনকী বিচারাধীন মামলারও ভবিষ্যদ্বাণী করছেন সরকারি দলের নেতা-এমপি-মন্ত্রীরা। আর বিরোধী দলের শীর্ষনেতারা ক্ষমতাসীনদের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে আদালতের বিরুদ্ধে করছেন বিষোদ্গার।

রাজনীতিবিদদের অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য জনগণকে অনৈতিকতার দিকে প্ররোচিত করে। অথচ তারা অবলীলায় দিয়ে যান যত সংযমহীন-লাগামহীন বক্তব্য। রাজনৈতিক মামলার আদেশ বা রায় যে নেতার বিপক্ষে যায়, তিনি ওই রায় বা আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে প্রকাশ্যে বলেন। কিন্তু কোনও আদালতের রায় প্রত্যাখ্যান করার অধিকার বা ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। তবে মামলার পরাজিত পক্ষ ঘোষিত রায়ের প্রতি অসম্মতি জানিয়ে উচ্চ আদালতে এর বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রার্থী হতে পারেন। ওই অধিকার সংবিধান-আইন প্রতিটি নাগরিককে দিয়েছে। কিন্তু আদালতে চলমান মামলার বিচারপ্রক্রিয়া বা ঘোষিত আদেশ-রায় সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করার অধিকার  কোনও রাজনীতিককে দেওয়া হয়নি।

অথচ ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রীরা যেমন বিচারাধীন মামলার ভবিষ্যদ্বাণী করতে থাকেন, তেমনি বিরোধী দলের নেতারাও এই সুযোগে আদালতের প্রতি কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য করেন। উভয়ের মন্তব্যই নৈতিকতাবহির্ভূত। যেমন— গত  রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘দৈনিক আমার দেশ’-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুুর রহমানের মুক্তি ও পত্রিকাটি খুলে  দেওয়ার দাবিতে আয়োজিত এক মানববন্ধনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘জজ কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রিম  কোর্ট— সব কোর্টই এখন মুজিব কোটের পকেটে বন্দি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এই পকেট ছিঁড়তে না পারলে কেউ ন্যায়বিচার পাবে না। বিচারকদের বিবেক জাগ্রত হবে না। বিচারকরা আইনজীবীদের শুনানি শোনেন না। কারণ তারা সে অনুযায়ী রায় লিখতে পারেন না। বরং তারা একটি ইশারার আশায় বসে থাকেন। ইশারা এলে সে অনুযায়ী রায় লিখতে হয়।’ খবরটি পরদিন দেশের শীর্ষ দৈনিকগুলো গুরুত্বসহ প্রকাশ করেছে। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের এমন মন্তব্যের ঠিক একদিন আগে শনিবার ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে অনুষ্ঠিত আইনজীবীদের সনদপ্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেছেন, ‘কোনও মামলার রায় হলে, পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়েই অনেক মহল থেকে ঢালাও মন্তব্য শুরু হয়। এভাবে ফ্রি স্টাইলে মন্তব্য করা ঠিক নয়।’ প্রধান বিচারপতি এও বলেছেন, ‘সংবিধান হচ্ছে একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে।’  অবশ্যই এর আগে ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় পড়ার আগে সূচনা বক্তব্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর  চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানও আদালতের রায় নিয়ে মনগড়া মন্তব্য করা থেকে সবাইকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় নিয়ে মনগড়া মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন। এ ধরনের মন্তব্য আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘রায়ের পর  টেলিভিশনের টক শোতে রায় সম্পর্কে বিভিন্নজনের বিভিন্ন মন্তব্য শুনি। এগুলো ঠিক না।’

আদালত সম্পর্কে শাসক দল ও বিরোধী দলের শীর্ষনেতারাই যে কেবল প্রভাববিস্তারি ও কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য করেন, তা নয়; সুশীলসমাজের অনেকেরই রয়েছে এই স্বভাব। তারাও কখনও আলোচনা সভায়, কখনও সংবাদপত্রের কলামে এমন সব মন্তব্য করেন, যা বলার জন্য তাদের রাষ্ট্র-সংবিধান-আইন— কোথাও অধিকার দেওয়া হয়নি। তারা আদালতের সহজাত ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মাঝে-মাঝে। আদালত কাকে জামিন দেবেন, কার জামিন বর্ধিত বা বাতিল করবেন, পরিস্থিতি বুঝে সংশ্লিষ্ট বিচারকই ওই সিদ্ধান্ত নেবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১(ক) ধারা মতে হাইকোর্ট এবং ৪৯৭ ধারার অনুবলে নিম্ন আদালতগুলো এ সহজাত ক্ষমতার অধিকারী। তবে আদালতের সিদ্ধান্তের ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ওই সংশ্লিষ্ট আদালতের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাতে পারেন, অথবা উচ্চ আদালতে আপিল-রিভিশন করতে পারেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে— প্রচলিত-আইন-সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার-অনুযায়ী প্রতিকার না চেয়ে মনগড়া মন্তব্য করলে বাক-স্বাধীনতার সফল প্রয়োগ হয় না। তাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় মাত্র। সমাজের সভ্যরূপ-গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে গেলে প্রতিটি নাগরিককে হতে হবে বাকসংযমী। কারণ বাক-স্বাধীনতার সফল প্রয়োগে সমাজ হয়ে উঠবে সুশৃঙ্খল, রাষ্ট্রের কাছ থেকে সহজে আদায় করা সম্ভব হবে নাগরিক-অধিকার। এর অপপ্রয়োগে সমাজে সৃষ্টি হতে পারে বিশৃঙ্খলা, নেমে আসতে পারে নৈরাশ্য-নাশকতা। যদি কখনও তেমনটা ঘটে, তাহলে তার সব দায় নিতে হবে রাজনীতিবিদ-সুশীলসমাজকেই।

প্রতিকার-প্রার্থী নাগরিকের বিচারের ভার আদালতের ওপর ন্যস্ত করেছে রাষ্ট্র, আদালতের বিচার করার এখতিয়ার জনগণকে দেয়নি। রাজনীতিকদের বক্তব্যের কারণে আদালতের ওপর জনতার আস্থায় যদি চিড় ধরে, দণ্ডবিধির ১২৪ ও ১২৪(ক) ধারা মতে ওই রাজনীতিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলাই সঙ্গত।

উল্লেখ্য, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ‘জজ কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রিম  কোর্ট— সব কোর্টই এখন মুজিব কোটের পকেটে বন্দি’ বক্তব্যটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর ওই বক্তব্যকে অবমাননাকর মনে করেছেন হাইকোর্ট। এ কারণে সোমবার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে এই নেতাকে তলব করেছেন। হাইকোর্টের ওই নির্দেশের পরও  মঙ্গলবার গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘বিচারকরা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সত্য কথা বলে যদি আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় তাতেও আমার আপত্তি নেই।’

মনে হয়, আমাদের রাজনীতিবিদদের এখন সময় হয়েছে— সভ্য জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে কথায়-আচরণে সংযমী ও চিন্তায়-রুচিতে সংস্কৃতিবান হওয়ার। সময় হয়েছে বাক-স্বাধীনতা ভোগ করার পাশাপাশি চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার বিষয়টি মনে রাখারও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন