মসৃণ শব্দ গুলো ছেড়ে কঠিন শব্দ চলে আসে। সব এ শহুরে মানুষদের আতিশয্য। বিরক্ত হয়ে একটার পর একটা শব্দ মুছে ফেলি। মনে হয়, এখন সবুজের কথা বলি।
পাহাড়ের একটা ছোট্ট গ্রাম। দু'মাস আগে যে হাসিখুশি বৃদ্ধা মা'কে দেখেছিলাম, সপ্তাহ হল সন্তান হারিয়েছেন। আজ তাঁকে নীরবে অশ্রু সিক্ত দেখছি। তাঁর অন্য ছেলে ভাই হারিয়ে পাগলামো করছে কিছুদিন। বৃদ্ধ মা আমাকে আর দাইফকে বসিয়ে নিজে পেছনে বসে আছেন। দাইফ তাঁকে কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরে বললঃ "আমি আপনার বড় ছেলে। "
বৃদ্ধা মা ভালো বাংলা বলতে পারেন না। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললেনঃ "হে। তুমিই আমার ছেলে আর ও আমার ছেলের বউ।"
তাঁদের বাগানের আনারস বিক্রী করে আজ টাকা পেয়েছেন। বৃদ্ধ বাবা কিছুক্ষণ আগেই কিছু টাকা দিয়ে রেখেছিলেন বৃদ্ধা মা'কে। বৃদ্ধা মা আমাকে পাঁচশ টাকার একটি নোট ধরিয়ে আশীর্বাদ করলেন। ছেলের বউকে টাকা দিলে ফেরত দিতে পারে না। আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। এই নোটটি আমি সারাজীবন রেখে দেব। আমার শ্বাশুড়ী নেই। মাঝে মাঝে আমার বরটির জন্য খুব মায়া হয়। আর এসব সহজ সরল পাহাড়ী লোকজন যখন ওকে নিজের সন্তানের মতন আগলে রাখে খুব ভালো লাগে। আজকে বৃদ্ধা মা দাইফকে যখন আকড়ে ধরে রাখছিলেন, নিশ্চুপে সে ব্যথা দেখে যাচ্ছিলাম। পৃথিবীতে কষ্টগুলো যখন প্রখর, ভাষা নিশ্চল।
আমাদের রেখে পাহাড়ী মা বাগানে আনারস কাঁটতে চলে গেলেন। আবেগের এমন নিয়ন্ত্রণ অবাকই করে। তাঁর অন্য ছেলেটির সাথে সবুজের কাছে যাই। ভাই হারানো এই ছেলেটি ইদানীং পাগলামো করছে বেশ। ওকে সান্তনা দেয়াটাই বেশ কঠিন। ওর সাথে সবুজ বন ঘেরা পাহাড়ে উঠে পড়ি। ওদের বাগান দেখি। জুমের ধান লাগিয়েছে। পাশে ছনের বন। একটু পর জুমঘর- জাম্বুরা গাছ। এখানে সেখানে কাঁঠাল পেকে পড়ে আছে। এখান থেকে জন্ম নেবে নতুন চারাগাছ। পাহাড়ে অনেক কিছুই এখনো প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে উঠে- কোন সার ছাড়া- যত্ন ছাড়া। জুম পেড়িয়ে ওরা নিচুতে চলে যায়- মাটিতে বৃষ্টির পানি- পিচ্ছিল। সাবধানে এগুতে এগুতে সামনে বড় বড় পাহাড় উঠে যায়। দূরে আনারসের বীজ করা হচ্ছে। এর নিচেই একটা ঝিরিপথ- ছনের বনের জন্য দেখা যাচ্ছেনা। আমরা হাঁটতে থাকি। সূর্য উপরে থাকলেও পাহাড়ের ভেতরের দিকে মশার উপদ্রব বাড়তে থাকে।
জুমের পাশে টকপাতা দেখে খুশি হই। পাহাড়ীরা খুব সুন্দর টকপাতা রান্না করে। আমার জন্য কিছু টকপাতা নেয়া হল। দুপুরে সে টকপাতাই রান্না করা হল। আর এখানের পাহাড়ী মুরগী ভাজা। খাবার শেষ হবার সাথে সাথে ঝুম বৃষ্টি। পাহাড়ীরা খুশি হয়। যত বৃষ্টির পানি পড়বে, নতুন লাগানো গাছ বেড়ে উঠবে। অনেকদিন পর টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছি - ঝমঝম ঝমঝম। উঠানে একটা বাশের মধ্য দিয়ে পানি প্লাস্টিকের জলাধারে জমা করা হচ্ছে। সেই ছোট্টকালে দাদু বাড়িতে দেখেছিলাম বৃষ্টির কিছুক্ষণ পরে টিনের চাল থেকে বৃষ্টির পানি জমাতে। সুখের স্মৃতির মতন ভালো লাগে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বৃষ্টির পানি জমা হওয়া দেখলাম। বৃষ্টির পানির শব্দে মায়া বাড়িয়ে দেয়। আমরা রাস্তায় ছাতা নিয়ে বের হয়ে যাই। ছাতাটা সরালে দাইফ বকাঝকা করে ছাতা মেলতে বাধ্য করে। রাস্তা ছেড়ে বৃষ্টিতে পাহাড়ে উঠে পড়ি। দুরন্ত বাতাসে চেপে মেঘ চলে আসে। আমরা এখন সমতল থেকে দু'হাজার ফুট উপরে। বাতাসে ছাতা উল্টে যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথায় মাথায় মেঘের ঝাপি আর আমরা দাঁড়িয়ে। কোথাও কোথাও ক্ষেতি করা হয়েছে। শসা লাগিয়েছে- পাহাড়ের একদিকের ঢালে ধানের চারা। ভুট্টো আর আনারসের চারা একসাথে বাড়ছে। তিনবছর পর এখানে ফসল উঠবে। বৃষ্টিতে দাইফ চলে যেতে চাইলে আমার ইচ্ছেয় থেকে যায়। পাহাড়ের অন্যদিকে তাকালে মায়ানমারের সীমান্ত দেখা যায়। আজ মেঘ থাকাতে সবটা সাদা হয়ে আছে। আমাদের চারপাশে - আমাদের থেকে নিচে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হয় মেঘের সাথে সাথে ঘুরে বেড়াই। পাহাড়ের এ দিকটায় আসলে দূরের উপত্যকা দেখা যায়। আজ মাটি অনেক পিচ্ছিল। উপত্যকায় হেঁটে যাবার ইচ্ছে আপাততঃ মনের মধ্যে রেখে তাকিয়ে রইলাম। নদীপথ শুনেছি ওদিকটায় যাবার পথ আছে। একদিন ঠিকই হাজির হব সে স্বর্গীয় ভূমিতে।
ভিজে মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে স্যান্ডেলে এক হাটু কাঁদা জমেছে। রাস্তায় নেমে জমে থাকা পানিতে কাঁদা পরিষ্কার করছি। আর পাহাড়ী ভাইটা চিৎকার চেচামেচী করছে। বৃষ্টিতে জমানো পানি দিয়ে কাঁদা পরিষ্কার করে দেবে। আমাদের না শুনে তাঁকে মোটেও খুশি মনে হল না। রাস্তায় যেতে যেতে জবা - বাগানবিলাস - নাম না জানা বনফুল আর অসাধারণ একটা গোলাপ ঝাড়ের ফটো তুলছিলাম। গত দু'বছর ধরে একটা পাহাড়ী ফুলের ছবি তুলতে চাইছিলাম। আজ দাইফ সে ফুল পেড়ে দিল। পাহাড়ী ভাইটা আমি কেন এত ফটো তুলি সেটা নিয়ে প্রশ্ন করে। বললাম সে বুড়ো হলে তাঁর নাতি নাতনীদের দেখাব। আমার কথা শুনে সে ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে থাকে।
ওদের কাছ থেকে বিদেয় জিনিসটা আহামরি কিছু নয়- সাধারণ খুব মিষ্টি একটা স্মৃতি সংগ্রহ করা। মনে হয়, এ পৃথিবী থেকে যখন বিদেয় নেবার সময় হবে, এসব সুন্দর মুহূর্তগুলো সঙ্গী করে নেব। আজ পাহাড়ী মা'য়ের অনাড়ম্বর কষ্টটা নিয়ে ফিরছি। ফিরতি পথে পাহাড়ী জলপ্রপাতের কাছে দাঁড়ালাম একটু। জল পড়ার শব্দ শুনছি। স্মৃতিতে এশব্দটুকুন কুড়িয়ে বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসে। গভীর আরামে ঘুম চলে আসে। ওর কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিতে আমায় শক্ত করে ধরে। মাটির সুবাসের সাথে ওর বুকের সুবাস এক হয়ে অকৃত্রিম হয়ে ওঠে। শহরের কোলাহল থেকে সুখগুলো দূরে সরিয়ে রাখে। আমি সবুজ হয়ে উঠি।