সোমবার, ৩০ জুন, ২০১৪

আমি সবুজ হয়ে উঠি ।। সৈয়দা আমিনা ফারহিন




মসৃণ শব্দ গুলো ছেড়ে কঠিন শব্দ চলে আসে। সব এ শহুরে মানুষদের আতিশয্য। বিরক্ত হয়ে একটার পর একটা শব্দ মুছে ফেলি। মনে হয়, এখন সবুজের কথা বলি।

পাহাড়ের একটা ছোট্ট গ্রাম। দু'মাস আগে যে হাসিখুশি বৃদ্ধা মা'কে দেখেছিলাম, সপ্তাহ হল সন্তান হারিয়েছেন।  আজ তাঁকে নীরবে অশ্রু সিক্ত দেখছি। তাঁর অন্য ছেলে ভাই হারিয়ে পাগলামো করছে কিছুদিন। বৃদ্ধ মা আমাকে আর দাইফকে বসিয়ে নিজে পেছনে বসে আছেন। দাইফ তাঁকে কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরে বললঃ "আমি আপনার বড় ছেলে। "

বৃদ্ধা মা ভালো বাংলা বলতে পারেন না। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললেনঃ "হে। তুমিই আমার ছেলে আর ও আমার ছেলের বউ।"

তাঁদের বাগানের আনারস বিক্রী করে আজ টাকা পেয়েছেন। বৃদ্ধ বাবা কিছুক্ষণ আগেই কিছু টাকা দিয়ে রেখেছিলেন বৃদ্ধা মা'কে। বৃদ্ধা মা আমাকে পাঁচশ টাকার একটি নোট ধরিয়ে আশীর্বাদ করলেন। ছেলের বউকে টাকা দিলে ফেরত দিতে পারে না। আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। এই নোটটি আমি সারাজীবন রেখে দেব। আমার শ্বাশুড়ী নেই। মাঝে মাঝে আমার বরটির জন্য খুব মায়া হয়। আর এসব সহজ সরল পাহাড়ী লোকজন যখন ওকে নিজের সন্তানের মতন আগলে রাখে খুব ভালো লাগে। আজকে বৃদ্ধা মা দাইফকে যখন আকড়ে ধরে রাখছিলেন, নিশ্চুপে সে ব্যথা দেখে যাচ্ছিলাম। পৃথিবীতে কষ্টগুলো যখন প্রখর, ভাষা নিশ্চল।

আমাদের রেখে পাহাড়ী মা বাগানে আনারস কাঁটতে চলে গেলেন। আবেগের এমন নিয়ন্ত্রণ অবাকই করে। তাঁর অন্য ছেলেটির সাথে সবুজের কাছে যাই। ভাই হারানো এই ছেলেটি ইদানীং পাগলামো করছে বেশ। ওকে সান্তনা দেয়াটাই বেশ কঠিন। ওর সাথে সবুজ বন ঘেরা পাহাড়ে উঠে পড়ি। ওদের বাগান দেখি। জুমের ধান লাগিয়েছে। পাশে ছনের বন। একটু পর জুমঘর- জাম্বুরা গাছ। এখানে সেখানে কাঁঠাল পেকে পড়ে আছে। এখান থেকে জন্ম নেবে নতুন চারাগাছ। পাহাড়ে অনেক কিছুই এখনো প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে উঠে- কোন সার ছাড়া- যত্ন ছাড়া। জুম পেড়িয়ে ওরা নিচুতে চলে যায়- মাটিতে বৃষ্টির পানি- পিচ্ছিল। সাবধানে এগুতে এগুতে সামনে বড় বড় পাহাড় উঠে যায়। দূরে আনারসের বীজ করা হচ্ছে। এর নিচেই একটা ঝিরিপথ- ছনের বনের জন্য দেখা যাচ্ছেনা। আমরা হাঁটতে থাকি। সূর্য উপরে থাকলেও পাহাড়ের ভেতরের দিকে মশার উপদ্রব বাড়তে থাকে।

জুমের পাশে টকপাতা দেখে খুশি হই। পাহাড়ীরা খুব সুন্দর টকপাতা রান্না করে। আমার জন্য কিছু টকপাতা নেয়া হল। দুপুরে সে টকপাতাই রান্না করা হল। আর এখানের পাহাড়ী মুরগী ভাজা। খাবার শেষ হবার সাথে সাথে ঝুম বৃষ্টি। পাহাড়ীরা খুশি হয়। যত বৃষ্টির পানি পড়বে, নতুন লাগানো গাছ বেড়ে উঠবে। অনেকদিন পর টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছি - ঝমঝম ঝমঝম। উঠানে একটা বাশের মধ্য দিয়ে পানি প্লাস্টিকের জলাধারে জমা করা হচ্ছে। সেই ছোট্টকালে দাদু বাড়িতে দেখেছিলাম বৃষ্টির কিছুক্ষণ পরে টিনের চাল থেকে বৃষ্টির পানি জমাতে। সুখের স্মৃতির মতন ভালো লাগে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বৃষ্টির পানি জমা হওয়া দেখলাম। বৃষ্টির পানির শব্দে মায়া বাড়িয়ে দেয়। আমরা রাস্তায় ছাতা নিয়ে বের হয়ে যাই। ছাতাটা সরালে দাইফ বকাঝকা করে ছাতা মেলতে বাধ্য করে। রাস্তা ছেড়ে বৃষ্টিতে পাহাড়ে উঠে পড়ি। দুরন্ত বাতাসে চেপে মেঘ চলে আসে। আমরা এখন সমতল থেকে দু'হাজার ফুট উপরে। বাতাসে ছাতা উল্টে যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথায় মাথায় মেঘের ঝাপি আর আমরা দাঁড়িয়ে। কোথাও কোথাও ক্ষেতি করা হয়েছে। শসা লাগিয়েছে- পাহাড়ের একদিকের ঢালে ধানের চারা। ভুট্টো আর আনারসের চারা একসাথে বাড়ছে। তিনবছর পর এখানে ফসল উঠবে। বৃষ্টিতে দাইফ চলে যেতে চাইলে আমার ইচ্ছেয় থেকে যায়। পাহাড়ের অন্যদিকে তাকালে মায়ানমারের সীমান্ত দেখা যায়।  আজ মেঘ থাকাতে সবটা সাদা হয়ে আছে। আমাদের চারপাশে - আমাদের থেকে নিচে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হয় মেঘের সাথে সাথে ঘুরে বেড়াই। পাহাড়ের এ দিকটায় আসলে দূরের উপত্যকা দেখা যায়। আজ মাটি অনেক পিচ্ছিল। উপত্যকায় হেঁটে যাবার ইচ্ছে আপাততঃ মনের মধ্যে রেখে তাকিয়ে রইলাম। নদীপথ শুনেছি ওদিকটায় যাবার পথ আছে। একদিন ঠিকই হাজির হব সে স্বর্গীয় ভূমিতে।

ভিজে মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে স্যান্ডেলে এক হাটু কাঁদা জমেছে। রাস্তায় নেমে জমে থাকা পানিতে কাঁদা পরিষ্কার করছি। আর পাহাড়ী ভাইটা চিৎকার চেচামেচী করছে। বৃষ্টিতে জমানো পানি দিয়ে কাঁদা পরিষ্কার করে দেবে। আমাদের না শুনে তাঁকে মোটেও খুশি মনে হল না।  রাস্তায়  যেতে যেতে জবা - বাগানবিলাস - নাম না জানা বনফুল আর অসাধারণ একটা গোলাপ ঝাড়ের ফটো তুলছিলাম। গত দু'বছর ধরে একটা পাহাড়ী ফুলের ছবি তুলতে চাইছিলাম। আজ দাইফ সে ফুল পেড়ে দিল।  পাহাড়ী ভাইটা আমি কেন এত ফটো তুলি সেটা নিয়ে প্রশ্ন করে। বললাম সে বুড়ো হলে তাঁর নাতি নাতনীদের দেখাব। আমার কথা শুনে সে ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে থাকে।

ওদের কাছ থেকে বিদেয় জিনিসটা আহামরি কিছু নয়- সাধারণ খুব মিষ্টি একটা স্মৃতি সংগ্রহ করা। মনে হয়, এ পৃথিবী থেকে যখন বিদেয় নেবার সময় হবে, এসব সুন্দর মুহূর্তগুলো সঙ্গী করে নেব। আজ পাহাড়ী মা'য়ের অনাড়ম্বর কষ্টটা নিয়ে ফিরছি।  ফিরতি পথে পাহাড়ী জলপ্রপাতের কাছে দাঁড়ালাম একটু। জল পড়ার শব্দ শুনছি।  স্মৃতিতে এশব্দটুকুন কুড়িয়ে বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসে। গভীর আরামে ঘুম চলে আসে। ওর কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিতে আমায় শক্ত করে ধরে। মাটির সুবাসের সাথে ওর বুকের সুবাস এক হয়ে অকৃত্রিম হয়ে ওঠে।  শহরের কোলাহল থেকে সুখগুলো দূরে সরিয়ে রাখে। আমি সবুজ হয়ে উঠি।

রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

হে জীবনানন্দ আপনাকে মিস করি খুব । । হাসসান আতিক

Hassan Atik
..............................
প্রচণ্ড গরমে ভেজা গামছার মতো বাতাসি-রাত
খুব ভালো করে মন মুছে দিলে
আর শিরিষের ডালে ঘুম দেখে শালিকের
হে জীবনানন্দ, আপনাকে মিস করি খুব।

ঘড়ির কাঁটা, অফিসের গলি, প্রেমিকার কোলাহল
সব থেমে গেলে
আপনার চোখ নিয়ে বসি
মেডিকেল পড়ুয়ার মতো কেটেকুটে দেখি
চোখ নয়, জমে থাকা অভিমানী মার্বেল
টলমলে ধানসিঁড়ি নদী।
এছাড়া ব্যাচেলর জীবনে ভুনাডিম মেখে
যখনই মুখে নলা তুলি
আপনাকে মিস করি খুব
আর বকা দেই লাবণ্য দাশকে
যার ভুনাডিমে মিশে ছিল
অন্য কারো প্রেম, ভিন্ন কাতরতা।

শনিবার, ২৮ জুন, ২০১৪

শাহানা সিরাজী ।। অনুভব -১৩


চোখের কোণে কখন আটলান্টিক মহাসাগর জেগে উঠেছে
বোঝার আগেই দেখি নায়াগ্রার জলপ্রপাত ভিড় করছে
বললাম, সরো , মন ভেজা তে দাও চোখ নয়
কিন্তু চোখের জানালা ভেঙে এমন স্রোত এলো
মন যে কোথায় হারাল আর খুঁজেই পেলাম না ...

ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের মতো এপায়ে ওপায়ে
নিবিড়তম পরিচর্যায় অপেক্ষা করে কাপটি তারই
রঙ বেরঙের কুটুম সুতোয় বাঁধা খেয়ালি বৃষ্টি
আবার পথ খোঁজে নাহ এখানে পাহাড়- নদীর সখ্যতা নেই
বিষণ্ণ রোদ্দুরে দুপুরের সিঁড়ি বেয়ে যেতে হবে অন্য কোথা!
ওই কীতপতঙ্গের বুক তো তোমারই ছিল!
এখন খাঁখাঁ বিরানভুমি বরষায় ডোবা আকাশ
সাঁতরে ফিরে কদম ভেজা শরীরের খোঁজে!
মনাড়ালে নৈশব্দতা আঁধারের রূপ খোঁজে
আমি দেখি শ্রাবনের ঢল ভাসায় আবার বাঁচায় !

মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০১৪

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তি ।। মোহাম্মদ নূরুল হক

 

 

[ আজ ২৫ জুন। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের  মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে চিন্তাসূত্রের নিবেদন]

অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, মনীষা, অধ্যয়ন ও কল্পনার মিথস্ক্রিয়ায় সৃজিত হয় শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। মনের বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃজনের শ্রেষ্ঠ সুযোগ কিন্তু শ্রেষ্ঠষ্ট সৃষ্টির পূর্বশর্ত শৃঙ্খলা। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসারে, মহাবিশ্বে গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টির পেছনে নক্ষত্রের বিশৃঙ্খলাই দায়ী। কোনো সুচিন্তিত প্রপক্রিয়ার ফলে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ও সংকোচন ঘটে না। সৃষ্টিশীলতার যেকোনো প্রপঞ্চের ক্ষেত্রেও ওই সূত্র আংশিক সত্য। কবি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-ভিন্ন স্বকপোলকল্পিত বিষয়কে সব সময় কবিতা করে তুলতে পারেন না। যিনি পারেন তিনি হৃদয়বৃত্তির কাছে যেমন সৎ নন, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। যে কবির অভিজ্ঞার ভাণ্ডার বিচিত্রমুখী, অনেকান্ত ঘটনার যিনি গভীর পর্যবেক্ষক, তাঁর পক্ষে কেবল স্বকপোলকল্পিত সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব নয়। পাঠ ও যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতা যাঁকে প্রাজ্ঞ করে তুলেছে, কল্পনা যাঁকে করেছে কবি, তাঁর কবিতায় বুদ্ধির দীপ্তি এবং মনীষার ছাপ থাকবেই। ব্যক্তি তাঁর অভিজ্ঞার বাইরের গিয়ে কেবল কল্পনায় ভর করে প্রকাশ করতে পারে না। অত্যল্প পাঠের ওপর নির্ভর করে কবি কল্পনা-প্রবণ হয়ে উঠতে পারেন কিন্তু বিপুল পঠন-পাঠনে যিনি নিজেকে ঋদ্ধ করে তুলেছেন, তাঁর পক্ষে যুক্তিহীন কল্পনার স্রোতে ভেসে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁকে হতে হয় বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ক। একই সঙ্গে ইতিহাস-ভূগোল-রাজনীতি-অর্থনীতি-ধর্ম ও সমাজ সচেতনও। আধুনিক যুগের জটিল পরিস্থিতির ভেতর বসবাস করে সময়ের জটিল আবর্তন শনাক্ত করাও তাঁর দায়।

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিকদের একজন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর কবিতায় আবেগের চেয়ে প্রজ্ঞা, কল্পনার চেয়ে অভিজ্ঞতা এবং ভাবালুতার চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় বহুল পরিমাণে বিধৃত। ফলে তাঁর কবিতা সহজবোধ্য হয়ে ওঠেনি। এর কারণ কবিতা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যানস্থ হওয়া এবং কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও ভাবনা প্রকাশের বাহন করে তোলা। এ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘কাব্য সংগ্রহ’র ভূমিকায় লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু, ‘সুধীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, তাঁর স্বভাবেরই প্রণোদনায়, কিন্তু তাঁর সামনে একটি প্রাথমিক বিঘ্ন ছিলো বলে, এবং অন্য অনেক কবির তুলনায় যৌবনেই তাঁর আত্মচেতনা অধিক জাগ্রত ছিলো বলে, তিনি প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন__ যা আমার উপলব্ধি করতে অন্তত কুড়ি বছরের সাহিত্যচর্চার প্রয়োজন হয়েছিলো__ যে কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার, ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ। তাঁর প্রবৃত্তি তাঁকে চালিত করলে কবিতার পথে__ সে-পর্যন্ত নিজের উপর তাঁর হাত ছিলো না, কিন্তু তারপরেই বুদ্ধি বললে, ‘‘পরিশ্রমী হও।’’ এবং বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য করে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে তিনি অগ্রসর হলেন, অতি সুচিন্তিতভাবে, গভীরতম শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে।’ শিক্ষা  ও রুচিবোধ যাঁকে মার্জিত ও আবেগের সংহতি দিয়েছে, তাঁর পক্ষে প্রগলভতায় ভেসে যাওয়া দুরূহ। সুধীন দত্তের কবিতায় এমন এক মার্জিত রুচির প্রলেপ ছড়ানো যাকে দুর্বোধ্য বলে দূরে ঠেলে দেওয়া যায় না, সসম্ভ্রমে প্রণতি জানাতে হয়। এ কথা সত্য__ তাঁর কবিতার সঙ্গে সাধারণ পাঠকের প্রীতিপূর্ণ কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না; যা গড়ে ওঠে দীক্ষিত পাঠকের ক্ষেত্রে।

প্রবুদ্ধি ও হৃদয়াকুতি__ এ দুয়ের মিথস্ক্রিয়ায় যে কবিতার সৃষ্টি, সে কবিতা পাঠকের মনকে সহজে আকৃষ্ট করে না কিন্তু চিন্তা জগতে সসুক্ষ্ম অভিঘাত সৃষ্টি করে। তাঁর কবিতা বিশেষভাবে পূর্বকল্পিত সৃষ্টি; কোনোভাবেই আকস্মিক ঘটনা কিংবা তাৎক্ষণিক অনুভূতির তরল প্রকাশ নয়। ‘কবিতার নির্মাণ : সুধীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে অশ্রুকুমার শিকদার উল্লেখ করেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের কবিতার গঠন উদ্ভিদের অচিন্তিতপূর্ব নিয়মে সম্পাদিত হয় না। তার বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধি স্থাপত্যের মতো পূর্বপরিকল্পিত। বাস্তুশিল্পী যেমন ব্লুপ্রিন্ট বা নকশা তৈরি করে তারপর সৌধনির্মাণে হাত দেন, তেমনি এই কবির প্রতিটি কবিতার পিছনে আমরা এক পূর্বকল্পনা বা নকশার অস্তিত্ব অনুভব করি। ইটের মতো শব্দ সাজিয়ে সাজিয়ে গড়ে ওঠে তাঁর কবিতার এক একটি স্তবক। ন্যায়ের পরম্পরায় সেই স্তবকগুলি সাজিয়ে নির্মিত হয় তাঁর এক একটি কবিতা। কবিতাগুলি যেন সঙ্গীত বেদনায় মুখর এক একটি কক্ষ। অনেকগুলি কবিতা নিয়ে এক-একটি কাব্যসংকলনÑযেন এক-একটি মহাল। সেই সব মহাল নিয়ে এই মহিমাময় কাব্যের সৌধ।’ অশ্রুকুমার সিকদারের এই মূল্যায়ন যথার্থ; কিন্তু ইটের মতো শব্দ সাজিয়ে নির্মাণের যে অভিমত, তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ এ কথা মেনে নিলে সুধীন্দ্রনাথকে কবিতা বিনির্মাণকলার একজন কৌশলী বলেই মনে হয় এবং প্রকৃত কবির যে বৈশিষ্ট্য ও অভিধা, তা থেকে বঞ্চিত করা হয়।

সুধীন দত্ত কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ে প্রজ্ঞার স্মারক করে তুলেছেন। চিন্তাশূন্য কল্পনাবিলাসিতার বিপরীতে অবস্থা নিয়েছে তাঁর কবিতা। সঙ্গত কারণে অপ্রস্তুত পাঠকের পক্ষে তাঁর কবিতার রস আস্বাদন অনায়াস-সাধ্য নয়। একথা অস্বীকার যায় না__ তাঁর কবিতায় তৎসম শব্দের বাহুল্য রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে মিথ ও পাণ্ডিত্যের সংশ্লেষ। এর অন্য কারণও রয়েছে। সুধীন দত্ত যুক্তিনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞান-মনস্ক। প্রমাণ ছাড়া অন্তঃসারশূন্য বিষয়ের প্রতি কোনো মোহ ছিল না। বস্তুসত্যের ওপর কল্পনার প্রলেপে কবিতা সৃষ্টিই একমাত্র লক্ষ্য ছিল। কেবল ভাবের জগতে বিচরণ করে, যুক্তিহীন স্বপ্নচারিতায় প্রতিভার অপচয় সময়ের অপব্যবহারে ছিলেন অনীহ। যা কিছু দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন তাকেই কবিতায় রূপান্তর করেছেন। তাঁর কবিতার বিষয়-আশয় হয়ে উঠেছে খুব তুচ্ছ বিষয়ও, কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গির আভিজাত্যে বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগেনি। ‘উটপাখি’, ‘কুক্কুট’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন তেমনি লিখেছেন দর্শন, সমাজ, রাষ্ট্র, অধ্যাত্ম-সংকট নিয়েও। কিন্তু এসব কবিতাকে কোনোভাবেই বিষয়ের অনুগত করে তোলেননি। তাঁর কবিতা যেমন দর্শনে আক্রান্ত নয়, তেমনি ধর্মীয় বাণী প্রচারের অনুষঙ্গও নয়। বরং কোনো কোনো সমালোচক তাঁর কবিতায় নিখিল নাস্তির সন্ধানও পেয়েছেন। এ সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসানের অভিমত__ ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : শব্দের অনুষঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের জড়বাদী দুটি জিনিস তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। একটি হচ্ছে তিনি যে নাস্তিক একথা বারবার বলতে চান। এই বলাটা তো কবিতা হয় না। কিন্তু এই বলাটাকেই তিনি রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন কবিতায়। ‘‘হয়তো ইশ্বর নেই : স্বৈর সৃষ্টি আজন্ম অনাথ’’___বলে তিনি একটা পরিতোষ লাভের চেষ্টা করেছেন। সৃষ্টি সত্যিই অনাথ কি না এগুলো নিয়ে দার্শনিকরা চিন্তাভাবনা করুন, কিন্তু কবি এগুলো নিয়ে কথা বলবেন__ এটা ভাবতে আমাদের অসুবিধা লাগে এবং এটা একটা বক্তব্য মাত্র। এ বক্তব্যের নানা রকম প্রসার ঘটিয়েছেন তিনি কবিতায়।’ সুধীন্দ্রনাথের ঈশচিন্তা___ নিয়ে সৈয়দ আলী আহসান অস্বস্তি বোধ করেছেন। কারণ সুধীন দত্ত যেমন নিখিল নাস্তির জয়গান গেয়েছেন, তেমনি সৈয়দ আলী আহসান আস্তিক্যকে করেছেন শিরোধার্য। ফলে বিশ্বাসের দিক থেকে পরস্পর বিপরীত মেরুর ছিলেন বলেই সুধীনদত্তের দার্শনিক অভিজ্ঞা সৈয়দ আলী আহসান নির্মোহ দৃষ্টিতে গ্রহণ করতে অনীহ ছিলেন। সুধীনদত্তের শিল্প -বা কাব্য সিদ্ধি নিয়ে সৈয়দ আলী আহসান নিঃসংশয়; কিন্তু আদর্শিক বৈপরীত্যের কারণে তাঁর প্রতি তিনি সুপ্রসন্ন হতে পারেননি। একই রকম অপ্রসন্ন ছিলেন দীপ্তি ত্রিপাঠীও। ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’ শীর্ষক গবেষণা-প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের কাব্য যেন ভ্রষ্ট আদমের আর্তনাদ। তিনি স্বর্গচ্যুত কিন্তু মর্ত্যে অবিশ্বাসী। তাঁর মধ্যে বিজ্ঞতা আছে কিন্তু শান্তি নেই, যুক্তি আছে কিন্তু মুক্তি নেই। তাঁর কাব্য কোনো আশ্বাসের আশ্রয়ে আমাদের পৌঁছে দেয় না। সুধীন্দ্রনাথের নঞর্থক ও পরে ক্ষণবাদী জীবনদর্শন আমাদের ধর্মপুষ্ট বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব সংযোজন। এমনকী আধুনিক কাব্যের অনেকগুলি লক্ষণ যদিচ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান তথাপি এই দর্শন-বৈশিষ্ট্যে তিনি আধুনিক কবিদের মধ্যেও স্বতন্ত্র।

সুধীন্দ্রনাথের কাব্যপাঠকালে মনে হয় কবি যেন এক নিঃসঙ্গ চূড়ায় দাঁড়িয়ে আধুনিক জীবনের নিঃসীম শূন্যতা নৈরাশ্যভারাতুর নয়নে অবলোকন করছেন।’ আধুনিক যুগে মানুষের প্রতি মানুষ প্রশ্নহীন আস্থা স্থাপন করতে পারে না বিচিত্র কারণে। জীবন-যাপনে যেখানে অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ বিগ্রহে যেখানে মুহূর্তে লাখ -লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, সামান্য কারণে যেখানে মানুষ খুন হয়, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রের নাগরিকদের পেছনে গুপ্তচর লেলিয়ে দিয়ে রাখে, আণনবিক বোমার আঘাতে এক-একটি ভূ-খ- মুহূর্তে ধধুলিস্যাৎ হয়ে যায়, যেখানে ঐশীশক্তির কোনো নিদর্শন দেখা যায় না, সেখানে যুক্তিনিষ্ঠ, বিজ্ঞান-মনস্ক কবি সংশয়ী হবেন; এটাই স্বাভাবিক। সুধীন দত্ত এই স্বভাবের জাতক। ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যের ‘মৈমন্তী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়’। এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে হতাশা আর ভালোবাসার জন্য কাকুতি এবং সবশেষে না-পাওয়া বেদনা। তাঁর মনে হয়েছে, চরাচরে চিরায়ত বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই, নেই কোনো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কোনো শক্তিও। ফলে তিনি আর ‘শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে’ সময় ব্যয় করবেন না। এই উপলব্ধি নিছক ধর্মবিদ্বেষ বা আস্থাহীনতা থেকে উদ্ভূত নয়, নয় নাস্তিক্যের চেতনা থেকেও। তাহলে অন্যত্র (চপলা কবিতায়) উচ্চারণ করতেন না, ‘জনমে জনমে, মরণে মরণে, / মনে হয় যেন তোমারে চিনি।’ নিখিল নাস্তিক বহুজনম বা পুনর্জšে§ বিশ্বাস করবেন কোন ভিতের ওপর নির্ভর করে?

সমাজ-জীবনে সত্য-মিথ্যার অস্তিত্ব আছে; কিন্তু এই সত্য-মিথ্যা আপেক্ষিক, না শাশ্বত? যদি যুক্তিবোধ এবং বাস্তবতার নিরিখে সত্য-মিথ্যা নিয়ে ভাবা যায়, তাহলে সত্য এবং মিথ্যা দুটি আপেক্ষিক পদ মাত্র; দুটিই সাপেক্ষ পদ। একটির অভাবে অন্যটির অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। মানবজীবনে এ ধরনের তর্কের সামাজিক কি আর্থিক, কোনো মূল্য নেই। কিন্তু শিল্পের প্রশ্নে__ বিশেষত কবিতায় সত্য-মিথ্যার সম্পস্পর্ক সুনিবিড়। এ সম্পর্কে বিনয় ঘোষ ‘সত্য ও বাস্তব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সত্য পরিবর্তনশীল ক্রমবির্ধমান ও সমাজাশ্রয়ী।’ অর্থাৎ সত্যের কোনো চিরন্তন রূপ নেই। কবিতায় এ সত্য বা বাস্তবতার প্রসঙ্গ আরও সূসুক্ষ্মভাবে এসেছে। বাস্তবতা হলো একটি বস্তুকে মানুষস কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে? মানুষের উপলব্ধি এবং বোধের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে কোনো একটি বস্তুর গুণাগুণ বিচারের দৃষ্টিভঙ্গিও। কবিতা মানুষের উপলব্ধিজাত বিষয়গুলোর একটি। তাই কবিতার সত্য এবং বস্তুসত্য কোনোকালেই এক ছিল না, এখনো নয়।

সময়, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির আন্তঃসম্পর্কের ধরন সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথের ছিল গভীর পর্যবেক্ষণ। জীবন ও সংসার সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি স্পষ্ট, কিন্তু ওই অভিজ্ঞান প্রকাশে সংশয়ী। ফলে তাঁর চেতনার উপরিতল সম্পর্কে ‘নাস্তিপ্রবণ’ বলে শনাক্ত করা হয়। মহাশূন্যের দিকে তাকালে তাঁর মনে হয় ‘নির্বাক নীল, নির্মম মহাকাশ’। কল্পনাপ্রবণ কবির কাছে নীল যেখানে রোম্যান্টিকতার প্রতীক, বুদ্ধিবাদী কবির কাছে সেখানে কেবল নির্মম। অথচ ‘নাম’ কবিতায় শুরুতে তাঁকে অস্থির ও অধীর মনে হয়। কাক্সিক্ষতকে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার জন্য কালক্ষেপণ করার ৈ ধর্য নেই তাঁর। কাক্সিক্ষতের অভাবে ‘অসহ্য অধুনা’ এবং ‘ভবিষ্যৎত বন্ধ অন্ধকার’, ফলে তার ‘কাম্য শুধু স্থবির মরণ’। চাওয়ার সঙ্গে সব সময় পাওয়ার সমন্বয় ঘটে না। হয়তো তাই, এই অস্থিরতা। হয়তো এ কারণেই এই উচ্চারণÑ‘বজ্রাহত অশোকেরে অলজ্জায় করেছি বিনত / ক্ষণিক পুষ্পের লোভে।’ কিন্তু এ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির নিকট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।

বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞার অনুশাসনও যে কবিতা হয়ে উঠতে পারে, এর প্রমাণ সুধীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন অনেক কবিতায়। এর মধ্যে ‘শাশ্বতী’ও একটি। কবিতাটি তিন পর্বের ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্তে রচিত। প্রথম দুই পর্ব পূর্ণমাত্রার শেষ পর্বের মাত্রা সংখ্যা দুই। মাত্রাবৃত্তের যে সাংগীতিক লয়, সে লয় এখানে পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি। আবার অক্ষরবৃত্তের ধীর, গম্ভীর লয়ও অনুপস্থিত। অর্থাৎ সংগীতময়তার ভেতর, ধ্বনি-সংহতি, গাম্ভীর্যের ভেতর সুললিত সুর__ এ সবের সম্মিলনে সৃষ্ট এ কবিতা। ভাব ও বিষয়ের যুগলচিত্র প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে এভাবে__

সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া

মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;

অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া

খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।

একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে

ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;

একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণীজুড়ে,

থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;

আগেই বলেছি__ সুধীন্দ্রনাথকে কোনো কোনো সমালোচক নৈরাশ্যবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এই নৈরাশ্যবাদী পরিচয় ছাপিয়ে ভিন্ন পরিচয় আবিষ্কারের চেষ্টা তেমন কারও ভেতর নেই। অথচ তাঁর কবিতাগুলোয় বেশির ভাগই প্রত্যাশা ও সামান্য সংশয়বাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এই পঙ্ক্তিগুলো আশাবাদের সাক্ষ্য দেবে__ ‘বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা / রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে।’ একটি বিশেষ কালসীমার পর অন্য ধরনের অভিজ্ঞতা মানুষের জন্য অপেক্ষা করে। এরপরেই সংকটকাল শেষও হতে পারে। ফলে জীবনের কোনো কোনো স্মৃতি মানুষ আজীবন ধরে রাখে। কখনোই সে স্মৃতি ভুলতে পারে না।

তাঁর চিত্রকল্প ও উপমা ভাবাবেগ নয় বুদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে। ফলে কেবল অনুভবগ্রাহ্য অলঙ্কারেই তিনি তৃপ্ত নন, দৃশ্যগ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রকল্প-উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রমাণ রেখেছেন কবিতায়। ভাবাবেগের চেয়ে বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞা মানবজীবনে ভূমিকা রাখে বেশি। কেবল তীব্র ভাবাবেগ ও হৃদয়াকুতির কাছে সমর্পিত কবির পক্ষে তারল্যপূর্ণ কবিতা চর্চা সম্ভব, মনীষার প্রতি আস্থা রাখা অসম্ভব।

সুধীন্দ্রনাথের মানসপ্রকৃতি শেষ পর্যন্ত সংশয়বাদী। সংশয়-ই তাঁর মনীষার ভূষণ। যেন কোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে আস্থা রাখতে পারেন না কবি, যেন কোনো উপমা-ই তাঁর মনোঃপূতঃ হয় না, কেবলই বারবার রুচির পরিবর্তন ঘটান, রূপান্তর চান চিন্তারও। ‘মহাসত্য’, ‘মার্জনা’, ‘সংশয়’, ‘প্রশ্ন’, ‘দ্বন্দ্ব’, ‘যযাতি’, ‘উপস্থাপন’, ‘মৃত্যু’, ‘সৃষ্টিরহস্য’ কবিতাগুলো মূলত প্রশ্ন, বিস্ময়, সন্দেহ ও সংশয়কে আশ্রয় করে রচিত। মানবমনের স্বতঃসিদ্ধ স্বভাব বস্তু বিশেষকে পরীক্ষা করে নেওয়া, এক বস্তুকে অন্য বস্তুর সঙ্গে তুলনা-প্রতিতুলনা করে বিচার করা। এমন বিচার-প্রক্রিয়ায় সাফল্যও আসে। কিন্তু কেউ কেউ আবেগ ও চিন্তার বিশেষ মুহূর্তে এত বেশি উদ্বেল কিংবা অস্থির কিংবা নিরপেক্ষ হয়ে ওঠেন, যে বিশেষ কোনো বস্তুকে একাধিক বস্তুর সঙ্গে তুলনা করেও সন্তুষ্ট হতে পারেন না। কোনো ব্যাখ্যা-ই তার মনের মতো হয় না, তবু অব্যক্ত কোনো এক ভালো লাগা তাকে বস্তু বা ব্যক্তি বিশেষের প্রতি সম্মোহিত করে রাখে।

রূপসী বলে যায় না তারে ডাকা;

কুরূপা তবু নয় সে, তাও জানি;

কী মধু যেন আছে সে-মুখে মাখা;

কী বরাভয়ে উদ্ধৃত সে-পাণি।

(সংশয় : উত্তর ফাল্গুনী)

যার রূপ-গুণ সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে ব্যক্তি পৌঁছাতে পারে না, তার সম্পর্কে শেষ প্রশ্ন তার মনে-ই বেজে ওঠে__ ‘ভালো কি তবে বেসেছি তারে আমি?/ বিজ্ঞ হিয়া শিহরে তাই ভয়ে?’ প্রশ্নশীল ও সংশয়বাদীরা কোনো একটি বিশেষ বিষয়কে বিনা তর্কে মেনে নিতে পারে না। তাদের হৃদয় যতটা আবেগে ভরা, ততধিক প্রজ্ঞাপূর্ণ। ফলে নিজের স্বভাব সম্পর্কেও ‘বিজ্ঞ হিয়া শিহরে’ ওঠে ভয়ে। আদৌ শিহরে ওঠে কি না, সে বিষয়েও কবি নিশ্চিত নন, ফলে নিজেকেই প্রশ্ন করেন__ ‘বিজ্ঞ হিয়া শিহরে তাই ভয়ে?’ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক চিন্তাও সমানভাবে উপস্থিত। মৌলিক চিন্তক মাত্রই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধে বিশ্বাসী। পূর্ববর্তী কোনোনও চিন্তকই তার পূর্বসূরি নন; কারও চিন্তার রেশ তার প্রেরণার উৎস নয়। প্রকৃত চিন্তক মূলত একমেবাঅদ্বিতীয়ম্। চরাচরের ঘটনা ও দুর্ঘটনার ফলাফল এবং প্রপঞ্চগুলোর কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ ও প্রতিষ্ঠা করাই তার মূল কাজ। কোনোনও মৌলিক চিন্তা-ই একই সঙ্গে দুই চিন্তকের হতে পারে না। কারণ মৌলিক চিন্তকের চিন্তা অনেক সময় অনির্দেশ্য ও অনির্দিষ্ট থাকে। বিক্ষিপ্ত চিন্তাকণিকার মিথস্ক্রিয়ায় একটি মৌলিক চিন্তার বীজ প্রথমে অঙ্কুরোদগম হয়। এরপরই সে অঙ্কুর ক্রমাগত পরিচর্যায় হয়ে ওঠে একটি বিশেষ প্রপঞ্চের ভাষ্য।

সে চিন্তার সঙ্গে কল্পনার অন্বয় ঘটিয়ে সৃষ্ট কবিতাও চিন্তাশীলদের আরাধ্য। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটে চিন্তাসূত্র বৈচিত্র্যপূর্ণ। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ক্ষেত্রে কথাগুলো ষোলোআনা-ই সত্য। ‘মহাসত্য’র মূল ভাব চিরায়তকে অস্বীকার; আপেক্ষিকতার জয়গান। চিরকালীন সত্য বা শাশ্বত রূপকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে এ কবিতায়। কিন্তু তার এ ব্যঙ্গপ্রবণতা দার্শনিকতা নয়, বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে হৃদয়বৃত্তি অনেকাংশে উপেক্ষিত হয়েছে। কবিতায় অতিমাত্রায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হৃদয়বানকে পীড়া দেয়, এ কথা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : শব্দের অনুষঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, কবিতায় ‘যে মেধা ও মননের পরিচয়টা তিনি দিয়েছেন, ইতিহাসটা দিয়েছেন, সেই মেধা এবং মনন শব্দের ক্ষেত্রে শব্দতেই পর্যবসিত এবং শব্দ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর মেধাকে পূর্ণ ব্যবহার করেন। অন্য কোনো ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসর হতে আর পারলেন না।’ অধ্যাত্ম চেতনা মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা। সংকটে, সংশয়ে মানুষ মাত্রই অলৌকিক শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। চায় পরিত্রাণ, নির্ভয় ও আশ্রয়। কেউ গোপনে, কেউ প্রকাশ্যে। যে সব অঞ্চলে বা সাংস্কৃতিক বলয়ে ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলীতার সম্পর্ক সৌহার্র্দ্যপূর্ণ ওই সব অঞ্চলের শিল্পকর্মেও অধ্যাত্মচেতনা শিল্পিত মহিমায় উজ্জ্বল।

যে সব অঞ্চলে ধর্মানুষঙ্গের সঙ্গে আধুনিকতা, প্রগতিবাদিতার সম্পর্ক সাংঘর্ষিক, সে সব অঞ্চলে অধ্যাত্মচেতনা গোপনে চর্চিত হয়। প্রকাশ্যে অলৌকিকতার বিরুদ্ধে সরব শিল্পিীর শিল্পকর্মেও গোপনে চর্চিত হয় অধ্যাত্মপ্রেম। অধ্যাত্মসংকট একটি জটিল সংকট। বিজ্ঞানে প্রমাণিত নয়, এমন বিষয়ও স্বয়ং বিজ্ঞানিীরাও লালন করেন। সঙ্গত কারণে কেবল বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবোধ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর গূঢ়ার্থ অন্বেষণ করা জরুরি। মানুষের ভয়, হতাশা, নিরাপত্তাহীনতাই তাকে অধ্যাত্মসংকটের দিকে প্রণোদিত করে। ফলে মানুষ অবদমনকেও অনিবার্য নিয়তি ভাবতে শুরু করে এবং মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই সংশয়চিত্ত মানবজাতির একদিকে রয়েছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার, বস্তুনিষ্ঠা এবং যুক্তিবোধ; অন্যদিকে রয়েছে অলৌকিকতার মোহ, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা এবং অস্তিত্বের সংকট। সঙ্গত কারণে সংশয়ী চিত্ত একসময় নির্ভরতার আশ্রয় খোঁজে।

বস্তুসত্য বাঙালি সহজে মেনে নেয় না; মেনে নেওয়ার ভান করে মাত্র। বাঙালি জাতি হিসেবে মূলত ভাবুক। তাই ভাবনার জগতে যত পারে ঐশী শক্তিকে স্বাগত জানায়, কিন্তু বস্তুসত্যের নগদ ফলকেও বিচার করে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। কবিরা এই ভাবুকগোষ্ঠীর মন্ত্রণাদাতা। তাঁদের চিন্তারাজ্যে বস্তুসত্য ও কাব্যসত্য প্রায় সমান্তরাল পথ সৃষ্টি করে। সুধীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে ভাববাদী ও সংশয়বাদী। কবিতার শরীর ও আত্মাজুড়ে সংশয় ও ভাবেরই প্রচ্ছন্ন ছাপ রেখেছেন তিনি। বস্তুসত্যকে অগ্রাহ্য করেও ভাববাদে আস্থা রেখেছেন। অলীক বিষয়কে দিয়েছেন মর্যাদা; কবিতা হয়ে উঠেছে ভাবুকের প্রাণের উৎসারণ, কল্পনার দৃশ্যগ্রাহ্য ভুবন। যুক্তি ও বাস্তবতা সেখানে হয়ে উঠেছে প্রায় অপাঙ্েেক্তয়। প্রবল নিষ্ঠা, যুক্তিবোধ ও কল্পনায় সৃষ্টি হয়েছে সংশয়ের ভুবন; নিখিল নাস্তি কিংবা অকাট্য বিশ্বাস সেখানে মান্যতা পায়নি। যেখানে বিজ্ঞানমনস্ক হতে চেয়েছেন, সেখানে হয়েছেন বড়ে জোর সংশয়ী। ভাবুকের পক্ষে নিখিলনাস্তির জয়গান গাওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব নয়; মাঝেমধ্যে বিশ্বাসের জগতে আলোড়ন তুলতে পারে মাত্র। এ কারণে প্রবল ধার্মিকের সঙ্গে কবির চিন্তার তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। তাঁর কবিতায় চিন্তার স্ববিরোধ ও অধ্যাÍবোধ গোপন সুতোর মতো ইন্দ্রজাল সৃিেষ্ট করে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় বস্তুবাদী দর্শন স্পষ্ট। আধুনিকতাবাদীদের বিবেচনায় বস্তুবাদের প্রতি সমর্পিত সত্তাই আধুনিক সত্তা। কিন্তু নিটশের সে বিপুল নৈরাশ্যচেতনাও সুধীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করতে পারেনি। বাঙালি কবি যতই পশ্চিমের আধুনিকতার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করার মনোভাব দেখান, ততটা দৃঢ় হতে পারেন না। বাইরে যতই যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় তাঁর, ভেতরে ততই অধ্যাত্মচেতনা। সুধীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। ফলে তাঁর কবিতায় বিজ্ঞান-যুক্তির পাশাপাশি অধ্যাÍচেতনার সমন্বয় ঘটে সহজে। ‘মৃত্যু’, ‘প্রার্থনা’, ‘মরণতরী’, ‘দ্বন্দ্ব’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘অসময়ে আহ্বান’, ‘সান্ত¡না’, ‘প্রতিহিংসা’সহ আরও বেশ কিছু কবিতায় উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিচর্যার সাক্ষাৎ মেলে।

অধ্যাত্মসংকট বাঙালির মৌলসংকট। এ সংকট বাঙালির উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। ইচ্ছা করলেই যুক্তিবোধ, গবেষণা এবং বিজ্ঞান দিয়ে এ সংকট থেকে তার উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। অন্তত যত দিন, বাঙালিজীবনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কার্যকারণ জলবায়ু পরিবর্তনও আবহাওয়ার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যৌক্তিক কার্যকারণ সম্পর্কের ফল বলে স্বীকৃত না হয়, তত দিন তার মনে হবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ মানবজাতির পাপাচারের ফল__ শাস্তি। এ কেবল ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়, জাগতিক স্বার্থশ্লিষ্ট বিষয়েও প্রাসঙ্গিক। এ সম্পর্কে ‘উটপাখি’ উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। প্রথম চার পঙ্ক্তি স্মরণ করা যাক__

আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?

কেন মুখ গুঁজে আছ তবে মিছে ছলে?

কোথায় লুকাবে? ধূ ধূ করে মরু ভূমি;

ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।

শূন্য মরুর বুকে হতাশাগ্রস্ত জীবন স্বাভাবিক। সেখানে যেকোনো ধরনের আহ্বান তৃষ্ণার্তের জন্য মহার্ঘ্যতুল্য। কিন্তু যখন একজন তৃষ্ণার্ত আশ্রয়-ভালোবাসার আহ্বানও নীরবে উপেক্ষা করে তখন আহ্বানকারীরও আÍমর্যাদাবোধে আঘাত লাগে। তখন তারও মনে হতে পারে ‘ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে’। যে উটপাখিকে কবির মনে হয়, মরুদ্বীপের সমস্ত খবর জানা প্রাণী, তাকেই আবার স্মরণ করিয়ে দেন কবি__ ‘তুমি তো কখনও বিপদপ্রাজ্ঞ নও’। অর্থাৎ মানুষ বা প্রাণীÑ সবাই অতীতের ঘটনা পর্যালোচনা করে অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, ক্ষেত্র বিশেষ যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার কার্যকারণ সম্পর্কও আবিষ্কার করতে পারে। কিন্তু অতীত-বর্তমানের ঘটনা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চিত বার্তা কেউ দিতে পারে না; কেবল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেওয়া সম্ভব হয় তাদের পক্ষে। ফলে অতীতের সাক্ষী হয়েও কেউ কখনো সর্বজ্ঞ হতে পারে না। সঙ্গত কারণে চরাচরের নানা সম্পর্কের ধরন ও বিভেদের দায় একা কারও নয়।

আমরা জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে

আমরা দু জনে সমান অংশীদার;

অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে

আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার

তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।

অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে?

আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।

ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।

অতএব এসো আমরা সন্ধি করে

প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি:

তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে

তোমাকে, বন্ধু, আমি লোকায়তে বাঁধি।

জাতির উদ্ধারকারী হিসেবে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যক্তির প্রতিশ্রুতি হিসেবে শেষের চার পঙ্ক্তি অনন্যসাধারণ। আর ‘অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে’ একই সঙ্গে প্রশ্নশীল উপলব্ধি ও প্রবচন। পুরো কবিতায় পরার্থপরতাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। উটপাখি একটি প্রতীক মাত্র, আড়ালে সমাজ ও রাজনৈতিক বিমুখ, উদাসীন মানুষের প্রমূর্তি। তাই সতর্ক উচ্চারণ__‘ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে’।

মানুষ নিজের নিরাপত্তার জন্য নিয়ম তৈরি করে; নিজেই সে নিয়ম লঙ্ঘংঘন করে অন্যতর প্রয়োজনে। অন্যে যখন নিয়ম লঙ্ঘন করে তখন তার জন্য শাস্তি কামনা করে, কিন্তু নিজের নিয়ম লঙ্ঘনকে দেয় বৈধতা। মানবচরিত্রের এই এক ভয়াবহ দ্বৈরথ। দ্বিমুখী স্বভাব তার। অন্যকে শাস্তি দিতে সে কুণ্ঠাহীন, নিজের দোষের ক্ষেত্রে তৈরি করে অন্য বিধি। যে কাজ অন্যের বেলা গর্হিত বলে প্রচার করে, সে কাজ নিজের জন্য করে তোলে গর্বের। অন্তত এমনটাই প্রচার করে সে। সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় এ বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত।

আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রসঙ্গ ।। মোহাম্মদ নূরুল হক


[আজ ২৫ জুন। কবি-সম্পাদক আবু হাসান শাহরিয়ারের জন্মদিন। এ উপলক্ষে চিন্তাসূত্রের নিবেদন]

 


আধুনিক বাংলা কবিতা যতটা না বিষয়গত, তারও বেশি আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার। ফলে রোম্যান্টিকদের সঙ্গে আধুনিকদের প্রাকরণিক পার্থক্যও স্পষ্ট। যেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দ-সুধীন দত্তদের। এই ধারাবাহিকতা বর্তমান কালের বাংলা কবিতায়ও সমুপস্থিত। এই সময়ের প্রধান কবিদের অনেকেরই উন্মেষকাল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেবর্তী সময়। ওই সময়ের কবিতার বিষয়-আশয়ের বিপুল অংশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, ক্ষোভ, দেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক অনুষঙ্গই বেশি। তবে কেউ কেউ সমকালের স্রোতের ভেতর থেকে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছেন, নিস্পৃহতা ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির জোরে। ফলে এ ধারার কবিরা সমকাল থেকে রস গ্রহণ করেও সমকালের প্রভাবে প্রভাবিত হন না, স্বকালকে প্রভাবিত করেন। স্বকালের ওপর তাঁদের প্রভাব এমন সর্ববিস্তারিী হয় যে, কালের উত্তাপ তাঁদের পোড়াতে পারে না, স্পর্শ করে মাত্র। আবু হাসান শাহরিয়ার এই ধারারই একজন।
আধুনিক কালের কবি তাঁর উপস্থিতকালের প্রধান অসুখ শনাক্ত করেন এবং এ থেকে নিরাময়ের স্বপ্ন দেখান স্বজাতিকে। এ কারণে তাঁদের কাজে নিজের কাল তেমন গুরুত্ব পায় না। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের বিষয়-আশয় থেকে তাঁদের কবিতার রস ও রসদ সংগৃহিীত হয়। অর্থাৎ অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের রুচি এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নচারণ__ এই তিনের মিথস্ক্রিয়ায় সৃজিত হয় কবিতার অন্তরাত্ম ও অবয়ব। এ সঙ্গে শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় কবি নিজেই বলেছেন, ‘বহুকালের বহু কবির ঋণভূমে নতুন শব্দের বীজ হাতে দাঁড়ায় কবিতার নতুন সমকাল। সেই সমকালকে নিয়ে কোনো দূর ভবিষ্যতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন কবি। অস্থির সমকালে বাস করেও কবি এক ধ্যানী মহাকালের বাসিন্দা।’ পাশাপাশি ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার প্রসঙ্গও স্বীকার করেছেন।
চিন্তা ও কল্পনার সমন্বয়ে কবিতায় বুদ্ধি ও আবেগের সুষম সম্পর্ক রক্ষা করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আধুনিক কবি অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটান। নারী-পুরুষের প্রেম, প্রকৃতি, নদী, দেশপ্রেম, যুদ্ধ, ধর্ম, দর্শন ও রাজনীতি ছাড়াও মনোবিকার, ক্ষোভ, হতাশা, যৌনতা, বিশ্বায়ন, সর্বপ্রাণে প্রেম, যুদ্ধবিরোধী মনোভাব, সমকালের বিশেষ ঘটনার রেশ ইত্যাদি আধুনিক কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে। তাঁর কবিতায় বিষয় বিচিত্র, কোনো নির্দিষ্ট ছকে সীমাবদ্ধ নয়। এ প্রসঙ্গে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন__ ‘জীবনের ছবি থেকেই আমি তুলে আনি কবিতার চিত্রকল্প। জীবনের হাসি-কান্না হাহাকার থেকেই উঠে আসে আমার কবিতার ধ্বনিময়তা।’ কোনো বিশেষ নারী যেমন তাঁর আরাধ্য, তেমনি নির্বিশেষ নারীও। আবার কেবল নারীপ্রেমেই সীমাবদ্ধ নন কবি, চরাচরের অশরীরীরি প্রাণের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার স্বপ্ন দেখেন। এ কারণে কাব্য চর্চার শুরুর দিকের কবিতা ‘তুমি’েেত যেমন ‘তুমি’র পরিচয় স্পষ্ট করেন না, তেমনি পরিণতকালের কবিতা ‘বালিকাআশ্রম’-এ-ও। প্রথম দিকের কাব্যগুলোয় কবি মূলত প্রেমিক, যে প্রেম নারীর প্রতি, কিছুটা নিসর্গের প্রতিও। কিন্তু মধ্যপর্যায় থেকে শুরু করে সর্বশেষ কাব্যে তাঁর প্রেম বিবর্তিত হয়েছে নারী থেকে নিসর্গে, দেহ থেকে দেহাতীতে। কবি যেন বস্তুবাদী ধারণা থেকে ভাববাদী চৈতন্যে পরিভ্রমণ করেছেন। কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারেননি। মূলত কবি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর বিষয়ে কবিতা রচনা করেননি। তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে বহু বিষয়ের বহুরৈখিক প্রকাশের। শাহরিয়ার যেকোনো বিষয়কে কবিতা করে তুলতে জানেন। এ প্রসঙ্গে সমালোচক পবিত্র মুখোপাধ্যায় ‘চিরচলমান কবিতার এক কবি’ প্রবন্ধে লিখেছেন__ ‘স্বাভাবিক কবিত্বশক্তি নিয়ে জন্মেছেন শাহরিয়ার। যে কোনো অনুভবকে সংযমশাসিত কবিতা তুলতে পারেন, তার অনুভব এত সৎ ও গভীর যে, তার প্রকাশও স্বচ্ছ-সাবলীল এবং ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে ওঠে।’ পবিত্র মুখোপাধ্যায় শাহরিয়ারের কবিত্বশক্তির মৌলিক ও সাবলীল দিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘স্বাভাবিক কবিত্ব শক্তি’ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এই স্বাভাবিক কবিত্ব শক্তি স্বভাবকবির নয়, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ, বহুলপাঠে আত্মপ্রস্তুতিসম্পন্ন প্রাজ্ঞের। ফলে নিজের অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন, কল্পনা ও মনীষাযোগে যেকোনো বিষয়ে কবিতাসৃষ্টি তাঁর জন্য সহজ। এ প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য__ ‘শাহরিয়ার প্রেরণনার জন্য শুধু মেঘ কিংবা নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টি রাখেন না, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থমালার প্রতিও গভীর মনোনিবেশ করেন। নিজের অন্তর্দৃষ্টি, প্রচুর পাঠ, সর্বোপরি জীবন-নিঙড়ানো অভিজ্ঞতা শাহরিয়ারের কবিতাকে সমৃদ্ধ এবং অগ্রসর করে তুলেছে।’ সমকাল ও সমাজকে অনুভবে ধরাই কবির মৌল কাজ। বস্তুসত্য সেখানে অর্থহীন। অনর্থক তার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা। মরীরিচিীকার নাগাল পাওয়া মানবজীবনের স্বপ্নের অসাধ্যও। বাস্তবের সঙ্গে তার সম্পর্ক মনোভূমিকেন্দ্রিক। বস্তুগত সত্যের সঙ্গে সম্পর্ক অসম্ভবের। জাতীয়তাবোধের প্রশ্নে, স্বজাতির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবি আঁকা দেশপ্রেমিক কবির দায়। সে দায় পালনে তার কাব্যিক সততা তাৎপর্যময়।
কেবল স্বজাতি-স্বদেশ নয়, বৈশ্বিক চেতনাও তাঁর কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবি জানেন এবং মানেন__ উগ্র জাতীয়তাবোধ কবিকে সংকীর্ণ ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ রাখে। আবার দেশপ্রেমহীন বিশ্বনাগরিকবোধও কবিকে  উদ্বাস্তু করে তোলে। শেকড়বিহীন বৃক্ষ যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, তেমনি নির্দিষ্ট ভূখ- ব্যতিীত কবিরও অস্তিত্বত্ত্ব বিপন্ন। কারণ, ভূখ- ব্যতিীত যেমন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না, তেমনি সার্বভৌম কবির অস্তিত্বও। প্রত্যেক সার্বভৌম কবিরই একটি নির্দিষ্ট ভূখ- থাকে। সেটিই তাঁর শেকড়। শেকড় যে প্রাণসঞ্জিীবীনী গ্রহণ করে, তা তাঁর নিজের ভূখ- থেকেই।
তবে এ কথা অস্বীকার করা যায়ই না__ বুদ্ধির চেয়ে হৃদয়বৃত্তির প্রাখর্যেই তাঁর সৃষ্টি উজ্জ্বল। কবিমনের অহংপ্রবণতা, কবিতাকে মানবজাতির চিৎপ্রকর্ষ ও চরিত্রের দার্র্ঢ্য প্রকাশের অনুষঙ্গে পরিণত করে। কলাকৈবল্যবাদীদের ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্ব বর্তমান মানবসমাজে অন্তঃসার শূন্য প্রপঞ্চে পর্যবসিত। পাখি আপন মনে গান করে। এতে মানবজাতির কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই পাখির গান প্রকৃত গান নয়। মানব রচিত ও গাওয়া গানই গান। কারণ এতে মানুষের অংশগ্রহণকে মানুষ স্বাগত জানায়। শিল্পের যে প্রকরণ মানবতাকে শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করে, সে প্রকরণের মৃত্যু জন্ম লগ্নেই নির্ধারিত হয়।
সাম্যের গান- মানবমন্ত্রে পরিণত হয়েছে অনেক আগে। তবু পরাধীন জাতিগুলো স্বাধীনতার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্বাধীনতাকামী জাতিকে পদানত করে রাখার জন্য দ্বিধাবিভক্ত করে। সবকালেই এর প্রমাণ রয়েছে। স্বাধীনতাকামী জাতিগুলোও বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে স্বাধীনতার দাবি ফিকে হয়ে আসে। আবার স্বাধীন জাতিগুলোর ভেতর বিভিন্ন রকম উপসর্গ ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন গৌণ বিষয়ে বিবদমান রাখে। তখন স্বাধীন জাতিগুলোও নিজেদের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও সংঘঙ্ঘ তৈরির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। যে সে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। মোদ্দা কথা, ছলে-বলে- কৌশলে এসব জাতির ঐক্য বিনষ্ট করে, জাতিগুলোর মতানৈক্যের সুযোগে পদানত করে রাখে। আবু হাসান শাহরিয়ার কবি হিসেবে অহিংসবাদী এবং প্রতিশোধবিমুখ। ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন, ‘হত্যার বদলে যারা হত্যা চায় তারা/ সভ্যতার গ্লানি’। পাশাপাশি দোষীর মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন, অন্তত নির্বাসনে পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। ঠিক এ কবিতাটির বিপরীতধর্মী কবিতা ‘একলব্যের পুনরুত্থান’। এই কবিতায় ব্যক্তির ‘সম্পন্ন মানুষ’ হয়ে ওঠার পেছনে বাধাগুলো শনাক্ত করে কবির দৃঢ়চিত্তের ঘোষণা সহসা সচকিত করে ‘সভ্যতার প্রতি’র পাঠককে। ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতার সমস্ত প্রস্তাবনাকে চূর্ণবিচূর্ণ করেই যেন শেষ দুই পঙ্ক্তি রচিত__ ‘যদিও একলব্য তবু ভুলিনি অপমান/ পুনর্বার হব না তাই ক্ষমাঅন্তঃপ্রাণ’। স্বাভাবিকভাবে দুটি কবিতার মধ্যে বিরোধ লক্ষণীয় হলেও প্রকৃতপক্ষে আন্ত্যঃমিলই বেশি। দুটোতে অহিংস এবং আত্মমর্যাদাকে গুরুত্ববহ করে তোলা হয়েছে। পরন্তু ‘একলব্যের পুনরুত্থান’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে সমস্ত মেকি ও ন্যাকামিীর বিরুদ্ধে দ্রোহ। কারণ একপক্ষ কেবল ক্ষমাঅন্তঃপ্রাণ হলে অন্য পক্ষের স্বৈরাচারী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে সমাজের নানা স্তরের মানুষের স্বরূপ উন্মোচনও কবি করে দেন সহজে। ‘জন্ম যার নিসর্গতায় পদ্য তার পায়ে গড়ায়’ শীর্ষক এক বিশ্লেষণাত্মক গদ্যে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে মনের অথই বোধের অতল যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি মেধাবী ভাষায় সমকালের সমস্ত দীর্ণতাকেও ব্যঙ্গবিদ্র্রূপে শ্লেষে তীর্যকে  অনেক রঙিন মুখোশধারীর আসল চেহারাও শনাক্ত করেছেন।’ প্রথম দিকে রচিত কবিতাগুলোয় কবি যতটা ভাববাদী, শেষদিকে ততটা নন। শেষ দিকের বিশেষত ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’, ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’ ও ‘বালিকাআশ্রম’ কাব্যে সমাজের প্রতি কবির দায় পালনের উজ্জ্বল প্রমাণ রয়েছে।
বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কষ্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার, চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রভাব, যান্ত্রিক সভ্যতার বিবমিষা, নগর জীবনের নৈঃসঙ্গতা, নৈরাশ্য আর অবসাদগ্রস্ত এক ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আধুনিক কাল মানুষকে। যার মুখোমুখি দাঁঁড়িয়ে নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত জন অলৌকিকতা এবং ঐশ্বরিক কার্যকারণ সম্পর্কের মধ্যে আপাতত অন্তঃসার শূন্যতা দেখেন। ফলে ক্রমাগত জগৎসংসার, যূথবদ্ধ জীবনপ্রণালিী আর যৌথ পরিবার প্রথার বন্ধন নিয়ে সন্দেহ ও নৈরাশ্যবোধের উন্মেষ ঘটে। যা থেকে কেউ কেউ তাদের প্রাত্যহিক জীবন-যাপন থেকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও অনুশাসনগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে স্বতঃপ্রণোদিত ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। যান্ত্রিক জীবনের প্রতি স্বপ্নবান মানুষের বিবমিষা জন্ম সহজে। যে যন্ত্র মানুষের আবেগ ও নিত্যপ্রয়োজনেরর দাবিকে অস্বীকার করে, তার প্রতি কবি বিতৃষ্ণ। ‘আড়াইঅক্ষর’ কাব্যে দার্ঢ্যরে সঙ্গে উচ্চারণ করেন__ ‘জীবনই না থাকে যদি কেন হাঁটি জীবিকার গলি?’ নাগরিক প্রতিবেশে বসে কবি নিসর্গকে স্মরণ করেন প্রেয়সীর মতো। এ কারণেই তাঁর সহজ উচ্চারণ ‘মাটির আমি পেটের ছেলে; আকাশ আমায় ডেকেছে ‘‘ভাই’’__/ একসঙ্গে বসে সবাই এক থালাতে নিসর্গ খাই।’ তবে শাহরিয়ার নিসর্গকে কাব্যের অনুষঙ্গ করে তুলতে গিয়ে গ্রাম্য করে তোলেন না, নিসর্গপ্রেমের সঙ্গে নগর চেতনার অন্বয় সাধনও করেন। নিজে হয়ে ওঠেন বিদগ্ধ এবং কবিতা তাঁর মন ও মননের স্মারক। তাই যৌনগন্ধী শব্দ এবং শারীরবৃত্তীয় শব্দের সমন্বিত পাঠ তাঁর কবিতায় অপেক্ষাকৃত বেশি। শেষ পর্যন্ত যৌনতাও শিল্প হয়ে উঠেছে।
তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের বিবেচনা করলে দেখা যায়Ñ ‘অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ’ কাব্যে পূর্বসূসুরিদের ঋণ লক্ষণীয় হলেও তাঁরও প্রস্তুতির স্বাক্ষর রয়েছে। এ কাব্যের ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় কবি দেশকে দেখেছেন কন্যারূপে। বলেছেন বাংলাদেশ লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে, হাজারও সংকট ও সংগ্রামের পথ মাড়িয়ে সিজিল-মিছিল করে উঠেছে মাত্র এই কন্যা। তাকে যেন কেউ ভূত সেজে ভয় না দেখায়। ‘অব্যর্থ আঙুল’ মূলত আত্মজিজ্ঞাসা তাড়িতের দার্শনিক প্রজ্ঞাপূর্ণ। এ কাব্যের গুরুত্বপূর্ণ কবিতাগুলোর একটি ইতোপূর্বে উল্লিখিত ‘সভ্যতার পতি’। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘মোহরপ্রার্থী।’ এই কবিতায় স্বরবৃত্তের দ্রুতলয়ের শব্দ সমবায়ের সমন্বয়ে সংবেদনশীল হৃদয়ের স্পষ্ট ও দৃঢ়মনোবাসনা প্রকাশিত হয়েছে। স্বরবৃত্তের পর্ববিন্যাস ও পঙ্ক্তিবিন্যাসে ভাঙচুর ও নিরীক্ষার প্রমাণ রয়েছে।
‘তোমার কাছে যাই না তবে যাব’ প্রস্তুতিকাল ছাড়িয়ে পরিণতকালের কাব্য। এ কাব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘যে -গোলাপ অনন্ত সুন্দর’। এ কবিতায় ব্যক্তির আত্মউদ্বোধন এবং উšে§াচনকে বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ করে তুলেছেন। গোলাপপ্রীতি সবার স্বতঃস্ফূর্ত নয়। অনেকটা লৌকিক আচরণ মাত্র। স্বার্থসিদ্ধির উপচারের পরিণত গোলাপ অনেক অসত্যেরও সহায়। তাই গোলাপপ্রীতি ফ্যাশন হয়ে ওঠে। যান্ত্রিক সভ্যতায় সবকিছুই যেখানে উপযোগ দাবি করে করে, আর্থিক লাভালাভের ভিত্তিতে সেখানে প্রেমিকের দাবি কী? নৈরাশ্য তাকে আচ্ছন্ন করে কখনো কখনো। এই সত্য উপলব্ধিজাত নয় কেবল, অভিজ্ঞতারও অংশ। যে অভিজ্ঞানে কবি সাধারণ মানুষ থেকে কবি হয়ে ওঠেন, কবি থেকে হয়ে ওঠেন সম্পন্ন মানুষও। এ গোলাপ কার্যসিদ্ধিরও উপায়। যা বহু আগে ইয়েটÑ 'TO THE ROSE UPON THE ROOD OF TIME' ' কবিতায় বলেছিলেন, 'Come near; I would, before my time to go,/ sing of old Eire and the ancient ways: Red Rose, proud Rose, sad Rose of all my days'. গোলাপ বিদায়ক্ষণকে মিলনবেলার মতো স্মরণীয় করে রাখার আদর্শ অনুষঙ্গ হতে পারে। ইয়েটস সে কথাই ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। শাহরিয়ার ঠিক সেভাবে বলেন না, তাঁর বলার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্প্রীতি স্থাপনে গোলাপ যেমন সেতু বন্ধন হতে পারে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদিী কোনোনও কর্মযজ্ঞেরও স্মারক গোলাপ হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই গোলাপের গুরুত্ব অপরিমেয়। ইয়েটস গোলাপকে নিয়ে অহংকার করেছেন, শাহরিয়ার করে তুলেছেন আত্মউদ্বোধনের চিহ্ন।
ঐতিহ্য ও লোকপুরাণের নবায়নে সৃষ্ট ‘একলব্যের পুনরুত্থান’। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’ প্রকৃতপক্ষে নিসর্গ প্রশস্তি ও সর্বপ্রাণের প্রতি প্রেমের বর্ণনা। আরোপিত সভ্যতার যন্ত্রণাকিীষ্ট জীবনের প্রতি তীব্র কটাক্ষের কাব্য, ‘এ বছর পাখিবন্যা হবে’। ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’, ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’, কাব্যত্রয়ী উত্তরাধুনিক চেতনায় ঋদ্ধ। এ উত্তরাধুনিকতা পশ্চিমের আরোপিত নয়, বাংলার ঐতিহহত্য, পুরাণকে চিন্তার ভরকেন্দ্রে রেখে কল্পনার সংহত ভাবের সমন্বয়ে সৃষ্ট। সমকাল ও স্বসমাজের নানা দিক কেন্দ্রে রেখে আপনসৃষ্টির মিথস্ক্রিয়ায় লিখিত কাব্য ‘তোমাদের কাচের শহর’। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’, ‘আড়াইঅক্ষর’ ও ‘বালিকাআশ্রম’ মূলত আখ্যানকাব্য। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’ ও ‘আড়াইঅক্ষর’এর কবিতাগুলো লিরিকধর্মী, বিষয় নির্বাচনে প্রেম, শরীর, প্রযুক্তির নানা দিক প্রাধান্য পেয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ-বিষয়, যুদ্ধ, প্রেম, সংবিধান প্রভৃতি বিষয়ের বহুরৈখিক প্রকাশ ঘটেছে ‘বালিকাআশ্রম’ কাব্যে।
কবিমানস কাল সচেতন বলেই সমকালকে শব্দে-বাক্যে-পঙ্ক্তিতে ধারণ করেন সচেতনভাবেই। তাতে কবিতা সমকালের ফসল হয়েও চিরকালীন হয়ে ওঠে। সমকালীন রাজনীতি, রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা ভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কুসংস্কার, সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব কবির মনোবিশ্বকে আলোড়িত করে, ব্যথিত করে; করে ক্ষত-বিক্ষতও। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ধর্মীয় উন্মদনার অপ-সংক্রমণে কবি ব্যথিত। ছন্দ মানা ও ছন্দভাঙার প্রতি তাঁর সমান আগ্রহ, চিত্রকল্পে রয়েছে নিজস্ব রুচির পরিচয়। সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার শিক্ষাকে কবিতার অনুষঙ্গে পরিণত করতে গিয়ে শিক্ষিত মানুষের ভদ্রোজনোচিত ভাষাকে কবিতার ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি। কবিতার স্বর ও সুর এবং চিত্রকল্পে তাঁর স্বাতন্ত্র্য উজ্জ্বল।

সোমবার, ২৩ জুন, ২০১৪

তুমি ।। আশরাফুল মোসাদ্দেক





সর্বশেষ যখন দেখি
তখন অনেক বড় হয়ে গেছো তুমি
আমি তারচেয়ে খানিকটা লম্বা
আমারা উচ্চতা মেপেছিলাম
কুয়ার রশি দিয়ে

জবাবে মেয়েটি বলেঃ
মাঝপথে বিভক্ত চুলগুলো
আমিও মেপেছিলাম তোমার সাথে
যা ঝুলছিলো আমার কোমড় বরাবর
কার জন্য ওগুলো চূড়ো করে বাঁধি
যদি না তা হও তুমি

* ইসে মনোগাতারি নবম শতকের একজন জাপানি কবি। প্রেম বিষয়ক তার কবিতা আজো মন কেড়ে নেয়।

* মূলঃ ইসে মনোগাতারি

রবিবার, ২২ জুন, ২০১৪

স্রোতের ভাসান ।। সৈয়দ সাইফুর রহমান সাকিব


সৈয়দ সাইফুর রহমান সাকিব
কেউ কেউ বলে
কিরে! ইন্দ্রিয় অবশ করে
পঁচে মরছিস কেন একা একা ঘরে?
বেকসুর ভাবছিস নিজেকে তাইনা!
হাসিও অকাট্য হয় প্রথম শুনছি
হাসিতে হাসিতে বলে যাচ্ছে
ছনের দাওয়ায় পড়ে আছি নাকি
ঘুম ঘুম ঘোরে।

এখন ব্যস্ততা পারলে উপড়ে নিয়ে
বসিয়ে দেয় বাণিজ্য পালে।
নড়ে ওঠে গোড়া, টের পাচ্ছো!
বাতাস বইছে
এখনই নাকি সময়, ইতর হয়ে
লিখে দিতে হবে
এই সুরারোপে আমি একজন তোরা
স্রোতে গা ভাসিয়ে যেতে হবে।

শৈশবের ডাইনিরা ।। ফজলুল হক তুহিন


 Fazlul Haque Tuhin

শৈশবের দিনগুলি আমার কেটেছে দাদির রহস্য গল্পের আসরে
আমার চোখের পাতা পড়তো না কখনো আরব্য রজনির
বিস্ময়জাগানো সব কাহিনির ক্রম যখন সিনেমা হয়ে ভেসে উঠতো অদ্ভুত
দেখতে পেতাম ডাইনির হাতের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে যাদুর
ভয়াল পশুরা, আঁচলের মধ্যে থেকে হা হা হাসিতে হাজির
অতিকায় হিংস্র দৈত্য- আমরা ভয়ে গুটিশুটি মেরে
পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকতাম
তবু গল্পের শেষ না শুনে গল্পের হাট ভাঙতাম না কিছুতেই
আমাদের খুশি সাঙ্গ হতো ডাইনি ও দৈত্যের বিনাশে
সেই দাদি সেই গল্প আর সেই আসরের রূপরসগন্ধ আর নেই।

ফিরে আসে না কিছুই
তবু আবারও ফিরে এসেছে ডাইনি, ফিরে এসেছে দৈত্যের দিন
ডাইনির আঁচলের তলে নাক ডাকে, হুঙ্কারে কাঁপিয়ে তোলে চারদিক
মাঝে মাঝে বের হয়ে আসে রক্তের তৃষ্ণায়
মুড়ি মুড়কির মতো গিলে খায় মানুষের দেহপ্রাণমন
ডাইনির হাতের যাদুতে হঠাৎ প্রকাশ পায় চিতাবাঘ
ঘাড় মটকে হালুম করে খেয়ে ফেলে নারীশিশুযুবা, ঘরবাড়ি, সবুজ প্রান্তর
অতঃপর বের হয়ে আসে দাঁতাল শুয়োর
উল্লুকভাল্
লুক, অজগর, শেয়াল, কুকুর, কুমির, গণ্ডার
বসে বসে ভাবি মানুষের মতো দেখতে ডাইনি কীভাবে হয়
আচ্ছা, ডাইনির কী তবে আমাদের মতো আছে একটি হৃদয়?

কবিতা কী বলে ।। আবদুল হক

 

 মনের ভাবের কোনো ছক নেই, চৌহদ্দি নেই। কিন্তু ভাষার শক্তির সীমা আছে। মননশীল মন সেই সীমায় বাধা পায়, মুক্তি চায়, পথ খোঁজে। চেনা শব্দে গোনা শব্দে যখন তার চলে না, মন তখন শব্দে ভর করে সেই শব্দকে ছাড়িয়ে যায়। উড়োজাহাজ চাকায় ভর করেই চাকার সীমা ছাড়িয়ে অসীম আকাশে পাখা মেলে, দূরাভিসারী কবিমন তেমনি শব্দকে আশ্রয় করেই শব্দোত্তর অনন্তের দিকে উড়ে চলে।
  
কবিতা যা বলে, আর কেউ তা পারে না। কবিতা যেমন করে বলে, তেমন আর কিছু বলে না। এই যাযেমন-এর বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই কবিতার প্রকৃতি, তার কৃতি, তার সার্থকতা। এখানেই গদ্যের ওপরে তার মহিমা, পদ্যের চেয়ে সে উচ্চতর এখানেই। গদ্য কাজের কথা বলে, পদ্য সুন্দর কথা বলে, কবিতা সুন্দরের কথা বলে।

সেদিন রেলে দেখলাম, এক কুলিকে জনৈক বাবু সাব ঠেলে নিচে ফেলে দিল। চোখ ফেটে জল এল জগৎ জুড়ে এভাবে কি দুর্বলেরা মার খাবে?
এটা গদ্য। সরল কাহিনি, সহজ বক্তব্য। এ ধরনের বক্তব্যের জন্যে কবিতার দরকার নেই। একে কবিতার আকারে লিখলেও, প্রকারে তা কবিতা হবে না। কেননা এতে এমন উঁচু কোনো ভাব নেই, যা একান্তই কবিতারসবলের হাতে দুর্বল মার খাচ্ছে দুঃখজনক, কিন্তু সাধারণ ঘটনা। এ ঘটনা দেখে যে-কোনো ভালোমানুষ দুঃখ পেতে পারেন। মহৎ মানুষ হলে কেঁদে ফেলতেও পারেন। এমনকি প্রতিবাদও করতে পারেন। তবু এ ঘটনা ও তা দেখে দুঃখ পাওয়ার বিবরণ কবিতা নয়। এমন সাধারণ আবেগ রাজা-চাষা-হরকরা-বাদামঅলা প্রভৃতি যে-কারো মনে জাগতে পারে। পড়ালেখা জানলে এঁরা তা লিখে রাখতেও পারেন। কথা বলার মতো লিখলে গদ্য হবে। ছন্দ ও মিল দিয়ে লিখলে পদ্য হবে। নজরুল ছন্দ ও মিল দিয়ে লিখেছেন। তিনি খুব সুন্দর পদ্য লিখেছেন:

দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল!

এখানে পদ্যের সৌন্দর্য আছে, কাব্যের ঐশ্বর্য নেইঅতল ভাবনা নেই। গূঢ় তাৎপর্যের ইশারা নেই। অধরাকে ধরবার আকুলতা নেই। শব্দোত্তর ব্যঞ্জনা নেই। গহন উদ্বোধন নেই। দুরূহ দ্বন্দ্ব নেই। অলোকের আলোক নেই। রহস্যের ছায়া নেই। কবিতার কিছুই নেই। সরল ঘটনা ও তরল আবেগ নিয়ে পঙক্তিগুলি চমৎকার পদ্য কবিতা নয়।

     কিন্তু এর ঠিক পরেই যখন আবৃত্তি করি যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে দেখি, এই দধীচি শব্দটি, ওই পৌরাণিক উপমাটি, আগে-পরের তাবৎ পদ্যপঙক্তি নিয়ে উঠে আসতে চাইছে কবিতার কাতারে। দধীচি তখন শব্দমাত্র নয় আর, তার তলে একটি অর্থমাত্র চাপা নেই শুধু আছে তার বেশি কিছু ওই বেশিটুকুই কবিতা। বজ্রার্থে আত্মত্যাগী যে-দধীচি স্বত্যাগচেতনার প্রতীক, কবি একে সঞ্চারিত করেন আবহমান শ্রমে, লক্ষ লক্ষ কুলি-মজুর তখন দধীচি হয়ে ওঠে। এভাবেই এক বজ্রকর প্রতীকায়নের সাহায্যে শব্দোর্ধ্ব অতিরেকের বিদ্যুৎ-সংযোগ ঘটান কবি, আর তখুনি জ্বলে ওঠে তাঁর কবিতা।

     এই যে শব্দোর্ধ্ব অতিরেক, মানে শব্দ যে-অর্থ ধারণ করে শব্দকে তার বেশি কিছু বলানো, এ-ই কবিতার আসল শক্তি। এ শক্তির অধিকারেই কবি শক্তিমান স্রষ্টা। কবিতার উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক, বিমূর্তে রূপদান ও জড়ে প্রাণারোপ এ শক্তিরই প্রকাশক। এ নইলে কবিতা হয় না। এ শক্তির কেরামতি না জানলে কেউ কবি নয়। কবিতাকে অকবিতা থেকে, কবিকে ছদ্মকবি থেকে আলাদা করে চেনার এই একটাই পথ শব্দোত্তর প্রকাশশক্তি। অতএব কবিতা কী বলে এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর বিষয়বাচক নয়, গুণবাচক কবিতা বেশি বলে, বলার সম্ভবতার চেয়ে; কবিতা অসীমের ইশারা আনে।

     কবিতা সবসময় আপাদমস্তক কবিতা হয় না। এক পেয়ালা পানিতে এক চিমটি চা-পাতা মেশালে পেয়ালার সবটুকু পানিই চায়ে পরিণত হয়, তেমনি একপাতা কথায় বা একরাশ পঙক্তিতে একটুকু কবিতেয় রহস্য মিশিয়ে দিলে ক্ষেত্রবিশেষে সব বাক্য-পঙক্তিকেই তা কবিতায় উত্তীর্ণ করে তুলতে পারে। নজরুলের চুয়াল্লিশ পঙক্তির দীর্ঘ কুলি-মজুর অকাব্যিক বর্ণনা, ঘোষণা ও বক্তব্য নিয়ে প্রধানত যা পদ্যই তিন-চারটি পঙক্তির কারণে কবিতাখ্যেয়। যেমন শেষ পঙক্তিটা: ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান ঠেলে কাউকে নিচে ফেলে দেওয়ার মতো সাধারণ দেখা ঘটনার বর্ণনা নয়, এ অতিসাধারণ কাব্যিক চিত্রকল্প। ইনসাফ ও যুলম এখানে ভগবান ও শয়তানের রূপ ধরে জীবন্ত ও দৃষ্ট হয়েছে। ফলে তাতে কবিতার অতিরিক্ত শর্ত সৃষ্ট হয়েছে। যে-কবিতায় এ অতিরেক যত বেশি, তা তত সার্থক কবিতা।

     খবরের ভাষা নির্দিষ্ট, জ্ঞানের ভাষা স্পষ্ট কিন্তু কবিতার ভাষা প্রচ্ছন্ন, কুয়াশাময়। কারণ কবিতা খবরিয়া নয়, শাস্ত্রীয় জ্ঞানের কারবারিও নয় তার কারবার গহন বোধ ও অন্তরস্থ অভিজ্ঞানের কারবার। গহন বোধ যেহেতু আম নয়, অভিজ্ঞান সুলভ নয়, কবিতাও তাই সকলের জন্যে নয়। ছড়া খুব ছড়াতে পারে, পদ্য পেতে পারে প্রবাদের সর্বপ্রিয়তা, কিন্তু কবিতা সচরাচর সেভাবে জনপ্রিয় হয় না। আবদুল হাকিমের যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি কিংবা রঙ্গলালের স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে অথবা মদনমোহনের সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি প্রভৃতি পঙক্তিমালা প্রবলভাবে সেকেলে সমাজনৈতিক অভিপ্রায় ও মূল্য ধারণের সুবাদে শত শত বছর ধরে বিখ্যাত নিত্যাবৃত্ত পঙক্তি তবু সাদা পদ্য ওসব, কবিতা নয়। প্রাচীন চর্যাপদ বা সাবআ মুয়াল্লাক্বাও আসলে কবিতা নয়, যদিও তাতে কবিতার কিছু রং ইতস্তত ছিটোনো দেখা যায়; তবে কালিদাসের মেঘদূত, রুমীর মসনবী ও লালনের বিস্রস্ত ভজনগুলি কবিতা, উত্তীর্ণ কবিতা। যেগুলোকে বলছি কবিতা নয়, কবিতা নয় মানে যে এসব কিছুই নয় তা কিন্তু নয়, সফল পদ্য ও আলঙ্কারিক রচনা হিসেবে যথাযথ সাহিত্যমূল্য এগুলির অবশ্যই আছে।

     এককালে চল ছিল মহাকাব্যের নাম মহাকাব্য হলেও প্রকৃতপক্ষে ওগুলো কাব্য ছিল না ছিল ছন্দোবদ্ধ কেচ্ছা রাজার গুণকেচ্ছা, যুদ্ধের বড়াইকেচ্ছা, হায় হায় শোককেচ্ছা দিন গিয়েছে, সময়ের সিদ্ধান্তে কথিত মহাকাব্যও পরিত্যক্ত হয়েছে আজকাল কেউ মহাকাব্য লেখে না, আর লিখবে বলেও বোধ হয় না ওডিসি-শাহনামা-মহা শ্মশান ঐতিহাসিক সম্পদ বলে বর্ণিত হয়, পঠিত হয় না

     সময়ের স্পর্শের বাইরে কিছুই নেই। দিন গিয়েছে, দিন এসেছে, কবিতাও বদলেছে, বদলাচ্ছে। সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে আমাদের কবিতাবোধ। ঘটনা, বিশ্বাস, রুচি ও মতবাদের পরিবর্তনে কবিতার নিরিখও পরিবর্তিত হয়েছে, আধুনিকায়িত হয়েছে নতুন দিনের কবি লিখছেন নতুন কবিতা। পাশাপাশি পরিবর্তনের কোলাহলে খেই হারিয়ে ছদ্মকবিরা লিখে চলেছেন লক্ষ্যহীন বিশেষণভার আর অর্থহীন দুবোর্ধ্যতায় আক্রান্ত অসংলগ্ন ছদ্মকবিতা। রোমান্টিক কবির কাল ফুরোল বলে। পরাবাস্তবতাও মলিন হতে লেগেছে। স্বকালের বহু কবি ও কবিতা এখন কবি ও কবিতা নয়। দুঃখজনক উদাহরণ, সত্যেন্দ্রনাথ কত অজস্র অবাক করা দুলিয়ে দেওয়া পঙক্তিমালা তাঁর। তবু সময়ের মুরব্বিয়ানার ওপরে কথা চলে না। যদিও সময় হার মানে কোথাও কোথাও। প্রতিভার আলোয় সময়কে পথ দেখান কেউ কেউ, যেমন রবীন্দ্রনাথ। সূক্ষ্মতর বোধের বৈভবে কেউ আবার ডিঙিয়ে যান সময়ের সীমানা, যেমন জীবনানন্দ। যা বলা যায় না, এঁরা তা-ই বলেন, মানবাত্মার অন্ধকার অতল খুঁড়ে তুলে আনেন মণি-মুক্তো।

     আবার বলি, কবিতার প্রাণের ধন সেই কথাটি: যা আদৌ বা ঠিক সুরে বলা হয় নি, হয় না, সাধারণত হওয়ার নয়। প্রকৃত কবির কাজ: সেই অধরাকে ধরা, যার নাগাল কেউ পায় না কিংবা ঠিক ঠিক ধরতে পারে না। শুধু কবিতা পারে। কেবল কবি পারেন। বিশ্বকবির গভীর কণ্ঠে তাই শুনতে পাই:

শেষের মধ্যে অশেষ আছে
এই কথাটি মনে
আজকে আমার গানের শেষে
জাগছে ক্ষণে ক্ষণে।

শুদ্ধতম কবিই টের পান:

অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয়
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে


 

 

শনিবার, ২১ জুন, ২০১৪

শাহানা সিরাজীর কবিতা


Shahana Siraji
 

অনুভব --৯

প্রথম ঢেউয়ের স্পর্শে জেগে উঠে ঘুমন্ত পার
দ্বিতীয় ঢেউ কি পারে তেমনি ঘুম পাড়াতে?
তবুও ঢেউয়ের পর ঢেউ সাজে সাজায় বনভুমি
প্রলম্বিত বৃষ্টির নরম ঠোঁটে লেগে থাকে মুখরিত বর্ষণ

প্রমত্ত সাগর যখন বৃষ্টির সাথে অবগাহন করে
তখন অবোধ চোখে অবিরত ধারা উদাস বাতাসে
নিজের ছবি আঁকে; জলে পড়ে না ছায়ার প্রতিচ্ছবি
আষাঢ়ের অনুপ্রাস হৃদয় খরায় পুড়ে পুড়ে খাঁটি
রোদ বৃষ্টির ষড়যন্ত্রে বিব্রত প্রেমপত্র ক্রমশ দিক বদলায়

ছুটে আসা অলৌকিক ঘর উষ্ণ বেদনায় মলিন
সময়ের খেলায় দূরত্ব আরও বাড়ে ;সু
মুদ্র-পানি- পার
কে কার আপন ? কার জন্য কে?
কেন বুঝিনা মেঘেরা কেন রঙ বদলায়!

এবার নোঙ্গর ফেল; যতটুকু পেয়েছি তাই থাক
চোখের জলের মতো একান্তই নিজের হয়ে...



অনুভব --১০


ফিরতি পথে পা বাড়ালাম
পেছনে অনবদ্য কিশোরী বেলা ম্লান মুখে বৃষ্টির জলে
লুকানোর বৃথা চেষ্টা ... গ্রামীণ জীবন নয় মফঃস্বলীয় আডম্বরে
ঠায় একা ... কীভাবে সোনালী অতীত হারিয়ে যায়

আজো জানিনি অনিমেষ চোখ কি খোঁজে
কেন ও চোখের কোনে শাদা অভিমান নীরবে অশ্রুপাত করে
যতবার পেছনে ফিরি ততবারই খাঁচার দুয়ার রুদ্ধ হয়
একটু একটু করে সরে যাই জড়ানো দিনের মোহনীয় জাল ছিঁড়ে

একবার তো বলতে পারতে... যেওনা ...
হুড়মুড় বৃষ্টি কোলাহল ছেড়ে লুটিয়ে পড়তো কোলে

না হয় কিছুটা সময় আঁকড়েই ধরতে অনাহুত ভেবে উপেক্ষা করতে
তবুও নিশিগন্ধার মতো লেগেই থাকতাম আবশ্যকীয় উপকরণ হয়ে

দমকা বাতাস কেন এতো কাঁদাও বলতো নাড়ীর টান ছেঁড়া যায় ?
রক্তের নাচন যে মুদ্রাতেই থাকুক তা অচেনা হয়?

বনের পাখি শেকলে বাঁধা পড়ে না সহজে জানি
খাঁচার পাখিও যাবেনা কখনো শেকল ছিঁড়ি ছিঁড়ি

পাঁজর ভাঙা আর্তনাদ আকাশের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে
ওভাবে তাকিয়ো না ...ভেজা বৃষ্টি চোখের পাতা চুমে যায়
প্রকৃতিতে তুমুল আলোড়ন চলো অনেক দূর যেতে হবে ...

ক্লান্ত পা কোথায় রাখি...

শুক্রবার, ২০ জুন, ২০১৪

বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় কবিদের বর্ষার কবিতা পাঠ


Photo

বাইরে বৃষ্টি, হলের ভিতরে সুনসান নিরবতা। কবি আর দর্শক-শ্রোতা একাকার হয়ে উপভোগ করেছেন বর্ষার কবিতা। একের পর এক কবি মঞ্চে আসছেন আর তাঁর কবিতা পাঠে দর্শক-শ্রোতা বিমোহিত হচ্ছেন। এ এক অন্যরকম আয়োজন, এক ভিন্ন মেজাজী আয়োজন। শুধুমাত্র কবিতা আর কবিতা। বগুড়াতে এই প্রথম অগ্রজ-অনুজের সমন¦য়ে শুধুমাত্র বর্ষার কবিতা পাঠের আয়োজন। আয়োজনের  শিরোনাম ছিল ‘বর্ষায় কবিতা, কবিতায় বর্ষা’। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহি সাহিত্য সংগঠন বগুড়া লেখক চক্রের আয়োজনে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় উডবার্ণ পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে ভিন্নধর্মী এই আয়োজন শ্রোতাদের বিমোহিত করে। অনেক অপরিচিত কবি যেমন কবিতা পাঠ করেছেন, তেমনি ছিলেন অনেক সাংবাদিক। যাঁরা কবিতা থেকে সাংবাদিকতায় এসেছেন কিংবা সাংবাদিকতা থেকে  কবিতায়। স¦-রচিত কবিতা পাঠের এই আসরে তরুণদের প্রাধান্য ছিলো চোখে পড়ার মতো। বর্ষার কবিতা পাঠ পর্বের আগে সংক্ষিপ্ত এক আলোচনা সভা সংগঠনের সভাপতি কবি ইসলাম রফিকের সভাপতিতে¦ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ষাট দশকের অন্যতম কবি, অনুবাদক ও শিক্ষাবিদ বজলুল করিম বাহার, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ষাট দশকের আর এক কবি প্রফেসর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি রেজাউল করিম চৌধুরী, কবি শোয়েব শাহরিয়ার, কবি মনজু রহমান, বৃহত্তর বগুড়া সমিতি-ঢাকার সভাপতি মাসুদুর রহমান রন্টু, বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না এবং বগুড়া লেখক চক্রের উপদেষ্টা আতিকুর রহমান মিঠু ও এ্যাড. পলাশ খন্দকার। সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক আমির খসরু সেলিম। কবিতা পাঠের এক ফাঁকে কবি মনসুর রহমান এর ৭৯তম জন্মদিন উপলক্ষে বগুড়া লেখক চক্রের পক্ষ থেকে তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয় এবং তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়।

 স¦রচিত কবিতা পাঠে অংশগ্রহন করেন- বজলুল করিম বাহার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, রেজাউল করিম চৌধুরী, শোয়েব শাহরিয়ার, মনজু রহমান, খন্দকার বজলুর রহিম, খৈয়াম কাদের, পলাশ খন্দকার, আব্দুল খালেক, শিবলী মোকতাদির, পান্না করিম, মতিয়ার রহমান, আজিজার রহমান তাজ, ইসলাম রফিক, জি এম সজল, প্রদীপ ভট্টাচার্য্য শংকর, জে এম রউফ, মনসুর রহমান, শাহান ই জেসমিন ডরোথী, আমির খসরু সেলিম, সেলিম রেজা কাজল, প্রত্যয় হামিদ, আমিনুল ইসলাম রনজু, কামরুন নাহার কুহেলী, সিকতা কাজল, রনি বর্মন, অনামিকা  তাবাসসুম, রনজু ইসলাম, মামুন স্বরকার, করিম মোহাম্মদ, আফসানা জাকিয়া, আনিছ রহমান, মুনজুরুল ইমরান, হাসনাত মোবারক, আল-আমিন মোহাম্মদ, সতেজ মাসুদসহ আরো অনেকে। কবিতার পাঠ পর্ব উপস্থাপনায় ছিলেন কামরুন নাহার কুহেলী ও সিকতা কাজল।


বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন, ২০১৪

মোহাম্মদ নূরুল হক-এর প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য : সমকালীন সাহিত্যরুচির উত্তাপ ।। রেজা নুর

         

সাহিত্য মনের শৈল্পিক অভিব্যক্তি। তা স্বত’স্ফূর্ত ও অবারিত। আরোপিত নয়। এই নির্জলা একটি বিষয়ের ওপরে আলোচনা বা সমালোচনা একটু স্পর্শকাতর ব্যাপার বটে। একই গ্রন্থ বা বিষয়ের ওপর একের অধিক আলোচনা হলে তা বিচ্ছুরিত হবে আলাদা আলো ও রঙে। এখানে দৃষ্টিভঙ্গি রুচি ও পছন্দ প্রাধান্য পায়।

সত্যিকার সাহিত্য-ব্যক্তিত্বই প্রকৃত সাহিত্য সমালোচনা লিখতে পারেন। পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে, ভার ভারিক্কি ভাষায় পা-িত্য প্রকাশ করা সহজ। এর সাথে সঙ্গতি রেখে লেখার মর্মে আলো ফেলা ততই কঠিন। তাই যারা কবি বা সাহিত্যিক তাঁরাই আলোচনায় তুলে আনতে পারেন আলোচিত বিষয়ের একজন হয়ে। শুধুই সমালোচক যারা, তাদের উদাহরণ বোধ করি এমন কোথাও পড়েছিলাম: সমালোচনার খাতিরে যারা সমালোচক তারা নিজেরা গাড়ী চালাতে জানেন না অথচ গাড়ী যারা চালান তাদেরকে কীভাবে চালাতে হবে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতে কমতি করেন না। যারা হয়তো জীবনে লেখেননি একটি কবিতা বা গল্প তারাই বলেন এর নানাদিক। লেখার ভালোদিক এড়িয়ে প্রথমেই বসে যান ব্লেড হাতে। জিহ্বা সরিয়ে ওখানেও বসিয়ে নেন ক্ষুর। তাই যতদূর আমরা ভাবিনা কেনো, তাদের তথাকথিত সাহিত্য সমালোচনা থেকে অনাগত কাল সমসমসাময়িক সাহিত্যের প্রকৃত চিত্র পরম্বরা পায় না।

কবি  মোহাম্মদ নূরুল হক ‘গদ্যকথন’ - এ বলছেন: “কবি-সাহিত্যিকের খ-িত পরিচয়, কিংবা বিশেষ শ্রেণীর লেবেল পরিয়ে দিয়ে সমালোচককুল আত্মপ্রশান্তি পান হয়তো, কিন্তু সাহিত্যিক তাতেই বিব্রতবোধ করেন। সঙ্গতকারণে একজন কবি, কিংবা একজন সাহিত্যিকের সামগ্রিকরূপ নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ । খ-িত কালসীমার পরিসরে কোনও সাহিত্যআন্দোলন গড়ে ওঠে না। অথচ নিজেকে একটি বিশেষ কালখ-ের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। বিষয়টা সাহিত্যের পথে মঙ্গলজনক নয়” ‘গদ্যকথন’ কবি’র ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’ প্রবন্ধ-গ্রন্থের ভূমিকা। এই বইতে মোট ২০টি প্রবন্ধ রয়েছে। ১৬০ পৃষ্ঠার সুপুষ্ট বইখানি যেমন অবয়বে স্থ’ুল তেমনি বিষয়-বৈচিত্র্য, গাম্ভীর্য ও সুক্ষè আলোচনায় সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের নানাদিক আলোকপাতের জন্য তাঁকে ভ্রমণ করতে হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের সূর্যোজ্জ্বল উপত্যকায়। সবগুলো প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না ঠিকই, তবে বিশেষ বিশেষ প্রবন্ধের ওপর সাধ্যানুসারে আলো ফেলার প্রচেষ্টা থাকবে। কারণ, পাঠক সত্যিকার রসাস্বাদন করতে পারবেন মূল প্রবন্ধগুলো আদ্যোপান্ত পড়ার পরই।

বইয়ের অন্দরে যাবার আগে লেখক সম্বদ্ধে একটু বলে নেয়া ভাল। মোহাম্মদ নূরুল হক কবি। ‘মাতালনদীর প্রতœবিহার’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা তিনি। তবে তার আলোচনা শুধু কবিতার ওপরেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রাধান্য আছে। ছোট ছোট বাক্যে রয়েছে কাব্যিকতা ও প্রয়োজনীয় অসংখ্য উদ্ধৃতি। এতে তাঁর গভীর পাঠ-সমৃদ্ধির দেখা মেলে। যা একজন আলোচকের পয়লা যোগ্যতা। নিজে কবি হওয়াতে আলোচিত কবিদের মরমে অনুপ্রবেশ ক’রে ক’রে উপলদ্ধ উপমা, গঠন, বিষয় ও শৈলী’র শিখর স্পর্শ করতে পেরেছেন। আর এগুলো তিনি সম্ভব করেছেন তাঁর কবিতাক্রান্ত, স্বচ্ছ অথচ গভীর গদ্যভঙ্গির জন্যে। ঠাঁসবুনটে কোনো কোনো অংশই হয়ে উঠেছে এক একটি মন্থিত কবিতাংশ। উদাহরণ :

“কবিতা বুদ্ধির দীপ্তি, প্রজ্ঞার জৌলুস, চিন্তার সৌকর্য এবং আবেগের সংহত ও পরিশীলিতরূপের বিবর্তনেরই মিথস্ক্রিয়া। অবয়ব সৃজিত হয় ছন্দ, অলংকার, ভাষা এবং প্রকরণের যথার্থ ও অনিবার্য পরম্পরায়। শুধু বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞার অনুশাসনে কবিতার স্বতঃস্ফূর্তভাব, চরিত্র ও প্রাণচাঞ্চল্যেও সর্বস্ব হরণ করে। বস্তুসত্যের যৌক্তিক ব্যাখ্যার প্রশ্নে কাব্যসত্য আপাতত কিশে হয়ে আসে; কিন্তু শুদ্ধতম অনুভূতি ও অন্তরের আহবানকে মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করতে চিন্তার পরিশীলিতরূপের সঙ্গে হৃদয়াবেগের সংহতরূপকে অস্বীকার করা যায় না।”
( কবিতার অবয়ব ও আন্তঃসংগঠন প্রক্রিয়া)

প্রবন্ধগুলোতে লেখক সাহিত্য আলোচনার সামগ্রিকরূপ তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। এবং সফলও হয়েছেন। সাহিত্য-চর্চার জন্য যা প্রয়োজন সেগুলো উঠে এসেছে অতি আকর্ষণীয়ভাবে। এখানে প্রাসঙ্গিক একটা শব্দ ব্যবহার করতে ইচ্ছে হয়,--- সার্বভৌম। তিনি সার্বভৌম প্রাবন্ধিক হিসেবেই পরিগণিত হন। ‘কবিতার নেপথ্যকথা’ থেকে শুরু করে ‘কবির তপস্যা ও কবিতার সৃজনক্রিয়া’,  ‘কবিতা পাঠের অনুভূতি ও বিস্ময়’ জাগিয়ে আমাদেরকে নিয়ে চলেন, ‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ দেখাতে; ‘কাব্যসত্য ও পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষা’র অন্বেষণে, চিনিয়ে দেন মানবমনের অনন্ত জিজ্ঞাসা ও কবিতার শত্রু-মিত্র’ কে। অবারিত করেন, ‘রূপসীবাংলা ও বালিকাআশ্রম: নিসর্গের অহংকার-প্রাণের ঐশ্বর্য’কে। এভাবে ‘গদ্যের বিষয়বস্তু ও ভাষাশৈলী’র পথ বেয়ে উপসংহারে আসেন ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’-এর মাধ্যমে।

‘কবির তপস্যা ও কবিতার সৃজনক্রিয়া’ বাংলা সাহিত্য শুধু নয় বিশ্ব-সাহিত্যের দিকপালদের কাব্যভাবনা ও উদ্ধৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এতে কবি’র সাধনার ধরন ও সৃজনশৈলীর পথরেখা নির্দেশিত। এই যে সাধনা, এই যে সত্যের মুখোমুখি কবির অবস্থান তা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সত্যের মতো কঠোর যে হিমালয়ের মতো সামনে এসে দাঁড়াতে চায়। এখানে কবিগুরু সম্পর্কে বলছেন, “রবীন্দ্রনাথ বলেছিনে, ‘সত্য যে কঠিন, তাই কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। রবীন্দ্রনাথ আকস্মিক চমক দেখানোর যাদুকর নন। কঠিনকে ভালোবেসে নিরন্তর পরিচর্যায় হয়ে উঠেছেন বিস্ময়কর। দেশ-কালের সীমা ছাড়িয়ে পরিণত হয়েছেন সর্বজনীন। এ সত্য ছন্দমুক্তির তপস্যা করার স্মরণ রাখা বাঞ্ছনীয়।......    রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে জীবনশিল্পী, সে অর্থে নেরুদা, হুইটম্যান এবং নজরুলও। চ-ীদাস বায়রন, শেক্সপিয়র, সাঁত্রে, গোর্কিও। মানুষকে অস্বীকার ক’রে এদেও সাহিত্যের ঐশ্বর্যপূর্ণ সৌধ গড়ে ওঠেনি। সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যে, শেক্সপিয়রর শ্রেষ্ঠ ট্রাজিডিগুলো, সফোকিসের ট্রাজিডি কিং ইডিপাসেও মানবাত্মার জয় ঘোষিত।”  কবিতা কখন কবিতা হয়ে ওঠে এ সম্পর্কে সুজিত সরকারের উদ্ধৃতি টেনেছেন, “শব্দ দিয়ে রচিত হয়েও যা শব্দকে অতিক্রম করে যায়, তাই কবিতা। শব্দের সীমানা অতিক্রম করার এই ক্ষমতাই হলো ব্যঞ্জনা।” প্রবন্ধে টি এস এলিয়ট-এর উক্তি, “শিল্পের আবেগকে নৈর্ব্যিিক্তক হয়ে উঠতে হবে।” কখন একটি কবিতা সত্যিকার কবিতা হয়ে ওঠে,  সোমত্ত হয় সে বিষয়ে লেখকের এই লাইনটি তুলে দেয়ার প্রয়াস পাই: “আবেগের সংহতি, যুক্তিবোধ ও যুক্তিহীনতার শৃঙ্খলা যখন প্রজ্ঞাশাসিত পথে অনুগমন করে, তখনই কবিতা সম্পন্ন হয়ে ওঠে।”

‘কবিতা পাঠের অনুভূতি ও বিস্ময়’-এ লেখকের নি¤েœাক্ত লাইনগুলো স্বত:সিদ্ধ সত্যে প্রতিভাত হয়: “একটি কবিতায় গুণের চেয়ে দোষের পরিমাণ খুঁজে বের করার মধ্যে গবেষক জীবন সার্থক হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু তাতে কবিতার রস-উপলদ্ধ হয় না। কবিতার উদ্দেশ্য আবিষ্কারের ভেতর পা-িত্য থাকতে পারে; প্রেম থাকে না। প্রেম বিবর্জিত কবিতাপাঠে কবিতা সম্ভ্রম হারায়, হৃদয়কে আলোড়িত করে না............. কোনও ক্রমপরিবর্তনমান শিল্প-প্রপঞ্চ সম্পর্কে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের প্রতি প্রশ্নশীল হওয়া জরুরী। যে প্রশ্নের উত্তর নিজের মন দিতে অপারগ, সে প্রশ্ন প্রকৃতিকেও করা অনুচিৎ।”  প্রবন্ধের অনত্র বলছেন, “ বিস্ময়বোধ জাগিয়ে তোলাই কবির প্রধান কীর্তি। বিস্ময়য়েরই আরেক নাম কবিতা। তাই শত বছরের ব্যবধানেও এক কবির চেতনার সঙ্গে অন্য কবির চেতনার কী অবিশাস্য মিল! কবি যখন একা থাকেন, তখনই নিজের ভেতর সম্পন্ন মানুষকে আবিষ্কার করেন। তখন পুরুষ কিংবা নারী আর সাপেক্ষ পদ থাকে না। থাকে না অন্যেও মুখাপেক্ষিও। হয়ে ওঠেন স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সার্বভৌম।”

‘কবিতার নেপথ্য কথা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার একটি। কবিতা পরিপূর্ণ অবয়ব লাভ করার আগে তার ভাব, ভাষা, গঠন ও প্রকৃতি কেমন হয় তা সত্যিই কৌতুহলের বিষয়। কবি মাত্রই এক অনিবার্য অন্ত:দহনের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেন। ক্ষণিক কোনো দৃশ্য বা অনুভব এমন সুষম আকারে ধরা দিতে পারে মানসপটে যে তা তখনই আকৃতি পায় মনোলোকে। কাগজে অক্ষরবিন্যাস হয়ে আসাটাই যা বাকী। এমনও জানতে পারা গেছে যে কোনো কোনো কবিতা দেখতে পান কবি মনের চোখে। আবার কিছু কিছু বিষয়ের ওপর নিবিষ্ট সাধনা এনেই গড়ে তুলতে হয় পঙক্তির পর পঙক্তি। এর পরও কবিতার কিন্তু সার্বজনীন সংজ্ঞা নিরূপন দুরূহ। প্রবন্ধকার যেমন বলেছেন, “কবিতা সম্পর্কে প্লেটো’র চড়বঃৎু রং ‘রহংঢ়রৎবফ সধফহবংং’.’ এবং গধঃঃযবি অৎহড়ষফ এর ‘ধ পৎরঃরপরংস ড়ভ ষরভব’ কিংবা জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতা অনেক রকম’ কোনও সংজ্ঞাই সার্বজনীন নয়। .........   কবিতা একান্ত উপলব্ধি ও উপভোগের বিষয়। ভোগ করার মতো স্পৃশ্য শরীর এর নেই। তাই ভোগের প্রশ্নে কবিতা অনঙ্গ। সে অনঙ্গ শিল্পের পথে একাকী রাতখচিত সময় কাটান কবি। কবির অনিদ্রা কবিতার সৃজন মুহূর্তের পূর্বাভাষও।........ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মানুষ যেমন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে শেখে, তেমনি কবিও প্রতিটি কবিতা সৃষ্টির পূর্বমুহূর্তে এক অলৌকক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকেন। সবাই সে সৃজন যন্ত্রণা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে না। যিনি পারেন তিনি কবি।......  কবিতা কবির দিনলিপিও। ....... কবি কোনও কোনও সময় কবিতার ভেতর আত্মপ্রকৃতিও এঁকে রাখেন। আত্মপ্রকৃতি আঁকার বাসনা থেকেই কবি দীর্ঘকাল যাবত একটি অখ- কবিতাই লেখার সাধনা ক’রে আসছেন। কিন্তু কোথাও তৃপ্ত হওয়ার অবসর নেই তার।   ........ কবি কবিতাকে চিত্তের এমন স্তরের বিষয় পরিণত করেন, যেখান থেকে কবিতাকে নিছক বুদ্ধির মারপ্যাঁচ দিয়ে বোঝার বিষয়ে পর্যবসিত করা যায় না। ........ কবিতা পরিকল্পনা ক’রে লেখা যায় না। ......   কবির মনোভূমে দৈবশক্তির অস্তিত্ব প্রয়োজন। তা হলে দেখা যাবে কষ্টকল্পনার স্থানে স্বতঃস্ফূর্ততা এসে কবিতাকে মহিমান্বিত ক’রে তুলবে।”

‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ কবি মোহাম্মদ নূরুল হকের এক প্রতিনিধিত্বকারী প্রবন্ধ ব’লে মনে হয়েছে। নাতিদীর্ঘ এই আলোচনায় তিনি সমসাময়িক সাহিত্য পরিম-লের অনস্বীকার্য বাতাবরণের বাতায়ন অবারিত করেছেন। বিশেষ ক’রে বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক আবহের ইঙ্গিত এসেছে সুস্পষ্টভাবে। তাঁর কথায়: “একজন কবির খ-িত পরিচয় কোনও সুফল বয়ে আনে না। বরং কবির পাঠক বলয়ের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।......... মতান্ধের মতবাদে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কবিতা। ......... বর্তমানে বাংলাদেশে প্রগতিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দলে বিভক্ত সাহিত্যসমাজ। ..........  ধার্মিক মাত্রই মৌলবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল নন। আস্তিক্যবাদী দর্শনের সঙ্গে আধুনিকতাবাদের সম্পর্ক  কি সাংঘর্ষিক?  তাহলে খ্রিস্টিও ধর্মাবলম্বী ও ঐতিহ্যের অনুসারী টি এস এলিয়ট কী ক’রে আধুনিক কবি হন? কিংবা লিও টলস্টয়?......... সাহিত্যের কোনও প্রবণতা উপলদ্ধি করতে হলে দশক কিংবা মতবাদ নয়, নয় কোনও তত্ত্বকেন্দ্রিক চিন্তাও; তার জন্য চাই নির্দিষ্ট প্রকরণের সামগ্রিক রূপ। একটি কবিতা, গল্প কিংবা উপন্যাসের ভেতর একই সঙ্গে বিভিন্ন তত্ত্ব ও প্রকরণ যেমন থাকতে পারে, তেমনি একটি কবিতা গল্প কিংবা উপন্যাস একটি বিশেষ দশকে রচিত হয়েও রসগুণে তা চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে।”

‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’ প্রবন্ধে দশক বিষয়ক দ্বন্দ্ব আরও স্বচ্ছতায় তুলে ধরেছেন প্রবন্ধকার। প্রথম লাইনই পরিষ্কার করে দিনের আলোর মতো দশক বিভক্তির কুফল। “বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের একটি বিষফোঁড়া--- দশক বিশ্লেষণ। এটি যেমন সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি সৃষ্টিশীলতার অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক। মহাকালের হিসাবের খাতায় শতকই যেখানে গৌন, দশক সেখানে অতি তুচ্ছ বিষয় মাত্র।........ দশক বিভাজন নিয়ে অরুণ মিত্র বলেন--- ‘আমি দশক বিভাজনে একেবারেই বিশ্বাসী নই। সাহিত্যের গতি দশ বছর অন্তর পাল্টায় না। এমন কোনও নিয়ম নেই। কোনও বিশেষ সাহিত্যের ধারা হয়তো দশ বছর বা পঞ্চাশ বছর থাকতে পারে। তার পরে হয়তো পাল্টায়। দশক বিভাজন করলে একটা সুবিধা হয় এই যে, অনেক কবির নাম ঢুকিয়ে দেয়া যায়’। ......... যারা সারাজীবন হয়তো একটিও কালোত্তীর্ণ কবিতা, উপন্যাস,  কিংবা ছোটগল্প লিখতে পারেননি, কিন্তু কবি কিংবা কথাশিল্পী হিসেবে সহজে আত্মপ্রচারের সুযোগ নিতে ও পেতে চান, তারাই দশকবিভাজনে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। মূলত দশকবিভাজনে আগ্রহী তারাই, যারা সাহিত্যের নানা বাঁক ও প্রবণতা শনাক্তিতে অসমর্থ। সমকালীন সাহিত্যরুচির উত্তাপ উপলব্ধিতে ব্যর্থরাও জনরুচি সাহিত্যরুচিকে একই গ্লাসে গুলিয়ে পান করার পক্ষে।”

প্রবন্ধের উপসংহার খুবই প্রণিধানযোগ্য। পুরো বইয়ের নির্যাস স্থিত এই ক’টি লাইনে: “আত্মপ্রসাদের কর্মযজ্ঞে দশকবাদী বনসাঁইরা আত্মরতিতে ভুগলেও সে-আত্মরতি অচিরেই আত্মগ্লানিতে পরিণত হয়। তখন প্রকৃত মহীরুহ সমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। অতএব কালের বিবর্তনে, বিকৃতির ধুলোর আবরণ মুছে গেলে, দশকভিত্তিক সংকলন ও গদ্য থেকে বাদপড়া কিংবা সেখানে অবমূল্যায়িত হওয়া কবি-লেখকরাই যে কালের বিচারে শ্রেষ্ঠ’র আসনগুলো অলংকৃত করবেন, সে-ব্যাপারে সন্দেহ কী!”

‘কবিতার অবয়ব ও আন্তঃসংগঠনপ্রক্রিয়া’ : কবিতার আকার বা গঠন কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে বিচার করা সম্ভব নয়। কবিতা দুই থেকে দুই হাজার লাইনেরও হতে পারে। ভাব ও  বক্তব্য প্রকাশের ধরনই বেঁধে দেয় এর অবয়ব-কাঠামো। লেখক বলছেন, “কবিতা হয়ে উঠার জন্য মৌলিক অনুষঙ্গ,ছন্দ-ভাষা যথোপযুক্ত অলঙ্কার অনিবার্য।........... কবির প্রত্যক্ষণে যে বস্তু দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠে না কোনো মতে; সে বিষয়াবলীও কবির বলার ঢংয়ে পাঠকমনে বিশ্বস্ততার সঙ্গে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বস্তু বা বিষয়ের বৈশিষ্ট্যের চেয়ে বলার ভঙ্গিই মুখ্য”।

‘কাব্যসত্য ও পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষা’ : প্রবন্ধটিতে স্বল্প পরিসরে কবিতার চিরন্তনতা, স্থায়ীত্ব ও অবিনশ্বরতা এবং এর সাথে ‘পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তির অন্বেষা’র চমৎকার সাযুজ্য অনন্য সাবলীলতায় উপস্থাপিত হয়েছে:  “ সাহিত্যেও সত্য চিরন্তন। চ-ীদাস সে প্রাচীন যুগে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘শোনো হে মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।  দেবদেবীর মাহাত্ম্যকে ম্লান ক’রে দেয়া  সে অমোঘ উচ্চারণ আজও যুক্তিনিষ্ঠ মানুষের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে সমান ঢেউ তুলতে সক্ষম। ......... কাব্যসত্যের সঙ্গে বস্তুসত্যের পার্থক্য বস্তুগত, চেতনাগত নয়। বুদ্ধি বৃত্তিক অন্বেষার  উত্তর হয়তো এখানেই নিহিত। যেখানে অন্তরের সত্যকে নির্ভিকচিত্তে ঘোষণা করেন কবি, সেখানেই জ্ঞানের, নন্দনের, দর্শনের নানা ¯্রােত এসে একটি বিপুল ঘূর্ণনের সৃষ্টি করে। তারপরই নিখিলসমুদ্রসঙ্গমের আয়োজন সম্পন্ন হয়। সে সঙ্গমোত্তর ফলাফল বিশ্লেষণেই স্পষ্ট হয় পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষার অমোঘ ও অবিনশ্বর উত্তর।”

‘মানবমনের অনন্ত জিজ্ঞাসা ও কবিতার শত্রু-মিত্র’ : অন্যতম উপভোগ্য একটি আলোচনা। প্রিজমের মতো নানাদিকে আলোক-বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়ে আবছায়া থেকে আভাময় করা হয়েছে কবিতার বৈরীতাকে। এখানে কবিতার শত্রু হিসেবে ধর্ম, সমাজ, তত্ত্বপ্রচারক, সাম্প্রদায়িক মনেবৃত্তি, অসাহিত্যিক মনোবৃত্তি, রাজনীতি, এক সময়ের রাজা-বাদশাহ, এমনকি কবি ও উপকবির দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে। মনের জিজ্ঞাসা উপস্থাপিত হয়েছে ঐতিহাসিক অনন্য এক উদাহরণের মাধ্যমে : “ মানবমনের অস্ফূট প্রশ্নের উত্তর জমা থাকে সংবেদনশীল মানুষের কাছেই। প্রশ্নশীল চারিত্র্য কি মানুষকে শিল্পী ক’রে তোলেনি? যে বেদনাবোধ থেকে সফোকিস কিং ইডিপাস লিখে মানবজাতিকে অনন্ত দু:খের কাহিনী শুনিয়েছিলেন, সে মর্মযাতনার মূলেও মানবাতœার অনন্তজিজ্ঞাসা উপস্থিত। ....... সমকালীন বাংলা সাহিত্য কি অনেকটা দলীয় রাজনীতিদুষ্ট? কিছুটা বৃত্তবদ্ধের স্বার্থশ্লিষ্ট? পুরো ডানপন্থী ও বামঘরানায় বিভক্ত। তার প্রভাব সাহিত্যেও পড়েছে। মানুষ আপন সমাজের প্রভাব সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে না। স্বসমাজের অভ্যাস আচরণ রপ্ত ক’রে যে কবি-কথাশিল্পী আত্মপ্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, তার পক্ষে সে বৃত্ত ছাড়িয়ে বৃত্তহীন হওয়া সম্ভব নয়। বিপরীত দৃশ্যও রয়েছে। নিরন্তর চেষ্টায় স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যকে পরিমার্জিত ক’রে মার্জিত রুচিবান হয়ে ওঠার প্রমাণও আছে। বৃত্তের ভেতর থেকে বৃত্ত ভাঙার ঔদার্য দেখানো কবি-সাহিত্যিকও রয়েছেন। হৃদয়ের ঔদার্য দিয়ে সমস্ত সংকীর্ণতাকে জয় ক’রে মানবমনের অর্ন্তলীন বাসনার ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন এমন কবি সংখ্যাল্প হলেও দুর্নিরীক্ষ নয়। সে সংখ্যাল্প কবি-কথাশিল্পীর আত্মোন্মচনই সাহিত্যকে গতিশীল রাখে।..........  প্রচারমাধ্যমের দৌরাতেœ্য প্রকৃত শিল্পী আপাতত অপরিচয়ের আড়ালে প’ড়ে যান। কবিতার সবচেয়ে বড় শত্রু ‘উপকবি’। এ উপকবিই পাঠকমনে কবিতাসম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম দেয়ার জন্য দায়ী। তাই ‘উপকবি’কে কবির ছায়ার নিচে মাড়িয়ে দিলে সে ছায়া থেকে বড় কবির আত্ম-উদ্বোধন সম্ভব।”

আলোচনা-বইয়ের আলোচনায় বাড়তি কোনো কথা বলা থেকে যথাসম্ভব বিরত থেকেছি। শুধু আলোচ্য বিষয় মৃদু উন্মোচনের অভিপ্রায়ে লেখকের উদ্ধৃতির আগে আগে বলেছি দু’কথা। বিশটি প্রবন্ধের বিস্তৃত ভূমিতে বিচরণও এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয় কোনোমতেই। মাত্র আটটি প্রবন্ধের মর্ম থেকে লেখকের লেখনীর মনন-চিত্র উদ্ভাসিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যাতে পাঠকের বইটি পড়বার সাগ্রহী মন তৈরি হয়ে ওঠে সহজেই ।





        



বই আলোচনা ।। রনজু রাইম-এর কাব্যগ্রন্থ ‘দেবতাগণ’ : মুগ্ধ ভাবনার প্রস্ফুটন ।। রেজা নুর



কিছু কিছু কথা আছে যা চম্কে দেয়। সেই চমকে থাকে মুগ্ধতা। অভিনব অনুভূতি। কবিতার বেলায় এর মুখোমুখি হতে হয় বেশী ক’রে। প্রতিদিনের অনুভব আবেগ দৃষ্টির তুলিতে এঁকে শব্দ সাজিয়ে কবিতার শরীর গড়ে তোলেন কবিরা। আমরা কথার রকমারিতে সাজাই সারাটা সময়। দৈনন্দিন কথোপকথনের বেলায় সাদামাটা শব্দই সই। তবে বিশেষ কোনো ভাবনা, ভাললাগা, অনুভব, অভিজ্ঞতা শিল্পময় ক’রে তুলতে হলে তা শিল্পিত উপস্থাপনা দাবী করে। কবিতা সেইরকম শিল্পের সবচেয়ে মার্জিত, নন্দিত ও ফুলেল শিল্প-সুষমা।

কবি রনজু রাইমের কাব্যগ্রন্থ “দেবতাগণ”-এর কিছু কবিতা আমার অনুভব ও ভাবনায় অন্যএক দ্যোতনা এনেছিল। চারটি কবিতা পড়েছিলাম একদিন ---  ‘গরুগ্রাম’ , ‘ক্ষমতা’, ‘ছাতা’ ও ‘জানালামাত্র’। ‘গরুগ্রাম’ নামটা আনকোরা আকর্ষণে টেনে নিলো:
 ‘গরুগ্রামের মানুষেরা কৃষিজীবী নয়--  গরুজীবী
বিস্তর ফসলি জমিতে গরুদের জন্য তারা
                               ঘাসের আবাদ করে
নগরে নগরে তারা ফেরি করে গরুর খাঁটি দুধ’
(কবিতা /   গরুগ্রাম )

গল্পের আদলে সমাজের ‘দেবতাগণ’ সম্পর্কে  চমৎকার সাবলীলতায় ইঙ্গিত এগিয়ে গেলো  শেষ শব্দটি পর্যন্ত।

‘ক্ষমতা’য় শুরুর তিনটি লাইন টেনে নামাল যেন জলে,--- ‘সীমাবদ্ধ জলে’।  যেখানে ‘সামর্থ্যের সবটুকু খেলা’ দেখানো কঠিন, কারণটা ওই সীমাবদ্ধ জল। গন্ডী নির্দিষ্ট। সামর্থ্য বিস্তৃত বা অবারিত হবার ক্ষেত্র থেকে বঞ্চিত হয়। তবে যারা ‘পরিহাসপ্রিয়’ তারা ‘অক্ষমতার দায়’ ঠিকই চাপিয়ে দেয় ‘কাঁধে’।
‘কেননা এ যুগের পা-িত্য যে কেবল মূর্খদের দখলে।
 তোমাকে ওজন দেবে তারা বামনের খেলনা নিক্তিতে
সমুদ্র সমুদ্র বলে হাঁক ছাড়লেও  তোমাকে ডোবার
                   ঘোলাজলেই সারতে হবে ¯œান
( কবিতা /  ক্ষমতা )
‘ছাতা’ কবিতাটি ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় অসঙ্গতি উপস্থাপনের এক চমৎকার উদাহরণ :
“ছাতা এবং মাথ এ দুয়ের সম্পর্কও
                              সুদূর পরাহত
তবুও কত ছাতামাথার ঝক্কি পোহাতে হয়—
....................................................
কারো কারো মাথার ভেতর ছাতা --  ওপরে নয়
                  বলছি এবার তাদেরই কথা ”
( কবিতা / ছাতা )

‘জানালামাত্র’ খোলা হাওয়ার হিমেল স্পর্শের মতো আবেশ নিয়ে আসে। মিহিজলের কল্লোলে ছন্দসুর রিনিরিনি ঝংকৃত হয়ে চলে যেন। আলতো ভেসে যায় যেমন জলের বুকে ঝরাফুল, পাতা, বা শেওলার সাদাটে বেগুণী ফুলের ঘূর্ণিময় চঞ্চলতা। পাঠকের ভাললাগা, ভাবনার প্রস্ফুটন বিমোহিত হতে হতে এগোয় এর লাইনের পরতে পরতে। শেষের দুটো প্যারা :

 “আমার আছে দুটোমাত্র চোখ
দৃষ্টি যে তার অভিন্নতা ঘিরে
 দেহের ভিতর যা কিছু উন্মুখ
যায় হারিয়ে অদেখাতে ফিরে

ঘর জুড়ে ¯্রফে একটি জানালা
দুই পাট তার যুগল চোখের মতো
যদিও ঘওে রুদ্ধ লোহার তালা
প্রাণটুকু এই দুর্গে অরক্ষিত -- ”
( কবিতা /  জানালামাত্র )


এ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের অন্যান্য কবিতা ভিন্ন ভিন্ন পশরা নিয়ে আসে পাঠকের সামনে। এখানে যেমন আছে গূঢ় ভাবনার গভীরতা। আছে ‘ঘরহীন’ এই সুখের রাজ্যপাট’-এ ‘মগ্ন দুপুরে পথের পাশে’র ‘নদীর বুকে নৌকো’ ভাসানো আর ‘পাখিদের কুজন’ শুনবার আহবান” :
“ঘরহীন এই সুখের রাজ্যপাট
নগর কি আর অট্টালিকায় আছে
বৃক্ষলতা অচেনা পথ-ঘাট
হৃদয় খুলে ডাকছে বুকের কাছে
( কবিতা / মগ্ন দুপুর )

‘অন্দর-বাহির’-এ পাঠকের ভাবনা ঘিরে এক দোলাচল চঞ্চল হয় যখন কবি বলেন, ‘কোন্ ফুলের কেমন সৌরভ তা-কি ফুলবিক্রেতা জানে?’ অথবা :
“এ কালের মানুষেরা গুণবিচারী নয়, দেখে বাইরের সাজ
ইান্দনিক পরিচর্যার কথা তারা যেন ভুলতেই বসেছে
বুঝতে চায় না তারা মেয়েদের গৃহবাসী মন --
বেকার মুহূর্তে সেই মেয়েরাও জানে না বিভোর সন্তরণ
( কবিতা  :  অন্দর বাহির )


‘দেবতাগণ’ কাব্যগ্রন্থে নানা আকৃতির কবিতার সমাবেশ রয়েছে। তিন লাইন থেকে ক্ষুদ্রতম দুই লাইনের কবিতাও নজরে আসে। যেমন, ‘কবিতার পাঠক’ :
“কবিতা না বুঝলে তুমি চিরদিন অবুঝই রয়ে যাবে
অ-কবিতা  বোঝো যে তা-ও শিল্পীত জ্ঞানের অভাবে--”

তাঁর কতকগুলো ব্যাঙ্গাত্মক কবিতার উপস্থাপনা এরকম : “গৃহবিবাদ মেটাতে না পারা অক্ষম মানুষ তিনি / রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর ঝাড়লেন ব্যক্তিগত ব্যর্থতার খেদ” ( কবিতা : টকশো ) । “মনে মনে নিজেকে মহারাজা ভাবলে /  বাধা দেবে কে আর বলো -- / কেননা সবারই তো জানা আছে / পাগলের সুখ মনে মনে” ( কবিতা :  লাগাম ) । “শেখানো বুলিতে  তোতাপাখি / হওয়া যায় / কবি হওয়ার জন্য চাই / স্বাধীনভাবে ডাকবার  /  গান গাইবার ক্ষমতা” ( কবিতা : কারুবাসনা ) ।

প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন স্মরণে কবি রনজু’র কবিতা ‘হোমওয়ার্ক’ নস্টালজিকতায় আচ্ছন্ন করে। ভালো লাগে যখন তিনি তার ‘নাট্যগুরু’ সম্বন্ধে বলেন : জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী যে ঝুলন্ত রেখা / তোমার চাকা সেখানেও পথ ক’রে নেবে” ।

‘একনায়ক’-এ সাহসী উচ্চারণ নতুন উজ্জীবন দান করে : “এমন কোনো আগুন নেই পোড়াবে আমার মন”। গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘অনুসনেট’-এর নিচের দুই লাইনের চিত্রকল্প সকরুণতায় ধরা দেয় :
“সফেদ পায়রাগুলো শিকারীর জালে ধরা নিল
পালকে পালকে লেখা সেই সব করুণ কাহিনী

বেশকিছু লাইন ও শব্দ-সমষ্টি  মুগ্ধকর । যেমন : ‘ডানাখসা পালকের আশকারা বাতাসে আজ আকাশ মাতায়’, ‘শীতঘুমে তারা অলস ওমে’ ( কবিতা : পাখিদের ডায়রি ), ‘শাখার আদর’ , ‘বাইরে রক্ষাব্যুহ ভিতরে অনন্ত দ্রোহ’, ‘ঘুমের সঙ্গে রাতভর’, ‘অবিকল্প হাতছানি’, ‘ঝনঝন ক’রে ওঠে বিবাদ আর বিভেদের তরবারি’, ‘কত কী সম্ভোগ আছে তবু কেন প্রেম নিয়ে ছলা / বাহারি গোলাপগুলো সেই শোকে বিষণœ অবলা’, ‘নৈ:শব্দের রাজাধিরাজ’, ‘ক্ষমা পেয়ে আপনি তো নিজেকে শোধরালেন না’, ‘ভালোবাসার নেই তো ফিতে-গজ’, ‘স্বঘোষিত দেবতারা পুজো চায় নানান ছলে’, ‘সবকিছু প- করেছেন বলেই তো তিনি আজ যথার্থ প-িত’, ‘প্রণয়ের কৃষ্ণসাধক’. ‘ভিক্ষালব্ধ ধনে বলো তুমি কতদূর যাবে’, ‘পদ লেহনে পদক’, ‘ গোষ্ঠী বিচারী কবি’ ইত্যাদি।
কতকগুলি শব্দের বানান ও সঠিক শব্দ-রূপের দিকে খেয়াল করলে ভাল হতো।  যেমন, ‘দোষারূপ ( দোষারোপ ), ‘বুঝে’ ( বোঝে), ‘বুঝো’ ( বোঝো )। এগুলো হয়ত মুদ্রণ-প্রমাদ। তবুও কবিতার বই শতভাগ মুদ্রণ-শুদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয় বোধ হয়। কবি রনজু রাইম-এর কাব্যচর্চায় বাংলা কবিতার অংগন আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক।