বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০১৪

ভয়াবহ রাতদিন ॥ তপন বাগচী



ধোঁয়ায় ছেয়েছে গাজার আকাশ_ বোমা-বন্দুক-গুলি
বিশ্বমোড়ল চুপ করে আছে দুচোখে দিয়েছে ঠুলি॥

ইসরাইলের বোমার আঘাতে জ্বলছে ফিলিস্তিন
নিরীহ মানুষ কোথায় পালাবে_ ভয়াবহ রাতদিন।
মানুষ মরছে, ভরছে কেবলি যুদ্ধবাজের ঝুলি।
বিশ্বমোড়ল চুপ করে আছে দুচোখে দিয়েছে ঠুলি॥

আমরা মানুষ প্রতিবাদ করি_ ঘৃণ্য এ হামলার
চাই না কোথাও এক ফোঁটা খুন কখনো ঝরুক আর!
চাই না উড়ুক মায়ের কিংবা শিশুর মাথার খুলি।
বিশ্বমোড়ল চুপ করে আছে দুচোখে দিয়েছে ঠুলি॥

বার বার-বার আসে//মহীবুল আজিজ


এই ফুল হয়তো বুধবারে ফুটেছিল
বুধবারে আমি দেখি নাই
তবে সেটা মঙ্গলেরও তো হতে পারে
নাকি সোমের
রবির কী হতে পারে
মনে হয় না
বৃহস্পতিতেও ফোটে ফুল এবং
বুধের ফুলেদেরও কিন্তু তখন ফুল্লত্ব বজায় রয়েছে
বৃহস্পতিবারে বুধের কিছু ফুল দেখি
বৃহস্পতিরও দেখি
কিন্তু আমি বুধের কিছু ফুলকে হয়তো
বৃহস্পতির বলে মনে করি
হয়তো সেগুলো বৃহস্পতিতে ফোটা ফুলের চেয়েও
প্রফুল্ল রয়ে যায় ও তাদের বুধত্ব পেরিয়ে
এমনকি তারা শুক্রে এসেও
দুনিয়ায় দারুণ রঙিণ দেখায়
শুক্রেও ফুল ফোটে এবং
বুধ বৃহস্পতি শুক্র মিলে
ফুলেরা বাড়তেই থাকে
এর মধ্যে অবশ্য কিছু ফুল মরে যেতে থাকে
শনিবারে আমার হিসেব মেলে না
মরে যাওয়া ফুলটি কী বুধের না বৃহস্পতির
নাকি শুক্র’র
শুক্র’র ফুল কী শনিতে মরে
কোন্ ফুল কি বারে মরলো তাতে কার কী লাভ
মানুষেরাও তো কোন না কোন বারে মরে
বার কি কারও মনে থাকে!

রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৪

ওয়ালিদ খাজিন্দার অদৃশ্য আলো । ভাষান্তর : অজিত দাশ



দেখো, নির্মম ঠান্ডায়

নগ্ন গাছে ঝুলে আছে শীতের মৌসুম

তোমার হাতের মুঠো থেকে

ছোট্র পাখিটিকে মুক্ত করে দিয়ে

একটু স্থির আর লাজুক হাসি দাও

আমি দেখি নিদারুন মানসিক যন্ত্রণা

আমরা কি গাইবো আবার !

যেভাবে উষ্ণ ছিলাম- হাতে হাত রেখে,

জ্বলজ্বলে সূর্য থেকে একটু ছায়ায়

আমরা কি এভাবে থাকতে পারিনা?

প্রয়োজনের চেয়ে আরো সুদৃশ্য করে

আলো জ্বালাবো, একটু নীরবে?

অন্ধকার ক্রমশ বাড়ছে; আমাদের সতর্ক হতে হব

এবং এই অদৃশ্য আলো আমাদের একমাত্র ভরসা-

এই বিপন্ন শিখা,  শুরু থেকেই জ্বলছে
ঝিকিমিকিয় হয়ে, আসন্ন বিপদের দিকে
  
আমার কাছে আসো, আরো কাছে...

আমি অক্ষম- কিছুতেই বলতে পারি
না
আমার হাতে হাত রাখ

চলো জেগে থাকি যেনো শুভ্র ঝরে

আমাদের প্রাণ না চলে যায়

[ওয়ালিদ খাজিন্দার ১৯৫০ সালে গাজায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফিলিস্তিনের একজন খ্যাতনামা কবি। ১৯৯৭ সালে প্রথম ফিলিস্তিনি হিসেবে কবিতায় পুরস্কার লাভ করেন। ]

ইউক্রেন-গাজা ও বৃহৎ শক্তির ভূমিকা ।। তারেক শামসুর রেহমান



গাজায় ইসরাইলি সামরিক আগ্রাসন ও ইউক্রেনে একটি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ভূপাতিত করার ঘটনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় ধরনের ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এ দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূমিকা আবারো উন্মোচিত হলো। নিঃসন্দেহে ইউক্রেনে বিমান ধ্বংস ও ২৯৬ জন যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা একটি বড় ধরনের অপরাধের শামিল। তবে গাজায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী যে হত্যাকা- চালিয়েছে, তার অপরাধ কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, ইউক্রেনের ঘটনায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং একটি আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু গাজায় ছোট ছোট শিশুদের যখন হত্যা করা হয় এবং শিশু ও নারীদের হত্যাকা-ের খবর যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলে, তখন জাতিসংঘ থাকে নির্বিকার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ফোন করে ইউক্রেনের ঘটনার প্রতিবাদ করেছন। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরো শক্ত অবস্থান নিতে তিনি তার ইউরোপীয় মিত্রদের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু শিশুদের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে কোনো নির্দেশ দেননি গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ করতে। এখানেই এসে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈত নীতি। গণতন্ত্র তথা মানবাধিকার সংরক্ষণের তথাকথিত উদ্যোক্তা পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থ যেখানে বেশি, সেখানেই তারা সোচ্চার। যেখানে স্বার্থ নেই, সেখানে তারা সোচ্চার নয়। গাজায় যখন মানুষ মরছে এবং গাজা একটি বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে, সেখানে তাদের বিবেক এতটুকু জাগেনি। বরং রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্যই ইউক্রেন ইস্যুটিকে তারা মুখ্য করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে, যাতে উত্তেজনা বাড়ছে। প্রথমে ক্রিমিয়ার গণভোট ও রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির সিদ্ধান্ত, পরে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার ও ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তের পর ঘটল মালয়েশিয়ান বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা। এ ঘটনায় কোন পক্ষ জড়িত, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা প্রচারণা চলছে এবং রাশিয়াকে ইতোমধ্যে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ইউক্রেন সঙ্কটকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর। বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপকভাবে আলোচিত। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইউরোপে দুই পরাশক্তির মাঝে প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের। দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউপোপে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল, একসময় তা ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্বে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ও দেশটি ভেঙে যাওয়ার পরই আবসান ঘটে এ স্নায়ুযুদ্ধের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোয় রাশিয়ার উত্থান ও বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করার প্রবণতা এবং সর্বশেষ রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ ইউক্রেনের সীমান্তে সেনাবাহিনী পাঠানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার যে বৈরিতার জন্ম হয়েছে, তাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা আখ্যায়িত করেছেন স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে। এর আগে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান সেনা পাঠানোর ঘটনা এ অঞ্চলে বড় ধরনের উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। শুধু ইউক্রেনই নয়, বরং পাশের পোল্যান্ডের নিরাপত্তাও এখন হুমকির সম্মুখীন। এ নিরাপত্তাহীনতা এখন এ দেশগুলোকে এবং সেই সঙ্গে জর্জিয়াকে আরো বেশি মাত্রায় ন্যাটোর ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। এ দেশগুলো, সেই সঙ্গে তার পাশে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, অন্যপাশে জর্জিয়া, কৃষ্ণ সাগরভুক্ত অঞ্চল। তুরস্ক রয়েছে অন্য পাশে। ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে এ অঞ্চলে ন্যাটোর যে সম্প্রসারণ ঘটেছে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই ক্রিমিয়ায় সৈন্য পাঠিয়েছিল রাশিয়া। এ অঞ্চলজুড়ে ন্যাটোর যে সম্প্রসারণ ঘটেছে, তা রাশিয়ার নেতারা শুধু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণই করছেন না, বরং এ সম্প্রসারণ যে তাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ তা তারা একাধিকবার বলেছেন। একসময় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ সামরিক জোটের (বিলুপ্ত ১৯৮৮) সদস্য ছিল। এখন এ দেশগুলো (রোমানিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বাল্টিক দেশগুলো, চেক, বুলগেরিয়া) ন্যাটোর সদস্য। ঐতিহাসিকভাবেই ক্রিমিয়ার বন্দর সেভাস্টোপোলে রয়েছে রাশিয়ার নৌবাহিনীর বিশাল উপস্থিতি। কৃষ্ণ সাগর বা ব্লাক সির পশ্চিম পাশে রোমানিয়ার মিহাইল কোগালনাইসেআনুতে রয়েছে ন্যাটোর বিমানঘাঁটি। এ ঘাঁটির গুরুত্ব অনেক। আফগানিস্তানে সেনা ও রসদ সরবরাহের জন্য ট্রানজিট রুট হিসেবে এ বিমানঘাঁটিটি ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্ব আরো একটি কারণে। এখানে অবস্থান রয়েছে ন্যাটোর জয়েন্ট টাস্কফোর্স ইস্টের। কৃষ্ণ সাগরভুক্ত তিনটি দেশ রোমানিয়া, বুলগেরিয়া আর তুরস্ক নিয়ে ন্যাটো গেল বছর তাদের তিন মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছিল। এটা রাশিয়ার ওপর এক ধরনের স্নায়বিক চাপ। ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অনেক দিক থেকেই কৃষ্ণ সাগরভুক্ত এলাকা, সেই সঙ্গে কাস্পিয়ান সাগরভুক্ত অঞ্চলকে ‘হট এরিয়া’, অর্থাৎ উত্তেজনাপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন। সুতরাং ক্রিমিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ রাশিয়ানদের (জনসংখ্যার ৫৯ ভাগ, প্রায় ২০ লাখ) নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই যে শুধু রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছিল, তা বিবেচনায় নিলে ঠিক হবে না। রাশিয়ায় ‘নয়া জার’ নেতৃত্ব রাশিয়ার নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ক্রিমিয়ায় বসবাসকারী রাশিয়ানদের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের নিজেদের ভূখ-গত নিরাপত্তার বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পুরো কৃষ্ণ সাগরভুক্ত অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব করার জন্যই ন্যাটোর দরকার জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেয়া। তাহলে রাশিয়ার সীমান্তে উপস্থিত থাকবে ন্যাটোর সেনাবাহিনী। এটা রাশিয়ার ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ। রাশিয়ার সমরনায়করা এটা যে মেনে নেবেন না, তা-ই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, গেল বছর কৃষ্ণ সাগরে ন্যাটো ও জর্জিয়ার নৌবাহিনী যৌথভাবে একটি সামরিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল, যা রাশিয়া খুব সহজভাবে নেয়নি। ক্রিমিয়ার ঘটনার রেশ ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে। কার্যত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে তখন আর ইউক্রেন সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই। এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা, যারা ক্রিমিয়ার মতোই রাশিয়ার অংশ হতে চায়। আর এ অঞ্চলেই মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের বিমানটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হলো। তবে এ হামলা কারা চালিয়েছে তা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। অভিযুক্তদের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তারা অবশ্য হামলা চালানোর কথা অস্বীকার করেছে। ইউক্রেন সরকারকেও অভিযুক্ত করা হচ্ছে। মার্কিনি ভূমিকাও সন্দেহের বাইরে নয়। কেননা ন্যাটোর পূর্বমুখী যে সম্প্রসারণ, তার প্রধান উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই চাচ্ছে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দুটো দেশÑ জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য হোক। তাহলে ন্যাটোর তথা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এ দুই দেশে মোতায়েন করা যাবে। ফলে চাপের মুখে রাখা যাবে রাশিয়াকে। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার জ্বালানিসম্পদ, বিশেষ করে গ্যাসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হবে। তাই পুতিন যে এই মার্কিনি স্ট্রাটেজি বোঝেন না তা ভাবা ছিল ভুল। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়ার সঙ্গে সীমিত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর উপস্থিতি রাশিয়া মেনে নেবে না। এর পরই ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ইউক্রেন সঙ্কটকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া পরস্পর ‘বাগ্যুদ্ধে’ অবতীর্ণ হয়। ইউক্রেনকে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ইউক্রেনকে রাশিয়া তার ইউক্রেন পাইপলাইন বন্ধ করে দিয়েছে। আর এতে করে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া আর সার্বিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এ তিন দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। পরিসংখ্যান বলছে, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ সংস্থা গ্যাসপ্রোমের ইউক্রেনের কাছে পাওনা রয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার। এ টাকা এখন ইউক্রেন কীভাবে শোধ করবে? এ সঙ্কট এখনো যুদ্ধের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। রাশিয়া ইতোমধ্যে ইউক্রেনকে বাইপাস করে কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে একটি পাইপলাইন তৈরি করছে। সমগ্র ইইউর গ্যাস চাহিদার ৩০ ভাগ একা জোগান দেয় রাশিয়া। আর জার্মানির ৪০ ভাগ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ওই গ্যাস আগামী দিনে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হবে ইউরোপের রাজনীতিতে।
ইউক্রেনের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রহ এ কারণেই তৈরি হয়েছে। সেখানে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে রাশিয়া সমর্থিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইয়াকোনোভিচকে উৎখাত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং একজন পশ্চিমা রাজনীতি সমর্থক ধনকুবের সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এ অঞ্চলে মূলত এক ধরনের ‘প্রস্ক্রি ওয়ার’ চলছে। এ প্রস্ক্রি ওয়ারটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার। অন্যদিকে গাজায় পশ্চিমা স্বার্থ তুলনামূলকভাবে কম। গাজায় তেমন সম্পদ নেই। এখানে যে গণহত্যা চলছে, তাতে পশ্চিমা বিশ্ব নিশ্চুপ। যা প্রতিবাদ হয়েছে, তা শুধু উন্নয়নশীল বিশ্বে। এমনকি আরব বিশ্বেও তেমন বিক্ষোভ হয়নি। বাংলাদেশ সরকার গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলার নিন্দা জানালেও, ভারতে মোদি সরকার ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করেনি। নিন্দা প্রস্তাবও নেয়নি মোদি সরকার। তুরস্ক সোচ্চার হয়েছে বটে, কিন্তু ইসলামিক ঐক্য সংস্থা কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। অনেকেই মনে করেন অনেক আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনে ইসরাইল সম্পর্ক রক্ষা করে। তুরস্কসহ কিছু কিছু আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে (মিসরসহ) ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি পাকিস্তানও গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে, যা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয় না।
 শিশু ও নারীদের হত্যা করে ইসরাইল আরো একবার তাদের আগ্রাসী চেহারা উন্মোচন করল। এখন ইসরাইলের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার জন্য মামলা দায়ের করা যেতে পারে। বসনিয়ার মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যদি দ্য হেগের আদালতে বিচার হতে পারে, যদি বুরুন্ডি ও লাইবেরিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হতে পারে, তাহলে আজ গাজায় গণহত্যার জন্য নেতানিয়াহু ও তার সহকর্মীদের বিচার হওয়া উচিত। উদ্যোগ নিতে হবে তথাকথিত গণতন্ত্রী পশ্চিমা বিশ্বকেই। গাজার হত্যাকা- আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব ধরনের অন্যায় আর অবিচারের প্রতিবাদ করার। বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা আজ জরুরি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত। আর এ প্রতিবাদটিই করতে হবে উন্নয়নশীল বিশ্বকে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান: আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক

ঈদোৎসবের সমাজতত্ত্ব ।। বীরেন মুখার্জী




Biren Mukherjee

উৎসবপ্রিয় জাতি হিসেবে বাঙালির সুনাম রয়েছে। উৎসবে মেতে ওঠার এ রেওয়াজ বাঙালির দীর্ঘদিনের। শত প্রতিকূল পরিস্থিতি উপেক্ষা করেও দেশে-বিদেশে বাঙালি জাতিকে নিজ নিজ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, সামাজিক-পারিবারিক পরিপ্রেক্ষিত, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবস, এবং জাতিসত্তাভিত্তিক সংস্কৃতি পালনে নানা উৎসবে মেতে উঠতে দেখা যায়। বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসব এবং বাঙালি সংস্কৃতি নবায়নে অনুষ্ঠিত উৎসবগুলো জমকালো অনুষ্ঠানের মর্যাদা পায়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাধারণত দুটি রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। একটি শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা, অন্যটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সংক্ষিপ্ত পরিসরে, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে সত্য; কিন্তু এসব উৎসবের সামাজিক দিকটিরও গুরুত্ব বিশাল। কর্মব্যস্ত জীবনে ধর্মীয় উৎসবের সামাজিক দিকটি মানুষের জীবনে যোগ করে নতুন মাত্রা। উৎসবের ব্যবহারিক দিকে যেমন সার্বজনীন চেতনা লক্ষণীয় তেমনি এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। সময়-কাল ও যুগরুচির বিবর্তনের ফলে উৎসবের প্রকৃতি পাল্টায়। এতে যোগ হয় নতুন নতুন উপাদান। আবার বর্জিতও হয় অনেক কিছু। বর্তমানে ধর্মীয় উৎসবাদির যে আনুষ্ঠানিকতা তা আজ থেকে একশ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। ‘উৎসব এখন একটি প্রথা। আর, প্রথা মাত্রেই সামাজিক পরিবেশের ফল।’১ এই পরিবেশ গড়ে ওঠে সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা প্রপঞ্চের সহায়তায়, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ তার জীবন ধারণের প্রয়োজনে একটা না একটা উপলক্ষ খুঁজে মেতে উঠেছে ক্লান্তি নিরসনে। এই উপলক্ষ বা উৎসবই কালের বিবর্তনে মানুষের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির একটি অংশ হিসেবে মান্যতা পেয়েছে এই ‘উৎসব’, যা বিনোদন লাভেরও একটি অন্যতম মাধ্যম।

ঈদোৎসব ইসলাম ধর্মালম্বীদের আধ্যাত্মিক জীবনে আত্মসংযম ও আত্মবিনোদনের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। রমজানের সময় দীর্ঘ এক মাস ধরে আত্মসংযমের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের প্রতি যে ভক্তি আর মনের বিশুদ্ধতা অর্জিত হয়, তাতে মানুষের মনের কুপ্রবৃত্তিগুলো দমিত হয়ে মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সুখী করে তোলে। রমজানের শিক্ষা হলো বিশুদ্ধ জীবনচর্যার মধ্যদিয়ে কলুষমুক্ত সমাজ গঠন। এটা ঈদুল ফিতরের স্পিরিচুয়্যাল দিক। আর উৎসবের ব্যবহারিক দিক হলো, ধনী গরিব নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মুসলিম মানব, সমান অধিকার নিয়ে ঈদের নামাযে সমবেত হয়ে একটি আদর্শ মানবসমাজের সৃষ্টি করেন। যেখানে ভক্তি, প্রেম ও সমান সাহচর্যের প্রতিফলন আশা করা হয়। উৎসব মানে যাবতীয় ভেদাভেদ ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, শুভেচ্ছা আর কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে অন্তরের উষ্ণ স্পর্শ গ্রহণ। বিশ্বব্যাপী মুসলিম অধ্যুষিত দেশে এই ধর্মীয় উৎসবটি উদযাপিত হয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বন্ধন হিসেবে। উৎসবটির সর্বজনীন দিক হলো, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ ঈদের আনন্দের অংশীদার হতে পারেন শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে এবং মুসলিম ভাইদের আতিথ্য গ্রহণ করে। এটা সামাজিক রীতিরই অংশ। এর আরও একটি সর্বজনীন দিক আছেÑউৎসবটি কেবল বাঙালি মুসলমানের নয়, বিশ্বে ইসলাম ধর্মের অনুসারী বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও ভাষাভাষী মানুষও একই উদ্দেশ্য নিয়ে এটি পালন করে থাকেন। সেটি হলো সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, আনন্দ ও ঈশভক্তি লাভ। তবে বাঙালি তার ঐতিহ্যসূত্রে পাওয়া চিরকালীন নিজস্ব সংস্কৃতিকে উৎসবের সঙ্গে যোগ করতে ভোলেন না। ধর্মীয় বাধানিষেধ যাই-ই থাক, ঈদুল ফিতর বাঙালি যখন উদযাপন করেন তখন তাতে বাঙালির কৃষ্টিসভ্যতার ছোঁয়া স্পষ্ট করেই ছায়া ফেলে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘকাল সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছে। এদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের। আর মুসলমানের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর, যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত। শাব্দিক অর্থে ‘ঈদ’ অর্থ খুশি। ধর্মীয় ভাবে ঈদ পালিত হয় সকালে জামাতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়ের মধ্যদিয়ে।  লৌকিক আনন্দ লাভের অংশ হিসেবে যথাসাধ্য নতুন, পরিচ্ছন্ন বা সুন্দর পোশাক পরিধান, ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ঈদের দিন প্রতিটি পরিবারের একই চিত্র দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে এদিনে ধনী-গরীবে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। ফলে, দৃশ্যত ঈদের দিনে মোলাকাত, পাশাপাশি বসে নামাজ আদায় করার মধ্য দিয়ে মানুষে-মানুষে ব্যবধানহীন ব্যূহ-ই যেন রচিত হতে দেখা যায়। এ চিত্র ঈদোৎসবের সামাজিক গুরুত্বকে আরো বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। তবে কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের ঈদোৎসবের আয়োজন এত বৈচিত্রময় ছিল না। আখতার হোসেন উল্লেখ করেছেন, ‘সময়ের পরিক্রমায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঈদ উৎসব আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে প্রায় এক হাজার বছর আগে এদেশে ইসলাম প্রসার শুরু হলেও প্রাচীনকালের ঈদ উৎসবের ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না।’২ আবার রফিকুল ইসলামের ‘ঢাকার কথা’ গ্রন্থের বিবরণে জানা যায়, তৎকালীন বাংলার সুবেদারদের নেতৃত্বে ঈদের আনন্দমিছিল হতো। সেখানে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। মূলত ঈদের আনন্দ ও উৎসব অভিজাত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন ধনী-গরীব নির্বিশেষ ঈদোৎসব পালিত হয়ে থাকে। এ পার্বণে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও এখন যোগ দেয়। আগে মুসলমান পরিবারের খাবারের স্বাদগ্রহণ অন্য সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দুদের জন্য ধর্মবিচ্যুতির নামান্তর হিসেবে গণ্য হতো। বাংলাদেশে এখনো কোথাও কোথাও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় এ শাসনব্যবস্থা চালু থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যত্যয় ঘটে। ঈদ উৎসব সামাজিকীকরণের প্রভাবেই এই শিথিলতা এসেছে বলে অনেক গবেষক মনে করেন।

ইতিহাসপাঠে জানা যায়, ইউরোপের শিক্ষার প্রভাবে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি অক্ষুণœ থাকে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক পর্যন্ত। এর ‘৪৭ এর দেশবিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানেরা তাদের স্বকীয়তা খুঁজে পায়। এরপর স্বাধীনতা অর্জনের পর তা পূর্ণাঙ্গ হয়। ফলশ্রুতিতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের যে কোনো উৎসব-আয়োজনে সব শ্রেণি-পেশা-ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে সর্বজনীনতা পেতে থাকে। বর্তমানে এই উৎসব এখন আর কোনো বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং হয়ে উঠেছে প্রত্যেক মানুষের উৎসবের অংশ। সত্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর বাঙালির আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জগতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পাশাপাশি যোগাযোগ ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ায় দেশিয় সংস্কৃতির সঙ্গে বিদেশি সংস্কৃতির যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। মানুষে-মানুষেও যোগাযোগ হয়েছে উন্নততর। সামগ্রিক বিবেচনায় এখন বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামেরই মানুষ কর্মসূত্রে রাজধানী ঢাকা বা বিদেশে অবস্থান করছে। ফলে দেশি-বিদেশি সব তথ্য দ্রুতগতিতে গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। গ্রামের মানুষও দেশি-বিদেশি সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়ায় প্রতিমুহূর্তে নিজেকে নবায়ন করার সুযোগ পাচ্ছে।

যোগাযোগব্যবস্থার সহজলভ্যতার কারণেই ঈদোৎসবে গ্রামমুখী হচ্ছে মানুষ। দীর্ঘ কর্মব্যস্ততার পর একত্রে মিলিত হওয়ার সুবাদে যেমন পরস্পরের আত্মিক বন্ধন সুদৃঢ় হচ্ছে তেমনি প্রতিবেশিদের সঙ্গেও সখ্যতা বাড়ছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা উপহার আদানপ্রদান, আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে মিলনসম্মিলন, নানা উপাদেয় খাদ্য খাওয়া আর খাওয়ানো হয়। ছোট-খাটো সামাজিক সমস্যাও নিরসনে এই সম্মিলন রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাঙালির উৎসবে সার্বজননীতার ছোঁয়া কেবল দেশ, কাল, সীমানা অতিক্রম করে সভ্যতা, সংস্কৃতি কিংবা ধর্মীয় চেতনার বিস্তার লাভের মধ্যে সংহত নয়। বলা যায়, কৃষিসভ্যতার মন্থর জীবনে বাংলার আদিমতম কৌম সমাজের মানুষ বিভিন্ন অভিঘাতের মধ্যদিয়ে নিজেদের যেমন সংস্কার করেছে তেমনি হয়ে উঠেছে রুচিবান। বাঙালি আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে সজাগ আবার নানা সামাজিক উৎসবের মধ্যেও বৈচিত্রসন্ধানী। উৎসবে, আনন্দ-আয়োজনে চেতনার বিস্তৃতি ঘটায় পর্যায়ক্রমে নানামাত্রিক বৈচিত্র্য যোগ হয়েছে উৎসবগুলোতে। কেননা, উৎসব হলো সামাজিক মানুষের ব্যবহারিক জীবনে আত্মপ্রপ্রকাশের এমন একটি স্বাভাবিক মানসবৃত্তি, যেখানে তার বাস্তব বুদ্ধি ও কল্পনাগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবিই প্রতিফলিত হয়।


 সূত্র :

১. উৎসব বারো মাস, লোককৃতি বিচিত্রা : আতোয়ার রহমান, বাংলা একাডেমি ঢাকা, জুন ১৯৯৯, পৃ. ১২১।
২. প্রবন্ধ : বাঙালি মুসলমানের ঈদ ও সামাজিক উৎসব, আখতার হোসেন।


শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৪

সাহিত্যের রাজনীতি ।। মোহাম্মদ নূরুল হক



মানুষের চিন্তার স্রোত সব সময় একমুখী হয় না, থাকে না বাঁকহীনও। নানা চড়াই-উতরাইৎরায় পার হতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। এই অভিজ্ঞতা মানুষকে ধীরে ধীরে বদলে দেয়। পরিবর্তন ঘটে তার আচরণে, মনোজগতে। আর এই পরিবর্তন ঘটে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সাহিত্যিকদের। সাহিত্যিক ও সাহিত্যশ্লিশষ্টদের ভেতর চিন্তার পরিবর্তন ও বিবর্তন কখনো কখনো ঘটে আকস্মিক; কখনো কখনো সুপরিকল্পিতভাবে। পরিবর্তন ঘটে দুভাবে। প্রথমত, লব্ধ ধারণা ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজ-পরিবর্তনে লেখক অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পড়েন। ফলে মাঙ্গলিক চিন্তায় পূর্ণ হয়ে ওঠে সৃষ্টির ভুবন। দ্বিতীয় পরিবর্তন ঘটে আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছায়। এ পরিবর্তন যাদের মধ্যে প্রবল তারা লেখালেখির চেয়ে লেখালেখিকেন্দ্রিক কৌশলে আগ্রহী বেশি। লেখালেখিকে অবলম্বন করে জাগতিক স্বার্থসিদ্ধি-ই এই শ্রেণীর মূল্য উদ্দেশ্য। এই স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা গঠন করে বিভিন্ন সংঘ, গোষ্ঠী। দখন করে নেয় দৈনিকলগ্ন সাহিত্য পাতা, সাময়িকী এবং প্রকাশ করে নানা রকম গৌণ ইস্যুভিত্তিক সংকলন। ওই সংকলনগুলোর ভিত্তি সাধারণত কোনো দশক, কিংবা তুচ্ছ কোনো মতবাদ। ওই সংকলনগুলোর মূল উদ্দেশ্য_ একজন বা একাধিক কথাশিল্পীর সঙ্গে নিজেকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা। এই প্রবণতার সরল নামকরণ হতে পারে সাহিত্যের রাজনীতি।
পৃথিবীতে যত ধরনের রাজনীতি রয়েছে, এর মধ্যে সাহিত্যের রাজনীতি সবচেয়ে ভয়ানক। অন্য যেে কোনো পেশার লোকের চেয়ে সাহিত্যশ্লিশষ্ট লোকের আত্মম্ভরিতা বেশি। গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, স্টান্টবাজি ও স্নবরি- এ অঞ্চলের মতো অন্য কোথাও নেই। ইংরেজি পলিটিক্স শব্দের যথাযথ প্রতিশব্দ বাংলায় নেই। তাই রাজনীতি শব্দটা কাছাকাছি হওয়ায় গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু কী সেই রাজনীতি? প্রতিভাবানকে উপেক্ষা করে মেধাহীনদের দৌরাত্ম্যের ইতিহাস অনেকের-ই জানা। অনুরাগী পাঠক ও খ্যাতিপ্রত্যাশীদের প্রচার-প্রচারণায় সমকালে যিনি খ্যাতির শিখরে উঠতে পেরেছেন, তিনি কখনো নিজের আশে-পাশে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীদের প্রশ্রয় দেন না। নিজেও কোনো জ্ঞানী কিংবা নিজের চেয়ে প্রতিভাবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন না এবং নিজের চেয়ে বেশি প্রতিভাবানকে সহ্য করতে পারেন না। সাহিত্যের রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা অনুসারী সৃষ্টি ও লালনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন। আর অনুসারী লালনে তাঁদের কিছু নগদ অর্থও ব্যয়িত হয়। এই নগদ অর্থের উৎস- লেখক-কবিযশপ্রার্থী-আমলা-ব্যবসায়ীদের লেখক বানানোর প্রকল্প। এই প্রকল্প থেকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দুই ধরনের অর্থ উপার্জন সম্ভব। পাঠবিমুখ-অপ্রস্তুত সাহিত্য সম্পাদকেরা বিত্তশালীদের রচনা ছাপিয়ে সময়ে-অসময়ে কিছু আর্থিক সুবিধা আদায় করেন। সে অর্থেই চলে তাঁদের অনুসারীগোষ্ঠী লালন। তাঁরা ভুলে যায়-প্রজ্ঞাবানেরা আইডিয়া নিয়ে নিজে নিজে ভাবেন, পর্যালোচনা করেন নিজের সঙ্গে নিজে। নির্বোধেরা নিজের মনে কোনো চিন্তার উদয় হওয়া মাত্র-ই দশজনকে জানায়; চালাকেরা ওই আইডিয়া ধার করে নিজের বলে চালিয়ে দেয়। এই নিয়ম যুগ -যুগ ধরে চলে আসছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না- ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না, মাঝেমাঝে কেউ কেউ কিছুদিনের জন্য বিকৃত করে মাত্র। ইতিহাস আপনি গতিতে চলে এবং স্বমহিমায় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। এ-ও সত্য- সূর্য থেকে আলো আর উত্তাপ নিতে হয় প্রাণীজগৎ আর উদ্ভিদ জগতের। সূর্যের বুকে কেউ পৌঁছতে পারে না, বিপরীত চেষ্টা করলে ভস্ম হতে হয়। কিছু মানুষ সব সময়-ই ক্ষমতাবানদের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য লালায়িত থাকেন। তাঁরা ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সময় সুবিধাবাদী অবস্থানে থাকেন এবং ডিগবাজি খান।
তোষামোদকারী যতই ক্ষমতাবানদের কাছে ঘেঁষতে থাকে, প্রাজ্ঞজনেরা ততই উপেক্ষিত হতে থাকেন। এর কারণ ক্ষমতাবানেরা অনেক সময় তোষামোদকারীদের স্তুতির বন্যায় এমন-ই ভেসে যেতে থাকেন যে প্রায় অন্ধ হয়ে যান। যৌক্তিক-অযৌক্তিক বিষয়কে আলাদা করার পর্যবেক্ষণ শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তখন মোসাহেব বেষ্টিত থাকার কারণে প্রকৃত সত্য জানার সুযোগ পান না। বিস্ময়ের বিষয় হলো,-  এই চরম সত্য থেকে তোষামোদকারী কিংবা ক্ষমতার মোহে অন্ধরা কোনো দিন শিক্ষা নেন না। পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাস এই সাক্ষ্য-ই বহন করে।
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য এ শ্রেণীর সাহিত্যশ্লিশষ্টরা দায়ী। তাঁদের মূল্য লক্ষ্য- সমাজকে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেওয়া, সৃষ্টি করা নৈরাশ্যজনক সাহিত্য সমাজ। যেখানে ক্রমাগত শিষ্টাচার- বহির্ভূত আচরণ করতে থাকবে, কবি-কথাশিল্পী-যশপ্রার্থীরা। নিজেদের ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণকে চিত্তের দার্ঢ্য আর গোঁয়ার্তুমিকে দ্রোহ বলে-ই দাবি করে। তাঁদের স্বভাবজাত প্রবণতা হলো- সমাজের সম্মানিত কাউকে অসম্মান করা। ছোটকে বড় আর বড়কে ছোট বলে প্রচার করা মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ধরনের অপরাধ যাঁরা করেন তাঁরা মূলত অসাহিত্যিক সাহিত্য-সম্পাদক। অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা সাহিত্য পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পেলে পুরো পাতাটিকে পারিবারিক সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের দেয়ালিকায় পরিণত করেন। এই অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখকদের প্রতি তাকান ভীত সন্ত্রস্ত চোখে, আর আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চানাচুর মার্কা পত্রস্থ করেন যত্মসহকারে। সাহিত্যসমাজে যখন স্নবরি  বা স্টান্টবাজ লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন নির্মোহ, নিরাসক্ত ও নির্লোভ প্রাজ্ঞ ও হৃদয়বান সাহিত্যিকেরা উপেক্ষিত হতে থাকেন। প্রচল সমাজ ব্যবস্থার নিরিখে নির্মোহ, নিরাসক্ত সাহিত্যিককে কারও কারও কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। মনে হতে পারে অপ্রকৃতিস্থও। প্রচল স্রোতের সঙ্গে গা ভাসাতে না পারা প্রতিভাবানদের এই এক সমস্যা। লোভের পৃথিবীতে নিস্পৃহ-নির্লোভীরা কোনো দিন যথাযথ সম্মান পায় না। এই লোভ ও হুজুদের  পৃথিবীতে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থান চাটুকারদের জন্য বরাদ্দ। চাটুকারদের দৌরাত্ম্যে প্রতিভাবান-সত্যবাদীরা উপেক্ষিত হতে থাকেন নানাভাবে। কিন্তু সত্যবাদীরা ব্যক্তিগত জীবনে যতই সত্যের চর্চার করুক কিন্তু সমাজের ওপর তেমন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না উপস্থিতকালে। বিপরীতে চাটুকারেরা নিজেদের সুবিধা আদায় করে নেয় প্রায় তাৎক্ষণিক। সত্যবাদীদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজপতিরা, শাসকবর্গ। ফলে সত্যবাদীদের জন্য প্রতিমুহূর্তে উপেক্ষার যন্ত্রণা নির্ধারিত থাকে। চাটুকারদের সঙ্গে আপাতত তাদের পরাজয়ই বড় হয়ে ওঠে। এর কারণ- চাটুকারের পেছনে থাকে ক্ষমতার শক্তি, সত্যবাদীর জন্য ক্ষমতার খক্ষ।
কিন্তু এই সত্যবাদীদেরও শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। এক শ্রেণীর সত্যবাদী রয়েছে, যারা আসন্ন বিপদের সংকেত না বুঝেই, সময় না বুঝেই, নিজের উপলব্ধি যেখানে-সেখানেই প্রকাশ করে। অন্য েেশ্রণীর সত্যবাদীরা পরিস্থিতি বুঝে, সময়মতো সত্য প্রকাশ করে। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর সত্যবাদীরা অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সত্য প্রকাশেও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়ন। এই শ্রেণীর সত্যবাদীরা-ই প্রকৃতপক্ষে প্রজ্ঞাবান। বিষয়টা অনেকটা ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর মতো। বোকারা ঝড়ের সময় আম কুড়ায়, বুদ্ধিমানেরা ঝড় শেষে; আর প্রজ্ঞাবানেরা পর্যবেক্ষণ করে। ফলে ঝড়ের কবলে ফলে বোকারা মাঝেমাঝে প্রাণ হারায়, বুদ্ধিমানেরা তাদের ঠকিয়ে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে আর প্রজ্ঞাবানেরা কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়েই ফসল তোলে ঘরে। প্রসঙ্গটা আপাতত, অসংলগ্ন মনে হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের রাজনীতির আলোচনায় এ প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। ফলে যারা সাহিত্যের রাজনীতি করে, অন্যকে খাটো করে নিজের সুবিধা আদায়ের হীন চেষ্টায় লিপ্ত থাকে, তাদের মানসিকতা বোঝার জন্য উপর্যুক্ত বিষয়ের ধারণা রাখারও প্রয়োজন রয়েছে। সে সঙ্গে এ-ও পরিষ্কার হয়ে যাবে- সমকালে সাহিত্যের রাজনীতির শিকার-উপেক্ষিত মাত্র-ই দুর্বল নন, নন উত্তরকালে হারিয়ে যাওয়ার কোনো মামুলি সত্তা। বরং উপেক্ষিতদেরই ভেতর থেকেই কেউ কেউ হয়ে ওঠে মহীরুহ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৪

মিল-অমিলের সঙ্গে ।। মোহাম্মদ নূরুল হক

তোমার সঙ্গে যত অমিল, তোমার সঙ্গেই মিল 
মনের ভেতর উধাও নদীর উড়ন্ত গাঙচিল!

হায়রে আমার মাতাল নদী, হায়রে নদীর ঢেউ 
অমাবশ্যায় আর কি তেমন সাঁতার কাটে কেউ?

নদী তো নয় জলকুমারি। শরীরজোড়া সাপ।  
তোমার সঙ্গে লুকোচুরি, ‍জলেই প্রথম পাপ।

আমি পাপি, ভুলোমনা ভুলেছি নামধাম  
তুমি কেন তুললে ফণা, শরীর ভরা কাম!

মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০১৪

শিরোনামহীন ।। সিপাহী রেজা

জুলাইয়ের ডানা ভাঙা হরিণ ফড়িঙের বনে
হেঁটে হেঁটে যায়...
তামায় বাঁধানো পথ ভেজা আশাঢ়ীয়া ঠোঁটে

আধুনিপাতেরও পর বেলা উত্তরের ওয়াক্তে

একঝাক পাজামা ছাড়া রোদ
জোনাকির মত উদোমল্যাংটা
জ্বলে আছে চিকচিক, আধশোয়া রমনার লেকে।

হে পূণ্যময়ী রমণী ।। নূরুল হক


[বৈজয়ন্তীকে নিবেদিত]

পান্ডুর হয়েছে আজ পান্ডুলিপি অযত্নে হেলায়
বিবর্ণ ধূসর আর দূর্বিসহ জীবনের মাঠ
ক্রমশঃ মলিন হয় স্মৃতিময় সবুজ তল্লাট
নিষ্প্রান চাহনী নিয়ে বসে থাকে গোধুলি বেলায়।

অথচ চিত্রিত ছিল প্রেমকাম তোমার আনন
অজস্র অবজ্ঞা আর অবহেলা ছিল নিত্যসঙ্গি
লিখেছি বিনম্র রাতে কথকথা সব অঙ্গভঙ্গী
উজাড় হয়েছে সেই পান্ডুলিপি স্মৃতির কানন

যতই পান্ডুর হোক পান্ডুলিপি হে পূণ্যরমণী
যতই ঝরুক ঘৃণা, যত হোক রক্তের ক্ষরণ
সহসা তোমাকে কেহ পুষ্পপত্রে করিবে বরন
তুমিতো কামজ ছায়া চিত্রকল্প কবিতার ধবনি

অদৃশ্য অশ্রুর কাছে কোনদিন মানো নাই হার
বৈজয়ন্তী হাতে নিয়ে দূর করো দূবৃর্ত্ত আঁধার।

শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০১৪

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইনলঙ্ঘন কাঙ্ক্ষিত নয় ।। মোহাম্মদ নূরুল হক


আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। দেশের ভেতরে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ-খুনে ঘটনায় তদন্ত, অপরাধীদের আটক-গ্রেপ্তার করা এ বাহিনীর কাজ। কিন্তু পুলিশ যখন এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তখন, তাদের  প্রতি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। সম্প্রতি পুলিশের বিরুদ্ধেই উঠেছে___ হত্যা, চাঁদাবাজি, স্বর্ণ চোরাকারবারিদের কাছ  থেকে উদ্ধারকৃত স্বর্ণ আত্মসাৎসহ,  গ্রেপ্তার-আটকবাণিজ্য, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও কন্টাক্ট কিলিংয়ের।
চলছে সংযমের মাস রমজান। সামনে বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদ। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমান কর্মস্থল থেকে প্রাণের টানে ঘরের পানে ছুটে যায়। দীর্ঘদিন পর মিলিত হয় পরিজন-স্বজনের সঙ্গে। ঈদের আনন্দ উপভোগ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নতুন পোশাক। ধনীদরিদ্র, নারীপুরুষ নির্বিশেষে ঈদের আগে প্রত্যেকের রুচি-সামর্থ্য অনুযায়ী পোশাক কেনেন। কেনাকাটা করেন অলঙ্কারসহ গৃহসজ্জার নানা পণ্যও। এই আনন্দ উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মৌসুমি চাঁদাবাজরা।
খবরে প্রকাশ__ ঈদকে সামনে রেখে আয়-রোজগার বৃদ্ধির দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে পেশাদার চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা। একই সঙ্গে মৌসুমি অপরাধীরাও জড়িয়ে পড়েছে চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের সঙ্গে। বিশেষ করে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে নতুন ফর্মুলা ইফতারি-ঈদ কার্ড। শীর্ষসন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীনদের নামে ইফতারি-ঈদকার্ড দিয়ে এসব চাঁদা আদায় হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব  যে-কোনও ধরনের বেআইনি কর্মকা- প্রতিহত করা। একই সঙ্গে চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া এবং অপরাধীদের আটক-গ্রেপ্তারপূর্বক বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে এর উল্টো চিত্র। চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের শিকার যারা, তারা পুলিশিসাহায্য নিতেও সাহস পাচ্ছেন না। থানায় চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা-জিড়ি করতে গেলে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে উল্টো ক্ষতিগ্রস্তদেরই। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ___ মামলা তদন্তের চেয়ে থানাপুলিশ পকেট ভর্তিবাণিজ্যে বেশি মনোযোগী। এ কারণে এসব ঘটনার কোনও কূলকিনারা হয় না।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ___ চেকপোস্ট আর মহাসড়কে মালবাহী গাড়ি তল্লাশির নামে পুলিশ ঈদকেন্দ্রিক চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছে। গৃহমুখী মানুষ এবং নিত্যপণ্যবাহী গাড়ি এখন পুলিশের ঈদ-বখশিসের অন্যতম উৎসে পরিণত। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ বহু পুরনো। বাংলা প্রবাদবাক্য___ ‘শর্ষের ভেতর ভূতের’ সার্থকতা আর কোথাও না থাকুক, বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীতে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যে বাহিনীর কাজ, আইনলঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটানো এখন সেই বাহিনীর জন্য নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ থেকে  মুক্তির উপায় কী?
সমাজে সংঘটিত বেআইনি কর্মকাণ্ড রোধে দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আর সে বাহিনীই যদি আইনলঙ্ঘনে জড়িত থাকে, তাহলে তাদের প্রতিরোধ করা সমাজের সচেতনশ্রেণীর কর্তব্য। এর জন্য চাই___ নৈতিক সততা, চারিত্র্যিক দৃঢ়তা ও তীব্র মানসিক শক্তি। অর্থাৎ শর্ষের ভেতর থেকে ভূত তাড়াতে হলে, আগে প্রয়োজন ভূত তাড়ানোর মন্ত্র জানা। আবার মন্ত্র জানাও সব নয়। জানতে হবে প্রয়োগবিধিও। তবেই ভূততাড়ানো ওঝার কৃতিত্ব! কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালি সমাজের প্রথা এই যে___ কোনও তথা-ভূতগ্রস্তকে ভূতের আছরমুক্ত করার কাজটা ওঝা একা করে না। সঙ্গে থাকে তার সমান দক্ষ একাধিক সহযোগী। তারাই মূলত ভূত তাড়ানোর কাজটা সম্পন্ন করেন। এক্ষেত্রে শর্ষের ভেতর যে ভূত রয়েছে, তাও তারাই শনাক্ত করেন। কারণ তারা চেনেন, কোনটা ভূতের চোখ আর কোনটা শর্ষের দানা। 
একটি সমাজে যখন অবক্ষয় শুরু হয়, তখন সর্বত্রই এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তখন যার থাকার কথা অন্তরালে সে বেরিয়ে আসে মঞ্চে। যার হওয়ার কথা রক্ষক, সে হয়ে ওঠে নিষ্ঠুরতম ভক্ষক। এরই স্বাভাবিক পরিণতি ঘটেছে পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রে। যেখানে পুলিশের ঠেকানোর কথা ছিনতাই-চাঁদাবাজি, সেখানে এই বাহিনীর সদস্যরাই জড়িয়ে পড়ছে এ ধরনের বেআইন কর্মকাণ্ডে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জনসাধারণের কাছ থেকে পারিতোষিক, উৎকোচ আদায় আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৬১ ও ৩৮৫ ধারার বিধান মতে মামলা দায়ের করা যায়। কিন্তু থানায় যদি কেউ মামলা করতে চায়, থানা পুলিশ সহজে মামলা নিতে চাইবে না__ এটাই স্বাভাবিক।
জনসচেতনতা ও গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে এই চাঁদাবাজি বন্ধের পরামর্শ দিতে হয়তো দেবেন সমাজকর্মী-অপরাধবিশেষজ্ঞরা। কিন্তু গণপ্রতিরোধের একটা বিরাট সমস্যা হল___ দেশের সংবিধান বা কোথাও জনগণকে বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পরন্তু বিভিন্ন রকম অসমাজিক কর্মকা- বন্ধে পুলিশি সহায়তা চাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর এক্ষেত্রে ৫৪ ধারায় পুলিশকে বরং এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যে ক্ষমতা বলে, পুলিশ যে কাউকে আটক করতে পারে। শেষপর্যন্ত পুলিশ ৫৪ ধারার ক্ষমতার অজুহাতে যে কাউকে যে কোনও স্থানে আটক করে হয়রানি করার সুযোগ নেয়।
পুলিশি হেফাজতে মানুষের মৃত্যুর অভিযোগ অনেক পুরনো। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমানের হাতে ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজন খুন, বরিশালের গৌরনদীতে দাবিকৃত ১ লাখ টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রবাসীর ছেলে কম্পিউটার ব্যবসায়ী শাহীন মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা, ১ হাজার টাকার জন্য আশুলিয়ার নবীনগরে চা-বিক্রেতা রিপন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষকে ভীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। পুলিশ এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেসব কারণ দাঁড়ায় করায়, সেগুলো অনেক চেনা ও বহুলব্যবহারে মানুষের মনে বিরক্তি জন্মেছে। পুলিশের দাবিমতে, অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় পুলিশের সঙ্গে কেবল পুলিশের ৩৯ ও র‌্যাব- পুলিশের সঙ্গে যৌথ বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হন।
পুলিশের হওয়া উচিত জনগণের সেবক, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাহারাদার। কিন্তু এই বাহিনীর সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়েন কেন? এখন সময় এসেছে___ এর উত্তর খুঁজে বের করার। এই দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্রের।

শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০১৪

সানাউল্লাহ সাগর এর কবিতা

Sanaullah Sagor
 

খোয়াব

ধুলোমাখা মুখে সামনে আর ঘুরঘুর করিও না শব্দবিতান।
এবারের শীত- বসন্ত থেকে মুক্তি নিয়ে তোমার উঠোনেই সাঁতরাবে
বিদ্যুতমুখী রোদ বালুসংগ্রামের জায়নামাজ ছিঁড়ে চিঁড়ে
শ্রেণি বৃত্তান্ত তৈরি করছে আর রাশিচক্রের কোলবালিশে
লুকিয়ে আছে কৃষ্ণসমাজ।
অঙ্গছেদের পুরোহিত রাধার বিছানায় তুমিও শিশু।
দৈঘ্য-প্রস্তের জীবনে অলংকারের পেলবতা খুঁজে বেড়ানো বোকামীই বটে!



রেডিও

তুমিতো রেডিও দুঃখের গীতবিতান
লাজুক সম্ভ্রমে জেগেই থাকো পুষ্পিত পিরামিডে-
বর্ণগুহায় মৈত্রীয় আখ্যান ভুলে সিথানের কথকচাবীতে-

দুঃখতো মাসতুত বোন-স্বপ্নে আসা পরি- অথবা সকালের সংবাদ পাঠিকা।
দুঃখেরা স্বপ্নে ঘুরে-
ময়ূর সঙ্গম বাজায় প্রীতির অভ্যন্তরে।

তুমিতো রেডিও বেজে চলো সুখে-অসুখে...



ঘুম শব্দটি

তোমাকে কি আমি কখনো চিনতাম?
তাহলে তুমি মধ্যরাতে জোনাকির শরীর নিয়ে হাজির হও কেনো?
নিগুরভাবেআমার দিন-রাত পর্যবেক্ষণ করো।
কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারি না।
তোমার আর হাওয়াই মানুষের জীবন দেখে দেখে পঁচে যেতে ইচ্ছে করে-
চিৎকারের সক্ষমতা যেদিন থেকে হারিয়েছি
সেদিন থেকেই তোমার আনাগোনা বাড়ছে।
তোমার আজব নৃত্য দেখে অসহয় আমি হাইতুলি,
ঘুমিয়ে পড়ার চেস্টা করি।
কিন্তু এখানের অভিধানে ঘুম নামের কোনো শব্দ নেই!


প্রেমতলা

প্রেমতলার যুঁতসই একটা গল্প ছিলো যা আসমানে উড়ে জমিনেও হাঁটে কিন্তু দূভাগ্য কাকড়ার নকশীকাথা ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। শুধু নড়িয়ার বুক পকেটে পুরানো অর্থের অজ্ঞাত বসবাস আর আফ্সোসের সিথানে র্নিঘুম নাবালক প্রেমিক।

তখনো নায়িকাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি জাজিরাÑ নাওডুবায়।তাও প্রেমতলার শরীরে মোলায়েম স্পর্শে কামের উষ্ণতা জেগে উঠেছিলো। অশরীরী মাদকতায় হেসেছে ঘাসের ডালপালা।

এরপর থেকে বিবস্ত্র প্রেমতলার বুকজুড়ে স্বপ্ন স্বপ্ন ঘুম মুছে গেলো। আর শান্ত উরু জুড়ে সহাস্যে তাকিয়ে থাকলো সমুদ্রের ঢেউ। আজকাল আমার চিন্তাজুড়ে শুধুই প্রেমতলা- বিয়োগে বিয়োগে দেউলিয়া যে টালীজীবন তাকে প্রেমতলার গল্প শুনাই। আর ছইহীন মনের নাওয়ে জোছনার কামকলা আঁকি।


বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০১৪

এক দুপুরে আল মাহমুদ ।। মোহাম্মদ নূরুল হক

আজ ১১ জুলাই। কবি আল মাহমুদের জন্মদিন।  এ উপলক্ষে নিবেদন।



আল মাহমুদ, বাংলা কবিতার এক অনিবার্য নাম। যিনি যৌবনে আবেগে উদ্বেল কবিতায় উন্মাতাল, বার্ধক্যে ধর্মে সমর্পিত। শুরু থেকে শেষপর্যন্ত মানবজীবনের নানাদিক তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। নারী-প্রকৃতি-ধর্ম-রাজনীতি, প্রেম-আধ্যাÍের মতো বহুরৈখিক বিষয় তার কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। তার কবিতায় চিত্রকল্প-উপমা যেমন নতুন উদ্বীপনা সৃষ্টি করে কবিতাপ্রেমীদের মধ্যে, তেমনি তার ব্যক্তিগত জীবন-যাপনও অনেকের কৌতূহলের বিষয়। তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দর্শন যাদে অপছন্দের,  তারাও তাঁর কবিতার মুগ্ধ পাঠক, তাঁর মঙ্গলাকাক্সক্ষী। সাহিত্যবিষয়ক ছোটকাগজ ‘অনুরণন’-এর সম্পাদক তরুণ কবি ও কথাশিল্পী রেজা নুর যখন আমাকে অনুরোধ করলেন, আল মাহমুদের একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য, তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে গেলাম। সেই মে কি জুনে। কিন্তু সময় আর হয়ে ওঠে না। আল মাহমুদের বাসায় যাব কীভাবে এসব নিয়ে যখন ভাবছিলাম, তখনই মনে পড়ল তরুণ কবি আবিদ আজমের নাম।  সৌভাগ্যবশত আবিদ আজম আর আমি এখন একই বাড়ির বাসিন্দা। ও থাকে বাড়ির একতলায়, আমি তৃতীয় তলায়। ২৬ অক্টোবর সকালে আবিদ আজমকে ফোন করে আল মাহমুদের বাসায় যাওয়ার বিষয়টা জানাতেই বললেন, আজই চলুন।
দুজন একসঙ্গেই হাজির হলাম আল মাহমুদের বাসায়। আবিদ আজম আমাকে গেস্টরুমে বসিয়ে রেখে ঢুকে গেল আল মাহমুদের বেডরুমে। কিছুক্ষণপর ডাক পড়ল আমার। গিয়ে দেখি, আল মাহমুদ মুখে মুখে কবিতা রচনা করছেন, আর আবিদ আজম শ্রুতি লিখন করছেন। লেখা শেষে আবিদ কবিতাটা শোনালেন আল মাহমুদকে। বললেন, মাহমুদ ভাই, কেমন লিখলাম? আল মাহমুদ সবিস্ময়ে তাকালেন আবিদের দিকে___ তুমি লিখলে? আবিদ বললেন, তো? কে লিখেছে? কবি যেন এবার আসল বিষয় ধরতে পারলেন, হো হো হো করে উঠলেন। বললেন, হ্যাঁ চমৎকার লিখেছ। তোমার লেখার তুলনা হয় না। এরপর হঠৎই যেন আমার দিকে দৃষ্টি পড়ল তার। বললেন, ‘তুমি কে?’
মোহাম্মদ নূরুল হক:  মোহাম্মদ নূরুল হক। আপনাকে দেখতে এলাম। কেমন আছেন মাহমুদ ভাই।
আল মাহমুদ : আজ সকালে গিয়াস কামাল চৌধুরী মারা গেছেন, জানো তো?
হক: হ্যাঁ।
আমার কথার মাঝখানে কবি থামিয়ে দিলেন। বললেন, সবাই একে একে চলে যাচ্ছেন। আমারও তো বয়স হয়েছে, আমিও চলে যাব যে কোনো দিন।  এসময় আবিদ কবিকে প্রবোধ দেওয়ার ছলে বললেন, আপনার আর তেমন বয়স কত?
মাহমুদ : রবীন্দ্রনাথ বেঁচেছিলেন দীর্ঘ দিন। কিন্তু আমি দেখেছি এই বৃদ্ধবয়সে আমি খুব দুর্বল হয়েছি।  বৃদ্ধবয়সে অনেকে হুঁশ হারিয়ে ফেলেন। হাটাচলা করতে পারেন না।
হক: সে হিসেবে আপনি অনেক ভালো আছেন। আমরাও আপনার সুস্থতা কামনা করি।
মাহমুদ : হ্যাঁ আমি অনেক ভালো। আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি।
আবিদ :   বেঁচে আছেন, এবং ক্রিয়েটিভ মানে সচল আছেন আর কি।
আল মাহমুদ : তবে দিন শেষ হয়ে আসতেছে। সত্তর আশি বছর বেঁছে থাকা আর...
আবিদ : একশ বছর বেঁচে থাকা তেমন বেশি কিছু না...
আল মাহমুদ : অবশ্যই এত বেশি বছর বেঁচে থেকেই বা লাভ কী? (সমস্বরে হাঁসি)। যদি লিখতে না পারি?
হক-আবিদ: না আপনি তো লিখতে পারেন...
মাহমুদ :  যাই হোক,খুব খুশি হলাম আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায়। কী নাম আপনার?
হক: মোহাম্মদ নূরুল হক।
মাহমুদ :  বাড়ি হইল...
হক:  নোয়াখালী।
মাহমুদ : নোয়াখালীর কোথায় ?
হক : মাইজদী।
মাহমুদ : মাইজদীতে, ও...। ওখানে তো আমি গেছিলাম।
হক: হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম সেবার। আপনার ছোট একটা সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। একসঙ্গে ঘুরেছি, আপনার সঙ্গে ছটি-টবিও তুলেছি...
আবিদ: হ্যাঁ মাহমুদ ভাই, হক ভাই আপনাকে নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন, জনকণ্ঠে, ডেসটিনিতে, আরও কোথায়-কোথায় যেন... হক ভাই যখন ইত্তেফাকে ছিলেন, তখন আপনার কবিতা নিয়ে ছাপিয়েছেন সেখানে। বিলও অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নাইস নূরের কাছে।
মাহমুদ : কবিতা ছাপালে তো আমাকে খালি হাতে ফেরানোটা যায় না।  কবিকে তো সম্মান দিতে হয়।
হক: মাহমুদ ভাই আমি লেখকের সম্মান ও সম্মানি একসঙ্গেই দিই।
আবিদ : হ্যাঁ সেটাই। এই আরকি। হকভাই অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন, আপনাকে নিয়েও লিখেছেন, তার বইয়েও আপনাকে নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ আছে।  লোকে বলে, আপনাকে গালি দিয়েও নাকি প্রবন্ধ লিখেছেন এই লোক। কবিতাও ভালো লিখছেন। এবং একটা মজার ব্যাপার হলো মাহমুদ ভাই, হক ভাই একটা জাতীয় দৈনিকের নিউজ এডিটর।
মাহমুদ : এটা কোন দৈনিক?
আবিদ : আমাদের সময়।
মাহমুদ : খুবই ভালো। খুবই ভালো। সারাজীবন তো আমি এই-ই করেছি। করে যাচ্ছি। আমি সম্পাদক ছিলেন গণকণ্ঠের।  লেখালেখির কারণে প্রচুর জুলুম আমার ওপর দিয়ে গেছে। সংসার তছনছ হয়ে গেছে।  ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন সময় শেষ হয়ে এসেছে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি আর কি।
আবিদ : না, মৃত্যুর সময় না। আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আমার বয়স অনেক কম। কিন্তু আমি আপনার আগেও মারা যেতে পারি। এটা বলা যেতে পারে...
মাহমুদ : আমি এখন খাওয়া কন্ট্রোল করে চলি। মুসলমানদের ওই কথা মানি। পেট ভরে খাইতে হয় না। একটু খালি রাখতে হয়।
আবিদ : একবার আমরা কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের নিমন্ত্রণে যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গেলাম না?  সেখানে তো খাওয়ার টেবিলে শাহরিয়ার ভাই খাবার তুলে দিচ্ছেন আপনার প্লেটে। আপনি বললেন, না, না শাহরিয়ার আমি খেতে পারি না। তুমি মরা ঘোড়ার ওপরে বাজি ধরো না। আমি বেশি খেতে পারি না। (সমস্বরে হাঁসি) অনেক দিন আগে।
মাহমুদ : আবিদ কোত্থেকে এসেছ?
আবিদ : বাসা থেকে। আব্বা অসুস্থ। তাঁর পাশে বসেছিলাম। এ সময় হক ভাইয়ের ফোন। বললেন, মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে একটু দেখা করতে যাব। তিনি অবশ্যই অনেক দিন থেকে বলে আসছিলেন। তো ফোন পেয়ে বললাম, চলেন আজই যাই।  গত তিন মাস ধরে হক ভাই বলতেছেন। তো আজ নিয়ে এলাম তাকে।
আল মাহমুদ : আমি তো ভাই বুড়ো মানুষ। আমার তো কিছু করার থাকে না। মাঝেমাঝে লেখি। (আবিদ আজমের দিকে তাকিয়ে, আমাকে ইঙ্গিত করে ও কী করে?)
আবিদ : উনি প্রবন্ধ লেখেন। কবিতাও খুব ভালো লেখেন। অনেক পরিশ্রম করে তিনি প্রবন্ধগুলো লেখেন। এখন যদিও উনি নিউজের মানুষ হয়ে গেছেন। এখন কবিতার কথা ভুলে গেছেন কি না।
হক: না, না, এখনও প্রচুর লিখি। প্রতি সপ্তাতে অন্তত একটা গদ্য লিখি।
মাহমুদ :  আমিও তো এডিটরি করেছি। এরপরও তো কবিতা ভুলিনি।  প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা হয়, সেখানে তো আমার একটা না একটা কবিতার বই বের হয়। আচ্ছা তুমি কেন এসেছ তা তো বললে না।
হক: আপনাকে দেখতে এলাম। আপনাকে দেখাও হল, আপনার কিছু কথা শোনাও হলো। এই জন্যই আসা।
মাহমুদ : বলো... কী জানতে চাও...
হক: আপনি অনেক কথাই বলেছেন। অনেক সময় একই কথা বারবারও বলেছেন। আমি শুনতে এসেছি এমন কিছু কথা, যা আগে কখনো বলেননি। এমন কিছু কথা, যা বলতে ইচ্ছা করে, অথচ বলতে পারছেন না।
মাহমুদ : আছে কিন্তু তোমাকে বলব না। কারণ বিষয়টা খুব ব্যক্তিগত। তবে আমি কোথাও-কোথাও লেখার চেষ্টা করেও লিখিনি।
হক: কেন লিখলেন না? লেখা যেত না?
মাহমুদ : লেখা যেত, কিন্তু ঠিক হতো না।
হক : সামাজিক কারণ?
মাহমুদ : আমাদের এই সামাজিক পরিবেশে কেউ ওই লেখা পড়ে দুঃখ পাবে। এই কারণে আমি লিখিনি। এই রকম বিষয় আছে আমার। আমি লিখলে কেউ একজন হয়তো ঘরে বসে, রান্নাঘরে চোখ টিপেটিপে কাঁদতো। এটা তো আমি চাই না। এ জন্য লিখি না।
আবিদ: হ্যাঁ, সেটাই।  মাহমুদ ভাইতো তো একটা কথা প্রায়ই বলেন যে, তাঁর চরিত্রগুলো মানে তাঁর গল্প-উপন্যাস-কবিতার চরিত্রগুলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পূর্ণাঙ্গ নির্যাস।
হক: মানুষের কল্পনা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরের কিছু নয়। মানুষ তার অভিজ্ঞতার বাইরে কল্পনাও করতে পারে না।
মাহমুদ: হুম, মানুষের অভিজ্ঞতায় যা নেই তা সে লিখতে পারে না।
আবিদ : সে যাই  হোক,
মাহমুদ : যাই হোক, (আবিদের দিকে তাকিয়ে ) তুমি কেমন আছ?
আবিদ : ভালো। কিন্তু আব্বা অসুস্থ। আপনি একটু  দোয়া করবেন।
মাহমুদ : অবশ্যই।
আবিদ : দেশের পরিস্থিতি তো খুবই খারাপ।
মাহমুদ : খুবই খারাপ। দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।
আবিদ : কী করা যায় এই মুহূর্তে?
হক: আপনার কী মনে হয়, দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
মাহমুদ : আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত সংঘাত হবে না। তবে খুব খারাপ।
আবিদ: কী করা যায় এই মুহূর্তে?
মাহমুদ : আমার মনে হয় শেষপর্যন্ত সংঘাত হবে না। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমত আছে। আল্লাহ কীভাবে যেন এদেশের মানুষকে রক্ষা করেন।
আবিদ: আপনি খুব আশাবাদী মাহমুদ ভাই।
মাহমুদ :  হ্যাঁ আমি আশাবাদী। আমাদের দেশের মানুষের সব আছে। কী নেই? আমরা কোনও কাজ করি না। বসে থাকি। গরিব মানুষরা সকাল থেকে  সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন।
আবিদ : একটা কবিতা আমরা পড়েছিÑ সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা। চাষা তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাটে।
মাহমুদ : দাও পয়সা দাও।
আবিদ : দেব। হক ভাই দেবেন। উনি তো বলেছেন, কবিকে উনি সম্মান ও সম্মানি দুই-ই দেন। আপনার কি খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে কোনও লেখা আছে?
হক: শুরুর দিকের লেখাগুলোয় তো আছে।
মাহমুদ : আমি এডিটর ছিলাম না? তখন তো প্রচুর লিখেছি।  লিখে জেল খেটেছি না?
আবিদ: আপনাকে জেল থেকে যে লোকটা ছাড়িয়ে নিয়ে আসলেন, সে গিয়াস কামাল চৌধুরী তো আজ মারা গেছেন।
মাহমুদ : মারা গেছেন, আজ। গিয়াস কামাল চৌধুরীর বড় ভাই হলেন, বেলাল চৌধুরী। তারা তো আমাদের আÍীয়। তাদের বাড়ি তো নোয়াখালীর দিকে।
হক:  গিয়াস কামাল চৌধুরী আপনাকে কীভাবে জেল থেকে বের করে আনলেন...
মাহমুদ : তুমি তো আমার অনেক খবর জানো...
আবিদ : হ্যাঁ, উনি আপনার সব খবর রাখেন...
মাহমুদ : গিয়াস কামাল আমার জন্য এত করেছেন। এটা বলে শেষ করা যাবে না। সে শেখ সাহেবের সঙ্গে তর্ক করেছেন। উনাকে উত্যক্ত করেছেন। আমি যখন জেলে, আমাকে ছাড়ানোর জন্য খুব চেষ্টা করেছে। তখন তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের বোধ হয় সভাপতি ছিলেন, বা সেক্রেটারি ছিলেন; যাই হোক। তিনি আমাকে জেল থেকে বের করেছেন।
হক: তিনি চেষ্টা করেছেন, আর বঙ্গবন্ধু তো আপনাকে খুব পছন্দ করতেন..
মাহমুদ : হ্যাঁ, আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমার সাথে তার একটা ব্যক্তিগত.... হ্যাঁ কীভাবে যেন একটা সম্পর্ক ছিল। আমাকে খুব øেহ করতেন। উনি তো সাংবাদিক সম্মেলন ডাকতেন, মাঝে-মধ্যে বাসায়। সেখানে বক্তৃতা করতেন। বক্তৃতার পরে আমাকে চোখ ইশারা দিতেন ওনার কাছে আসার জন্য। সবাই চলে গেলে আমি থেকে যেতাম। তখন আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যেতেন। আমাকে সিঙ্গাড়া খাওয়াতেন। বলতেন, নে খা।
হক: বঙ্গবন্ধু তো ছোটদের তুই করেই সম্বোধন করতেন... আপনাকেও তাই।
আবিদ : নানা বিষয়ে বোধ হয় পরামর্শও করতেন আপনার সাথে?
আল মাহমুদ : পরামর্শ মানে, আলাপ করতেন আর কি, নানা বিষয়ে আলাপ। নিজেও সাংবাদিক ছিলাম তো।
হক: জেল থেকে আসার পর তো আর গণকণ্ঠে গেলেন না...
মাহমুদ : না।
হক: তখন কি শিল্পকলায় জয়েন করলেন?
মাহমুদ : হ্যাঁ, শিল্পকলায় গেলাম। আমি জেলখানায় থাকতেই শুনেছি, গণকণ্ঠের কিছু  লোক আমাকে সরাতে চাইছিল। আমি বিশ্বাস করি নাই। সেটা হলো যে, আমি ফিরে আসলে আমাকে আর গণকণ্ঠে যেতে দেবে না। আমাকে একটা সাপ্তাহিক করতে বলবে। আর তারা গণকণ্ঠ করবে। এর মধ্যে একজন ছিলেন আফতাব আহমেদ। আমার বন্ধু মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি এই পরিকল্পনাটা করেছিলেন।
হক: এই আফতাব আহমদ কি প্রফেসর আফতাব আহমদ?
মাহমুদ : হ্যাঁ। কিন্তু আমি যখন বেরিয়ে আসলাম, তখন আফতাব আহমদ আমার বাসায় আসল। এসে বলল, গণকণ্ঠ তো সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। তুমি আর গণকণ্ঠ বের করার চেষ্টা করবা না। তখন আমি আর কী করব? তখন তো আমার অবস্থা খুবই কাহিল। পরিবার নষ্ট হয়ে গেছে।  ছেলেরা কে কোথায় কিছুই জানি না। এরকম একটা পরিস্থিতি। এমন একটা ল-ভ- অবস্থায় আমি। এটা আবার শেখ সাহেবও জানতেন। আমার পরিবার নষ্ট হয়েছে, ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি আমাকে বলেছিলেনও যে, তোর জন্য আমার হƒদয়ে খুব ব্যথা আছে। বিশ্বাস কর, তোর জন্য আমার হƒদয়ে খুব ব্যথা আছে। এসব বলেছেন আমাকে। তো আমি তো আর কিছু বলতাম না। আমি তো এই অবস্থার মধ্যেই ছিলাম। জীবন বড় কঠিন।
আবিদ : বঙ্গবন্ধু তো আপনাকে জেল থেকে বের করে এনে আবার চাকরিও দিলেন...
মাহমুদ : চাকরি তো আমি চাইনি। আমাকে জোর করে চাকরি দিয়েছেন।
হক: শিল্পকলায়?
মাহমুদ: শিল্পকলায়। আমার জন্য তিনি গাড়ি পাঠিয়েদিয়েছেন। তখন আমার স্ত্রী আমাকে বললেন, দেখো, শেখ মুজিবের বিরোধিতা করেছে এমন সবাইকে তো তিনি  জেলে ভরেছেন। আর তোমাকে চাকরি দিয়ে দিচ্ছেন। তুমি তো জীবনে আমার কথা শুনো নাই, এবার আমার কথা শোনো। তুমি চাকরিতে জয়েন করো।  তো, আমি আমার স্ত্রীর কথায় জয়েন করলাম। এই আর কি।
হক: ছিলেন তো ওখানে, বেশ অনেক দিন।
মাহমুদ : হ্যাঁ, ওখানে দুই বছর ছিলাম।  প্রকাশনা বিভাগের ডিরেক্টর ছিলাম। যা হোক, এখন সিগারেট খাব। আমি তো সিগারেট খাই না, কেউ আসলে তখন....
এই সময় কবিকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। আবিদ আজম  এই ফাঁকে খাদিজা বলে ডাকতেই, একটা ছোট মেয়ে এসে সিগারেট দিয়ে গেল। আবিদ তখন ওই সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে কবিকে দিলেন। কবি খুব ধীরে, অনেক ধ্যনস্থ হওয়ার মতো করে সিগারেটে টান দিলেন। আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি তাঁরÑ কী তুমি সিগারেট-টিগারেট খাও না কি? আমি হাসতে হাসতে বললাম, না ভাই, আমি খাই না। কবি চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। আমরা তিনজনই এসময় চুপচাপ। আমি আবার শুরু করি
হক: আমি কি বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিলেন?
মাহমুদ : না, আমি করি নাই। আমাকে গণকণ্ঠের কারণে জেলে দিয়েছেন। আমি তিনি খুব ভালোবাসতেন ব্যক্তিগতভাবে। আমাদের সবাইকে চিনতেন। আমার বাবা-মা চাচাদের চিনতেন। উনি আমাকে বলতেন যে, উনি যখন ছাত্র ছিলেন, কোলকাতায়। আমার চাচাতো ভাই, চাচা তাদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল ভালো। আমি অবশ্যই জানতাম না অত কিছু। আমি একটু উদাসীন ধরনের মানুষও ছিলাম। কবি ছিলাম তো।
হক: প্রকৃত কবি তো  সব সময়ই কবি...
মাহমুদ : না রে ভাই। এটা কিন্তু সত্য না। মানুষ সব সময় কবি থাকতে পারে না। মাঝেমাঝে কবিত্বশক্তি একটু শিথিল হয়ে যায়। তখন চেষ্টা করেও কবিতা লেখা যায় না। আবার হঠাৎ করে লিখতে পারে। কবিসত্তা ফিরে আসে।
হক: কবিতা আসলে চেষ্টা করে লেখা যায় না।
মাহমুদ : না, হয় না। তবে চেষ্টা করে হয় না মানে কী? আসলে লেখার সাধনা করতে হবে। লেখার চেষ্টা তো তোমার থাকতে হবে।
হক: আমি তো আপনার সম্পর্কে এমন জানি যে, আপনি চেষ্টা করেও অনেক কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে একটা কবিতা হল, কবি আবু হাসান শাহরিয়ার আমন্ত্রণে যুগান্তরের জন্য লিখেছিলেন।
আবিদ : কতদূর এগোলো মানুষ?
হক: না, এটা তো সোনালি কাবিনের প্রথম কবিতা ‘প্রকৃতি’র শুরুর পঙক্তি।
মাহমুদ : হ্যাঁ।
হক: আমি যেটার কথা বলছিলাম সেটা এটা দ্বিতীয় ভাঙনের প্রথম কবিতা...
আবিদ : হক ভাই আপনার কি কনসেপ্টটা মনে আছে।
হক: আছে। ওই যে পাখি...খাঁচা
আবিদ: মাহমুদ আপনার একটা কবিতায় আছে না, আপনার মেয়ে কবিতা কবিতা করে...
হক: ওই কবিতার নাম ‘কবিতার কথা’ই তো...
মাহমুদ :হ্যা
হক: আবেগ রহমান নাকে একজন লেখক আছেন। তিনিই গিয়েছিলেন আপনার কাছ থেকে কবিতাটা লিখিয়ে আনতে। ওটা যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটা আনার জন্য কবি আবু হাসান শাহরিয়ার পাঠিয়েছিল তাকে। আপনি তাকে তেরো দিন ঘুরিয়ে চৌদ্দ দিনের দিন দিয়েছিলেন।
আবিদ : আবেগ রহমান ওই ঘটনা নিয়ে একটা লেখাও লিখেছেন।
হক: পায়ে যে চতুর্দদশপদী রচিত।
আবিদ : ওই লেখাটা লিখেই তিনি বেশ পরিচিতিও পেয়েছেন। (এই সময় খুব উচ্চস্বরে হাসতে থাকেন।) মাহমুদ ভাই তো আবু হাসান শাহরিয়ারকে নিয়েও একটা গদ্য লিখেছেন। যেখানে এক অভিমানী ছোট ভাইকে বোঝাতে চেয়েছেন আপনার আদর্শগত পরিবর্তন।
মাহমুদ : কী রকম? আমার তো মনে নাই।
হক: লেখাটার নাম বোধ হয়, প্রিয় শাহরিয়ার, ওই গদ্যে আপনি আপনার  লোকলোকান্তর, কালের কলস, সোনালি কাবিন পর্ব থেকে কীভাবে মায়াবিপর্দা দুলে ওঠো পর্বে বাঁক নিলেন, এসব কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।  সেই, জেলখানায় স্বপ্ন দেখা, বুকের ওপর কোরান রাখা....
মাহমুদ: মনে পড়ে না, কিছুই। ভুলে গেছি।
আবিদ: আবু হাসান শাহরিয়ার তো তার প্রথম বই শামসুর রাহমান আর আপনাকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি তো আপনাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি খুব মেধাবী মানুষ। আপনি তার লেখার খুব প্রশংসা করতেন একসময়।
এ সময় আল মাহমুদকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। যেন কিছু  মনে করার চেষ্টা করতেছেন, অথচ মনে পড়ছে না। বারবার মাথা দোলাচ্ছিলেন। একসময় হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকালেন।
হক: আপনার পরে যারা লেখালেখিতে এসেছেন, বিশেষ করে কবিতায় তাদের মধ্যে কার কার কবিতা আপনার ভালো লাগে?
মাহমুদ: আমি তো পড়তে পারি না।
হক: যখন পড়তে পারতেন, তখন কার কার কবিতা ভালো লাগত?
মাহমুদ : এখন তো আর নামটাম মনে নাই আমার। বয়স হয়ে গেছে অনেক।
আবিদ : আপনি বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা বড় লেখা লিখবেন, মানে মুক্তযুদ্ধ আর আপনার আÍজীবনী মিলিয়ে আর কি।
মাহমুদ : এখন আর পারব না। আমি কিন্তু খুবই অসুস্থ। ডাক্তার আমাকে একদম বারণ করেছেন কথা বলতে। একদম ভয়েসরেস্ট থাকতে বলেছেন।
আবিদ : কিন্তু আপনার অনেক দিনের স্বপ্ন আপনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনি একটা বড় লেখা লিখবেন।
মাহমুদ : লিখব তো, বেঁচে থাকলে লিখব ইনশাল্লাহ।
হক: যেভাবে বেড়ে উঠি যেখানে শেষ হলো, তার পর থেকে আর কিন্তু লিখলেন না। এরপরের পর্বটা তো লেখা যায়...
মাহমুদ: যেভাবে বেড়ে উঠিÑ এটার ৪টা সংস্করণ বের হয়েছে।
হক: আমার কাছে প্রথম সংস্করণটা আছে।
আবিদ: প্রথমা থেকেও তো বইটার একটা সংস্করণ বের হলো, ওই যে গিয়াস কামাল চৌধুরীকে উৎসর্গ করলেন...তাকে আর দিতে যাইতে পারলাম না। তাকে একটা বই উৎসর্গ করলেন।
মাহমুদ : গিয়াস কামাল চৌধুরী তো আজ মারা গেলেন জানো তো? এত দুঃখ পেয়েছি। আমার জন্য এত করেছেন, আমি সেটা ভুলতে পারব না। আমি যখন জেলে ছিলাম, তখন তিনি আমার জন্য অনেক করেছেন। তার চেষ্টায়-ই আমি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছি।
আবিদ: এবার তো নোবেল পেলেন.....
হক: কানাডিয়ান লেখিকা অ্যালিস মনরো
আবিদ : ছোটগল্প লিখেছেন।
মাহমদু : বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে এখন আর আমার তেমন যোগাযোগ নাই আমার। আসলে আমি তো এখন আর চোখেও দেখি না।
আবিদ : হিটলারের দ্য মাইন্ডক্যাম্প পড়লেন কদিন আগে।
মাহমুদ : হ্যা পড়লাম। বইটা কিন্তু খুবই ভালো। একটা মানুষকে বোঝা যায়। হিটলার কিন্তু নিজেকে জারজ মনে করত। তার ধারণা ছিল, কোনো জার্মান ইহুদি তার বাবা। এই জন্যই নাকি ইহুদিদের প্রতি তার একটা বিদ্বেষ ছিল। এটাই কারণ কি না তা আমি জানি না। তবে তার মায়ের কবরে গিয়ে হিটলার ছেলে মানুষের মতো কেঁদেছিলেন। শিশুদের মতো কেঁদেছিলেন। এই বর্ণনাটা আমি ওই বইয়ে পড়ে জেনেছি। হিটলার তো এককভাবে পৃথিবীকে শাসন করতে চেয়েছিলেন।
আবিদ :  স্বৈরাচার...
মাহমুদ: স্বৈরচার না, তাকে তো ফ্যাসিস্ট বলা হতো।  অনেক হিস্ট্রি আছে, না পড়লে তো এগুলো জানা যাবে না। হিটলার নিজেকে জারজ সন্তান মনে করত, এবং একজন ইহুদিকে তার বাবা মনে করত।
আবিদ : মাহমুদ ভাই, অন্য একটা কথা। আপনারা পঞ্চাশের কবিরা, বুদ্ধদেব বসুর ছত্রছায়ায় ছিলেন, এটা খুব মনে করা হয় আর কি...
মাহমুদ: ছত্রছায়ায় না, বুদ্ধদেবের লেখা আমাকে অনুপ্রাণিত করত। তার লেখায় একটু আন্তর্জাতিক রস পাওয়া যেত। তার চিন্তাচেতনা প্রসারিত ছিল।
হক: কবিতায় না গদ্যে?
মাহমুদ: গদ্যে।
হক: কবিতায় তো মূল কাজ অনুবাদে...
মাহমুদ: তিনি তো মূলত বোদলেয়ার অনুবাদ করেছেন। তার অনুবাদ অসাধারণ। এরকম অনুবাদ বাংলাভাষায় আর নেই। কেদজ কুসুম তিনি অনুবাদ করেছিলেন।
আবিদ : বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় আপনি কবিতা পাঠিয়েছিলেন। ছাপানোর পর আপনি বলেছিলেন, ওই মুহূর্তটা আপনার জীবনের সবচেয়ে বেশি পুলক-মুহূর্ত।
মাহমুদ : আমি তিনটা কবিতা পাঠিয়েছিলাম। বুদ্ধদেব বসু আমার কবিতাগুলো পেয়ে সাদা পোস্টকার্ডে একটা চিঠি লিখেছেনÑ প্রিয় বরেষু, তোমার একটি বা দুটি কবিতা ছাপা যাবে মনে হচ্ছে। নিচে সই ছিল বুদ্ধদেব বসুর। কার্ডটা বহুদিন আমার কাছে ছিল। এখন আর নাই। তবে ওটার ছবি ছাপা আছে।
হক: পরে কয়টা কবিতা ছাপা হয়েছিল?
মাহমুদ: তিনটা। পরে দেখলাম, যখন কবিতাপত্রিকা বের হলো, তিনটাই প্রকাশিত হলো। এটা প্রথম এসে বললেন যিনি এবং পত্রিকাটা আমাকে যিনি দিলেন,  তিনি শহীদ কাদরী। তিনি তখন বিউটি রেস্টুরেন্টে বসে মুখ গোমরা করে বসে আছেন। আমি সেখানে গেলে আমার দিকে কবিতাপত্রিকা বাড়িয়ে ধরে বললেন,  দোস্তা এটা নিয়ে যাও। আমি খুব অবাক হলাম তার এমন আচরণ দেখে। পরে জেনেছিলাম, ওই দিন তার মা মারা গেছেন। তিনি শুধু আমাকে কবিতাপত্রিকা দেওয়ার জন্য ওখানে অপেক্ষা করছিলেন।
আবিদ : মাহমুদ ভাই রবীন্দ্রনাথের প্রতি আপনার তো খুব মুগ্ধতা
মাহমুদ: আমার প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ না পড়লে কেউ বুঝতে পারবে না।
হক: রবীন্দ্রনাথ প্রিয় কবি হয়ে ওঠার কারণ কি তাঁর কবিতায় আধ্যাÍসংকটের প্রাচুর্য?
মাহমুদ : তা তো আছেই। এছাড়া, সত্যি কথা বলতে কী, ছন্দের যে মিল, মিল যে কত রকমের হতে পারে এটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। আর রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করার মতো খুব একটা দোষ কিন্তু পাওয়া যাবে না। আমি বলছি না যে, রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা হয় না, নিশ্চয় হয়। আপনি যদি রবীন্দ্রনাথকে পড়েন, তাহলে আপনি, আমার তো মনে হয় যে, মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না।
আবিদ : নজরুলকে দেখেছেন?
মাহমুদ : হ্যাঁ দেখেছি। শেষ সময়। আমি আর শামসুর রাহমান একসঙ্গে গিয়েছিলাম। আমার মনে আছে, আমার চোখে কোনো চশমা ছিল না, শামসুর রাহমানের চোখে ছিল। এটা দেখে কবি খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তখন নজরুলের ছেলে এসে বললেন, চশমা খুলে ফেলেন, বাবা চশমা পরা দেখলে অসন্তুষ্ট হন। এর কারণ কী ছিল তা আমি জানি না। কী কারণে তিনি চশমাধারী লোকদের দেখতে পারতেন না তা আমি  জানি না।
এসময় আল মাহমুদ নিজের মুখম-লে বারবার হাত বোলাতে থাকেন। একই কথা বারবার বলতে থাকেন। নজরুল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তাঁর কথাগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল।
হক : জসীমউদদীনের সঙ্গে আপনার যোগাযোগটা কেমন ছিল?
মাহমুদ : ভালো।
হক: তাকে নিয়ে তো আপনার একাধিক লেখা আছে।
মাহমুদ : না, একটা
হক: আমার জানা মতে দুটা। কবির আÍবিশ্বাস বইতে একটা আছে। যেখানে কবির আÍবিশ্বাস ও অহঙ্কারের বিষয়টা বলেছেন। ওই যে কেউ তাকে দাওয়াত দিতে এলে তিনি নিজের সঙ্গে তার পরিবারের জন্যও যাতায়াত টিকিট চাইতেন...
মাহমুদ : হ্যাঁ। একবার আমিও ছিলাম। কোলকাতা থেকে ওরা এসেছে দাওয়াত দিতে। উনি সব শর্ত দিচ্ছেন, ওরা সব বিষয়ে কেবল জে, আজ্ঞে বলছে। কবি বলছেন, আমি প্লেনে যাব। ওরা বলছে, জে আজ্ঞে। কবি বলছেন, আমাকে বিমানবন্দর থেকে প্রেমেন মিত্র রিসিভ করতে হবে। ওরা বলছে জে আজ্ঞে।
আবিদ : যে লোক দাওয়াত দিতে এসেছিলেন, তিনি কি কবিকে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে গেলেন?
মাহমুদ : এখন আর মনে নাই।
হক: শক্তিচট্টপাধ্যায়ের সঙ্গে তো বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল আপনার।
মাহমুদ : তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। শক্তি মানুষ তেমন ভালো না হলেও তার বউ খুব ভালো ছিলেন, এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।
হক: বুদ্ধদেবের সঙ্গে আপানার কখন দেখা হলো?
মাহমুদ : আমি তখন কলকাতায়। একবার শুনলাম তিনি আসবেন। আমরা যেখানে থাকি তার পাশে। বুদ্ধেদেবের জামাই আমাকে জানালেন। অবশ্যই যে বাসায় তিনি এসেছিলেন, সেখানে আমি নিমন্ত্রিত ছিলাম না। সে যাই হোক, কবির জামার সঙ্গে গিয়ে কবিকে পা ছুয়ে সালামটালাম করলাম। তিনি আমার নাম শুনে বললেন, ও তুমি আল মাহমুদ! তোমার লেখা তো আমি ছেপেছি।  আমি বললাম, জি। আমি ওখানে থাকলাম না। চলে এলাম।
হক: ওই ঘটনাকে মনে রেখে একটা কবিতা লিখেছেন, বুদ্ধদেব বসুর সাক্ষাৎকার নামে।
আবিদ : আমাদের সাহিত্য আলোচনায় ফররুখ আহমদের নাম কেউ নেন না। এর কারণ কী মাহমুদ ভাই?
মাহমুদ :ওই আর কি, উনার কবিতায় ইসলাম ভাবসাব বেশি এজন্য। তিনি পুথি সাহিত্য থেকে তার কবিতার বিষয় নিয়েছেন। এটা এখানে গ্রহণ করছে না আর। তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারার একজন কবি।
হক: আমার মনে হয় ফররুখ আহমেদকে নিয়ে আলোচনা করতে না চাওয়ার কারণ, তার কবিতায় বাংলাদেশের পরিবেশ বেশি পাওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্য, মশলার দ্বিপ পাওয়া যায়...
মাহমুদ : এই অভিযোগ সত্য না। তিনি তো পুথির জগতে থাকছেন। পুথি তো বাংলাদেশের সৃষ্টি।
হক: আপনি একবার বলেছিলেন, কবির একটা নির্দিষ্ট ভূখ- থাকা দরকার।
মাহমুদ : কবির একটা দেশ থাকা দরকার। একবার লিখেছিলাম, আমি এখনও সেটা বিশ্বাস করি।
হক: আপনার লোকলোকান্তর, কালের কলস, সোনালিকাবিন এর পর বিরাট পরিবর্তন আসে মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো পর্বে। এরপর দ্বিতীয় ভাঙন পর্বে। কিন্তু আপনি যতই বিষয় আর আঙ্গিকের পরিবর্তন ঘটান না কেন, সব পর্বের কবিতায়ই ছন্দযুক্ত। কোথাও আপনি ছন্দ বর্জন করেননি। ছন্দের নিয়মকানুন মেনে চলেছেন।
মাহমুদ : ছন্দ ছাড়া তো কবিতা হয় না।
হক: এখন যারা লিখতে আসছে, তারা তো ছন্দ না মানার স্লোগান দিচ্ছে...
মাহমুদ:  সেটা হয়, ছন্দ ছাড়া কবিতা? হাহাহহাহাহা। ওরা কী বলতে চায়?
হক: ওরা বলতে চায়, ওরা ছন্দ মানছে না, ছন্দ ভাঙছে...
মাহমুদ : কী ভাঙছে, ‘সবাই বলে ভাঙো ভাঙো, কেউ কি কিছু ভাঙে/ ষাটের দশক বগল বাজায় বউ নিয়ে যায় লাঙে।’ আমিই তো লিখেছি। সবাই বলে ভাঙো ভাঙো, কী ভাঙে তারা? ভাঙতে পারছে কই?
হক: আপনি একবার বলেছিলেন, কবিদের এখন গদ্য লেখার যুগ
মাহমুদ : হ্যা, দেখেন সব কবিই ভালো গদ্য লিখেছেন। জসীমউদদীনের গদ্য পড়েছেন? অসাধারণ গদ্য।
হক: বুদ্ধদেব বসুর গদ্যও
মাহমুদ: আমাদেরও।
হক: আপনার পরে জেনারেশনের আবদুল মান্নান সৈয়দ...
মাহমুদ: মান্নানও গদ্য লিখেছেন। আমি তো প্রবন্ধ ছাড়া, উপন্যাস-ছোটগল্পও লিখেছি। আমার গল্পের বই দুই খ- বেরিয়েছে। আমি নিজেই অবাক যে, এত লেখা আমি লিখলাম কখন?
আবিদ: মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এসে আপনি গল্পে লিখতে শুরু করলেন...
মাহমুদ: আমি তো সময় এখন ভাগ করতে পারি না। কবিতা লেখার একটা উত্তেজনা আছে কিন্তু। গদ্যে সেটা নাই। গদ্যে তো স্থির মস্তিষ্ক লাগে, গদ্যে যুক্তি দেখাতে হয়। কিন্তু কবিতা তো যুক্তি মানে না। কবিতা আবেগের তৈরি। মানুষের অন্তরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কবিতা। কবিতা যুক্তি মানে না।
আবিদ: একটা মজার ব্যাপার হলো, আপনার কবিতার মতো, আপনার গদ্যভাষাও আপনার নিজস্ব।
মাহমুদ : প্রকৃত লেখক সবসময় নতুন ভাষা সৃষ্টি করে।
হক: প্রকৃত লেখক স্বসৃষ্টভাষায় লেখেন, অন্যের ভাষায় নয়। 
মাহমুদ : যাই হোক, আপনার নাম কী যেন বললেন?
হক: মোহাম্মদ নূরুল হক।
মাহমুদ: আপনি এখন কোথায় আছেন?
হক: আমাদের সময়ে।
মাহমুদ : নিউজ এডিটর?
হক: হ্যা।
মাহমুদ : ভালো। খুব ভালো।
আবিদ: মাহমুদ ভাই, পত্রিকাটির সম্পাদক হলেন, কবি আবু হাসান শাহরিয়ার।
মাহমুদ: ও তো খুব মেধাবী।
আবিদ : আপনি হক ভাইকে চেনে না, কিন্তু তিনি আপনাকে নিয়ে অনেক লিখেছেন।
মাহমুদ: সমকালের কালের খেয়ায় দেখলাম, ওরা জীবনানন্দ, সুনীল, শাসুর রাহমানকে নিয়ে সংখ্যা করেছে। ওই তিনজনকে আলাদা সংখ্যা করার মানে বুঝলাম না। হাহাহাহা
হক: মাহমুদ ভাই, ওটা কবিত্ব শক্তির বিচারে নয়, ওই কবির জš§মৃত্যু তারিখ অক্টোরের ১৫, ২৩Ñ এই দুদিনে। তাই ওরা হয়তো একসঙ্গে তিন জনকে স্মরণ করেছে।
মাহমুদ: ও, আচ্ছা, আচ্ছা। একটা রেডিও থেকে আমার কাছে এসেছিল, শামসুর রাহমান সম্পর্কে আমার কমেন্ট নিতে। আমি বলেছি তার সম্পর্কে।
হক: আপনি তো শামসুর রাহমানকে নিয়ে একটা প্রশ্বস্তিমূলক গদ্যও লিখেছেন আপনার যৌবনে।
মাহমুদ: ঠিক বলেছ। ওই প্রবন্ধের কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। বাইরের লোক মনে করত আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। খুব মধুর ছিল। আপনি দেখছি, অনেক জানেন।
আবিদ: তরুণদের মধ্যে হক ভাই কিন্তু অনেক পরিশ্রমী। পরিশ্রম করে প্রবন্ধ লেখেন। আবদুল মান্নান সৈয়দের পরে তো তেমন প্রবন্ধে কেউ নাই। এখন দেখা যাক, হক ভাই যদি একটু পরিশ্রম করে, যতœ করে কাজ করেন, তাহলে
হক: আমার দুটা কবিতার আছে। গদ্য লেখার কারণে কেউ আর আমাকে কবি বলে না।
মাহমুদ: হাহাহাহাহাহাহাহ
আবিদ: মান্নান সৈয়দেরও একই সমস্যা ছিল। গদ্য লেখার কারণে শেষ দিকে লোকজন তাকে আর কবি বলত না।
মাহমুদ: আমি আপনাকে কবি বলব। যার দুটা কবিতার বই আছে, সে কবি না হয়ে যায় না। হাহাহা।
এসময় কবি ও আমার একটা ছবি তুললেন আবিদ আজম। কবি আমার কাঁদের ওপর হাত রেখে বললেন, দাও আমাদের ছবি তুলে দাও। আল মাহমুদ একই কথা বারবার বলতে থাকেন। দশ মিনিট আগে কী বলেছেন, দশমিনিট পরে মনে রাখতে পারেন না। একারণে কিছুক্ষণ পরপরই একই কথা বলতে থাকেন। এক ঘণ্টার আড্ডায় আল মাহমুদ আমার জিজ্ঞাসা করেছেন তিন/চার বার। কখনো আপনি, কখনো তুমি করে সম্বোধন করেছেন। স্বাভাবিক কথায়, আচরণে কবি খেই হারিয়ে ফেলেন বারবার। কিন্তু মুখে মুখে কবিতাসৃষ্টির সময় তাঁর পঙক্তিবিন্যাসের ধারাবাহিকতা সাধারণত কোনও ব্যঘাত ঘটে না। দীর্ঘক্ষণ কথা বলার কারণে হয়তো, কবিকে খুব কান্ত দেখাচ্ছিল। এদিকে আবিদ আজমও আমাকে ইশারা দিচ্ছেন, আমাদের দুজনেরও অফিসে যাওয়ার সময় প্রায় ঘনিয়ে এলো। আবিদ বলল, মাহমুদ ভাই, আপনার সঙ্গে অনেক কথা হলো, আজ তাহলে আসি? কবি আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে, তুমি আবারও আসবে। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম আর আবিদ জানালো আমার মনের কথাÑ হক ভাই তো প্রায় আসতে চান, কিন্তু সময় হয় না তার। আমি বললাম, আবার আসব, আজ আসি। আমাদের সময়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

শনিবার, ৫ জুলাই, ২০১৪

মেটাফর ।। বীরেন মুখার্জী

Biren Mukherjee



ম্রিয়মাণ আলোয় ভেঙে গেলে নিঃশব্দ প্রতিচ্ছবি
উপাসনালয়ের নির্জনতা খুন হয় পবিত্র ব্যাৎসায়নে;
যারা আজও নিজেদের মানুষ দাবি করে, তাদের
কর্ণিয়া ঘিরে লাল পিঁপড়ের দল উত্তুঙ্গ নাচে আর
পাহাড়সমেত ভরসন্ধ্যা উড়ে যায় মেঘের শাসনে।

মিছিলফেরত মানুষ ছিল নদী-নির্মাতা, বনস্পতি ভূমে
পবিত্র যোগফল খোদাই করে গড়েছে সভ্যতার বন্দর
এখন তালুতে বন্দি মরুমুদ্রা
প্রান্তবাসী তবু খোঁপায় গোঁজে নদীভ্রমণের রূপকথা!

মিছিলফেরত মানুষ এখন বসন্তের অথর্ব পুরোহিত
অবগাহনে খোঁজে মরুজল!

বুধবার, ২ জুলাই, ২০১৪

আষাঢ়ের পংক্তিমালা ।। চাণক্য বাড়ৈ


শেষ বিকেলের রোদ নিস্তরঙ্গ হলে তুমি বিছানায় যাও এবং আর সকলের মতো তোমারও রয়েছে এক নিজস্ব চিল, যাকে আকাশে ওড়াতে তোমার সামান্য সময় নিতে হয়।
নদীতে ভাসমান নৌকোটাকে পুরোটা দেখা যাচ্ছিল না বলে কিছুটা কৌতূহলী হয়ে দেখলে বাড়ির পেছনের রাধাচূড়া গাছটি কবে কবে যেন বড় হয়ে গেছে-- গত আষাঢ়ে যার চারা লাগাতে গিয়ে কালিদাস আওড়াচ্ছিলে। আর সেদিন বিশুদ্ধ বর্ষায় ভেজা তোমার কুমারী শরীর দেখে যে কাঠবিড়ালীটি সঙ্গমলিপ্সু হয়েছিল, তাকে আজ মতিদের বিড়ালে খেয়েছে।
আর আজই ধূলোমলিন গোধুলির প্রাক্কালে যে চিলটি ওড়ালে, সেও বিরুদ্ধ বাতাস কেটে কেটে একদিন ঠিকই মেঘেদের কাছে পৌঁছোবে। আর জ্যৈষ্ঠের মরাচাঁদ পুনরায় রজঃস্বলা হলে তোমার হাতে পৌঁছে দেবে একটি হাতচিঠি। অথচ লাটাইয়ের প্রতি তোমার সীমাহীন বৈরাগ্য দেখে অবাক হতে হয় !
আসছে আষাঢ়ে তুমি কোন ছুতোয় বৃষ্টিতে ভিজবে ?

মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০১৪

আহমদ ছফার বাঙালি দর্শন ।। মোহাম্মদ নূরুল হক

বাঙালিচিন্তকের সমস্যা দুদিকে। একদিকে সমাজ বোঝার, অন্যদিকে নিজের অনুভূতি-উপলব্ধি-অভিজ্ঞতা অন্যকে বোঝানোর। এই বোঝা-বোঝানোর ব্যাপারটা নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর। এক. সভাসেমিনারে বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া দুই. প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গদ্য রচনা। এই প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গদ্য রচনারও রয়েছে নানা ধরন, নানা ধাঁচ। একদল লেখেন, অতি দরকারি প্রবন্ধ। অন্যদল লেখেন, আপাত দৃষ্টিতে বেদরকারি গদ্য। দরকারি প্রবন্ধ লেখকেরা মূলত কর্মী, সমাজ তাঁদের কাজের সরাসরি উপকারভোগী। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাকর্ম থেকে শুরু করে, মাঠজরিপের ফলপ্রকাশ___ সবই তাদের প্রবন্ধের বিষয়-আশয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক থেকে শুরু করে, সমাজকর্মী-স্থানীয় তহশিলদার___ সবার কাছেই সমান কদর ওই সব রচনার। বিপরীতে আপাত-বেদরকারি গদ্যলেখকেরা লেখেন মনের আবেগে, প্রজ্ঞার শাসনে। তাদের গদ্য তাৎক্ষণিক সমাজের কোনো কাজে আসে না। দরকারি প্রবন্ধের রচয়িতারা কর্মী হলে আপাত-বেদরকারি গদ্যের লেখকেরা শব্দশ্রমিকের পাশাপাশি শিল্পীও। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার___ কর্মীরা পারিশ্রমিকেই তুষ্ট; শিল্পী চান সম্মানি-সম্মান___ দুটোই। এ জন্য শিল্পীকে অপেক্ষা করতে হয়। পরিচয় দিতে হয় পরম ধর্য্যরে। কর্মী-শিল্পীর পার্থক্য এখানেই সুস্পষ্ট। আহমদ ছফা সম্পর্কে একবাক্যে বলতে গেলে তাকে এই আপাত-বেদরকারি গদ্যলেখকের দলেই বিবেচনা করতে হয়।
আহমদ ছফার লেখালেখির ভুবন সর্বত্রগামী না হলেও বিচিত্রমুখী। লিখেছেন কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও  ছোটগল্প। অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অনুবাদ করেছেন গ্যাটের ‘ফাউস্ট’। তবে এসবের ভেতর সবচেয়ে উজ্জ্বল পরিচয় বোধ করি তাঁর সমাজচিন্তক সত্তা। ছফা বাঙালির মানস-সংকট, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় পরিচয়ের ভেতর জাতীয় পরিচয়ের উৎস সন্ধান করেছেন। কিন্তু এ সন্ধান প্রাতিষ্ঠানিক অভিসন্ধর্ভের ধাঁছে নয়। করেছেন একান্ত বেদরকারি-গদ্যলেখকের মতোই___ আপন মনের খেয়ালে, আপনার মতো করে। এক্ষেত্রে ছফা গবেষক নন, পর্যবেক্ষক। পর্যবেক্ষণদৃষ্টি তীক্ষ্ম, উপলব্ধি স্বচ্ছ। তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গদ্যের বিষয় যেমন সমকালীন অন্য লেখকদের চেয়ে ভিন্ন, তেমনি তার উপস্থাপনকৌশলও। ছফা বাঙালির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য-স্বভাব শনাক্তিসহ সবিস্তারে আলোচনা করেছেন ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ও ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শীর্ষক দুটি বইয়ে।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালিচিন্তকদের সম্পর্কে রূঢ়সব মন্তব্য করেছেন। অবশ্যই এসব মন্তব্যের শক্ত ভিতও রয়েছে। সাত চল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ___ দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আত্মবিক্রয়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কীভাবে পুরস্কার-পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তার তথ্য-উপাত্তও সাধ্যমতো উপস্থাপন করেছেন। একইসঙ্গে তাঁর মন্তব্যসহ ব্যাখ্যা করেছেন পরিস্থিতি। লেখাটি শুরু করেছেন নেতিবাচক পর্যবেক্ষণলব্ধ মন্তব্যসহ। লিখেছেন___ ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।’ বুদ্ধিজীবীরা সত্যা-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দের নিরিখে কখনো ভূমিকা পালন করেন না। তাঁরা মূলত সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন, সমাজের কল্যাণসাধনের জন্য নয়, নিজেদের আখের গোছাতে। ফলে তাঁরা যখন কোনো পক্ষাবলম্বন করেন, তখন যেমন তাঁদের কোনো পূর্বপরিকল্পনা থাকে না, তেমনি পক্ষত্যাগকালেও থাকে না। ছফার মতে, ‘আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়___প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন___সেও ঠেলায় পড়ে।’ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁদের চরিত্রও পাল্টায়। তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-বিশ্বাস নেই। একারণে তিনি বুদ্ধিজীবীদেরকে সুবিধাবাদী হিসেবেই বিচার করেছেন তিনি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের আগে-দেশস্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশ্বস্তি,  স্বৈরশাসকের জীবনী  অনুবাদ___ এসব বিষয়কে ছফা দেখেছেন লেখকদের মেরুদ-হীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষাৎ-পূর্বমুহূর্তে লেখকসমাজের নিষ্ক্রিয়তা-যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা, ভারতে পালিয়ে বেড়ানো, ভোগবিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ছফা তুলে ধরেছেন, স্বাধীনতাপূর্ববর্তী বাংলাদেশের লেখকসমাজ কী পরিমাণ অপরিণামদর্শী-অদূরদর্শী ছিলেন। তাঁরা একটি দেশের পটপরিবর্তনের আভাষটুকুও উপলব্ধি করতে পারেন না। এই লেখকসমাজ নিজেরাই অনুভব করতে পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে___ তাই জাতিকে সতর্ক করারও প্রয়োজন তাঁরা অনুভব করেননি। তাঁরা কেবল যা ঘটে তারই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকারী। যা ঘটতে যাচ্ছিল, তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তাঁদের কল্পনায়ও ধরা দেয় না সম্ভাব্য-ভবিষ্যৎ। তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে ছফার মূল্যায়ন দ্ব্যর্থহীন___ ‘বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কিছু কিছু পোশাকি ভূমিকা পালন করেছেন।’ বাঙালিচিন্তক-লেখকদের চরিত্রে দ্বিমুখিনতা ছফা খোলাসা করেছেন উদাহরণ-ব্যাখ্যাসহ। সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ‘প্রয়োজনে-ঠেলায়’ পড়ে বিশেষ বিশেষ ঘটনার আগে যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দেন, ঘটনার পরে লেখেন তার উল্টো কাসুন্দি। ফলে তাদের কোনো চিন্তা-কর্ম-উপদেশ সমাজের বিশেষ কোনো কাজে আসে না। কারণ এই বুদ্ধিজীবীরা সমাজকে কোনো নতুন কিছু উপহার দেওয়া দূরের কথা, আসন্ন বিপদ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগাম খবরটুকুও দিতে ব্যর্থ হন। সফল হবেন কী করে___ তাঁরা তো সমাজমঙ্গল নিয়ে কোনো চিন্তা করেন না, কাজ করেন না মানুষের কল্যাণে। যেটুকু করেন, সেটুকু কেবল নিজের স্বার্থে।
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অতীত-আসক্তি ভয়ানক রকমে উপস্থিত। তাই অতীতের তুচ্ছ বিষয়গুলোর মোহে এতই অন্ধ থাকেন যে, সামনের দিনগুলো সম্পর্কে ধারণা করতে পর্যন্ত পারেন না। তাঁদের বতর্মান থাকে আপসকামিতায় আকীর্ণ। অর্থাৎ তাঁদের উপস্থিতকাল কাটে ক্ষমতাবানদের স্তুতি, পুরস্কার-পদক গ্রহণে। আহমদ ছফা এই জাতীয় বুদ্ধিজীবীর চারিত্র্যিক স্খলন-খোলনলচে বদলানোর স্বভাব ব্যাখ্যা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। পাশাপাশি বলেছেন, দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণ ভেতর থেকে জেগে উঠেছে। দেশমাতৃকার সংকটকালে জনগণ-জনযোদ্ধারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাতে বুদ্ধিজীবীদের কোনো কার্যকর ভূমিকা ছিল না।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ আর ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। প্রায় একদশক পর প্রকাশিত বইয়েও ছফার মূল আক্রমণের শিকার বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণীর বাঙালি। বাঙালি লেখক-কবিরা কীভাবে যুক্তিহীন আবেগে ভেসে গেছেন, জনগণের সঙ্গে কীভাবে সুক্ষ্ম প্রতারণা করেছেন, তারই ব্যাখ্যা দিয়েছেন ছফা। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শুরুই হয়েছে পুঁথিসাহিত্যের প্রসঙ্গ দিয়ে। ছফা পুঁথিকারদের মনের ভেতর দিয়ে সৃজনশীল বাঙালিকে চেনার চেষ্টা করেছেন। দেখিয়েছেন বাঙালি মুসলমান মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দুর উত্তরাধিকারী। উচ্চবর্ণের স্বধর্মীয়দের অত্যাচার নিপীড়ন থেকে বাঁচতে যারা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, তারাই আজকের বাঙালি মুসলমান। ছফার মতে, বাঙালি মুসলমানের আদৌ কোনও গৌরবজনক অতীত নেই। ছিল না কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে প্রভাববিস্তারী অতীত-ভূমিকাও। তারা প্রথমে ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু, পরে শ্রমিকশ্রেণীর-কৃষিজীবীশ্রেণীর মুসলমান। মূলত উৎপাদনেই তাদের সময় কেটেছে, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী কোনো কাজ কিংবা পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির ক্ষেত্রে আন্দোলনে তেমন কোনো আধিপত্য ছিল না। ছফা দেখিয়েছেন কীভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হওয়ার পর অতীতের নিপীড়িত জীবনস্মৃতি মনে রেখে, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিশোধ নেয় পুঁথি রচনা করে। তাদের রচিত পুঁথির পটভূমি চরিত্র সবই আরবের, কিন্তু ধর্ম-সংস্কৃতি বাংলার। বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য ছফার___ ‘মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো হয়তো চর্বিতচর্বণ, নয়তো ধর্মীয় পুনর্জাগরণ। এর বাইরে চিন্তা, যুক্তি এবং মনীষার সাহায্যে সামাজিক ডগ্মা বা বদ্ধমতসমূহের অসারতা প্রমাণ করেছেন তেমন লেখক-কবি মুসলমান সমাজে আসেননি। বাঙালী মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসা ভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সঙ্কুচিত। বাঙালী মুসলমানের মন এখনো একেবারে অপরিণত, সবচেয়ে মজার কথা এ-কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না। যেহেতু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রসারমান যান্ত্রিক কৃৎকৌশল স্বাভাবিকভাবে বিকাশলাভ করছে এবং তার একাংশ সুফলগুলোও ভোগ করছে, ফলে তার অবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এঁচড়েপাকা শিশুর মতো। অনেক কিছুরই সে সংবাদ জানে, কিন্তু কোনো কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপন করতে জানে না। যখনই কোনো ব্যবস্থার মধ্যে  কোনোরকম অসংগতি দেখা দেয়, গোঁজামিল দিয়েই আনন্দ পায় এবং এই গোঁজামিল দিতে পারাটাকে রীতিমত প্রতিভাবানের কর্ম বলে মনে করে। শিশুর মতো যা কিছু হাতের কাছে, চোখের সামনে আসে, তাই নিয়েই সে সন্তুষ্ট। দূরদর্শিতা তার একেবারেই নেই, কেননা একমাত্র চিন্তাশীল মনই আগামীকাল কি ঘটবে সে বিষয়ে চিন্তা করতে জানে। বাঙালী মুসলমান বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেই জানে না এবং জানে না এই কথাটি ঢেকে রাখার যাবতীয় প্রয়াসকে তার কৃষ্টি-কালচার বলে পরিচিত করতে কুণ্ঠিত হয় না।’  কথাগুলো কেবল বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে যে খাটি তা নয়, একই সঙ্গে সমগ্র বাঙালির জন্যও প্রযোজন্য। ছফা বাঙালি মুসলমানকে আঘাত কওে জাগিয়ে তুলতেছিলেন। তাই কেবল বাঙালি মসুলমান সমাজের ত্রুটি-সীমাবদ্ধতা, অজ্ঞতা-মূর্খতাকে কাঁক্ষ করেছেন। কিন্তু সাধারণ চোখে যদি সমগ্র বাঙালি সমাজকে দেখি, তাহলে কী দেখি? দেখি___ পুরোসমাজটাই সবজান্তার ভান করে বসে আছে। এ সমাজে যে কিছুই জানে না সে এবং যে অনেক কিছু জানে সে___ এই দুই-ই প্রায় একই রকম। দুজনকেই অল্পজানা লোকেরা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফলে সমাজে ও মননশীলতার অঞ্চলে ব্যপক সংঘর্ষ বাধে। তবে এ সংঘর্ষ থাকে প্রচ্ছন্ন। সমাজে যা কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তার জন্য ষোলো আনা দায়ী সবজান্তারা। এই সবজান্তার ভান কেবল বাঙালি মুসলমানই করে তা নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও সমানে-সমান এ ক্ষেত্রে। ছফার বাঙালি দর্শন তাই এত বিচিত্র, এত যৌক্তিক।   
বাঙালির জীবনসংগ্রামের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, বিপ্লবের কথা যেমন উৎপাদনব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সন্ধি-অভিসন্ধি, শিক্ষাব্যবস্থার বহুমাত্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন, ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’, ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’, ‘বাংলা ভাষা : রাজনীতির আলোকে’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘রাজনীতির লেখা’, ‘সঙ্কটের নানা চেহারা’, ‘শান্তিচুক্তি’ ‘বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র’ প্রভৃতি প্রবন্ধ ও বইগুলোয়। এর মধ্যে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ যতটা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কিত, ঠিক ততটা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারও নির্যাস। নিজের উচ্চশিক্ষাবিমুখের কারণ এবং এ ঘটনার সঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাকের প্রভাব সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এ কারণে বইটি হয়ে উঠেছে একই সঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাকের মূল্যায়ণ ও ছফার নানা অনুষঙ্গের বিবরণ। 
‘শতবর্ষের ফেরারী : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ আপত-সমালোচনামূলক মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। এই বইয়ে ছফা বঙ্কিমসমালোচনায় একনিষ্ট নন, নিন্দায় আকীর্ণ। তিনি গড়পরতা বাঙালির কাতারে ফেলেই বঙ্কিমকেও বিচার করেছেন। ফলে বঙ্কিমের সামাজিক অবস্থান, মুসলমানদের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবের কারণ অনুসন্ধান করেননি। ‘বাঙালি মুসলমান মন’ যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে, যে দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখেছেন, একই মনোভাব নিয়ে বঙ্কিম মূল্যায়ণও করেছেন। ফলে বিচারটা হয়ে পড়েছে একপেশে।   
বাঙালির বুদ্ধিজীবীদের অর্থলোলুপ স্বভাব এবং সাধারণ নাগরিকের হুজুগে বৈশিষ্ট্যকে কটাক্ষ করেছেন। বাদ দেননি সামাজিক বিকার-মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টিও। আহমদ ছফা বোধ করি জানতেন___ বাঙালি দুর্লভকে লাভ করার সাধনা তেমন করে না। তাই সহজে কোনো দুর্লভ কিছু পেয়ে গেলেও ওই মহার্ঘ বস্তুকে তখন কেবল খাটো করেই দেখে। সহজে পায় বলে কদর করে না সে। অর্থাৎ বাঙালির জন্য সেই পুরনো বাণীই সত্য___ ‘বানরের গলে দিলে মুক্তার হার / ফল ভেবে দাঁতে কেটে করে চুরমার।’ তাই বিবেকবান মাত্রই গুণাগুণ বিবেচনায় বস্তুকে উপযুক্ত স্থানেই রাখেন। বস্তুর যেমন স্থানিকগুরুত্ব রয়েছে, তেমনি মানুষেরও। ব্যক্তিকে তার মেধা, প্রতিভা, কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সমাজ-আসন নির্বাচন করতে হয়। নিজের চেয়ে নীচুস্তরের সমাজ মূল্য বোঝে না, উঁচুতলায় দেয় না যথার্থ সম্মান। অর্থাৎ যস্মিন দেশে যদাচার নীতি মেনে চলাই উত্তম। এ থেকে সহজ সমীকরণ করা যেতে পারে___ যে সমাজে গুণীর কদর জানে না, সেখানে গুণীকে সহজলভ্য করা মহাপাপ। বাঙালি মুসলমানেরও মূল সমস্যা এখানে। তারা নিম্নবর্ণের নিন্দুদের সঙ্গে মিশতে পারেনি, উচ্চবর্ণ তাদের গ্রহণ করেনি কোনোকালেই। সঙ্গতকারণে পুরো সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি। বাঙালির এই চরিত্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ছফা। প্রকাশও করেছেন সরাসরি, কোনো ভণিতা ছাড়াই।
আহমদ ছফার গদ্যভাষা নিরুত্তাপ নয়। পরন্তু অনেকটা রাগী; কিছুটা ঝাঁঝালো। বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভাষার মেজাজ নির্মাণ করেছেন তিনি। কবিতার মতোই আবেগের সংহতি তাঁর গদ্যের অলঙ্কার হতে পারত। কিন্তু হয়নি যে, তার কারণ ছফার মনে যে কথার উদয় যেভাবে হয়েছে, ঠিক ঠিক সেভাবেই প্রকাশ করেছেন। ফলে কোনো ঘষামাজা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁর গদ্যের ভাষা প্রবহমান নদীর মতো, কোথাও হোঁচট খায় না। কিন্তু সময়-স্থান বুঝে যে, একটু খানি বিরতি দিয়ে, চলার বেগের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটিয়ে চিন্তার বিস্তৃতি ঘটানো___ তাঁর গদ্যের কোথাও এর দেখা মেলে না। 
এরপরও সত্য___ছফা বাঙালির সদর-অন্দরের খবর রপ্ত করেছেন উত্তমরূপেই। প্রকাশ করেছেন, এ জাতির মনের কথা, তার পোশাকি শৈলি, অন্তরের দুর্বলতা, আবেগের তীব্রতা, কল্পনার সীমাহীনতা, বুদ্ধির বন্ধ্যাত্ব ও জ্ঞানের সংকীর্ণতা। বাঙালি মুসলমানের মন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাধারণের চেয়ে পুঁথিলেখকদের মানসিকতা পর্যবেক্ষণ করেছেন তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। একই সঙ্গে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুনবিন্যাস’-এ যতটা না সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও যুদ্ধশেষে বুদ্ধিজীবীদের দায়দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তারও বেশি সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকাও পর্যবেক্ষণ করেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়ে ব্যাপার হলো___আহমদ ছফা  মেরুদণ্ডসম্পন্ন বাঙালি বলতে মূলত বুঝেছেন, চাষাভূষাকেই, আর বাঙালি মুসলমান বলতে চিনেছেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিতদের। যারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।